৩৭. শ্রাবণ মাসের গোড়াতে

শ্রাবণ মাসের গোড়াতে শওকত সাহেবের শরীর খুব খারাপ করল। তিনি প্ৰায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। কাজের মেয়েটিও নেই। খুব ঝামেলা। মুনা অফিসে চলে গেলে সামান্য এক গ্লাস পানিও নিজেকে গড়িয়ে খেতে হয়। তাতেও কষ্ট হয়। এক সন্ধ্যায়। তার অসুখ বেশ বাড়ল। প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা, সেই সঙ্গে গা কাঁপিয়ে জ্বর। বাইরে ঘোর বর্ষ। বৃষ্টিতে পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকেই ইলেকট্রিসিটি নেই। মুনা হারিকেন জ্বালিয়ে মামার ঘরে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। তুই এখানে খানিকক্ষণ বসে থাক।

মুনা বসল। শওকত সাহেব এলোমেলা ভাবে দু’একটা কথাটথা বলতে চেষ্টা করলেন। সবই বকুলকে নিয়ে। গত মাসে বকুল এসেছিল। খবর না দিয়ে আসা। জহিরের মামাতো ভাইয়ের বিয়ে নারায়ণগঞ্জে সেখানে যাবার পথে ঘণ্টা তিনেকের জন্যে এ বাড়িতে থাকা। মুনা সে সময়টা বাসায় ছিল না। শওকত সাহেব বকুলের গল্প পঞ্চাশবার করেছেন। প্রতিবারেই নতুন নতুন কিছু তথ্য যোগ হয়েছে। মুনার কেমন সন্দেহ হয় বেশির ভাগই বোধ হয় বানানো। আজও সেই গল্পই শুরু হল।

মেয়েটা সুন্দর হয়েছে খুব, বুঝলি মা খুব সুন্দর।

সুন্দর হবারই তো কথা। বিয়ের পর মেয়েরা সুন্দরী হয়। এটাই নিয়ম।

সবাই হয় না। যারা সুখী হয় তারাই হয়। মেয়েটা সুখী হয়েছে। আর হবে না কেন বল ছেলেটা তো ভাল। ভাল না?

হ্যাঁ হয়।

এসেই পা ছুঁয়ে সালাম করল।

কী যে তুমি বল মামা! তোমার জামাই আর তোমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করবে?

না মানে সবাই তো করে না। আজকালকার ছেলে। জহির বিদেশ যাচ্ছে বুঝলি।

কবে যাচ্ছে?

এখনো ঠিক হয়নি। চেষ্টা চলছে। তার এক চাচা থাকেন ইংল্যান্ডে। তিনিই ব্যবস্থা করছেন।

ভাল।

একবার গেলে বকুলকেও নিয়ে যাবে তাই না?

নেওয়াই তো উচিত।

দেশ বিদেশ দেখা হবে মেয়েটার ভাগ্যের ব্যাপার তাই না?

তাতো বটেই। আচ্ছা মামা আমার কথা বকুল কিছু জানতে চায়নি, তাই না?

শওকত সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, জানতে চাইবে না। কেন? চেয়েছে। অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছে।

কি জিজ্ঞেস করেছে?

তিনি সে সব কিছু বলতে পারলেন না। মুনা মৃদু হাসল। বকুল কিছুই জানতে চায়নি। কিন্তু কোন চাইবে না?

মামা। তুমি শুয়ে থাকে। আমি খাবার তৈরি করি। রুটি খাবে তো?

হ্যাঁ। আরেকটু বাস। ঝড় কমুক।

ঝড় কোথায় দেখলে তুমি! বাতাস দিচ্ছে। তুমি শুয়ে থােক। কয়েকটা রুটি বানিয়ে চলে আসব। বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি খানিকক্ষণ থাকতে পারবে অন্ধকারে? হারিকেনটা নিয়ে যাই।

রুটি বানাতে মুনার অনেকক্ষণ লাগল। চুলায় কি একটা হয়েছে। বারাবার নিভে যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালার কবাট একটা ভাঙা। বাতাসের ঝাপটায় হারিকেন নিভে যাচ্ছে। যন্ত্রণার এক শেষ।

মুনা রুটি বানিয়ে মামার ঘরে এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় ডাকল, মামা ঘুমিয়ে পড়েছ?

মামা জবাব দিল না। দ্বিতীয়বার মামাকে ডাকতে গিয়ে তার গলা কেপৌ গেল। কেউ তাকে বলে দেয়নি। কিন্তু সে জানে মামা আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেবেন না। মুনা খুব সাবধানে হরিকেনটি মেঝেতে নামিয়ে রাখল। সে বুঝতে পারছে না। এখন কি করবে। চিৎকার করে কাদবো? ছুটে যাবে রাস্তায়? কিন্তু কোনটিই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে বারান্দায় বেরিয়ে এল। বৃষ্টির ছাঁট এসে গায়ে লাগছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠছে। আবার সব ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শব্দ, বজপাতের শব্দ তবুও কী অসম্ভব নীরবতা চারদিকে।

ছোটবেলায় মুনা যখন একলা হয়ে পড়েছিল তখন তার এই মামা তাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে তার বড় ভয় লাগত। মামা তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতেন নিজের বিছানায়। ফিসফিস করে বলতেন, ভয় কি রে পাগলী, আমাকে শক্ত করে ধরে থােক। মুনা তাকে শক্ত করে ধরে থাকত। তবু ভয় কাটত না। মুনা বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এক সময় তার পা ভার হয়ে এল। সে বাচ্চা মেয়েদের মত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। ফিসফিস করে সম্ভবত নিজেকে শোনাবার জন্যেই বলল, তোমাকে কতটা ভালবাসি। এই কথা কি মামা আমি কোনোদিন তোমাকে বলেছি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *