প্রথমে মামুনের মনে হলো, কোথা থেকে ধোঁয়া এসে ভরে গেছে ক্যাবিন, কুণ্ডলী পাকানো নীলাভ ধোঁয়া, কেউ কি কাছেই একটা খুঁটে কয়লার ভোলা উনুন ধরিয়েছে? ক্রমে সেই ধোঁয়ার রং কালচে হয়ে এলো, দরজাটা দেখা যাচ্ছে না, ইস সিস্টার-মেট্রোনরা কেউ নজর দিচ্ছে না এদিকে, এরকম একটা অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার…
ওদের ডাকবার জন্য একটা বেল-এর সুইচ আছে, সকাল থেকে সেটা খারাপ, কেউ এখন আসবে না, কেউ জানবে না, মামুনের দম বন্ধ হয়ে যাবে…। আস্তে আস্তে সেই ধোঁয়া জমাট বেঁধে একটা মূর্তির রূপ নিতে লাগলো, মানুষ না অতিপ্রাকৃত কিছু? মামুন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চোখ বুজে আঁ আঁ করে উঠলেন।
শরীর যতই দুর্বল হোক মামুন তাঁর যুক্তিবোধ একেবারে বিসর্জন দিতে পারেন না। তিনি ভয়ও পাচ্ছেন আবার সেই সঙ্গেই মনে হচ্ছে, এরকম হতে পারে না, এরকম হতে পারে না। তবে কি মৃত্যুর আগে মানুষ চোখে এমন ভুল দেখে? কিন্তু মামুন জ্ঞান হারাতে চান না, তিনি শেষপর্যন্ত দেখে যেতে চান, তিনি আবার জোর করে চোখ খুললেন।
এবার মূর্তিটা অনেকখানি স্পষ্ট, একজন দীর্ঘকায় মানুষ, কাঁধদুটি ঈষৎ ঝুঁকে আছে, চোখে কালো চশমা, মুখ দিয়ে সত্যিই ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মামুন আরও ভয় পেয়ে গেলেন, তাঁর বুকে প্রবল ব্যথা হতে লাগলো, চোখে জল এসে গেল। তাঁর পায়ের কাছে যে দাঁড়িয়ে আছে, সত্যিকারের মানুষের মতনই তার অবয়ব, এবং মামুনের চেনা, সেইজন্যই অবিশ্বাস্য। তবে কি শয়তান এসেছে এই বেশে? সঙ্গে সঙ্গে মামুন ভাবলেন, না, না, শয়তান টয়তান কিছু আসে না, ওসব কুসংস্কার, তিনি হার মানবেন না। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন।
দীর্ঘকায় মানুষটি বললো, মোজম্মেল হক সাহেব, ঘুম ভাঙালাম নাকি? আছেন কেমন?
এই সেই মুসাফির, চোখে সানগ্লাস, মুখে চুরুট। এখনও মামুনের মনে হচ্ছে, এটা কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা। ভারতে আসার পর চার মাসের মধ্যেও মামুন কখনো মুসাফিরের সন্ধান। পাননি, কারুর মুখে এর কথা শোনেনওনি, সেই লোক হঠাৎ এসে কী করে দেখা দিল সন্ধেবেলা হাসপাতালের ক্যাবিনে?
মামুন বালিশের তলা হাতড়াতে লাগলেন। এক্ষুনি সরবিট্রেট জিভে দিতে না পারলে তাঁর দম বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি সহ্য করতে পারছেন না, এত উত্তেজনা কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।
মুসাফির একটু কাছে এসে বললেন, কী খোঁজেন? ওষুধ? শরীর খারাপ লাগছে?
আধখানা সরবিট্রেট জিভের তলায় দিয়ে মামুন কয়েক পলক চোখ বুজে থেকে মনটাকে বশে আনবার চেষ্টা করলেন। ক্যাবিনের মধ্যে চুরুটের সামান্য ধোঁয়া ছাড়া আর ধোঁয়া নেই, কিন্তু জানলার বাইরেটা অন্ধকার, ভেতরেও আলো জ্বালা হয়নি, এরই মধ্যে সন্ধে হয়ে এলো? অথচ হেনা-মঞ্জুরা এলো না?
মুসাফির আরও কিছু বলে যাচ্ছিলেন, মামুন হঠাৎ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত, দৃঢ় গলায় বললেন, আপনি এখানে?
মুসাফির হেসে বললেন, আমিও তো আপনার মতন এই হাসপাতালেরই রুগী। আমি আছি তিনতলায়। আজ দুপুরেই আপনাকে প্রথম দেখতে পেলাম।
অতি সাধারণ ও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা। দু জনে একই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু না। এই চার মাস মুসাফিরের সঙ্গে দেখা হয়নি, দৈবাৎ তিনি এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলেই দেখা হয়ে গেল। এই দিকটা মামুন চিন্তা না করেই কেন অত ভয় পেয়েছিলেন? তাঁর মনের একটা দিকে কি প্যারালিসিস হয়ে গেছে?
মুসাফির জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী হয়েছে, হার্ট?
এই লোকটা জ্যোতিষী না ভবিষ্যদ্বক্তা কী যেন! কিন্তু মামুন যে হার্ট পেশেন্ট হিসেবে এই ক্যাবিনে শুয়ে আছেন, তা জানার জন্য ওসব কিছু লাগে না।
শিয়ালদার কাছে মামুন একদিন বিকেলে বুকে অসহ্য ব্যথা বোধ করার পর চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন। তিনি নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন রাস্তায়। এই ভিড়ে-ভরা নিষ্ঠুর শহর, এখানে কেউ কারুর দিকে ফিরেও তাকায় না, বিকেলবেলা অফিস ভাঙার পর ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা পাগলের মতন স্টেশনের দিকে ছোটে। লোকের পায়ের ধাক্কায় মামুন সেদিনই শেষ হয়ে যেতে পারতেন। তাঁর পরম সৌভাগ্য, কয়েকজন পথচারী ধরাধরি করে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল কাছাকাছি নীলরতন সরকার হাসপাতালে। মামুনদের কলেজ-জীবনে এর নাম ছিল ক্যাম্পবেল হাসপাতাল, এখনও মামুনের সেই নামটাই মনে পড়ে।
প্রথমে তিনি স্থান পেয়েছিলেন জেনারেল বেডে, জ্ঞান ফেরার পরই তিনি একটা খবর দিতে বলেছিলেন বাংলাদেশ মিশনে। তিনি জয় বাংলার লোক শুনেই তরুণ ডাক্তাররা তাঁকে খাতির করতে লাগলেন, তাঁকে সরিয়ে আনা হলো ক্যাবিনে। ঠিক হার্ট অ্যাটাক নয়, মামুনের হৃদরোগটির নাম অ্যানজাইমা পেকটোরিস। সবাই বলছে, ততটা ভয়ের কিছু নেই।
বাইরে এখন গাঢ় অন্ধকার, সন্ধে পেরিয়ে রাত নামছে, আজ তা হলে হেনা-মঞ্জুরা আর আসবেই না তাঁকে দেখতে! আদালত এত কাছে, প্রতাপও এলো না? হাসপাতালের রুগীদের কাছে রোজ রোজ আসতে কারই বা ভালো লাগে। অন্য কেউ আসেনি, তাই মুসাফির এসেছে।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী জন্য ভর্তি হয়েছেন এখানে?
মুসাফির বললেন, আমার হৃদয় দৌর্বল্য নেই, তবে পাকস্থলীতে বড় রকমের ক্ষত হয়েছে। মনে হয়। কোনো কিছুই খেয়ে হজম করতে পারি না।
–আপনি সেই সিক্সটি ফাইভে ঢাকায় গিয়ে আটকা পড়েছিলেন, তারপর কবে এদেশে ফিরে এলেন কিছুই খবর পাইনি।
–আপনাদের জেলখানার দানাপানি খাওয়া আমার কপালে লেখা ছিল বোধহয়। আমার আর খবর বিশেষ কিছু নাই। মফস্বলে থাকি, বহরমপুরের দিকে, কলকাতায় বিশেষ আসি না। ওখানে চিকিৎসায় কোনো কাজ হলো না। কবি জসিমুদ্দিন কেমন আছেন? উনি কি ঢাকাতেই রয়ে গেলেন?
–আমি ঠিক জানি না।
–গোবিন্দচন্দ্র দেব, মনিরুজ্জামান এনারা সত্যিই খুন হয়েছেন? কাগজে পড়েছি, তবু বিশ্বাস হয় না। সেবারে এদের দু জনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল।
উত্তর না দিয়ে মামুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পচিশে মার্চের ঘটনা বাড়িয়ে বলার কিছু নেই, যে-সব বীভৎস ব্যাপার ঘটেছে তার একাংশ শুনলেও এখানে অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। ভারতীয় নগর-জীবনে সামরিক বাহিনীর কোনো তাণ্ডব এ পর্যন্ত ঘটেনি, তাই এরা কল্পনাও করতে পারে না ব্যাপারটা।
হাই হিল জুতোর টক টক শব্দ করে একটি নার্স এই ক্যাবিনে এসেই মুসাফিরকে ভর্ৎসনা করে বললেন, আপনি এখানে চুরুট খাচ্ছেন? আপনারা কি হাসপাতালের কোনো নিয়ম মানবেন না? পাশের হলঘরটায় পর্যন্ত গন্ধে টেকা যাচ্ছে না!
মুসাফির কাঁচুমাচুভাবে বললেন, আপনাদের কাছ থেকে ধমক খাবার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এবার ফেলে দিচ্ছি। এই বদ নেশা কিছুতেই ছাড়তে পারি না যে!
মামুন ভাবলেন, ঐ চুরুটের গন্ধের অনুষঙ্গেই তিনি অতখানি ধোঁয়ার দৃশ্য কল্পনা করেছিলেন। বোধহয়। আজ,আটদিন হলো তিনি একটাও সিগারেট খাননি, ডাক্তাররা বলছে, আর কখনো খাওয়া চলবে না। তবু চুরুটের গন্ধে তাঁর মনটা চনমন করছে।
আলোটা জ্বেলে দিয়ে নার্সটি একটি থার্মোমিটার মামুনের মুখের মধ্যে ভরে দিলেন যান্ত্রিকভাবে। তারপর ঘড়ি দেখতে লাগলেন।
জানলার কাছে গিয়ে চুরুটটা নিবিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে মুসাফির বললেন, কী মেঘটাই না করেছে! মোটে সোয়া তিনটে বাজে, এর মধ্যে মনে হচ্ছে যেন রাত্তির হয়ে গেল। এ বছর বন্যা না ডাকিয়ে ছাড়বে না।
মামুন চমকে উঠলেন। মুখের মধ্যে থার্মোমিটার, তাই কথা বলতে পারছেন না। মাত্র দুপুর সোয়া তিনটে? মেঘের জন্য আকাশ অন্ধকার? তা হলে তো হেনা-মঞ্জু কিংবা প্রতাপের আসার সময় যায়নি! অথচ রাত হয়ে গেছে ভেবে মামুন ওদের ওপর অভিমান করছিলেন!
ভুল বোঝাবুঝি, কত সামান্য কারণে ভুল বোঝাবুঝি! একটা দিকের ওপর বেশি ঝোঁক দিলে অন্য দিকটা আর দেখাই হয় না। তারই জন্য রাগারাগি কিংবা মনে মনে কষ্ট পাওয়া। আগে তো মামুনের মধ্যে এরকম অস্থিরতা ছিল না!
মামুনের অসুস্থতার খবর পেয়ে এত ব্যস্ততার মধ্যেও মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এই হাসপাতালে। তিনি মামুনের স্ত্রীর দিক দিয়ে কিছুটা আত্মীয় এবং এককালের বন্ধুও বটে। তিনি বলেছিলেন, তোমার হার্টে ব্যামো হয়েছে শুনে আশ্চর্য হই নাই, বুঝলে মামুন। এই যে যুদ্ধের অংগজাইটি, আনসার্টেনিটি, এর ফলে অনেকেরই হার্ট ডিজিজ হবে, ডায়াবিটিস হবে, হইতে বাধ্য! এই সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখাই সবচেয়ে শক্ত কাজ!
নার্সটি টেম্পারেচার নিয়ে চলে যেতেই মামুন মুসাফিরের দিকে তাকিয়ে ব্যগ্রভাবে বললেন, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? যদি আপনি কিছু মনে না করেন, কিংবা আপত্তি না থাকে…
মুসাফির বললেন, হার্ট ট্রাবল থাকলে সবসময় মন খোলসা করা উচিত, মনের মধ্যে কিছু চেপে রাখবেন না। বলুন!
–আপনি সবসময় চোখে কালো চশমা পরে থাকেন কেন? এমনকি ঘরের মধ্যেও, অন্ধকারে–
বেশ জোরে একটা নাটকীয় ধরনের অট্টহাসি দিয়ে মুসাফির বললেন, এটা বোঝেননি? নিজেকে বেশ একটা রহস্যময় চরিত্র বানিয়ে রাখার জন্য…আমার চশমা খুললে আমার চক্ষুদুটো দেখলে আপনি আঁতকে উঠবেন, না দেখাই ভালো!
–আপনার আসল নাম কী? সবাই আপনাকে মুসাফির বলে,
–অতি সিম্পল ব্যাপার। বাপ-মা আমার নাম রেখেছিল রেজাউল করীম। এই নামে একজন লেখক ছিলেন, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই? আমি যখন একটু-আধটু লিখতে শুরু করি, তখন যাতে কনফিউশান না হয়, সেইজন্য পেন-নেম নিয়েছিলাম মুসাফির। এইটাই এখন নিজের নাম হয়ে গেছে। পোস্টঅফিসে নাম সই করি মুসাফির খান!
–মুসাফির, আপনি তো দূরদর্শী মানুষ। আপনি বলেন তো, আমাদের এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিণতি কী হবে? কতদিন এই যুদ্ধ চলবে?
–এই যুদ্ধের পরিণতিতে আপনাদের কপালে অশেষ দুর্গতি ভোগ আছে।
–অ্যাঁ? সে কী? আমরা স্বাধীনতা পাবো না?
–কেন পাবেন না? স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিণতিতে স্বাধীনতা আসেই। কিন্তু তাতে আপনাদের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচবে, তা কে বলেছে? ভারতও তে স্বাধীন, কিন্তু এদিকের মানুষের দুঃখ কষ্ট কমেছে, না বেড়েছে?
–আপাতত স্বাধীনতা পাওয়াটাই বড় কথা। সেটা যদি পেয়ে যাই
–সেটা নির্ভর করছে স্বাধীনতা বলতে কে কী বোঝে তার ওপর। কার কাছ থেকে স্বাধীনতা, কাদের জন্য স্বাধীনতা? আপনারা স্বাধীনতা পাবার জন্য তড়িঘড়ি ভারত ভাগ করে ফেললেন। তখন তোত ভেবেছিলেন–
–আমরা ভারত ভাগ করেছি?
–আপনারা সবাই তখন মুসলিম লীগের সাপোটার ছিলেন না? আপনারা তখন অবাধ্য বালকের মতন পাটিশানের জন্য ঝুলোঝুলি করেননি?
–মুসাফির, আপনি কী বলছেন? আমাদের পার্টিশান চাওয়ার পিছনে কতগুলো কারণ ছিল। তা ভেবে দেখবেন না? কারা আমাদের বাধ্য করেছিল? সে সময়কার কংগ্রেস মুভমেন্টের ইতিহাস ভালো করে খুঁটিয়ে দেখুন, সবসময় হিন্দু কমিউনালিজম আধিপত্য বিস্তার করে ছিল। আপনার মনে নেই, জিন্না সাহেব যখন কংগ্রেসের নেতা, তখনও গুজরাটের বেনিয়া গান্ধী জিন্না সাহেবকে মুসলিম লীডার বলেছেন? আসলে ওরা নিজেরাই কখনো ভুলতে পারেনি যে ওরা জাতীয়তাবাদী, কংগ্রেসী বা ভারতীয় ইত্যাদি যাই হোক না কেন, তারচেয়েও বড় পরিচয়, ওরা হিন্দু! সুতরাং আমাদেরও মুসলিম আইডেনটিটি রক্ষা করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল, সেইজন্যই আমরা পাকিস্তান চেয়েছিলাম।
–বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবাংলা, আসামের কোটি কোটি মুসলমানকে ফেলে রেখে, তাদের ভাগ্য অনিশ্চিত রেখে, আপনারা পাকিস্তান নিয়ে সরে পড়লেন।
–হয়তো সব দিক বিবেচনা করা হয়নি। মুসাফির সাহেব, আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনি নিজে মুসলমান হয়ে সেই চল্লিশের দশকে আপনিও কি পাকিস্তানের দাবি সাপোর্ট করেননি?
–হয়তো করেছিলাম। কিন্তু সেই চাওয়াটা যে সঠিক হয়েছিল তার তো কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না! এই চব্বিশ বছরে যে-সব ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেল, পাটিশান না হলে হয়তো এরচেয়ে বেশি কিছু নাও ঘটতে পারতো! এই একটা জীবনে যত ট্রাজেডি আমরা দেখলাম, তারচেয়ে আর কী বেশি হতে পারে? আপনারা মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়ার দু’ চার বছরের মধ্যেই পূর্ব আর পশ্চিমে বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠলো। বাজেনি?
–তখন বুঝিনি যে এক ধর্মের মানুষ হলেও অত্যাচারী, শোষকরা ক্ষান্ত হয় না। তারা ঠিকই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে!
–এখন বুঝি ভাবছেন, এক ভাষাভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র হলেই অত্যাচারী, শোষক আনডেমোক্রাটিক ফোর্সগুলো মাটির তলায় লুকোবে? মুনাফা আর ক্ষমতার নেশায় যারা শত-সহস্র মানুষকে বঞ্চিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না, তারা কখনো ধর্ম কিংবা ভাষার তোয়াক্কা করে? ভাষা-সংস্কৃতির ব্যাপারটা অনেকটাই ইনটেলেকচুয়ালদের ধোঁকাবাজি, আমাদের মতন দেশের সাধারণ মানুষদের ওতে কিছু যায় আসে না!
–আপনি এত পেসিমিস্টিক কথা বলছেন, আপনি কি বলতে চান, আমাদের এই স্বাধীনতার জন্য লড়াইটা ভুল? সিকস্টি নাইনের পর আমাদের ওখানে কী সিচুয়েশন হয়েছিল আপনি বুঝবেন না। ইস্ট পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না।
–মার্ক টোয়েনের সেই কথাটা মনে নেই? পূর্ব হচ্ছে পূর্ব আর পশ্চিম হচ্ছে পশ্চিম, এই দু’ জনের কখনো মিল হতে পারে না?
–আপনি ঠাট্টা করছেন। আপনি ঠাট্টা করছেন আমার সঙ্গে?
–আহা, অত উত্তেজিত হবেন না, মামুন সাহেব। আমি ঠাট্টা-ইয়ার্কির সুরে ছাড়া কথা বলতে পারি না। এই জন্যই তো আমার জীবনে কিছু হলো না। প্লিজ টেক নো অফেন্স। এবার একটা অন্য কথা বলি! আপনার কপালে যে ভাঁজ দেখতে পাচ্ছি, সে তো শুধু স্বাধীনতার জন্য দুশ্চিন্তা নয়। আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও দুশ্চিন্তা অতি প্রবল।
–হোয়াট ডু ইউ মীন?
–আপনি আপনার জীবন থেকে নারীদের বাদ দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো এক নারীই আপনার মনটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। আপনার বুকের ব্যথার কারণও সেইটাই।
–শুনুন মুসাফির সাহেব, আমি জ্যোতিষ-ট্যোতিষদের শালাটান মনে করি। এইসব বোগাস ফোরকাস্ট শুনে আমি ইমপ্রেসড হই না। আপনি এই ধরনের কথা আমাকে আগেও বলেছিলেন। আমার জীবনে কোনো রহস্যময়ী নারী-টারী নেই, অন্তত বছর পনেরো ধরে আমি সে রকম কোনো নারীর কথা চিন্তাই করি না। আমার সে মনোবৃত্তি নাই, সময়ও নাই!
–কোনো নারীর কথা চিন্তা করেন না, তা হলে কবিতা লেখেন কী করে?
–শুধু নারীর কথা চিন্তা করলেই কবিতা লেখা যায়, এরকম কথা যে বলে সে গণ্ডমূর্খ। দ্বিতীয়ত, আমি অনেকদিন কবিতা লিখি না, হয়তো আর কোনোদিন লিখতেও পারবো না! আপনি একদিন ঢাকায় আমার প্রতি ঐ অ্যাপারসন দেবার পর আমি নিজেকে অনেক ভাবে অ্যানালাইজ করেছি। অন্য নারী বলতে আমার বড় আপার মেয়ে মঞ্জু, তাকে আমি স্নেহ করি, হয়তো একটু বেশিই স্নেহ করি, কিন্তু তা স্নেহ ছাড়া আর কিছুই না, এর মধ্যে কোনো আমিষ। সম্পর্ক নাই। আপনারা বুঝি এই স্নেহের সম্পর্কটাকেও অন্য একটা কালার না দিলে শান্তি পান না?
–বিদ্যাসাগর মশাই লিখেছেন জানেন না, স্নেহ অতি বিষম বস্তু! কখনো কখনো অতিরিক্ত স্নেহ প্রেমের চেয়েও মারাত্মক হয়। ভালোবাসার তবু প্রতিদান পাওয়া যায়, কিন্তু স্নেহের প্রতিদান বড়ই দুর্লভ।
–স্নেহ নিম্নগামী!
–অবশ্যই, অবশ্যই। তবু মানুষ তা মানতে চায় না, বুকে জ্বালা ধরে থাকে, মনে হয় সমস্ত পৃথিবীটাই অকৃতজ্ঞ।
বাইরে কয়েকটি কলকণ্ঠ শোনা গেল, মামুন বুঝতে পারলেন যে হেনা-মঞ্জুরা এসে গেছে। ঠিক চারটের সময় ওরা আসে।
মুসাফির ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনার ভিজিটার এসে গেছে, এবার আমি চলি!
মামুন ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না, আপনি বসেন। ওদের সাথে আলাপ করবেন। আপনার সাথে আমার আরও কথা আছে।
মুসাফির বললেন, আমার কাছেও এখন ভিজিটার আসবে, আমি যাই। আর একদিন হবে!
ক্যাবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে মঞ্জু কথা বলছে নার্সের সঙ্গে, সে ভেতরে আসবার আগেই মুসাফির বেরিয়ে গেলেন। মামুনের আবার একটা অযৌক্তিক চিন্তা ও ভয় মাথায় খেলে গেল। মুসাফির সাহেব কি সত্যিই পেসেন্ট হিসেবে এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন? নাকি একটি দুষ্ট আত্মার মতন তিনি হঠাৎ উদয় হয়ে ভয় দেখিয়ে গেলেন?
হেনা-মঞ্জুর সঙ্গে এসেছে বরুণ আর পলাশ। হেনা দৌড়ে বাবার কাছে এসে হাত ধরে বললো, রাস্তায় কী বৃষ্টি, আলু, এক হাঁটু পানি জমে গেছে।
মামুন মেয়ের মাথায় অন্য হাত রেখে দেখলেন, তার চুল ভেজা, কানের লতির পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসছে বিন্দু বিন্দু জল। তিনি বললেন, ইস ভিজে ভিজে আসলি, একটু দেরি করতে পারলি না! তোয়ালে আছে, মাথা মুছে নে!
মঞ্জু বললো, মামুনমামা, আজ তোমার জ্বর মোটে নাইন্টি নাইন পয়েন্ট টু! ব্লাড রিপোর্টও ভালো।
মামুন মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারলেন না। আজ যেন তাকে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি পরেছে, চুলগুলো সব খোলা, মুখখানা এত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কেন? যেন সারা মুখে চিকচিক করছে অভ্রবিন্দু, ঠোঁটে লিপস্টিক মেখেছে নাকি, না, মঞ্জু ওসব ব্যবহার করে না, অন্তত কলকাতায় এসে কোনোদিন করেনি। এখন আর কবিতা না লিখলেও সৌন্দর্যপ্রিয়তা তো মামুনকে ছেড়ে যায়নি, নিজের ভাগ্নী হলেও মঞ্জুর রূপ দেখে তিনি মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। কিন্তু সে তো শুধু মুগ্ধতাই, আর কিছু না!
মঞ্জু আজ একটু বেশি সাজগোজ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার স্বামীর আজও কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি, সেই দুশ্চিন্তার কোনো ছাপ নেই মঞ্জুর মুখে। মামুন অসুস্থ, হাসপাতালে তাঁকে দেখতে আসার জন্য মঞ্জু এত সেজেছে, এটা নির্লজ্জতা নয়? মামুনের মনটা কুঁকড়ে গেল।
বরুণ বক্সী বললো, মামুন সাহেব, আপনি তো আজকে বেশ ভালো আছেন, নার্স-ডাক্তাররা কইলো। খুব ফ্রেস দেখাইত্যাছে। আর কয়দিন এরকম হাসপাতালে শুইয়া থাকবেন? এবার বাড়ি চলেন!
মামুন জোর করে হাসলেন। এদিকের যাদের একসময় পূর্ববঙ্গে বাড়ি ছিল, তারা এখন জয় বাংলার মানুষ দেখলেই বাঙালভাষা ঝালিয়ে নিতে চায়। এতদিনের অনভ্যাসে অনেকেরই ঠিক সুরটা আর হয় না, ভুল জায়গায় অ্যাকসেন্ট দেয়, শুনতে বেশ মজাই লাগে।
মামুন বললেন, আমি তো বাসাতেই ফিরে যেতে চাই। তোমরা ব্যবস্থা করো।
বরুণ বললো, ডাক্তার বললেন, আপনি নাকি একেবারে হাঁটেন না? সারাদিন শুইয়া থাকেন? একটু হাঁটা চলা করা হার্টের পক্ষে ভালো। ওঠেন, ওঠেন, আমার হাত ধরেন, বারান্দায় আপনারে হাঁটাইয়া নিয়া আসি।
মামুন বললেন, এখন থাক। এখন তোমরা এসেছে, গল্প করা যাক।
বরুণ একেবারে মামুনের মুখের কাছে মুখ এনে গোপন কথা বলার সুরে বললো, মামুন সাহেব, কাল আমরা কয়েকজন বড়ারে যাবো, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে, ওষুধ আর ওয়্যারলেস সেট, গাড়িতে যাওয়া হবে, মঞ্জু আর হেনাও যেতে চাইছে আমাদের সঙ্গে। ওদের নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?
মামুন সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, না, বর্ডারে ওরা যাবে? আউট অফ কোয়েশ্চেন। আমাদের কতরকম শত্রু আছে, এখানকার বিহারী মুসলমানরা ক্ষেপে আছে। আমাদের ওপর…
বরুণ বললো, আপনার পারমিশন না নিয়ে ওদের নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভোরবেলা বেরিয়ে আমরা দিনে দিনেই ফিরে আসবো, তবু বলা তো যায় না, গাড়ি খারাপ হতে পারে, রাত হয়ে যেতে পারে, আমারও মনে হয় ওদের না যাওয়াই ভালো।
হেনা বললো, আব্ব, কিছু হবে না, আমরা যাই না?
মামুন মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে কঠোরভাবে বললেন, না!
বরুণ বললো, মামুন সাহেব, আপনি ভালো করে বলে দ্যান তো। ওরা আমাদের কথা শুনতে চায় না। বড়ারে যাওয়া এখন সত্যি রিস্কি, মাঝে মাঝে গুলিগোলা ছুটে আসে এদিকে।
পলাশ কোনো কথা বলছে না, মামুনের চোখে চোখ পড়তেই সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। পলাশ। ঠিক বুঝেছে যে মামুন তাকে ইদানীং একটুও পছন্দ করতে পারেন না। অন্য কেউ হয়তো টের পায়নি, কিন্তু তাঁরা পরস্পর কথা খুব কম বলেন। মামুন হাসপাতালে, এই সুযোগে তার বাসায় এখন পলাশরা নিয়মিত আড্ডা জমায়। ভাবলেই মামুনের গা জ্বলে। সেইজন্যই তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যেতে চান। বরুণ রোজ এখানে আসে না, কিন্তু পলাশ প্রত্যেকদিন মঞ্জু আর হেনাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে আসে। ওর এত দরদ কিসের?
মুসাফিরের চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধ এখনও যেন পাওয়া যাচ্ছে একটু একটু! হঠাৎ মামুনের মনে হলো, পলাশের ওপর তিনি যে রাগ করছেন, সেটা কি আসলে ঈষা? নাকি অভিভাবকসুলভ সতর্কতা? মঞ্জু-হেনাকে কেউ না নিয়ে এলে ওরা হাসপাতালে দু বেলা আসতো কী করে? ওরা কি কলকাতা শহরের রাস্তা চেনে? আজ অত বৃষ্টির মধ্যে ওদের আসা তো অসম্ভব ছিল।
সেই মুহূর্তে মামুন ঠিক করলেন, পলাশকে তিনি ক্ষমা করবেন। পলাশের কোনো কুমতলবের এখনো ঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেদিন বর্ধমান থেকে ফেরার পথে চন্দননগরের কাছে ওদের গাড়ি বিকল হয়েছিল, পলাশ অত রাতে কোথা থেকে যোগাড় করেছিল একটা ট্যাক্সি। বাংলাদেশের শিল্পীরা এটা পারতো না, পলাশ সঙ্গে না থাকলে ওদের আরও বিপদ হতো, এসব কথা মামুন পরে শুনেছেন।
মামুন পলাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও কাল যাচ্ছো নাকি বর্ডারে?
পলাশ বিনীতভাবে বললো, আজ্ঞে না, কাল দুপুরে আমার একটা রেকর্ডিং আছে।
তা হলে মঞ্জু-হেনাকে নিয়ে বর্ডারে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাটা পলাশের নয়! বরুণও ওদের নিয়ে যাবার জন্য খুব আগ্রহী নয়, হেনা-মঞ্জুই জোর করেছিল। মঞ্জু-হেনা এখনও যুদ্ধের গুরুত্বটা বোঝে না। পাকিস্তানী বাহিনী নতুন করে শক্তিশালী হয়েছে, মুক্তি বাহিনীর দখলীকৃত এলাকাগুলো প্রায় সবই ছিনিয়ে নিয়েছে আবার।
তিনি বরুণকে বললেন, তুমি বড়ারে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছো, খুব সাবধানে, আমার অনুরোধ, বেশি ঝুঁকি নিও না।
বরুণ হেসে বললো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি একটা কাঠবিড়ালীর মতনও সামান্য একটু সাহায্য করতে পারি, তাতেই আমার জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে! আপনি চা খেয়েছেন…মামুন সাহেব? আনাবো?
মামুন উত্তর দেবার আগেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপ। মাথার চুল এবং জামা একেবারে চুপচুপে ভেজা, হাতে একটা বড় সন্দেশের বাক্স। প্রত্যেকদিনই প্রতাপ মিষ্টি কিংবা গাদাখানেক কমলালেবু-আপেল আনবেনই, কোনো দরকার নেই আনবার, বারণ করলেও শুনবেন না প্রতাপ। মালখানগরের মজুমদাররা বোধহয় কখনো খালি হাতে হাসপাতালে যায়
মামুনের আহারের রুচি ফেরেনি, মিষ্টি কিংবা ফলটল কিছুই তাঁর খেতে ইচ্ছে করে না। ওসব ভিজিটাররাই খায়। বরুণ বলে উঠলো, এই তো হাকিম সাহেব সন্দেশ এনেছেন। দ্যান দ্যান, আমার বেশ ক্ষুধা পাইছে।
প্রতাপের হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে বরুণ সবাইকে ভাগ করে দিতে লাগলো, মামুনকেও একটা সন্দেশ জোর করে খাইয়ে ছাড়লো। মামুন ভাবলেন, এই হাসিখুশি দিলখোলা ছেলেটির হঠাৎ কোনো বিপদ হবে না তো? এদিককার দু’ জন সাংবাদিক-ফটোগ্রাফার জোর করে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছিল, তাদের নাকি আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
মিষ্টি খাওয়ার পর বরুণ কী করে যেন সকলের জন্যই চায়ের ব্যবস্থা করে ফেললো।
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, প্রতাপ, দিদি কেমন আছেন?
প্রতাপ সামান্য মাথা নেড়ে বললেন, ভালো।
অর্থাৎ সুপ্রীতি ভালো নেই, কিন্তু সে বিষয়ে প্রতাপ মামুনকে বিশেষ কিছু জানাতে চান না। প্রতাপ রোজ একবার করে না এলে মামুন ক্ষুব্ধ হন, অথচ তিনি জানেন, সুতির কাছেও যেতে হয় প্রতাপকে, প্রতিদিন দুটি হাসপাতালে যাওয়া-আসা করা কি সোজা কথা! প্রতাপের সারা মুখে ক্লান্তির ময়লা ছাপ। বৃষ্টিভেজার জন্যও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
সমস্ত রাস্তায় জল জমেছে, ট্রাফিক বিপর্যস্ত, বাড়ি ফিরতে কত সময় লাগবে কে জানে! প্রতাপ উঠে পড়লেন একটু আগেই। মঞ্জুরা গেল শেষ ঘণ্টা বাজার পর। মামুন ওদেরও তাড়া দিচ্ছিলেন ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু শেষপর্যন্ত থেকে গেল ওরা।
হঠাৎ ক্যাবিনটা একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতন নির্জন হয়ে গেল। এক হিসেবে জেনারাল ওয়ার্ড তবু ভালো, পাশাপাশি অন্য মানুষ দেখা যায়, নার্স-ডাক্তারদের চলাফেরা দেখা যায়। এরপর একজন খাবার দিতে আসবে, এখানকার বড় ডাক্তার রাউন্ডে আসবেন রাত সাড়ে আটটার পর। বৃষ্টির মধ্যে কি তিনি আসতে পারবেন আজ? হেনা-মঞ্জুরা চলে যাবার পর প্রত্যেকদিনই শরীরটা দুর্বল লাগে।
হেনা একবার বলে ফেলেছিল যে আজ সন্ধেবেলা মহাজাতি সদনে বড় একটা অনুষ্ঠান আছে। পলাশ তাড়াতাড়ি সেটা চাপা দিয়ে বলেছিল, এত বৃষ্টিতে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে!
সেইজন্যই মঞ্জু অত সেজেছে আজ। হাসপাতালে মামুনকে দেখার জন্য নয়, এখান থেকে বেরিয়ে মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠান শুনতে যাবার প্ল্যান ছিল!
মামুনের বুকটা চিড়চিড় করতে লাগলো। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন, আর ওরা ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানের কথা মঞ্জু তো নিজের মুখে কিছু বলেনি, সে কি গোপন করতে চেয়েছিল? এখান থেকে বেরিয়ে ওরা কি সত্যি বাড়ি ফিরবে, না একবার মহাজাতি সদন পর্যন্ত দেখতে যাবে যে সত্যি অনুষ্ঠানটা বন্ধ হয়েছে কি না।
মামুন নিজের বুকে হাত বুলাতে লাগলেন। এত উত্তেজনা ভালো নয়। পলাশকে তিনি ক্ষমা করতে চেয়েছিলেন, তবু তার ওপর আবার এত রাগ হচ্ছে কেন? তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন বলেই ওরা বাড়িতে চুপ করে বসে থাকবে? মহাজাতি সদনে একটা অনুষ্ঠান শুনতে গেলে তাতে দোষের কী আছে? যৌবনের ধর্মই তো এই, তারা অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তা করে বর্তমানটাকে অবহেলা করে না বুড়োদের মতন। গাড়ি-ঘোড়া না পেলে ওরা হেঁটেই যাওয়ার চেষ্টা করবে মহাজাতি সদনের দিকে। রাস্তায় এক হাঁটু পানির মধ্যেও ওরা লাফালাফি করবে, মঞ্জু ধরেছে পলাশের হাত, কৌতুক-হাস্যে দুলে দুলে উঠছে, মামুন যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পেলেন দৃশ্যটা!
মামুন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন, মনটাকে আবার স্ববশে আনলেন। বুকটা ঘষে ঘষে তিনি যেন তাড়িয়ে দিতে চাইলেন রাগ-দ্বেষ। ওদের পক্ষে এইটাই তো স্বাভাবিক। ওরা হাঁটুক মহাজাতি সদনের দিকে, আজ যেন সেখানে অনুষ্ঠান বন্ধ না থাকে। ভবিষ্যতে আরও কত কষ্ট-দুর্দিন অপেক্ষা করে আছে কে জানে, হেনা-মঞ্জুরা এখন যে-কটা দিন পারে আনন্দ করে নিক!