প্রসঙ্গ : সংমিশ্রিত বীর্য
পুরুষের বীর্য যে বিভিন্ন গ্ল্যান্ড-নিঃসৃত উপাদানে গঠিত একটি সংমিশ্রিত তরল পদার্থ, তা আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। কথাটা কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এভাবে:
“নিশ্চয় আমরা মানুষকে গঠন করিয়াছি সামান্য পরিমাণ সংমিশ্রিত তরল পদার্থ হইতে।”-সূরা ৭৬ (দাহর), আয়াত ২ :
এখানে যে মিশ্রিত তরল পদার্থের উল্লেখ করা হয়েছে, আরবি শব্দে তা হচ্ছে “আমসাজ। প্রাচীন তাফসীরকারকগণ এই সংমিশ্রিত তরল পদার্থ’ বলতে সাধারণ পুরুষ ও নারীর মিশ্রিত বীর্য বুঝিয়েছেন। তারা নারীর বীর্য’ বলতে সেই তরল পদার্থকে বুঝিয়েছেন যৌনমিলনেরকালে যা নারীর যোনী থেকে নিঃসৃত হয়। তাঁরা মনে করতেন যে, সন্তান-প্রজননে নারীর যোনী নিঃসৃত এই তরল পদার্থও পুরুষ-বীর্যের সমান ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিষয়টা বৈজ্ঞানিক বিচারে ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণিত। প্রকৃতপক্ষে, নারীর কোনও বীর্য নেই। প্রাচীন অনুবাদক ও তাফসীরকারগণের ‘আমসাজ’ শব্দের এই অর্থ ও ব্যাখ্যা (নারী ও পুরুষের মিশ্রিত বীর্য) তাই আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রাচীন তাফসীরকারগণ এই ব্যাখ্যাই দিয়েছেন যেহেতু তাদের সময় এই ধারণাই সর্বত্র চালু ছিল। এমনকি কোরআন যখন নাজিল হয়েছিল, তখন মানুষ এই ধারণাই পোষণ করত।
এর কারণ অবশ্য অবোধগম্য নয়। কেননা, সেকালে দেহবিজ্ঞান-সম্পর্কিত নারীর আলাদা দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কে সঠিক কোন জ্ঞান কারো ছিল না। সে-কারণে সাধারণ মানুষের মত সেকালের বিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞ তাফসীরকারগণও মনে করতেন যে, নারীরও বীর্য রয়েছে এবং সন্তান উৎপাদনে তা পুরুষ-বীর্যের সমান ভূমিকা পালন করে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রাচীনকালের বরেণ্য তাফসীরকারগণের সবাই ছিলেন ধর্মীয় জ্ঞানে সুপণ্ডিত এবং আরবী ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী। কিন্তু তাহলে কি হবে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাজাত তথ্য উপাত্ত তাঁদের নাগালের মধ্যে ছিল না। ফলে, তাঁদের অনুসরণের দরুন এ যুগেরও অনেক তাফসীরকার শুধু এ বিষয়ে নয়, কোরআনের প্রকৃতি ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহুবিষয়ে একইধরনের অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রচার করে চলেছেন।
এই স্থলে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। ‘আমসাজ’ বা ‘সংমিশ্রিত বীর্য’ যদি ‘নারী ও পুরুষের মিশ্রিত বীর্য’ হত, তাহলে শব্দটি কোরআনে ‘বহুবচনে’ না হয়ে আরবী ভাষার সাধারণ রীতি অনুসারে ‘দ্বিবচনেই’ উল্লিখিত হত। কোরআনের ভাষা সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকেফহাল, তাঁরা জানেন, এ ধরনের প্রকাশভঙ্গিতে ভাষা ব্যবহারে কোরআনের কোথাও কোন ভুল পরিলক্ষিত হয়নি। এখানে বহুবচন ব্যবহারের দ্বারা বহু উপাদানের মিশ্রণে গঠিত পুরুষ-বীর্যের কথাই বলা হয়েছে–অন্য কিছু নয়!
এই পর্যায়ে আরেকটি বৈজ্ঞানিক তথ্যের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার এবং সেই তথ্যটি আলোচ্য গবেষণার জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, নারীর যে ডিম্বাণু, তা কোনক্রমেই পুরুষ-বীর্যের মত তরল পদার্থের সংমিশ্রণ-জাত কিছু নয়। তাছাড়া, যৌনমিলনেরকালে নারীর যোনীতে যে পিচ্ছিল তরল পদার্থের নিঃসরণ ঘটে এবং জরায়ুতে যে-সব শ্লেষ্ম-জাতীয় পদার্থ বিদ্যমান, ডিম্বাণুর উর্বরতা প্রদানে তথা সন্তান-সৃষ্টিতে সে-সবের কোন ভূমিকা নেই। কেননা, সন্তান উৎপাদনের বা ডিম্বাণু নিষিক্তকরণের অপরিহার্য উপাদান ওইসব পদার্থে অনুপস্থিত।
সুতরাং, কোরআনে ‘আমসাজ’; শব্দের দ্বারা যে ‘সংমিশ্রিত তরল পদার্থের’ কথা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে পুরুষের সেই — শুক্রকীটবাহী এবং বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণে গঠিত। আধুনিক গবেষণায় বিজ্ঞান জানাচ্ছে, পুরুষের বীর্যে যে-সব উপাদান বিদ্যমান, সেগুলো নিঃসৃত হয় নিম্নলিখিত গ্ল্যান্ড বা রসস্রাবী গ্রন্থি থেকে : (১) টেস্টিক্যালস্ বা অণ্ডকোষদ্বয়; (২) সেমিন্যাল ভেসিক্যালস্ বা মৌলিক বুদবুদ কোষ; (৩) প্রোটেস্টেন্ট গ্ল্যান্ড এবং মূত্রনালী সংলগ্ন বিভিন্ন গ্ল্যান্ড।
মূলত, স্ত্রী-ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ তথা ডিম্বাণুকে উর্বরতা প্রদানের কাজটি শুধু বীর্যের দ্বারাই সাধিত হয়। এটি আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং প্রমাণিত একটি সত্য। কোরআনের অন্য এক আয়াতে প্রমাণিত এই সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে এইভাবেঃ
“অতঃপর (আল্লাহ) তৈয়ার করিয়াছেন তাহার (মানুষের) বংশধারা তুচ্ছ তরল পদার্থের সারনির্যাস হইতে।”–সূরা ৩২ (সাজদা), আয়াত ৮ :
এখানে তুচ্ছ, ঘৃণ্য বা অবজ্ঞাত বলতে বীর্যকে যতটা না বুঝানো হয়েছে তারচেয়েও বেশি বুঝানো হয়েছে সেই তরল পদার্থ নির্গত/নিক্ষিপ্তকারী পুরুষের মূত্রনালীকে–যা দিয়ে মূত্রের মত ঘৃণ্য পদার্থ নির্গত হয়। (উল্লেখ্য অনাবশ্যক যে, নারীর মূত্রনালী ও যোনীনালী এক নয়; বরং আলাদা)।
এই আয়াতে ‘তরল পদার্থের সারনির্যাস’ বলতে যে আরবী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে–ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে কর্দমের সারনির্যাস থেকে। এই ‘সুলালাত’ শব্দের আরেক অর্থ, ‘সারনির্যাস’ বা ‘কোন একটি পদার্থ থেকে নিঃসৃত অপর একটি পদার্থ,’ বা ‘নির্যাস’। এই ‘সুলালাত’ এর অপর এক অর্থ, ‘পদার্থের সর্বোত্তম অংশ’ বা ‘সারভাগ’। সুতরাং, এখানে এই ‘সুলালাত’ শব্দের দ্বারা অনিবার্যভাবেই পুরুষ-বীর্যের মধ্যস্থিত ‘শুক্রকীটের’ কথাই যে বুঝানো হয়েছে, তা বোধহয় না বললেও চলে।