1 of 2

৩৮. মুর্শিদের চরে কয়েক দিন

মুর্শিদের চরে কয়েক দিন থাকার পর সূর্য বিরক্ত হয়ে উঠল। শুধু একঘেয়েমির জন্যই নয়, তার মনে হতে লাগল, সারা দেশে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে–সে সব কিছু থেকে বাদ পড়ে রইল। এই রকম পলাতক জীবন তার কত দিন চলবে? ব্রজগোপাল বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। কিন্তু নির্দেশ যদি শেষ পর্যন্ত না আসে? যদি উনি নিজেই ইতিমধ্যে ধরা পড়ে থাকেন? সূর্য কি তবু ক্যাসাব্লাঙ্কার মতন অপেক্ষা করে যাবে?

তমোনাশ ডাক্তারের খবর পাকা ছিল, ইতিমধ্যে একদিন পুলিশ উপেনের বাড়ি হানা দিয়ে গেছে। তছনছ করে দিয়ে গেছে বাড়িঘর, উপেনকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল, মারধর করে ছেড়ে দিয়েছে একদিন পর। হাসিখুশি মানুষটা চুপসে গেছে খানিকটা, কিন্তু ভেঙে পড়েনি–এখনও সূর্যকে খাবার পাঠায়।

এই ব্যবস্থাটা মোটেই পছন্দ হয় না সূর্যর। অত দূর থেকে তার জন্য কেউ কষ্ট করে খাবার নিয়ে আসবে–এটা ভাবতেও তার অস্বস্তি হয়। অথচ এখানে থাকতে গেলে আর কোনও উপায়ও তো নেই। দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সূর্য হ্যাংলার মতন প্রতীক্ষা করে কখন খাবার নিয়ে লোক আসবে। শুধু খাবারের জন্যই নয়, কথা বলার একজন মানুষের জন্য। যত স্বল্পভাষী মানুষই হোক, সারা দিনে একবার অন্তত কারওর সঙ্গে কথা না বলতে পারলে দম বন্ধ হয়ে আসে।

সারা দিন এই জংলা জলাভূমিতে সূর্য একা একা ঘুরে বেড়ায় আর বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলে। এখানে তার সঙ্গী কিছু পোকামাকড়, ইঁদুর আর হঠাৎ একটা সাপ। সাপটাকে সে বারকয়েক দেখেছে কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছোবার আগেই সেটা পালিয়েছে। সাপটাকে সে যে ঠিক মারতে চায় তাও নয়, তার উদ্দেশ্য সাপটার গতিবিধি লক্ষ রাখা। সময় কাটাবার জন্য সে সারা দিন ধরে সাপটাকে খোঁজে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ইঁদুরের গর্তগুলো বড় করে। পিঁপড়ের সারি দেখলে সে ওদের পাশে পাশে হামাগুড়ি দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যায়, দুটি গুবরে পোকাকেও সে প্রায়ই অনুসরণ করে।

বৃষ্টি ভিজে, রোদে পুড়ে তার গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে। নরম কচি ঘাসের মতন প্রথম বারের দাড়ি গজিয়েছে তার গালে, তার মাথা-ভরতি ঘন চুলে এখন আঠার মতন জট। এর মধ্যে কোনও অসুখবিসুখ হয়নি তার, কিন্তু একটা উপদ্রব দেখা দিয়েছে। সারা গায়ে চুলকুনি। ওঃ, কী অসহ্য চুলকুনি, রোদ লাগলেই চিড়বিড় চিড়বিড় করে, মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে তখন ঘ্যাস ঘ্যাস করে গোটা শরীরটা চুলকোতে হয়। এক এক সময় সূর্য আর সইতে পারে না–তখন শ্যাওলাভরা অগভীর জলে সে শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। তখন তাকে মনে হয় অদ্ভুত কোনও জলজ প্রাণী। জলের মধ্যে চুলকুনির তেজ কম, খানিকটা সাময়িক আরাম হয়, এবং ওই নোংরা জলের জন্যই গায়ের চুলকুনির রোগটা আরও বেড়ে যায়।

এখানে যে কখনও কোনও লোক আসে না এমন নয়। গোরু ছাগল চরাতে চরাতে দু’-একটি রাখাল মাঝে মাঝে চলে আসে। একদিন তিনটি ছেলে সম্ভবত স্কুল পালানো, এখানে এসেছিল সিগারেট খেতে। ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য, বাইরের খবর জানার জন্য সূর্যর মন আকুলিবিকুলি করেছে। কিন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয়ে সে বুঝতে পেরেছে, তার এখানে আত্মগোপন করে থাকার ব্যাপারটা কোনক্রমেই বাইরে ছড়িয়ে পড়া সমীচীন নয়। সূর্যকে তখন লুকিয়ে পড়তে হয়। নিঃশব্দে চলাফেরায় সে এখন অভ্যস্ত, পায়ের তলায় শুকনো পাতা পড়লেও শব্দ হয় না। অনেক সময় এমন হয়েছে, দু’জন রাখাল মাটির ঢিবির ওপর বসে গল্প করেছে, আর খুব কাছেই কোনও গাছের আড়ালে বন্যপ্রাণীর মতন লুকিয়ে আছে সূর্য, ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছে।

উপেনের বাড়িতে পুলিশের হামলা হবার পর দেড়দিন কোনও খাবার আসেনি সূর্যর জন্য। অত ডামাডোলের মধ্যে সূর্যকে খাবার পাঠানো হয়ে ওঠেনি। সেই সময়টা সূর্য যা খিদেয় কষ্ট পেয়েছিল, সে রকম অসম্ভব কষ্ট সে জীবনে আগে কখনও পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। ছত্রিশ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা এমন কিছুই না কিন্তু যেখানে খাওয়াটাই সারা দিনের একমাত্র কাজ, যেখানে প্রতি মুহূর্তে মনে হয় এই বুঝি আসবে, এই বুঝি আসবে–সেখানে একষ্টের তুলনা নেই। কারাগারের বন্দিজীবনের চেয়েও বেশি, কারণ এখানে দেওয়ালটা নিজের তৈরি করা। বনতুলসী গাছগুলোতে এক রকম ছোট ছোট ফল হয়–খিদের জ্বালায় সূর্য সেইগুলো খেয়েছে, মুঠো মুঠো তেঁতুলপাতা চিবিয়েছে, মাঠের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে থেকে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে তার।

তারপর একসময় লক্ষ্মী এল খাবারের ঝোলা হাতে নিয়ে। তাকে দেখে আনন্দিত হবার বদলে রেগে আগুন হয়ে উঠল সূর্য। আশা করতে করতে সীমানাটা পার হয়ে যাবার ফলে এই রাগ। সূর্যর ইচ্ছে হল খাবারের ঝোলাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, লক্ষ্মীকে খুন করে মাটিতে পুঁতে রাখে। কাছে আসার পর লক্ষ্মীর মলিন মুখখানা দেখে সে থমকে গেল। তখন লক্ষ্মী জানাল যে, তার বাবাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, ছেড়ে না-দেওয়া পর্যন্ত তাদের বাড়িতেও কেউ কিছু খায়নি।

তারপর থেকে কোনও দিন লক্ষ্মী এসেছে, কোনও দিন তার ভাই। অতখানি পথ পার হয়ে তারা আসে, লোকের চোখ আড়াল করে–এজন্য সূর্যর মমতা হয়। তার ছটফটানি বাড়ে। একটা কিছু করা দরকার–এ রকম ভাবে আর চলে না।

একদিন লক্ষ্মী একটা বলের মতন গোল সাবান নিয়ে এল সূর্যর জন্য। সাবানের চল নেই তাদের বাড়িতে, এটা জোগাড় করার জন্য লক্ষ্মীকে অনেক বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছে। চুলকুনির ওষুধ হিসেবে খানিকটা কবিরাজি মলমও এনেছে। সাবানটা দেখে প্রথমে সূর্যর মুখে উপহাসের হাসি এসেছিল, তারপর কী ভেবে সে খুব আগ্রহের সঙ্গে সেটা রেখে দিল।

সূর্যর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত লক্ষ্মী বসে থাকে, কেন না সে বাসনপত্র নিয়ে যাবে। তার পরেও সে বসে থাকতে চায়। মদির আলস্য খেলা করে তার চোখেমুখে, গাছে হেলান দিয়ে বসে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সূর্যর দিকে। তার কচি কিশোরী হৃদয় কোনও বিপদ বরণের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। এখানে অদ্ভুত নির্জনতা, শেষ জুলাইয়ের চড়া রোদ, গাছের ছায়ায় বসেও ঘন ঘন ঘাম মুছতে হয়, মাঝে মাঝে পাতার শব্দে ঝিরঝিরে হাওয়া–এই সবকিছুর মধ্যেই যেন কিছু একটা ছমছমানি আছে।

সূর্যর কিন্তু ওসব কোনও দিকে মন নেই। সেই যে একদিন মধ্যরাত্রে সে লক্ষ্মীর কাঁধ চেপে ধরার পরেও ছেড়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে সে আর লক্ষ্মীকে মেয়ে বলেই মনে করে না। সে সহজ সাধারণ ভাবে তার সঙ্গে কথা বলে, বকুনি দেয়, কিন্তু শরীরের কথা মনে স্থান দেয় না।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর সূর্য বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খুলে ফেলল ধুতি, গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার সব–এখানে উলঙ্গ হয়ে থাকলেও দেখবার কেউ নেই। তার শার্টটা লুকোনো ছিল একটা ঝোঁপের মধ্যে সেটাকেও বার করে এনে সবকটাকে সাবানকাঁচা করল অনেকক্ষণ ধরে যত্নের সঙ্গে। মাথার চুলে সাবান ঘষে, সারা শরীরে সাবান মেখে স্নান করল। তারপর জামাকাপড়গুলো মেলে দিয়ে নিজের শরীরটাও শুকোতে দিল ঘাসের ওপর শুয়ে। তার নগ্ন শরীর এখন অনেকটা পরিচ্ছন্ন। রিভলবারটা পেটের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়ল সেই অবস্থায়।

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। জামাকাপড় পরে ভদ্রস্থ হল আবার। ঘুমন্ত অবস্থায় কয়েকটা লালপিঁপড়ে কামড়ে গেছে, ফুলে উঠেছে কয়েক জায়গা। জামাকাপড়গুলো দোমড়ানো মোচড়ানো হলেও পরিষ্কার হয়েছে বেশ। যেটুকু সাবান অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু একটা কঞ্চির মাথায় গেঁথে কঞ্চিটা সোজা করে পুঁতে রাখল মাটিতে। আর একটা কঞ্চি দিয়ে তার সামনে মাটির ওপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, চলে যাচ্ছি। ভোর হবার আগেই সে বেরিয়ে পড়ল।

সূর্যর যাবার ইচ্ছে ছিল খগপুরে, পথ ভুল করে চলে গেল অন্যদিকে। তার ধারণা হয়েছিল, বিপ্লব বা লড়াই থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে–এখন দরকার খগপুরের মতন কোনও বড় জায়গায় যাওয়া। তা ছাড়া খগপুর নামটা তার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। কিন্তু পথ ঠিক করতে না পেরে এসে পড়ল বেলদা-পটাশপুরের দিকে। সঙ্গে তার কিছু টাকাপয়সা গোড়া থেকেই ছিল, এতদিন খরচের সুযোগ হয়নি–এবার সে পটাশপুর বাজারের কাছে একটা ভাতের হোটেলে ঢুকে অনেকদিন বাদে মাংস ভাত খেল।

এখানকার লোকের বাংলা উচ্চারণে একটা আলাদা টান আছে। সূর্য কথা বলতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে যে সে স্থানীয় লোক নয়। সুতরাং সে নিজে কিছু না বলে কান খাড়া করে শুনতে লাগল অন্যদের কথা। যুদ্ধের খবর সম্পর্কে স্থানীয় লোকের যে খুব একটা মাথাব্যথা আছে তা মনে হয় না। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বোসের নামও শোনা যায় না– সবাই জিনিসপত্রের দাম বাড়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এবং দেশের সর্বত্র যে টিকটিকি ঘুরছে এবং যাকে তাকে যখন তখন থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে–এটাও একটা বলবার মতন ঘটনা।

এদিকে আবার কলেরার প্রকোপ চলছে। এবং কলেরা ডাকিনি বিতাড়নের জন্য চলছে এক জায়গায় দিবারাত্র অবিরাম হরি সংকীর্তন। দিঘির পারে একটা শামিয়ানা খাঁটিয়ে একদল লোক ঢোল-মৃদঙ্গ করতাল নিয়ে অবিরাম চেঁচিয়ে যাচ্ছে, তাতে কান ঝালাপালা হলেও রাত কাটাবার পক্ষে জায়গাটা বেশ সুবিধাজনক। শ্রোতাদের মধ্যে কে। কখন উঠে যাচ্ছে, কে ঘুমোচ্ছে, তাতে কারওর কোনও চিন্তা নেই, পুলিশের চোখ থেকেও এটা নিরাপদ। রাতটা সূর্য সেখানেই কাটিয়ে দিল।

সকালবেলা গেল বাসের খোঁজে। তার সঙ্গে কোনও মালপত্তর নেই, থাকার জায়গা নেই–এ অবস্থায় এক জায়গায় বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেই সন্দেহের উদ্রেক করবে। বাসের খোঁজখবর নিয়ে সে জানল যে, এখান থেকে উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ চলে যাওয়া যেতে পারে বেশ সহজেই এবং তার পক্ষে লুকিয়ে থাকতে হলে ওই জায়গাটাই ভালো হবে। খড়গপুরেও যাওয়া যায় বাস বদল করে। সূর্য অনেক ভেবেচিন্তে খড়্গপুরেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত করল। এই এক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে তার জীবনের ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীও বদলে যাচ্ছে তা সে জানে না। পটাশপুর থেকে সকাল সাড়ে ন’টার বাস না নিলে পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটার সম্ভাবনা ছিল না তার জীবনে।

বাস নারায়ণগড়ে এসে থেমেছে, সূর্য জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একটা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ছোলা-মুড়ি কিনছিল, এমন সময় একটু দূরের মুদিখানার সামনে দাঁড়ানো একটি লোকের দিকে তার চোখ আটকে গেল। সূর্যর টিকিট কাটা ছিল আরও দূরের, কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে নেমে পড়ল সেখানে। মুদিখানার কাছে গিয়ে লোকটির থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে সে দেখতে লাগল তাকে।

লোকটি গরমমশলা, এলাচ, ইত্যাদির দর করছিল, চিনিও তার দরকার। চিনি বাজার থেকে উধাও হবার জন্য তার মেজাজ খুব গরম। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ডান দিকে ঘুরে তাকাল সূর্যর দিকে, কয়েক মুহূর্তের জন্য মুখখানা তার বিবর্ণ হয়ে গৈল, স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, তারপরই হাসিমুখে বলল, আরে, অমর না? চিনতেই পারিনি।’

যোগানন্দ সূর্যকে অমর নামেই জানে। সূর্য প্রতিবাদ করল না। গম্ভীর ভাবে বলল, যোগানন্দদা, আপনি এখানে? আমার ধারণা ছিল, আপনি মরে গেছেন!

যোগানন্দ হা হা করে হেসে বলল, বালাই যাট, এরই মধ্যেই মরব কেন? এখনও কত কিছু বাকি।

এতদিন আপনার কোনও খোঁজখবর পেয়ে—

যোগানন্দ সূর্যর কাঁধে এক চাপড় মেরে বলল, চলো ব্রাদার, আমার বাড়ি চলো, সেখানে সব কথা হবে। কী চেহারাই করেছ, খেতেটেতে পাও না নাকি? এ-দিকে কোথায় যাচ্ছিলে?

সূর্য শুকনো মুখে বলল, আমার কোনও জায়গা নেই। ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

এই কয়েক মাসে সূর্যর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিছুটা শিখেছে বুঝেশুনে কথা বলতে। এখন যোগানন্দর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা তৈরি করাই তার দরকার।

বাজার এলাকা ছাড়িয়ে এসে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে যোগানন্দ জিজ্ঞেস করল, দাদাদের খবর কী?

সূর্য অপ্রসন্ন ভাবে বলল, আমার সঙ্গে আর কারওর কোনও যোগাযোগ নেই। আমাকে ওরা দল থেকে বাদ দিয়েছে।

কেন?

আমি একটা অ্যাকশানে যেতে পারিনি।

কেন, যাওনি কেন, ভয় পেয়েছিলে?

আমার শরীর খারাপ ছিল। আমার জিনিসটাও সেই সময় নিয়ে গেল, আর ফেরত দিল না। হরদা আমার কাছে রাখতে বলেছিলেন

জিনিসটাও নিয়ে গেল? হাঃ হাঃ হাঃ। এখন তুমি তা হলে কী করবে?

বাড়িতেও ফিরতে পারছি না, পুলিশ চোখ রেখেছে।

তোমার কোনও ব্যবস্থাও করেনি দাদারা? ‘অসময়ে হায় হায়, বন্ধু কেউ নয়।আমি তখনই ভেবেছিলাম, তুমি ছেলেমানুষ, তোমাকে ওরা ঠকাবে। আমার এখানে থাকো কয়েক দিন, তারপর দেখা যাক, কী করা যায়!

যোগানন্দর বাড়িটি মোটামুটি ছিমছাম সাজানো। বাড়িটির বাইরে থেকে যে রকম সুন্দর, অন্দরমহলের গৃহকত্রীটিও তেমন সুন্দরী। মহিলা প্রায় যোগানন্দর সমান বয়সি, গায়ের রং কালো কিন্তু তার মুখে ও শরীরে এমন এক লাবণ্য আছে যাতে গায়ের রঙের কথা মনেই থাকে না।

যোগানন্দ সেই মহিলাকে দেখিয়ে সূর্যকে বলল, অমর, ইনি তোমার বউদি হন। প্রণাম করো, প্রণাম করো–

একপ্রকার জোর করেই প্রণাম করাল সূর্যকে দিয়ে। তারপর স্ত্রীকে বলল, ভালোমন্দ কিছু খেতে দাও তো, তোমার দেওরটি না খেতে পেয়ে পেয়ে শুকিয়ে গেছে দেখছ না!

যোগানন্দ বাড়ির সংলগ্ন একটা দোকান খুলেছে টিউবওয়েলের যন্ত্রপাতির। তার অবস্থা বেশ সচ্ছল বলে মনে হয়। নিজের থেকেই সে সূর্যকে শোনাল যে তার সংসারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সে তার জমিদার পিতার কাছ থেকে নিজের সম্পত্তির অংশ নিয়ে এসে এখানে বাড়ি করেছে। বিপ্লব টিপ্লব নিয়ে সে আর মাথা ঘামাতে চায় না। ওসব পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। দেশ যখন স্বাধীন হবার আপনিই হবে–দু-চারটে বোমা পিস্তল নিয়ে যারা বিপ্লব করার কথা ভাবে–তারা স্রেফ গোঁয়ার। গোঁয়ারতুমি করে প্রাণ দেবার সাধ তার নেই।

সূর্য একদৃষ্টে যোগানন্দের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবে, এইসব কথা সেই ডাকাতি করার পরেই কেন মনে হল যোগানন্দর, ডাকাতির আগে কেন মনে পড়েনি? তখন তো ওর দারুণ উৎসাহ ছিল। ডাকাতির পরিকল্পনাটাও মোটামুটি ছিল ওরই। এই যোগানন্দকে দেখেই সূর্য একসময় দারুণ মুগ্ধ হয়েছিল। চন্দননগরের সেই পোডড়া বাড়িতে সকালবেলা যোগানন্দ তাকে এমন আন্তরিক ভাবে কয়েকটা কথা বলেছিল, যা এখনও তার বুকে লেগে আছে। যোগানন্দ বলেছিল, ভাই অমর, দেশের কাজকে যদি তোমার নিজের কাজ বলে ভাবতে পারো–তা হলেই এ পথে থেকো। কোনও দিন কোনও প্রতিদান আশা কোরো না। আর সবাই ছেড়ে চলে গেলেও তোমাকে থাকতে হবে–এই কথাটা সবসময় মনে রেখো।

এই কথাগুলো যে বলেছিল, আজ তার এই পরিণতি। কথার গুরুত্ব না বুঝে মানুষ এ রকম ভাবে উপদেশ দিতে পারে? এসব কি শুধু কথা, এর পেছনে আর কিছু নেই?

যোগানন্দ বরাবরই’পেটুক মানুষ। খেতে ভালোবাসে, এখন তার খাওয়াদাওয়া একটা উৎসবের মতন। সারা দিন ধরেই খাওয়াদাওয়ার ধুম লেগে আছে। তার স্ত্রী শ্যামলী রান্নার ব্যাপারে একজন শিল্পী। প্রত্যেক বেলা শুধু মাছই রান্না হয় তিন-চার রকম। যোগানন্দর আগে ছিল শক্ত সবল চেহারা, এখন গায়ে বেশ চর্বি লেগেছে। পায়েসের বাটিতে চুমুক দিয়ে সে যখন তারিয়ে তারিয়ে খায়, তখন সূর্যর মনে পড়ে যায়, একদিন ডুমুর আর পেঁয়াজের বিচিত্র তরকারির সঙ্গে মশলা ছাড়া খিচুড়ি কী অপূর্ব তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিল যোগানন্দ।

যোগানন্দ সূর্যকে খুবই খাতিরযত্ন করে। সবসময় স্ত্রীকে বলে, অমরকে এটা দাও, অমরকে ওটা দাও। দিন তিনেক ভালো করে স্নানটান ও খাওয়াদাওয়া করে সূর্যর চেহারা ফিরে গেল। তখন শ্যামলী অন্য চোখে দেখতে লাগল সূর্যকে।

শ্যামলী কথাবার্তা কম বলে, কিন্তু দু-একটি কথা শুনলেই বোঝা যায়, সে বেশ বুদ্ধিমতী। মাঝে মাঝেই সূর্য দেখতে পায়, শ্যামলী তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সূর্যর অনুপস্থিতিতে সূর্যর ঘরে পরিষ্কার জামাকাপড় রেখে যায়। রাত্তিরবেলা তার মাথার কাছে জল ঢাকা থাকে। প্রথম তিন দিন শ্যামলী সূর্যর সঙ্গে সাধারণ সৌজন্যসূচক দু’-চারটে কথা ছাড়া কিছুই বলেনি, তারপর একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ পানের রসে ঠোঁটদুটি রাঙিয়ে সূর্যর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী, এত মনখারাপ কেন?

সূর্য তখন জানলার ধারে গুম মেরে বসেছিল। গম্ভীর হয়ে থাকলেই তার মুখে এক ধরনের গাঢ় বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। তার ফরসা সুন্দর মুখে সেই বিষণ্ণতা কেমন যেন অদ্ভুত দেখায়।

সূর্য মুখ ফিরিয়ে বলল, যোগানন্দদা কোথায়?

ঘুমোচ্ছে।

সূর্য আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। মেয়েদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয়, সে জানে না। শ্যামলী একটু বাদে এগিয়ে এসে বলল, আপনি বলব, না তুমি বলব? তুমিই বলি, তোমার বয়স কত?

সূর্য বলল, আঠেরো।

বাবা, এর মধ্যেই এত লম্বা হয়ে গেছ। তুমি তো তোমার এই দাদাটিকেও ছাড়িয়ে গেছ। আচ্ছা ভাই অমর, তুমিও কি এখন তোমার দাদার মতন দল-ছাড়া?

এ বাড়িতে এদের মুখে অমর ডাক শুনে সূর্যর এখনও অস্বস্তি হয়। তার বাবার নাম অমর, বাবার নামে ছেলেকে কেউ ডাকলে ছেলের কানে সেটা অদ্ভুত শোনাবেই। কিন্তু তার দল থেকে তাকে এই ছদ্মনামটা দেওয়া হয়েছিল।

সূর্য বলল, আমি কোনও দিন কোনও দলে ছিলাম না। যোগানন্দদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়।

হুঁ, বুঝেছি। যেই যুদ্ধ লাগল অমনি তোমাদের সব জারিজুরি থেমে গেল? আচ্ছা, এই যুদ্ধ কত দিন চলবে বলতে পারো?

কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

তোমার দাদা তো বলেন, যত বেশি দিন যুদ্ধ চলে, ততই নাকি ভালো। এখন ওর দোকানে বিক্রি খুব ভালো, যুদ্ধ থেমে গেলে আর এতটা হবে না।

একটু চুপ করে থেকে শ্যামলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, তোমার দাদাকে আমি দশ বছর ধরে চিনি। যখন ও পুলিশের সঙ্গে লড়াই করত, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত–তখন ওকে আমার অনেক অনেক বেশি ভালো লাগত। তখন ছিল একটা দুর্দান্ত প্রকৃতির মানুষ। এখন কী রকম যেন সাধারণ, আর পাঁচজনের মতন, আমার এ রকম ভালো লাগে না। আগে ওর সঙ্গে নমাসে-ছ’মাসে দেখা হত–সেও অনেক ভালো। ছিল—

সূর্য একটু অবাক হয়ে তাকাল শ্যামলীর দিকে, কিন্তু কোনও মন্তব্য করল না। শ্যামলীর মুখে যেন সত্যিই একটা দুঃখের ছায়া। সূর্যর সঙ্গে আরও কথা বলার উদ্দেশ্যে শ্যামলী এসে বসল সূর্যের বিছানার ওপর। মাথার বালিশটা সরাতে যাচ্ছিল সূর্য বিদ্যুৎবেগে এসে বসে পড়ল বালিশটার ওপর। বালিশের তলায় তার গোপন জিনিস আছে, শ্যামলীকে দেখানো যায় না।

সূর্যর এ রকম ব্যবহারে চমৎকৃত হয়ে গেল শ্যামলী। সূর্য প্রায় তার গায়ের ওপরেই এসে বসে পড়েছে। কৌতূহলের চোখে সূর্যর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়িতে আর কে কে আছেন?

সূর্য দায়সারা উত্তর দিচ্ছে। শ্যামলীকে এখান থেকে ওঠানো দরকার। কিন্তু সে তো তাকে উঠে যেতে বলতে পারে না। শ্যামলী চেয়ে আছে সূর্যর গেঞ্জি পরা শরীরের দিকে। সূর্যর বাহুতে চাকা চাকা দাগ–সেদিকে আঙুল তুলে শ্যামলী বলল, এসব কী?

সূর্য বলল, আমার গায়ে চুলকুনি আছে, আপনি সরে বসুন।

সরে বসার কোনও লক্ষণ দেখাল না শ্যামলী, হাসতে হাসতে বলল, সে কথা আগে বলোনি কেন? গরম তেলে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে দেবকাল মাখবে সারা গায়ে

সূর্যর পিঠে হাত রেখে শ্যামলী বলল, এমন সুন্দর চেহারা, কেউ তার এমন অযত্ন করে।

হঠাৎ রক্তের গন্ধ পেয়ে গেল সূর্য। তীব্র চোখে শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক। তারপর আর সময় নষ্ট না করে শ্যামলীকে জড়িয়ে ধরল।

আর্ত কণ্ঠে, নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে শ্যামলী বলল, এই কী হচ্ছে কী–দরজা খোলা…

ধুৎ তেরি, দরজা খোলা। সূর্য কোনও দিন এসব গ্রাহ্য করেছে? ততক্ষণে সে শ্যামলীর ঠোঁট কামড়ে ধরেছে, কোমর থেকে হাত নিয়ে এসেছে বুকের কাছে।

শ্যামলী কোনওক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জ্বলন্ত চোখে বলল, ছি ছি ছি, তুমিও এই রকম? কোনও মেয়ে কোনও ছেলের সঙ্গে একটু নির্জনে কথা বলতে এলে তোমরা এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারো না?

সূর্য রুক্ষ গলায় বলল, আপনি কেন বললেন, দরজা খোলা?

দরজা খোলা থাক বা না থাক, তুমি এত নির্লজ্জ, এই তোমরা বিপ্লবী?

সূর্য তর্কাতর্কি করে পারবে না। সে আর কথা খরচ না করে উঠে দরজা বন্ধ করে এল। শ্যামলীর সব বাধা অগ্রাহ্য করে তার কোমর ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে এল বিছানায়। কয়েক দিন ভালো খাবার ও পরিচর্যা পেয়ে তার শরীরের এই খিদেটা অসম্ভব জেগে উঠেছে। শ্যামলীর দুটো হাত বিছানার ওপর জোর করে চেপে ধরে, শরীরের ভরে পাদুটো আটকে সে চুম্বন করল শ্যামলীকে। এত দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন যে মনে হয় অন্তহীন। শেষের দিকে শ্যামলীর প্রতিরোধ কমে এল, অংশগ্রহণ করতে লাগল তার নিজের ঠোঁট। তখন সূর্য শ্যামলীর হাত ছেড়ে তার বুকের আঁচল সরিয়ে দিল। একটানে ব্লাউজটা ছিঁড়তে যেতেই সে থমকে গেল।

শ্যামলীর গলায় সোনার সরু হার, লকেটটা মস্ত বড়। লকেটের মাঝখানে একটা লাল পাথর। এই হার সূর্য চেনে। ডাকাতির দিন আঢ্যিবাড়ির যুবতী বধূটির গলা থেকে এই হার যোগানন্দ নিজে ছিঁড়তে গিয়েছিল। সেই হার যোগানন্দ তার নিজের স্ত্রীর গলায় পরিয়েছে। এ কী ধরনের মানুষ? এ কী ধরনের পৃথিবী? সূর্যর শরীরটা গুলিয়ে উঠল।

শ্যামলীকে ছেড়ে ভূতে-পাওয়া মানুষের মতন সে উঠে দাঁড়াল। কুঁকড়ে গেছে তার মুখখানা। শ্যামলীর ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে, তাই দেখে সূর্য বিকৃত গলায় বলল, যান, মুখ ধুয়ে আসুন। আপনার রক্ত আমি খেয়ে ফেলেছি, তাই আমার বমি পাচ্ছে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা সূর্য যোগানন্দকে বলল, দাদা, একটু বেড়িয়ে আসি, বাড়িতে বসে আর ভালো লাগছে না।

যোগানন্দ সূর্যকে বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করেছিল। কিন্তু দিনের পর দিন বাড়িতে বসে থাকা কি এ ছেলের পক্ষে সম্ভব? বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, তাই দেখে যোগানন্দ বলল, ঠিক আছে যাও, বেশি দেরি কোরো না। কাল তোমাকে নিয়ে আমি মেদিনীপুর টাউনে যাব–ভোরে উঠতে হবে।

আপনিও চলুন না। কাজ তো কিছু নেই।

যোগানন্দ বলল, ঠিক আছে, চলো, তোমাকে বনের ধারটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ও দিকটা বেশ সুন্দর। তুমি একা গেলে কোথায় যেতে কোথায় যাবে আবার!

বাড়ির পেছন দিকে মাঠের মধ্য দিয়ে রাস্তা। সূর্য এখন অসম্ভব শান্ত, সে নীরবে হেঁটে যাচ্ছে যোগানন্দের পাশে। যোগানন্দ গুন গুন করে গান ধরেছে, স্বামী বিবেকানন্দর প্রিয় গান, ‘যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে রত পান্তুয়া শত শত–’।

সন্ধ্যা শুরু হতে না হতেই সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছে। পরিষ্কার আকাশ। ফুরফুরে হাওয়ায় গান ও কথা উড়ে যায়। মাঠ শেষ হবার পর অল্প অল্প জঙ্গল শুরু হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে পায়ে-চলা পথ। যোগানন্দের মনে কবিত্ব জেগেছে। সে ওপরে তাকিয়ে বলল, কত তারা দেখেছ? একসঙ্গে এত তারা কলকাতায় বসে কেউ দেখতে পায় না। তারাগুলো ঠিক ফুলের মতন মনে হয়।

সূর্য বলল, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখা যায়, এক একটা তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে।

যোগানন্দ বলল, তারা নয়, সেগুলো ধূমকেতু।

তর্কের ভঙ্গিতে সূর্য বলল, না তারা।

ওঃ, তা হলে মরা তারা। অনেক সময় দেখা যায় পৃথিবীতে খসে পড়ছে–পড়তে পড়তেই পুড়ে যায়।

না, সেগুলো না। এক একটা তারা স্থান বদলায়। মানুষের জীবনের মতন। আমি দেখেছি।

মুর্শিদের চরে থাকবার সময় সূর্যকে অনেক আকাশ দেখতে হয়েছে–এ-দৃশ্য তার সত্যিই দেখা।

যোগানন্দ বিড়বিড় করে বলল, সত্যিই মানুষের জীবন বদলায়। বড় ঘন ঘন বদলায়। আমি অনেক বদলেছি–আমাকে দেখে তুমি অবাক হচ্ছ, না? কাল থেকে কিন্তু আমার অনুতাপ হচ্ছে। তোমাকে একটা কথা বলব বলব করেও বলিনি। কাল শহরে গিয়ে আমি একটা হ্যাঁন্ডবিল দেখলাম। মহাত্মা গান্ধী থেকে কংগ্রেসের সব নেতাকে ইংরেজ সরকার আবার জেলে ভরেছে। ৯ই অগাস্ট থেকে দেশের অনেক জায়গায় বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। রেললাইন উপড়ে, স্টেশন পুড়িয়ে

সূর্য বিমূঢ় গলায় জিজ্ঞেস করল, আজ কত তারিখ?

এগারো। সত্যি অমর, সারা দেশে বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। আর আমরা এখনও বসে আছি? আমার রক্ত আবার চনমন করে উঠছে। একসময় অনেক কিছু করেছি, আর আসল লড়াইয়ের সময়েই ঘরের কোণে বসে থাকব? আমার বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। অনুতাপে। তখন ভেবেছিলাম, আর কোনও আশা নেই–যুদ্ধ না থামলে,–তাই নিজের ঘর গুছিয়ে নেবার জন্য কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, সুভাষবাবু সত্যি সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসবেন। ওঃ, কী ভুল করেছি! বিয়ে করে সংসারে জড়িয়ে

সূর্য থমকে দাঁড়িয়ে কর্কশ গলায় বলল, সেই ডাকাতির রাত্রে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

আমি গ্রামের লোকের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। মালপত্র তো সব কেড়ে নিয়েছেই, এমন মার মেরেছিল যে সে যাত্রা যে প্রাণে

কথা বলতে বলতে যোগানন্দর মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে সূর্যর হাত দু’খানা চেপে ধরে বলল, তুই আমাকে খুন করতে এসেছিস, তাই না?

হাত ছাড়ুন।

আমাকে খুন করার জন্য তোকে ওরা পাঠিয়েছে, না রে অমর?

সূর্য হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল, কিন্তু যোগানন্দের গায়েও প্রচণ্ড জোর। সে দু’ হাতে সূর্যকে সপাটে চেপে ধরেছে। সূর্য প্রাণপণেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না, তখন কামড়ে দিল যোগানন্দের হাতে ব্যথার জ্বালায় যোগানন্দ তাকে ছেড়ে দিয়েই প্রচণ্ড এক লাথি মারল পেটে। সূর্য ছিটকে পড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে রিভলবার বার করে গুলি চালাল।

হাত স্থির ছিল না, গুলি যোগানন্দের গায়ে লাগেনি। যোগানন্দ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গড়াতে শুরু করেছে অন্ধকারের দিকে। সূর্য রিভলবার হাতে এগিয়ে আসতেই সে চেঁচিয়ে উঠল, অমর, মারিস না, মারিস না, শোন, কথা শোন। আমি ভুল স্বীকার করছি–দাঁড়া, একটা কথা বলতে দে—

লক্ষ্য স্থির নিশ্চিত করা জন্য সূর্য অস্ত্র হাতে নিয়ে পায়ে পায়ে গিয়ে যেতে লাগল ওর দিকে। যোগানন্দ একটা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়েছে। সেখান থেকে বলতে লাগল, অমর, মারিস না, এ রকম ভাবে মারিস না– আমিও অনেক কাজ করেছি–আমাকে আর একটা সুযোগ দেকালই আমি বাড়ি-ঘড় ছেড়ে বেরিয়ে পরবো–যদি পুলিশের গুলিতে মরি, তাও একটা সান্ত্বনা থাকবে।

সূর্য হুকুম করল, ওখান থেকে বেরিয়ে আসুন।

মারবি না বল? একটা সুযোগ দিবি?

বেরিয়ে আসুন আগে। এতে এখনও পাঁচটা টোটা আছে, এইখান থেকেই আমি আপনাকে শেষ করে দিতে পারি। বেরিয়ে আসুন।

যোগানন্দ বেরিয়েই সূর্যর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সূর্যর মুখখানা পাথরের মতন শক্তি। যোগানন্দর মাথা টিপ করে রিভলবার তুলেছে, যোগানন্দ হাউ হাউ করে কেঁদে বলল, এ রকম ভাবে মারিস না, আমাকে পুলিশের গুলিতে মরতে দে।

ঠিক?

অমর, তোর কাছে কথা দেওয়ার কিছু নেই। আমার নিজেরই অসম্ভব অনুতাপ হচ্ছে। আমি যা ভুল করেছি, আমার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবেই!

সূর্য হিংস্র ভাবে বলল, আমার যদি কোনও ভুল হয়, তা হলে আমি নরকে গিয়েও আপনাকে খুঁজে বার করব।

সেই রাত্রে শ্যামলী সূর্যর ঘরে জল রাখতে এসে সূর্য দরজার সঙ্গে তাকে চেপে ধরে, গলার হারটা একটানে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বাইরের অন্ধকারে, ঠাস ঠাস করে তার দু’গালে দুটি চড় মারে। শ্যামলী এতই অবাক হয়ে যায় যে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। সূর্য যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আবার একটা প্রচণ্ড চড় মেরে বলে, লোভের শেষ নেই। না? আর সব গয়না কোথায়?

একটু পরে দেখা যায়, শ্যামলী সূর্যর পায়ের কাছে বসে কাঁদছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *