নবীনকুমারের বিবাহে যেমন জাঁক হলো, তার তুল্য কিছু সাম্প্রতিক কালের কলকাতায় আর ঘটেনি। এ শহরে রাজা মহারাজাদের অন্ত নেই, তা ছাড়া নতুন কালের শ্রেষ্ঠী যারা, তাদেরও অতুল ধনসম্পদ। দত্ত, মলিলক, দেব, শীল, সরকার, ঘোষাল—এই সব এক একটি পরিবারে শ্রাদ্ধ, বিবাহে প্রচুর ধুমধাম আর টাকার ছড়াছড়ি হয় বটে, কিন্তু পরলোকগত রামকমল সিংহের বিধবা পত্নী বিম্ববতী একেবারে সকলকে টেক্কা মেরে গেলেন। লোকে বলাবলি করতে লাগলো, রামকমল সিংগী বেঁচে নেই, তাতেও এত জোস, আর তিনি বেঁচে থাকলে না জানি আরও কী হতো! লোকে আরও বললো, হ্যাঁ, একেই বলে সোদরোপম বন্ধু! নাবালকের সম্পত্তি চিরকাল বার ভূতে লুটে খায়, আর বিধু মুখুজ্যে তাঁর বন্ধুর নাবালক পুত্রের সম্পত্তি যেন চার গুণ বাড়িয়ে দিয়েচেন।
নবীনকুমারের বিবাহ হলো বাগবাজারে। বর যখন শোভাযাত্রা করে যায়, তখন তাকে দেখবার জন্য শহর। সুদ্ধ লোক যেন ভেঙে পড়েছিল। জুড়িগাড়ির বদলে বর গিয়েছিল অশ্বারোহণে, তার জন্য একটা বিশেষ পোশাক তৈরি করানো হয়েছিল, যাতে সাচ্চা হীরা-মোতি-চুনী-পান্নার ঝালর, মাথায় উষ্ণব, আর কোমরবন্ধের তলোয়ারের খাপে সোনার কাজ করা। ত্ৰয়োদশ বর্ষের কিশোর নবীনকুমারের সে কি রূপ, যেন তাকে স্বপ্নের দেশের রাজকুমার বলে বোধ হয়।
বিবাহ উপলক্ষে বাই নাচ হয়েছিল সাত দিন ধরে। ইদানীংকালের কেতা অনুযায়ী সাহেব-বিবি এবং দেশীয় ব্যক্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন দিনে। নিমন্ত্রিতদের প্রত্যেকের কাছে পত্রের সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল পিতলের ঘাড়া বা থালা, অথবা কাশ্মীরী শাল বা কাশীর বস্ত্র অথবা রৌপ্য বাঁধানো শঙ্খ ও লোহা। সকল সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হলো নবীনকুমারের বিবাহের উৎসবের বর্ণনা।
এত বড় অনুষ্ঠানে গঙ্গানারায়ণের কোনো ভূমিকাই ছিল না, ব্যবস্থাপনার সমস্ত দায়িত্ব বিধুশেখর নিজের হাতে রেখেছিলেন। তিনি কোনো বিষয়েই গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে একবারও পরামর্শ করার প্ৰয়োজনীয়তা বোধ করেননি, প্রকাশ্যেই তিনি গঙ্গানারায়ণের প্রতি অবজ্ঞা প্ৰদৰ্শন করেছেন।
গঙ্গানারায়ণ বাল্যবিবাহের ঘোর বিরোধী, সে নিজে এরকম বিবাহে বাধ্য হয়েছিল বটে, কিন্তু সে চেয়েছিল, তার আদরের ছোট ভাইটি লেখাপড়া শিখে উপযুক্ত হয়ে উঠে যখন ভালো মন্দ বিচারে পারঙ্গম হবে, তখনই তার বিবাহ দেওয়া ঠিক হবে। বাল্যবিবাহরূপ কুপ্ৰথা এ দেশের অনেক দুৰ্দশার হেতু।
এ ব্যাপারে গঙ্গানারায়ণ প্ৰথমে জননী বিম্ববতীকে বোঝাতে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। গঙ্গানারায়ণের সমস্ত কথার উত্তরে উনি শুধু বিধুশেখরের ওপর বরাত দিয়ে বলেছিলেন, উনি যা ভালো বোঝেন তাই করবেন, তুই আর অমত করিসনি, গঙ্গা। উনি তো নবীনের অহিত চাইবেন না!
গঙ্গানারায়ণ কিছুতেই বুঝতে পারেনি, বিধুশেখরের এতখানি জোরের কারণ কী। কলেজে পড়া বন্ধ হওয়ায় নবীনকুমার উন্মাদের মতন কান্নাকাটি করেছে, দুদিন কিছুই খায়নি, তবু বিধুশেখরের মত অগ্রাহ্য করে পুত্ৰকে কলেজে পাঠাতে রাজি হননি বিম্ববতী। পুত্র-অন্ত প্ৰাণ যে বিম্ববতীর, তিনিও বিধুশেখরের ভয়ে পুত্রের ক্ৰন্দন সহ্য করেছেন।
সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বিধুশেখর রূঢ় ভাষায় গঙ্গানারায়ণকে যে কথাগুলি বলে গিয়েছিলেন, তা স্মরণ করলে এখনো ক্ৰোধে গঙ্গানারায়ণের শরীর কম্পিত হয়। কথাগুলি যেন গলিত লাভার মতন তার কৰ্ণে প্ৰবেশ করেছিল। সেইক্ষণেই সে শপথ নিয়েছিল, এবার সে ঐ বৃদ্ধের দর্প ভাঙবেই। বিম্ববতী যতই বিধুশেখরের পক্ষ সমর্থন করুন, নবীনকুমারকে সে তার নিজের দিকে পাবে। তার ছোট ভাই তার কথা মান্য করে। নবীনকুমার জেদ ধরলে তার অন্যথা করার সাধ্য বিধুশেখরেরও নেই। নবীনকুমার বিধুশেখরকে ভয় পায় না একটুও।
কিন্তু অতীব আশ্চর্যের বিষয়, নবনীকুমার কলেজে যেতে না পারার জন্য কাঁদা-কাটা করলেও বিবাহের প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। ঐটুকু বালকের বিবাহের জন্য কী আগ্রহ! বস্তুত বিবাহ প্রসঙ্গ এসে পড়াতেই সে কলেজে না-যাবার দুঃখ ভুলে গেল। গঙ্গানারায়ণ জিজ্ঞেস করেছিল, ছোটকু, তুই এরই মধ্যে বে করবি? তুই বের কি বুঝিস?
নবীনকুমার বিজ্ঞ ভঙ্গিতে বলেছিল, হ্যাঁ দাদা, আমি রাধাকে বে কর্বো।
গঙ্গানারায়ণ বিস্মিত হয়ে বলেছিল, রাধা? রাধা কে? নবীনকুমার বলেছিল, আমি তো কেষ্টঠাকুর। তাই রাধা আমার বউ হবে। বেশ মজা হবে, আমি রাধার সঙ্গে বাগানে নুকোচুরি খেলবো। গঙ্গাদাদা, জানো, আমি বাঁশি বাজাতে পারি!
বাগবাজারের যে পাত্রীটি বিধুশেখর পছন্দ করে রেখেছিল, তার নাম রাধা নয় অবশ্য, বরং তার থেকে এক কাঠি ওপরে, সে মেয়েটির নাম কৃষ্ণভামিনী। এ নামের অর্থ নবীনকুমারকে বোঝাতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি, সে একেবারে আহ্লাদে ডগমগ।
ঐ বিবাহের কিয়ৎদিবস পরে গঙ্গানারায়ণ আবার মহাল পরিদর্শনে যাওয়া মনস্থ করলো। নীলচাষীদের অসন্তোষ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অবিলম্বে এর কিছু বিহিত না করলে অবিলম্বে একটা গুরুতর হাঙ্গামা শুরু হয়ে যেতে পারে। নীলচাষীরা তাদের অসহায় অবস্থা দূর করার জন্য জমিদারদের সাহায্য প্রার্থনা করছে, কিন্তু জমিদাররাও কুঠিয়াল সাহেবদের কাছে পযুদস্ত। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মফস্বল আদালতে কুঠিয়াল সাহেবদের অপরাধের বিচার করার কোন ব্যবস্থা সরকার মেনে নিলেন না। ফলে মফস্বলে কুঠিয়াল সাহেবগণ অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, এমনকি মানুষ খুন করেও নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। আর চাবুক মারার ঘটনা তো অহরহই ঘটছে। হাতে চাবুক নেই এমন কোনো নীলকর সাহেবের চেহারা কল্পনাও করা যায় না।
গঙ্গানারায়ণ অকুস্থলে গিয়ে যে কিছু ব্যবস্থা করতে পারবে, তার কোনো ভরসা নেই, আবার না। গেলেও মহালগুলি চিরতরে হাতছাড়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা। বিধুশেখর নিজে কখনো বাইরে যান না, তাই এই দায়িত্ব তার ওপরে দেওয়া ছিল। গঙ্গানারায়ণেরও কলকাতার বাড়িতে মন টিকছে না। নবীনকুমারের বিবাহের পর বাড়িতে এখনো বহু আত্মীয়স্বজনের ভিড়, সকলেই নতুন বর-বধূকে নিয়ে মত্ত। গঙ্গানারায়ণ সেই মত্ততায় যোগ দিতে পারেনি বলে তার প্রতিও কেউ মনোযোগ দেয় না। সে যেন নিজগৃহে পরবাসী। যথারীতি নবীনকুমারের পত্নী কৃষ্ণভামিনীও এক অষ্টমন্বষীয়া অক্ষরজ্ঞানহীনা বালিকা। দেশে ও সমাজে যে একটা নতুন পরিবর্তনের প্রবাহ এসেছে, সে সম্পর্কে বাড়ির সকলেই অচেতন। এটা যেন গঙ্গানায়ণের কিছুতে সহ্য হয় না।
তার স্ত্রী লীলাবতীকেও সে আপন মনের মতন করে গড়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। লীলাবতীকে সে লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করেছিল, হলো না। লীলাবতী কোনো মেমবিবির কাছে পড়বে না। বাইরের কোনো পুরুষ মানুষ, তা তিনি যত বৃদ্ধই হোন, তাঁর সামনেও মুখ খুলবে না। লীলাবতী। তখন গঙ্গানারায়ণ ধৈর্য ধরে নিজে সময় ব্যয় করে লীলাবতীকে পড়াতে চেয়েছে, লীলাবতী তাতেও কান্নাকাটি করে বলেছে, ওগো, আমার মাতা নেই, তুমি রাগ করোনিকো, আমার ওসব হবে না। ছাগল দিয়ে কি হাল চাষ হয়!
যে-শ্ৰীলোক নিজেই নিজেকে ছাগলের সঙ্গে তুলনা দেয়, তার সঙ্গে মানুষ হয়ে গঙ্গানারায়ণ আর কতকাল একসঙ্গে বাস করতে পারবে।
এমনকি নবীনকুমারকেও গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, ছোটকু, তোর বউঠানকে মাঝে মধ্যে একটু পড়াবি তো। পড়ায় মন না বসলে বকবি! নবীনকুমার মহোৎসাহে কয়েকদিন পড়াতে বসেছিল লীলাবতীকে। তার ফল শুভ হয়নি। নবীনকুমার আর লীলাবতীর বয়সের ব্যবধান বেশী নয়, লীলাবতী মাত্র দু বৎসরের বড়। প্রায়ই দেখা গেল, তারা হাতাহাতি, চুলেচুলি করছে। শেষে বিম্ববতীই আদেশ দিয়েছেন, দুজনের আর একসঙ্গে পড়তে বসার প্রয়োজন নেই।
বিদ্যার্জনে না হয় আগ্রহ নাই-ই থাকলো, স্বামীর মন বোঝার কিংবা স্বামীকে সঙ্গ দেবার ব্যাপারেও তার কোনো আগ্রহ নেই। লীলাবতী ভাবে, শুধু রাত্রে স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়াতেই নারীজন্মের সার্থকতা। তাতেই সে তৃপ্ত। তার বয়সী অনেক মেয়েই এমন সুযোগও পায় না। লীলাবতী তার মা-দিদিমা-মাসী-পিসীদের জীবন থেকে এই ধারণাই গড়ে নিয়েছে যে বাড়ির কর্তাদের সঙ্গে বাড়ির বউদের দেখাশুনা হবে খুবই কম, নানান কাজে কম্মে কর্তারা প্রায়ই বাড়ির বাইরে রাত কাটাবেন। মাসের পর মাস দেখা না হওয়াটাও আশ্চর্য কিছু নয়। দূরত্ব ও দুর্লভতর কারণেই পতিকে দেবতার মতন সম্মান করতে হয়। গঙ্গানারায়ণ যে লীলাবতীকে প্রতিদিন অনেকক্ষণ ধরে কাছে পেতে চেয়েছে, তার বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের অনেক কথা উজাড় করে দিতে চেয়েছে, তাতে যেন কিছুতেই লীলাবতী স্বস্তি বোধ করেনি, কথার মাঝখানে তার চক্ষে ফুটে উঠেছে চাঞ্চল্য। স্বামীর এরকম ব্যবহার তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। সে যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
এমনকি গঙ্গানারায়ণ যখন মহাল পরিদর্শনে যায়, তখনও লীলাবতী তার সঙ্গিনী হতে চায় না। গঙ্গানারায়ণ তার বোটে লীলাবতীকে নিয়ে গেছে দু একবার, সে উপভোগ করেনি। বাইরের পৃথিবীকে সে একটা ভয়ের স্থান বলে বিবেচনা করে। সন্ধের পর সে একটি সামান্য ছিপ নৌকোকেও মনে করে ডাকাতের নৌকো, খালি-গায়ে যে-কোনো অচেনা মনুষ্যকেই সে মনে করে দুৰ্বত্ত। আর পথে-ঘাটে খালি গায়ে মানুষই বেশী। বর্ষার নদী কিংবা দুপুরের বৃক্ষরাজি কিংবা আকাশে কৃষ্ণবর্ণ মেঘের গায়ে উড়ন্ত বলাকার দৃশ্যও তাকে মুগ্ধ করে না। গঙ্গানারায়ণ লীলাবতীকে দেখে বুঝেছে যে প্রকৃতির রূপ অবলোকন ও তারিফ করার জন্যও মানসিক শিক্ষার প্রয়োজন। বহু শতাব্দী ধরে যারা মুক্তির স্বাদ পায়নি, তারা তো মুক্তির মর্মই ভুলে গেছে। গঙ্গানারায়ণ অবশ্য এমন নির্লিপ্তভাবে বিষয়টি সব সময় দেখতে পারে না, প্ৰায়ই তার অভিমান হয়।
এবারও গঙ্গানারায়ণ একাই বেরিয়ে পড়লো। ইব্রাহিমপুর পরগনায় বিশেষ গোলযোগের সংবাদ এসেছে, তার গন্তব্য সেই দিকে। এবার তার হৃদয় খুব ভারাক্রান্ত। অথচ বিশেষ চিন্তা বা উদ্বেগ যে রয়েছে তা নয়, বরং কোনো চিন্তাই যেন দানা বাঁধছে না। চিন্তাহীনতাও যে মনের ভর বৃদ্ধি করে, তা এই সব সময়ে বোঝা যায়। সে যেন তার জীবনের উদ্দেশ্যই হারিয়ে ফেলেছে। সংসারের প্রতি কোনো বন্ধন তার নেই, অথচ সংসারের বাইরে বৃহৎ কোনো কর্মকাণ্ডেও সে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে পারছে না। শিক্ষা, ধর্মসংস্কার, সাহিত্য-সৃষ্টি প্রভৃতি ব্যাপারে দেশে নিত্য নতুন নতুন আন্দোলন দেখা দিচ্ছে। এবং এই সব মিলিয়ে আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে এক রকমের জাতীয়তাবোধ। গঙ্গানারায়ণ এসব টের পায়, কিন্তু সে যেন শুধু দর্শক, সে অংশগ্রহণকারী নয়। এজন্য সে নিজেকে এক এক সময় তিরস্কার করে, তবু কিছুতেই সে নিজের অন্তমুখী স্বভাবটা বদলাতে পারে না।
বিধুশেখরের কাছে সে পরাজিত হয়ে গেছে। বিম্ববতী তাঁকে জমিদারী পরিচালনার ব্যাপারে নিজের প্ৰতিনিধি করে রেখেছেন। কিন্তু জমিদারী বা ব্যবসায়ের ব্যাপারে সে কোনো পরিবর্তন আনতে গেলে বিধুশেখর মাঝে মাঝে হস্তক্ষেপ করেন। গঙ্গনারায়ণ দশটি প্রস্তাব আনলে চার পাঁচটিতে বিধুশেখর সম্মতি জানিয়ে বাকিগুলি সম্পর্কে গম্ভীরভাবে মস্তক নেড়ে বলেন, না, এটা কল্যাণকর হবে না, কিংবা, না, এটা বাপু এ বংশের মযাদার উপযুক্ত হবে না। ব্যাপারটার মধ্যে এমন সূক্ষ্মী চতুরতা আছে যে, তা শুধু গঙ্গানারায়ণের চক্ষেই ধরা পড়ে। অকিঞ্চিৎকর বা অতি সাধারণ বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্মতি জানিয়ে বিধুশেখর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলিতে নিজের অধিকার অক্ষুন্ন রাখেন। এতে বিম্ববতী মনে করেন যে গঙ্গানারায়ণের অর্ধেক প্রস্তাব তো বিধুশেখর গ্রহণ করেছেনই, বাকিগুলি সম্পর্কে পরামর্শ দেবার মতন অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও পারিবারিক অধিকার বিধুশেখরের অবশ্যই আছে।
গঙ্গানারায়ণ জানে যে এই বিশাল সম্পত্তির সে মালিক নয়, সে তার ভ্রাতা ও জননীর স্বার্থরক্ষার কারণেই নিজেকে এর সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। কিন্তু সে যদি তার অধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, প্রয়োজন অনুযায়ী তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে বাধা পায়, তাহলে তো তার ভূমিকা একজন সাধারণ কর্মচারীর মতন। তবু গঙ্গানারায়ণ এই কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে, কোনো না কোনো উপায়ে সে এক সময় বিধুশেখরের মৌরুসীপাট্টা ভাঙবেই। কিন্তু কয়েকমাস আগে বিধুশেখর সিঁড়ির পাশে তাকে বললেন, আমি বলচি, নবীনকুমার কলেজে যাবে না, আমি শীঘ্রই বিবাহ দেব তার—এবং কথাগুলি ঠিক অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হলো, এর ফলেই গঙ্গানারায়ণের মন যেন একেবারে ভেঙে গেছে। বিধুশেখর তাকে তৃণবৎ তুচ্ছ জ্ঞান করেন এবং বিম্ববতীর কাছে বিধুশেখরের আদেশই ধ্রুব।
প্ৰজারা গঙ্গানারায়ণকে জমিদার জ্ঞানে সম্রম করে, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ প্রকৃতপক্ষে তো জমিদার নয়, সে সিংহবাড়ির সন্তানও নয়। গঙ্গানারায়ণ এ পৃথিবীর কেউ নয়।
ইব্রাহিমপুর পরগনার ব্যাপার বিশেষ জটিল। রামকমল সিংহের আমলেই এখানে তাদের নিজস্ব। একটি নীলকুঠি ছিল। নীল চাষে লাভ যথেষ্ট। তবে কয়েক বছর ধরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। অদূরেই সাহেবরা আর একটি কুঠি স্থাপন করেছে এবং জমি ইজারা নিয়ে রায়তদের দিয়ে জোর জুলুম করে নীল চাষ করাচ্ছে। চাষীরা আজকাল তাদের উৎপাদিত নীলের ন্যায্য দাম পায় না, সাহেব কুঠিয়ালের কাছেই তাদের সব ফসল বিক্রি করতে হয়। মূল্যের ব্যাপারেও সাহেবদের কথাই চূড়ান্ত। এখন আবার মূল্যের প্রশ্নও নেই। সাহেবগণ বিঘা প্রতি দুটাকা করে দাদন দিচ্ছে চাষীদের, তারপর উৎপন্ন সব ফসলই তাদের। যে রায়ত দাদা নিতে অস্বীকার করে তাকে ধরে এনে প্ৰহারে প্রহারে আধমরা করার পর কাগজে আঙুলের ছাপ দেওয়ানো হয়। সেই দুটাকার দাদন তার আর ইহজীবনে শোধ হবে না।
চাষীদের দুর্দশা দেখে কয়েক বৎসর আগে গঙ্গানারায়ণ ঠিক করেছিল যে নীল চাষের বদলে সে চাষীদের আবার ধান চাষে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
কিন্তু বিধুশেখর তাতে বাধা দিয়েছেন। বিধুশেখরের বক্তব্য ছিল এই যে, জলে বাস করে যেমন কুমীরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না, সেরকমই কোনো রাজার রাজত্বে বাস করে রাজবংশীয় লোকেদের সঙ্গে বিবাদ করে প্রাণ বাঁচানো যায় না। সাহেবরা যখন নীলকুঠি স্থাপন করেছে, তখন সন্নিহিত জমিতে সোনার ধান ফলতে দেখলে তাদের চক্ষু জুড়োবে না। বরং চীনা ড্রাগনের মতন তাদের মুখ দিয়ে আগুন নিৰ্গত হবে এবং সেই আগুনে ধান ক্ষেত ছারখার হয়ে যাবে।
বিধুশেখরের নির্দেশে ইব্রাহিমপুর পরগনার জমিদারীর অর্ধেক নীলকর সাহেবদের ইজারা দিয়ে দেওয়া হলো। সমগ্র জমিই ছাড়া হয়নি, তার কারণ এখানকার কিছু জমিতে খুব ভালো ইক্ষু চাষ হয়, কয়েকজন চায়নাম্যান একটি চিনিকলও স্থাপন করেছে, আর চিনি বিক্রি হয়। প্ৰায় সোনার দামে। কিন্তু সাহেবদের কাছে অর্ধেক জমি ইজারা দিয়েও সমস্যার সমাধান হয়নি। ম্যাকগ্রেগর নামে এক কুঠিয়ালের অত্যাচারে প্রজাদের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ম্যাকগ্রেগরের চাবুকের নাম শ্যামচাঁদ, সেই শ্যামচাঁদ একবার যার পিঠে পড়ে জন্মের মতন তার শিরদাঁড়া বেঁকে যায়। এ বছর খরার কারণে ফসল ভালো হয়নি বলে ম্যাকগ্রেগর ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। এসব রায়তদেরই কারসাজি মনে করে সে গ্রামের ভেতর ঢুকে প্রতিদিন বাড়িঘর তছনছ করে। প্রাণভয়ে ভীত প্ৰজারা দলে দলে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে সাহেবের এলাকার বাইরে, তবু সেখানেও নিস্তার নেই। ম্যাকগ্রেগর এলাকা মানে না, তার ঘোড়া যতদূর ছুটতে পারে, ততদূরই সে যেতে রাজি। বড় রকমের ঝঞ্জাটের আশঙ্কায় চায়নামানরা চিনিকল বন্ধ রেখে চলে গেছে। এখান থেকে।
গঙ্গানারায়ণের পিনিস বজরা নদীর ঘাটে এসে ভেড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক দুই করে প্রজারা এসে হাজির হতে লাগলো। বজরার আগমন বার্তা অনেক আগে থেকেই রটে যায়। ইজারা দেওয়া তালুকের প্রজারা এসে কেঁদে পড়লো গঙ্গানারায়ণের পায়ে। বংশানুক্রমিকভাবে তারা জমিদারকেই রক্ষাকতা বলে জেনে এসেছে। দেশের রাজা কে, সে খবর তারা রাখে না। খাজনা বাকি পড়লে জমিদারের প্যায়দা গোমস্তারা মারধোর করে, সেটাও জমিদারের অধিকারের মধ্যে পড়ে। আবার আপদে বিপদে জমিদারের চরণেই আশ্রয় নিতে হয়।
গঙ্গানারায়ণ উদাসীনভাবে সব কথা শুনে যেতে লাগলো। বিভিন্ন জনের কথায় কুঠিয়াল ম্যাকগ্রেগরের যে চরিত্র ফুটে উঠছে, তাতে তাকে দানব বলেই প্রতীয়মান হয়। অনেকেরই পিঠে, বুকে, মুখে ম্যাকগ্রেগরের হাতের শ্যামচাঁদের ক্ষতচিহ্ন। অনেকে গৃহহীন।
গঙ্গানারায়ণের মনে হলো, ইজারা দেওয়া তালুকের প্রজাদের সম্পর্কে তার করণীয় কিছু নেই। জমির সঙ্গে সঙ্গে সেই জমি-নির্ভর মানুষদেরও ইজারা দেওয়া হয়ে গেছে। ইজারাদারই সেই জমি ও মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কতা। যদিও সেইসব প্রজারা এখনো জমিদারকেই তাদের প্রভু মনে করছে। কিন্তু আইন একথা মানবে না। আর তাদের খাস তালুকের প্রজাদের ওপরেও যে অত্যাচার চলছে, তার প্ৰতিবিধান করতে গেলেও কোনো না কোনোভাবে আইনেরই আশ্রয় নিতে হবে। সাহেব জাতির বিরুদ্ধে তো আর পাইক লাঠিয়াল নিয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়া যায় না। মামলা মোকদ্দমার বিষয় বিধুশেখরই ভালো বুঝবেন।
গঙ্গানারায়ণের মন বিবশ হয়েছিল, প্রজাদের দুঃখ দুৰ্দশার কাহিনী শুনতে শুনতে আস্তে আস্তে তার জড়তা কাটতে লাগলো। সবচেয়ে সে বিচলিত হলো জামালুদ্দীন শেখের ঘটনা শুনে। জামালুদ্দীনের বিবি হানিফাকে কয়েকদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না, সকলের ধারণা নীলকুঠিতেই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ম্যাকগ্রেগরের কয়েকজন দেশী কর্মচারী আছে, তাদের মধ্যে গোলক দাস নামে একজন একেবারে সাক্ষাৎ শয়তান, সে ঐ সাহেবের সকল অপকর্মের দোসর। ঐ গোলক দাসের চোখ পড়েছিল হানিফা বিবির ওপর, সে-ই তাকে নিশ্চয়ই তুলে দিয়েছে সাহেবের হাতে। হানিফা বিবি দুদিন ধরে বেপাত্তা বলে জামালুদ্দীন শেখ নিজে গিয়েছিল। নীলকুঠিতে খবর নিতে, তারপর থেকে জামালুদ্দীনও আর ফেরেনি। নীলকুঠিতে মাটির নীচে একটা ঘর আছে, সেখানে নিশ্চয়ই আটক করে রেখেছে জামালুদ্দীনকে। কিংবা তাকে এতক্ষণে খুন করে ফেলাও বিচিত্র নয়। ঐ নীলকুঠিতে যাবার সাহস আর কারুর নেই, একমাত্র গঙ্গানারায়ণ যদি কোনো ব্যবস্থা করতে পারে। হাজার হোক গঙ্গানারায়ণ জমিদার, নীলকুঠির সাহেব তার মান রেখে কথা বলবে অন্তত।
জামালুদ্দীন শেখকে চেনে গঙ্গানারায়ণ। অত্যন্ত বলিষ্ঠকায় পুরুষ, তার চেহারা ভিড়ের মধ্যেও চোখে পড়ে, সে এখানে একজন মোড়ল গোছের, কথাবাতাঁর ভঙ্গি গোঁয়ারের মতন, যদিও গঙ্গানারায়ণ বুঝেছিল, যে জামালুদ্দীন মানুষটা অতি সরল। সেই জলজ্যান্ত মানুষটা অদৃশ্য!
জামালুদ্দীনের বৃদ্ধ পিতার দু চোখে ছানি, সামনাসামনি খোলা চোখে চেয়ে থাকে। কিন্তু হাত নাড়ে অন্ধের মতন। সে বললো, মুই তোমার গোলাম হইত গো রাজাবাবু, তুমি মোর ছাওয়ালডারে ছামিল কইরা দিতা না?
গঙ্গানারায়ণ বললে, তোমরা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে খবর দাওনি? এর বিহিত তো তিনিই করতে পারেন। তোমরা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে দরবার করো গে যাও!
এর উত্তরে সবাই সমস্বরে গোলমাল করে যা বললো, তার মমর্থ এই যে, তারা ম্যাজিস্টর সাহেবের ওপর কোনোই ভরসা রাখে না। তাকে তারা জুজুর মতন ভয় পায়। তিনি এই নীলকুঠির ম্যাক গরগর সাহেবের কুটুম্ব, ম্যাজিস্টর যখন এ তল্লাটে আসেন, তখন তিনি আস্তানা নেন। ঐ নীলকুঠিতেই এবং কুঠিয়ালদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে হাত বাঁকাঝাঁকি করেন। ম্যাক গরগর সাহেবের হাতি আছে, বাঘের মতন বড় বড় পোষা কুকুর আছে, সেই হাতির পিঠে চড়ে কুকুরগুলো সঙ্গে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বাঘ শিকারে গিয়েছিলেন এই তো কয়েক মাস আগে। সুতরাং সেই ম্যাজিস্ট্রেট কি এই ম্যাকগ্রেগর সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো নালিশ শুনবেন?
গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চলো, আমি যাচ্ছি।
গঙ্গানারায়ণ তখুনি পিনিস থেকে নামতে উদ্যত হতেই তার স্থানীয় সরকার বললো, সেকি, আপনি কোথায় চললেন, হুজুর? ম্যাকগ্রেগর একেবারে কাঁচাখেগো দেবতা, ও বর্বর মানীর মান রাখতে জানে না। আপনি জানেন না।
গঙ্গানারায়ণ কোনো উত্তর না দিয়ে নেমে যাচ্ছিল, তখন তার নিজস্ব খাজাঞ্চি বৃদ্ধ অক্ষয় সেন বললেন, বাবু, যাবার আগে আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ আচে, এক দণ্ড অপিক্ষে করে যান।
দিবাকরকে পছন্দ করে না গঙ্গানারায়ণ,তাকে সে কর্মচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বিধুশেখরের জন্য পারেনি। তবে দিবাকরকে সে আর মফস্বলে আসবার সময় সঙ্গে নেয় না, তার বদলে এই অক্ষয় সেন মানুষটি অনেক ধীর স্থির, এঁর পরামর্শের মূল্য আছে।
ভিতরের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাজাঞ্চি নিভৃতে বললেন, হুজুর, আপনি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা কত্তে যেতে চান তো যাবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনি জমিদার, আর সাহেবরা হাজার হোক আপনার ইজারাদার, দেখা কত্তে হলে সাহেবেরই আপনার নিকটে আসা উচিত। আপনি সাহেবের কাছে এত্তেলা পাঠান।
গঙ্গানারায়ণ বললো, আমি এত্তেলা পাঠালে সে আসবে? যদি না আসে? যতদূর মনে হলো, সে আমার এত্তেলার পরোয়া করবে না!
খাজাঞ্চি বললেন, তা হলে আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন না। আপনি জমিদার হয়ে তো বেচালে চলতে পারেন না? প্রজারা নেচে উঠলেই কি আপনার কেতা নষ্ট করা উচিত হয়? আপনার বংশের একটা মান মযাদা আছে না!
গঙ্গানারায়ণ বললো, সেন মশাই, যদি এক্ষুনি এই কামরার মধ্যে একটা বিষাক্ত সাপ দেখি, তা হলে অমনি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠবো। এমনভাবে লাফিয়ে ওঠা জমিদারের পক্ষে বড়ই অনুচিত কাজ, কিন্তু কখনো কদাচিৎ তাও করতে হয়। আমি চললাম!
তখন খাজাঞ্চি বললেন, তবে অন্তত এক কাজ করুন। আগে থেকে একটা খবর অন্তত পাঠানো হোক। আপনি যাবেন, আপনার আপ্যায়নের জন্য তাদের তৈরি হবার একটু সময় তো দিতে হবে অন্তত। আপনি উটুকো হঠাৎ যাবেন। গিয়ে দেখলেন হয়তো সাহেব কুঠিতে নেই। তাছাড়া আপনার এখনো মানাহারও হয়নি।
এতে গঙ্গানারায়ণকে রাজি হতেই হলো। নীলকুঠিতে তার দূত গিয়ে খবর দিয়ে এলো যে অপরাহ্নে সে যাবে দেখা করতে, সাহেব যেন অনুগ্রহ করে তখন উপস্থিত থাকেন।
এই খবর পাঠানোই হলো একটা বড় ভুল। তার অভ্যর্থনার ব্যবস্থাটি বেশ ভালোই হলো। নীলকুঠির বিশাল চত্বরে একটি ক্যাম্প চেয়ারে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ম্যাকগ্রেগর, রোদ আড়াল করার জন্য মুখের ওপর টুপি চাপা দেওয়া। মাটিতে গড়াচ্ছে কয়েকটা সূরার বোতল, সেখানে ভন ভিন করছে এক ঝাঁক মাছি। সাহেবের জামায় ঝোলের দাগ, বোঝা যায়, দুপুর থেকে খানাপিনা বেশ জবর হয়েছে।
কয়েকজন কর্মচারী সন্ত্রস্ত মুখে একটু দূরে সারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, দুজন সঙ্গীকে নিয়ে গঙ্গানারায়ণকে প্ৰবেশ করতে দেখে তারা সসম্রামে তাকে ভেতরে নিয়ে এলো এবং একজন সাহেবের কানে কানে কিছু বললো।
সাহেব টুপিটা সরিয়ে রক্তাক্ত চক্ষে গঙ্গানারায়ণের দিকে তাকিয়ে জড়িত স্বরে বললো, হ্যালো, জমিণ্ডার! নাইস সিয়িং ইউ! কাম অন্য, সীট ডাউন!
একজন দৌড়ে একটি কেদারা এনে দিল গঙ্গানারায়ণের জন্য। গঙ্গানারায়ণ সেটিতে বসে সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সে ততক্ষণে আবার মাথা হেলিয়ে দিয়ে মুখের ওপর টুপি চাপা দিয়েছে।
গঙ্গানারায়ণ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, মিস্টার ম্যাকগ্রেগর, শুভ অপরাহ্ন, আশা করি আপনার শরীর স্বাস্থ্য মঙ্গল। আশা করি। এতদঞ্চলের জলবায়ু আপনার সহ্য ও পছন্দ হইয়াছে। আমি আপনার সহিত কয়েকটি বিষয় লইয়া কিঞ্চিৎ আলোচনা করিতে আসিয়াছি।
ম্যাকগ্রেগর এর উত্তরে নাক ডাকাতে শুরু করলো।
বিস্মিত হয়ে গেল গঙ্গানারায়ণ। অনেক ইংরাজের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, এ রকম বর্বর তো সে কখনো দেখেনি।
একজন খর্বকায় গোলাকৃতি বাঙালী হাত জোর করে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে আছে কাছে। তার দিকে ফিরে গঙ্গানারায়ণ বললো, সোনামুড়া পর্যন্ত পত্তনী ইজারা দেওয়া হয়েছিল, তার বাইরে আমার খাস তালুক, সেখানেও নীলকুঠির লোকেরা প্ৰবেশ করে জোর করে আমার প্রজাদের ধরে আনে। আমার প্ৰজারা নীলকুঠির রায়ত নয়।
সেই লোকটি বললো, হুজুর, আপনার প্রজাগো হয়রানি করার কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবি না। আপনারা হইলেন এ দিগের তিন পুরুষের জমিদার। তবে কি না। আমাগো রায়তরা আপনের তালুকে গিয়া লুকাইয়া ঘাপটি মাইরা থাকে, তাগো ধইরা আনতে হয়। এলাকা-চাষীরা বে-এলাকায় যাবে ক্যান, হেডা আগে কান? ব্যাটারা দুই আনা পয়সা মজুরি। আর পাঁচ পো চাউল খুরাকি পায়, আমাগো সাহেব পয়সা খরচ করতে কক্ষনো নারাজ নন, তবু ব্যাটারা—
গঙ্গানারায়ণ বললো, আমার এলাকায় কয়েকটি পাকা আখের ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েচে, হুমকি দিয়ে চিনি কল বন্ধ করা হয়েচে।
সেই লোকটি বললো, হুজুর, কার ক্ষেতে কে আগুন দেয়, তার কি ঠিক আছে? এ ব্যাটারা কথায় কথায় নিজেগো মইধ্যে কাজিয়া করে, পিতিবেশীর ঘরে আগুন লাগায়, অ্যাগো কথা মোটেই বিশ্বাস লবেন না হুজুর।
গঙ্গানারায়ণ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সাধারণ একজন কর্মচারীর সঙ্গে এসব আলোচনা করতে তার ঘৃণা বোধ হচ্ছে। লোকটির মুখ দেখলেই বোঝা যায়, লোকটি অতি খল। কে জানে, এই সেই গোলক দাস কিনা।
গঙ্গানারায়ণ জিজ্ঞেস করলো, কুঠিতে আর কোনো সাহেব নেই? আমার কাটা জরুরি কতা বলবার ছেল।
লোকটি বললো, আইজ্ঞা না হুজুর, সাহেবরা সবাই চরমহালে শূয়র মারতে গেছেন গিয়া। বেলাবেলিই রওয়ানা হইছেন, আপনে আসবেন কইয়া গ্রেগর সাহেব শুধু রইছেন।
গঙ্গানারায়ণ সেই লোকটিকে বললো, জামালুদ্দীন বলে একজন চাষী এই কুঠিতে এসেছেল, আর ফিরে যায়নি।
লোকটি বললো, কোন জামালুদ্দীন হুজুর? কত মানুষই তো এখেনে আসে যায়।
এবার ম্যাকগ্রেগর জড়িত গলায় বললো, দোজ বেগারস! দে অল লুক অ্যালাইক…
অপমানে কৰ্ণমূল ও নাসিকাগ্র রক্তিমবৰ্ণ হয়ে গেল গঙ্গানারায়ণের। সাহেবটি জেগেই আছে, সব শুনছে, শুধু ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করে রয়েছেন। এই কথাটি বলেই সে নাক ডাকতে শুরু করেছে আবার।
কর্মচারীটি বললেন, সাহেব কইলেন যে ঐ চাষাভূষা সকলডিরই চ্যাহারা একই লাহান। শুধু নাম শুইন্যা চেনা যায় না।
—তোমার সাহেবকে ডাকো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো।
লোকটি জিভ কেটে বললো, সে সাইধ্য আমার নাই। এহানে কারুরই নাই, হুজুরী! কাঁচা ঘুম ভাঙাইলে গ্রেগর সাহেব চইট্টা আগুনের মতন লকলক করেন, তাহন হাতের সামনে যারে পান…
গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়ালো। অভদ্র ব্যবহারের উত্তর কী হতে পারে, শারীরিক শক্তির প্রয়োগ কিংবা পাল্টা অভদ্র ব্যবহার, এর কোনোটিতেই গঙ্গানারায়ণ অভ্যস্ত নয়। সাহেবটি তাকে ইচ্ছে করে অপমান করছে! এটা যেন তার অবিশ্বাস্য মনে হলো। একজন মানুষের সঙ্গে আর একজন মানুষ এমন ব্যবহারও করতে পারে? এই ব্রিটিশ জাতিরই কবি শেকস্পীয়র, মিল্টন?
হঠাৎ যেন গঙ্গানারায়ণের মস্তিষ্কটা শূন্য হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে রইলো স্থির হয়ে, কিন্তু সে ভুলে গেল যে কোথায় আছে। সে চোখে কিছু দেখতে পেল না, সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল তার কানে, সে যেন একটি পাথরের মূর্তি। অপমান ও অত্যন্ত ক্রোধের পর সে যেন অপমান ক্ৰোধ ছাড়িয়ে চলে গেল অন্য কোনো স্তরে।
কর্মচারীটি বললো, ঐ যে দূরে কদম গাছটা দ্যাখতে আছেন হুজুর, প্রজারা কেউ আর বেশী দূর আসে না। ঐ হানে খাড়াইয়া কথা কয়। কোন প্রজার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে সাহেবগো কাছারির মইধ্যে পা দিবে! আপনে আইছেন, আপনে মাইন্য লোক, আপনার কথা হইল গিয়া ভেন্ন। কিন্তু সুজাউদ্দীন না গজাউদ্দীন কার কথা কইলেন, সে এ হানে আসফে ক্যান?
গঙ্গানারায়ণ কিছুই শুনতে পেল না। এসব। তার চোখের সামনে যে সমস্ত জগৎ চলমান। তার মাথা টলছে একটু একটু।
লোকটি বললো, হুজুর কি সাহেববাড়িতে জল খান? তাইলে একটু মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা করি?
একথাও শুনতে পেল না গঙ্গানারায়ণ। সে যেন অচেতন অথচ দণ্ডায়মান। তার সমস্ত মুখে বিষাদের কালিমা মাখা।
তাকে সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সকলেই বিস্মিত। তার সঙ্গীদের মধ্যে একজন ডাকলো, হুজুর!
গঙ্গানারায়ণ এক পা বাড়াতে গিয়ে টলে পড়ে যাচ্ছিল, তার সঙ্গীরা ধরে ফেললো তাকে। তখন যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সে আচ্ছন্ন গলায় বললো, কী হয়েচে? তোরা আমায় ধরে রাইচিস কেন?
—হুজুরের কি শরীর খারাপ হলো?
গঙ্গানারায়ণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো, না, চল!
ধীর পায়ে সে বেরিয়ে এলো নীলকুঠি থেকে।