কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ বসে থাকে। বাইরে রাতের নিস্তব্ধতায় নানা গ্রামীণ শব্দ। দূরে মেঘ ডাকল। বৃষ্টি হবে।
তৃষা দীপনাথের দিকেই একদাষ্টে চেয়ে ছিল। হঠাৎ স্তব্ধতা ভেঙে সে-ই প্রথম বলল, কেউ যদি মরতে চায় তাহলে কী করে ঠেকাব বলো?
দীপনাথ বিরক্ত ছিল। গলার স্বরে একটু রূঢ়তা চলে এল। সে বলল, ওটা কথা নয় বউদি, ওটা কথার চালাকি। তোমার কাছ থেকে এ ধরনের কথা আনএক্সপেকটেড। যে বুক দিয়ে আগলে অসীম মমতায় বড়দার সম্পত্তি আগলাচ্ছে, কারবার বাড়াচ্ছে, এত দায়-দায়িত্ব পালছে, সে কেন। দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলবে?
কথার রূঢ়তা তৃষার দুই গালে চড় কষায়। ভীষণ অপমান বোধ করে সে। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ এ ধরনের কথা বললে সে সহ্য করত না। কিন্তু এ যে দীপনাথ। এই একজন মানুষ যার সামনে তার হৃদয় দ্রব হয়, গাঢ় হয়। দীপনাথের প্রতি তার এক অন্ধ স্নেহ।
তৃষা বড় শ্বাস ফেলে বলল, তুমি বোধ হয় ভাবছ, বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে মেতে আছি বলেই তোমার দাদাকে দেখার সময় পাই না!
ঠিক তা বলছি না।
তাই বলছ গো।
বলে তৃষা ম্লান হাসল। আজকাল তার মনে কোনও আবেগ ওঠে না, বিরহ জাগে না, প্রেম নেই। আছে কঠিন সব সমস্যার সমাধান, হিসেব-নিকেশ, দেনা-পাওনা। কিন্তু আজ হঠাৎ একটু দুলছে মনটা। সে দীপনাথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলে, কথাটা মিথ্যেও তো নয়। বহুকাল তোমার মেজদার শরীরের খবর আমি জানি না। ওর অবশ্য এমনিতে অসুখ-বিসুখ কিছু নেই। কিছু হলে বলবেও না।
মেজদার বয়স চল্লিশের কোঠায় পড়ল না!
হবে বোধ হয়।
এইবেলা চেকআপগুলো করিয়ে নাও না কেন?
তোমাকে একটা কথা বলব?
বলো।
এসেছই যখন দয়া করে এখন ওগুলোর ভার তুমিই নাও না!
আমি তো কাল সকালেই কেটে পড়ব।
আর-একটা দিন থাকো। ডাক্তার আনানোর ব্যবস্থা আমিই করাব। তুমি শুধু তোমার দাদাকে রাজি করাবে।
দীপনাথ একটু চিন্তা করে বলে, অফিসের বুড়ি একবার ছুঁয়ে আসতেই হবে। তারপর যদি হয়–
তাই হবে। এখান থেকে অনেকে কলকাতায় অফিস করে। তুমিও পারবে।
এখানে কি ভাল ডাক্তার আছে?
আছে, তবু আমি এখানকার ডাক্তার ডাকব না। সরিৎ কাল সকালে গিয়ে কলকাতা থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে আসবে।
তাতে অনেক খরচ। তার চেয়ে মেজদাকে নিয়ে গেলেই তো হয়। মেজদা তো আর শয্যাশায়ী রুগি নয়!
ও কি যেতে চাইবে ডাক্তারের কাছে?
দীপনাথ হেসে ফেলল। বলল, আজ তোমার বুদ্ধি একদম খেলছে না, খুব ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ।
কেন? কী বললাম?
মেজদা যদি কলকাতায় ডাক্তারের কাছে যেতে না চায়, তা হলে বাড়িতেও যে ডাক্তার দেখাবে তার গ্যারান্টি কী?
তবু বাড়িতে তো তুমি থাকবে!
আমিই না হয় কলকাতায় নিয়ে যাব। তাহলে তো হবে?
তৃষা লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলল, হবে, কিন্তু তাহলে তো তুমি আর-একটা দিন এখানে থাকবে না!
শুধু আমাকে এখানে একদিন আটকে রাখার জন্য এত টাকা খরচ করবে! তুমি পাগল হলে নাকি বউদি?
রাগ করলে না তো!
না। তবে আমি গরিব ঘরের ছেলে, বাজে খরচা একদম পছন্দ করি না। বলছি তো থাকব।
তৃষা ভারী লজ্জা পেয়েছে। নিজের মনের কোনও দুর্বলতা ধরা পড়লে সে ভীষণ লজ্জা পায়। স্বভাবে এক দুর্মদ অহংকার আর তেজ আছে তার। কোথাও সে মাথা নোয়ায় না। এই একটা লোকের সামনে তার সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।
ধরা পড়ে তৃষা দুই চোখে মিটমিট করে চেয়ে দীপনাথের মুখে কৌতুকের হাসিটা দেখে নিয়ে বলল, শোনো দীপু, সংসারে বোধ হয় আমার আপন মানুষ একজনও নেই যাকে নিজের কথা বলি। আমার মতো এমন একা দুটি নেই। এমনকী আমার পেটের ছেলেমেয়েরাও আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে।
তুমি এরকম ভয়ংকরী তো আগে ছিলে না।
আজকাল হয়েছি। ভিতরে ভিতরে শুকিয়ে পাকিয়ে কোনওদিন যে মেয়েমানুষ ছিলাম তা ভুলতে বসেছি। অথচ পুরুষমানুষও তো নই। আজকাল তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আপনজন। কেউ না থাকলে বেঁচে থাকাটা কি বড় আলুনি নয়?
তোমার মুখে একদম মানাচ্ছে না কথাটা বউদি। তুমি কি জানো, আড়ালে, তোমাকে কেউ কেউ দেবী চৌধুরানি বলে ডাকে?
জানব না আবার!–বলে একটু হাসে তৃষা। শোনো দীপু, তোমার দাদা নয়, হয়তো একদিন শুনবে, আমিই সিলিং থেকে দড়িতে ঝুলে পড়েছি।
ইয়ারকি মেরো না।
ইয়ারকি বুঝি? বিশ্বাস হচ্ছে না?
তুমি মরবে কেন?
কেউ ভালবাসে না বলে।–তৃষা দুষ্টুমির হাসি হাসল।
দীপনাথ একটু গম্ভীর হয়ে বলে, মেজদার কথা কেন বললাম জানো? মেজদার চেহারাটার ওপর যেন একটা ছায়া পড়েছে। কিসের ছায়া কে জানে! তবে দেখলে খুব ভাল ঠেকে না। আজকাল কি মেজদা খুব ড্রিংক করে?
তা করে বোধ হয়। কিন্তু তার জন্য নয়। ড্রিংক অনেকেই করে।
তা হলে আর কী করে বলো তো?
কিছু করে না। কিংবা কী করে তা জানায় না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ একটা রাগ আর অভিমানে ফেটে পড়ছে সবসময়।
তবু তুমি কিছু উপায় বের করতে পারছ না?
তাই তো তোমাকে ধরেছি। তুমি একটা কিছু উপায় করো, হয়তো তোমার কথা শুনবে।
ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি, কিন্তু তোমাদের ভিতরকার জটিলতাকে সরল করব কী করে? কাজটা তো সহজ নয়।
আমাদের জটিলতা যেমন আছে থাক। এ জন্মে ওর সঙ্গে আমার বোধ হয় আর মিলমিশ হবে। কিন্তু ও লোকটা তো বাঁচুক। নিজের মনে মাথা খুঁড়ে মরছে, এটা তো ভাল নয়।
দাদার সম্পত্তি নিয়ে কোনও গন্ডগোল নয় তো?
না, তা কেন? তোমার মেজদা সম্পত্তির পরোয়াই করে না। এর সমস্যা অন্য। হয়তো সবটার জন্যই আমি দায়ী নই।
তোমাকে দায়ী করছে কে?
একটা শ্বাস ফেলে তৃষা বলে, তুমিই করছ গো। আর একমাত্র তোমাকেই আমি ভয় পাই।
দীননাথের এ কথায় আসা উচিত ছিল, কিন্তু হাসি এল না। সে বলল, ভয় পাও বউদি? আমাকে ভয় পাও? আমাকে ভয় পাওয়ার কী আছে?
কী আছে তা কী করে বলব? ঠিক এরকম আর-একজনকে ভয় পেতাম। সে কে জানো? ভাসুরঠাকুর।
দীপনাথের ভ্রু কুঞ্চিত হল। একটু সময় নিয়ে সে বলল, বড়দাকে তুমি খুব শ্রদ্ধা করতে? না বউদি?
গাঢ়ম্বরে তৃষা বলল, করতাম। ওরকম মানুষকে কে না করে বলো?
তোমাকেও বড়দা খুব ভালবাসত নিশ্চয়ই। নইলে সব তোমাকেই লিখে দিয়ে যেত না।
তৃষা দৃষ্টি নত রেখে বলল, বোধ হয়। কিন্তু সে কথা থাক।
দীপনাথ অস্বস্তির সঙ্গে মৃদু স্বরে বলল, অনেকে অনেক কুকথা বলে। আমি সেগুলো বিশ্বাস করি না। তোমরা যখন বড়দাদার বাড়িতে এসেছ, তখন আমি ছিলাম সেই শিলিগুড়িতে। কী হয়েছিল তা সঠিক জানি না। কী হয়েছিল বউদি?
প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলতে তৃষার আটকায় না। কিন্তু আজ রাতে এই প্রিয় দেওরটির সামনে যখন দ্রবীভূত মন নিয়ে সে বসে আছে তখন মিথ্যে কথা বলতে জিভে আটকাল তার। মল্লিনাথকে নিয়ে আজ অবশ্য তার লজ্জারও বোধ হয় কিছু নেই। দশজনের সামনে ইচ্ছে করলে সে চেঁচিয়েও বলতে পারে।
তৃষা মৃদু স্বরে বলল, সংসারটা তো জঙ্গল। বাইরে মানুষ পোশাক পরে থাকে বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেশির ভাগই তো জানোয়ার। কেউ কারও ভাল দেখতে চায় না, তাই কলঙ্ক রটায়। রটানোর রসদও ছিল। আমি তখন যুবতী, ভাসুরঠাকুরেরও এমন কিছু বয়স হয়নি… আর কি কিছু বলতে হবে?
তৃষা মিথ্যে কথা বলল না, সত্যও নয়। ঠেকা দিল মাত্র।
কুণ্ঠিত দীপনাথ বলল, থাক থাক। তোমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি ওসব জানি। তুমি কিছু মনে কোরো না বউদি।
আমার মনই নেই, তাই মনে করাটরা আসে না। আগে আগে রাগ হত, দুঃখ হত। আজকাল কিছু হয় না।
আমাকে ভয় পাও কেন তা কিন্তু বলোনি।
সব কি বলতে হয়?
আহা, এ তো গোপন কিছু নয়।
যদি বলি তবে তুমি আমার ভয় ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমি চাই, ভয়টা থাক। পৃথিবীতে অন্তত আমার একজনও ভয়ের লোক থাক।
দীপনাথ একটু যেন বিরক্ত হল। বলল, বলছ বটে, কিন্তু ভয়ের কোনও লক্ষণ তো কখনও দেখিনি।
তৃষা বড় বড় চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, দেখোনি?
কোথায় আর দেখলাম।
দেখার চোখ থাকলে তো দেখবে।
তা হলে তোমার চোখ দিয়েই না হয় দেখাও।
এই যে সন্ধেবেলা তোমার হুকুমে রঙিন শাড়ি পরে এলাম এ কাজ আর কেউ আমাকে দিয়ে করাতে পারত?
দীপনাথ নিঃশব্দে কিন্তু মুখ ভরে সরল হাসি হাসল। বলল, তা হলে শাডিটা কাউকে আবার দিয়ে-টিয়ে দিয়ো না। মাঝে মাঝে পরো। ভয়েই পরো না হয়।
তৃষা গাঢ় স্বরে বলে, তুমি যখন আমাকে খুকি সাজাতে চাও তখন না হয় সাজবই।
পরবে তো?
পরব বাবা, বলছি তো।
বৃষ্টি নামল বাইরে। গাছের পাতায় জলের ফোটা পড়ার সেই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর শব্দ বহুকাল বাদে শুনল দীপনাথ। গাছগাছালির ভিতর দিয়ে বাতাস বইছে। ব্যাং ডাকছিল অনেকক্ষণ ধরে। এখন বৃষ্টির সঙ্গে সেই ডাক মিশে যেন মুহূর্তের মধ্যে ফিরিয়ে আনল শিলিগুড়ির শৈশবকে।
বউদি, কী অদ্ভুত!
কী অদ্ভুত?
তোমাদের এই জায়গাটা!
তোমার পছন্দ?
খুব পছন্দ। বড়দা একটা সুন্দর জায়গা বেছে বের করেছিল তো!
মুখ টিপে হেসে তৃষা বলে, খুব সুন্দর নয় গো। থাকলে টের পাবে। থাকবে এখানে?
বললাম তো থাকব। কালকের দিনটা।
না রে বোকা, সে কথা বলিনি। বলছি এখানেই থাকো না কেন? কোনও অসুবিধে হবে না। মেসে বোর্ডিং-এ থাকো, আমার ভাল লাগে না।
দূর। তাই হয় নাকি?
কেন হয় না দীপু? যে মানুষটা এ বাড়িতে থাকলে আমি সবচেয়ে খুশি হই সেই কেন আসতে চায় না বলো তো!
দীপনাথের মুখে কথা আসছিল না। তবে মেজো বউদি যে তাকে খুব ভালবাসে এটা সে বহুদিন ধরে জানে। তবু সে একটু নিষ্ঠুর হল। আস্তে করে বলল, কী জানো বউদি, সেটা ভাল দেখাবে না। বড়দা একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই তোমাকে এই সব বাড়িঘর সম্পত্তি দিয়ে গেছে। যদি আমি বা বুলু এসে থানা গাড়ি তা হলে লোকে বলবে, সম্পত্তির লোভে এসে জুটেছি।
তুমিও ওকথা বললে দীপু?
একটু ভেবে দেখো বউদি, খারাপ কথা কিছু বলিনি। আজ বাবাও আমাকে ওরকম একটা কিছু বলছিল, আমি কান দিইনি।
বাবা তার কথা বলেছেন, আমি আমার কথা বলছি। আমার নিকটজন কেউ নেই দীপু, সমান সমান কেউ নেই, বন্ধু নেই।
নেই? বলো কী? তবে মঞ্জু স্বপ্ন সজল সরিৎ এরা কারা?
ওরা ওরাই। তুমি তো ওদের মতো নও। ওরা আমাকে ভয় পায়, ওরা কেউ আমার সমান সমান নয়, বন্ধু নয়। সম্পর্কটা কেমন জানো? যেন ওরা সবাই আমার অধীন, আর আমি ওদের ওপরওয়ালা।
আমি কি তোমার সমান সমান?
দীপু, তুমি তার চেয়ে কিছু বেশি। পৃথিবীতে কারও যদি আমার ওপরওয়ালা হওয়ার ক্ষমতা থেকে থাকে তবে সে একমাত্র তুমি।
যাঃ, কী যে সব বলছ আজ বউদি! তোমার মাথাটা আজ বড় গোলমাল করছে দেখছি। একটু বায়ু দমনের ওষুধ খাওগে যাও।
ইয়ারকি নয় দীপু। তুমি আমার সমস্যাটা ধরতেই পারছ না।
ধরার মতো লিড দিচ্ছ কই? এমন সব কথা বলছ যা নাটক-নভেলে থাকে।
বোকা কোথাকার! তুমি মেয়েমানুষদের একদম চেনো না।
খুব চিনি।
ছাই চেনো। একমাত্র বসের ওই কালো বউটিকে চিনলেই কি আর সবাইকে চেনা যায়?
বউদি! ফের ইয়ারকি?
কালো বললাম বলে রাগ নাকি?
আঃ, তোমার সঙ্গে পারা যায় না। ভয় নেই গো, আমি মণিদীপার চ্যাপ্টার খুলে বসব না। ওর নাম শুনলেই তোমার যা মুখের অবস্থা হয়।
দীপনাথ নিজের করতলের দিকে চেয়ে থাকে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। মনের মধ্যে কেবল আনন্দে-বিষাদে মেশা আলোছায়ার চক্কর।
তুমি আমাকে সন্দেহ করো বউদি?
তৃষা স্মিতমুখে বলে, করি। কিন্তু ভয় পাই বলে অতটা বলতে ভরসা হয়নি। আজ বললাম। তবে আবার বলছি, তোমার মনের কথা জানি না এখনও। কিন্তু আমার মেয়েমানুষের চোখ ভুল দেখেনি, তোমার বসের কচি বউটার মাথা কিন্তু তুমিই চিবিয়ে খেয়েছ। ও তোমাকে অন্ধের মতো ভালবাসে।
বাসলেই বা কী লাভ? উদাস অবহেলায় বলে দীপনাথ।
তাই দেখছি। তোমাকে যারা ভালবাসে তাদের কোনও লাভ নেই। তুমি সকলের প্রতি সমান নিষ্ঠুর।
উঃ, আজ তুমি মাথা ধরিয়ে দিলে বউদি। যা ডায়ালগ দিচ্ছ।
তৃষা মৃদু হেসে বলে, তুমি তো জানো না, আমি পাঁচ জনের সঙ্গে কত কম কথা বলি। লোকে যদি শোনে যে, আমি কথা বলে বলে তোমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছি, তা হলে বিশ্বাস করবে না। সবাই বলে, আমি নাকি ভীষণ গম্ভীর।
কী একটা বলছিলে যেন!
বলছিলাম, মেয়েমানুষকে তুমি ছাই জানো।
জানলেই বা কী এমন ক্ষতি!
তোমার ক্ষতি নয়। ক্ষতি আমার।
তোমারই বা কেমন ক্ষতি!
বললে তো বলবে নাটকের ডায়ালগ দিচ্ছি।
আচ্ছা, বলব না।
মাথা ধরবে না?
না। ঘাট মানছি, বলো।
তুমি কি মানো যে, আমার বাইরেটা যতই রুক্ষ হোক, আমি আসলে একজন মেয়েমানুষ?
তাই তো জানতাম। অত ঘটা করে মানবার কী আছে! তুমি মেয়েমানুষ না হলে পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হল কী করে?
তৃষা হেসে বলে, লোকে অবশ্য তোমার দাদাকেই মেয়েমানুষ বলে, আমাকে পুরুষ।
কথা ঘোরাচ্ছ। পয়েন্ট থেকে সরে যাচ্ছ।
খুব ঘুম পায়নি তো?
না। তবে রাত অনেক হল, এক কাপ চা হলে—
করছি। এ ঘরে চায়ের ব্যবস্থা সব সময়েই থাকে।
তৃষা উঠে কেরোসিনের স্টোভে চা বসিয়ে এসে বলল, তুমি ঠিক বুঝবে না। তবু বলি, আমার মাঝে মাঝে মাথাটা কেমন হয়ে যায় আজকাল। বুদ্ধি বিবেচনা গুলিয়ে যায়। তখন মনে হয়, আমাকে চালানোর মতো কেউ থাকলে বড় ভাল হত।
তোমার চালক তো মেজদা।
আইনে তা-ই বলে, কিন্তু কাজে নয়। ওর কথা থাক। আমার কথা বলি। আমি কারও প্রভুত্ব মেনে নিতে পছন্দ করি না। আমি অন্যের ওপর ছড়ি ঘোরাতে ভালবাসি। আমি ক্ষমতা ব্যবহার করতে ভালবাসি। এগুলো সবাই জানে, আমিও অস্বীকার করি না। আমি অহংকারী, একটু রাগী, হয়তো একটু নিষ্ঠুরও। কিন্তু আমার ভিতরে যে মেয়েমানুষের মনটা আছে সে এখন কারও প্রভুত্ব মেনে নিতে চায়। চালানোর লোক চায়। একজন বিশেষ কারও হুকুম মেনে চলতে চায়। তুমি কি জানো দীপু, মেয়েরা যে যত বড়ই হোেক প্রত্যেকের ভিতরে এই মজ্জাগত আকাঙ্ক্ষা থাকে? জানো
তো? তা হলে আমার কাছ থেকে শোনো। স্বামী বা প্রেমিক, ছেলে বা ভাই, কোনও একজন না। একজন পুরুষের কর্তৃত্ব সব মেয়েই জীবনের কোনও না কোনও সময়ে স্বেচ্ছায় মেনে নেয়। নইলে তার মন ছটফট করে, ভিতরটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে ভরে থাকে।
দীপনাথ খুব অবাক হয়ে চেয়ে ছিল তৃষার দিকে। মুখে একটু অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। বলল, মাইরি মেজো বউদি, তুমি তো দারুণ কথা বলতে পারো। কী সুন্দর সাজিয়ে বললে! আমি তো ভেবেছিলাম গাঁয়ে থেকে তুমি গাঁইয়া-মাজারি হয়ে গেছ।
তৃষা আবার লজ্জা পেল। উঠে গিয়ে চায়ের জল নামিয়ে পাতা ছেড়ে এসে ফের বসল। বলল, কথা কি মুখে এমনি আসে? আসে জ্বালায়!
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, তোমার কথা মানছি। মেয়েরা না হয় প্রভুই চায়, কিন্তু আমি মনে করি তাদের প্রভু হবে তাদের স্বামীরাই। মেজদাকে তুমি একটু কষ্ট করে প্রভুত্বটা দিয়ে দাও।
আবার তোমাকে হাঁদা গঙ্গারাম বলতে ইচ্ছে করে।
বলো না, শুনতে খারাপ লাগছে না।
ফাজিল হয়েছ। শোনো দীপু, মেয়েদের সকলেরই একজন প্রভু থাকেন, সবসময়ে সে তো স্বামীই হয় না। স্বামীদের সকলের কি সেই সিমপ্যাথি বা পার্সোনালিটি থাকে! ওসব ছেলেমানুষি কথা বলছ কেন? তোমার মেজদার এমন কিছু নেই যে, আমার ওপর প্রভুত্ব করতে পারেন।
দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এটা যদি বিয়ের আগে ডিসাইড করতে বউদি, তা হলে কত ভাল হত! যার প্রভু হওয়ার যোগ্যতা নেই তাকে বিয়ে করতে গেলে কেন?
তখন কি জানতাম!
জানা উচিত ছিল।–ভ্রু কুঁচকে দীপনাথ বলে।
সবাই কি জানে! জিজ্ঞেস কোরো তো মণিদীপাকে, সেও জানে কি না। জিজ্ঞেস কোরো তো, তার প্রভু কে!
তৃষা চা করে নিয়ে আসে। এক কাপ দীপনাথকে দেয়, এক কাপ নিজে নিয়ে বসে। বলে, আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমি কতটুকু। জীবনের এত বিষ তো তখনও পান করিনি।
রবিঠাকুর ছাড়ছ যে!— বলে দীপনাথ একটু হাসে। কিন্তু হাসিটা ফুটল না। বলল, আমাকে দিয়ে কি তোমার সেই সুপারম্যানের কাজ হবে বউদি?
জানি না। শুধু বলি, ভাসুরঠাকুরের পর একমাত্র তোমাকেই আমার বন্ধুর মতো মনে হয়। নিজের ভাই বা বাপের বাড়ির কাউকেই আমি এত স্নেহ বা শ্রদ্ধা করি না। সামনাসামনি বলছি, খারাপ লাগছে। দীপু, তোমাকে আমার খুব দরকার। পরামর্শ করার, দুঃখের কথা বলার, সঙ্গ করাব মতো তো কেউ নেই আমার।
দীপনাথ চা খেতে খেতে বাইরে বৃষ্টির গভীর শব্দ শুনতে থাকে। কোঁচকানো। ভাবছে। অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, কেউ যদি আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনে বউদি, তা হলে ভাববে আমরা দেওরে বউদিতে অবৈধ প্রেম করছি।
তৃষা ম্লান হাসল, আর প্রেমে কাজ নেই গো। অনেক হয়েছে। আর লোকের ভাবনা নিয়ে ভাবতে পারি না। থাকবে এখানে দীপু? যদি থাকো, আমি সব সম্পত্তি তোমার নামে লিখে দেব।
চায়ের কাপটা শেষ করে মেঝেতে নামিয়ে রেখে দীপনাথ বলে, তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো! ওসব বোলো না, শুনতে ভাল লাগে না।
তোমার লোভ নেই কেন দীপু?
কে বলল নেই? তবে আমি সহজ পন্থায় বিশ্বাসী নই।
তোমাকে কিন্তু লোভ দেখাইনি। বিশ্বাস করো, এত কষ্টে আমি যা করেছি সব এখন ছাই বলে মনে হয়। অথচ কষ্ট তো করেছি। এগুলো তো যাকে-তাকে বিলিয়ে দিতে পারি না।
দীপনাথ হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলে, তোমার অফারটা খুব ভাল। সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমারও এসব ভাল লাগে না বউদি। আমার এই পরিবেশ, এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, এত নোংরা আর প্যাচের জগৎটাকেই পছন্দ হয় না। আমি কি ভাবি জানো? একদিন এক মস্ত বরফে ঢাকা পাহাড় আমাকে ডাকবে। সেদিন আমি সব ছেড়েছুড়ে রওনা হয়ে যাব, আর কোনওদিন ফিরব না।
ও কী অলক্ষুনে কথা! যাঃ।
সত্যি। বিশ্বাস করো। একটা পাহাড় আমাকে ডাকে। ভীষণ ডাকে। সেই মস্ত উঁচু, আকাশছোঁয়া মহাপর্বতের কথা ভাবলে আমি সব ভুলে যাই।
তৃষা আস্তে হেসে ওঠে, পাগলা কোথাকার! যদি পাহাড়েই যাবে তবে মণিদীপার হবে কী? সে যে কেঁদে মরে যাবে।
বউদি, ফের?–বলে কটমট করে তাকানোর একটা অক্ষম চেষ্টা করে দীপনাথ। ঘাট হয়েছে। আর হবে না।
অনেকবার ওকথা বলেছ, কিন্তু তোমার সত্যিকারের রিপেনটেনস এসেছে বলে মনে হয় না। ফের বললে কিন্তু
আচ্ছা, এবার দেখো।
টেবিলের ওপর অ্যালার্ম ক্লকটায় সময় দেখে তৃষা চমকে উঠে বলল, ওমা! রাত একটা বাজে। সত্যিই তো, লোকে সন্দেহ করলে বলার কিছু নেই। এবার আমি যাই দীপু, তুমি দরজা দিয়ে শোও।
বৃষ্টিতে যাবে? ছাতা?
আছে গো, আছে।-বলে তৃষা আলমারির পিছন থেকে ছাতা বের করে তড়িৎ পায়ে দরজা খুলে চলে গেল।
দরজার ছিটকিনি আর বাটাম দিয়ে দীগনাথ এসে বিছানায় বসে। এ জায়গায় একদম মশার উৎপাত নেই। কেন নেই তা কিছুক্ষণ ভাবল দীপনাথ। থাকারই তো কথা! বোধহয় বউদি ওষুধ ছড়িয়ে চারদিককার মশা নিকেশ করেছে! বউদি ওরকমই, যা করবে তাতে খুঁত রাখবে না।
অনেকক্ষণ ভারী আনমনে বসে রইল দীপ। অনেক কথা ভাবল। সে একটা জিনিস টের পায় আজকাল। সেটা হল, মানুষকে স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণ করার এক দুর্লভ ক্ষমতা আছে তার।
বউদি বিছানার চাদর, মাথার তোয়ালে পালটে দিয়ে গেছে। তবু এই বিছানায় প্রগাঢ় মেয়েমানুষি কিছু সুগন্ধ রয়ে গেছে এখনও। এত ভাল বিছানায় দীর্ঘকাল শোয়নি দীপনাথ। সহজে তাই ঘুম আসে না।
পাশবালিশ আঁকড়ে ধরে সে জিজ্ঞেস করে, মণিদীপার প্রভু কে? বিলুর প্রভু কে? বীথির প্রভু কে? দুর দূর, বউদিটা যে কী সব বলে গেল!
গভীর এক বৃষ্টি ঝেপে এল চারদিক। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। উঠোনে অনেক জল দাঁড়িয়ে গেছে। এমন সুন্দর জলে জল পড়ার নিবিড় শব্দ বহুকাল শোনেনি যেন দীপনাথ। সে ঘুমিয়ে পড়ে।
অমনি দেখে একটা মস্ত আস্ত কাচের ওপাশে মণিদীপা। কাচে গাল ঠেকিয়ে কোনাচে চোখে দেখছে তাকে।
কিছু বলছেন?
মণিদীপা কিছু বলে। ঠোঁট নড়ে কিন্তু শব্দ আসে না।
মণিদীপা, আপনি কেন আমাকে ভালবাসেন? ঠিক নয়, মণিদীপা, ঠিক নয়। আপনি বোস সাহেবকে ভালবাসুন। ভালবেসে দেখুন, ঠকবেন না।
মণিদীপার চোখে অসহ্য অভিমান। ঠোঁট কাঁপে। কিন্তু শব্দ আসে না।
দীপনাথ কাচের গায়ে আঙুল ঘেঁয়ায়। মণিদীপা, আমাদের এরকম করাটা উচিত নয়। আমি আপনার ভাল চাই।
মণিদীপা কী বলছে? শুনতে পায় না দীপ। কিন্তু দেখে, মণিদীপার পিছনে এক মস্ত অন্ধকার। একটা ফাঁকা মাঠ।
ভিতরে আসছেন না কেন মণিদীপা?
এবার কাচের ভিতর দিয়ে ক্ষীণ টেলিফোনের গলার মতো ফিনফিনে শব্দ আসে, দরজা কোথায়?
দরজা! দরজা নেই?—দীপনাথ জিজ্ঞেস করে।
না। দরজা রাখেননি কেন দীপনাথবাবু? পিছনের মাঠে অনেক মশাল জ্বলে উঠল হঠাৎ। এক দঙ্গল কালো কালো লোক। হাতে লাঠি সড়কি বল্লম। ডাকাত।
দরজা রাখিনি! বড় ভুল হয়ে গেছে। দাঁড়ান, কাচ ভেঙে ফেলছি।
মণিদীপা হেসে ওঠে, ভাঙবেন? এ যে বুলেটপ্রুফ কাচ।
দীপনাথ দড়াম করে ঘুসি মারে কাচে। একটুও চিড় ধরে না। মাঠ ভেঙে লোকগুলো নিঃশব্দে, বিশেষ এক উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে আসছে।
দীপনাথ কাচের গায়ে দমাদম লাথি মারে। কিছুই হয় না। মাঠ ছেড়ে লোকগুলো মণিদীপার কাছ বরাবর এসে ঘিরে ধরে।
গোঁ গোঁ আওয়াজ করে পাশ ফেরে দীপনাথ। অস্ফুট স্বরে ঘুমের মধ্যেই বলে, আমি আসছি।