৩৮. কবির মামা বাড়ি ফিরে এসেছেন

কবির মামা বাড়ি ফিরে এসেছেন। বাড়ি মানে নিজের বাড়ি নয়–নীলুদের ভাড়াটে বাসা। এ বাসায় কত অসংখ্য বার তিনি এসেছেন, এমনও হয়েছে টানা এক মাস কেটে গেছে।–নাড়ার নাম নেই। কিন্তু এ-বার এসে কিছুটা অদ্ভুত আচরণ করছেন। যেন তিনি অপরিচিত একটা জায়গায় এসেছেন-লোকজন ভালো চেনা নেই। শারমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, মা, বাথরুমটা কোন দিকে? বাথরুম কোন দিকে তাঁর না-জানার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্নের ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে তিনি জানেন না।

রাতে খাবার টেবিলে বসলেন, কিন্তু কিছু মুখে দিলেন না। মনোয়ারা বললেন, ভাইজান, আপনাকে দুটা রুটি বানিয়ে দেবে? তিনি বললেন–জ্বি-না। আপনাদের কষ্ট দিতে চাই না।

মনোয়ারার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ভাইজান তাঁর সঙ্গে আপনি-আপনি করছেন কেন? তিনি তাকালেন নীলুর দিকে। নীলু বলল, মামা, আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে?

না। আমি ভালো।

মামা আসুন আপনাকে শুইয়ে দি। দুধ গরম করে দিচ্ছি। দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ুন।

 

কবির মামা নিঃশব্দে উঠে পড়লেন। তাঁর খুব খারাপ লাগছে। তিনি এ-রকম করছেন কেন? তাঁর গায়ে জ্বর নেই। এ-রকম করার তো কথা নয়।

মাখন-লাগানো দু স্নাইস রুটি আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে নীলু কবির মামার ঘরে ঢুকল।

মৃদু স্বরে ডাকল, মামা।

আয় বেটি। আয়।

আপনার জন্যে রুটি আর দুধ এনেছি।

রেখে দাও মা। খিদে পেলে খাব।

না, আপনাকে এখনই খেতে হবে। আপনাকে খাইয়ে তারপর আমি যাব।

কবির মামা একটু হাসলেন, তারপর নেহায়েত যেন নীলুকে খুশি করবার জন্যেই পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দুধে ড়ুবিয়ে মুখে দিতে লাগলেন।

মাখন দেয়া রুটি মামা, দুধে ডোবাচ্ছেন কেন?

নরম হয়, খেতে সুবিধা।

আপনার খেতে ইচ্ছা না-হলে খাবেন না মামা। শুধু দুধটা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলুন।

তিনি বাধ্য ছেলের মতো দুধ খেয়ে ফেললেন।

পান খাবেন মামা? একটু পান এনে দিই। মুখের মিষ্টি-মিষ্টি ভাবটা যাবে।

তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন পান তো আমি খাই না। ঠিক আছে, তোমার যখন ইচ্ছা, দাও।

পান এনে নীলু দেখল মামা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধহয়। সে চাপা গলায় বলল, মামা ঘুমিয়ে পড়েছেন? না, জেগে আছি। দাও, পান দাও। আর একটু বস আমার পাশে। নীলু বসল। তিনিও উঠে বসলেন। নরম গলায় বললেন, আচ্ছা মা, তোমার বিয়েতে কি আমি কিছু দিয়েছিলাম?

নীলু বিস্মিত হয়ে বলল, হঠাৎ এই কথা কেন মামা? না, মানে, হঠাৎ মনে হল। এ জীবনে তোমার কাছ থেকে শুধু সেবাই নিয়েছি। কিছু ফেরত দেয়া হয় নি।

আপনার ভালোবাসা যা পেয়েছি, সেটা বুঝি কিছু না মামা? তা ছাড়া আপনার মনের শান্তির জন্যেই বলছি, আপনি বিয়েতে খুব দামী একটা শাড়ি দিয়েছিলেন। নীল রঙের একটা কাতান। চার শ টাকা দাম ছিল শাড়িটার। তখন চার শ টাকায় একটা গয়না হয়ে যেত।

তাই নাকি?

হ্যাঁ মামা। আমার বিয়ের শাড়ির দাম ছিল তিন শ টাকা। আমার বড়ো বোন বললেন, বিয়ের শাড়িটা থাক, এইটা দিয়েই বৌ সাজিয়ে দিই।

না মামা। বিয়েতে নাকি লাল শাড়ি পরতে হয়, তাই সবাই মিলে আমাকে লালটা পরাল। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা করছিল নীলটা পরতে।

কবির মামা হাসতে লাগলেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে এই গল্পে তিনি খুব আনন্দ পাচ্ছেন। তাঁর চোখেও পানি এসে যাচ্ছে। যদিও চোখে পানি আসার মতো গল্প এটা না।

মামা।

বল মা।

তখন তো আপনার নীলগঞ্জ ছিল না, টাকাপিয়াস যা পেতেন। আমাদের পেছনেই খরচ করে ফেলতেন। শুয়ে পড়ুন মামা।

রফিক কি বাসায় আছে মা?

জ্বি, আছে। এই কিছুক্ষণ আগে এসেছে।

ওকে কি একটু আমার কাছে পাঠাবো?

পাঠাচ্ছি।

রফিক খেতে বসেছে। কবির মামা ডেকেছেন শুনে মুখ বাঁকা করে বলল, ওল্ড ম্যান আমার কাছে কী চায়? এখন যেতে পারব না।

নীলু বলল, চট করে না বলে ফেল কেন? এক জন অসুস্থ মানুষ ডাকছে, তুমি যাবে না?

শুধু ভ্যাজারভ্যাজার করবে।

যদি করে, হাসিমুখে শুনবে সেই ভ্যাজরভ্যাজর।

তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন ভাবী? আমি তো জাস্টি কথার কথা হিসেবে বলেছি। তুমি খুব ভালো করে জান আমি মুখে না বললেও কবির মামাকে দেখতে ঠিকই যাব। খ। তাঁর সব ফালতু কথা শুনব। যে কদিন উনি হাসপাতালে ছিলেন, আমি কি রোজ তাঁকে দেখতে যাই নি?

নীলু লজ্জা পেয়ে গেল। রফিক ভাত শেষ না-করেই উঠে পড়েছে। নীলু বলল, তুমি কি আমার উপর রাগ করলে রফিক?

না, তা করি নি। আমি তো মেয়েমানুষ না যে কথায়-কথায় রাগ করব। আর যদি করিও তাতে কার কী যায় আসে?

রফিক কবির মামার ঘরে ঢুকল।

মামা জেগে আছ?

বস রফিক।

বসব না। যা শোনবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনব। বল কী বলবো?

তুই আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবি?

কোন জায়গায়?

আগে বল নিয়ে যাবি কিনা?

নিয়ে যাব।

বারাসাতে যাব। ঐখানে আমাকে নিয়ে যা।

সেটা আবার কোথায়?

চব্বিশ পরগণা জেলা।

ইণ্ডিয়া?

হ্যাঁ। বেনাপোল বর্ডার দিয়ে…।

তুমি কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে নাকি মামা!

জন্মস্থান দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি আর বাঁচব না।

তুমি একা কেন, আমরা কেউ বাঁচব না। জন্মস্থান দেখলে হবেটা কী? ঐখানে গিয়ে মরতে চাও?

তিনি জবাব দিলেন না। রফিক খাটে বসল। নরম স্বরে বলল, জন্মস্থানে মরতে যেমন কষ্ট, বিদেশে মারতেও ঠিক সে-রকম কষ্ট। মরার কষ্ট সব জায়গায় সমান।

তুই তাহলে নিতে পারবি না?

না মামা, পারব না। পাসপোর্ট-ফাসপোর্টের অনেক ঝামেলা। আমার মনে হয় মরতে চাইলে তুমি তোমার সুখী নীলগঞ্জেই মর। সেটাই ভালো হবে।

তিনি হেসে ফেললেন। রফিকও হাসল। হাসতে-হাসতেই বলল, তুমি আবার আমার উপর রাগ করলে না তো?

না, তোর কোনো কথায় আমি রাগ করি না।

খুব ফালতু কথা বলি, এই জন্যে?

তাও না। তোর কথাবার্তা ঠিকই আছে। তোর কথাবার্তা আমার পছন্দ। যা শুয়ে পড়া।

বারাসাতে যেতে চাচ্ছি। কেন?

মনটা হঠাৎ টানছে। হাসপাতালে শুয়ে—শুয়ে অনেক ভেবেছি। বারাসাতে শৈশব কেটেছে। একটা বিরাট পুকুর ছিল, নাম হল গিয়ে ভূতের পুকুর। ছোটবেলায় ভূত দেখার জন্যে এর পাড়ে বসে থাকতাম।

দেখেছ?

না, দেখিনি।

মামা আমার কথা শোন-এখন যদি যাও, তোমার খুবই খারাপ লাগবে। দেখবে, সব বদলে গেছে। ভূতের পুকুর হয়তো ভরাট করে দালান তুলেছে। এরচে শৈশবের স্মৃতিটাই থাকুক।

কবীর মামা শুয়ে পড়লেন। রফিক মশারি গুঁজে দিতে-দিতে বলল, এর পরেও যদি তোমার যেতে ইচ্ছে করে, তাহলে কী আর করা, নিয়ে যাব। কী, ইচ্ছে করে?

তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, হ্যাঁ করে।

রফিক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মাস তিনেক তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে মুম্ আদি একটা কাজ শুরু করেছি। একটু গুছিয়ে নিই।

কী কাজ?

ব্যাবসা। মতিঝিলে রুম নিয়েছি। কাউকে কিছু বলিনি। বুধবারে বলব। সবাইকে অফিস দেখিয়ে আনব। তুমি থাকছতো বুধবার পর্যন্ত?

থাকব। দেখে যাই তোর কাণ্ডকারখানা।

মামা, এখন যাই?

আচ্ছা যা। বাতি নিভিয়ে যা।

 

শারমিন জেগে আছে। আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে। মেয়েদের চুল বাঁধার দৃশ্যটি বেশ সুন্দর। দেখতে ভালো লাগে। রফিক খানিকক্ষণ দেখল। ছন্দবদ্ধ ব্যাপার। চিরুনি উঠছে-নামছে। ওঠা-নমা হচ্ছে নির্দিষ্ট তালে। রফিক সিগারেট ধরাল। শারমিন বলল, দয়া করে সিগারেটটা বাইরে গিয়ে খাও।

কেন?

ঘরে কুৎসিত গন্ধ হয়, আমার ভালো লাগে না।

গন্ধ তো আগেও হত, তখন তো কিছু বল নি।

তখন বলি নি বলে কখনও বলতে পারব না। এমন তো কোনো কথা নেই। এখন বলছি।

রফিক সিগারেট ফেলে দিল। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে শারমিন চুল বাঁধা শেষ করে উঠল। দরজা বন্ধ করে বাতি নেভাল। মশারি ফেলে হালকা গলায় বলল, তুমি কি ঘুমুবে, না। আরো কিছুক্ষণ জেগে বসে থাকবে?

ঘুমুব।

বিছানায় উঠতে-উঠতে শারমিন বলল, তোমার মতিঝিলের অফিস স্টার্ট হচ্ছে কবে? রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, অফিসের খবর তুমি কোথায় পেলে?

কেন, এটা কি গোপন কিছু?

না, গোপন কিছু না। কাউকে তো বলি নি। তুমি জানলে কী ভাবে? কে বলল?

আজবাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বাবা বললেন।

তিনি জানলেন কোত্থেকে?

তিনি জানবেন না কেন? সব তো তাঁরই করা। বেকার জামাই বোধহয় সহ্য হচ্ছিল না। দূর থেকে কলকাঠি নাড়লেন।

রফিক স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এই সম্ভাবনা তার মাথায় আসে নি। রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। কেন সব এমন ঘড়ির কাঁটার মতো সহজে হচ্ছিল, এটা বোঝা গেল।

শারমিন বলল, দেখে মনে হচ্ছে অধিক শোকে পাথর। শ্বশুরের সাহায্য নিতে চাও না?

রফিক সে প্রশ্নের জবাব দিল না। বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে সিগারেট টানবে। মাথা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবে। ঘুমুতে যাবে অনেক রাতে। যখন যাবে, তখন দেখবে শারমিন পরম তৃপ্তিতে ঘুমুচ্ছে। তার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসবে না। নানান আজে-বাজেচিন্তা তার মাথায় ভিড় করবে। একেক দিন একেক জিনিস নিয়ে সে ভাবে। আজ ভাববে। শারমিন হঠাৎ করে বাবার কাছে কেন গেল? পিতা-কন্যার মিলন তাহলে হয়েছে। কীভাবে হল কে জানে! শারমিন নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, খুব ভুল করেছি। বাবা। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আর কোনোদিন তোমার অবাধ্য হব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব। এবারকার মতো আমাকে ক্ষমা করি।

 

কবির মামার জ্বর পুরোপুরি ছাড়ল না। সকালের দিকে সুস্থ থাকেন। বিকেল থেকেই কাতর। গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। ম্যালেরিয়ার রোগীর মতো লেপ জড়িয়েও শীত মানানো যায় না, যদিও অসুখটা ম্যালেরিয়া নয়। ডাক্তাররা নিঃসন্দেহ, জীবাণুঘটিত কিছু নয়। হোসেন সাহেব এই জ্বর নিয়ে খুব উত্তেজিত। তাঁর ধারণা, এক সপ্তাহ চিকিৎসা করবার সুযোগ দিলে তিনি হোমিওপ্যাথি যে কী, তা প্রমাণ করে দেবেন। এই সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। কবির মাস্টার পরিষ্কার বলেছেন, সারা জীবন যে-কয়েকটা জিনিস অবিশ্বাস করে এসেছি, হোমিওপ্যাথি হচ্ছে তার একটা। এখন শেষ সময়ে যদি হোমিওপ্যাথিতে সেরে উঠি, সেটা খুব দুঃখজনক হবে। আমাকে অবিশ্বাস নিয়েই মরতে দাও।

হোসেন সাহেব হাল ছাড়লেন না। নীলুর সঙ্গে পরামর্শ করে গোপনে কবির মাস্টারের খাবার পানিতে এক পুরিয়া কেলিফস মিশিয়ে দিলেন। নীলুকে বললেন, এক ডোজেই কাজ হবে। দেখবে আজ আর জ্বর আসবে না। এক শ টাকা তোমার সঙ্গে বাজি।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, সত্যি সত্যি জ্বর এল না। আনন্দে ও উত্তেজনায় হোসেন সাহেব অন্য রকম হয়ে গেলেন। রান্নাঘরে ঢুকে নীলুকে বললেন, কী, যা বলেছিলাম তা হল? বিশ্বাস হল আমার কথা? এত যে তোমাদের অবিশ্বাস! আশ্চর্যা নীলু হেসে ফেলল।

আমার অবিশ্বাস নেই তো।

আছে আছে, তোমারও আছে, সবই বুঝি। টুনির মাথাব্যথা হচ্ছিল, সেই চিকিৎসা কি করিয়েছ। আমাকে দিয়ে? অবিশ্বাস কর আর যাই করা, চিকি ৎসাটা এক বার তো করিয়ে দেখবে? দেখা উচিত নয়?

জ্বি বাবা, উচিত।

আমি মা চিন্তা করছি একটা ঘর ভাড়া করে প্রফেশনাল চিকিৎসা শুরু করব। ফার্মেসি দেব। তুমি একটা নাম ঠিক করা ফার্মেসির।

হোসেন সাহেব হৃষ্টচিত্তে রান্নাঘর থেকে বেরুলেন। টুনি ও বাবলুবইপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের বললেন, তোরা নিজে নিজে পড়, আজ আমি ব্যস্ত। কাজ আছে। তিনি হোমিওপ্যাথির বই খুলে বসলেন।

তাঁর আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। ভোররাতে কবির মামার প্রচণ্ড জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে তিনি ছটফট করতে লাগলেন। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে লাগলেন। মাঝে মাঝে উঠে বসেন, শূন্যদৃষ্টিতে সবারদিকে তাকান। গম্ভীর গলায় বলেন, হে বন্ধু হে প্রিয়। দেশের দরিদ্র বন্ধু আমার। হে আমার প্রিয় বন্ধু। আজ এই শরতের মেঘমুক্ত প্রভাত…।

কিছুক্ষণ প্রলাপ বকেন, তারপর আবার সহজ-স্বাভাবিক কথাবার্তা। যেন কিছুই হয় নি। নীলুকে বললেন, বৌমা, আমার জ্বরটা একটু কমলেই কিন্তু আমি নীলগঞ্জ রওনা হব। সেখানে বড়ো কোনো ঝামেলা হয়েছে।

নীলু বলল, কোনো ঝামেলা হয় নি মামা। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন। মাথায় পানি ঢালিছি।

ঝামেলা হয়েছে মা, খুব ঝামেলা, নয়তো শওকত আসতো। এত দিন হয়ে গেছে ঢাকায় আছি, কিন্তু শওকতের কোনো খোঁজ নেই।

আপনি এখন কথা বলবেন না তো মামা। প্লিজ।

কবির মামা চোখ বন্ধ করে আবার তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন, হে বন্ধু হে প্রিয়। হে দেশবাসী। হে আমার দরিদ্র বন্ধু।…

রফিক ডাক্তার আনেতে গেল।

হোসেন সাহেব হতভম্ব হয়ে বিছানার পাশে বসে রইলেন। টুনি খুব ভয় পেয়েছে। সে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে।

দুপুরের আগেই জ্বর নেমে গেল। কবির মামা শিঙি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে বারান্দায় এসে বসলেন। নীলু অফিসে গিয়েছে। অফিসে জরুরি মীটিং, না গেলেই নয়। দায়িত্ব দিয়ে গেছে শারমিনের উপর। শারমিন তার দায়িত্ব পালন করছে চমৎকারভাবে। কবির মামা বারান্দায় আছেন, সেও আছে বারান্দায়।

মামা, আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?

না মা, লাগবে না। তুমি খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম কর। আমার শরীর এখন ভালো। বেশ ভালো। ইনশাআল্লাহ কাল রওনা হব।

অসম্ভব! কাল কী ভাবে রওনা হবেন?

রওনা হতেই হবে মা, উপায় নেই। তোমার বাবা এক বার বলেছিলেন নীলগঞ্জ যাবেন। আমারও খুব শখ ছিল তাঁকে নিয়ে যাবার। আর সম্ভব হল না!

সম্ভব হবে না কেন?

কবির মামা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–মৃত্যু এখন আমার পাশেই অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝে সে হাত দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারি। আমার সময় কোথায় মা? সময় শেষ মা।

আমি বাবাকে বলব, যেন তিনি তাড়াতাড়ি নীলগঞ্জ চলে যান। আমি আজই বলব।

কবির মামা হেসে ফেললেন। বারান্দায় বসে থাকতে-থাকতে তাঁর ঝিমুনি ধরে গেল। শীত-শীত করছে। আবার হয়তো জ্বর আসবে। তাঁর বড়ো লজ্জা লাগছে। এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকে তিনি বিব্রত করছেন। সেই অধিকার তীর কি সত্যি আছে?

 

পরদিন তিনি অসুস্থ শরীরেই নীলগঞ্জ রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে গেল সোভােহান। রফিকের যাবার কথা ছিল–তার অফিস উদ্বোধন হবে, সে যেতে পারল না। জুটিয়ে দিল সোভােহানকে। এই লোকটি কোনো রকম আপত্তি না!

স্টেশন থেকে বাড়ি অনেকটা দুর। কবির মাস্টারের হেঁটে যাবার সামৰ্থ্য নেই। আবার আকাশ-পাতাল জ্বর। সোভাহান গরুর গাড়ি জোগাড় করে আনল। রওনা হবার আগে এক জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার। আশপাশে কোথাও ডাক্তার নেই। নবীনগরে এক জন ডাক্তার আছেন—এলএমএফ। কবির মাস্টার বললেন, নিজের চোখে দেখ, গ্রামগুলির কী খারাপ অবস্থা। ডাক্তাররা কি এই গণ্ডগ্রামে আসবে? তারা যাবে শহরে।

সোভাহান বলল, আপনি এইখানে বসে বিশ্রাম করতে থাকুন, আমি নবীনগর থেকে ডাক্তার নিয়ে আসব।

পাগল নাকি তুমি! বহু দূরের পথ।

কোনো অসুবিধা নেই। এই অবস্থায় আপনাকে নিয়ে রওনা হব না। গরুর গাড়িতে বিছানা করে দিচ্ছি, শুয়ে থাকুন। আমি যাব আর আসব।

নবীনগরের ডাক্তার সাহেবকেও পাওয়া গেল না। তিনি বিরামপুর কলে গিয়েছেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই। নাও ফিরতে পারেন। বিরামপুরের কাছেই তাঁর শ্বশুরবাড়ি। রাতটা হয়তো শ্বশুরবাড়িতেই কাটাবেন।

সোবাহান ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে ফিরে এসে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখল-গরুর গাড়ির চারপাশে অসংখ্য মানুষ।

চারদিক খবর রটে গিয়েছে, অসুস্থ কবির মাস্টার গ্রামে ফিরেছে। দলে দলে লোক আসছে। ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। বিশাল একদল মানুষ নিয়ে গরুর গাড়ি রওনা হল।

আশপাশের মানুষ জিজ্ঞেস করে, কে যায় গো?

কবির মাস্টার যায়।

কী হইছে মাস্টার সাবের?

শইল খুব খারাপ। উল্টাপাল্টা কথা কইতাছে।

কও কী! কী সর্বনাশের কথা।

খেতের কাজ ফেলে রেখে চাষীরা উঠে আসে রাস্তায়। তারা এক পলক দেখতে চায় মাস্টার সাহেবকে। দুটি কথা শুনতে চায়।

সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে। চলমান মানুষগুলির ছায়া ছোট হয়ে আসে। কবির মাস্টার চোখ মেলে এক বার জিজ্ঞেস করেন, আর কত দূর সোভাহান? আর যে কত দূর সোভাহান নিজেও জানে না। এই অঞ্চল তার অপরিচিত। তবু সে বলে, এসে পড়েছি। ঐ তো দেখা যাচ্ছে।

সুখী নীলগঞ্জ সাইনবোর্ড দেখা যায়? বিরাট সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছি।

র মাস্টার টেনে টেনে হাসেন। সোভাহান কোনো সাইনবোর্ড দেখতে পায় না। শুধু দেখে, মানুষ আসছে পিলপিল করে। চিৎকার নেই। হৈচৈ নেই। নিঃশব্দ মানুষ। মাথা নিচু করে এরা হাঁটছে।

সোভাহান।

জ্বি মামা।

শুধু সাইনবোর্ডটাই আছে। নীলগঞ্জকে সুখী নীলগঞ্জ করতে পারলাম না। আফসোস রয়ে গেল।

এক জীবনে তো হয় না মামা। আপনি শুরু করেছেন, অন্যরা শেষ করবে। শুরু করাটাই কঠিন। শুরু তো হয়েছে।

ঠিক ঠিক। খুব ঠিক।

আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে মামা?

হচ্ছে। আবার আনন্দও হচ্ছে। কত লোক এসেছে, দেখলে?

জ্বি, দেখলাম।

কিছুই করতে পারি নি। এদের জন্যে। তবু এরা আসছে। বড়ো আনন্দ ल१छ 6নাठহানা।

আনন্দ হবারই কথা।

জীবনটা তাহলে একেবারে নষ্ট হয় নি। কী বল?

জ্বি-না। অসাধারণ জীবন আপনার!

পানি খাওয়াতে পার? বুক শুকিয়ে আসছে।

বটগাছের ছায়ার নিচে গরুর গাড়ি রাখা হল। চার-পাঁচ জন ছুটে গোল পানির খোঁজে। আশপাশের বাড়ির বৌ-ঝিরা সব বেরিয়ে আসছে। এদের মধ্যে অল্পবয়স্ক একটা মেয়ে খুব কাঁদছে। সে নীলগঞ্জের মেয়ে। এই গ্রামে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের দিন খুব গণ্ডগোল হচ্ছিল। জামাইকে সাইকেল দেয়ার কথা, সেই সাইকেল দেওয়া হয়নি। বিয়ে ভেঙে বরযাত্রীর দল উঠে যাবে। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। খবর পেয়ে ছুটতে—ছুটতে এলেন কবির মাস্টার। থমথমে গলায় বললেন, সাইকেল আমি দেব। বিয়ে হোক।

কবির মাস্টারের কথাই যথেষ্ট। বিয়ে হয়ে গেল। তার পনের দিন পর নতুন সাইকেল নিয়ে কবির মাস্টার এসে উপস্থিত। তিনি সাইকেল নতুন জামাইয়ের হাতে দিয়েই আচমকা প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, হারামজাদা ছোটলোক। সাইকেলটা তোর কাছে বড়ো হল? তুই একটা মেয়েকে বিয়ের দিন লজ্জা দিলি? তোর এত বড়ো সাহস!

ছেলেটা ভালো ছিল। সাত দিন পর সাইকেল ফিরিয়ে দিয়ে গেল। লাজুক গলায় বলল, আপনার দেয়া চাই মাস্টার সাব, আর কিছু চাই না। আপনে খাস দিলে আমার জন্যে দোয়া করেন।

কবির মাস্টার গম্ভীর হয়ে বললেন, দোয়া লাগবে না। সৎ মানুষের জন্যে দোয়া লাগে না। দোয়া দরকার অসৎ মানুষের জন্যে। তোর বেঁটাকে আদর-যত্নে করিস। ভালো মেয়ে।

সেই মেয়েটাই এখন চিৎকার করে কাঁদছে। কয়েক জন বৃদ্ধা মহিলা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। কবির মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন, তুই এরকম করছিস কেন? সালাম করেছিস আমাকে? আদব-কায়দা কিছুই শিখিস নি। নীলগঞ্জের মেয়ে না। তুই? গ্রামের বদনাম। আয়, সালাম কর। তোর জামাই কই? ব্যাটাকে ধরে নিয়ে আয়।

 

নীলগঞ্জে ঢোকার ঠিক আগে আগে কবির মাস্টার মারা গেলেন। নিঃশব্দ মৃত্যু। কেউ কিছুই টের পেল না। সবাই ভাবল, বোধহয় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। সোভাহান তাঁর হাত ধরে বসে ছিল, শুধু সে টের পেল। হাত নামিয়ে দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে এল। অসংখ্য লোকজন চারপাশে। সবাই নিঃশব্দে হাঁটছে। সেও হাঁটছে তাদের সঙ্গে। এই মানুষগুলিকে মৃত্যুর খবর দিতে তার মন চাচ্ছে না।

গরুর গাড়ি নীলগঞ্জের সীমানায় এসে এক মুহূহের জন্যে থমকে দাঁড়াল; নীলগঞ্জের সীমানায় বিশাল এক রেইনটি গাছ। সেই গাছে সাইনবোর্ড ঝলছে। সেখানে লেখা :

আপনারা সুখী নীলগঞ্জে প্রবেশ করছেন। স্বাগতম।

নীলগঞ্জের সমস্ত বৌ-বিরাজড়ো হয়েছে সেখানে। ছুটতে-ছুটিতে আসছে। শওকত। আজ সকালেই সে থানা-হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছে। নীলগঞ্জের চেয়ারম্যান তাকে একটা ডাকাতি মামলায় আসামী দিয়েছিল। ওসি সাহেব নিজ দায়িত্বে তাকে জামিন দিয়েছেন। শওকত চেঁচাতে-চেঁচাতে আসছে— কী হইল? আমার স্যারের কী হইল?

দুপুরবেলার শান্ত নিস্তব্ধ গ্রাম। করুণ সুরে ঘুঘু ডাকছে। ক্যাচ-ক্যাচ শব্দে এগিয়ে চলছে গরুর গাড়ি। সোভাহান দাঁড়িয়ে আছে রেইনটি গাছের কাছে। তার দৃষ্টি সাইনবোর্ডের দিকে :

আপনারা সুখী নীলগঞ্জে প্রবেশ করছেন। স্বাগতম।

সোভাহানের মনে হচ্ছে সুখী নীলগঞ্জ জায়গাটা বড়ো পবিত্র। এরকম একটা পবিত্র জায়গায় প্রবেশ করবার মতো যোগ্যতা তার নেই। তার উচিত। এই সীমানা থেকেই বিদেয় নেওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *