৩৭
আজাদকে যুদ্ধে এনেছিল কাজী কামাল উদ্দিন ৷ তার বন্ধুরা, ক্রিকেট খেলার সঙ্গীরা যে অনেকেই আগরতলা গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, আজাদ জানত না ৷
বর্ষা এবার প্রলম্বিত হচ্ছে ৷ একেক দিন বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতেই চায় না ৷ আর বৃষ্টি না হলে পড়ে গরম ৷ সেটা আরো অসহ্য ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসার দু বাসা পরের বাসাটার সামনের বাগানে বেলিফুলের ঝাড়ে ফুল ফুটে থাকে ৷ একেকটা রাতে তার ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে আজাদের ৷ আজাদের কেমন ঘোর ঘোর লাগে ৷ বেলির গন্ধের সঙ্গে রাজারবাগে দেখা লাশের গন্ধ যেন মিশে যায় ৷
এক দুপুরে কাজী কামালের সঙ্গে দেখা আজাদের ৷ ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সামনে একটা সিগারেটের দোকানে ৷ এটা আজাদের প্রিয় একটা সিগারেটের দোকান ৷ ৩ টাকার সিগারেট কেনার জন্য আজাদ এখানে আসে ৩ টাকা বেবিট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে হলেও ৷
কাজী কামালকে দেখেই আজাদ উল্লসিত, ‘আরে কাজী, তুমি কই হারিয়ে গেলে ৷ দেখা পাই না ৷’
কাজী কামাল সন্ত্রস্ত ৷ পাগল কী বলে! এইভাবে প্রকাশ্য রাজপথে এই ধরনের কথা বলার মানে ধরা পড়ে যাওয়া ৷ কাজী কামাল কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ‘এরামে চলো ৷ তোমারে সব কইতেছি ৷’
এরাম রেস্তোরাঁ এবং বার ৷ দিনের বেলাতেও খোলা থাকে ৷ আজাদ আর কাজী কামাল সেখানে যায় ৷ বারটা এখন ফাঁকা ৷ একটা কোনায় তারা দুজন বসে পড়ে ৷
কাজী কামাল বলে, ‘আজাদ ৷ তোমার একটু হেল্প দরকার ৷ আমি তো ট্রেনিং নিয়া আসছি ৷ গেরিলা ট্রেনিং ৷’
আজাদ বলে, ‘এটা তুমি কী করলা ? আমাকে ফেলে রেখে একা একা চলে গেলা ৷ তুমি ওঠো ৷ যাও ৷ তোমাকে আমি কিছুই খাওয়াব না ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘আরে পাগলামো কইরো না ৷ তুমি এখানে থাইকাই যুদ্ধ করতে পার ৷ হেল্প আস ৷’
আজাদ বলে, ‘কী ধরনের হেল্প ?’
‘এবার আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র আনছি ৷ রাখার জায়গা নাই ৷ আবার আমাদেরও থাকার জায়গা লাগে ৷ হাইড আউট ৷ তোমার বাসায় আমাদের জায়গা দিতে পার ৷’
‘অফ কোর্স ৷’
‘বুইঝা বলো ৷ এখনই বলার দরকার নাই ৷ তোমার মায়ের পারমিশন নাও ৷ বাসায় বাইরের ছেলেরা থাকবে ৷ অস্ত্রপাতি থাকবে ৷ খালাম্মাকে না জানায়া এসব করা উচিত হবে না ৷’
‘মা কিছু বলবে না ৷ রাজি হয়েই আছে ৷’
‘তবুও তুমি মারে জিগাও ৷ রান্নাবান্না কইরা খাওয়াইতে তো হবে ৷’
‘মা তো খাওয়ানোর লোক পেলে খুশি হয় ৷’
‘আরে তুমি জিগাও তো ৷ আমি তোমার বাসায় কালকা আসতেছি ৷ জুয়েলকেও নিয়া আসব ৷ সকাল ১০টায় বাসায় থাইকো ৷’
‘জুয়েলও গিয়েছিল নাকি ?’
‘হ ৷ আরো কে কে আছে আমগো লগে, দেখলে বেহুঁশ হইয়া যাবা ৷ হা-হা-হা ৷’
দুজন খদ্দের এসে তাদের পাশের টেবিলে বসে ৷ তারা আর আলাপ করতে পারে না ৷ গেলাস শেষ করে উঠে পড়ে ৷ আজাদ বিল মিটিয়ে দেয় ৷
আজাদ বাসায় যায় ৷ মাকে বলে, ‘মা শোনো, তোমার সাথে কথা আছে ৷’
মা রান্নাঘরে ছিলেন ৷ তার কপালে ঘাম ৷ তিনি আঁচল দিয়ে ঘাম মোছেন ৷ হাতের হলুদ তার মুখে লেগে যায় ৷ ‘বল, কী বলবি, চুলায় রান্না ৷’
‘বসো ৷ বসে মন দিয়া শোনো ৷’
‘বলে ফেল ৷’
‘আগে বলো, না করবা না ৷’
‘আরে তুই আগে বলে ফেল না ৷’
‘মা, আমার কয়জন বন্ধুবান্ধব আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে ৷’
‘থাকবে থাকুক ৷ এটা আবার জিজ্ঞেস করার কথা ৷ বন্ধুগুলো কারা ?’
‘এই ধরো কাজী কামাল, জুয়েল ৷’
‘কাজী, জুয়েল এরা অনেক দিন আমাদের বাসায় আসে না ৷ আসতে বল ৷ ওদের বাড়িতে কি অসুবিধা হয়েছে কোনো ?’
আজাদ কন্ঠস্বর নামিয়ে বলে, ‘ওরা তো যুদ্ধ করছে ৷ শুনছ না, ঢাকায় গেরিলা অপারেশন হচ্ছে ৷ ওরাই করছে ৷ তাই নিজের বাসায় থাকা নিরাপদ না ৷ সাথে কিছু অস্ত্রশস্ত্রও থাকে তো ৷’ আজাদ শেষের কথাটা বলে রাখে ইচ্ছা করেই ৷ অস্ত্র রাখার অনুমতিটাও এই সুযোগে নিয়ে রাখা দরকার ৷
মা স্থির হয়ে যান খানিকক্ষণের জন্যে ৷ তাঁর কপালে ঘামের বিন্দুগুলো শিশিরের মতো জমতে থাকে ৷ এবার তিনি কী বলবেন ?
একটামাত্র ছেলে তাঁর ৷ এই ছেলেকে মানুষ করার জন্যেই যেন তিনি বেঁচে আছেন ৷ ছেলে তাঁর এমএ পাস করেছে ৷ এখন তার জীবন, তার নিজের জীবন ৷ সত্য বটে, ছেলে তাঁর এখন আয়-রোজগার করবে, এখন মায়ের কষ্ট করে জমি আবাদ করার দিন শেষ, বীজ বোনা, নিড়ানি দেওয়া সব সমাপ্ত, এখন তাঁর ফসল ঘরে তোলার দিন ৷ এখন সংসারে তাঁর লাগার কথা নবান্নের আনন্দের ঢেউ, নতুন ভাতের গন্ধের মতোই আনন্দের হিল্লোলে তাঁর ঘরে মৌ-মৌ করার কথা ৷
ইতিমধ্যেই তিনি ছেলের জন্যে একটা বউ দেখে রেখেছেন ৷ আলাপ-আলোচনা কেবল শুরু হয়েছে ৷ আজাদকে নিয়ে তিনি একদিন যাবেন মেয়ের বাসায়, বেড়াতে যাওয়ার ছলে দেখে আসবেন মেয়েকে ৷
এর মধ্যে এ কোন প্রস্তাব!
কিন্তু তিনি নাই-বা করেন কোন মুখে! জুয়েলের মাও তো ছেড়েছে জুয়েলকে, কাজী কামালের মা কাজী কামালকে! আর তা ছাড়া ২৫শে মার্চের পরে ঢাকা শহরের ওপরে পাকিস্তানি মিলিটারি কী অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, সে খবর কি তিনি পাচ্ছেন না! বিনা দোষে মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ ৷ রোজ মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, অত্যাচার করছে মেয়েদের ওপর ৷ তার জুরাইনের পীরসাহেব বলেন, ‘মেয়েদের ওপরে অত্যাচার যখন শুরু হয়েছে, পাকিস্তান আর্মি তখন পারবে না ৷ আল্লাহতালা এই অত্যাচার সহ্য করবেন না ৷’
না ৷ এই অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না ৷ এটা অধর্ম ৷ তাঁর অবশ্যই উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা ৷ রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটা গান শোনা যায় : মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি… হ্যাঁ, একটা ফুলকে, একটা দেশকে, দেশের মানুষকে তো বাঁচাতে হবে, আর বাঁচাতে হলে যুদ্ধ তো করতেই হবে ৷ আজাদের বন্ধুরা যুদ্ধ করছে, সারা বাংলার কত কত তরুণ-যুবক, কত কত মায়ের সন্তান যুদ্ধে গেছে, আর তার ছেলে যোদ্ধাদের সাহায্য করবে না ?
তিনি কপালের ঘাম মুছে বলেন, ‘নিয়ে আসিস তোর বন্ধুদের ৷’
আজাদ খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ৷ বলে, ‘মা, তোমার কপালে হলুদ লেগেছে, সুন্দর দেখাচ্ছে ৷’
কাজী কামাল আসে পরদিন সকাল ১০টায় ৷ মা তার সামনে আসেন ৷ বলেন, ‘কেমন আছ বাবা ৷ কী খাবে ? আজাদ আমাকে বলে কামাল, জুয়েল এরা এসে বাসায় থাকবে ৷ এ জন্য কি পারমিশন নিতে হয় নাকি! তোমরা আমার ছেলের মতো না ? আসবে ৷ যখন সুবিধা মনে করবে আসবে ৷’
জায়েদের মনে পড়ে, আজাদদের মগবাজারের বাসাটা ছিল একটা ছোটখাটো ক্যান্টনমেন্ট ৷ প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ আসত এ বাসায় ৷ আবার এখান থেকে বিভিন্ন বাসায় সেসব চালান হয়েও যেত ৷ সে নিজেও বস্তায় ভরে অস্ত্র নিয়ে গেছে আশপাশের বাসায় ৷ দিলু রোডের হাবিবুল আলমের বাসায় যেমন ৷
তার এই বীরত্ব নিয়ে কৌতুক করত মর্নিং নিউজের সাংবাদিক আবুল বাশার ৷ বলত, কিরে, ভয় পেয়েছিস নাকি! আয় তো, এদিকে আয় ৷ জায়েদের প্যান্ট একটানে খুলে বলত, দেখি, প্যান্টের মধ্যে হেগে ফেলেছিস নাকি!’
জায়েদ খুবই বিরক্ত হতো ৷ সে কত কষ্ট করে পিঠে বয়ে রেললাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে দিলু রোডের পেছন দিয়ে ঢুকে অস্ত্র রেখে এল ৷ আর তার সঙ্গে কিনা এই ইয়ারকি ৷ বাশারের লুঙ্গিটা ধরে একটা টান দেবে নাকি সে!
দাদার বন্ধু ৷ সে কিছু বলতেও সাহস পায় না ৷
আজাদের আরেক খালাতো ছোট ভাই টিসুর মনে পড়ে, একবার আজাদ ধরে নিয়ে এল এক পুরনো খবরের কাগজের ফেরিঅলাকে ৷ তাকে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে ৷ টিসুর ছিল কতগুলো পুরোনো বইখাতা, সেসব বিক্রি করার উদ্দেশ্যে সে ওই ঘরে গিয়ে দেখে ফেরিআলার ডালায় কাগজপত্রের নিচে সব আগ্নেয়াস্ত্র ৷ ফেরিঅলাটাও আসলে এক মুক্তিযোদ্ধা ৷ টিসুর আর বইখাতা বিক্রি করা হয় না ৷
আর সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে পড়ে, যুদ্ধের সময় তাদের ইস্কাটনের বাড়িতে বদিউল আলম আর স্বপন ছিল দুই মাসের মতো ৷ আশরাফুলের বাবা নান্না মিয়া কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন বলে ধরেই নেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সন্দেহের তালিকায় এই বাসা থাকবে না ৷ এটা হতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ৷ যুদ্ধের মধ্যে একদিন কাজী কামাল উদ্দিন, জুয়েল, বদি তাদের বাসায় আসে ৷ সঙ্গে আজাদও ছিল ৷
জুয়েল বলে, ‘আমরা তো সব যুদ্ধে ইনভল্ভ্ড হয়ে গেছি ৷ তুমি কী করবা ?’
সৈয়দ আশরাফুল একই সঙ্গে ভয়ে কাঁপে, আবার বিস্ময়ে চোখের পাতা পিটপিট করতে থাকে, কারা কারা জড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধের সঙ্গে, সব খেলোয়াড়, সব ভালো ছেলে, সে লক্ষ করে, এই গেরিলারা নিজেদের মধ্যে সব সময় কথা বলে ইংরেজিতে… আর বদিকে দেখে তার বিস্ময় আরো ব্যাপক, বদি ভাই! এনএসএফের গুণ্ডা বদি ভাই, তিনিও ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন!
সৈয়দ আশরাফুল জবাব দেয়, ‘আপনাদের যা যা সাহায্য করন লাগে, করুম ৷ বাট আই উইল নট গো টু ইন্ডিয়া…’
বদিউল আলম আর স্বপন-এই দুই যোদ্ধা আশরাফুল হকের বাড়িতে যখন ছিল, তখন বদির এক অসাধারণ গুণ পর্যবেক্ষণ করে আশরাফুল ৷ আশরাফুলের এক বোন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই, দেশী-বিদেশী বই, বদি দুই মাসে পুরো লাইব্রেরির অর্ধেকটা পড়ে সাবাড় করে ফেলে ৷ একটা বই হাতে নিয়ে সে ঘন্টা তিন-চারেক একেবারে দুনিয়াদারির বাইরে চলে যেত, পড়া শেষ করে তারপর যেন ফিরে আসত মর্ত্যে ৷
সৈয়দ আশরাফুল হকের এও মনে পড়ে, একাত্তরে আজাদ ভাইদের বাসাটা ছিল একটা মুক্তিযোদ্ধা মেসের মতো ৷ প্রায়ই বিনা নোটিসে আজাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা চলে আসত বাসায় ৷ থাকার দরকার হলে থাকত, খাওয়ার দরকার না হলেও খেতে বাধ্য হতো ৷ কারণ আজাদের মা না খাইয়ে ছাড়তেন না তাদের ৷
জুয়েল আর কাজী কামাল মাঝে মধ্যেই আজাদদের বাসায় আসে ৷ রাতে থাকে ৷ কোনো অপারেশন না থাকলে তাস খেলে ৷ টিভি দেখে ৷ আর আজাদের সঙ্গে গল্প করে ৷
জুয়েল বলে, ‘দোস্তো, যখন তুই আর্মস হাতে নিবি, ফায়ার করবি, তখন কিন্তু ইরেকশন হয় ৷ ঠিক কি না কাজী ভাই ?’
কাজী কামাল স্বীকার করে, ‘হয় ৷’
জুয়েল বলে, ‘আজাদ, তুমি তো দোস্তো বুঝবা না ৷ তুমি তো আর্মস নাড়ো নাই ৷’
আজাদ হাসে ৷ ‘কী কয় ৷ আমাদের আর্মসের দোকান ছিল না ? আমার টার্গেট তোদের চাইতে ভালো ৷ আরে আমি যতগুলান পাখি শিকার করছি, আর কেউ করতে পারছে ?’
জুয়েল হাসে ৷ ‘পাখি শিকার করা আর পাক আর্মি মারা আলাদা ব্যাপার ৷ পাঞ্জাবি হইলেও তো মানুষ ৷’
আজাদ বলে, ‘দ্যাখো ৷ পাখি মারতে মায়া লাগে ৷ পাঞ্জাবি মারতে আবার মায়া কী রে! ওরা কেমন করে মারছে!’
আজ মনে হয় তাদের গল্পে পেয়েছে ৷ জুয়েল আর কাজী কামাল আজাদকে শোনাচ্ছে তাদের অপারেশনের কথা ৷
জুয়েল শোনায় তাদের ফার্মগেট অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ ৷
ধানমন্ডি ২৮-এর হাইড আউটে মিটিং ৷ আলম, বদি, স্বপন, চুল্লু ভাই ছাড়াও মিটিংয়ে ছিলেন শাহাদত চৌধুরী ৷ ঠিক হলো ফার্মগেটের আর্মি চেকপোস্ট অ্যাটাক করা হবে ৷ সবচেয়ে বেশি উৎসাহ বদির ৷ এক সপ্তাহ ধরে রেকি করা হলো ৷ তারপর আবার মিটিং ৷ সে মিটিংয়ে ঠিক হলো ফার্মগেটের সঙ্গে সঙ্গে দারুল কাবাবেও আক্রমণ চালানো হবে ৷ ওটাও একই ময়মনসিংহ রোডে ৷ দুটো গ্রুপ গঠন করা হলো ৷ ফার্মগেট অপারেশনে থাকবে বদি, আলম, জুয়েল, পুলু আর সামাদ ভাই ৷ আহমেদ জিয়ার নেতৃত্বে চুল্লু ভাই, গাজি থাকবে দারুল কাবাব ঘর অপারেশনে ৷ ফার্মগেট অপারেশন শেষ হলে গ্রেনেড চার্জ করা হবে, এটাই হবে দারুল কাবাবে হামলা করার সংকেত ৷
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ফার্মগেটে মিলিটারি ক্যাম্পে হামলা করার সময় ঠিক হলো ৷ ওই দিন বিকালে সবাই মিলিত হলো সামাদ ভাইয়ের মগবাজারের বাসায় ৷ আলমের হাতে মেজর নুরুল ইসলাম শিশুর দেওয়া এসএমজি ৷ অন্য সবার হাতে থাকে স্টেনগান ৷ অপারেশন করতে দু-তিন মিনিট লাগার কথা ৷ এর মধ্যে আলম একটা ঝামেলা করে ফেলে ৷ তার সাব মেশিনগান পরিষ্কার করতে গিয়ে পরিষ্কার করার নিজস্ব উদ্ভাবিত পুল নলের ভেতরে আটকে যায় ৷ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ৷ সাড়ে ৬টা বাজে ৷ সবাই উৎকন্ঠিত ৷ এসএমজি চালু না হলে আজকের অপারেশনই হবে না ৷ শেষে কেরোসিন ঢেলে ভেতরে আটকে যাওয়া দড়ির গিঁটে আগুন লাগিয়ে ওটাকে জঞ্জালমুক্ত করা যায় ৷
নিয়ন সাইনের মালিক সামাদ ভাই গাড়ি চালাবেন ৷ বদি আর আলম থাকবে সামনের সিটে ৷ জানালার ধারে থাকবে আলম ৷ পেছনের সিটে স্বপন, জুয়েল আর পুলু ৷ এর আগে আলম, বদি, সামাদ ভাই ফার্মগেট এলাকা অনেকবার রেকি করেছে ৷ এমনকি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ওখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা কে কী করে, তাও তারা জানে ৷
এখনও কিছু সময় বাকি আছে ৷ জুয়েল স্বভাবমতো চুটকি বলতে শুরু করে ৷ সামাদ ভাই মেটালিক সবুজ টয়োটা সেডান গাড়িটা শেষবারের মতো চেক করে নেন ৷ ৭টা ১৫ মিনিট ৷ সবাই তাদের পোশাক-আশাক পরিপাটি করে নেয় ৷ কেশবিন্যাস করে ৷ এর কারণ এলোমেলো পোশাকে গাড়িতে গেলে তাদের সন্দেহ করা হতে পারে ৷ ঢাকার গেরিলারা সব সময় ভালো শার্ট, ভালো প্যান্ট পরে ৷ ঠিক সাড়ে ৭টায় তারা গাড়িতে উঠে বসে ৷ আলমের হাতে এসএমজি, অন্যদের হাতে স্টেন, এ ছাড়া জুয়েল আর পুলুর হাতে ফসফরাস গ্রেনেড ৷ আরেকটা ইন্ডিয়ান পাইনঅ্যাপেল গ্রেনেড ৷ দেখতে আনারসের মতো বলে এই নাম ৷ ওপেনিং কম্যান্ড দেবে বদি ৷ ফেরার কম্যান্ড দেবে স্বপন ৷
গাড়ি চলতে শুরু করেছে ৷ মগবাজার থেকে ধীরে ধীরে এসে পড়ছে ময়মনসিংহ রোডে ৷ রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি চলাচল করছে ৷ শত্রুর গাড়ির কাছে আসতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত আপনা-আপনিই অস্ত্রের গায়ে চলে যাচ্ছে ৷ তারা ধীরে ধীরে দারুল কাবাব পেরিয়ে ফার্মগেট মোড়ে যায় ৷ ডান দিকেই তাদের লক্ষ্যবস্তু ৷ আর্মি চেকপোস্ট ৷ দুটো তাঁবু ৷ দুজন সৈন্য নিজেদের মধ্যে গল্প করছে ৷ আরেকজন সৈন্য একটা বেবিট্যাক্সি থামিয়ে এক যাত্রীকে তল্লাশি করছে ৷ বাকি সৈন্যরা হয়তো তাঁবুতে রাতের খাবার খাচ্ছে, বা বিশ্রাম নিচ্ছে ৷ তাদের গাড়ি ডানে ঘুরে তেজগাঁও সড়কে পড়ে ৷ কিছুদূর গিয়ে সামাদ ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেন ৷ তারপর গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির নিজস্ব গতিজড়তায় গাড়িটাকে এনে দাঁড় করান হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে ৷ পানের দোকানে বিকিকিনি চলছে যথারীতি ৷ সামাদ ভাই বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা ৷’ পাঁচজন নেমে পড়ে ৷ এক মিনিটের মধ্যে সবাই যার যার পজিশন নিয়ে ফেলে ৷ দুজন সৈন্য এখনও গল্প করছে ৷ তৃতীয় সৈন্যটিও তাদের কাছে এসে গল্প জুড়ে দেয় ৷ গেরিলাদের বুক কাঁপছে ৷ বদি নির্দেশ দেয় : ‘ফায়ার ৷’ আলম গুলি চালায় তিন সেন্ট্রিকে লক্ষ্য করে ৷ সেন্ট্রিরা সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে ৷ আর বাকি চারজন গেরিলা একযোগে ব্রাশফায়ার করতে থাকে দুই তাঁবু লক্ষ্য করে ৷ তিনজন প্রহরারত সৈন্যকে ধরাশায়ী করে আলমও তাক করে তাঁবু দুটো ৷ রচিত হয় গুলির মালা ৷ স্বপন নির্দেশ দেয় : ‘রিট্রিট’ ৷ জুয়েল আর পুলু বোমা চার্জ করে ৷ সবাই দৌড়ে এসে উঠে পড়ে গাড়ি ৷ সামাদ ভাই গাড়িতে টান দেন ৷ ময়মনসিংহ সড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলে ৷ তখন সবার খেয়াল হয় গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি ৷ দারুল কাবাব ঘরের অপারেশন তাই হতে পারে না ৷
জুয়েল তাদের এই অপারেশনের বিবরণ পেশ করে বিশদভাবে, রসিয়ে রসিয়ে ৷
আজাদ বলে, ‘কয়জন মিলিটারি মারা গেল, বুঝলি কেমনে!’
জুয়েল বলে, ‘১২ জন সোলজার মারা গেছে ৷ আমরা পরদিন গেলাম আশরাফুলের বাড়ি ৷ ওইখানে আমগো বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও সব কইল ৷ অর বোন হলিক্রসের টিচার না ? উনিই সব দেখছে ৷ সারা রাত আর্মিরা লাশ লইতে আসতেও সাহস পায় নাই ৷ ভোরবেলা আসছে ৷ হিউবার্টের বোন ১২ বার বুকে কপালে ক্রস করছে ৷ মানে ১২টা লাশ লইয়া গেছে ৷ চিন্তা কর ৷ এরা নাকি দুনিয়ার সবচাইতে সাহসী সোলজার ৷ সারা রাত সৈন্যরা পইড়া থাকল, কেউ তো উন্ডেডও থাকতে পারে, আইসা দ্যাখ, হসপিটালে লইয়া যা, ঢাকা শহরের মধ্যে এই সাহসটা পাইল না ৷ আরে নিউজ শুইনা নাকি ক্যান্টনমেন্টে সব সোলজারগো পিশাব পাইছে, একলগে এতজন বাথরুমে যাইব কেমনে, সব কাপড় নষ্ট কইরা ফেলাইছে, মুতের গন্ধে ক্যান্টনমেন্ট যাওয়া যাইতেছে না…’
শুনে আজাদ উত্তেজিত-’জুয়েল, যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তোদেরকে অনেক অ্যাওয়ার্ড দেবে রে ৷ শোন, আমিও যাব নেঙ্ট অপারেশনে ৷ আমাকে তোরা অবশ্যই নিবি ৷’
‘যেতে চাইলে যাবি ৷ কিন্তু আম্মার পারমিশন লাগবে ৷ আম্মার পারমিশন ছাড়া তরে নেওন যাইব না’-জুয়েল বলে ৷ জুয়েল আজাদের মাকে আম্মা বলে, কারণ তার চাচাতো ভাই টগর আম্মা বলে ডাকে তাঁকে ৷
‘মা ঠিক পারমিশন দিবে ৷ ঘরে অস্ত্রশস্ত্র রাখতেছি ৷ তাতে যখন আপত্তি করে নাই, তখন…’
সেই রাতেই ভাত খেতে খেতে আজাদ মাকে বলে, ‘মা, এরা এরপর যেই অপারেশনে যাবে, আমি সেটাতে যেতে চাই ৷ এত বড় জোয়ান ছেলে, ঘরে বসে থাকে, আর দেশের মানুষ মার খায়, এটা হতে পারে না ৷’
মা কথার জবাব দেন না ৷
‘এই দ্যাখ মার অ্যাপ্রুভাল আছে ৷ মা আপত্তি করল না’-আজাদ কায়দা করে ৷
মা বলেন, ‘আমি কালকে তোকে ফাইনাল কথাটা বলব ৷ আজকের রাতটা সবুর কর ৷’
‘ঠিক আছে ৷ কিন্তু দ্যাখো মা, না কোরো না ৷’
মা সারা রাত বিছানায় ছটফট করেন ৷ কী বলবেন তিনি ছেলেকে ৷ যুদ্ধে যাও! পরে যদি ছেলের কিছু হয় ৷ এই ছেলে তাঁর বহু সাধনার ধন ৷ তাঁর প্রথম সন্তানটা একটা মেয়ে ৷ কানপুরেই জন্ম হয়েছিল মেয়েটার ৷ চৌধুরী সাহেব মেয়ের নাম রেখেছিল বিন্দু ৷ সেই মেয়ে এক বছর বয়সে মারা যায় ৷ প্রথম সন্তান বিয়োগের কষ্ট যে কী কষ্ট! বহু রাত সাফিয়া বেগম কেঁদেছেন ৷ মেয়েটা তাঁর কথা শিখেছিল ৷ ‘মা মা, দাদা দাদা’ বলতে পারত ৷ সুন্দর করে হাসত ৷ চৌধুরী সাহেব বলতেন, ফেরেশতারা হাসাচ্ছে ৷ বিন্দু তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল ৷ সেই মেয়ে বসন্ত হয়ে মারা গেল ৷ সাফিয়া বেগমের মনে হলো সমস্ত জগৎই শূন্য ৷ জীবনের কোনো মানে নাই ৷ বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান কথা ৷ বিন্দু মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পেটে সন্তান এসে গেল ৷ নতুন করে তিনি মাতৃত্বের স্বপ্ন বুনতে লাগলেন ৷ জন্ম নিল আজাদ ৷ তখন আজাদির স্বপ্নে পুরো ভারতই উত্তাল ৷ তাই ছেলের নাম, চৌধুরী রাখলেন আজাদ ৷ আজাদকে তিনি যত্ন করেছেন অনেকটা আদেখলার মতো করে ৷ সারাক্ষণ কপালে টিপ পরিয়ে রেখেছেন, যেন কারো নজর না লাগে ৷ মাজারে গিয়ে মানত করেছেন তার সুস্থতার জন্যে ৷ আজাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে তিনি পাগলের মতো করতেন ৷ তাঁরা পাকিস্তানে চলে আসার পরে তাঁর শাশুড়ি এসবকে বাড়াবাড়ি বলে সমালোচনা করতেন ৷ কিন্তু তাঁর কীই-বা করার ছিল ৷ ছেলের অমঙ্গল-আশঙ্কায় সর্বদা তাঁর মন কুপিত হয়ে থাকত ৷ আজাদের পরেও তাঁর কোলে একটা বাচ্চা এসেছিল ৷ সেও তো বাঁচেনি ৷ আজাদ তাঁর সর্বস্ব ৷ তাকে বুকের মধ্যে আগলে না রেখে তিনি পারেন ?
সেই ছেলে আজ কেমন ডাগরটি হয়েছে ৷ মাশাল্লা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য সুন্দর ৷ ছেলের জন্য তিনি মেয়ে দেখে রেখেছেন ৷ ছেলের বিয়ে দিতে পারলে তাঁর দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হয় ৷ পুত্রপালনের দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় একা কাঁধে তুলে নিয়েছেন ৷ এই দায়িত্ব কঠিন ৷ আজকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হবে ৷ এই সিদ্ধান্ত তিনি কী করে একা নেবেন ? ছেলের বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো ৷ তা তিনি জীবন থাকতেও করবেন না ৷ যে বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও স্থূল বাসনা থেকে নিজেকে নিরত রাখতে পারে না, সে আবার বাবা কিসের ? সাফিয়া বেগম আজ সত্যি অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি ৷
কিন্তু দেশ যখন তাঁর ছেলেকে চাইছে, তখন মা হয়ে কি তিনি ছেলেকে আটকে রাখতে পারেন ? বলতে পারেন, আমার একটামাত্র ছেলে, আর কেউ নাই ত্রিজগতে, আমার ছেলেকে ছাড় দাও ৷ এই কথা বলার জন্যে কি তিনি ইস্কাটনের বাসা ছেড়েছিলেন ? এই সুবিধা নেওয়ার জন্যে ? না ৷ ওটা ছিল তাঁর নিজস্ব সংগ্রাম ৷ আজকে দেশ অন্যায় শাসনে জর্জরিত ৷ সাফিয়া বেগম যতটুকু বোঝেন, রেডিও শুনে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনে, ছেলেদের আলোচনা শুনে, বাসায় আগত লোকদের কথাবার্তা যতটুকু তার কানে আসে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে, আর পুলিশ সুবেদার খলিলের বয়ান শুনে, তাতে পাঞ্জাবিদের এই জুলুম মেনে নেওয়া যায় না, মেনে নেওয়া উচিত না ৷ তিনি ছেলেকে মানুষ করেছেন কি নিজে ছেলের আয়-রোজগার আরাম করে ভোগ করবেন বলে! কক্ষনো নয় ৷ এটা তিনি ছেলেকে চিঠিতেও লিখে জানিয়েছেন, ছেলেকে তিনি মানুষ করেছেন মানুষের যা কিছু কর্তব্য তাই করবে বলে ৷ দেশ আর দশের কাজে লাগবে বলে ৷
অমঙ্গল-আশঙ্কায় আবার তাঁর বুক কেঁপে ওঠে, সমস্ত অন্তরাত্মা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যায় ৷ যদি ছেলের কিছু হয়! তিনি কল্পনা করার চেষ্টা করেন, কেউ এসে তাঁকে খবর দিচ্ছে যে তার ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে, না, তিনি কল্পনা করতে পারেন না, অশ্রুর প্লাবন এসে তাঁর দু চোখ আর সমস্ত ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৷
একজন কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো ৷ কিন্তু কার সঙ্গে! হঠাৎই মায়ের মনে পড়ে যায় জুরাইনের পীরসাহেবের কথা ৷ বড় হুজুর আর তাঁর স্ত্রী দুজনই বড় ভালো মানুষ ৷ তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেই তো চলে ৷
মা সকালবেলা রওনা দেন জুরাইন মাজার শরিফ অভিমুখে ৷ পীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন ৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়, তিনি কি অনুমতি দেবেন ?
পীরসাহেব বলেন, ‘ছেলেকে যেতে দাও ৷ পাকিস্তানিরা বড় অন্যায় করতেছে ৷ জুলুম করতেছে ৷ আর তা ছাড়া, ছেলে বড় হলে তাকে আটকায়া রাখার চেষ্টা করে ফল নাই ৷ তুমি না করলেও সে যুদ্ধে যাবেই ৷’
মায়ের মন থেকে সব দ্বিধা দূর হয়ে যায় ৷ ফিরে এসে তিনি আজাদকে ডাকেন ৷ বলেন, ‘ঠিক আছে, তুই যুদ্ধে যেতে পারিস ৷ আমার দোয়া থাকল ৷’
ছেলে মায়ের মুখের দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ৷ বোঝার চেষ্টা করে, মা কি অনুমতিটা রেগে দিচ্ছেন, নাকি আসলেই দিচ্ছেন ৷
‘মা, তুমি কি অন্তর থেকে পারমিশন দিচ্ছ, নাকি রাগের মাথায় ?’
‘আরে রাগ করব ক্যান ৷ দেশ স্বাধীন করতে হবে না ?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ মা ৷ আমি জানি তোমার মতো মা আর হয় না ৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটা গান হয় না, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ওগো মা… তুমি হলে সেই মা ৷’