৩৮
আজাদের সঙ্গে রুমীর দেখা হয়ে যায় ধানমন্ডির হাইডআউটেই ৷ এটার কোড-নাম ২৮ নম্বর ৷ এটা একটা ওষুধ কোম্পানির ছেড়ে যাওয়া অফিস ৷ এখানে থাকেন শাচৌ আর আলম ৷ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তখন একত্র হয়েছে ৷ উলফত, হ্যারিস, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কাজী কামাল, আলম আর রুমী ৷ মেলাঘর থেকে নতুন অস্ত্র আসবে ৷ আসবে আরো আরো বিস্ফোরক ৷ ঢাকায় গেরিলাদের অভিযান এখন একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে ৷ ফার্মগেট অপারেশনের পর গেরিলাদের মনোবল এখন তুঙ্গে ৷ তারা এখন বড় অ্যাটাকে যেতে চায় ৷ যদিও শাহাদত চৌধুরী বারবার সাবধান করে জানিয়ে দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন হায়দারের উক্তি-গেরিলারা কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করবে না, তারা হঠাৎ আক্রমণ করবে, লুকিয়ে যাবে জনারণ্যে ৷ স্মরণ করিয়ে দেন মেজর খালেদ মোশাররফের রণকৌশল, আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক ৷
কিন্তু গেরিলারা এখন সামরিক আক্রমণের জন্যে অস্থির ৷
আজাদ আসে ৷ শাচৌয়ের কথা শোনে ৷ কে এই ক্যাপ্টেন হায়দার ৷ দেখতে কেমন তিনি ৷ শোনা যায়, দাড়ি ছিল, এখন ক্লিন শেভ্ড ৷ প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় ৷ মেলাঘরে একবার যাওয়া দরকার ৷ আর মেজর খালেদ মোশাররফ ৷ ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান ৷ তাকে তো ছেলেরা একেবারে হিরোর মতো দেখে ৷ কিংবদন্তি যেন তিনি ৷ শাহাদত চৌধুরী তো বলেন, প্রথম দেখার দিনটায় খালেদ মোশাররফকে তাঁর মনে হয়েছিল গ্রিক দেবতার মতো, বিকালবেলা তাঁকে প্রথম দেখেন শাচৌ, জিপ থেকে নামছেন গোমতী নদীর এমবারক্মেন্টে, পেছনে অস্তগামী সূর্যটা লাল আর গোল, সোনালি রঙের গ্রিক দেবতা নেমে এলেন…
শাচৌ অনেক কথা বলেন ৷ বুঝিয়ে বলেন, ঢাকার যুদ্ধটা কনভেনশনাল যুদ্ধ নয় ৷ এটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধ ৷ এই যুদ্ধে জয় বা মাটি দখল উদ্দেশ্য নয় ৷ উদ্দেশ্য হলো, মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখা ৷
পরিবেশটা গম্ভীর ৷ এখানে জুয়েল থাকলে ভালো হতো ৷ এখনই একটা কৌতুক বলে পরিবেশটা জমিয়ে তুলতে পারত ৷
‘এই আজাদ তুমি ?’
একটা জুনিয়র ছেলে তাকে তুমি করে বলছে ব্যাপার কী! ছেলেটা আবার দেখতে রুমীর মতো ৷ ‘হ্যাঁ ৷ তুমি ?’
‘চিনতে পারছ না ৷ আশ্চর্য তো! আমি রুমী!’
‘রুমী! এই, তোমার কী চেহারা হয়েছে ৷’
‘মেলাঘরে ট্রেনিং নিতে গেছলাম না ৷ বোঝোই তো ৷ আমার শরীরে কি ওই সব সহ্য হয় ৷ এই, খালাম্মা কেমন আছেন ?’
‘আছেন ভালো ৷ তোমার মা ?’
‘আছেন ৷ মার সঙ্গে দেখা করতে বাসায় চলো ৷ কাজী, জুয়েল ওরা থাকে তো মাঝে মধ্যে ৷ আজকে আমার সঙ্গে চলো ৷ তোমাকে একটা জিনিস দেব ৷’
‘কী জিনিস ?’ রুমী জিজ্ঞস করে ৷
‘তুমি না গান ভালোবাসো ৷ রেকর্ড শোনো ৷ আমাদের বাসা থেকেও তো রেকর্ড ধার নিতা!’
‘হ্যাঁ ৷ তো ?’
‘একটা গান দেব তোমাকে ৷’
‘রেকর্ড!’
‘না রেকর্ডটা পাই নাই ৷ গানের লিরিকটা পেয়েছি ৷ আমি কপি করে রেখেছি ৷ তোমাকেও দেব এখন ৷’
‘কোন গান, বলো তো!’
‘জর্জ হ্যারিসনের ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ ৷’
‘ও মাই গড ৷ তুমি ওর রেকর্ড পেয়েছ ?’
‘রেকর্ড পাই নাই ৷ জর্জ হ্যারিসনের গানের কপিটা পেয়েছি ৷ বাংলা দেশ বাংলা দেশ ৷’
‘চলো ৷ এখনই যাই ৷ শাহাদত ভাই, আমি একটু আজাদের বাসায় যেতে পারি ?’
‘কেন ?’
‘আগেই বলব না ৷ আগে আনি, তারপরে আপনাদের সবাইকে দেব ৷’
‘কী জিনিস ?’
‘জর্জ হ্যারিসনের গানের লিরিক ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ ৷’
‘বলো কি!’ শাচৌ উত্তেজিত বোধ করেন ৷
শাচৌও খুব গান শোনেন ৷ তবে গানের ব্যাপারে, সাহিত্যের ব্যাপারে তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না ৷ তিনি মনে করেন, জনপ্রিয়তা আর শিল্পের উৎকর্ষ সমার্থক নয় ৷ তার ঝোঁক ক্লাসিকের দিকে ৷ যুদ্ধ আস্তে আস্তে তার মনোভাব পাল্টে দিচ্ছে, এটা তিনি লক্ষ করছেন ৷ জনরুচির প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর বাড়ছে ৷ হয়তো জনগণের কাছাকাছি থাকতে গিয়ে তাঁর এই পরিবর্তন ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ সম্পর্কে তিনি জানেন ৷ পহেলা আগস্ট এই কনসার্ট হয়েছে ৷ আমেরিকায় মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ৷ জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, বব ডিলান, এরিখ ক্লাপটন ৷ একেকজন দিকপাল ৷ এরা সবাই মিলে খোদ আমেরিকায় করেছে এই কনসার্ট ৷ হাজার হাজার তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছে এই কনসার্টে ৷ ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-সর্বত্র ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে এই কনসার্টের খবর ৷
শাচৌ বলেন, ‘এই, একটা কপি করে আমাকেও দিও তো ৷’
রুমী বেরিয়ে পড়ে আজাদের সঙ্গে ৷ রিকশায় সহজেই চলে যাওয়া যায় মগবাজার ৷ রেললাইনের ধারে বাসাটা ৷
মাকে ডাকে আজাদ-’মা দ্যাখো ৷ কাকে এনেছি ৷’
মা মাথায় কাপড় দিতে দিতে এগিয়ে আসেন ৷ ‘কে ?’
রুমী সালাম দেয় ৷ মা সালামের জবাব দেন ৷ আজাদ বলে, ‘রুমী ৷’
মা বিস্মিত! রুমীর চেহারা এতটা রোদে পোড়া হলো কী করে! কুশল বিনিময় শেষ করে মা রুমীর জন্যে নাশতা আনতে যান ৷ রুমী আর আজাদকে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না ৷ বরং তার উৎসাহ জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটা নিয়ে ৷
আজাদ একটা বইয়ের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে ৷ সেই কাগজে সে কপি করে রেখেছে গানটা ৷ তাকেও সে কাগজ-কলম এগিয়ে দেয় ৷ রুমী কপি করার আগে গানটা একবার পড়ে নেয় ৷
Oh friends came to me
With sadness his eyes
(রুমী ভাবে, আজাদ কপি করতে একটু ভুল করেছে ৷ ফ্রেন্ডস না হয়ে ফ্রেন্ড হলে তো গ্রামারটা ঠিক থাকে ৷)
He told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn`t feel the pain
I knew I had to try
Now I am asking all of you
To help us save some lives
Bangla Desh, Bangla Desh
Where so many people
Are dying fast.
And it sure looks like a mess
I have never seen such distress.
I want you lend your hand
Try to understand
Relieve the people of Bangla Desh
Bangla Desh Bangla Desh
Such a great disaster
I don`t understand
But it sure looks like mess
I never known such distress
Please don`t turn away
I wanna hear you say
Relieve the people of Bangla Desh…
রুমী পড়ে ৷ তার দু চোখে পানি এসে যায় ৷ বলে, ‘কত দূরে বসে একজন গায়ক বাংলাদেশের মানুষের জন্যে ভাবছে, লিখছে, গান করছে, ফান্ড কালেক্ট করছে, মানুষ যখন মানুষের জন্য করে, তখন কেমন লাগে, না!’ সে কাগজকলম নিয়ে বসে পড়ে অনুলিপি করতে ৷ আজাদও কপি করতে থাকে অন্য সহযোদ্ধাদের জন্যে ৷
মা বলেন, ‘আজাদ, চা হয়েছে ৷’
আজাদ বলে, ‘আসছি ৷’ সেও কপি করতে থাকে ৷ শাচৌকে দিতে হবে ৷ জুয়েল, কাজী কামাল-ওরাও তো চাইবে এর কপি ৷
জাহানারা ইমাম ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন ৷ বিকালবেলা ৷ রুমী বলেছে, ‘আম্মা, চলো তোমাকে এক বাসায় নিয়ে যাই ৷ তোমার মন একদম ভালো হয়ে যাবে ৷’
‘কোথায় ?’
‘আগে থেকে বলব না ৷ সারপ্রাইজ ৷’
মগবাজার চৌমাথা থেকে তেজগাঁও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার দিকে একটু এগিয়েই রেললাইন পার হয়ে গাড়ি খানিক সামনে গিয়ে ডানে একটা গলিতে ঢোকে ৷ আরো একটুখানি গিয়ে আবার ডানে ঢুকে থামে একটা একতলা বাড়ির সামনে ৷ ৩৯ বড় মগবাজার ৷ দু ধাপ সিঁড়ি উঠেই ছোট্ট একটা বারান্দা-রেলিংঘেরা ৷ এ কার বাসায় যে রুমী আনল তাকে-জাহানারা ইমাম ভাবেন ৷ তিনি দেখতে পান, বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে এক স্বাস্থ্যবান যুবক ৷ উঠে দাঁড়িয়ে আদাব দেয় তাকে ৷ রুমী বলে, ‘মা, এ হলো আজাদ ৷ একে তুমি এর ছোটবেলায় অনেক দেখেছ ৷ আগে আমরা এদের বাসায় আসতাম ৷ দাওয়াত খেতাম ৷’
জাহানারা ইমাম আজাদের মুখের দিকে ভালো করে তাকান ৷ কিন্তু মনে করতে পারেন না ৷ তিনি বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে যান ৷ আজাদের মা তার সামনে আসেন ৷ ‘আরে, এ যে সাফিয়া আপা ৷’ জাহানারা ইমাম উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ৷ আজাদের মাকে জড়িয়ে ধরেন ৷ বলেন, ‘কত দিন পরে আপনার সাথে দেখা হলো বলেন তো দশবারো বছর তো হবেই ৷’
আজাদের মা বলেন, ‘তাই হবে ৷’
জাহানারা ইমামের মনে পড়ে, তিনি শুনেছিলেন বটে যে আজাদের আব্বা আরেকটা বিয়ে করেছে ৷ তাই রাগ করে আজাদের মা ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন ৷
আজাদের মা চা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ৷ জাহানারা ইমাম বলেন, ‘আপনি বসুন, আপনার সাথে গল্প করি ৷’
আজাদের মা হাঁক ছাড়েন, ‘কচি, একটু শুনে যেও ৷ খালাম্মাকে কী খাওয়াবে ৷’ তারপর জাহানারার দিকে চেয়ে বলেন, ‘আমিও আজাদকে নিয়ে আলাদা হয়েছি, আমার বোনটাও মারা গেছে, ওর ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রেখেছি ৷ মাঝখানে কয়েক বছর অনেক কষ্ট করেছি আপা ৷ এখন তো মনে করেন আজাদ এমএ পাস করেছে ৷ দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে ব্যবসাপাতি করবে ৷ এখন তো ভালোই আছি ইনশাল্লাহ আপনাদের দোয়ায় ৷’
জাহানারা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন সাফিয়ার দিকে ৷ তাঁকে তাঁর বরাবরই মনে হয়েছে বাইরে নম্র মৃদুভাষিণী, আর ভেতরে ভেতরে দৃঢ়চেতা, কিন্তু তাই বলে এই মহিলা যে এতটা একরোখা, তা তো তিনি আগে বোঝেননি ৷ এখন আজাদের মা অনেক শুকিয়ে গেছেন ৷ আগে তাঁর ছিল স্বাস্থ্য-সুখী কান্তি ৷ এখন পরনে সরুপাড় শাদা শাড়ি, গায়ে কোনো গয়না নাই, আগে ছিল শরীরভরা গয়না, দামি শাড়ি, মুখে পান আর মৃদু হাসি, আঁচলে চাবি ৷ কী কনট্রাস্ট ৷
তবে আজাদ ছেলেটাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ সুন্দর হয়েছে ছেলেটা, স্বাস্থ্যবান ৷ মায়ের মতোই মুখে সব সময় হাসি লেগে আছে ৷
রুমী আর আজাদ অন্য ঘরে গল্প করছে ৷ এরই মধ্যে আরেকজন ছেলে আসে ৷ লম্বা ৷ ফরসা ৷ রুমী মাকে ওইঘরে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় তার সঙ্গে, ‘আম্মা, এনাকে চেন ৷ কাজী কামাল উদ্দিন ৷ উনি প্রভিন্সিয়াল বাস্কটবল টিমের খেলোয়াড় ৷ ন্যাশনাল টিমেও ডাক পেয়েছিলো ৷ কাজী ভাই যান নাই ৷ ওনার সাথে আমার দেখা হয়েছে মেলাঘরে, ট্রেনিং ক্যাম্পে ৷ এখানেও কাজী ভাইয়ের অনেক নাম ৷ হিরোইক ফাইটার ৷’