ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বেদান্তবিচারে — মায়াবাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি) — বেদান্ত বিচারে, সংসার মায়াময়, — স্বপ্নের মতো, সব মিথ্যা। যিনি পরমাত্মা, তিনি সাক্ষিস্বরূপ — জাগ্রত, স্বপন, সুষুপ্তি তিন অবস্থারই সাক্ষিস্বরূপ। এ-সব তোমার ভাবের কথা। স্বপ্নও যত সত্য, জাগরণও সেইরূপ সত্য। একটা গল্প বলি শোন। তোমার ভাবের —
“এক দেশে একটি চাষা থাকে। ভারী জ্ঞানী। চাষবাস করে — পরিবার আছে, একটি ছেলে অনেকদিন পরে হয়েছে; নাম হারু। ছেলেটির উপর বাপ-মা দুজনেরই ভালবাসা; কেননা, সবে ধন নীলমণি। চাষাটি ধার্মিক, গাঁয়ের সব লোকেই ভালবাসে। একদিন মাঠে কাজ করছে, এমন সময় একজন এসে খপর দিলে, হারুর কলেরা হয়েছে। চাষাটি বাড়ি গিয়ে অনেক চিকিৎসা করালে কিন্তু ছেলেটি মারা গেল। বাড়ির সকলে শোকে কাতর কিন্তু চাষাটির যেন কিছুই হয় নাই। উলটে সকলকে বুঝায় যে, শোক করে কি হবে? তারপর আবার চাষ করতে গেল। বাড়ি ফিরে এসে দেখে, পরিবার আরও কাঁদছে। পরিবার বললে, ‘তুমি নিষ্ঠুর — ছেলেটার জন্য একবার কাঁদলেও না?’ চাষা তখন স্থির হয়ে বললে, ‘কেন কাঁদছি না বলব? আমি কাল একটা ভারী স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম যে, রাজা হয়েছি আর আট ছেলের বাপ হয়েছি — খুব সুখে আছি। তারপর ঘুম ভেঙে গেল। এখন মহা ভাবনায় পড়েছি — আমার সেই আট ছেলের জন্য শোক করব, না, তোমার এই এক ছেলে হারুর জন্য শোক করব?’
“চাষা জ্ঞানী, তাই দেখছিল স্বপ্ন অবস্থাও যেমন মিথ্যা, জাগরণ অবস্থাও তেমনি মিথ্যা; এক নিত্যবস্তু সেই আত্মা।
“আমি সবই লই। তুরীয় আবার জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি। আমি তিন অবস্থাই লই। ব্রহ্ম আবার মায়া, জীব, জগৎ আমি সবই লই। সব না নিলে ওজনে কম পড়ে।”
একজন ভক্ত — ওজনে কেন কম পড়ে? (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্রহ্ম — জীবজগৎবিশিষ্ট। প্রথম নেতি নেতি করবার সময় জীবজগৎকে ছেড়ে দিতে হয়। অহংবুদ্ধি যতক্ষণ, ততক্ষণ তিনিই সব হয়েছেন, এই বোধ হয়, তিনিই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।
“বেলের সার বলতে গেলে শাঁসই বুঝায়। তখন বিচি আর খোলা ফেলে দিতে হয়। কিন্তু বেলটা কত ওজনে ছিল বলতে গেলে শুধু শাঁস ওজন করলে হবে না। ওজনের সময় শাঁস, বিচি, খোলা সব নিতে হবে। যারই শাঁস, তারই বিচি, তারই খোলা।
“যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা।
“তাই আমি নিত্য, লীলা সবই লই। মায়া বলে জগৎসংসার উড়িয়ে দিই না। তাহলে যে ওজনে কম পড়বে।”
[মায়াবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ — জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ ]
মহিমাচরণ — এ বেশ সামঞ্জস্য, — নিত্য থেকেই লীলা, আবার লীলা থেকেই নিত্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানীরা দেখে সব স্বপ্নবৎ। ভক্তেরা সব অবস্থা লয়। জ্ঞানী দুধ দেয় ছিড়িক ছিড়িক করে। (সকলের হাস্য) এক-একটা গরু আছে — বেছে বেছে খায়; তাই ছিড়িক ছিড়িক দুধ। যারা অত বাছে না আর সব খায়, তারা হুড়হুড় করে দুধ দেয়। উত্তম ভক্ত[1] — নিত্য লীলা দুই লয়। তাই নিত্য থেকে মন নেমে এলেও তাঁকে সম্ভোগ করতে পারে। উত্তম ভক্ত হুড়হুড় করে দুধ দেয়। (সকলের হাস্য)
মহিমা — তবে দুধে একটু গন্ধ হয়। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — হয় বটে, তবে একটু আওটাতে হয়। আগুনে আউটে নিতে হয়। জ্ঞানাগ্নির উপর একটু দুধটা চড়িয়ে দিতে হয়, তাহলে আর গন্ধটা থাকবে না। (সকলের হাস্য)
[ওঁকার ও নিত্যলীলাযোগ ]
(মহিমার প্রতি) — “ওঁকারের ব্যাখ্যা তোমরা কেবল বল ‘অকার উকার মকার’।”
মহিমাচরণ — অকার, উকার, মকার — কিনা সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি উপমা দিই ঘন্টার টং শব্দ। ট-অ-অ-ম-ম-। লীলা থেকে নিত্যে হয়; স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ থেকে মহাকারণে লয়। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি থেকে তুরীয়ে লয়। আবার ঘণ্টা বাজল, যেম মহাসমুদ্রে একটা গুরু জিনিস পড়ল আর ঢেউ আরম্ভ হল। নিত্য থেকে লীলা আরম্ভ হল, মহাকারণ থেকে স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ শরির দেখা দিল — সেই তুরীয় থেকেই জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি সব অবস্থা এসে পড়ল। আবার মহাসমুদ্রের ঢেউ মহাসমুদ্রেই লয় হল। নিত্য ধরে ধরে লীলা, আবার লীলা ধরে নিত্য।[2] আমি টং শব্দ উপমা দিই। আমি ঠিক এই সব দেখেছি। আমায় দেখিয়ে দিয়েছে চিৎ সমুদ্র, অন্ত নাই। তাই থেকে এইসব লীলা উঠল, আর ওইতেই লয় হয়ে গেল। চিদাকাশে কোটি ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, আবার ওইতেই লয় হয়, তোমাদের বইয়ে কি আছে, অত আমি জানি না।
মহিমা — যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা তো শাস্ত্র লেখেন নাই। তাঁরা নিজের ভাবেই বিভোর, লিখবেন কখন! লিখতে গেলেই একটু হিসাবী বুদ্ধির দরকার। তাঁদের কাছে শুনে অন্য লোকে লিখেছে।
[সংসারাসক্তি কতদিন — ব্রহ্মানন্দ পর্যন্ত ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — সংসারীরা বলে, কেন কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি যায় না? তাঁকে লাভ করলে আসক্তি যায়।[3] যদি একবার ব্রহ্মানন্দ পায়, তাহলে ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ করতে বা অর্থ, মান-সম্ভ্রমের জন্য, আর মন দৌড়ায় না।
“বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখে, তাহলে আর অন্ধকারে যায় না।
“রাবণকে বলেছিল, তুমি সীতার জন্য মায়ার নানারূপ ধরছো, একবার রামরূপ ধরে সীতার কাছে যাও না কেন? রাবণ বললে, তুচ্ছং ব্রহ্মপদং পরবধূসঙ্গঃ কুতঃ — যখন রামকে চিন্তা করি, তখন ব্রহ্মপদ তুচ্ছ হয়, পরস্ত্রী তো সামান্য কথা! তা রামরূপ কি ধরব!”
[যত ভক্তি বাড়ে, সংসারাসক্তি কমে — শ্রীচৈতন্যভক্ত নির্লিপ্ত ]
“তাই জন্যই সাধন-ভজন। তাঁকে চিন্তা যত করবে, ততই সংসারের সামান্য ভোগের জিনিসে আসক্তি কমবে। তাঁর পাদপদ্মে যত ভক্তি হবে, ততই বিষয়বাসনা কম পড়ে আসবে, ততই দেহের সুখের দিকে নজর কমবে; পরস্ত্রীকে মাতৃবৎ বোধ হবে, নিজের স্ত্রীকে ধর্মের সহায় বন্ধু বোধ হবে, পশুভাব চলে যাবে, দেবভাব আসবে, সংসারে একেবারে অনাসক্ত হয়ে যাবে। তখন সংসারে যদিও থাক জীবন্মুক্ত হয়ে বেড়াবে। চৈতন্যদেবের ভক্তেরা অনাসক্ত হয়ে সংসারে ছিল।”
[জ্ঞানী ও ভক্তের গূঢ় রহস্য ]
(মহিমার প্রতি) — “যে ঠিক ভক্ত, তার কাছে হাজার বেদান্ত বিচার কর, আর ‘স্বপ্নবৎ’ বল তার ভক্তি যাবার নয়। ফিরে-ঘুরে একটুখানি থাকবেই। একটা মুষল ব্যানা বনে পড়েছিল, তাতেই ‘মুষলং কুলনাশনম্’।
“শিব অংশে জন্মালে জ্ঞানী হয়; ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা — এই বোধের দিকে মন সর্বদা যায়। বিষ্ণু অংশে জন্মালে প্রেমভক্তি হয়, সে প্রেমভক্তি যাবার নয়। জ্ঞানবিচারের পর এই প্রেমভক্তি যদি কমে যায়, আবার এক সময় হু হু করে বেড়ে যায়; যদুবংষ ধ্বংস করেছিল মুষল, তারই মতো।”
১ উত্তম ভক্ত — যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে নে প্রণশ্যতি। [গীতা, ৬/৩০]
২ নিত্য ধরে লীলা — From the Absolute to the Relative — from the Infinite to the Finite – – from the Undifferentiated to the Differentiated — from the Unconditioned to the Conditioned and again from the Relative to the Absolute.
৩ রসর্বজং রসোঽপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে। [গীতা, ২।৫৯]