ডেইলি পিপল পত্রিকার সাব-এডিটর নির্মলেন্দু গুণ লুকিয়ে আছেন ময়মনসিংহ জেলার বারহাট্টা গ্রামে। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে তার তেমন অসুবিধা হয় নি। লম্বা দাড়িতে তাকে দেখাতো তরুণ সুফিদের মতো। ঢাকা ছেড়ে আসার দিনও তিনি শহরে নিজের মনে হেঁটেছেন। শহীদ মিনারের দিকে গেলেন। দূর থেকে দেখলেন। কাছেই জি সি দেবের কোয়ার্টার। এই দার্শনিক মানুষটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না। তবু কী মনে করে যেন গেলেন। শূন্য বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকালেন। আবার পথ হাঁটা। দূর থেকে ইকবাল হল দেখা।
তিনি হাঁটতে হাঁটতে হাইকোর্টের মাজারের দিকে গেলেন। এখানে এসে বড় ধরনের চমক খেলেন। দুটা লম্বা টেবিল পেতে মিলিটারিরা অফিসের মতো করেছে। রেডিও-টেলিভিশনের ঘোষণা মতো বেসামরিক লোকজনদের কাছ থেকে অস্ত্ৰ জমা নেয়া হচ্ছে। প্রতিটি থানায় অস্ত্র জমা নেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমস্যা হলো অনেক থানা আছে, যেখানে কেউ নেই। বাঙালি পুলিশ থানা ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে। সে কারণেই হয়তো বিকল্প ব্যবস্থা।
ঢাকা শহরের বেশকিছু লোক অস্ত্র জমা দিতে এসেছে। তারা মিলিটারিদের দিকে তাকাচ্ছে না। তাদের দৃষ্টি মাটির দিকে। অস্ত্ৰধারী হবার অপরাধে তারা যেন মরমে মরে যাচ্ছে।
মিলিটারিদের ভেতর থেকে একজন নির্মলেন্দু গুণের কাছে এগিয়ে এলো। ধমক দিয়ে জানতে চাইল–কী চাও তুমি?
নির্মলেন্দু গুণ বিনীতভাবে বললেন, অস্ত্র জমা দেয়া দেখি।
তুমি এই দৃশ্য দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ?
জি জনাব।
ভাগো হিয়াসে। ভাগো।
মিলিটারি হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার মতো ভঙ্গি করল। নির্মলেন্দু গুণ হাঁটা ধরলেন। হাঁটতে হাঁটতেই ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা। নেত্রকোন থেকে বারহাট্টা। তার নিজের বাড়ি। এই বাড়িতেই এক নিশুতি রাতে তিনি আগ্নেয়াস্ত্ৰ নামের ছোট্ট একটি কবিতা লেখেন—
পুলিশ স্টেশনে ভিড়, আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের
সন্দিগ্ধ সৈনিক। সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের
শটগান, রাইফেল, পিস্তল এবং কার্তুজ, যেন দরগার
স্বীকৃত মানৎ, টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত।
আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি
কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে
অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক
একটি আগ্নেয়াস্ত্ৰ, আমি জমা দেই নি।