সকাল থেকেই বৃষ্টির বিরাম নেই, তাই দুপুরে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। সঙ্গে মাংস আর ফজলি আম। এই দিয়েই আজ বেগম জাহানারা ও জনাব শরীফ ইমামের চব্বিশতম বিবাহবার্ষিকীর ভোজ। অন্যবছর এই দিনটিতে আত্মীয়-বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হতো। এ বছর আর কারুকে ডাকা হয়নি, তবে একজন আছে বিশিষ্ট অতিথি। রুমী, হ্যাঁ, অতিথিই তো রুমী, সে কখন আসবে, কখন চলে যাবে তার কোনো ঠিক নেই, সে সম্পর্কে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করাও চলবে না। সে হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছে কাল সন্ধের পর।
মাঝখানে বেশ কিছুদিন রুমীর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। শুধু শোনা গিয়েছিল যে সে মেলাবাড়ি নামে একটা জায়গার ক্যাম্পে আছে। কোথায় যে সেই মেলাবাড়ি, সেটা আধা শহর না গ্রাম, সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই জাহানারা ইমামের। তবে কয়েক সপ্তাহ আগে দুটি যুবক এসে দেখা করেছিল ওঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দু’জনেরই মাথার লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে, জুলপি নেমে গেছে কানের লতির কাছে, নাকের নিচে মোটা গোঁফ। যুবকদুটিই অতি গম্ভীর ধরনের, চঞ্চল চোখে মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকায়। সিগারেটের প্যাকেট খুলে ভেতরের পাতলা কাগজটায় লেখা একটা দু’লাইনের চিঠি তারা দেখিয়েছিল, “পত্রবাহক দু’জনকে দরকার হলে কিছু সাহায্য করবেন। আমি ভালো আছি।-মণি।” চিঠিটা দেখেই অদ্ভুত এক আনন্দ, বিস্ময় ও রোমাঞ্চ বোধ করেছিলেন জাহানারা আর শরীফ! মণি হচ্ছে মেজর খালেদ মোশাররফ-এর ডাক নাম, তাঁর হাতের লেখাও ওঁদের চেনা। খালেদ মোশারফ-এর মতন পেশাদার যোদ্ধারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে কিংবা দেয়নি, কে কোথায় আছে, ঢাকায় বসে তা কিছুই জানার উপায় নেই। ঐ ছেলেটির কাছেই শোনা গল যে রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সেকটর টু এবং কে-ফোর্সের কমাণ্ডার এখন খালেদ মোশাররফ, তিনি আছেন আগরতলার কাছাকাছি একটা জায়গায়, সেখানেই গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে রুমী।
ঐ স্বল্পভাষী যুবকদুটিকে খালেদ মোশাররফ পাঠিয়েছিলেন ঢাকার চেনাশুনো মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য, কিছু কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসও তাঁর দরকার। যুবকদুটি শুধু কাজের কথাই বলে, রুমীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে কি না কিংবা রুমীকে তারা আদৌ চেনে কি না সেরকম কোনো প্রশ্নেই তারা মুখ খুলতে চায় না।
পরের সপ্তাহেই অবশ্য ঐ ছেলেদুটিকে জাহানারা ইমামের মনে হয়েছিল যেন সশরীর ফেরেস্তা। তারা রুমীর চিঠি এনেছিল, রুমীর নিজের হাতে লেখা! চিঠি তো নয়, যেন টেলিগ্রাম। “আমি ভালো। মণিভাইদের সঙ্গে আছি। এদের যা যা দরকার সব দিও।–রুমী।”
সে চিঠি পেয়ে জাহানারা দারুণ উতলা হয়ে উঠেছিলেন। কী কী চায় ওরা? কোনো কিছু যদি কিনে দিতে হয়, টাকাপয়সা যা লাগবে, তাঁর সমস্ত গয়নাগাঁটি বিক্রি করে, যথাসর্বস্ব দিতেও তিনি রাজি। শরীফ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ওরা টাকা পয়সা চায় না, ওরা চায় ব্রীজ!
খালেদ মোশাররফ গোপন নির্দেশ পাঠিয়েছেন যে বাংলাদেশের সবকটা ব্রীজ আর কালভার্টের তালিকা তাঁর দরকার। এবং সেতুগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটানো বিষয়ে কিছু তথ্য। শরীফ নিজে একসময় সরকারের রোডস অ্যাণ্ড হাইওয়েজ-এর ডিজাইন ডিভিশনে কাজ করেছেন। সে কথা খালেদ মোশাররফ মনে রেখেছেন। শরীফ অনেক কৌশলে সেই ফাইল বার করে তার থেকে প্রয়োজনীয় নকশা সব কপি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তারপরেই রুমীর ফিরে আসা। সে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তা এখনো বলেনি।
কাল গল্প হয়েছে রাত তিনটে পর্যন্ত। এখন দুপুর বারোটা, রুমী এখনো ঘুমোচ্ছে। রান্নাবান্না সব হয়ে গেছে, তবু রুমীকে জাগাতে ইচ্ছে করে না।
ঢাকা শহরের অবস্থা এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। যদিও কিছু কিছু আগুনে-পোড়া বস্তি এখনো চোখে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলা-বিধবস্ত হলগুলি জনমানবশূন্য, একুশে ফেব্রুয়ারি স্মৃতিস্তম্ভটি অর্ধেক ভাঙা, তার গায়ে মসজিদ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে, রমনা মাঠের প্রাচীন কালীবাড়িটি একেবারে নিশ্চিহ্ন, তবু দোকানপাট খুলেছে, অফিস-আদালতে কাজ চালু হয়েছে, বাজার বসছে। দিনের বেলা অন্তত ঢাকার যে-কোনো জায়গায় আনাগোনা করা যায়। বিদেশী পত্র-পত্রিকা কিছুই পাওয়া যায় না, রেডিওতে বি বি সি, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরলে শোনা যায় সীমান্ত-যুদ্ধের খবর, আবার পাকিস্তানী বেতার শুনলে মনে হয়, ঐ সবকিছুই মিথ্যে, পাকিস্তানী আর্মি সমস্ত ভারতীয় চর ও দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করে দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কথাটা ছিল কিছু কিছু হঠকারী ও উন্মাদের অলীক স্বপ্ন, তারা আশ্রয় নিয়েছে ভারতে, পাকিস্তান এখন আগের চেয়েও সুদৃঢ় ও একতাবদ্ধ।
তবু সন্ধের পর হঠাৎ হঠাৎ শোনা যায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। মেশিনগানের চকিত ফায়ারিং। ঢাকার মানুষ ব্যাকুল হয়ে জানতে চায় কোথায় কী ঘটছে! কিন্তু জানবার উপায় নেই, সে সময় বাইরে বেরুতে কেউ সাহস করে না, এমন কি ছাদে উঠেও উঁকি ঝুঁকি মারা যায় না, দৈবাৎ আর্মি-পেট্রোলের চোখে পড়ে গেলে সে বাড়ি সার্চ হবে। সেইসব বিস্ফোরণের পরই বাতি নিবে যায়, দু’তিন দিন আর কারেন্ট আসে না, কল দিয়ে জলও পড়ে না। বোঝা যায় যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এসে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সরকারি অফিসগুলিতে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে, দিনের বেলাতেও তাদের পরাক্রম দেখা যাচ্ছে, সেইসব অসম সাহসী বিচ্ছুরা মোটর সাইকেল কিংবা জিপে চেপে এসে আকস্মিকভাবে কোনো পথের মোড়ে কিংবা জরুরি কোনো অফিসের সামনে পাকিস্তানী আর্মি ও প্যারা মিলিশিয়ার ওপর এক ঝাঁক গুলিবর্ষণ করে মিলিয়ে যাচ্ছে চোখের নিমেষে। এই বিচ্ছুরা যেন যখন তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। পাকিস্তানী সেনারা এখনো জানেই না, মুক্তিদের দেখতে কেমন?
খোদ ঢাকা শহরের বুকের ওপর এসে এই ধরনের আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম মোটেই বন্ধ হয়নি, পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে তারা ভয় পায় না।
রুমী কিছু বলতে না চাইলেও জাহানারা ইমাম বুঝেছেন যে সীমান্ত ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়ে কিছু কিছু ছেলে যে ঢাকায় নিজেদের বাড়িতে আবার ফিরে আসছে, নিশ্চয়ই তার বিশেষ কারণ আছে। যুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েও তারা বাড়ি ফিরে আসবে কেন? ঢাকার ভেতরে থেকেই বড় রকম কোনো আঘাত দেবার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে তারা? রাত্তিরে বোমার শব্দ শুনলে জাহানারার মতন আরও অনেকের আনন্দ হয়, গর্ব হয়, ইলেকট্রিসিটি কিংবা ওয়াটার সাপ্লাই দিনের পর দিন বন্ধ থাকলে যত অসুবিধেই হোক, তবু তাতে মনে হয়, তাঁদের ছেলেরা জিতছে। কিন্তু জাহানারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না যে রুমীর পক্ষে সীমান্ত ক্যাম্পে থাকার চেয়েও ঢাকায় ফিরে আসা বেশি বিপজ্জনক কি না। এতদিন রুমী চোখের আড়ালে ছিল, কোনো খবর পাননি, দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। আজ রুমী বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে, তবু অজ্ঞাত আশঙ্কায় মায়ের বুক ছমছম করে।
একটু পরে তিনি রুমীর ঘরে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রুমী, রোদে পুড়ে তার চামড়ার রং যেন পুরোনো কাঁসার মতন হয়ে গেছে। মাথাভর্তি চুলের সঙ্গে যেন চিরুনির সম্পর্কই নেই। কাল রুমী বলছিল পাক আর্মির নজর ফাঁকি দেবার জন্য ওদের অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুকুর-নালার পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকতে হয়। এ বাড়ির প্রথম সন্তান এই রুমী, কত আদরের, এর আগে সে বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকেনি, মাত্র কয়েক মাসে সে কত বড় হয়ে গেল! এই সময়ে তার বিদেশে গিয়ে পড়াশুনো করার সব ঠিকঠাক ছিল।
ঘুমন্ত সন্তানকে একটু আদর করতে ইচ্ছে হলো জাহানারার। আস্তে তিনি রুমীর পিঠে হাত রাখলেন।
সঙ্গে সঙ্গে রুমী ছিটকে একপাশে সরে গিয়ে বললো, কে? কে?
ঘুমের মধ্যেও এত সতর্কতা, এও কি গেরিলা ট্রেনিং? জাহানারা হাসতে হাসতে বললেন, ওরে, আমি রে, আমি!
এখনো দু’চোখের পাতায় ঘুম লেগে আছে, তবু পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে রুমী জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে, আম্মা? কেউ এসেছে?
জাহানারা বললেন, না, কেউ আসেনি। একটা বেজে গেছে, গোসল করবি না? খাবার-দাবার সব রেডি!
একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে রুমী বললো, হু, সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে, নিশ্চয়ই খিচুড়ি হয়েছে। আজ! গ্র্যাণ্ড! কতদিন ঘি দিয়ে খিচুড়ি খাইনি! এত বেলা হয়েছে, তুমি আমাকে আগে ডাকোনি কেন, আম্মা?
–তোকে দেখে মনে হচ্ছিল, তুই যেন কত মাস ঘুমাস নাই! তোর সারা শরীরে ঘুম লেগেছিল।
উঠে দাঁড়িয়ে কয়েকবার লাফালো রুমী। কোমর বাঁকিয়ে ব্যায়াম করে ঘুম তাড়াতে লাগলো। তারপর মায়ের আঁচল ধরে চার বছরের বালকের মতন গলায় বললো, আজ আমি নিজের হাতে খাবো না। তুমি খাইয়ে দেবে? অন্তত প্রথম দুই এক গেরাস!
জাহানারা তাড়া দিয়ে বললেন, যা যা, বাথরুম ঘুরে আয়। জামী বসে আছে না খেয়ে।
একটুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিচের খাবার ঘরে চলে এলো রুমী। টেবিলে বসার আগে সে হঠাৎ জাহানারার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে বললো, আম্মা, আজ তোমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। বাবার সঙ্গে তোমার বিয়ে না হলে আমি আর জামী জন্মতামই না, তাই না?
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে জাহানারা বললেন, শোনো ছেলের অদ্ভুত কথা! নে, নে, এখন খেতে বোস!
ছোট ভাই জামী প্লেট সামনে নিয়ে বসে মৃদু মৃদু হাসছে। কাল রাতে রুমীর মুখ থেকে সবাই যখন যুদ্ধের গল্প শুনছিল, তখন তার ঘুম এসেছিল, তার অনেক গল্প শোনা বাকি।
সে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া, ক্যাম্পে প্রায়ই তো খিচুড়ি খাওয়ায়?
রুমী বললো, খিচুড়ি কী বলছিস! আমাদের দারুণ খাওয়া দাওয়া হয়। একদিন অন্তর একদিন বিরিয়ানি গোস্ত, নাস্তার সময় দুটো করে আণ্ডা, সপ্তাহে দু’দিন মুর্গি, আর মাছ তো। রোজ আছেই!
জাহানারা আর জামী দু’জনেই চমকে উঠলো। জাহানারা বললেন, এত খাবার? সত্যি? কে দেয়? ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট তো রিফিউজিদেরই খাওয়াতে পারছে না শুনি!
–মুক্তিযোদ্ধাদের স্পেশাল খাতির! সেইজন্যই তো প্রত্যেকদিন হাজার হাজার ছেলে। ক্যাম্পে যোগ দিতে যাচ্ছে। কি রে, জামী। তুই-ও এবার যাবি নাকি?
জামী বললো, এত খাবার খেলে তো সবাই মোটা হয়ে যাবে। লড়াই করবে কী করে?
রুমী মুখ তুলে বললো, আম্মা, খাইয়ে দাও!
প্রথম গেরাসটি নেবার পর সে বললো, আঃ, অমৃত! অমৃত! এত ভালো ঘি সহ্য হলে হয়। না রে, জামী, আমাদের ওখানে খিচুড়িও বিশেষ হয় না। ভাত-রুটির সঙ্গে একরকমের ডাল দেয়, কে আমরা বলি ঘোড়ার ডাল!
জাহানারা আঁতকে উঠে বললেন, ঘোড়ার ডাল, সে আবার কী?
–চোকলা মোকলা সুদ্ধ একধরনের গোটা গোটা ডাল, নর্মাল টাইমে বোধহয় ঘোড়াকে খাওয়ানো হয়। আর রুটির মধ্যে মাঝে মাঝে মরা পোকা পাই, রুটির সঙ্গেই সেঁকা হয়ে যায়।
–রুটির মধ্যে পোকা? তখন কী করিস, রুটিটা ফেলে দিস?
–ফেলে দেবো, তুমি কি পাগল হয়েছে আম্মা! অত শস্তা নাকি? পোকাটাই নখে খুঁটে ফেলে দিই।
জামী তার মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি করলো। খাওয়ার ব্যাপারে রুমীর খুঁতখুঁতে স্বভাবের কথা কে না জানে! প্লেটে সামান্য একটু ময়লা দাগ দেখলে সে খাওয়া ছে চাইতো!
রুমী আবার মুচকি হেসে বললো, ঐ রুটি-ঘোড়ার ডালই যে কত ভালো লাগে, তা তুই বুঝবি কী করে জামী! ঐ খাবারও যে রোজ জোটে না! হাংগার ইজ দা বেস্ট সস, এখন মর্মে মর্মে বুঝি! একবার কী হলো জানো আম্মা, একটা অ্যাকশানে গেছি, দু’দিন কিছু খাদ্যবস্তু জোটেনি। শেষে খিদের চোটে গাছ থেকে একটা আধপাকা কাঁঠাল ছিঁড়ে নিয়ে খেতে শুরু করলাম। আমি তিন-চার কোয়া মোটে খেয়েছি, একজন লোভের চোটে পনেরো কুড়ি কোয়া খেয়ে নিতেই তারপর তার সাঙ্ঘাতিক পেট ব্যথা আর বারবার…
জাহানারা বললেন, থাম, তোকে আর ঐ খাওয়ার গল্প করতে হবে না। আর একটু খিচুড়ি নিবি? গোস্তের সুরুয়া দিয়ে খেয়ে নে।
–একদিনে বেশি না, আম্মা। এখন তো বাড়িতেই থাকছি?
–কয়দিন থাকবি?
–তা বলতে পারি না। আজকের দিনটা আছি, সেটা জানি। তোমাকে খুশি করার জন্য কালও না হয় থেকে যাবো।
জামী জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ভাইয়া, তুমি নিজের হাতে কোনো খান সেনাকে খতম করেছে। এ পর্যন্ত?
ছোট ভাইয়ের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক ভাবে চেয়ে থেকে গম্ভীর ভাবে রুমী বললো, ওসব কথা জিজ্ঞাসা করতে নাই। শুধু একটা কথা মনে রাখিস জামী, খান সেনাদের ভূমিকা হলো শোষক আর অত্যাচারীর ভূমিকা। আর আমরা মুক্তিসংগ্রামী। আমরা মানুষ মারি না, আমরা আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করছি।
গল্প করতে করতে এঁটো হাত শুকিয়ে গেছে, উঠে হাত ধুয়ে এসে রুমী একটা সিগারেট ধরালো। তা দেখে বিস্ফারিত হয়ে গেল জামীর দুই চোখ। এ বাড়িতে সিগারেট? তার বাবা সিগারেট খান না, আম্মা সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না। একদিন কাকে যেন সিগারেট ধরাতে দেখে খুব বকেছিলেন।
জাহানারা ছোট ছেলের দিকে চোখের ইঙ্গিতে জানালেন যে তাঁর সম্মতি আছে।
জাহানারা একসময় রুমীকে বলেছিলেন, যদি কোনোদিন সিগারেট ধরিস, আমাকে আগে জানাবি। অন্য কেউ এসে বলবে যে তোমার ছেলে সিগারেট খায়, তা আমি সহ্য করতে পারবো না। কলেজে উঠেও রুমী একদিনও সিগারেট টানেনি। কিন্তু কাল রাত্তিরে সে জানিয়েছে যে ক্যাম্পে থাকার সময় সে সিগারেট খাওয়া অভ্যাস করে ফেলেছে। সেখানে অনেকেই সিগারেট খায়। অ্যাকশানে যাবার সময়, ঝোপে-জঙ্গলে বহুক্ষণ ঘাপটি মেরে একলা একলা বসে থাকতে থাকতে সিগারেটটাকেই সঙ্গী মনে হয়। খাবার না জুটলেও সিগারেটের ধোঁয়ায় খিদে মরে। এখন সে সিগারেট ছাড়তে পারবে না। মায়ের আপত্তি থাকলে সে সামনে খাবে না। বাইরে উঠে যাবে!
জাহানারা সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিয়েছেন। তুচ্ছ সিগারেটের জন্য ছেলেকে কয়েক মিনিটের জন্যও তিনি চোখের আড়ালে যেতে দিতে চান না। আজ তিনি নিজেই রুমীর জন্য ভালো সিগারেট কিনে আনিয়েছেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে রুমী, তুই বাবুল চৌধুরীর কোনো খবর জানিস? রুমী অন্যমনস্ক ভাবে বললো, উঁহু!
–ওদের বাড়িতে যে বাচ্চা মেড সারভেন্টটা ছিল, সেফু, সে প্রায়ই এসে বাবুলের খোঁজ করে আর কাঁদে। মেয়েটা খুব ভালোবাসে বাবুলকে। বাবুল কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল?
–তা জানি না। তবে সিরাজুলের খবর পাই মাঝে মাঝে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সে খুব। নাম করেছে, দারুণ তার সাহস। তবে এখনও নাকি সে হঠাৎ হঠাৎ মনিরার নাম ধরে কাঁদে।
–ওঃ, মনিরাকে যেদিন ধরে নিয়ে গেল, সেদিনের কথা ভাবলে আজও বুক কাঁপে। আর কি মনিরাকে কোনোদিন ফিরে পাওয়া যাবে? কোনো ট্রেসই রাখলো না মেয়েটার!
–হয়তো মনিরাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আম্মা, যে রাক্ষসরা মনিরাকে ছিঁড়ে খেয়েছে, তারা নিস্তার পাবে না। তাদের একটা একটা করে শেষ করবো!
সিগারেটটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে রুমী হঠাৎ আবৃত্তি করে উঠলো :
দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক-আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে
অথচ জবরজং ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতই কিংবা চা-খানায় বসো
ছায়াচ্ছন্ন?
দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্নতন্ন করে
খোঁজে প্রতিঘর…
জাহানারা মুগ্ধ হয়ে শোনবার পর জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার কবিতা রে? শামসুর রাহমানের?
রুমী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো, নাম জিজ্ঞেস করতে নেই, নাম জিজ্ঞেস করতে নেই!
তারপর সে বেরিয়ে গেল।
এরপর কয়েকদিন রুমী কখন আসে, কখন বেরিয়ে যায় তার কিছু ঠিক নেই। দু’একদিন রাত্তিরে বাড়ি ফেরে না। সেসব রাত্রে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচণ্ড বুম বুম শব্দ শোনা যায়। রুমীকে কোনো প্রশ্ন করার উপায় নেই। কখনো তার সঙ্গে আসে কয়েকজন বন্ধু, বদি, আলম, স্বপন, চুন্নু, সুন্দর হাসিখুশি সব ছেলেরা, এরাই যে ভেতরে ভেতরে কী সাঙ্ঘাতিক পরিকলপনা আঁটছে, তা বোঝার উপায় নেই।
বাড়িতে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতদের ভিড় লেগেই আছে। কারুকেই ফেরানো যায় না, কারুকেই অবিশ্বাস করা যায় না। তবু জাহানারার বুক সবসময় আশঙ্কায় কাঁপে। এমন এক একটা বাড়ি সার্চের খবর শোনা যায়, মিলিটারি পুলিশ সোজা রান্নাঘরে এসে মেঝে খুঁড়তে শুরু করে, তখন স্পষ্ট বোঝা যায় কেউ খবর দিয়েছে। কখন কী ঘটে যায় কে জানে!
একদিন রুমী মাকে কিছু না জানিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গেল পিরুলিয়া গ্রামে। সেখানে ওদের একটা গোপন ক্যাম্প আছে। সেখান থেকে দুটি বস্তা ভর্তি অস্ত্র নিয়ে ফিরলো পরদিন সন্ধের সময়। বন্ধুদের সঙ্গে আগে থেকে প্ল্যান করাই ছিল, ধানমণ্ডি থেকে হাইজ্যাক করা হলো দুটো গাড়ি, একটা মাজদা আর একটা ফিয়াট। দুটো দলে ভাগ হয়ে ওরা উঠলো দুটো গাড়িতে। আজ রাতে অনেকগুলি অকশান হবে। একটা গাড়ি থেকে শাহাদত জিজ্ঞেস করলো, হোয়াট আর ইয়োর টার্গেটস? কোনদিকে যাচ্ছো? অন্য গাড়ি থেকে উত্তর এলো, ডেস্টিনেশান আনোন; টারগেট-মোবাইল।
রুমীরা কয়েকজন অবশ্য ঠিক করে রেখেছিল ধানমণ্ডির কুড়ি নম্বর রাস্তায় চীনা দূতাবাসের কোনো এক কর্তাব্যক্তির বাড়ি, তার সামনে বেশ কয়েকজন মিলিটারি পুলিশ পাহারা দেয়। অতর্কিতে খতম করতে হবে তাদের। তারপর আক্রমণ চালাতে হবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের গেটে, তারপর গুলশানে এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে। চতুর্দিকে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে পাকিস্তানী শাসকদের বোঝাতে হবে যে বাংলার যুবশক্তিকে ভয় দেখিয়ে দমন করা যাবে না।
মাজদা গাড়িটায় উঠেছে ওরা ছ’জন, পেছনের সীটের মাঝখানে রুমী। কুড়ি নম্বর রাস্তায়। এসে সেই চীনা ডিপ্লোম্যাটের বাড়ির সামনে এসে ওরা হতাশ হলো। আজ সেখানে মিলিটারি পুলিশ পাহারা নেই। গাড়ি ঘুরিয়ে ওরা এলো আঠেরো নম্বর রাস্তায়, সেখানে আর একটি বাড়ির সামনে সাত-আটজন পুলিশ শরীর এলিয়ে বসে আছে, গালগল্প করছে। ওদের সামনে। দিয়ে গাড়িটা চলে গেল, ওরা ভূক্ষেপও করলো না।
গাড়িটা সোজা গিয়ে আবার ঘুরে এলো সাতমসজিদের মোড় থেকে। এবার বাড়িটা পড়বে বাঁ দিকে। একজন গাড়ি চালাচ্ছে, তিনজন একসঙ্গে ফায়ার করবে আর বাকি দু’জন অ্যালার্ট থাকবে অন্যদিক থেকে কোনো আক্রমণের সম্ভাবনা আছে কি না তা লক্ষ্য রাখবার জন্য। বাড়িটার সামনে এসে গাড়িটার গতি একটু ধীর হয়ে গেল, আলম চাপা গলায় অর্ডার দিল, ফায়ার!
তিনটে স্টেনগান গর্জন করে উঠলো এক সঙ্গে। আগেই বলে রাখা ছিল, তিনটে স্টেনগান গুলি চালাবে তিন লেভেলে, পেটে, বুকে, মাথায়। হাসি-তামাসা করতে করতে পুলিশ গুলো উঠে দাঁড়াবারও সুযোগ পেল না। ফুড়ে গেল মাটিতে। প্রতিপক্ষের একটা গুলিও ছুটে এলো না রুমীদের দিকে। অপারেশন সেন্ট পারসেন্ট সাকসেসফুল! কিন্তু এখানেই থামলে চলবে। গাড়িটা আবার চলে এলো কুড়ি নম্বর রাস্তায়। সেই চীনা কূটনৈতিকের সামনে এখনো পুলিশ নেই, কী হলো ব্যাপারটা? ভদ্রলোক কি ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন?
এখন অন্য গাড়িটার সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। আলম এদিক ওদিক গাড়িটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে মীরপুর রোডে এসে পড়লো। তারপর ছুটলো নিউ মার্কেটের দিকে। খানিকটা এগোতেই দেখলো সামনের রাস্তায় সার বেঁধে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাস্তায় প্রত্যেক গাড়ি চেক করা হচ্ছে। এরই মধ্যে খবর পৌঁছে গেল?
গাড়ি ঘোরাবার আর উপায় নেই। পেছন দিক দিয়েও আসছে দুটো আর্মি ট্রাক। সামনে ব্যারিকেড, সেখানে এল এম জি তাক করে দু’জন সৈন্য শুয়ে আছে মাটিতে। আর দু’জন সৈন্য হাত উঁচু করে গাড়ি থামাতে বলে এগিয়ে এলো।
গাড়ির মধ্যে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। গাড়ির চালক আলমকে কেউ কোনো কথা বললো না। আলম লাইট অফ করে ডান দিকে টার্ন নেবার ইনডিকেটর জ্বালিয়ে সামান্য ঘোরাবার ভঙ্গি করলো। একজন মিলিটারি পুলিশ চেঁচিয়ে বললো, বাস্টার্ডস! কিধার যাতা হ্যায়? গাড়ি রুখো!
সঙ্গে সঙ্গে আলম দারুণ বেগে বাঁ দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে সেই সৈন্য দুটোর প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়লো। রুমী চেঁচিয়ে বললো, মাটিতে দু’জন এল এম জি হাতে। ফায়ার।
তিনটে স্টেন গান থেকে এত তাড়াতাড়ি গুলি ছুটে এলো যে এখানেও এল এম জি কাজ করার সুযোগ পেল না। এবারেও কোনো প্রতিরোধ নেই বলতে গেলে। আলম গাড়িটাকে নিয়ে এলো ধানমণ্ডির পাঁচ নম্বর রাস্তায়, সামনেই গ্রীন রোড। রুমী পেছন ফিরে বসে রাস্তা দেখছে। হঠাৎ সে দেখতে পেল একটা মিলিটারি জিপ কোন গলি দিয়ে যেন এসে পড়েছে তাদের খুব কাছে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না। রুমী স্টেন গানের বাঁট দিয়ে ভেঙে ফেললো তাদের গাড়ির পেছনের কাঁচ, তারপরে গুলি চালালো। তার সঙ্গে বদি আর স্বপন। জিপটা মাতালের মতন টলতে টলতে গিয়ে ধাক্কা মারলো একটা ল্যাম্প পোস্টে।
এবারেও ওদের নিরঙ্কুশ জয়!
কিছু দূরে আরও একটা জিপ আর দুটো ট্রাক আসছে ওদের ফলো করে। কিন্তু এইসব ছেলেরা ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো যেমন চেনে, মিলিটারি ড্রাইভারদের সাধ্য আছে কি ওদের সঙ্গে পাল্লা দেয়! অনেক গলি খুঁজির মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে, অনুসরণকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে নিউ এলিফ্যান্ট রোডে পড়ে আলম হেড লাইট জ্বালালো, তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ওরা ছ’জন। আজ শত্রুপক্ষ যথেষ্ট ঘায়েল হয়েছে, কিন্তু ওদের গায়ে একটা আঁচড়ও দিতে পারেনি!
দরজায় ঘন ঘন বেল শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন জাহানারা। দরজা খুলতে তাঁকে প্রায় ঠেলেই যেন ঢুকে পড়লো রুমী আর দুটি ছেলে। তাদের চোখ মুখ লাল, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। আজ আর রুমী কিছু গোপন করতে পারলো না। মায়ের হাত চেপে ধরে আনন্দে-গর্বে-উত্তেজনায় বলে ফেললো, আম্মা, আজ একটা দারুণ অ্যাকশান করে এসেছি!
সবাই ওপরে চলে এলো রুমীর ঘরে। জামীকে সঙ্গে নিয়ে শরীফও এলেন। তারপর সবিস্তারে শোনা হলো সব ঘটনা। সব মিলিয়ে মাত্র আধঘণ্টায় এত কিছু ঘটেছে।
রুমী বললো, আম্মা, দেখ, আমার ঘাড়ে, কাঁধে স্টেন থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে কীরকম ফোস্কা পড়ে গেছে। মিলিটারি ধরলে এগুলো দেখলেই বুঝে যাবে। কটা দিন আর রাস্তায় বেরুনো যাবে না!
জাহানারা ছেলের জামার কলার সরিয়ে দেখলেন। অনেকগুলো কালো কালো ছোট ছোট ফোকা। জামাটারও কয়েক জায়গায় ফুটো ফুটো।
তিনি ডেটল এনে লাগাতে যেতেই রুমী বললো, একটু পরে এসব দিও। আমাদের আর্মসগুলো একটা জায়গায় রেখে এসেছি। সেগুলো আজই আনতে হবে। সেগুলো নষ্ট করা যাবে না! আম্মা, তুমি যাবে আমার সঙ্গে? মহিলা ড্রাইভার দেখলে ওরা হয়তো গাড়ি থামাবে না।
জাহানারা চমকে উঠে বললেন, এখনই আবার বেরুবি? রুমী বললো, উপায় নেই। যার বাড়িতে রেখেছি, তিনি বলেছেন, আজ রাত্তিরে ওখানে আর্মস রাখা চলবে না। এইসব এক একটা অস্ত্র আমাদের বুকের রক্তের চেয়েও দামী!
অন্য দুটি ছেলে মুখ নীচু করে আছে। তাদেরও মনের ভাব একই।
শরীফ বললেন, যাও, ঘুরে এসো। খোদা হাফেজ!
জাহানারা বিনা বাক্যব্যয়ে নিচে নেমে এসে গাড়ি বার করলেন গ্যারাজ থেকে। যে-সাঙ্ঘাতিক অ্যাকশান করে এসেছে রুমীরা, এখন মিলিটারি পুলিশ নিশ্চয়ই তাদের পাগলা কুকুরের মতন খুঁজে বেড়াচ্ছে। এত বড় বিপদ থেকে বেঁচে এসেও রুমী আবার বেরুতে চাইছে। এত সাহস এরা পেল কোথা থেকে।
জাহানারা স্টিয়ারিং-এ বসলেন, রুমী পেছন দিকে সীটের সঙ্গে মিশে শুয়ে রইলো। চাপা গলায় বললো, বেশি দূর যেতে হবে না, একটা গলি ছাড়িয়েই ডান দিকে। হাই সাহেবের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাবে। তারপর গলির শেষমাথায় গিয়ে আবার ঘুরে আসবে। দেখে নেবে কেউ আমাদের ফলো করছে কিনা!
সেটা একটা কানা গলি। সুনসান, নিঃশব্দ প্রায়। একটি বাড়ির বৈঠকখানায় কয়েকজন লোক তাস খেলছে। রুমী বললো, আবার হাই সাহেবের গেটের সামনে পার্ক করো। আর দু’খানা বাড়ি পরে জিনিসগুলো আছে। আমি দেখে আসি, সে বাড়িতে বাইরের কোনো লোক আছে কি না!
রুমী চলে গেল, জাহানারা বসে রইলেন। এখন তিনি এক অন্যরকম উত্তেজনা বোধ করছেন। কিছুই যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না এখনও। বিপ্লব, গেরিলাযুদ্ধ, আর্মির বিরুদ্ধে কলেজের ছেলেদের বন্দুক-মেশিনগান নিয়ে যুদ্ধ, এসব এতদিন তিনি বইতে পড়েছেন, বিদেশী সিনেমায় দেখেছেন। ঠিক সেই জিনিসই এখন ঘটছে নিজের দেশে, তাঁর নিজের ছেলে একজন বিপ্লবী? এমনকি তিনি নিজেও, এই যে অস্ত্র উদ্ধার করতে এসেছেন, তিনি নিজেও তো এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন? এই যে রুমী ফিরে আসার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন, তাঁর বুক কাঁপছে থরথর করে, এসবই স্বপ্ন নয় তো?
রুমী ফিরে এলো দুটো বস্তা ঘাড়ে নিয়ে। তারপর বললো, শিগগির চলো-।
শরীফ বাড়ির সামনের বাতিগুলো নিবিয়ে রেখেছেন। অন্ধকারের মধ্যেই গাড়িটা ফিরে এলো গ্যারাজে। বস্তাদুটি ওপরে নিয়ে আসা মাত্র জাহানারা বললেন, দেখি, দেখি, তোদের অস্ত্র গুলো একবার নিজের চোখে দেখি!
পাঁচটা স্টেনগান, একটা পিস্তল, দুটো হ্যাণ্ড গ্রেনেড়। হ্যাণ্ড গ্রেনেডগুলোর চেহারা অনেকটা আনারসের মতন, ডাক নামও পাইন অ্যাপল। স্টেনগানগুলোর দিকে তাকালেই গা ছমছম। করে, এই অস্ত্র কখন কার হাতে থাকবে, কিংবা কে প্রথম কী উদ্দেশ্য নিয়ে চালাবে, তার ওপরেই নির্ভর করছে জীবন কিংবা মৃত্যু। রুমীরা এই অস্ত্র নিয়ে একটু আগে জয়ী হয়ে এসেছে, আবার পাকিস্তানী সেনাদের হাতে এই স্টেনগানই অত্যাচারের প্রধান হাতিয়ার।
অস্ত্রগুলো কিন্তু দেখতে বেশ সুন্দর, স্মার্ট, ঝকঝকে। ওদের কোনো দোষ নেই। যারা বানায় এবং যারা ব্যবহার করে, তারাও হয়তো ধার্মিক এবংঈশ্বর-বিশ্বাসী, তবু ঈশ্বরের সন্তানদের বিনাশ করতে তারা কোনো দ্বিধা করে না।
জাহানারা সেই অস্ত্রগুলোর গায়ে হাত বুলাতে লাগলেন।
রুমী বললো, আম্মা, এক্ষুনি এগুলো লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা দরকার।
সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো একতলার পানির বিরাট ট্যাংকটি, যাকে হাউজ বলে। হাউজটা আট ফুট চওড়া, আর দশ ফুট লম্বা, প্রচুর পানি ধরে। এক কোণে একটা গোল। ম্যানহোল; তা দিয়ে ভেতরে নামা যায়। জামী নেমে গেল একটা ছোট টুল নিয়ে। টুলটাকে সে অনেক ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর অস্ত্রগুলো বস্তায় মুড়ে, দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে রাখা হলো সেই টুলের ওপর।
সব ব্যবস্থা নিখুঁত হবার পরও রুমী বললো, কিন্তু মিলিটারি পুলিশ এসে এত বড় একটা পানির হাউজ দেখতে বাদ দেবে? আব্ব, তুমি হলে কী করতে!
শরীফ তাঁর হাতের টর্চটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, অফকোর্স, এটা দেখলে আমার সন্দেহ হতো। আমি এসে এর ঢাকনা খুলে দেখতাম, ভিতরে কোনো মানুষ লুকিয়ে আছে কি না।
জাহানারা বললেন, ঢাকনা খুলে, টর্চ মেরে দ্যাখো! কী দ্যাখলা?
শরীফ বললেন, শুধু পানি চকচক করছে, এটাই দেখছি। ভিতরের দিকটা কিছু দেখা যায় না।
–ভিতরের দিকটাও দেখতে হলে পানির মধ্যে নামা ছাড়া উপায় নাই। ওয়েস্ট পাকিস্তানীরা পানিতে নামবে বলে মনে হয়? ওরা পানিকে ডরায়।
রুমী বললো, ওর ভিতরে নামলে সে ব্যাটাকে ঠুসে ধরবো।
এরপর দু’দিন রুমী প্রায় সর্বক্ষণই বিছানায় শুয়ে রইলো আর গান শুনতে লাগলো অবিরাম। বন্ধুরাও আসছে অনেকে। ধানমণ্ডি ও মীরপুর রোডের সেই সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, ঢাকা অ্যাডমিনিস্ট্রেশান একটা বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু রুমীদের দলটাকে সামান্য ক্ষতিও স্বীকার করতে হয়নি।
দু’দিন পর রুমী আবার একটু একটু বেরুতে শুরু করলো। আরও বেশি অস্ত্রশস্ত্র আনাবার প্রস্তুতি চলছে। আগামী মাসের ছ’ তারিখে পাকিস্তান সরকার প্রতিরক্ষা দিবস পালনের তোড়জোড় করছে, সেইদিনই মুক্তিযোদ্ধারা এক বড় রকমের আঘাত দিতে চায়। ঢাকায় এখন গেরিলাদের মোট ন’টি গ্রুপ, সেদিন তারা আক্রমণ চালাবে একযোগে।
সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে গেছে রুমী, ফিরলো সন্ধের পর। মুখটা শুকনো, শরীর ভালো নেই তা বোঝা যায়, কিন্তু কিছুতেই তা স্বীকার করবে না। জাহানারা বারবার জিজ্ঞেস করলে সে একসময় ক্লিষ্ট হেসে বললো, আম্মা, মাথাটা কেন জানি দপদপ করছে, ভালো করে বিলি করে দাও তো!
তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লো রুমী। জাহানারা তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। জামী আর হাফিজ নামে ওদের এক বন্ধু কাছে এসে বসে গল্প শুনতে লাগলো, এখন শুধুই যুদ্ধের গল্প। পাশে একটা রেডিও, তাতে পরপর বেজে চলেছে বাংলা গান, আকাশবাণীর অনুষ্ঠান। একটা গান শুনে চমকে উঠলো রুমী।
এই সেই খুদিরামের ফাঁসি উপলক্ষে বাংলার মর্ম নিঙড়ানো গান :
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি
ও মা হাসি হাসি পরো ফাঁসি
দেখবে জগতবাসী…
এই গানটা রুমীর খুব প্রিয়, তবু সে ভুরু কুঁচকে বললো, এই গানটা আজ দুপুরে আর একবার শুনেছি। রেডিওতেই, কোন স্টেশান কে জানে! একই দিনে এই গান দু’বার।
জামী বললো, জিম রীভত্স-এর রেকর্ড চালাবো? তুমি ভালোবাসো…
রুমী বললো, না থাক।
তারপর সে ঘুমিয়ে পড়লো। অন্যরাও চলে গেল যে-যার বিছানায়।
মধ্যরাত্রি পার হবার পর জাহানারা বেগম গেটের কাছে দুমদাম শব্দ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলেন। ছুটে গেলেন জানলার কাছে। গাড়ির শব্দ, বুটের আওয়াজ, তীব্র সার্চ লাইট। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত কুড়ি জন মিলিটারি। তিনি ঝড়ের মতন চলে এলেন রুমীদের ঘরে। ওরা ঘরের ঠিক মাঝখানটায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সব দিকের জানলা দিয়ে দেখা হয়ে গেছে, সব দিকেই মিলিটারি পুলিশ, তাদের সংখ্যা। কত কে জানে! এ বাড়ির বাগানের মধ্যে একদল পুলিশ ঢুকে পড়ে গেটে ধাক্কা দিচ্ছে।
পালাবার কোনো উপায়ই নেই। বাড়ির উঠোনে, বারান্দায়, বাগানে তীব্র আলো ফেলছে, চকচক করছে পুলিশদের হাতের রাইফেলের বেয়নেট। এই অবস্থাতেও জাহানারার একটা কথা মনে পড়ে গেল। রুমী একদিন বলেছিল, আমাদের সেক্টর কমাণ্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ কী বলেন জানো? তিনি বলেন, কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না। চায় রক্তস্নাত শহিদ মামণি, আমরা সবাই শহিদ হয়ে যাবো, এই কথা ভেবে মনকে তৈরি করে ফেলেছি।
আতঙ্কে তিনি রুমীর হাত চেপে ধরলেন।
পুলিশের কর্কশ চিৎকার শরীফকে নিচে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই হলো। ভেতরে ঢুকে এলো একজন ক্যাপটেন ও একজন সুবেদার আর কয়েকজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী পুলিশ। ক্যাপ্টেনটিকে মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কলেজের ছাত্র, রুমীর চেয়ে বয়েস খুব বেশি হবে না, দেশের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে সে আর রুমী হয়তো দু’টিমের হয়ে ফুটবল খেলতে পারতো, আজ সে এসেছে ঘাতকের ভূমিকায় আর রুমীও তার আদর্শের জন্য যে কোনো উপায়ে একে হত্যা করতে দ্বিধা করবে না। সঙ্গের সুবেদারটি মধ্যবয়স্ক, উর্দুভাষী বিহারী।
সমস্ত বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করলো তারা। শরীফ যেমন ভেবেছিলেন, জলের ট্যাংকটির ঢাকনা খুলে একবার টর্চ মেরে দেখলো শুধু। কোনো অস্ত্র না পেলেও রুমী, জামী, আর শরীফদের একতলার উঠোনে এনে দাঁড় করালো তারা। ক্যাপটেনটি গ্যারাজের গাড়িটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলো, ইয়োর কার? ড্রাইভার চালায়, না নিজে চালাতে জানেন?
শরীফ বললেন, চালাতে জানি।
ক্যাপ্টেন বললো, ড্রাইভ অ্যালং উইথ আস্।
রুমীদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো বাইরে। জাহানারা ছুটে এসে বললেন, ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমিও তা হলে সঙ্গে যাবো!
ক্যাপ্টেনটি শান্ত গলায় বললো, রুটিন ইন্টারোগেশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রমনা থানায়। দে উইল বী ব্যাক সুন!
শরীফ চোখের ইসারায় স্ত্রীকে সঙ্গে না আসার জন্য মিনতি জানালেন।
শরীফ আর জামী ফিরে এলো সেই রাত এবং পরের রাত পেরিয়ে তার পরের বিকেলের দিকে। তাদের লুঙ্গি-পাঞ্জাবি ছেঁড়া, ধুলো কাদা মাখা, চোখের নিচে কালো দাগ, ঠোঁটের কোণায় রক্ত, মাথার চুলে রক্ত, গভীর অপমানে বিবর্ণ মুখ।
জাহানারা আর্ত চিৎকার করে উঠলেন, রুমী? রুমী কোথায় গেল?
পিতা-পুত্র দু’জন চুপ করে রইলো। কণ্ঠ এতই শুকনো যে কথা বলারও ক্ষমতা নেই, পা দুটিও যেন শরীরের ভার বহন করতে পারছে না।
রুমীকে ওরা ছাড়েনি। রুমী সম্পর্কে ওরা অনেক কিছু জানে।