1 of 2

৩৮. চিঠিটি হাতে পেয়ে

চিঠিটি হাতে পেয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল পৃথু।

লিখেছে কুর্চি কারখানারই ঠিকানাতে। ভালই করেছে। বোয়ালমাছের যেমন কচিপোনা দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে, রুষারও কুর্চির চিঠি দেখলেই কপাৎ করে গিলে খেতে ইচ্ছে করে! এই চিঠিটিও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে যদি হত, তাহলে হারিয়ে-যাওয়া কুর্চির খবরও তার পেটে চলে যেত মাছেরই মতো। ছটফট করে মরত পৃথু।

উধাম সিং ডাকলেন ইনটারকম্‌-এ।

চিঠিটি হিপকেটে গুঁজে ওঁর ঘরে গেল পৃথু। বেশ অনেকটা হাঁটতে হয় কারখানার চত্বর থেকে অফিসে এম ডির ঘরে পৌঁছতে।

সিং সাহেব গম্ভীর মুখে বসেছিলেন।

গুড মর্নিং পৃথু। কাম। বী সীটেড।

হোয়াট উড য়ু লাইক টু হ্যাভ? টি আর কাফি? দুধ মাঙ্গাউ।

পাঞ্জাবী উচ্চারণে বললেন, সজ্জান উধম সিং।

ওরা কারখানাতে চারটে আকাট অস্ট্রেলিয়ান গরু ইমপোর্ট করেছে মাস ছয়েক হল। লাড্ডুর প্রেস্টিজ ষাঁড় তাদের চারজনকেই ইতিমধ্যেই প্রেস্টিজ দান করেছে। তাঁরা সকলেই মা হবেন, সামান্য সময়ের ব্যবধানে। তখন, দুধের বন্যা বইবে ভুবনে। এখন ক্যান্টিনের দিশি দুধ।

নো। থ্যাংকস। বলল, পৃথু।

কী করা যায় বলো তো? পরামর্শ করার মতো কেউই নেই আমার। এই দেখো, কেয়ারিনক্রস থেকে জুনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট কী লিখেছেন?

বলেই, একটি টেলেক্স, মেসেজ এগিয়ে দিলেন পৃথুর দিকে।

পাঠিয়েছে কে?

হ্যারী রবসন! আবার কে?

টেলেক্সটা হাতে তুলে নিল পৃথু।

ফ্রম এইচ/এইচ টু ইউ/এস্।

প্লীজ রেফার টু মাই টেলেক্স ডেটেড নাইন/ নো রিপ্লাই রিসিভড ফ্রম পি. জি./সীনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইজ হাইলী অ্যানয়েড/ ইমডিয়েটলী কল ফর অ্যান এক্সপ্লানেশান ফ্রম হিম/ উই হ্যাভ টু এন্টার ইনটু আ ডায়ালগ উইথ হিম/ নো-ওয়ান ইজ ইনডিসপেনসিবল ইন ব্রাডলী গ্রুপ/ আনলেস হী ইমপ্রুভস হিমসেল্ক, হী উইল গেট দ্যা স্যাক/ সরী/ উই কুডনট কেয়ারলেস/ হাউ ইজ প্রীতম/ প্লীজ কনভে মাই রিগার্ডস টু হার।

—রিগার্ডস/হ্যারী/

কিসের এক্সপ্লানেশান সিং সাহাব?

সে কী?

আমি তো কিছু জানি না।

বলো কী তুমি! সদারজী চেয়ারে উঠে বসলেন সোজা হয়ে। দাড়ির যেটুকু দুদিকে বেরিয়ে ছিল তা বাঁধনীর মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে উদ্বেগের গলায় বললেন, শর্মা দেয়নি তোমাকে? তুমি সেদিন আসোনি অফিসে তাই…।

শমা! কোন শমা? ইমম্যাটেরিয়াল সরী মেটেরিয়াল ম্যানেজার?

উধম সিং হেসে উঠলেন। তোমরা ওকে ইমেটেরিয়াল বল না কি?

পৃথুও হাসল, বলল, হ্যাঁ। সকলেই।

সেকি! সে তো মেটেরিয়ালিজএর কনসেপ্ট হচ্ছে!

আমি তো এই টেলেক্সের কোনও মাথা-মুণ্ডুই বুঝতে পারলাম না।

অলরাইট। শর্মাকে ডেকে আমি ফিগার-আউট করছি কেন সে তোমাকে এমন ইম্পট্যান্ট টেলেক্সটি দেয়নি।

কিছু ছিল কি তাতে?

সীরিয়াস অব আলেগেসান। তুমি মনমৌজী ভাবে অফিস করো। ইচ্ছে হলে আসো, ইচ্ছে হলে আসো না, আজে বাজে লোকের সঙ্গে মেলামেশা কর, কোম্পানির লাঞ্চরুমে লাঞ্চ খাও না, জুতোর দোকানি, মোটর মেকানিক এদের সঙ্গেই তোমার হনবিং, ক্লাবে যাও না একদিনও, হোল্ডিং কোম্পানীর লোকেরা এলে তাঁদের ইম্পর্ট্যান্স দাও না, খাতির করো না, সঙ্গ দাও না, তোমার সঙ্গে তোমার স্ত্রীর রিলেশান ভাল নয়, আরও নানা ব্যাপার। ইন ফ্যাক্ট এগুলো সবই চিঠিতে লিখেছিলেন। চিঠিটা আমার কাছেই আছে। বলেই, ড্রয়ার খুলে ছুঁড়ে দিলেন, এই নাও। স্ট্রিক্টলি কনফিডেনশিয়াল।

তারপর বললেন, আগের টেলেক্সটা শর্ট এবং ক্রীপ্টিক ছিল। তুমি ছিলে না বলেই এবং তাড়াতাড়ি উত্তর দেওয়া দরকার বলেই শর্মাকে দিয়েছিলাম একটি কপি, তোমাকে দিয়ে দিতে। আশ্চর্য!

পৃথু, টেবল থেকে পেপার-কাটারটা তুলে নিয়ে কল্পনায় ওর বাঁ হাতের আঙুলগুলো ডান হাত দিয়ে কাটছিল। এটা অভদ্রতা। কারও ঘরে ঢুকে তার টেবলের কোনও জিনিসেই না বলে হাত দেওয়া অভদ্রতা। কিন্তু উধাম সিং-এর সঙ্গে পৃথুর সম্পর্কটা ভদ্রতার নয়। সৌহার্দ্যর।

দুজনেই চুপচাপ। সুইস গ্রান্ডফাদার ক্লকটার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। সাইরেন বাজল, লাঞ্চ ব্রেকের। হাউ বাউট হ্যাভিং লাঞ্চ হিয়ার?

নোপ। অন্যমনস্ক হয়ে বলল, পৃথু।

কেয়ার ফর আ ড্রিঙ্ক পৃথু? লেটস গো টু দা ক্লাব। ওর উই ক্যান হাভ ইট ইন দা লাঞ্চ রুম। নো। থ্যাঙ্কট্য। ডোন্ট ফীল লাইক।

পৃথু বলল।

তারপর বলল, হোয়াট আর দে আপ টু?

সর্দার উধম সিং রিভলভিং চেয়ারে এক পাক ঘুরেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আবার বসে পড়ে বললেন, ই এ মামলা আচ্ছি তারা নাআল সমঝ লে পীরথু। তেরে তো কোই ইত্বার নাহিন রাহ্ গিয়া।

একটু থেমে গম্ভীর হয়ে বললেন, উ্য সী পীরথু, হ্যারী আলসো স্পােক টু মী অন দা ফোন লাস্ট নাইট। হোয়াট টু ড়ু? ম্যায় উহদে নাআল্ দো ঘন্টে গাঁলা করদে রিহা। বাট হোয়াট ফর? দ্যাট ম্যান ইজ আ রোগ!

আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, শালারা ভাবে কী বলত? ফিফটিওয়ান পার্সেন্ট শেয়ার আমাদের কজন কর্মচারীকে গিফ্ট করে দিয়ে শেয়ার স্ক্রিপ্টগুলো তাদেরই নমিনী ছাড়া আর কাউকেই বিক্রি করব না এই স্টেটমেন্টেও সই করিয়ে নিয়ে আমাদের মালিক বানিয়ে দিয়ে বাঁদর নাচাচ্ছে।

শেয়ার স্ক্রিপ্ট তো নেই আমার কাছে। পৃথু বলল।

আমার কাছেও নেই।

দেয়ইনি আমাদের। অডিটরও বিলিতি ছাপমারা অডিটার। লালমুখোরা এখনও গায়ের গন্ধ রেখে গেছে সেখানে। যা বলছে, সাহেবরা তাইই সই। শেয়ার স্ক্রিপ্ট দেখার দরকার পর্যন্ত নেই। এখনও আমাদের, আমাদের লেবারারদের ‘নেটিভ ভাবে তারা। তেমন হয়েছে গভর্নমেন্ট! বগলের তলা দিয়ে হাতি চলে যায় তবু দেখে না।

পৃথু বলল, দোষ তো আমাদেরই। আমরা ফালতু কজন ইন্ডিয়ানসরাই তো আমাদের নিজেদের সুখের জন্যে, ফালতু স্ট্যাটাস-এর জন্যে এই চক্র ছিড়ছি না। আমরা কি কাজ জানি না? একটা ফ্যাক্টরী ভাল করে চালাতে আমরা পারি না কি?

পারি। কিন্তু মার্কেটিং। মার্কেটিং-এ যে ওরা গত একশ বছর ধরে লন্ডনে বসেই কনট্রোল করে আসছে। আসল বাজার তো এক্সপোর্ট।

করব না আমরা এক্সপোর্ট। ইনল্যান্ড মার্কেটেই সাপ্লাই দেব শুধু। ইণ্ডিয়া এখন মস্ত মার্কেট। রাজি আছেন আপনি? তো বলুন ছেড়ে দেব এই অসম্মানের চাকরি। ভোপাল এয়ারপোর্টে গিয়ে শালাদের জন্যে মালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগে না আর। সাপের পাঁচ পা দেখেছে।

পৃথু বলল।

এই ফোরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশান অ্যাক্ট হবার আগে তবু ব্যাটাদের নিজে হাতে কিছু কাজ করতে হত, এখন তো তাও হয় না। আমাদের ওপরই ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিস্তার টাকা চালান দিচ্ছে ইংল্যান্ডে। এন্ড উই আর আ পার্টি টু ইট। আ সীক, ডাম্ব, পার্টি। জেলে যাবার সময় জেলে যেতে হবে আমাকে পিরথু, মাখম খাবার সময় ওরা। চলো, ছেড়ে দিই। করিই একটা কোম্পানি। ব্যাঙ্ক টাকা দেবে।

ওদের যা টাকার জোর। দেখবেন, ব্যাঙ্ক ম্যানেজারকে বিলেতে ঘুরিয়ে এনে, কালার টিভি ভিসি আর প্রেজেন্ট করে আমাদের লোনটা আটকে দেবে। দেশটা তো হাভাতে ভর্তি। ফোরেনে বেড়াতে পেলে আর ফোন গুডস পেলে নিজের মেয়েকেও তুলে দেবে হাতে। এই কথা ভাবলেই মন ভেঙে যায় যে, এত বছর হয়ে গেল দেশ স্বাধীন হল, এতদিনেও আমাদের একটা ন্যাশানাল প্রাইড, ন্যাশানাল এনটিটি হল না। দেশের সঙ্গে এখনও আমরা নিজেদের আইডেনটিফাই করতে পারি না। ভাল বুদ্ধি নেই তো খারাপ বুদ্ধি তো অনেকই আছে।

তা বটে।

তাছাড়া, আপনারা করলে, আমি সঙ্গে থাকব। ব্যসস এটুকুই। আমার আর কাজ করতে ভালই লাগে না। সত্যিই আমি মনমৌজী লোক।

এটা ভাল নয়। তুমি তো কিছু করলেও না জীবনে! তোমার ক্রিয়েটিভ ফীল্ডেও তো তুমি একজন ওয়েস্টার। যদি এসে বলতে আমাকে কোনওদিন : ‘আঁসী ইয়ে কিতাঁব লিখি হাই কত না খুশি হতাম আমি। কিছুই করলে না। ব্রিলিয়ান্ট এঞ্জিনিয়ার, কাজে মন দিলে এই ইন্ডাস্ট্রীতে তুমি রেভলুশান আনতে পারতে। বিয়ে করেছ, এমন সুন্দরী অ্যাকম্লিশ বউ তোমার, ফুটফুটে দুটি ছেলেমেয়ে। তোমার দায়িত্ব কর্তব্যও কি কিছু নেই? তুমি এমন কেন হয়ে গেলে বলো তো পৃথু! তোমাকে দেখলে আমার সত্যিই কষ্ট হয়।

আমারও হয়।

বলে, পৃথু উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে।

ভাবল, উধম সিংকে বলে লাভ নেই যে, টাকা রোজগার বা শেল্যাকের কারখানা ছাড়াও আরও করার অনেকই কিছু থাকতে পারে একজন মানুষের জীবনে। নিজের কোনও কাজই হল না। কিছুই হল না, জীবনের বেলা পড়ে এল অথচ।

মুখে বলল, আপনি ক্লাবে যান সিংসাব। আর হ্যারীকে বলে দিন যে, আই কুড় নট কেয়ারলেস। চাকরি, ওরা চাইলে, আমি ছেড়ে দেব। ফরেস্ট-ফার্মিং করব না হয়। খাটনি নেই। উ্যকালিপটাস লাগাব, পেপার মিলে সাপ্লাই দেব। কিন্তু এই কোম্পানি ছাড়ার আগে আই ওয়ান্ট টু টক টু হিম। এখনও অনেক ইনইকুয়ালিটিজ রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। সেগুলো ঠিক করে দিয়ে তবে আমি যাব। নইলে তাদের সিংহাসন নিয়েই নামব নীচে। আই উইল গিভ হিম আ বিট অফ মাই মাইণ্ড। হি উইল নো! ফেরা কোম্পানির কায়দা আমি সব চটকে দিয়ে যাব। এমনই চটকাব যে, দেশের অন্য সব ফেরা কোম্পানি নিয়েই গভর্নমেন্টকে নতুন করে ভাবতে হবে।

তুমি বড় উত্তেজিত হয়ে পড় সহজে। এতে প্রেসার বাড়ে, হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।

সহজে হই না। এই উত্তেজনা, হ্যারী, ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যাকাইভর এবং আপনার ইমমেটেরিয়াল ম্যানেজার গত পাঁচ বছর ধরেই গড়ে তুলেছে আমার মধ্যে। একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার এবার। দে কান্ট ব্রাও বীট মী। কল দেম হিয়ার। আপনি ওদের বলুন যে, আমি সাইকোলজিকাল কেস হয়ে গেছি। আপনি আমাকে ট্যাকল করতে পারছেন না। ওদের কারও অবিলম্বে আসা দরকার।

সত্যিই তুমি তাইই হয়ে গেছ পৃথু। এমন ভাল ছেলে ছিলে তুমি। সত্যিই কেমন ক্ষ্যাপাটে হয়ে গেছ আজকাল। তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে যাব আমি।

চলি। আমি এবারে। টেলেক্সটা পাঠিয়ে দেবেন।

বলে, উধম সিং-এর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল পৃথু। বাইরে তখন দারুণ রোদ। রোদে হেঁটে ও কারখানার গেট অবধি এসে একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে ভুচুর গারাজের দিকে চলল।

মনে মনে বলল, সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে যেতে হলে তার চেনা-জানা সকলকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। এক অদ্ভুত অসুস্থ সময়ে বাস করছি আমরা। ভুগছি দৃষিত, বক্র, এমনকী বিকৃত মানসিকতাতে। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্যি।

ভুচুর গ্যারাজে এখন খুবই কাজের ভিড়। ভুচু ক্রীসমাস প্রেজেন্ট দেয় কারখানার সব ছেলেদের। বিল আদায় করতেও দৌড়োদৗড়ি করছে সকলে। ভুচু ছিল না পকেট থেকে টাকা বের করে হুদাকে বলল, একটা ব্ল্যাকলেবেল বীয়ার আর দুটো মাটন রোল নিয়ে আসতে।

হুদা টাকা নিল না কিছুতেই। বলল, ভুচুদা জানতে পেলে মারবে আমাকে।

যাবার সময় বলল, পানও আনব তো? আপনার পান? পৃথুদা?

মাথা নুইয়ে হাসল পৃথু। নিজের শাশুড়ি নেই পৃথুর। থাকলেও ঠিক এতখানি আদর করতেন। কি না সন্দেহ। আদর যত্ন, ভালোবাসার ব্যাপারটাই বড় গোলমেলে। কোথায় যে কার জন্যে আদরের ভাত বাড়া থাকে, স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা, তা অলক্ষ্যে থেকে সব যিনি দেখেন, তিনিই একমাত্র জানেন। যেখান থেকে পাওয়ার ছিল, সেখান থেকে শূন্যতা নিয়ে ফিরতে হয় আর যেখানে প্রত্যাশার কিছুমাত্রও ছিল না সেখান থেকেই পূর্ণ হয়ে ফেরে।

চিঠিটা না পড়তে পারলে অস্বস্তি কাটছে না। এখনও নয়। হুদা বীয়ারটা নিয়ে আসুক।

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল একটা নীলরঙা অ্যামবাসাডার গাড়ির কাজ শেষ। বোধহয়, ডেলিভারির জন্যে পড়ে আছে। তারই পিছনের সীটে আরাম করে বসল পৃথু। একটা দরজা খুলে দিল। রোদ আসছে গায়ে। ডিসেম্বরের দুপুরের গায়ে ফ্লানেলের ব্লেজার-ব্লেজার গন্ধ আছে। একটা। ধুলোর গন্ধর সঙ্গে মিশে সেই গন্ধটা গাড়ির স্প্রে-মেশিনের থেকে উৎসারিত বাষ্পীয় রঙের গন্ধের সঙ্গে চারদিকে চারিয়ে যাচ্ছে। পেছনের বড় সেগুনগাছটা থেকে দাঁড়কাক ডাকছে একটা কাকা। কে জানে, এই ডাকের মানে, ভাল না খারাপ। গিরিশদা থাকলে জানা যেত। খারাপই হবে। সবই যখন খারাপ হচ্ছে পর পর কিছুদিন থেকে।

হুদা এলে, বীয়ারটা খুলিয়ে নিয়ে রোলটাকে পাশে রেখে ও হিপ পকেট থেকে চিঠিটা বের করল। খামটা ছিঁড়ে ফেলতেই ভাঁজকরা দুটি একশো টাকার নোট বেরিয়ে পড়ল তা থেকে।

পৃথুদা,

আমি জানি আপনি খুব রাগ করবেন আমার উপরে এ চিঠি পেয়ে। কিন্তু আমি নিরুপায়।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন এমন দুর্দৈবের মুহূর্ত আসে কখনও যখন তার অনেক থেকেও, কিছুমাত্রই থাকে না, অনেকে থেকেও; কেউই নয়। সেই সব মুহূর্তে তাকে তার আসল-আমি, একা-আমির সর্বস্ব সম্বল করেই দাঁড়াতে হয়। জীবনের কিছু মূল প্রশ্নর উত্তর তাকে একা একাই দিতে হয়, নিজেকে। সেই সব মুহূর্ত বড় কঠিন পরীক্ষার মুহূর্ত। কারওই জীবনে এমন পরীক্ষা না এলেই ভাল!

জানি না, আপনি আমার বক্তব্য বুঝবেন কি না। আমি নিজেও পুরো বুঝে উঠতে পারিনি এখনও। একটা ঘোরের মধ্যেই আছি।

আমি কোথায় আছি, কেমন আছি কার সঙ্গে আছি এসব প্রশ্নর জবাব এক্ষুণি আমি দিতে পারছি না। সময় যখন হবে তখন নিজেই সব জানাব। আর জানাবার সময় যদি নাইই পাই এ জীবনে, তবে আর জানানো হয়েই উঠবে না।

পোস্ট-অফিসের ছাপ দেখে আমার খোঁজ করতে বেরুবেন না। যেখানে আমি আছি, সেখান থেকে অনেক দূরে যাতে এ চিঠি পোস্ট হয় তার বন্দোবস্ত করেছি। তবুও ভেবে মনে মনে খুশি হচ্ছি যে, আপনি আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন ঘর-সংসার চাকরিবাকরি সব ভাসিয়ে দিয়ে। গল্পে উপন্যাসে, অথবা ইচ্ছেময়-ভাবনায় যা সহজেই ঘটে; জীবনে তা ঘটে না। ঘটা সম্ভব নয়। আপনার সে কারণে লজ্জিত বা অনুতপ্ত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। আমি জানি যে, আমি কাছে থাকলে আপনার পক্ষে যত সহজে কাছে আসা, আমাকে ভালোবাসা সম্ভব ছিল; দূরে এবং নিরুদ্দেশে ভেসে যাওয়ায় তা আর সম্ভব রইল না।

ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে। কনভিনিয়েন্সের ভালবাসা সব পারে না। তার দায়-দায়িত্ব অতি সীমিত। সে কারণে হয়ত প্রাপ্তিও।

এবার আপনার যা যা প্রশ্ন থাকতে পারে, অনুমান করে নিয়ে, এক এক করে তার জবাব দিই।

প্রথম প্রশ্ন : ভাঁটু কোথায়?

উত্তরে জানাই যে, আমার বিবাহিত স্বামী ভাঁটুবাবু এখন মালার জেলে। এতদিন পুলিশ হাজতে ছিল। হাতে-নাতে ধরা পড়ায় জেল হতে বেশি ঝামেলা হয়নি। সত্যকে দামি মিথ্যার বেসাতি দিয়ে ঢাকবার জন্যে কোনও নামী উকিলও সে দিতে পারেনি। মাত্র পনেরো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।

মেদ ঝরে যাবে। শরীর ও মনের।

যখন বেরুবে, তখন তাকে স্বামী বলে স্বীকার করব কি না, তা এখনই বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সময়, সব কিছুকেই বদলে দেয়। পনেরো বছর পরের আমি কেমন থাকব অথবা আদৌ থাকব কি না তা এত আগে থেকে বলা সত্যিই সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় প্রশ্ন : আমি কী ভাবে চালাচ্ছি?

চিন্তা করবেন না। নষ্ট হয়ে যাইনি। হব না। যে যাই বলুক, নষ্ট হয়ে যেতে কিছুটা নিজস্ব প্রবণতাও লাগে। যে-প্রবণতা আপনার মধ্যে আছে; আমার মধ্যে নেই। শুধু নষ্টই নয়, আপনার মধ্যে নিজেকে ধ্বংস করার প্রবণতাও লক্ষ করেছি, অনেকই সময়; ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে। জানি না, যিনি আপনার অনেক কাছের লোক; আপনার অর্ধাঙ্গিনী রুবৌদি, তিনি এই সাংঘাতিক প্রবণতার কথা কখনও লক্ষ করেছেন কি না। আপনাকে নিয়ে আমার বড়ই দুশ্চিন্তা হয়।

আমার জন্যে কিন্তু আপনি একটুও ভাববেন না। না-খেয়ে নেই। যদিও আহামরিও কিছু নেই। দুঃখেরও কিছু দেখি না এতে। কারণ এদেশে আমার চেয়ে অনেক রূপসী ও বিদূষী মেয়েও, যাদের স্বাধীনতা ও আত্মসম্মান বোধ আছে; এর চেয়ে অনেকই খারাপ থাকে।

তৃতীয় প্রশ্ন : আমি কি ভাঁটুকে এখনও ভালবাসি?

সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেই ঠিক জানি না। এক সঙ্গে পাশাপাশি বাড়িতে থাকলেও এক ধরনের মায়া তো জন্মাই, ট্রেনের কামরায় সহযাত্রীর সঙ্গে একটি দিন কাটালেও তাকে আপন লোক বলে মনে হয় অনেক সময়। বাড়িতে কুকুর বেড়াল থাকলেও তাদের প্রতিও এক ধরনের গভীর মমত্ববোধ জন্মায় আর ভাঁটু তো আমার বিবাহিত স্বামী! রক্ত-মাংসের; সুখ-দুঃখের ভাগীদার। আমার শরীরের শরিকও ছিল সে। আড়াল, কিছুমাত্রই ছিল না দুজনের মধ্যে। শিম্পাঞ্জিরা যে ধরনের মূক অথচ গভীর ভালবাসা একে অন্যকে বাসে ভাঁটুর ভালবাসাও আমার প্রতি তেমনই ছিল। সূক্ষ্ম ছিল না; রুচিসম্পন্ন ছিল না; কারণ সে সবের বালাই ওর মধ্যে ছিল না, কিন্তু আমার প্রতি ওর গভীর একতরফা অন্ধ ভালবাসায় কোনও খাদ ছিল না। যদিও ভালবাসা কাকে যে বলে, সে সম্বন্ধে ওর কোনও ধারণাই ছিল না। হয়তো, কম পুরুষেরই আছে। আমাকে নিয়েই ও ভরে ছিল। আমি ওকে ভালবাসতাম কিনা কখনও, তো যাচাই করে দেখার অবকাশও হয়নি। মানে, আমার দিক থেকে। যখন হল, এই দুঃসময়ে তখন মহা দুশ্চিন্তাতেই পড়লাম। এখনও বুঝে উঠতে পারছি না অভ্যেসটাকেই ভালবাসা বলে ভুল করেছি কি এতদিন?

পৃথুদা, আজ আমার স্বামী জেলে। স্বদেশের জন্যে আন্দোলন করে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আইনের চোখে কোনও আইন-ভাঙার অপরাধেও নয়, কাউকে বলা যায় না, নিজেও শুনতে ইচ্ছে করে না এমনই এক কারণে। জেলে গেছে সে গাঁজার চোরাচালান করে।

আজকে আমার মনে গভীর এক সন্দেহ জাগছে, ভাঁটু আমাকে ভালবাসে সে কথা জেনেও; ভালবাসা কি শুধুই একটি অভ্যেস মাত্র? সমস্ত বিবাহিত ভালবাসাই? অভ্যেসই বোধহয় ভালবাসা বলে চলে যায় এ সংসারে, আসলে ভালবাসা যে কী, তা বোঝার অবকাশ বোধহয় খুব কম মেয়ের জীবনেই আসে। আর ভাগ্যিস আসে না। এলেই, বড় কষ্ট। তবু বুঝলে সে সব মেয়েরাই শুধু বোঝে; আপনারা কিছুই বোঝেন না। ভাবেন, যে বোঝেন! মিথ্যা শ্লাঘাতে বেঁকে থাকেন আপনারা। আসলে সত্যিই কিছু বোঝেন না।

দীর্ঘ চিঠি লেখার অবকাশ এখন নেই। অনেক অসুবিধার মধ্যে এই চিঠি লিখছি। দেরিও হয়ে গেল অনেক। কারণ, আমি জানি যে, আপনি চিন্তা করছেন। করছেন? সতিই চিন্তা করছেন আমার জন্যে? ভাবতে, কী ভালই যে লাগে! আসলে, ভালবাসা বোধহয় একধরনের চরম স্বার্থপরতাও।

ভাঁটু আমার স্বামী। যে-মেয়ের নিজের আর্থিক স্বাধীনতা নেই কোনও, স্বামীর পরিচয়ই তো তার একমাত্র পরিচয়! এও একধরনের বন্দীজীবন। জেলখানারই মতো। গাঁজার চোরা চালান না করেও আমারও পনেরো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল, বিনা বিচারে, বিনা আদেশে, কারণ আমি আমার স্বামীর স্ত্রী বলে। স্বাবলম্বী নই বলে। এদেশে এখনও এইরকম হয়।

এই জেলখানা থেকে আমি বাইরে আসতে চাই। একবার বেরিয়ে এলে, আসতে পারলে তারপর অন্য কথা ভাবব। ভাঁটুদের যে জমিদারী ছিল উমেরীয়ায়, তা আমাদের বিয়ের পরই ভাঁটুর দাদা এবং ভাইয়েরা বেহাত করে নিয়েছে। লোকটাকে, বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে হলেও আসলে ওর এসব বুদ্ধি বিশেষ ছিল না। ওকে আমি কখনও তেমন করে ভালও বাসিনি; যেমন ভালবাসা ও চায়। আপনার পটভূমিতে ওকে বড়ই নিগুণ, নিষ্প্রভ, আনইন্টারেস্টিং, গ্রস বলে মনে হত, বিশেষ করে আমরা রায়নাতে ফিরে আসার পর। আপনি কবে আসবেন, কবে আপনার চিঠি পাব তার আশায় মুখ চেয়ে থাকতাম। আপনার সঙ্গে একটু দেখা হওয়া, আপনার একটি ছোট্ট চিঠি পাওয়াও আমার কাছে ওর সঙ্গে শারীরিক মিলনের চেয়েও অনেক বেশি আনন্দের কারণ হত। বুঝতে পারতাম যে, ওর সঙ্গে চিরজীবন থাকলে আমার নিজের প্রতি তো বটেই ওর প্রতিও অন্যায় করব আমি। অথচ দেখুন। আইন বলছে, জীবন বলছে, আমার অকারণের কারাদণ্ডও প্রমাণ করছে যে, ওইই আমার সব। আপনি কেউই নন। এটাই এখন ঘটনা। গাঁজা-চোরাই চালানকারীর স্ত্রী আমি। কী সম্মান বলুন তো! এর চেয়ে ব্যাঙ্ক ডাকাতরাও অনেক সম্মানিত। যেখানে আছি সেখানে একজন ছাড়া অন্যরা অবশ্য জানে না এই গর্বের খবর। এই অপরাধের মধ্যেও যেন একটা উগ্র কটুগন্ধ পাই, যদিও গাঁজার গন্ধ কেমন তা আমি জানি না। তবে, কতদিন আর লুকিয়ে রাখব? তাছাড়া, লুকিয়ে রাখাটা বোধহয় ঠিকও নয়। তার চেয়ে এই মিথ্যা সম্পর্ক ভাবছি ভেঙেই দেব।

সামনের রবিবার ওর সঙ্গে দেখা করতে যাব মান্দলাতে। শুনছি শিগগিরই ওকে অন্য জেলে চালান করে দেবে। গুণ্ডা, বদমাইস, খুনী, রেপিস্ট, স্মাগলারদের সঙ্গে ওঠাবসা করবে ও। যতটুকু ভালত্ব বা ছিল, তাও থাকবে না। আমি কেন ওর জন্যে পনেরো বছর অপেক্ষা করব? কেন করব? আপনি কোনও যুক্তি দেখাতে পারেন? ভেবে ভেবে কোনওই কুল পাচ্ছি না। আপনি তো এ জীবনে আমার অনেক ভালই করলেন, এটুকু করবেন না আমার জন্যে? কি আমার করা উচিত তা আমাকে বলে দেবেন না?

কোনওরকম সাহায্যই চাই না এ ছাড়া, আপনার কাছ থেকে। যাকে মানুষ ভালবাসে, তার কাছ থেকে কোনও সাহায্য নিলে সে ভালবাসা নোংরা হয়ে যায়। বিচ্ছিরি দেনা-পাওনার বিষয় হয়, সুন্দর আর থাকে না। সেদিন রাতে ইচ্ছে করে প্লেটের তলায় রেখে যাওয়া দুটি একশো টাকার নোট আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। এই চিঠির সঙ্গেই পাঠালাম। অর্থ খুবই দামি, বিশেষ করে অর্থহীনের কাছে; কিন্তু ভালবাসার চেয়েও নয়। দারিদ্র্য যখন আসে, তখন তাকে জড়িয়ে ধরার মধ্যেও একধরনের শিক্ষা লাগে, সুশিক্ষা। যে-মানুষ দারিদ্রে ভেঙে যায় টুকরো হয়ে, তার শিক্ষাটা মনে হয় এখনও পুরো হয়নি। আমি আমার মাকে চোখের সামনে দেখে এ কথা শিখেছি। দারির চেয়েও অনেক অনেক বড় কষ্ট একজন মানুষের জীবনে থাকতে পারে। থাকে। বড়লোকের ছেলে আপনি, যদিও বড়লোক মনোবৃত্তির নন; তবু বড়লোকের ছেলে তো! আপনার পক্ষে এই কথার তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়। এই পরীক্ষায় ইচ্ছে করে কেউই বসে না। আপনার যেন কখনও বসতে না হয়; এইই প্রার্থনা করি।

যদি চিঠি দেন, তাহলে খুব খুশি হব। কিন্তু আসবেন না। দিদি-ঠাকুমার মতো সেকেলে দিব্যি কেটেই বলছি যে, এলে; মরা মুখ দেখবেন আমার। আপনি এলে আমার মরা ছাড়া উপায় থাকবে না কোনও। সবদিক দিয়েই। আসেনই যদি, তাহলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। পারবেন? আমার ভালবাসার ধন! যিনি, আমাকে একটু দেখতে না পেলে পাগল হয়ে উঠতেন?

পারবেন না। আমি জানি যে, পারবেন না।

আপনি বিবাহিত। আপনার সুন্দরী, বিদূষী, সমাজে প্রশংসিত স্ত্রী আছেন; আছে সুন্দর ভাল ছেলে আর মেয়ে। পাল্লাতে তাদের দিকে ভার বেশিই হবে। আপনাদের মতো সাহসী, বাঘের মতো সচ্ছল পুরুষ মানুষের পক্ষে ভালবাসা ভালবাসা খেলা, প্রেমের বেদনা-বিলাসই বোধহয় বেশি মানায়। কবিতা-টবিতা ভাল লেখা যায় তাতে। কবিতার সঙ্গে কল্পনা এখনও সহবাস করে। প্রকৃত ভালবাসা যে বড়ই নগ্ন, বড় ঝড় ঝাপটার; তা অনেকই বেশি প্রত্যাশা করে অন্যজনের কাছ থেকে। সে দাবি, আপনার ওপর করব না। ভালবাসি বলেই আপনাকে সর্বনাশের ডাক দেব না। নিশ্চিন্ত থাকুন। কবিতা লিখুন। প্রকৃতি নিয়ে, নারী নিয়ে কাব্যি করুন, নিজের একতরফা আনন্দে বুদ হয়ে থাকুন সারা জীবন। এই সবই কবিদের প্রেরোগেটিভ, স্পেশ্যাল প্রিভিলেজ। ভাঁটু যখন জেলে মধ্যপ্রদেশের দুঃসহ গরমের দুপুরে বসে ঘানি-ফেরাবে অথবা বাজরার জন্যে জেলের প্রান্তরে কোদাল চালাবে, আমি যখন টিনের চালার জেলখানায় বসে পা-মেশিন চালিয়ে ছিটের ব্লাউজ তৈরি করব শুক্রবারের হাটিয়াতে ছত্তিশগড়িয়া, গোন্দ আর বাইগা মেয়েদের কাছে বিক্রি করার জন্যে, তখন আপনি কবিতা লিখবেন। আমাকে নিয়ে। এবং কে বলতে পারে, সেই কবিতাই হয়তো আপনাকে অমরত্ব এনে দেবে কোনওদিন।

আমাদের মতো মন্দভাগ্য মেয়েরাই চিরদিন আপনাদের কল্পনার খাদ্য হয়েছি, ষাঁড়দের যেমন টাটকা নেপিয়ার ঘাস; আমাদের খেয়ে ছিঁড়ে ছেনে ধুনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেড়ালে-খাওয়া সাদা কবুতরের মতো ছিন্ন ভিন্ন করে রেখে আপনারা পুরুষ কবিরা মহান হয়েছেন। আপনারা শতায়ু হোন।

এবার শেষ করব চিঠি। কম্বল আর বালিশ উঠোনের বেড়ায় রোদে দিয়েছি। একটা অসভ্য ষাঁড় কাল আমার বালিশের একটা পাশ খেয়ে গেছে। মেয়েলি তেলের গন্ধ পেয়েছিল বোধহয়। গরু হলে নিশ্চয়ই খেত না। শুনেছিলাম ছাগলে কী না খায়, পাগলে কী না বলে! ষাঁড়ও যে সব খায় জানতাম না! রাতে বড় শীত লাগে টিনের চালের মাটির ঘরের বেড়ার ঘরে। তাইই কম্বল বালিশ গরম করতে দিয়েছি। কবিরা বেশ প্রেমিকাদের কল্পনা করেই উষ্ণ হয়ে ওঠেন বলে শুনেছি, আমরা পারি না কেন বলুন তো! আমরা কি কিছুই পারতে পারি না?

আমার চিঠির রকম দেখেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই যে একজন সতী সাধ্বী অবলা স্ত্রী হিসেবে যতখানি ভেঙে পড়ার কথা ছিল এই আর্থিক দুর্দৈবে তা পারিনি। ভরসা রাখবেন যে, পড়বও না।

বেঁচে থাকার মতো আমার অনেকই কিছু আছে। সজনে পাতায় হাওয়া লাগলে এখনও আমার ভাল লাগে, ভাল লাগে ভোরের পাখির ডাকাডাকি, শেষ বিকেলের মন-খারাপ করা আলো। এই সব ছোটখাটো ভালোগা নিয়েই আরও পনেরোটা বছর কেটে যাবে। বুড়ো, কুঁজো ভাঁটুবাবু আমার চেয়ে বয়সেও সাত বছরের বড় এক সন্ধেয় গরুর ডাক আর বড়হা দেবের পুজোর ঘণ্টার শব্দর মধ্যে আমার ভাঙা বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াবে। বলবে, চিনতে পারো? কুর্চি?

ওকে চিনতে নিশ্চয়ই পারব। তবে কষ্ট হবে। ও-ও আমাকে চিনতে পারবে না প্রথমে। বস্তির কোনও ছেলেমেয়ে চিনিয়ে দেবে। চোখে চালসে চশমা, সাদা চুল, আমার দিকে চেয়ে ও বলবে, চিনলে না? আমি সেই ভাঁটু। উমেরীয়ার ভাঁটু।

ওই রক্তমাংসর মানুষটাকে চিনতে পারব। ও-ও পারবে আমাকে। আমি বসতে বলব, ভোলা উনুনে চা করে দেব, বাজরা মাখব রুটি করার জন্যে রাতের। ও মেঝের আসনে বসে, মাটির ঘরে, বসে আমাকে চিনতে চেষ্টা করবে। পুরনো গন্ধ খুঁজবে নাক উঁচু করে, পুরনো স্পর্শকে কল্পনা করে। খুশি হবে। আর আমি দু হাঁটুর মধ্যে থুতনি রেখে আগুনের দিকে চেয়ে থাকব। চোখ আমার জলে ভরে যাবে। আমি জানব যে, যে এসেছে আমার ঘরে, সে আমার কেউ না; কেউই ছিল না কোনওদিন, এদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ের স্বামীদেরই মতো।

নিরুচ্চারে আমি আবৃত্তি করব আমার প্রিয় কবি রাজলক্ষ্মী দেবীর একটি কবিতা :

জানি আমি একদিন বুড়ো হব। চশমার ফাঁকে।
উলের কাঁটার ঘর গুণে গুণে কাটবে সময়।
যদিও অনেক লোক আসে, যায়—দুটো কথা কয়—
মনে মনে জানা রবে, কেউ তার খোঁজে না আমাকে।
এমনি মেহগ্নি আলো বিকেলের জানালাকে ছোঁবে!
নরম চাঁদের বল ফের উঠে আসবে আকাশে।
বাতাস সাঁতার দেবে সবুজ ঢেউয়েরই মত ঘাসে।
আকাশের বুক ভরে তারারা বিছানা পেতে শোবে।
শাদা চুল নেড়া দাঁত, আয়নায় ভ্যাংচানো ছায়াকে
তখনো বলবো আমি রাজ্যচ্যুত রাজ্ঞীদের ভাষা।
জানিস, আমার ছিলো সে এক আশ্চর্য ভালবাসা।
তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবি সে পাওয়াকে?

ভাঁটু কিছুমাত্র বুঝবে না আমার মনের ভাব। হয়তো বলবে, চায়ে বেশি করে চিনি দিয়ে। কতদিন ভাল করে চিনি খাই না। জেলে বড় চুরি হয়।

আমার দু চোখ দিয়ে জল বইবে। আমি না বলে বলব, চুরি কোথায় হয় না?

আপনি তখন কোথায় থাকবেন পৃথুদা? ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকবেন হয়তো তো নাতি কোলে করে। ছিঃ ছিঃ একজন বাঘের কী, লজ্জাকর পরিণতি!

ভাল থাকবেন। সবসময় ভালবাসবেন আমাকে।

–ইতি কুর্চি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *