ত্রিপুরা থেকে শশিভূষণ হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছেন কলকাতায়। বেশ ব্যস্তসমস্ত ভাব। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য হাতে সময় বেশি নেই। মহীশূর, জয়পুর, পাতিয়ালা ইত্যাদি দেশীয় রাজ্যের মহারাজদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব প্রাসাদ রয়েছে এই কলকাতায়। স্বাধীন ত্রিপুরার মহারাজ যে-সে। বাড়িতে থাকতে পারেন না।
বর্ষাকালে ত্রিপুরায় নানা প্রকার পোকামাকড়ের উপদ্রব হয়। এক এক সময় গুমোট গরমে প্ৰাণ হাঁসফাঁস করে, বর্ষার সূচনাটি সেখানে তেমন মনোরম নয়। শোনা যাচ্ছে, ইংরেজরা নাকি কলকাতা শহরে মশা দমন করেছে, রোগ-ভোগ কমেছে, ওলাউঠা-ডাকিনী ইংলেণ্ডেশ্বরীর রাজত্বে উৎপাত করার সাহস পায় না। সাহেব চিকিৎসকদের সব রকম রোগই ডরায়, দেশীয়দের মধ্যে ডাক্তার রাজেন দত্ত, মহেন্দ্রলাল সরকার মৃতপ্রায় রুগীদেরও বাঁচিয়ে তুলছেন।
মহারাজ বীরচন্দ্ৰ মাণিক্য তাঁর নবতমা পত্নীকে ব্রিটিশ রাজত্বের চাকচিক্য দেখাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কলকাতায় আসতে চান বলে জানিয়েছেন। আর একটি গূঢ় কারণ হল, কিছুকাল হল তিনি পেটের ব্যামোয় বেশ কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের অভিমত, কিছুদিন জল-হাওয়া বদল হলে তিনি উপকার পাবেন। সেই জন্যই বীরচন্দ্র ঠিক করেছেন, তিনি বর্ষাকালের প্রথম মাসটা অন্তত এখানেই কাটাবেন।
এত দ্রুত মহারাজের সম্মানের উপযোগী প্রাসাদ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ভালো পল্লীতে একটি সুদৃশ্য বাড়ি ভাড়া নিতে হবে, তেমন তেমন প্রয়োজন হলে ক্ৰয় করাও যেতে পারে।
কলকাতায় পৌঁছবার পরদিন থেকেই শশিভূষণ গৃহ সন্ধানে বার হতে লাগলেন। ভরত তাঁর সঙ্গী।
ভরত বরাবরই শশিভূষণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে। শশিভূষণের ভাগের সম্পত্তি তদারকি করে সে মূলধন বাড়িয়েছে, এবং এখানকার ব্যবসায়ীদের হুন্ডি মারফত সে শশিভূষণকে টাকা পাঠিয়েছে নিয়মিত। ভরতের ব্যবস্থাপনায় শশিভূষণ খুবই সন্তুষ্ট, ভরত যে এখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনো করছে, তাও তিনি জানেন। কিন্তু অনেক দিন পর ভরতকে দেখে তিনি রীতিমতন বিস্মিত। এ যেন এক সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ। সেই লাজুক, ভিতু, বিহ্বল কিশোরটি কোথায় হারিয়ে গেছে। বয়েস বেশি না হলেও এখন সে এক লম্বাচওড়া যুবক, তার কপাল ও ওষ্ঠে আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গি স্পষ্ট। তার গায়ের রং শ্যাম, কিন্তু অনেকের মধ্যে সে প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সে অবশ্যই একজন সুপুরুষ। রাজপরিবারের অনুপযুক্ত নয় সে। ভরতকে দেখে শশিভূষণ একটা গোপন আনন্দ বোধ করেন।
এ যুবকটি যেন তাঁরই সৃষ্টি। ভরতের তো বাঁচার কথাই ছিল না। সেই গঞ্জের হাটে ভরতকে যে অবস্থায় তিনি দেখেছিলেন, দৈবাৎ দেখতে পেয়েছিলেন, যদি না দেখতেন, তা হলে ভরত প্ৰাণে বাঁচলেও উন্মাদ হয়ে যেত, পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াত। ভরতের কি মনে আছে, সে শুধু বিকারের ঘোরে পাখি সব করে রব, পাখি সব করে রব বলত? এখন সে স্পষ্ট উচ্চারণে শেক্সপিয়ার পাঠ করে।
এ পৃথিবীতে যদি একটি প্রাণও রক্ষা করা যায়, তারও তো মূল্য কম নয়। কত প্রাণই তো অযত্নে, অবহেলায় বিনষ্ট হয়!
শশিভূষণ অকস্মাৎ এসে পড়ে ভরতকে যেন আরও একবার রক্ষা করেছেন। এই দাঙ্গাহাঙ্গামার রাতে ভরত মেজকর্তা মণিভূষণ এবারে আর ভূমিসূতাকে নির্যাতনের শেষ রাখবেন না। গোধূলিবেলায় চুপি চুপি গ করেছিল। এই সঙ্গে ভরতের অনুপস্থিতি টের পেয়ে যদি দুই আর দুইয়ে চার করা হত, তা হলে আর দু’জনেরই হেনস্থার অবধি থাকত না। ভরত অবশ্য সে রাতে মনে মনে তৈরি হয়েছিল। সে জানত, শশিভূষণের বিনা নির্দেশে এই বাড়ি থেকে তাকে বহিষ্কার করার অধিকার কারুর নেই। ভূমিসূতার ওপর বেশি অত্যাচার করা হলে ভরত তাকে বার মহলে, নিজের ঘরের পাশে বারান্দাটিতে আশ্রয় দিত। তারপর যা হবার তা হত।
কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। সেই রাতেই শশিভূষণ ফিরেছেন, তাঁকে নিয়ে অন্দরমহলে আদিখ্যেতা চলেছিল অনেকক্ষণ, বিপত্নীক বা অবিবাহিত দেবরকে সব ভ্রাতৃবধূই পছন্দ করে, তাকে নিয়ে দুই বউদিদি খাতিরের প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন। ভূমিসূতার খোজ পড়েনি তেমন ভাবে। বাগানের পিছন দিকের দরজা দিয়ে ভূমিসূতাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ভরত ফিরেছিল আরও পরে।
শশিভূষণ জানতেও পারলেন না, ভরতকে তিনি আবার কোন বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। সার্কুলার রোডে অনেক বড় বড় বাড়ি তৈরি হয়েছে। পারসি ও আর্মেনিয়ানরা সেইসব বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে। জানবাজার থেকে বউবাজার পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে নতুন রাস্তা, সেখানেও গৃহনির্মাণ শুরু হয়েছে। উত্তর কলকাতায় শোভাবাজার রাজবাড়ির আশেপাশেও কিছু ভাড়ার বাড়ি আছে। শশিভূষণ নানান বাড়ি দেখছেন ঘুরে ঘুরে।
ভরতের সঙ্গে তাঁর অনেক গল্প হয়। ভরতকে তিনি এখন মাস্টারমশাই বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। অনেক দিনই তিনি ভরতের শিক্ষক নন, তা ছাড়া ষোলো বছরের বেশি বয়েস হয়ে গেলে পুত্রের সঙ্গেও বন্ধুর মতন আচরণ করতে হয়। ভরত অবশ্য সব সময় তা মনে রাখতে পারে না, মাঝে মাঝেই সে দাদা বলে ডাকার বদলে স্যার বা মাস্টারমশাই সম্বোধন করে ফেলে।
জানবাজার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, ভরত, কলকাতা শহরে এখন নতুন কী হুজুগ চলছে বল তো!
ভরত কী বলবে ভেবে পায় না।
এর মধ্যে তার প্রেসিডেন্সি কলেজের গল্প বলা হয়ে গেছে অনেকবার। তার বন্ধুদের মেসের গল্প শুনিয়েছে। বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে সে যে দেখা করতে গিয়েছিল, তারও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছে। কিন্তু হুজুগ কাকে বলে?
গত মাসে ফড়েপুকুর নামে এক স্থানে এক ধনী তেলীর বাড়িতে একজন গুরুদেব এসেছিলেন। তাঁর বুক ছাড়ানো লম্বা সাদা দাড়ি, মাথায় জটী, ভুরু পর্যন্ত সাদা, তার নাকি বয়েসের গাছপাথর নেই, সেই পরিবারের তিন পুরুষের তিনি গুরুদেব, যদিও বহুকাল আসেননি, সম্প্রতি বদরিকাশ্রম থেকে তিনি সমতলে নেমে এসেছেন। সেই গুরুদেবকে নিয়ে যাগযজ্ঞের খুব ধুমধাম চলছিল, হঠাৎ একদিন আরতির ধুনুচির আগুন লেগে গেল তাঁর দাড়িতে। ভয়ে ও যন্ত্রণায় গুরুদেব নিজেই তাঁর দাড়ি ধরে টান দিতেই সবটা উপড়ে এল। তখন বোঝা গেল, তার দাড়ি নকল। রসিক ছোকরারা তাঁর জটা ধরে টানাটানি করতেই বেরিয়ে পড়ল দিব্যি তেরি কাটা চকচকে মাথা। তাঁর ভুরুতেও চকখড়ি।
অবিলম্বে আবিষ্কার করতে বিলম্ব হল না। ওই ছদ্ম গুরুদেব আসলে ওই তেলী বাড়ির এক পুত্রবধূর পিসতুত দাদা। বধূটির সঙ্গে আগে থেকেই তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল, সেই টানে সে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও চলে এসেছিল। গুরুদেবের ছদ্মবেশ ধরে সে এমন ভাব দেখাত যেন সে নারী-পুরুষের তফাতই বোঝে না। কিন্তু মামাতো বোনটির সেবা নেবার ছলে সে কয়েকবার তার সঙ্গে শয্যায় মিলিত হয়েছে।
এ নিয়ে কয়েকদিন খুব হইচই চলল, ধনী বাড়ির কুৎসা সব সময়ই খুব মুখরোচক হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতের বন্ধুরা তর্ক করতে লাগল, ভণ্ড সাধুটিকে না হয় বিচারের জন্য আদালতে পেশ করা হয়েছে, কিন্তু ওই নববধূটির বরাতে কী আছে? সেই রমণীটি সত্যিই অপরাধিনী কিনা, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে কী ভাবে? এই বিতর্ক এখনও চলছে। অন্যান্য বাড়িতেও কিছু কিছু গুরুদেবের ওপর হেনস্থা শুরু হয়ে গেছে। একজন গুরুদেবের সত্যিকারের কাঁচাপাকা দাড়ি পরীক্ষায় ছলে টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে কয়েকটি কলেজ পড়ুয়া যুবক।
এই ব্যাপারটি একটি হুজুগ হিসেবে গণ্য হতে পারে, কিন্তু ভরত তার মাস্টারমশাইয়ের সামনে এই কাহিনী বিবৃত করার যোগ্য মনে করল না। শশিভূষণ আবার বললেন, ব্ৰাহ্মরা যেন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে, তাই না। ভরত, তুই কোনও ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করিস নাকি? ভরত বলল, না, আমাকে টানে না।
শশিভূষণের আমলে ছাত্ররা কোনও না কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হত। নিছক কলেজ। আর বাড়ি, এইটুকু গণ্ডির মধ্যে তারা আবদ্ধ থাকত না। সেই জন্য তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কোথায় যাস তুই? ভরত বলল, আমি ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় মাঝে মাঝে লেকচার শুনতে যাই।
শশিভূষণ বললেন, হুঁ, ডাক্তার সরকারের সঙ্গে আমাকেও একবার দেখা করতে হবে। তুই দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ সাধুকে দেখেছিস নাকি? ইন্ডিয়ান মিরার কাগজে প্রায়ই ওঁর কথা লেখে।
ভরত বলল, হ্যাঁ দাদা গত মাসে পরপর দুবার গেছি আমার এক বন্ধুর সাথে। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও কথা হয়নি, ওঁর মুখের গল্প শুনেছি, গ্ৰাম্য লোকের ভাষায় কথা বলেন, সব ঠিক বুঝি না। তবে ওখানে নরেন নামে একটি ছেলেকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার থেকে বয়েসে বেশ কিছুটা বড়। কিন্তু সে যেন এক জ্যোতিষ্ক। সে কোনও কিছুই যাচাই না করে মেনে নেয় না। এমনকি প্রায়ই রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে যাচাই করে।
শশিভূষণ বললেন, নরেন? কোন বাড়ির ছেলে। ভরত বলল, তা আমি ঠিক জানি না। তার নাম নরেন দত্ত, শুনেছি সিমলেপাড়ার দিকে থাকে।
শশিভূষণ বললেন, এবার কলকাতায় থাকব। এখন আস্তে আস্তে সকলের সঙ্গে চেনাপরিচয় হবে।
সকালে এক প্রস্থ বাড়ি দেখা হয়, তারপর দুপুরের দিকে ওরা দু’জন আহারাদির জন্য ফেরে। ভরতের এখন গ্ৰীষ্ম অবকাশ, তাই কলেজে যাবার দায় নেই।
শশিভূষণের মহল আলাদা হলেও কৃষ্ণভামিনী তাঁকে নিজের কাছে বসিয়ে খাদ্য পরিবেশন করেন। শশিভূষণ সেখানেও সঙ্গে নিয়ে যান ভরতকে। পাশাপাশি পাত পাত হয় দু’জনের। এতদিন পর্যন্ত এ বাড়ির অন্দরমহলে ভরতের প্রবেশ-অধিকার ছিল না, এখন ভরতের গতিবিধি অবাধ। ভরত সম্পর্কে শশিভূষণের মেজদাদার অনেক অভিযোগ আছে, কিন্তু এখন তিনি তা উত্থাপন করেন না। ভরতের প্রতি শশিভূষণের দুর্বলতা দেখে তিনি নিরস্ত হন। ব্যবসায়ের প্রয়োজনে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে বেশ কিছুটাকা ঋণ চাইবেন বলে মনস্থ করেছেন মণিভূষণ।
দুই মহলে যাতায়াতের পথে ভূমিসূতার সঙ্গে এখন প্রায়ই দেখা হয় ভরতের। কথা হয় না বিশেষ। দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে চায়। ভূমিসূতার দৃষ্টির আড়ালে যে বিষণ্ণতা, তা অনুভব করে ভরত প্রতিবারই ভাবে, এই দুঃখী মেয়েটিকে সে আর দুঃখ পেতে দেবে না, কথা দিয়েছে। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ সে এখনও কিছু চিন্তা করে নি। শশিভূষণ এসে পড়ায় সব কিছু মুলতুবি আছে।
ভূমিসূতার আস্তে আস্তে একটু সাহস বেড়েছে, সে আবার গোপনে গোপনে ভরতের ঘরে আসে। অবশ্য যখন ভরত থাকে না। সে আসে বই পড়ার টানে, বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভরতের ঘরের সব কিছু গুছিয়ে রাখে নিপুণ হাতে। ভরত সে কোমল হস্তের স্পর্শ টের পায়। এখন আর সে বিরক্ত হয় না। টেবিলের ওপর একটি ছোট্ট রেকাবিতে সুপুরির কুচি ও মৌরি ভাজা রেখে গেছে ভূমিসূতা। ভরত সেদিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, হঠাৎ তার গলার কাছে একটু বাষ্প জমে যায়।
ভূমিসূতাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এতদিন তার কল্পনায় ভবিষ্যতের কোনও স্পষ্ট ছবি ছিল না, এখন তার একটি আকাঙ্খাই প্রতিদিন স্বপ্ন হয়ে আসে, স্বপ্নটি ফুলের মত একটু একটু করে পাপড়ি মেলেছে। এ স্বপ্নের কথা এখনও জানানো হয়নি। সেরকম সুযোগ পাওয়া যায়নি।
অবশেষে সার্কুলার রোডেই একটি বাড়ি পছন্দ হয়। দেড় বিঘে জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, মধ্যে বাগান ও পুরনো বড় বড় গাছ রয়েছে, গৃহখানি দুটি ভাগে বিভক্ত। সামনের অংশটি দোতলা, মোট ছ’খানি ঘর আছে, একতলার তিন দিকেই টানা বারান্দা। পিছনের দিকটি সামনের তুলনায় অনেক বেশি মূল্যবান সরঞ্জামে নির্মিত, ইটালিয়ান মার্বেল পাথরের মেঝে, প্রতি ঘরের জানলায় কাচ ও কাঠের দুরকম পাল্লা।
বাড়িটির এ রকম আকৃতিই বিশেষ উপযোগী। সস্ত্রীক আসবেন মহারাজ, তার বসবাসের জন্য খোলামেলা বাড়ি, সামনে থেকে সব দেখা যায়, এমনটি মানাত না। একটা অন্দরমহল দরকার। এই বেশ হল, সামনের দিকে শশিভূষণ থাকবেন, তাঁকে পাকাপাকিই এখানে থাকতে হবে, এরকমই মহারাজের নির্দেশ, একতলায় ত্রিপুরা রাজ্য-সরকারের একটি দফতরও খোলা হবে। পিছনের দিকটি হবে মহারাজের অন্দরমহল।
বাড়িটি পুরোপুরি পরিদর্শন করার পর ছাদে এলেন শশিভূষণ। এক দিকে দেখা যায় আগাছা ভরা প্রান্তর ও জলাভূমি, খানিক দূরেই বড় টানা জালে মাছ ধরছে কয়েকজন জেলে। তার কাছেই ধানের খেত। আর সার্কুলার রোডের অন্য পারে অগণ্য নতুন নতুন গৃহ, এক একটি তিনতলা বাড়ি যেন আকাশচুম্বী। দশ-পনেরো বছর আগেও কলকাতায় এত উঁচু বাড়ি ছিল না।
ভরতের কাঁধে হাত রেখে শশিভূষণ বললেন, এবার তোর জন্য একটা থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। ভরত চমকে উঠে বলল, আমার জন্য? আমি এই বাড়িতে থাকিব?
শশিভূষণ হেসে বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এ বাড়িতে তোর আর পা দেওয়া দূরে থাক, এখানকার ত্রিসীমানার মধ্যেও তুই কখনও আসবি না। ত্রিপুরা থেকে কিছু কর্মচারী এসে এখানে থাকবে। তারা তোকে দেখলে চিনে ফেলতে পারে। আর মহারাজের নজরে পড়লে তোর ভাগ্যে আবার কী ঘটবে কে জানে। ত্রিপুরায় সরকারি ভাবে তুই মৃত, তা জানিস তো। অন্যান্য রাজকুমারদের মুখে আমি সেরকমই শুনেছি। তোর নামটা এখানে এসে বদল করলেই ভালো হত।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আমি আরও একটা কথা চিন্তা করছি, ভরত। আমার বাড়িতেও বোধ হয় তোর আর থাকাটা ঠিক হবে না। মহারাজ খামখেয়ালি মানুষ রাজকীয় রীতিনীতি অনেক সময়ই মানেন না। তিনি হয়তো-বা কিংবা নিশ্চিতই কখনও আমার পৈতৃক বাড়ি দেখতে যেতে চাইবেন।
ভরত বলল, তখন আমি লুকিয়ে থাকব? শশিভূষণ বললেন, মহারাজ, কবে বা কখন যাবেন, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমার আমন্ত্রণের তোয়াক্কা না করে নিজেই যদি হঠাৎ কোনও সকালে উপস্থিত হন? তুই মহারাজের চোখে না পড়লেও আমার সঙ্গে তোর সম্পর্ক রয়েছে, এটা কোনওক্রমে জানাজানি হয়ে গেল তোর বা আমার পক্ষে তা সুখকর হবে না। তুই অনেক দূরে, বাগবাজার-শ্যামবাজারের দিকে বাসা-ভাড়া করে থাকতে পারবি?
ভরত তৎক্ষণাৎ কোনও উত্তর দিতে পারল না। শশিভূষণ বললেন, তোকে অর্থচিন্তা করতে হবে না। যতদিন পড়াশুনো চালিয়ে যেতে চাস চালিয়ে যাবি। তার পরও যতদিন না তোর নিজস্ব জীবিকার ব্যবস্থা হয়, ততদিন তুই বৃত্তি পাবি। তোর বাসা ভাড়াও আমি দিয়ে দেব।
স্বাধীনভাবে ভরত একটি নিজস্ব বাড়িতে থাকবে, এতে তার খুশি হওয়ারই কথা। মণিভূষণের সঙ্গে তার বনিবনা হবে না কোনও দিন, শশিভূষণ না থাকলেই আবার যখন-তখন সংঘর্ষ বাধবো। ভরতের নিজস্ব হলে বন্ধুরা আসতে পারবে বিনা বাধায়, ইচ্ছেমতন রান্না করে খেতে পারবে। বাড়ির কাজের জন্য একটি লোক রেখে দিলেই চলবে।
তবু ভরতের মনটা দমে গেল। ভূমিসূতার কী হবে? ভরত কথা দিয়েছিল, সে ভূমিসূতাকে ছেড়ে যাবে না। কিন্তু ভূমিসূতাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেই বা কী করে। তা যে অসম্ভব! পরদিন থেকেই ভরতের জন্য বাসার খোজ শুরু হল। ভরত নিজেই একবার প্রস্তাব দিয়েছিল, মুসলমান পাড়া লেনের মেস বাড়িতে সে ভর্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু শশিভূষণের মেস বাড়ি পছন্দ নয়, তা ছাড়া শিয়ালদা অঞ্চলটি বেশ কাছাকাছি হয়ে যায়।
একজন উত্তর কলকাতায় বিডন স্ট্রিটের কাছে হরি ঘোষের গলিতে একটি ছোট বাড়ির সন্ধান দিল। একতলায় মশলার গুদাম, সেখানে সন্ধের পর একজন দারোয়ান ছাড়া আর কেউ থাকে না, দোতলায় দুখানি ঘর, অল্প একটু খোলা ছাদ। অতিশয় ভদ্র পল্লী। কাছাকাছি। কয়েকটি স্কুল ও কলেজ, সুন্দর পরিবেশ। বাড়িটির ভাড়া তেমন বেশি নয়, আট টাকা। আগে যে পরিবারটি সেখানে ভাড়া থাকত, তাদের মহিম ভৃত্যটি বেকার, সে আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। তাকেই কাজের জন্য নিযুক্ত করা হল।
সব কিছুই ঘটে গেল খুব দ্রুত।
দুদিনের মধ্যেই বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে চলে যেতে হবে ভরতকে। ভূমিসূতা এখনও কিছুই জানে না। কী করে জানাবে তাকে। অন্দরমহল থেকে ভূমিসূতাকে ডেকে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। শশিভূষণ সব সময় কাছাকাছি থাকেন বলে ভূমিসূতাও কাজের ছলে ভরতের সামনে আসে না। ভূমিসূতাকে কিছু না জানিয়েই সে চলে যবে। এই অসহায় মেয়েটার হাত ধরে ভরত বলেছিল, আমি তোমার পাশে থাকব। এখন কাপুরুষের মত ভরত দূরে সরে যাবে।
বই খাতা-পত্র বাণ্ডিল করে ভরত দড়ি দিয়ে বাঁধেছে আর মনে মনে বলছে, এই সময় ভূমিসূতা তাকে সাহায্য করার জন্য এলেও তো পারত। ভূমিসূতা লেখাপড়া জানে, তাকে ঠিকানা দিয়ে গেলে সে চিঠি লিখতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ কেন এসে পড়ছে না ভূমিসূতা! শশিভূষণের পাশাপাশি খেতে বসেছে ভরত, কৃষ্ণভামিনী পরিবেশন করছেন। একটু দূর থেকে ব্যঞ্জনের পাত্রগুলি এগিয়ে দিচ্ছে ভূমিসূতা। ভরত মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে, চোখাচোখি হলেও ভূমিসূতা কয়েক মুহূর্তেই বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে সাহস পায় না। এই বাঘের বাসার মধ্যে কি শুধু দৃষ্টি বিনিময়েও কথা বলা যায়। কৃষ্ণভামিনীর নজর অতি তীক্ষ্ণ
আঁচাবার সময় ভূমিসূতা শশিভূষণের হাতে জল ঢেলে দিল। সেটাই স্বাভাবিক। ভরত নিজেই জল নিচ্ছে, সে দেখতে পাচ্ছে ভূমিসূতার মুখের একটা পাশ।
অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় পায়চারি করল ভরত, যদি ছাদের কার্নিশে দেখা যায় ভূমিসূতাকে। কিন্তু পাশের ঘরে মণিভূষণ তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করছেন, তাই ভূমিসূতা এদিক পানে আসতেই ভরসা পায় না। ভূমিসূতা আশা করে আছে, শশিভূষণ নতুন বাড়িতে চলে গেলেই ভরতের সঙ্গে তার নিশ্চিন্তে দেখা হবে।
পরদিন সকালেই ভরতের চলে যাবার কথা। বাড়ির মধ্যে এ কথাটা ঘোষণাও করা হয়নি। এ আর এমন কি ব্যাপার, একজন আশ্রিত ছিল, এখন সে বিদায় নিচ্ছে। মণিভূষণ শুধু জানেন। দাস-দাসীরা টের পাবে কয়েকদিন পর।
ভরতের জন্য ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। শশিভূষণ আজ ভরতের সঙ্গে যেতে পারবেন না, ত্রিপুরার এক কর্মচারী এসে পৌঁছবে দুপুরে। ভরতের বিছানাপত্র বাঁধা শেষ, তবু সে বারবার এসে দাঁড়াচ্ছে বারান্দায়। সত্যি সত্যি ভূমিসূতাকে কিছু না জানিয়ে সে চলে যাবে? অথচ এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে একজন বিশেষ দাসীকে ছলছুতোয় ডেকে পাঠানো যায়?
হঠাৎ ভরত দেখল, অন্দরমহল থেকে তিনজন মহিলা ঘোমটায় পুরো মাথা ঢেকে নেমে গেলেন নিচে। সদর গেটের কাছে অপেক্ষা করছে একটি পালকি। কোনও গিনি গঙ্গাস্নানের যাচ্ছেন, আজ চন্দ্রগ্রহণ। ওই তিন রমণীর মধ্যে একজন ভূমিসূতা নয়? এমনই সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত যে বোঝার উপায় নেই, তবু চলার ভঙ্গিতে মানুষকে চেনা যায়। ভূমিসূতা গঙ্গাস্নানে যাচ্ছে, তা হলে তো আর দেখাই হবে না।
তিন রমণী যখন পালকির কাছে পৌঁছে গেছে, তখন ভরত মরিয়া হয়ে ডেকে উঠল, ভূমি, ভূমি!
ভূমিসূতা হয় শুনতে পায়নি, অথবা শুনলেও তখন সাড়া দেবার উপায় নেই। শেষ কালে সে ঢুকল পালকিতে, একবার ঘোমটা সুদ্ধ মুখ ফেরাল এদিকে, ভরত তার চোখ দেখতে পেল না, তবু সে একটা হাত তুলল, সেই হাতের মুদ্রায় বলতে চাইল, আমি আছি, তোমার জন্য আমি আছি, কিন্তু ভূমিসূতা বুঝতে পারল কিনা কে জানে।
ভরতের বুকটা একেবারে খালি হয়ে গেল! এ কী করল সে! যে-কোনও উপায়ে গতকাল ভূমিসূতার সঙ্গে দুটো একটা কথা বলা অবশ্যই উচিত ছিল তার। অবান্তর কিছু বললেও চলত, তবু কথা বলা হত। কিছুই বলল না সে!
ভূমিসূতার নামে একটি চিঠি লিখে যাবে? যদি অন্য কারুর হাতে পড়ে। সে সম্ভবনা খুব বেশি। ভরত চলে যাবার পর এ ঘরে যে-কেউ এসে ঢুকতে পারে। চিঠি পেয়ে কেউ তুলকালাম করতে পারে।
ইচ্ছে করে খাটের নীচে দুটি বই ফেলে দিল ভরত। ওই বই নেবার ছুতোয় তাকে আর একদিন আসতেই হবে। এই বই দেখে ভূমিসূতা কিছু বুঝতে পারবে না?
শশিভূষণ তাড়া দিলেন, ভরতকে সব জিনিসপত্র গাড়িতে তুলতেই হল। এ বাড়ির দ্বার তার জন্য বন্ধ হয়ে গেল, সে পা বাড়াচ্ছে অনিশ্চিতের দিকে। শশিভূষণকে প্ৰণাম করল ভরত।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর ভরতের বারবার মনে হতে লাগল, সে একজন প্রতারক। ভূমিসূতাকে সে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিল। এত সঙ্কোচ কিসের, ভূমিসূতাকে সে জোর করে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারত না? কিন্তু শশিভূষণ কি তা সমর্থন করতেন? সমাজ কি তা মেনে নিত! শশিভূষণের ওপর এখনও সে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, তাঁর দাক্ষিণ্য না পেলে সে অনাথ।
ভরতের চক্ষু জ্বালা করতে লাগল।
এর পর শশিভূষণ সার্কুলার রোডের বাড়ি সাজাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মহারাজ খবর পাঠিয়েছেন, তিনি শীঘ্ৰ আসছেন। নতুন নতুন আসবাব লাগবে। পালঙ্ক, আলমারি, আয়না থেকে শুরু করে পাপোশ পর্যন্ত সব কিছুর অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে, শশিভূষণ নিজে তদারক করেছেন। এক সময় তিনি অনুভব করলেন, গৃহসজ্জায় কিছুটা মেয়েলি স্পর্শের প্রয়োজন। পালঙ্কটি ঘরের কোন দিকে রাখা হবে, আলমারির আয়নায় রোদ্দুর পড়লে তা তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, জানলায় কোন রঙের পর্দা মানায়, তা মেয়েরা ভালো বোঝে। সে জন্য তিনি কৃষ্ণভামিনীর সাহায্য চাইলেন।
বাড়ি সাজাতে মেয়েরা সব সময়েই ভালোবাসে। হোক না তা পরের বাড়ি। এ বাড়িতে এসে শশিভূষণের ব্যবস্থাপনা দেখে তিনি হেসেই বাঁচেন না। অনেক কিছুই আনিয়েছেন শশিভূষণ, কিন্তু ঘরগুলো দেখলে মনে হয় যেন জিনিসপত্রের গুদোম।
সব কিছুই আবার সরাবার আদেশ দিলেন তিনি। রাস্তা থেকে ধাঙড় ডেকে বাড়ির সব আবর্জনা পরিষ্কার করিয়েছে শশিভূষণ, কিন্তু শয়নকক্ষগুলি কি ধাঙড়ের ঝাঁটায় শ্ৰী পেতে পারে। নিজের দাসদাসীদের আনিয়ে নিলেন কৃষ্ণভামিনী, তারা সারা বাড়ি ধোয়ামোছা করতে লাগল। কোথাও একটু ঝুলকালির চিহ্নমাত্র রইল না, মেঝের পাথরের পালিশ ফিরে এল।
কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়িটির রূপ ফিরে গেল। হ্যাঁ, এখন রাজা-মহারাজাদের বসবাসের যোগ্য হয়েছে বটে।
সামনের দিকের দোতলায় হবে শশিভূষণের নিজস্ব আস্তানা। কৃষ্ণভামিনী এবার সেখানে মন দিলেন। ভবানী পৈতৃক বাড়িতে সব ব্যবস্থা থাকতেও শশিভূষণকে থাকতে হবে এখানে। রান্নাঘর, স্নানের ঘর, শয়ন ঘর সবই করা দরকার। রান্নার একজন ঠাকুর নিযুক্ত হয়েছে, সে কোন পদের রাঁধুনী তা কে জানে। কৃষ্ণভামিনীর খালি মনে হয়, তাঁর দেবরটির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অনেক ঘাটতি হবে এ বাড়িতে।
বাড়ির অন্যান্য দাস-দাসীদের মধ্যে ভূমিসূতাও এখানে আসে কাজ করতে। একদিন কৃষ্ণভামিনী শশিভূষণকে বললেন, ঠাকুরপো, এই মেয়েটিকে আমি তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। রান্নাবান্না জানে, ঘরের কাজ জানে, তোমার অনেক সাহায্য হবে।
শশিভূষণ ভূমিসূতার দিকে তাকালেন। এখন তার মাথায় ঘোমটা নেই, সে দরজার একটি পাল্লা ধরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শশিভূষণ নাম ভুলে গেছেন, একদিন প্রবল জ্বরের ঘোরে এই মেয়েটিকে দেখেই যে তাঁর অলৌকিক কিছু মনে হয়েছিল, তাও বিস্তৃত হয়েছেন।
বাড়ির কাজে তো অনেক দাস-দাসী রাখতে হবে, তাই তিনি বললেন, বেশ তো। ও যদি এখানে কাজ করতে চায় তো থাকুক।
কৃষ্ণভামিনী বললেন, চাইবে না। আবার কী! আমরা যেখানে বলব। সেখানে থাকবে। ওকে মাইনেও দিতে হবে না, শুধু খোরাকি দিলেই চলবে।
শশিভূষণ একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন বিনা মাইনেতে কাজ করবে কেন?
কৃষ্ণভামিনী বললেন, ওকে সারা জীবনের বেতন দেওয়া আছে। একটু-আধটু লিখতে পড়তেও জানে, তোমার হিসেবপত্রও রাখতে পারবে, দেখো যেন টাকা-পয়সা নয়-ছয় না হয়।
ভূমিসূতাকে এখানে রাখার একটা স্বার্থও আছে কৃষ্ণভামিনীর। তিনি এই মেয়েটিকে তাঁর স্বামীর দৃষ্টি থেকে দূরে রাখতে চান। মন, একবার উচাটন হয়েছিল, আবার যে হবে না তার ঠিক কি! এক সরাবার উপায় খুঁজছিলেন তিনি। তাঁর স্বামীও মেয়েটির বেশি বেশি সেবা চান। তিনি আর আপত্তি করতে পারবেন না, তাদের এস্টেটের টাকায় কেনা এই ক্রীতদাসী তাদের পরিবারের একজনের কাছেই তো থাকছে।
কৃষ্ণভামিনী বললেন, বুমি, তুই আজ থেকেই এখানে রয়ে যা। তোর জামা-কাপড়, বিছানাপত্তর আমি পাঠিয়ে দেবনে। মন দিয়ে কাজ করবি। রাজবাড়ির কাজ, হলে গর্দান যাবে। এখন যা এখান থেকে।
ভূমিসূতা সেখান থেকে সরে যেতেই কৃষ্ণ ভ্ৰভঙ্গি করে বললেন, কী গো, ওকে পছন্দ হয়েছে?
শশিভূষণ ভুরু তুলে বললেন, পছন্দ-অপছন্দের কী আছে? তুমি রাখতে বলছ, তোমাদের কাছে অনেক দিন কাজ করেছে।
কৃষ্ণভামিনী বললেন, ওর অনেক গুণ। ও মেয়ে বিদ্যোধরী। দেখো বাপু, যেন মাথা ঘুরে না যায়!