৩৭. রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত লাভ এবং এতদসম্পর্কিত কয়েকটি পূর্বাভাস

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত লাভ এবং এতদসম্পর্কিত কয়েকটি পূর্বাভাস

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বলেন, অনেক ইহুদী পণ্ডিত, নাসারা গণক এবং আরবের অনেকে আবির্ভাবের আগেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) সম্পর্কে বলাবলি করতেন যে, তাঁর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। ইহুদী ও নাসারা পণ্ডিতগণ তাদের কিতাবসমূহে বর্ণিত রাসূল (সা)-এর গুণাবলী ও তাঁর আগমন কালের বিবরণ এবং তাদের নবীদের প্রতিশ্রুতি থেকে বিষয়টির ব্যাপারে অবহিত হতে পেরেছিলেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উক্ষ্মী নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল, যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়; (৭ আরাফ : ১৫৭)

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :

স্মরণ কর, যখন ঈসা ইব্‌ন মরিয়ম বলল, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর রাসূল, আমার আগমন পূর্বের তাওরাতের সত্যায়নকারী রূপে এবং এমন এক রাসূলের সুসংবাদ দানকারী রূপে যিনি আমার পরে আগমন করবেন, যার নাম হবে আহমদ।

আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন :

মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। তার সহচরীগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকৃ ও  ৭৬—

সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন পরিস্ফুটিত থাকবে; তাওরাতে তাদের বর্ণনা এইরূপ এবং ইনজীলেও এইরূপই। (৪৮ ফােতহ : ২৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন :

স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি। অতপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি স্বীকার করলো? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্ৰহণ করলে? তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। (৩ আলে ইমরান : ৮১)

সহীহ বুখারীতে ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, যদি মুহাম্মদের আবির্ভাব ঘটে আর তখন তিনি জীবিত থাকেন, যেন অবশ্যই তিনি মুহাম্মদ (সা)-এর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন এবং তাকে সাহায্য করেন। আর প্রত্যেক নবীকে আল্লাহ এই নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা নিজ নিজ উম্মত থেকে এই অঙ্গীকার নিয়ে রাখেন যে, যদি মুহাম্মদের আবির্ভাব ঘটে আর তারা তখন জীবিত তাকে যেন তারা তার প্রতি ঈমান আনে এবং তাকে সাহায্য করে এবং তাঁর অনুসরণ করে।

এই হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, প্রত্যেক নবীই মুহাম্মদ (সা)-এর ব্যাপারে সুসংবাদ প্রদান করেছেন এবং তাঁর আনুগত্য করার আদেশ দিয়েছেন।

হযরত ইবরাহীম (আ) মক্কাবাসীদের জন্য যে দোয়া করেছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন :

অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করবেন, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবেন। (২ বাকারা ৪ ১২৯)

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, হযরত আবু উমামা (রা) বলেছেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার মিশনের সূচনা কি ছিল? জবাবে নবী করীম (সা) বললেন :

আমার মিশনের সূচনা আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া, ঈসার সুসংবাদ আর আমার মা দেখেছিলেন যে, তার ভিতর থেকে এমন একটি আলো বের হচ্ছে, যার ফলে শামের রাজ-প্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক অন্যান্য সাহাবী সূত্রেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

অর্থাৎ সাহাবী হযরত আবু উমামা (রা) জানতে চেয়েছিলেন যে, মানুষের মাঝে রাসূল (সা)-এর মিশনের সূচনা এবং তার প্রচার প্রসার কিভাবে হয়েছিল? তাই নবীজী (সা) সেই ইবরাহীমের দোয়ার কথা উল্লেখ করলেন, যিনি গোটা আরবের মধ্যমণি হিসেবে স্বীকৃত। তারপর ঈসা (আ)-এর সুসংবাদের কথা বললেন, যিনি বনী ইসরাঈলের নবীদের সর্বশেষ নবী। উপরে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এই দুই নবীর মাঝে আরো যে সব নবী ছিলেন, তারাও মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে সুসংবাদ প্ৰদান করে গেছেন। পক্ষান্তরে উৰ্ব্বজগতে হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টির পূর্ব থেকেই রাসূল (সা)-এর মিশন প্রসিদ্ধ, আলোচনার বিষয় এবং জ্ঞাত বিষয় ছিল। যেমন ইমাম আহমদ (র) ইরবাজ ইব্‌ন সারিয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, ইরবাজ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :

আমি আল্লাহর বান্দা, সর্বশেষ নবী। অথচ আদম তখন তার কাদামাটিতে লুটোপুটি

খাচ্ছেন। আর আমি তোমাদেরকে এর সূচনা সম্পর্কে অবহিত করব। এটি ইবরাহীমের দোয়া, আমার ব্যাপারে ঈসার সুসংবাদ এবং আমার মায়ের দেখা স্বপ্ন। অদ্রািপ মুমিনদের মাগণেরও।

লায়ছ মুআবিয়া ইব্‌ন সালিহ থেকে বর্ণনা করেন যে, মুআবিয়া ইব্‌ন সালিহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মা তাঁকে প্রসব করার সময় একটি আলো দেখতে পান যার ফলে শামের রাজপ্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গিয়েছিল।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, মায়সারা আল-ফাজর (রা) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন? জবাবে তিনি বললেনঃ

আদম যখন রূহ আর দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় (আমি তখনও নবী)। উমর ইব্‌ন আহমদ ইব্‌ন শাহীন দালায়িলুনুবুয়্যাতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার জন্য নবুওত সাব্যস্ত হয়। কখন? জবাবে নবী করীম (সা) বললেন :

আদম-এর সৃষ্টি এবং তাঁর মধ্যে রূপ ফুকে দেয়ার সময়ও আমি নবী ছিলাম।

অর্থাৎ নবীগণের মাগণই এরূপ স্বপ্নই দেখে থাকেন? – মাওয়াহেব

আদম তখন তাঁর সৃষ্টির উপাদান কাদা-মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) পবিত্র কুরআনের আয়াত

وإذ أخذنا من النبين ميثاقهم ومنك و من نوح. এর ব্যাখ্যায় বলেছেন :

كنت أول النبين فى الخلق وآخرهم فى البغدث সৃষ্টির বেলায় আমি সর্বপ্রথম নবী আর আবির্ভাবের দিক থেকে সকলের শেষ নবী।

এককালে জিন শয়তানরা আড়ি পেতে আসমানের সংবাদ সংগ্ৰহ করত। এভাবে তারা ফেরেশতাদের আলোচনা শুনে তা তাদের গণকদের কানো দিত। তখনও তারকা নিক্ষেপের মাধ্যমে তাদের বিতাড়িত করা হতো না। এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাব সংক্রান্ত কিছু তথ্যও তারা সংগ্ৰহ করে আরবের গণকদের শোনায়। ফলে আরবের মানুষ তা জেনে যায়। রাসূল (সা)-এর নবুওত প্ৰাপ্তির প্রাককালে শয়তানদের আকাশের সংবাদ শ্রবণের সে পথ রুদ্ধ করা হয় এবং শয়তান ও তারা যে সব স্থানে বসে সংবাদ শ্রবণ করত, তার মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি করা হয়। তাদের প্রতি উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করা হয়। তাতে শয়তানরা বুঝে নেয় যে, আল্লাহর আদেশে নতুন কিছু একটা ঘটেছে বলেই এমন হচ্ছে। বর্ণনাকারী বলেন, এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তাআলা তীর রাসূলের প্রতি নাযিল করেন?

বল, আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ

করেছে এবং বলেছে- আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ-নিদের্শ

করে; ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন

শরীক স্থির করব না। (৭২ জিন : ১-২)।

আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে এসব বিষয়ে আলোচনা করেছি।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :

স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে যারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হলো, তারা বলল, চুপ করে শ্রবণ করা। যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল। সতর্ককারীরূপে। তারা বলল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে। মূসার পরে, এটা তার পূর্ববতী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। (৪৬ আহকাফ : ২৯-৩০)

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বৰ্ণনা করেন যে, ইয়াকুব ইব্‌ন উতবা ইবুন মুগীরা ইব্‌ন আখনাস বলেন, উল্কা নিক্ষেপের ফলে সর্বপ্রথম ভয় পেয়েছিল সাকীফ গোত্রের একটি শাখা। আমর ইব্‌ন উমাইয়া নামক বনু ইলাজ-এর অতি তীক্ষ্ণধী ও ধূর্ত এক ব্যক্তি ছিল। সাকীফ এর সেই লোকগুলো তার নিকট গিয়ে বলল, হে আমার! এসব উল্কা নিক্ষেপের ফলে আকাশে কী ঘটেছে, আপনি কী তা লক্ষ্য করছেন না? লোকটি বলল, হ্যাঁ, লক্ষ্য করছি বৈকি! তোমরা খোজ নিয়ে দেখ, এটি কোন তারকা? যদি এটি জলে-স্থলে, শীতে-গ্ৰীষ্মে দিক নির্ণয়কারী সেই তারকা হয়, তবে আল্লাহর শপথ, এই ঘটনা দুনিয়ার বিপর্যয় আর এই সৃষ্টি জগতের ধ্বংস বৈ নয়। আর যদি এটি অন্য তারকা হয়, সেই তারকা যদি আপন স্থানে বহাল থাকে, তবে বুঝতে হবে এটি আল্লাহর বিশেষ কোন সিদ্ধান্তের ফলে হয়েছে। তোমরা খোজ নিয়ে দেখ আসল ঘটনা কী?

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, কোন কোন আলিম বর্ণনা করেন যে, বনু সাহিম গোত্রের এক মহিলা ছিল। নাম ছিল তার গাইতালাহ! জাহেলী যুগে সে জ্যোতিষী ছিল। এক রাতে তার জিন সঙ্গীটি তার নিকট আসে। এসে সে আওয়াজ দিয়ে বলে, আমি যা জানিবার জানি -উৎসর্গের দিন। কুরায়শরা এ সংবাদ শুনে বলল, সে আসলে কী বলতে যাচ্ছে? তারপর সে আরও এক রাতে এসে অনুরূপ আওয়াজ দিয়ে বলল, ঘাঁটি, জান ঘাঁটি কী? দক্ষিণের অভিজাত বাহিনী তাতে ধরাশায়ী হবে। এ সংবাদ পেয়েও কুরায়শরা বলল, লোকটি কী বলতে চায়? কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বোধ হয়। তোমরা লক্ষ্য রােখ, কী ঘটে। কিন্তু তখনো তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। যখন ঘাঁটির নিকট বদর ও উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হলো তখন তারা বুঝতে পারল যে, জিনটি আসলে কী সংবাদ দিয়েছিল।

ইব্‌ন ইসহাক বৰ্ণনা করেন, আলী ইব্‌ন নাফি আল-জুরাশী বলেন যে, জাহেলী যুগে ইয়ামানের জন্মব গোত্রের একজন গণক ছিল। যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ব্যাপারে বলাবলি শুরু হলো এবং তা গোটা আরবে ছড়িয়ে পড়ল, তখন ঐ গোত্রের লোকেরা ঐ গণককে বলল, এই লোকটির ব্যাপারে একটু ভেবে দেখুন!! তারা তার সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য এক পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হলো। সূর্য উদিত হলে সে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। তাদের নিকট পৌঁছে সে তার ধনুকের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, লোক সকল!! আল্লাহ মুহাম্মদকে সম্মানিত করেছেন, তাকে মনোনীত করেছেন ও তার অন্তরকে পবিত্র করেছেন। লোক সকল! তোমাদের মাঝে তার অবস্থান কদিনের মাত্র। এই বলে সে যেখান থেকে এসেছিল, দ্রুতপদে সেখানে চলে যায়। ইব্‌ন ইসহাক। এরপর সাওয়াদ ইব্‌ন কারিব-এর কাহিনী উল্লেখ করেন। সেই আলোচনা আমরা জিনদের অদৃশ্যবাণী অধ্যায়ের জন্য রেখে দিলাম।

অধ্যায়

ইব্‌ন ইসহাক বৰ্ণনা করেন, আসিম ইব্‌ন আমর ইব্‌ন কাতাদার গোত্রের কতিপয় লোক

এমন বিদ্যা ছিল, যা আমাদের নিকট ছিল না। তাদের ও আমাদের মাঝে সর্বদা সংঘাত লেগেই থাকত। অগ্ৰীতিকর পরিস্থিতির শিকার হলে তারা আমাদেরকে বলত, প্রতিশ্রুত একজন নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আদি ও ইরাম জাতিকে হত্যা করার ন্যায় আমরা তার সঙ্গে যোগ দিয়ে তোমাদেরকে হত্যা করব। তাদের মুখ থেকে এ কথাটি আমরা বহুবার শুনেছি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) আবির্ভূত হয়ে যখন আমাদেরকে আল্লাহর পথে আহবান করলেন, তখন আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম। তারা আমাকে যাঁর ভয় দেখাত, আমরা তাকে চিনে ফেললাম। এবং তাদের আগে আমরা তার সঙ্গে যোগ দিলাম। আমরা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম আর তারা তাকে অস্বীকার করল। তাই আমাদের ও তাদের ব্যাপারে এই আয়াতটি নাযিল হয়ঃ

তাদের নিকট যা আছে, যখন আল্লাহর নিকট হতে তার সমর্থক কিতাব আসল; যদিও পূর্বে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে তারা এর সাহায্যে বিজয় প্রার্থনা করত, তবুও তারা যা জ্ঞাত ছিল, যখন তা তাদের নিকট আসল, তখন তারা তা প্ৰত্যাখ্যান করল। সুতরাং কাফিরদের প্রতি আল্লাহর লানত। (২ বাকারী ৪৮৯)

ইব্‌ন আবু নাজীহ সূত্রে আলী আল-আযদীি থেকে ওয়ারাকা। বর্ণনা করেন যে, আলী আল-আযদীি বলেন, ইহুদীরা বলত, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আপনি এই নবীকে প্রেরণ করুন! তিনি আমাদের ও লোকদের মাঝে মীমাংসা করে দেবেন। তারা নবীর উসীলা দিয়ে বিজয় প্রার্থনা করত।

ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, ইহুদীরা খায়বারে গাতফানের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে ইহুদীরা পরাজিত হয়। তখন তারা এই দোয়া করে যে, হে আল্লাহ! সেই উমী নবী মুহাম্মদের উসীলায় আমরা প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় প্রার্থনা করছি, যাকে শেষ যমানীয় প্রেরণ করবেন বলে আপনি আমাদের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারপর যখন নবী করীম (সা) প্রেরিত হন তখন তারা তাকে অস্বীকার করে।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, বদরী সাহাবী সালামা ইব্‌ন সালাম ইব্‌ন ওকাশ (রা) বলেন, বনু আবদুল আশাহালের জনৈক ইহুদী আমাদের প্রতিবেশী ছিল। একদিন সে তার ঘর থেকে বের হয়ে আসে। আমি তখন আমার ঘরের আঙিনায় কম্বল বিছিয়ে শুয়ে আছি। আমি তখন সবেমাত্র কিশোর। যা হোক, লোকটি এসে কিয়ামত, পুনরুস্থান, হিসাব, মীযান ও জান্নাত-জাহান্নামের কথা আলোচনা করে। বর্ণনাকারী বলেন, কথাটা সে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে না এমন মূর্তিপূজারী মুশরিকদের নিকট ব্যক্ত করলে তারা বলে, ধ্যাৎ, এসবও আবার হবে নাকি? মৃত্যুর পর পুনরুথিত করে মানুষকে এমন জগতে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে জান্নাত-জাহান্নাম আছে এবং সেখানে তাদেরকে কৰ্মফল দেয়া হবে, এমন কথা তোমার বিশ্বাস হয়? লোকটি বলল, হ্যাঁ, আমি এসবে বিশ্বাস করি। লোকেরা বলল, তা হলে এর লক্ষণ কী? সে বলল, এর লক্ষণ হলো, এই নগরী থেকে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। মক্কা ও ইয়ামানের প্রতি ইঙ্গিত করে সে বলল। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, তাকে আমরা কবে দেখব? বৰ্ণনাকারী বলেন, জবাবে সে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করল। আমি তখন উপস্থিত লোকদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। সে বলল, এই বালকটি যদি পরিণত বয়স লাভ করে তাহলে সে তাঁকে দেখতে পাবে। সালাম বলেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, এরপর একরােত একদিন অতিবাহিত হতে না হতেই আল্লাহ্ তাঁর রাসূল (সা)-কে প্রেরণ করেন। ইহুদী লোকটি তখন আমাদের মাঝে জীবিত। ফলে আমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম, কিন্তু অবাধ্যতা ও হিংসাবশত সে তাঁকে অস্বীকার করল। আমরা তাকে বললাম, কী খবর! তুমি না। আমাদেরকে কী সব কথা-বার্তা বলতে! সে বলল, বলতাম তো ঠিক, কিন্তু ইনি তিনি নন। আহমদ এবং বায়হাকী স্থাকিম সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন।

আবু নু আয়ম দালায়িল গ্রন্থে বৰ্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মদ ইব্‌নে সালামা বলেন, বনু আব্দুল আশাহালে একজন ছাড়া আর কোন ইহুদী ছিল না। নাম তার ইউশা। আমি তখন বালক, সবেমাত্র লুঙ্গিপরা শুরু করেছি, তাকে বলতে শুনেছি, একজন নবী তোমাদের মাথায় ছায়া পাত করে রেখেছেন। এই ঘরের দিক থেকে তিনি আবির্ভূত হবেন। তারপর সে বায়তুল্লাহর দিকে ইশারা করে। বলে, যে ব্যক্তি তাকে পাবে সে যেন অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করে। এক সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবির্ভূত হলেন। আমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম। আর সেই ইহুদী লোকটি আমাদের মাঝে উপস্থিত। কিন্তু বিদ্বেষ ও অবাধ্যতাবশত সে श्न् ऊान्ब्ल न्।

ইতিপূর্বে আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আবির্ভাব ও তাঁর গুণ-পরিচয় প্রদানকারী এই ইউশা এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম-তারকার আত্মপ্রকাশ সংক্রান্ত যুবোয়র ইব্‌নে বাতা-এর আলোচনা করে এসেছি। ইব্‌নে ইসহাক বলেন, আসিম ইব্‌নে উমর ইব্‌নে কাতাদা বর্ণনা করেছেন যে, বনু কুরায়জার জনৈক প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, আপনি বনু কুরায়জার জাতি-গোষ্ঠী বনু হাদাল-এর লোক ছালাবা ইব্‌নে সায়া, উসায়দ ইব্‌নে সায়া ও আসাদ ইব্‌নে উবায়দ-এর ইসলাম গ্রহণের পটভূমি জানেন কি? এরা জাহেলী যুগে বনু কুরায়জার সঙ্গে ছিল। তারপর ইসলামের যুগেও তারা বনু কুরায়জার নেতৃত্ব প্রদান করে। আমি বললাম, না, জানি না।

তিনি বললেন ৪ সিরিয়ার অধিবাসী ইব্‌নে হায়বান নামক এক ইহুদী ইসলামের আবির্ভাবের কয়েক বছর আগে আমাদের নিকট আসে। এসে লোকটি আমাদের মাঝে আত্মপ্ৰকাশ করে। আল্লাহর শপথ! তার অপেক্ষা উত্তম পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কারী আর কাউকে আমি দেখিনি। লোকটি আমাদের নিকট স্থায়িভাবে অবস্থান করতে শুরু করে। আমাদের অঞ্চলে কখনো অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমরা তাঁকে বলতাম, হে ইব্‌নে হায়বান! আসুন আমাদের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনা করুন। জবাবে তিনি বলতেন, না, আল্লাহর শপথ! আগে সাদাকা পেশ না করলে আমি এ কাজ করতে পারব না। আমরা বলতাম, কত দিতে হবে বলুন। তিনি বলতেন, একসা খেজুর কিংবা দুই মুদ্দ যাব। আমরা উক্ত পরিমাণ সাদাকা পেশ করতাম, এরপর তিনি আমাদের নিয়ে ফসলের মাঠে গিয়ে আমাদের জন্য বৃষ্টির প্রার্থনা করেন। আল্লাহর শপথ! তার সেই দোয়ার অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতে আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টিপাত শুরু হতো। এভাবে দুবার তিনবার নয়- তিনি বহুবার এরূপ দোয়া করেছেন। তারপর আমাদের নিকট থাকাবস্থায়ই তার মৃত্যুর সময় হয়। যখন তিনি আঁচ করতে পারলেন যে, তার আর বঁাচা হবে না, তখন তিনি বললেন, হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা কি জান, কিসে আমাকে প্রাচুর্যের দেশ থেকে এই অভাবের দেশে বের করে এনেছে? আমরা বললাম, আপনি ভালো জানেন। তিনি বললেন, আমি এমন এক নবীর আবির্ভাবের অপেক্ষায় এ দেশে এসেছি, যার আবির্ভাবকাল অতি নিকটে। এই নগরী তাঁর হিজরত ভূমি। আমি আশা করতাম যে, তিনি আবির্ভূত হবেন আর আমি তার অনুসরণ করব। তবে তাঁর সময় কিন্তু নিকটে। কাজেই হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমাদের আগে যেন অন্য কেউ তার সঙ্গী হতে না পারে। আবির্ভূত হওয়ার পর যারা তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, তাদের সঙ্গে তাঁর রক্তারক্তি হবে এবং বন্দীকরণ ও দাস বানানোর ঘটনা ঘটবে। অতএব কোন কিছু যেন তোমাদেরকে তার অনুসরণ থেকে বিরত না রাখে। তারপর যখন রাসূল (সা) আবির্ভূত হলেন এবং বনু কুরায়জাকে অবরোধ করলেন, তখন যুবকরা বলল— এখন তারা টগবগে যুবক- হে বনু কুরায়জা সম্প্রদায়ের লোকজন! আব্দুল্লাহর কসম! ইনিই সেই নবী, ইব্‌নে হায়বান তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারা বলল, না ইনি সেই ব্যক্তি নন। যুবকরা বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, তিনি যেসব গুণাগুণের বিবরণ দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী ইনিই সেই ব্যক্তি। এরপর তারা দুর্গ থেকে নেমে এসে ইসলাম গ্ৰহণ করে নিজেদের রক্ত, সম্পদ ও পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করে। ইব্‌নে ইসহাক বলেন, ইহুদীদের ব্যাপারে আমি যা জানতে পেরেছি, এই হলো তার বিবরণ।

আমরা উপরে উল্লেখ করে এসেছি যে, তুব্বা আল-ইয়ামানী— যার উপনাম আবু কারব তুব্বান আসাআদ মদীনা অবরোধ করতে এসেছিলেন। তখন দুইজন ইহুদী পণ্ডিত তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, এ কাজে সফলতা অর্জন করা আপনার পক্ষে সত্তেম নয়। কারণ এটি এমন আখেরী নবীর হিজরত ভূমি, যিনি শেষ যমানায় আগমন করার কথা। এ কথা শুনে তুব্বা তাঁর সংকল্প থেকে বিরত হন। আবু নু আইম তার দালায়িল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইব্‌নে সালাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা যখন যায়দ ইব্‌নে সাইয়াকে হেদোয়ত দান করার ইচ্ছা করলেন, যায়দা বললেন, দুটি ব্যতীত নবুয়তের সব কটি লক্ষণই আমি প্রথম দর্শনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চেহারায় প্রত্যক্ষ করি। যে দুটি লক্ষণ প্রথম দর্শনে দেখতে পাইনি, তা হলো তার সহনশীলতা অজ্ঞতার ওপর প্রবল থাকবে এবং তার সঙ্গে অজ্ঞতাসুলভ আচরণ যত বেশি করা হবে, তার সহনশীলতা ততই বৃদ্ধি পাবে। যোয়দ ইব্‌নে সাইয়া বলে, ফলে আমি একান্ত ঘনিষ্ঠতা লাভ করে তার সহনশীলতা ও অজ্ঞতা যাচাই করার প্রচেষ্টায় লেগে যাই। তারপর তিনি নবী করীম (সা)-এর নিকট ধারে মাল বিক্রয়েল্প কাহিনী উল্লেখ করেন এবং বলেন, যখন সেই ঋণ পরিশোধ করার দিন-তারিখ এসে গেল, আমি তার নিকট গিয়ে তার জামার কলার এবং চাদর টেনে ধরি। তিনি তখন তার সাহাবীগণের সঙ্গে এক জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। আমি তাঁর প্রতি উগ্ৰ মূর্তিতে দৃষ্টিপাত করি এবং বলি, মুহাম্মদ! তুমি কি আমার পাওনা আদায় করবে না? আল্লাহর শপথ, আমি জানি, আব্দুল মুত্তালিবের বংশটাই লেনদেনে এভাবে টালবাহানা করতে অভ্যস্ত। যায়দা বলেন, একথা শুনে উমর (রা) আমার প্রতি চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখ দুটো যেন ভাটার মত জুলছে। তারপর তিনি বললেন, ওহে আল্লাহর দুশমন! তুই আল্লাহর রাসূলকে কী বলছিস আর তাঁর সঙ্গে কী আচরণ করছিস সবই আমি শুনছি, দেখছি। সেই আল্লাহর শপথ, যিনি তাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি যদি তীর ভৎসনার ভয় না করতাম, তা হলে তলোয়ার দিয়ে তোর গর্দান উড়িয়ে দিতাম। রাসূল (সা) তখন শান্ত ও হাসিমুখে উমর (রা)-এর প্রতি তাকিয়ে আছেন। তারপর তিনি বললেন :

হে উমর! আমার আর তার তোমার থেকে এর স্থলে অন্যরূপ ব্যবহার প্রাপ্য ছিল। তোমার উচিত ছিল, আমাকে ঋণ আদায়ে উত্তম পন্থা অবলম্বন করার এবং তাকে আমার সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া। যাও হে উমর! লোকটার পাওনা পরিশোধ করে দাও। আর বিশসা (প্রায় দেড় মণ) খেজুর বেশি দিয়ে দাও।

এ ঘটনা দেখে যায়দ ইব্‌নে সাইয়া মুসলমান হয়ে যান এবং তার পরবর্তীকালের সকল জিহাদে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তাবুকের বছর তিনি ইনতিকাল করেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি সদয় হোন! তারপর ইব্‌নে ইসহাক হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন :

হযরত আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আব্বাস (রা) বলেন, সালমান ফারসী (রা) নিজের মুখে আমাকে বলেছেন যে, আমি ছিলাম ইস্পাহানের অধিবাসী এবং পারসিক ধর্মাবলম্বী। যে গ্রামে আমার বাস ছিল তার নাম জাই। আমার পিতা ছিলেন সেই গ্রামের প্রধান। আমি ছিলাম পিতার সর্বাধিক প্রিয় পাত্র। স্নেহের আতিশয্যে তিনি আমাকে তাঁর গৃহে আবদ্ধ করে রাখতেন, যেমন দাসীদের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। মজুসী ধৰ্ম আমি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করতাম। এক পর্যায়ে আমিই হলাম। সেই অগ্নিকুণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণকারী, যা সর্বদা প্ৰজ্বলিত রাখা হতো, এক মুহুর্তের জন্যও নিভতে দেয়া হতো না।

তিনি বলেন, আমার পিতা বিপুল জমি-জমার মালিক ছিলেন। তিনি নিজেই তার জমি-জমার দেখাশুনা করতেন। একদিন তিনি কোন এক নির্মাণ কাজে হাত দেন। ফলে আমাকে তিনি বলেন, নির্মাণ কাজের ব্যস্ততার কারণে আজকের মত আমি জমিজমা দেখাশুনা করতে পারছি না। আজকের মত তুমি গিয়ে একটু তদারকি করা। তিনি আমাকে এ সংক্রান্ত কিছু নির্দেশও দেন। তারপর তিনি আমাকে বলেন, ফিরতে বিলম্ব করো না। কারণ তুমি আমার চোখের আড়ালে চলে গেলে জমিজমার চাইতে তুমিই আমার বেশি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াও। তখন আমি কোন কাজই করতে পারি না।

সালমান ফারসী (রা) বলেন : আমি আমার পিতার জমি দেখার জন্য রওয়ানা হলাম। খৃস্টানদের একটি গির্জার নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় গির্জার ভিতরে খৃস্টানদের আওয়াজ পেলাম। তখন তারা উপাসনা করছিল। উল্লেখ্য যে, আমাকে ঘরে আটকে রাখার জন্য লোকজন যে আমার পিতাকে পরামর্শ দিয়েছিল, এতদিন আমি তা জানতাম না। যা হোক, শব্দ শুনে তাদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য আমি গির্জায় প্রবেশ করলাম। তাদের উপাসনা আমাকে মুগ্ধ করল এবং আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর শপথ, আমরা যে ধর্মে আছি, এই ধর্ম তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। আল্লাহর কসম, তখন থেকে আমি তথায় সূৰ্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত ঠােয় দাঁড়িয়ে রইলাম। পিতার জমিজমার কথা একদম ভুলেই গেলাম, ওখানে যাওয়া আর হলো না। তারপর আমি তাদেরকে বললাম, এই দীন আমি পাব কোথায়? তারা বলল, সিরিয়ায়। আমি পিতার নিকট ফিরে গেলাম। ততক্ষণে পিতা আমার অনুসন্ধানে লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং আমার চিন্তায় তার সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি উপস্থিত হলে তিনি বললেন বৎস! তুমি ছিলে কোথায়? আমি কি তোমাকে শীঘ্র ফিরে আসার কথা বলে দেইনি? সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমি বললাম, আব্বাজান! যাওয়ার পথে আমি দেখলাম, কিছু লোক তাদের গির্জায় উপাসনারত। তাদের উপাসনা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, সূর্যস্ত পর্যন্ত আমি তাদের নিকট সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। পিতল বললেন, বৎস! ঐ ধর্মে কোনো কল্যাণ নেই। তারচেয়ে তোমার ও তোমার পূর্বপুরুষদের ধর্মই উত্তম। আমি বললাম, কখনো নয়, আল্লাহর কসম! ঐ ধর্মই আমাদের ধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সালমান ফারসী বলেন, এতে পিতা আমাকে ভয়-ভীতি দেখান এবং পায়ে শিকল পরিয়ে আমাকে ঘরে আটকে রাখেন। আমি খৃস্টানদের নিকট খবর পাঠালাম যে, তোমাদের নিকট সিরিয়ার কোনো কাফেলা আগমন করলে আমাকে যেন অবহিত করা হয়। এক সময় একটি কাফেলা আগমন করে। খৃস্টানরা আমার কাছে সংবাদ পাঠায়। আমি বললাম, কাজ শেষ করে যখন তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় হবে, তখন আমাকে একটু জানিয়ো। তিনি বলেন, তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সয়ম হলে খৃষ্টানরা আমাকে তা অবহিত করে। আমি পায়ের শিকল ভেঙে তাদের সঙ্গে রওয়ানা হলাম। এক সময়ে আমি সিরিয়া এসে পৌঁছলাম।

সিরিয়া এসে আমি সেখানকার অধিবাসীদের জিজ্ঞেস করলাম, এই ধর্মের অনুসারীদের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান কে? তারা বলল, গির্জায় অবস্থানকারী প্রধান যাজক। আমি তার নিকট গিয়ে বললাম, আমি এই ধর্মের প্রতি আগ্রহী এবং আমি আপনার সাহচর্যে থাকতে চাই, গির্জায় আপনার সেবা করতে চাই এবং আপনার নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করে আপনার সঙ্গে উপাসনা করতে চাই। তিনি বললেন, ভিতরে প্রবেশ কর। আমি তার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, লোকটি আসলে অসৎ! সে তার অনুসারীদের সাদকা দানের আদেশ দেয় ও সেজন্য উৎসাহিত করে, কিন্তু প্রদত্ত সব সাদকা সে নিজের জন্য কুক্ষিগত করে রাখে এবং গরীব মিসকীনদের কিছুই দেয় না। এভাবে সে সাত মটকা সোনা-রূপী সঞ্চয় করে। সালমান ফারসী বলেন, এসব আচরণ দেখে লোকটির প্রতি আমার মনে তীব্র ঘৃণার সঞ্চার হয়। তারপর লোকটি মারা যায়। খৃস্টানরা তাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে সমবেত হলে আমি তাদেরকে বললাম, ইনি তো অসৎ লোক ছিলেন। ইনি আপনাদেরকে সাদকা দেয়ার আদেশ দিতেন এবং এজন্য উৎসাহিত করতেন বটে; কিন্তু আপনারা সাদকা নিয়ে আসলে তিনি তা মিসকীনদের না দিয়ে সব নিজের জন্য রেখে দিতেন। তারা আমাকে বলল, আপনি তা জানলেন কী করে? আমি বললাম, আমি আপনাদেরকে তার গোপন ধন ভাণ্ডার দেখিয়ে দিচ্ছি। তারা বলল, ঠিক আছে, দেখান। সালমান ফারসী বলেন, আমি তাদেরকে তার গুপ্ত ভাণ্ডারের স্থানটি দেখিয়ে দিলাম। সেখান থেকে তারা সাত মটকা ভর্তি সোনা-রূপা উদ্ধার করে। দেখে তারা বলে, একে আমরা দাফনই করব না। তারা তাকে শূলে চড়ায় এবং প্রস্তরাঘাত করে। তারপর তারা অপর এক ব্যক্তিকে এনে তার স্থলে বসায়।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, এই নতুন পাদ্রী রীতিমত উপাসনা করেন। তার মত দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ, আখেরাতের প্রতি উৎসাহী এবং রাতদিন ইবাদতগুজার আর কাউকে আমি দেখিনি। আমি তাঁকে ভালোবাসলাম, যেমন ইতিপূর্বে আর কাউকে আমি ভালোবাসিনি। বেশ কিছুদিন আমি তাঁর সাহচর্যে অতিবাহিত করলাম। তারপর তাঁর মৃত্যুর সময় নিকটবতী হলে আমি তাকে বললাম, আমি আপনার সাহচর্যে ছিলাম এবং আপনাকে আমি সর্বাধিক ভালো বাসতাম। এখন আল্লাহর নির্দেশে আপনার মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছে। কাজেই আপনি আমাকে কার নিকট যাওয়ার ওসীয়তা করছেন এবং আমাকে কী আদেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি যে ধর্মের অনুসারী ছিলাম, আজ সে ধর্মে তেমন কেউ আছেন বলে আমি জানি না। মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং তারা আদর্শ পরিবর্তন করে ফেলেছে। তবে মুসেলে অমুক নামের একজন লোক আছেন। তিনিও আমার দীনের অনুসারী। তুমি তার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হও।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, তার ইন্তিকাল ও দাফন-কাফনের পর আমি মুসেলের উপরোল্লিখিত লোকটির সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলাম। বললাম, জনাব! অমুক ব্যক্তি মৃত্যুর সময় আমাকে আপনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ওসীয়ত করে গেছেন এবং আমাকে অবহিত করেছেন। যে, আপনি তারই ধর্মের অনুসারী। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট অবস্থান কর। আমি তাঁর নিকট অবস্থান করলাম। তাঁকে আমি তাঁর সঙ্গীর ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত উত্তম ব্যক্তিরূপে পেয়েছি। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে আমি তাকে বললাম, জনাব! অমুক তো আপনার সান্নিধ্যে আসার জন্য আমাকে ওসীয়ত করেছিলেন। এখন আল্লাহর হুকুমে আপনার মৃত্যুকাল উপস্থিত, আপনি আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন এবং আমাকে কী আদেশ করছেন? তিনি বললেন, বৎস, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমরা যে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলাম, সে দীনের অনুসারী আর একজন লোকও আছে বলে আমি জানি না। তবে নাসীবীনে অমুক নামের একজন লোক আছেন, তুমি তার নিকট গিয়ে মিলিত হও। তারপর যখন তিনি মারা গেলেন এবং তার দাফন-কাফন সম্পন্ন হলো তখন আমি নাসীবীনের লোকটির সঙ্গে মিলিত হলাম এবং তাঁকে আমার নিজের ইতিবৃত্ত ও আমার দুই সঙ্গী আমাকে যা আদেশ করেছেন তা তার নিকট ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট অবস্থান কর। আমি তাঁর নিকট অবস্থান করলাম। তাকেও আমি তাঁর দুই পূর্বসূরির ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত পেয়েছি। এবারও আমি একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের সাহচর্যে কাটালাম। কিন্তু আল্লাহর শপথ করে বলছি, কিছু দিন যেতে না যেতেই তারও মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। মৃত্যুর আগে আমি তাঁকে বললাম, জনাব! অমুক ব্যক্তি আমাকে অমুকের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। তারপর দ্বিতীয়জন তৃতীয় আরেকজনের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। সবশেষে তৃতীয়জন আমাকে ওসীয়ত করেন। আপনার নিকট আগমন করার জন্যে। এখন আপনি আমাকে কার সান্নিধ্য অবলম্বনের উপদেশ দেবেন এবং আমাকে কী আদেশ দেবেন? বললেন, বৎস! আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমাদের ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত এমন একজন লোকও বেঁচে নেই; যার নিকট যাওয়ার জন্য আমি তোমাকে আদেশ করতে পারি। তবে রোমের আমুরিয়াহ নামক স্থানে একজন লোক আছেন, তিনি আমাদের ধর্মাবলম্বী। ইচ্ছে করলে তুমি তাঁর নিকট যেতে পার। কারণ, তিনিও আমাদের অভিন্ন পথের যাত্রী।

যখন তিনি মারা গেলেন এবং তার দাফন-কাফন সম্পন্ন হলো; আমি আমুরিয়ার সেই ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত করলাম এবং আমার বৃত্তান্ত শোনালাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমার নিকট থাক। আমি এবারও এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে অবস্থান ধরতে শুরু করলাম, যিনি আমার পূর্বের গুরুদেরই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। সালমান ফারসী (রা) বলেন, এসময়ে আমি কিছু উপার্জনও করি। কয়েকটি গাভী ও ছাগল আমার মালিকানায় আসে। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তারও মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে। তখন আমি তাঁকে বললাম, জনাব! আমি প্রথমে অমুকের সাহচর্যে ছিলাম। তারপর তিনি আমাকে অমুকের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। এরপর তিনি অমুকের নিকট যাওয়ার ওসিয়ত করেন। অতঃপর তিনি আমাকে অমুকের নিকট যাওয়ার ওসীয়ত করেন। সর্বশেষ ব্যক্তি আমাকে ওসীয়ত করেন। আপনার সান্নিধ্য অবলম্বন করতে। এখন আপনি আমাকে কার সাহচর্য অবলম্বনের ওসীয়ত করবেন এবং আমাকে কী আদেশ দেবেন? তিনি বললেন, বৎস! আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমার জানা মতে আমাদের পথের যাত্রী এমন একজন লোকও বেঁচে নেই, আমি তোমাকে যার নিকট যাওয়ার আদেশ করতে পারি। তবে এমন একজন নবীর আবির্ভাবকাল ঘনিয়ে এসেছে, যিনি দীনে ইবরাহীমসহ প্রেরিত হবেন। আরব ভূমিতে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। এবং খেজুর বীথি বেষ্টিত ভূমি হবে তাঁর হিজরত স্থল। তাঁর প্রকাশ্য কিছু লক্ষণ থাকবে! তিনি হাদিয়া গ্ৰহণ করবেন, সাদকা খাবেন না। তাঁর দুই কাঁধের মাঝে থাকবে নবুওতের মোহর। সম্ভব হলে সেই দেশে গিয়ে তুমি তাঁর সঙ্গে মিলিত হও।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, তারপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ও তার দাফন-কাফন সম্পন্ন হয়। আমি আরো কিছুকাল আমুরিয়ায় অবস্থান করি। তারপর আমি একটি বণিক কাফেলার সাক্ষাত পেয়ে তাদেরকে বললাম, তোমরা আমাকে আরব ভূমিতে নিয়ে যাও, বিনিময়ে আমি তোমাদেরকে আমার এই গাভী ও ছাগলগুলো দিয়ে দেব। তারা বলল, ঠিক আছে, চল। আমি তাদেরকে আমার গাভী আর ছাগলগুলো দিয়ে দেই। আর তারা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কিন্তু ওয়াদীল কুরায় পৌছে তারা আমার প্রতি জুলুম করে। আমাকে তারা এক ইহুদীর নিকট দাসরূপে বিক্রি করে দেয়। আমি তার নিকট থাকতে শুরু করি। এ জায়গায় খেজুর বৃক্ষ দেখে আমি আশান্বিত হলাম যে, আমার গুরু আমাকে যে নগরীর কথা বলেছেন, এটাই সম্ভবত সেই নগরী।

আমি আমার মনিবের নিকট থাকছি। এ সময়ে বনু কুরায়জা বংশীয় তার এক চাচাতো ভাই মদীনা থেকে তার নিকট আগমন করে আমার মনিবের নিকট থেকে সে আমাকে কিনে মদীনায় নিয়ে যায়। আল্লাহর কসম! মদীনাকে দেখামাত্র আমি বুঝে ফেললাম, এটাই সেই নগরী আমার গুরু আমাকে যার কথা বলেছিলেন। আমি মদীনায় অবস্থান করতে থাকি।

ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভার ঘটে গেছে। তিনি কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করেন। গোলামি জীবনের ব্যস্ততার কারণে তার কোনো আলোচনা আমি শুনতে পারছিলাম না। তারপর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একদিন আমি আমার মনিবের খেজুর গাছের কঁাদি কাটার কাজ করছিলাম। মনিব তখন নিচে উপবিষ্ট। এমন সময়ে তার এক চাচিতো ভাই এসে তার নিকট থমকে দাঁড়ায় এবং বলে, আল্লাহ বনু কায়লার অমঙ্গল করুন। তারা এখন কুবায় এমন এক ব্যক্তিকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়ে আছে, যিনি আজই মক্কা থেকে এসেছেন এবং তিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন। সালমান ফারসী (রা) বলেন, এ কথা শোনামাত্র আমার সমস্ত শরীরে কাপন ধরে যায়। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি গাছ থেকে মানিবের গায়ের ওপর পড়ে যাব। আমি খেজুর গাছ থেকে নিচে নেমে মনিবের চাচাতো ভাইকে বললাম, আপনি কী কী যেন বলছিলেন? সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমার কৌতুহলপূর্ণ প্রশ্ন শুনে মনিব আমার গালে কশে এক চড় বসিয়ে দেয় এবং বলে ও কী বলছে, তাতে তোর কী? যা, তুই তোর কাজ করগে। আমি বললাম, না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। মনে একটা কৌতুহল জাগল কি না। তাই।

তিনি বলেন, আমার নিকট কিছু সঞ্চিত সম্পদ ছিল। সন্ধ্যাবেলা আমি সেগুলো নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গেলাম। তিনি তখন কুবায়। নিকটে গিয়ে আমি তাঁকে বললাম, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি একজন পুণ্যবান ব্যক্তি। আপনার সঙ্গে যারা আছেন, তারা গরীব, অসহায়। এই জিনিসগুলো সাদকা দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি সঞ্চয় করেছিলাম। আমি দেখলাম যে, অন্যদের তুলনায় আপনারাই এর অধিক হকদার। এই বলে আমি জিনিসগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সঙ্গীদের বললেন, তোমরা খাও এবং নিজে হাত গুটিয়ে নিলেন, খেলেন না। আমি মনে মনে বললাম, এই পেলাম একটি।

তারপর আমি ফিরে গেলাম এবং আরো কিছু জিনিস সংগ্ৰহ করলাম। ততদিনে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় চলে গেছেন। আমি আবারও তাঁর নিকট গেলাম এবং বললাম, আমি লক্ষ্য করেছি যে, আপনি সাদকা খান না। তাই আপনার সম্মানার্থে এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া। সালমান ফারসী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নিজে কিছু খেলেন এবং সাহাবীদের খেতে আদেশ দেন। সাহাবীরাও তার সঙ্গে আহারে অংশ নেন। তিনি বলেন, তখন আমি মনে মনে বললাম, এই পেলাম দুটো।

তিনি বলেন, এরপর আরেকদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন বাকীউল গারকাদ গোরস্থানে জনৈক ব্যক্তির জানাযা উপলক্ষে সাহাবী পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে আছেন। গায়ে তাঁর দুটি চাদর। আমি তাকে সালাম দিয়ে তার পেছন দিকে গিয়ে আমার সঙ্গীর বর্ণনা মোতাবেক তার পিঠে মোহর আছে কিনা দেখতে লাগলাম। দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বুঝে ফেললেন যে, আমি কিছু একটা অনুসন্ধান করছি। ফলে তিনি নিজের পিঠ থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন। মোহরের প্রতি চোখ পড়া মাত্র আমি তা যে মোহরে নবুয়ত তা চিনে ফেললাম। দেখেই আমি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং তাকে চুমু খেতে খেতে কাঁদতে লাগলাম। দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন, এদিকে এস। পেছন থেকে ফিরে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সামনে আসলাম এবং আমি তাকে আমার কাহিনী শোনালাম, যেমন শোনালাম তোমাকে হে ইব্‌নে আব্বাস!! শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) মুগ্ধ হলেন এবং সাহাবীগণও তা শুনুন, তা তিনি চাইলেন।

তারপর সালমান গোলামির কাজে নিয়োয়িত থাকেন। এভাবে বদর গেল, উহুদ গোল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে সালমান (রা)-এর আর সাক্ষাত ঘটেনি। সালমান (রা) বলেন, এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন : সালমান! তুমি তোমার মনিবের সঙ্গে মুক্তিপণের ব্যাপারে কথা বল। ফলে আমি আমার মনিবের সঙ্গে তিনশত খেজুর গাছ এবং চল্লিশ উকিয়ার বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি করলাম। চুক্তি হলো— খেজুর গাছগুলোর চারা রোপণ করে ফলনশীল করে দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের বললেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের সাহায্য কর। খেজুর গাছের ব্যাপারে তারা আমাকে সাহায্য করেন। কেউ ত্রিশটি,

প্রত্যেকে আমাকে নিজ নিজ সামৰ্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেন। এভাবে আমার তিনশ চারার ব্যবস্থা হয়ে যায়। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বললেন, যাও হে সালমান! গর্ত কর গিয়ে। গর্ত করার কাজ শেষ হলে আমার নিকট এস; আমি নিজ হাতে গর্তে চারা রোপণ করে দেবো। হযরত সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমি গর্ত করলাম। আমার সঙ্গীরা একাজে আমাকে সহযোগিতা করেন। গর্ত করার কাজ শেষ হলে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে সংবাদ দিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) আমার সঙ্গে বাগানে আসেন। আমি তাঁকে একটি একটি করে চারা এগিয়ে দিলাম। আর তিনি নিজ হাতে তা গর্তে রোপণ করলেন। এভাবে সব কটি চারা রোপণের কাজ শেষ হয়। আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে সালমানের জীবন, তার একটি চারাও মরেনি। এভাবে আমি খেজুর গাছ রোপণের চুক্তি বাস্তবায়ন করলাম। বাকি থাকিল মাল। ইতিমধ্যে মুরগীর ডিমের ন্যায় এক টুকরো খনিজ সোনা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হস্তগত হয়। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, মুক্তিপণের চুক্তিকারী ফারসী লোকটি কোথায়? সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট ডেকে নেয়া হয়। নবী করীম (সা) বললেন : এটা নাও, এবং তোমার ঋণ পরিশোধ করা। আমি বললাম : এতে আর কী হবে? তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এর দ্বারা আল্লাহ তোমার মুক্তিপণ ও ঋণ আদায় করে দিবেন। আমি সোনার টুকরাটি হাতে নিয়ে ওজন করলাম। সালমানের জীবন যার হাতে, তার শপথ, সােনার টুকরাটির ওজন চল্লিশ উকিয়াই হয়েছে। আমি এর দ্বারা চুক্তি বাস্তবায়ন করলাম। সালমান আযাদী লাভ করলেন। এবার আমি স্বাধীন মানুষ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে খন্দকে অংশ নিলাম। এরপর কোন একটি যুদ্ধেও আমি অনুপস্থিত থাকিনি।

ইব্‌নে ইসহাক বৰ্ণনা করেন, সালমান (রা) বলেন, আমি যখন বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিয়ে আমার দায় শোধ হবে কী করে? তখন নবীজী (সা) জিনিসটি হাতে নিয়ে নিজের জিহবার ওপর উলট-পালট করলেন। তারপর বললেন : নাও, এটি দিয়েই সম্পূর্ণ দায় শোধ করা! আমি জিনিসটি হাতে নিলাম এবং তা দিয়েই আমি আমার চল্লিশ উকিয়ার দায় সম্পূর্ণ শোধ করলাম।

মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক আরো বলেন, সালমান (রা) আমাকে বলেছেন যে, তিনি যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবহিত করলেন যে, আমুরিয়ার লোকটি তাকে বলেছে যে, তুমি সিরিয়ার অমুক স্থানে যাও, সেখানে গভীর জঙ্গলে এক ব্যক্তি বাস করে এবং প্রতিবছর সে একবার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। রোগগ্ৰস্ত মানুষেরা তার কাছে এসে আর্জি পেশ করে। সে যার জন্য দোয়া করে, সেই আরোগ্য লাভ করে। তুমি তার নিকট যাও, তুমি যে দীনের অনুসন্ধান করছ, সে তোমাকে তার সন্ধান দেবে। সালমান (রা) বলেন, আমি রওয়ানা হলাম এবং তার নির্দেশনা মোতাবেক উক্ত স্থানে গিয়ে উপনীত হলাম। দেখলাম, জনতা সমবেত হয়ে তার আত্মপ্ৰকাশের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। সেই রাত্রে তার আত্মপ্রকাশ করার কথা। এক সময় তিনি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন। জনতা তাকে ঘিরে ধরে। যে রোগীর জন্য তিনি দোয়া করছেন, সেই আরোগ্য লাভ করছে। স্থানীয় জনতার ভিড়ের কারণে আমি তাকে একান্তে পেলাম না। এক সময়ে তিনি লোকালয় ত্যাগ করে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। আমি সেখানে গিয়ে তাকে ধরে বসি। তখন তার কাঁধ ছাড়া গোটা দেহই জঙ্গলে ঢুকে গেছে। আমি তাকে জাপটে ধরি। আমাকে দেখে আমার প্রতি মুখ ফিরিয়ে তিনি বললেন, কে তুমি? আমি বললাম, আল্লাহ আপনাকে রহম করুন! আমাকে আপনি সঠিক দীনে ইবরাহীমের সন্ধান দিন! তিনি বললেন, তুমি আমাকে এমন একটি বিষয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছ, যে বিষয়ে আজকাল মানুষ কিছু জানতে চায় না। তবে শোন, এই দীন নিয়ে যে নবীর আবির্ভাবের কথা, তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি হবেন হারমের অধিবাসীদের একজন। তুমি তার নিকট যেও, তিনিই তোমাকে দীনে ইবরাহীমের ওপর পরিচালিত করবেন।

এ কাহিনী শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) সালমান (রা)-কে বললেন : হে সালমানু! তুমি আমাকে যা বলেছি, যদি তা সত্য বলে থাক, তাহলে তুমি ঈসা ইব্‌নে মারিয়াম-এর সাক্ষাত লাভ করেছ। এ বর্ণনার একজন বর্ণনাকারী অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি, তা ছাড়াও বর্ণনার সূত্রে বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে। তুমি ঈসা (আ)-এর সাক্ষাত লাভ করেছ বলে উল্লেখিত উক্তিটি শুধু গরীব পর্যায়েরই নয়- মুনকার অর্থাৎ অগ্রহণযোগ্যও বটে। কেননা, হযরত ঈসা (আ)-এর ওফাত আর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত— মধ্যবর্তী শূন্যতার মেয়াদ ছিল কমপক্ষে চারশ বছর। করো কারো মতে সীের হিসেবে ছয়শ বছর। আর হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর আয়ু ছিল বড়জোর সাড়ে তিনশ বছর। শুধু তাই নয়— আব্বাস ইব্‌নে ইয়াখীদ আল-বুহরানী তো এ মর্মে মাশায়িখদের মতৈক্য উল্লেখ করেছেন যে, সালমান ফারসী (রা) বেঁচেছিলেন মাত্র দুইশ পঞ্চাশ বছর। তিনশ পঞ্চাশ বছরের অর্ধেক হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য বিদ্যমান।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, তুমি ঈসা ইব্‌নে মারিয়ামের ওসীয়ত প্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত করেছ। এটা সঠিক হওয়া অসম্ভব নয়।

সুহায়লী বলেন, অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীর নাম হচ্ছে হাসান ইব্‌ন আমারা। তিনি একজন দুর্বল রাবী। বর্ণনাটি বিশুদ্ধ হলে তা মুনকার হবে না। কেননা ইব্‌ন জরীর উল্লেখ করেছেন যে, ঈসা (আ)-কে আসমানে উঠানোর পর তিনি পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর মা এবং অন্য এক স্ত্রীলোককে ক্রুশবিদ্ধ ব্যক্তির লাশের নিকট কান্নাকাটি করছেন বলে দেখতে পান। তখন তিনি নিহত হননি বলে তাদের জানিয়ে দেন। এরপর হওয়ারীগণকে বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করেন। সুহায়লী বলেন, একবার তার অবতরণ যখন সম্ভব হয়েছিল তখন একাধিকবার অবতরণ করাও সম্ভবপর। শেষবার তিনি প্রকাশ্যে অবতরণ করে ক্রুশ ধ্বংস করবেন, শূকর নিধন করবেন এবং তখন বনী জুযামের এক মহিলাকে বিবাহ করবেন। যখন তার ইনতিকাল হবে তখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর রওযা শরীফের হুজরায় দাফন করা হবে।

ইমাম বায়হাকী দালায়িলুন নুবুওয়াত গ্রন্থে অপর এক সূত্রে সালমান ফারসী (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে যে, ইয়ামীদ ইব্‌নে সাওহান বলেন যে, তিনি শুনেছেন, সালমান ফারসী (রা) নিজে তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রামাহুরমুয অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর এক বড় ভাই ছিল অতিশয় বিত্তশালী। সালমান (রা) ছিলেন দরিদ্র। তিনি বিত্তশালী ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকতেন। গ্রাম প্রধানের ছেলে ছিল তাঁর সঙ্গী। সে তার সঙ্গে তাদের এক শিক্ষা গুরুর নিকট যাওয়া-আসা করত। ঐ ছেলেটি গুহায় অবস্থানকারী কতিপয় খৃস্টানের নিকটও যেত। সালমান (রা) একদিন আবদার করলেন, তিনিও তাদের সঙ্গে গুহায় যাবেন। জবাবে ছেলেটি তাকে বলল, তোমার বয়স কম। আমার আশংকা হয়, তুমি তাদের তথ্য ফাঁস করে দিবে। আর তার ফলে আমার আব্বা তাদেরকে হত্যা করে ফেলবেন। কিন্তু সালমান ছিলেন নাছোড় বান্দা। তিনি নিশ্চয়তা দিলেন যে, তার কারণে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। অবশেষে সালমান (রা) তার সঙ্গে সেখানে গেলেন। দেখলেন, সেখানে ছয় কি সাতজন লোক, ইবাদত করতে করতে তাদের আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তারা দিনে রোযা রাখেন। আর সারারাত জেগে ইবাদত করেন। তারা লতাপাতা আর যা পান। তাই খান। ছেলেটি তাকে তাদের পরিচয় দিয়ে বলল, এরা পূর্ববর্তী রাসূলগণের প্রতি ঈমান রাখেন এবং বিশ্বাস করেন যে, ঈসা আল্লাহর বান্দা, তার রাসূল এবং তাঁর এক দাসীর পুত্র। বিভিন্ন মুজিযা দ্বারা তিনি তাকে সাহায্য করেছেন। গুহার লোকেরা তাকে বলল, শোন বালক! নিশ্চয় তোমার একজন রব আছেন। মৃত্যুর পর তুমি পুনরায় জীবিত হবে। তোমার সামনে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নাম। আর এই যারা আগুন পূজা করে, তারা কুফরের ধারক ও বিভ্রান্ত। তাদের কর্মকাণ্ডে আল্লাহ সন্তুষ্ট নন। তারা আল্লাহর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তারপর থেকে সালমান (রা) ঐ ছেলের সঙ্গে তাদের কাছে যেতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে তাদের সঙ্গে থেকে যান। কিন্তু কদিন যেতে না যেতে সে দেশের রাজা তাদেরকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। সে রাজা ছিলেন সেই বালকের পিতা, যার সঙ্গ ধরে সালমান (রা) সেখানে আসা-যাওয়া করতেন। রাজা তার পুত্রকে নিজের কাছে আটকে রাখেন। সালমান (রা) তার বড় ভাইয়ের নিকট তাদের দীনের দাওয়াত পেশ করেন। জবাবে সে বলে, আমি জীবিকা উপার্জনের কাজে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সালমান তখন সে সব ইবাদতকারী সঙ্গীদের সাথে রওয়ানা হলেন। এক সময় তারা মুসেলের গির্জায় গিয়ে প্ৰবেশ করে। গির্জার লোকেরা তাদের সালাম করে।

সালমান (রা) বলেন, এরপর তারা আমাকে ওখানে ফেলে যেতে চান। কিন্তু আমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে অস্বীকার করি। আমরা রওয়ানা হলাম এবং কয়েকটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় গিয়ে উপনীত হলাম। সেখানকার পাদ্রীগণ আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন এবং আমাদেরকে সালাম করেন। আমাদের নিকট সমবেত হয়ে তারা কুশল বিনিময় করেন। তাদের অনুপস্থিতির কারণ এবং আমার পরিচয় জানতে চায়। সঙ্গীরা আমার পরিচয় দিতে গিয়ে আমার প্রশংসা করেন। তখন সেখানে অপর এক মহান ব্যক্তির আগমন ঘটে। তিনি উপস্থিত সকলের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করেন। রাসূলগণ এবং তাদের মিশনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি হযরত ঈসা (আ)-এর কথা আলোচনা করেন এবং বলেন যে, ঈসা (আ) ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। লোকটি উপস্থিত জনতাকে কল্যাণকর কাজ করার আদেশ এবং অন্যায় কাজ পরিহার করার উপদেশ দিয়ে তার ভাষণ

সমাপ্ত করেন।

বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তারা বিদায় নিতে উদ্যত হলে সালমান ফারসী (রা) ভাষণদানকারী লোকটিকে অনুসরণ করেন এবং তার সঙ্গ লাভ করেন। সালমান ফারসী (রা) বলেন, এই লোকটি দিনে রোযা রাখতেন আর সারারাত জেগে ইবাদত করতেন। সপ্তাহের প্রতিটি দিন তার একইভাবে অতিবাহিত হতো। সময়ে সময়ে জনতার মাঝে গিয়ে ওয়াজ করতেন ও ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতেন। এভাবে দীর্ঘদিন কেটে যায়। তারপর এক সময়ে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জিয়ারত করার ইচ্ছা করেন; সালমান ফারসী (রা) তার সঙ্গী হন। সালমান ফারসী (রা) বলেন, চলার পথে খানিক পর পর তিনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করতেন এবং আমার দিকে ফিরে আমাকে নসীহত করতেন। তিনি বলতেন যে, আমার একজন রব আছেন, আমার সামনে জান্নাত-জাহান্নাম ও হিসাব-নিকাশ রয়েছে। তা ছাড়া প্ৰতি শনিবার তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে যেসব উপদেশ দিতেন, আমাকেও সেসব বলতে লাগলেন। তিনি আমাকে যা বললেন তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হলো— হে সালমান! আল্লাহ অনতিৰিলম্বে একজন রাসূল প্রেরণ করবেন, যার নাম হবে আহমদ। আরবের কোন এক নিম্ন অঞ্চল থেকে তার আবির্ভাব ঘটবে। তিনি হাদিয়া গ্ৰহণ করবেন, সাদকা খাবেন না। তার দুই কাঁধের মাঝে নবুওতের মোহর থাকবে। এটাই তার আবির্ভাবের সময়, আর বেশি দেরি নেই। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। তাঁকে পেয়ে যেতে পারব বলে মনে হয় না। তুমি যদি তাঁকে পাও, তাহলে তাকে মেনে নেবে এবং তাঁর অনুসরণ করবে।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, যদি তিনি আমাকে আপনার দীন, আপনার নীতি-আদৰ্শ ত্যাগ করতে বলেন, তখন আমি কি করব? জবাবে তিনি বললেন, যদি তিনি তেমন কোন আদেশ করেন, তাহলে মনে রাখবে তিনি যা নিয়ে আসবেন, তাই সত্য এবং তিনি যা বলবেন, তাতেই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি।

সালমান ফারসী (রা) তারপর তাদের দুজনের বায়তুল মুকাদ্দাস গমন এবং তার সঙ্গী সেখানে কোথায় কোথায় নামায আদায় করলেন তার কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি আরও বর্ণনা করেন যে, বায়তুল মুকাদাস গিয়ে তাঁর সঙ্গী এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমানোর আগে তাকে বলে দেন যে, ছায়া যখন অমুক স্থানে পৌছবে তখন যেন তিনি তাকে জাগিয়ে দেন। কিন্তু সালমান ফারসী (রা) তাঁর বিশ্রামে ব্যাঘাত না ঘটানোর জন্য আরও অনেক পরে তাকে ঘুম থেকে ওঠান। জেগে ওঠে তিনি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেন এবং সালমান (রা)-কে তিরস্কার করেন। তখন এক পঙ্গু ব্যক্তি তার কাছে যাঙ্কু করে বলে, হে আল্লাহর বান্দা! আপনি এখানে আসার পর আপনার কাছে কিছু চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে কিছু দেননি, এখন আবার আপনার কাছে যাঙ্কা করছি। তিনি এদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না, তখন পঙ্গু লোকটির হাত ধরে বললেন, উঠে দাঁড়াও আল্লাহর নাম নিয়ে। সে তখন সম্পূর্ণ সুস্থ রূপে উঠে দাঁড়ালো যেন সে দড়ির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়েছে।

তারপর তাঁরা দুজন বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বের হন। লোকটি তখন আমাকে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার সামান-পত্ৰ আমার মাথায় তুলে দাও। আমি আমার পরিজনের নিকট চলে যাই এবং তাদেরকে সুসংবাদ প্ৰদান করি। আমি তাই করলাম! হঠাৎ করে আমার সঙ্গী কোন দিকে যেন উধাও হয়ে গেলেন, আমি টেরই পেলাম না। আমি সম্মুখে এগিয়ে গেলাম এবং তাকে খোজ করতে লাগলাম। একদল লোককে জিজ্ঞেস করলাম; তারা বলল, সামনে দেখ। আমি আরও সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখা হলো আরবের বনু কালবের একটি কাফেলার সাথে। তাদেরকেও জিজ্ঞেস করলাম। তারা আমার ভাষা শুনে তাদের একজন উট থামিয়ে আমাকে তার পিছনে চড়িয়ে নেয়। তাদের দেশে নিয়ে এসে তারা আমাকে বিক্রি করে ফেলে। এক আনসারী মহিলা আমাকে কিনে নিয়ে তার একটি বাগান রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত করে। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় আগমন করেন। তারপর সােলমান ফারসী (রা) তার সঙ্গীর বক্তব্য যাচাই করে দেখার উদ্দেশ্যে হাদিয়া ও সাদকা নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গমন করার কথা উল্লেখ করেন। সে সময়ে তিনি মোহরে নবুওত দেখারও চেষ্টা করেন। সঙ্গীর বর্ণনা মোতাবেক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুওত দেখে তৎক্ষণাৎ তিনি ঈমান আনেন এবং নিজের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনান। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদেশে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) তাকে তাঁর মহিলা মনিবের নিকট থেকে কিনে নিয়ে আযাদ করে দেন।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, তারপর একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে খৃস্টধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেন : তাদের মধ্যে কোন মঙ্গল নেই।

সালমান ফারসী (রা) বলেন, এতে আমি এতদিন যাদের সাহচর্যে ছিলাম বিশেষত বায়তুল

মুকাদাসে যে সাধু লোকটি আমার সঙ্গে ছিলেন তাদের ব্যাপারে আমার মন ভারী হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলা তার রাসূলের ওপর নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেন :

অবশ্য মুমিনদের প্রতি শক্রিতায় মানুষের মধ্যে ইহুদী ও মুশরিকদেরকেই তুমি সর্বাধিক উগ্ৰ দেখবে এবং যারা বলে আমরা খৃস্টান মানুষের মধ্যে তাদেরকেই তুমি মুমিনদের নিকটতর বন্ধুরূপে দেখবে। কারণ, তাদের মধ্যে অনেক পণ্ডিত ও সংসারবিরাগী আছে, আর তারা অহংকারও করে না। (৫ মায়িদা : ৮২)

এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ডেকে পাঠান। আমি ভীত মনে হাজির হয়ে তার সামনে বসলাম। তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ে

ذالك بأن منهم قسيسيين ورهبانا وأنهم لايستكبرون . ऊिब्ल७शाऊ वष्ट्राब्लन् उठांद्मश्र दळव्लन्?

সালমান! তুমি যাদের সাহচর্যে ছিলে তারা এবং তোমার সেই সঙ্গী নাসারা ছিল না। তারা ছিল মুসলিম।

আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে সত্তা আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার শপথ! আমার সঙ্গী লোকটি আমাকে আপনার আনুগত্য করার আদেশ করেছিলেন। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, যদি তিনি আমাকে আপনার দীন ত্যাগ করতে বলেন তাহলে? জবাবে তিনি বলেছিলেন— হ্যাঁ, তাহলে তুমি আমার দীন বর্জন করে তাকেই অনুসরণ করবে। কারণ তিনি যা আদেশ করবেন। সত্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি তারই মধ্যে নিহিত।

এই বর্ণনায় বহু বিষয় গরীব পর্যায়ের রয়েছে। তাছাড়া এটা মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাকের বর্ণনার সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক। ইব্‌ন ইসহাকের বর্ণনার সূত্র অধিক নির্ভরযোগ্য এবং বুখারীর বর্ণনার সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। বুখারীর এক সূত্ৰে সালমান ফারসী (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি পর্যায়ক্রমে তেরজন গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এক গুরু তাকে অপর গুরুর নিকট প্রেরণ করেছিলেন।

সুহায়লীর মতে তিনি ত্ৰিশজন মনিবের হাত বদল হয়েছিলেন। এক মনিব তাকে অপর মনিবের হাতে তুলে দেয়। হাফিজ আবু নু আয়মের দালায়িল গ্রন্থের এক বর্ণনায় আছে যে, সালমান ফারসী (রা) যে মহিলা মনিবের সঙ্গে মুকাতাবা (মুক্তিপণ চুক্তি) করেছিলেন, তার নাম ছিল হালবাসাহ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *