৩৭. রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ

টুক্ মীর-র জিগর-সোখতহ্ কী জ খবর লে।
কেয়া আর ভরোসা হ্যায় চিরাগ-এ সহরীকা।
(পোড়া হৃদয় মীরের একটু তাড়াতাড়ি খবর নিও,
হে বন্ধু, রাত্রী শেষের প্রদীপ আর কতক্ষণ।)

আপনি তো জানেন, মান্টোভাই, আমি যখন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলুম, তখন নাটকের শেষ দৃশ্যের অভিনয় চলছে। শুধু খোদা কখন যবনিকা ফেলবেন, তারই অপেক্ষা। কিলা মুবারকে দেওয়ান-ই-খাসের দেওয়ালে জাঁহাপনা শাহজাহান আমির খসরুর কবিতার দুটো পংক্তি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, অগর ফিরদৌসে বররুইয়ে জমিন অস্ত, হামিন অস্ত এ হামিন অস্ত এ হামিন অস্ত। প্রথিবীতে স্বর্গ যদি থাকে, তা হলে তা এখানে। আমি যখন জাঁহাপনা বাহাদুর শাহের দরবারে গিয়ে পৌঁছলুম তখন সেই স্বর্গ নরক হয়ে গেছে। ১৮৩৭-এ বাহাদুর শাহ সিংহাসনে বসলেন, তখন তার বয়স বাষট্টি। সাম্রাজ্য বলতে তো আর কিছুই নেই। ইংরেজরা একে একে সব গ্রাস করেছে। কেল্লার ভিতরে আর কাছাকাছি দু-একটা জায়গায় যেটুকু নবাবি দেখানো। আয় বলতে ইংরেজের দেওয়া ভাতা আর যমুনার তীরের কয়েকটা অঞ্চল থেকে পাওয়া রাজস্ব। আর কেল্লায় কত লোক থাকত, জানেন? দুহাজারের ওপর। এদের বেশির ভাগই অবৈধ সন্তান। ভাবতে পারবেন না মান্টোভাই, এই সব সুলাতিন পোকামাকড়ের মতো বেঁচে ছিল। বাহাদুর শাহ আসলে পোকামাকড়দের বাদশা হয়েছিলেন।

বাদশা হয়ে তিনি আবুল মুজফফর সিরাজুদ্দিন মহম্মদ বাহাদুর শাহ বাদশা গাজী নাম নিলেন। আমার হাসি পেত। গাজি? গাজি মানে জানেন তো? পবিত্র যোদ্ধা। আরে যুদ্ধটা তিনি করলেন কোথায়? আর যুদ্ধ করার মতো ক্ষমতাও তো তার ছিল না। সে জন্য যে সাহস, যে আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন বাদশার তা ছিল না। সিপাহি বিদ্রোহের সময় তো তাঁকে পুতুল হিসেবে নাচানো হয়েছিল। বেগম জিনত মহল আর খোজা মেহবুব আলি খানের হাতের পুতুল হয়েই বেঁচেছিলেন তিনি। মেহবুব আলি যা বলত, বাদশা তা-ই করতেন। আর মেহবুব আলিকে চালনা করতেন বেগম জিনত মহল। অবাক হবেন না, ভাইজানেরা। মুঘল সম্রাটদের হারেমের নজরদারি করত খোজারা। সাম্রাজ্য যখন ধ্বংসের পথে, হারেমের খোজারা এতটাই শক্তিশালী। হয়ে উঠেছিল যে বাদশা খোজা মেহবুবের কথা শুনেই চলতেন। ভেবে দেখুন মান্টোভাই, খোজারা যখন প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে, সাম্রাজ্যের ধ্বংস তখন অনিবার্য।

আর আমাদের বাদশা? তিনিও তো খোজাই ছিলেন, হ্যাঁ, মান্টোভাই, মানসিক ভাবে খোজা। কোনও যুদ্ধ বিগ্রহ করতে হয় নি তাঁকে। পূর্বপুরুষদের পয়সায় বসে বসে খেয়েছেন, নবাবি চাল দেখিয়েছেন, আর ফালতু কিছু কবিতা লিখে গেছেন। তার আইনি বিবি চারজন; বেগম আশরাফ মহল, বেগম আখতার মহল, বেগম জিনত মহল, বেগম তাজমহল। এছাড়াও কত যে ক্রীতদাসী আর রক্ষিতা। চুয়ান্নজন সন্তান হয়েছিল তাঁর, ভাবতে পারেন? বাইশটি ছেলে আর বত্রিশজন মেয়ে। এর নাম বাদশাহী জীবন, মান্টোভাই।

বাদশা নিজেও জানতেন, তৈমুরের সাম্রাজ্য অস্তাচলের পথে চলেছে। তাই কী করবেন, ভেবে উঠতে পারতেন না। রোজ দরবারে এসে বসতেন। কেন? তিনি নিজেই জানতেন না। কী হবে দরবার বসিয়ে? কিছুই তো তার হাতে নেই। অন্য সকলের সঙ্গে আমাকেও রোজ হাজিরা দিতে হত। জাঁহাপনা কোন গজল লিখলে সংশোধন করে দেওয়াই আমার কাজ। দরবারে যে যার মতো গুলতানি করত। বাদশা হয়ত হঠাৎ একটা শের বললেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে কেয়া বাৎ, কেয়া বাৎ, মারহাব্বা, মারহাব্বা। একেক সময় বাদশা ঘুমিয়ে পড়তেন। আমরা সবাই অপেক্ষা করে থাকতুম, কখন তার ঘুম ভাঙবে, কখন তিনি আমাদের ছুটি দেবেন।

একদিন হঠাৎ বললেন, কাল সকালে সালিমগড়ে চলে আসুন উস্তাদজি।

-জি হুজুর, কিন্তু কেন?

-পতঙ্গ বাজি হবে। যমুনার তীরে পতঙ্গবাজীর মজাই আলাদা।

-আপনি ঘুড়ি ওড়াবেন?

-অনেক দিন ওড়াই না তাই সাধ হল। পরদিন সকালে সালিমগড়ে হাজিরা দিতে হল। দুপুর পর্যন্ত বাদসার পতঙ্গবাজি দেখে বাড়িতে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে আবার যেতে হল। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাদশার ঘুড়ি ওড়ানো দেখে যেতে হবে। ঘুড়ি ওড়ানো শেষ করে বাদশার এবার অন্য আবদার। পতঙ্গবাজি নিয়ে একটা শের তার জন্য লিখে দিতে হবে। তক্ষুনি মুখে মুখে বলে দিলুম। বাদশা খুশ আর আমি একটা গাধার মতো ধুকতে ধুকতে খোঁয়াড়ে ফিরে এলুম। মান্টোভাই, আমি দিনে দিনে বুঝেছি, কবির জীবন বলে আসলে কিছু হয় না, আমরা সবাই চাকরবাকরদের মতোই বেঁচে থাকি। কবি কুর্তা -পায়জামা পরে চুলে টেরি কাটে, দাড়িতে মেহেন্দি লাগায়, আতরের খুশবু জড়িয়ে নেয় শরীরে, তবু সব কিছু পেরিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ঘামের গন্ধ-ক্রীতদাসের নিঃশ্বাস। সবাই অবশ্য তা বুঝতে পারে না। ক্ষমতার সঙ্গে একটু গা ঘষাঘষি করে নিজেকেও ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করে। আমি বলি, ওহে কবি, ক্ষমতার সতরঞ্চে তুমি একটা বোড়ে মাত্র।

তাই মজা করো, হ্যাঁ, মান্টোভাই, আপনি একমাত্র যা পারেন তা ক্ষমতাকে নিয়ে মজা করা। সব ক্ষমতাকে শুধু মজা দিয়ে হাস্যকর করে তুলতে হবে। আপনি যদি ভাবেন, এক ক্ষমতার থেকে অন্য ক্ষমতার কাছে গিয়ে আপনি সম্মান পাবেন, তা শুধুই মরিচিকা দেখা। ক্ষমতা শুধু আপনাকে ব্যবহার করবে, প্রয়োজন ফুরোলে লাথি মেরে নর্দমায় ফেলে দেবে। তাই কবিকে তার প্রতিভার কাছে বিশেস্ত থাকতে হবে, হয়তো কোনও একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয় মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের ক্ষেতে বুননের জন্য। তিনি প্রকৃতির সান্তনার ভিতরে চলে যাবেন-শহরে বন্দরে ঘুরবেন—জনতার স্রোতের ভিতর ফিরবেন-নিরালম্ব অসঙ্গতিকে যেখানে কল্পনা-মনীষার প্রতিক্রিয়া নিয়ে আঘাত করা দরকার, নতুন করে সৃষ্টি করবার জন্য সেই চেষ্টা করবেন; আবার চলে যাবেন, হয়তো উন্মুখ পঙ্গুদের সঙ্গে করে নিয়ে, প্রকৃতির সান্তনার ভিতর; সেই কোন আদিম জননীর কাছে যেন, নির্জন রৌদ্রে ও গাঢ় নীলিমার নিস্তব্ধ কোনও অদিতির কাছে।

একজন শাশক যখন পঙ্গু হয়ে যায় বা রাজ্যশাসনের যোগ্যতা যখন তার থাকে না, তখন সে কী করে জানেন, মান্টোভাই? সে তখন বিরক্তিকর কবিতা লেখে, মুশায়েরার আয়োজন করে, ঘুড়ি ওড়ায়, হাতির পিঠে চেপে শোভাযাত্রা বার করে। আমাদের বাদশাহেরও এছাড়া আর কিছু করার ছিল না। মোসায়েবের দল তাঁকে ঘিরে থাকত। বাদশাহের মুখ থেকে কোন কথা বেরোলেই তারা গদগদ হয়ে হায়! হায়! করে উঠত। আমি চুপচাপ বসে দেখতুম, ইতিহাসের কিতাবটাকে উইপোকারা কিভাবে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। ইতিহাস বলতে কি সত্যিই কিছু আর থাকে? পথের ধুলায় ছড়িয়ে থাকে কিছু কিস্সা।

কাল্লু একদিন কোথা থেকে ধরে নিয়ে এল এক দস্তানগোকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চেপে ধরে বললুম, মিঞা, আজ আমার সঙ্গে দরবারে চলো। -দরবার? কোন দরবার?

-বাদশার দরবার।

-মাফ করুন হুজুর। আমি কি দরবারে যাওয়ার লোক?

-আমি তো তোমাকে নিয়ে যাব।

-দরবারে আমার কী কাজ, হুজুর?

-বাদশাকে দস্তান শোনাবে।

-জাঁহাপনা দস্তান শোনেন?

-কেন শুনবেন না? বাদশার জীবনটাই তো আজিব দস্তান।

জাঁহাপনা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ আবার কাকে ধরে নিয়ে এলেন উস্তাদজি?

-দস্তান শুনতে ভালবাসেন তো জাঁহাপনা?

-জরুর। কার বলা দস্তান আপনি শোনাবেন, মিঞা?

-মওলা রুমির হুজুর।

-বহুৎ খুব।

বাদশা গড়গড়ায় মৌজ করে টান দিতে শুরু করলেন।

হুজুর, কিস্সাটা এক ইঁদুর আর উটের।

-মানুষ নেই?

-না, হুজুর। তবে ইঁদুর আর উটও তো একরকম মানুষ হুজুর।

-মতলব?

-হুজুর, কোনও মানুষের মধ্যে ইঁদুর লুকিয়ে থাকে, আবার কারও মধ্যে উট।

-শাবাস। আপনি কিস্সা শুরু করুন।

-হুজুর, এমন ইঁদুর খুব একটা দেখা যায় না। নিজেকে মনে করত একেবারে শাহেনশা।

-শাহেনশা? জাঁহাপনা হাসতে লাগলেন। ইঁদুরও নিজেকে শাহেনশা মনে করে?

-কেন করবে না বলুন? অন্য ইঁদুররা যে-কাজ করার কথা ভাবতেও পারত না, এই ইঁদুরটা তা বুক ফুলিয়ে করত।

জাঁহাপনা হা-হা করে হেসে উঠলেন। ইঁদুরেরও বুক ফোলে, মিঞা?

হুজুর, আশমান থেকে যদি দেখেন, আমরাও তো এক একটা ইঁদুর। আমাদের সিনা ফোলে না?

-বাজে কথা বাদ দাও। কিস্সাটা বলো শুনি।

-ওইটুকুন ইঁদুর হলে কী হবে, মনে মনে সে নিজেকে সিংহ ভাবত, হুজুর। বড় বড় বিপদের মুখে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারপর বুদ্ধির জোরে ঠিক বেরিয়ে আসত। অন্য ইঁদুরেরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। একদিন রাতে মরুভূমির পথে বাড়িতে ফিরছিল ইঁদুরটা। মরুভূমিতে একটা উট ঘুমিয়ে ছিল হুজুর। উটের গলায় বাঁধা দড়িতে জড়িয়ে আটকে গেল সে। তবে ইঁদুরটা তো খুব বুদ্ধিমান। নানা কসরত করে দড়ির ফাঁস থেকে বেরিয়ে এল।

-তারপর?

-অতি বুদ্ধিমানের মাথায় বদ বুদ্ধি খেলে হুজুর। দড়ির শেষ প্রান্ত ধরে ইঁদুরটা টানতে লাগল। উটের গেল ঘুম ভেঙে। ইঁদুরের পিছন পিছন সে এগিয়ে চলল। ইঁদুর তখন মনে মনে ভাবছে, একটা উট আমার পিছনে পিছনে আসছে। সবাই দেখে তাজ্জব হয়ে যাবে। যেতে যেতে পথে পড়ল একটা নদী। তার স্রোত সবসময় ফুসছে। ইঁদুর নদীর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে, কীভাবে পার হব এই অকূলবারিধি?

-তা কী করল সে? জাঁহাপনা জিজ্ঞেস করলেন।

-হুজুর, সব বুদ্ধিরই একটা শেষ আছে। ইঁদুর তো ভেবেই চলেছে। তখন উট বলল, তোমার মতো বুদ্ধিমান ইঁদুর তো নেই। দাঁড়িয়ে আছো কেন ভায়া? নদী পেরিয়ে আমাকে ওপারে নিয়ে চলো। উঁদুর বলল, বাজে কথা বোলো না। এ নদী বড় ভয়ঙ্কর। নামলেই আমরা ডুবে যাব। উট তখন নদীতে গিয়ে নামল ইঁদুরকে ডেকে বলল, যত গভীর ভাবছ, তা কিন্তু নয়।

দেখো না, জল আমার হাঁটু পর্যন্ত উঠেছে। ভয় পাওয়ার কী আছে?

-ঠিকই তো। জাঁহাপনা গড়গড়া টানতে টানতে বললেন।

-ইঁদুর বলল, আচ্ছা বুদ্ধ তো তুমি। নদীর জল তোমার হাঁটু অব্দি, কিন্তু আমি তো সেখানে ডুবে যাব।

-কেন? তোমার মত বুদ্ধিমান কজন আছে? বুদ্ধি আর সাহসই তো তোমাকে বাঁচিয়ে দেবে। জলে নেমে পড়ো। আমি তোমার পিছন পিছন যাবো।

-তারপর?

-ইঁদুর ভাবল, এই হাদা উটের কাছে সে ছোট হবে? মুখে দড়ি নিয়ে সে নদীতে নামল। ভয়ঙ্কর স্রোতের ঝাপটা খেতে খেতে প্রায় আধমরা হয়ে সে ওপারে গিয়ে পৌঁছল। উটের পায়ের কাছে সে তখন কাতরাচ্ছে। উট বলল, ইঁদুরভায়া নিজেকে সিংহ মনে কোরো না। তোমার চেয়ে। যারা বেশী দূর দেখতে পায়, তাদেরও বিশ্বাস কোরো। অতিবুদ্ধি একদিন তোমাকে ডোবাবে। এত দীর্ঘ পথ যাওয়া আমার কাছে সহজ। আমার কুঁজের ওপর উঠে বোসো, আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।

-তারপর?

-হুজুর, এরপর মওলা রুমি আর কিছু বলেননি।

-উস্তাদজি এই কিস্সার মানে কী? জাঁহাপনা আমার দিকে তাকালেন।

আমি অনেকক্ষণ থেকেই মনে মনে হাসছিলুম। মওলা তো কিস্সাটা বলেছেন মুর্শিদের ওপর বিশ্বাস রাখার কথা বোঝাতে। কিন্তু আর একটা অর্থও তো আমি দেখতে পাচ্ছিলুম। ইঁদুররা কখনও কখনও কীভাবে শাহেনশা হয়ে উঠতে চায়। আমি বললুম, কিস্যা তো আমরা শুনি মজা পাবার জন্য জাঁহাপনা। আপনি মজা পেয়েছেন তো হুজুর?

কীভাবে কত মজা লুটবেন, তার বাইরে আর কিছুই ভাবতেন না জাঁহাপনা। প্রায়ই চলে যেতেন মেহরৌলির জাফর মহলে। মহলটা বানিয়েছিলেন তার বাবা। বাদশা সেই মহলকে নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলেন। শিকার। মৌজমস্তি, আনন্দের ফোয়ারা-এরই জন্য জাফর মহল। অথচ ১৮৫৪-তেই ইংরেজরা জানিয়ে দিয়েছে বাদশার মৃত্যুর পর আর কেউ কেল্লায় থাকতে পারবে না; কুতুব মিনারের কাছে কোনও মহলে চলে যেতে হবে তাদের। বাদশা দেখেও দেখছিলেন না, তৈমুরের বংশধরদের কীভাবে মুছে দিতে চাইছে ব্রিটিশ। তখনও কেল্লার ভিতর মাঝে মাঝে গজলের আসর বসত, মাঝে মাঝে আমি যেতুম, আর অন্তঃসারশূণ্য মুশায়েরায় বসে বুঝতে পারতুম, খোদা যে কোনও মুহূর্তে এই নওটঙ্কি মুছে দেবেন। মীর সাবের একটা শের বারবার মনে পড়ত

শহর-এ দিল এক মুদ্দৎ হুয়া বসা গমোঁমেঁ
আখির উজাড় দেনা উসকো করার পায়া।
(দুঃখের মধ্যেই এক যুগ আগে এই হৃদয়নগরীর পত্তন হয়েছিল
শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হল, একেও উজাড় করে দেওয়া হবে।)

কয়েকটা দিন ভালোভাবে কাটছিল, ভাইজানেরা; কিন্তু খোদা তো আমাকে রহম করবেন না। ১৮৫৬-তে আমার আশমানে আবার কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। বাদশার উত্তরাধিকারী, আমার শার্গিদ ফকরউদ্দিনের মৃত্যু হল। আর ইংরেজরা ঘোষণা করল, বাদশার পরে যিনি তন্তে। বসবেন, তাঁকে আর বাদশা বলা হবে না, তিনি হবেন শুধু শাহজাদা। বুঝতে পারলুম, শুধু তৈমুরের বংশ নয়, আমার মতো সভাকবিদের দিনও শেষ হয়ে আসছে। এর চেয়েও বড় দুর্ভাগ্য, ওই বছরেই লখনউতে নবাবি আমল শেষ হয়ে গেল। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর কাছ থেকে বছরে পাঁচশো টাকা ভাতা পেতুম আমি, সে তো জানেনই, মান্টোভাই। বন্ধ হয়ে গেল। সেই ভাতা। লখনউ ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে হল নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে। নবাব যদি কাউকে বলতে হয়, মান্টোভাই, তবে তিনি ওয়াজিদ আলি শাহ। তার তখল্লুস ছিল কায়সার। শুধু গজলই লেখেননি, কত ঠুংরিও যে লিখেছেন। নিজে ভাল গানও গাইতে পারতেন। আর একটা খুব সুন্দর নাম নিয়েছিলেন নবাব। আখতারপিয়া। ওই নামেও অনেক গজল, ঠুংরি লিখেছেন। ভৈরবী রাগে বাঁধা তাঁর ঠুংরি বাবুল মোরা নৈহর ছুটো হি যায় শুনলে তো চোখের জল ধরে রাখা যায় না। নির্বাসনের যন্ত্রনায় নীল হয়ে আছে টুংরির প্রতিটি শব্দ। লখনউ ছেড়ে যাওয়ার সময় লিখেছিলেন :

দরূ ব দীওয়ার পর হস্ৰৎ সে নজর করতে হ্যাঁয়
রুখসৎ অ্যায় অহল্-এ বতন্‌, হম তো সফর করতে শ্যাঁয়।

(দরজা আর দেওয়ালগুলোর দিকে অতৃপ্তনয়নে দেখছি
বিদায় হে দেশবাসী, আমি যে পথে চলছি।)

আমি তো একটা রাস্তার কুকুর। বাদশাহি আমলের শোকে ডুবে থাকলে তো আমার চলবে না। টাকা দরকার, নইলে খাব কী? রামপুরের নবাব ইউসুফ আলিকে চিঠি লিখলুম। একসময় তিনি আমার কাছে ফারসি শিখেছিলেন, কবিতা লেখেন, আমার গজলের ভক্ত। তিনি জানালেন, আমাকে তার উস্তাদ হিসেবে বরণ করতে চান তিনি। আমি তো এইটুকুই চাইছিলাম। রামপুরের নবাবের উস্তাদ হওয়া মানেই কিছু টাকা পাওয়া। মান্টোভাই, আমার তখন শুধু খেয়ে-পড়ে থাকার জন্য টাকার দরকার। কবিতার কথা আমি আর কিছু ভাবতুম না; সেসব দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে।

শুধু টাকার জন্যই মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতি ফারসিতে একটা কসীদা লিখে ফেললুম। গভর্ণর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলুম লন্ডনে পাঠাবার জন্য। সঙ্গে একটা চিঠিও দিলুম, মহারানি যেন এই সামান্য কবিকে একটু দয়া করেন। গদরের বছরের গোড়াতেই উত্তর পেলুম। আমাকে জানানো হল, যথাযত তদন্তের পর খেতাব ও খিলাত দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু তারপর আর কিছু হয় নি। আমি কে? মহারানির কাছে তো ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা একটা মুখ মাত্র।

মান্টোভাই, আজ আপনাদের কাছে স্বীকার করতে কোনও লজ্জা নেই, আমি সত্যিই একটা উজবুক ছিলুম। জীবনে সবকিছুই তো আমার ভেস্তে গেছে, তবু প্রত্যেকবার ভাবতুম, এবার একটা কিছু হবেই, খোদা কি শুধু আমাকে মার খাওয়ানোর জন্য এই দুনিয়াতে এনেছেন? সারা জীবন আশার ফাঁদেই আটকে রইলুম।

তাব লায়ে-হী বনেগী, গালিব,
বাকেয়া সৎ হৈ অওর জান অজীজ।।
(পেরে উঠতেই হবে, গালিব,
অবস্থা সঙ্গীন এবং প্রাণ প্রিয়।।)

তবু তারই মাঝে কয়েকদিনের জন্য আবার বসন্তের বাতাস এসেছিল, মান্টোভাই। আমি অবশ্য তাকে চোখে কখনও দেখিনি। সে আমার শার্গিদ হয়েছিল। তার শের শুনে মনে হত :

দেখনা তক্রীর কী লজ্জত। কে যো উসনে কহা
ম্যায়নে ইয়ে জানা কে গোয়া য়ে ভি মেরে দিল মে হ্যায়।
(দেখো তার কথার ইন্দ্রজাল, সে যা বলল
আমার মনে হল এও তো আমার হৃদয়ে ছিল।)

আমি তার তখল্পস দিয়েছিলুম তর্ক। শাহজাহানাবাদের অভিজাত বংশের নারী। জাতিতে তুর্কি, তার পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন বুখারা থেকে। খুবই কম বয়েসে শহরকে হারিয়েছিল তর্ক। কবিতার কাছেই আশ্রয় খুঁজেছিল সে। তার মামা ওর লেখা শেরগুলো আমার কাছে। নিয়ে আসতেন। আমি ওর লেখা অক্ষরগুলির শরীরে হাত বোলাতুম; এভাবেই ওকে স্পর্শ করতে পেরেছিলুম। কখনও কখনও ওদের হাভেলিতেও গিয়েছি। ও থাকত সবসময় পর্দার আড়ালে। ওইরকম পরিবারে তো বাইরের পুরুষের সামনে মেয়েরা আসতে পারে না। মান্টোভাই, সত্যি বলতে কী, আমি তর্কের কণ্ঠস্বর শুনতেই যেতুম। যেন সাইপ্রাস গাছের মধ্য দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কী স্পষ্ঠ, কাটাকাটা উচ্চারণ। আর ওর গজলে ছিল কল্পনার অন্য এক উদ্ভাস। আপনি বিশ্বাস করেন কিনা জানি না, কিন্তু আমি মনে করি, নারীর কল্পনালোক পুরুষের চেয়ে আলাদা। তর্ক আমাকে এক গোপন আতরের মতো টানত, যার গন্ধ। পাওয়া যায়, কিন্তু কোনদিন ছোঁয়া যায় না।

দুখ অব ফিরাক কা হমসে সহা নহীঁ জাতা
ফির উসসে জুল্ম য়হ হ্যয় কুছ কহা নহীঁ জাতা।
(বিরহের জ্বালা আর তো সইতে পারছি না,
আরও যন্ত্রণা এই যে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছি না।)

.

আতরের খুশবুটা কবে যে হারিয়ে গেল বুঝতেই পারলুম না। একদিন ওদের হাভেলিতে গিয়ে শুনলুম, তর্ক আর দেখা করবে না। ওর মামাকে জিজ্ঞেস করলুম, কী হয়েছে মিঞাসাব? ওনার কী শরীর খারাপ?

-না মির্জা সাব। ওতো আর গজল লেখে না।

-কেন?

-সারাদিন শুধু কোরান পড়ে। ঘর থেকেও বেরোয় না।

–ইয়া আল্লা! অমন শায়রা গজল লেখা ছেড়ে দিলেন। কত বড় কবি হতে পারতেন।

-মির্জাসাব আমাদের সমাজে মেয়েদের কতটুকু মূল্য বলুন! তার ওপর কবিতা লেখে। তাকে সবাই পাগল ভাবে।

-আপনারাও তাই ভাবেন?

-না। কিন্তু ও যে কেন এভাবে গুটিয়ে গেল, আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না।

-একবার ওনার সঙ্গে দেখা করা যায় না?

-না মির্জাসাব। ও জানিয়ে দিয়েছে, আপনি যেন আর কখনও না আসেন। সবচেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন, নিজের লেখা গজলগুলো নিজের হাতে ছিঁড়ে সব পুড়িয়ে দিয়েছে।

সেদিন ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। যমুনার তীরে গিয়ে বসে রইলুম। কখন সন্ধ্যা নেমেছে। বুঝতেই পারিনি। অন্ধকারে যমুনার স্রোত নিজের সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছে। তখন তাকে দেখতে পেলুম। উৎকণ্ঠিতা নায়িকাকে। কুঞ্জবনে ঝরাপাতার আসনে বসে আছে সে প্রেমিকের অপেক্ষায়। ফুলভারানত গাছগুলি তাকে ঘিরে আছে, যেন বলছে, অমন উৎকণ্ঠিত হয়ো না। রাধিকা, সে আসবে, আসবেই তোমার শ্যামরায়। নায়িকার সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝরনা। সে-ও যেন বলে যাচ্ছে, আর একটু অপেক্ষা করো, ওই তো তার বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে। ঝরনার জল খাচ্ছে এক ত্রস্ত হরিণী। আর গাছেদের পিছন থেকে এক হরিণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে নায়িকার দিকে। আমি বুঝতে পারলুম, তর্ক কেন গজল লেখা ছেড়ে দিল। গজলের এক একটা শব্দের ভার সে আর সহ্য করতে পারছিল না। পর্দা সরিয়ে সে তো কনও বন্ধুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে না।

অব ম্যায় হু অওর মাতম্ এক শহর-এ-আরজু
তোড়া যো তুনে আইনা, তিস্সালদার থা।
(এখন আমি আছি আর শোক আছে এক আশান্বিত শহরে,
যে আয়না তোমার হাতে বিচূর্ণ হল তাতে ছবি ছিল অসংখ্য।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *