৩৭. মাতাল অবস্থায়

রফিকের ধারণা ছিল, মাতাল অবস্থায় লোকজন সত্যি কথা বলে। সে অবশ্যি মাতাল দেখেছে খুব কম। যাদের দেখেছে তাদের সবই কুলি বা রিকশাওয়ালা শ্রেণীর। এদের এক জন কাপড়াচোপড় খুলে মেয়েদের দিকে অশ্লীল ভঙ্গি করছিল। এতে আশপাশের পারলিক খেপে গিয়ে তাকে ধোলাই দিতে শুরু করে। সে হাতজোড় করে বারবার বলতে থাকে।–ভাই মাফ করেন। আর জীবনে মদ খামু না। এই কানো ধরলাম ভাই। দ্বিতীয় মাতালটি একটি ঠেলাগাড়ির উপর বসে বেশ করুণ সুরে গান গাচ্ছিল। ঠেলাওয়ালা সবাইকে হাসিমুখে বলতে—বলতে যাচ্ছে–ব্যাটা মদ খাইছে। ঠেলাওয়ালাকে খুব হাসিখুশি মনে হচ্ছিল। এক জন মাতাল তার গাড়িতে বসে সবার চিত্ত বিনোদনের চেষ্টা করছে, এটা বোধহয় তাকে খুব আনন্দ দিচ্ছিল। পারলিকও দৃশ্যটিতে মজাই পাচ্ছিল।

মাতালরা সত্যবাদী হয়, এ-রকম ধারণা হবার মতো কোনো কারণ রফিকের জানা ছিল না। তবু কেন জানি সে এটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরেই নিয়েছিল। ইদরিসের ব্যাপারটা সেই কারণে তাকে চিন্তায় ফেলে দিল। ব্যাটার মতলবটা কী?

বেশ কয়েক বার যাওয়া-আসা করেও তার মতলব পরিষ্কার হল না। বরং মনে হল সত্যি সত্যি ইদরিস রফিকের জন্যে কিছু করতে চায়। ব্যাঙ্কলোনের জন্যে ক্লান্তিহীন ছোটাছুটিও সে বেশ আগ্রহ নিয়ে করছে। তার চেয়েও অদ্ভুত কথা, মাতাল অবস্থায় ঐ রাতে সে যা বলেছে, তার কোনটিই দেখা গেল সত্যি নয়। ধারদেন তার একেবারেই নেই। মদ সে সপ্তাহে এক দিনই খায়, তাও নিজের পয়সায় নয়, অন্যদের পয়সায়।

কাঞ্চন বলে একটা মেয়ের অস্তিত্ব অবশ্যি আছে। কলগার্ল ধরনের মেয়ে। ইদরিস তার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে মেয়েটিকে প্রায়ই ক্লায়েন্টের কাছে পাঠায়। কাঞ্চন সেই উপলক্ষে মোটা কমিশন পায়। ব্যাপার এইটুকুই।

রফিক এক দিন বেশ অবাক হয়েই বলল, মাতল অবস্থায় তুই ডাহা মিথ্যা কথাগুলি বললি?

ইদরিস হাসিমুখে বলল, সত্যি কথা বলব আমি? পাগল হয়েছিস? ব্যবসা করে খাই না? সত্যি কথা বললে ভাত জুটবে?

ব্যবসায়ী হলেই সারাক্ষণ মিথ্যা কথা বলতে হবে?

তা তো হবেই। সত্যি কথাগুলিও এমনভাবে বলতে হবে, যাতে শুনলে মনে হবে মিথ্যা। হা হা হা। তারপর যখন ব্যবসা ফুলেফেপে বিশাল হয়ে যাবে, তখন কথাবার্তা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। তখন কথা বলবে ভাড়া-করা লোক। বুঝতে পারছিস?

এখনও পারছি না, তবে চেষ্টা করছি।

বিরাট ব্যবসায়ীরা দেখবি ব্যবসা নিয়ে একেবারেই কথাবার্তা বলে না। তারা কথাবার্তা বলে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে।

তাই নাকি?

তোকে এক দিন এ-রকম এক জনের কাছে নিয়ে যাব। বিড়ির বিজনেস করে লাল হয়ে গেছে। এখন রবীন্দ্রচর্চা করে। বিরাট এক প্রবন্ধও লিখেছে–রবীন্দ্রকাব্যে মুসলমানি শব্দ।

প্রশ্ন হয়েছে বলেই সে রবীন্দ্রচর্চা করতে পারবে না, এমন তো কোনো কথা নেই।

তা নেই। রবীন্দ্রচর্চা, পিকাসোচর্চা, সব চর্চার মূল হচ্ছে টাকা। এইটা থাকলে সব কলার চর্চা করা যায়।

ইদরিসের যোগাযোগ এবং কাজ করবার, কাজ গোছাবার কায়দা দেখে রফিক সত্যিকার অর্থেই মুগ্ধ। একটি পয়সা অ্যাডভান্স না দিয়ে সে মতিঝিলে রফিকের জন্যে দু কামরার এক অফিস জোগাড় করে ফেলল। টি এণ্ড টির বড়ো বড়ো কর্তব্যক্তিদের সঙ্গে সে কী বলল কে জানে তাঁরা আশ্বাস দিলেন এক মাসের মধ্যে টেলিফোন লাইন পাওয়া যাবে। ফানিচারের দোকান থেকে বাকিতে ফানিচার চলে এল। রফিক মুখ শুকনো করে বলল, আমার তো ভাই ভয়-ভয় লাগছে, সামাল দেব কী ভাবে?

সামাল দেওয়ার লোকও তোর জন্যে ব্যবস্থা করেছি। এই লাইনের মহা ঘাগু লোক। তোর নতুন ম্যানেজার। নাম হল সাদেক আলি। তবে ব্যাটাকে বিশ্বাস করবি না। তোর বিশ্বাস অর্জনের সব চেষ্টা সে করবে। তুইও ভাব দেখাবি যে বিশ্বাস করছিস, কিন্তু আসলে না।

এ-রকম একটা লোককে তুই আমার সঙ্গে গেঁথে দিচ্ছিস কেন?

তোর ভালোর জন্যেই দিচ্ছি। সাদেক আলি তোর ফার্মকে দাঁড় করিয়ে দেবে। যখন দেখবি তুই নিজে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছিস, তখন ব্যাটাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবি।

এটা কেমন কথা?

খুবই জরুরি কথা। নয়তো ব্যাটা তোর সর্বনাশ করে ভাগবে।

রফিক খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। সব কিছু হচ্ছে ঝড়ের গতিতে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? শেষ পর্যন্ত বড়ো রকমের ঝামেলায় পড়তে হবে না তো? আমিও যাবে ছালাও যাবে। তার ভরাড়ুবি কি আসন্ন?

এইসব কথাবার্তা সে অবশ্য বাসায় কিছুই বলে নি। শারমিনের সঙ্গেও নয়। শারমিনের সঙ্গে তার একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। সন্ধির কোনো রকম ইশারাও পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে দু জন দু দিকে ফিরে ঘুমায়। এই অবস্থায় ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা জমে না। তাছাড়া শারমিনের সন্দেহ-বাতিক আছে। এক লক্ষ প্রশ্ন করবে-কেন তোমার এই বন্ধু তোমার জন্যে এত কিছু করছে? তার স্বাৰ্থ কী? তোমার কত দিনের বন্ধু? কই, আগে তো তার নাম শুনি নি। তার আসল মতলবটা কী?

এই জাতীয় প্রশ্ন রফিকের মনেও আছে বলেই সে অন্য কারো মুখ থেকে শুনতে চায় না। তারচে যেভাবে এগোচ্ছে এগোক।

নীলুর সঙ্গে এক বার অবশ্যি কিছু কথা হয়েছে। তাও ভাসা-ভাসা কথা। যেমন একদিন রফিক বলল, Arrorn International নামটা তোমার কেমন লাগে ভাবী?

ভালোই লাগে।

এটা হচ্ছে আমার ফার্মের নাম।

ফাৰ্ম আবার কবে দিলে?

দিইনি। এখনও। দেব।

ও, তাই বল। এখনও পরিকল্পনার স্টেজে আছে।

হুঁ, তবে খুব শিগগিরই ড্রামাটিক একটা ডিক্লেরেশন আমার কাছ থেকে শুনতে পাবে। তখন আকাশ থেকে পড়বে।

তোমার সব ডিক্লোরেশনই তো ড্রামাটিক।

রফিক আর কিছু বলল না। বেশি কিছু বলতে সাহসও হল না। যদি ব্যাঙ্কলোন শেষ পর্যন্ত না পাওয়া যায়? তয়ী সাধারণত তীরে এসেই ডোবে। মাঝনদীতে ডোবে না।

রফিক চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাঙ্কলোন নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে তাঁর নতুন ম্যানেজার।–সাদেক আলি। ভালোমানুষের মতো চেহারা। মনে হয় বুদ্ধিবৃত্তি পুরোপুরি বিকশিত হয় নি। অথচ রফিক এর মধ্যেই বুঝেছে-এ মহা ধুরন্ধর।

সাদেক আলিকে নিয়েও রফিক সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় ভোগে। তার রাতে ভালো ঘুম হয় না। বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই দুঃস্বপ্নগুলিরও কোনো আগামাথা নেই। একটা স্বপ্ন ছিল এ-রকম–সে এবং সাদেক আলি প্ৰাণপণে ছুটিছে। দুজনের গায়েই কোনো কাপড় নেই। তাদের তাড়া করছে বাবলুর বয়েসী একদল ছেলে। সাদেক আলি বারবার বলছে—-এরা বড় যন্ত্রণা করছে। স্যার, বন্দুক দিয়ে একটা গুলী করেন।

এই জাতীয় স্বপ্নের কোনো মানে হয়?

 

হোসেন সাহেব বসার ঘরে ঢুকে দেখলেন মাঝবয়েসী এক জন অপরিচিত লোক বসে আছে। লোকটি খুব কায়দা করে সিগারেট টানছে এবং পা নাচাচ্ছে। হোসেন সাহেবকে দেখে সিগারেট ফেলে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিস্মিত হোসেন সাহেব বললেন, জনাব, আপনার নাম?

স্যার, আমার নাম সাদেক আলি।

বলতে-বলতে লোকটি এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। তিনি হকচকিয়ে গেলেন। বিব্রত কণ্ঠে বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না!

আমি দি অ্যারনইন্টারন্যাশনালের জেনারেল ম্যানেজার।

ও, আচ্ছা আচ্ছা।

স্যার কি আছেন?

শফিক তো চিটাগাং গিয়েছে।

আমি রফিক স্যারের কাছে এসেছিলাম।

ওর কাছে কী জন্যে?

দি অ্যারন ইন্টারন্যাশনালের ব্যাঙ্কলোন পাওয়া গেছে, এই সুখবরটা স্যারকে দেবার জন্যে এসেছিলাম।

হোসেন সাহেব কিছুই বুঝলেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

বেশিক্ষণ বসতে পারব না। স্যারকে খবরটা দিয়ে দেবেন। স্যার এটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন।

কী খবর দেব?

বলবেন, ব্যাঙ্কলোনটা হয়েছে।

জ্বি আচ্ছা, বলব। একটু চা খান।

চা আমি খাই না, তবে আপনি মুরুরি মানুষ বলছেন, এই জন্যই খাব।

সাদেক আলি কিছুক্ষণের মধ্যেই জমিয়ে ফেলল। হোসেন সাহেবের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হল যে, দেশ থেকে এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা তুলে দেওয়া দরকার। প্রতি ডিসটিক্টে থাকা দরকার একটা করে হোমিও হাসপাতাল। দরকার একটি হোমিও ইউনিভার্সিটির হোসেন সাহেব লোকটির আদব-কায়দা ও ভদ্রতায় মুগ্ধ হলেন। রাতে ভাত খাবার সময় নীলুকে বললেন, ম্যানেজার সাহেব বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

কোন ম্যানেজার?

সাদেক আলি সাহেব। রফিকের কাছে ব্যাঙ্কের কী-একটা কাজে এসেছে। আমার তো মা মনে থাকবে না। তুমি রফিককে বলে দিও।

কী বলব?

ম্যানেজার সাহেব এসেছেন, এটা বললেই হবে।

রফিক এল রাত এগারটার দিকে। সে হাসপাতালে কবির মামাকে দেখতে গিয়ে আটকা পড়ে গিয়েছিল। কবির মামার জ্বর হঠাৎ বেড়ে গেছে। আরোলতাবোল কথা বলছেন। অনেকটা বক্তৃতার ঢং সাধু ভাষার বক্তৃতা-সুধী সমাজের নিকট আকুল আবেদন। হে বন্ধু হে প্রিয়। সংযত হোন। বন্ধ করুন। শরৎকালের এই সুন্দর মেঘমুক্ত প্রভাত–

রফিক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ব্যাপার কী? মাঝবয়েসী এক জন ডাক্তার শুকনো মুখে বললেন, বুঝতে পারছিনা, ডিলেরিয়াম মনে হচ্ছে। ডিলেরিয়াম হবার মতো জ্বর তো নয়। এক শ দুই।

কিছু একটা করুন। মামার এই কুৎসিত বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে না। হাসি এসে যাচ্ছে। এখানে হাসা ঠিক হবে না।

ডাক্তার বিরক্ত মুখে তাকালেন।

আপনি রোগীর কে হন?

ভাগ্নে হই।

আমার মনে হয়, রোগীকে বাড়ি নিয়ে ফ্যামিলির কেয়ারে রাখাই ভালো।

শেষ অবস্থা নাকি?

কী ধরনের কথা বলছেন? শেষ অবস্থা হবে কেন?

এখনি বাড়ি নিয়ে যেতে বলছেন। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।

কাল-পরশু নিয়ে যান।

সেখানে যদি এ-রকম বক্তৃতা শুরু করেন, তখন কী করব?

ডাক্তার সাহেব বেশ কিছু সময় কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, দয়া করে আমার সঙ্গে রসিকতা করবেন না। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।

বাইরে তো বসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

বসার ব্যবস্থা না-থাকলে হাঁটাহাঁটি করুন।

রফিক আর কথা বাড়াল না। হাসপাতালের বারান্দায় রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল। ফেরার আগে দেখে এল কবির মামা শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। এখন সে বাড়ি চলে গেলে দোষ হবে না।

দরজা খুলে দিল শারমিন। শারমিনের মুখ গভীর। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে হাই চাপতে-চাপতে বলল, খাবে? না খেয়ে এসেছ?

রফিক তার জবাব না দিয়ে বাথরুমে ঢুকল। তাদের দুজনের মধ্যে এখন কথাবার্তা প্ৰায় নেই বললেই হয়। প্রায় রাতেই রফিক বাড়ি ফিরে দেখে শারমিন ঘুমিয়ে পড়েছে। আজই ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। এখনও জেগে আছে।

শারমিন তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। রফিককে তোয়ালে এগিয়ে দিতে-দিতে বলল, ভাত খাবে?

হ্যাঁ, খাব। তোমার থাকার দরকার নেই, ঘুমিয়ে পড়। যা হয় আমিই ব্যবস্থা করব।

তোমাকে একটি কথা বলার জন্যে জেগে আছি।

বল।

খেতে বস, বলছি।

সিরিয়াস কিছু?

না, খুবই সাধারণ! তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা কী বলব?

খুবই সাধারণ কথাগুলি রফিক শুনল। হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। শারামিনের রক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে সে পি-এইচ.ডি করার জন্যে দেশের বাইরে যাবে। খাওয়া এবং ঘুমানোর এই রুটিন তার আর ভালো লাগছে না।

রফিক হাত ধুতে-ধুতে বলল, যাবে কী ভাবে?

শারমিন বলল, অন্য সবাই যেভাবে যায় সেইভাবেই যাব। প্লেনে করে। হোটে-হেটে যাওয়া তো সম্ভব নয়।

সব ঠিকঠাক নাকি?

মোটামুটি ঠিকঠাক বলতে পার। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফরেন স্টুডেন্ট এ্যাডভাইজার আমাকে একটা চিঠি দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, আমার একটা টিচিং এ্যাসিসটেন্টশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

চিঠি কিবে এসেছে?

সপ্তাহখানেক আগে।

এই এক সপ্তাহ বসে-বসে ভাবলে?

হ্যাঁ। আমি ঘুমুতে গেলাম। তুমি বাতি নিবিয়ে এস।

রফিক বসার ঘরে দীর্ঘ সময় বসে রইল। এক বার ভাবছিল জিজ্ঞেস করবে।–ব্যবস্থা কে করে দিলেন, সাব্বির সাহেব? শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। সাব্বির প্রসঙ্গে সে কোনো দিন কিছু বলবে না, এ-রকম প্রতিজ্ঞা এক বার করেছে। প্রতিজ্ঞা করা হয় প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্যেই। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা সে ভাঙবে না। তার চা খেতে ইচ্ছে করছে। রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই বানিয়ে নিতে পারে, কিন্তু আলসে লাগছে। ঘুম-ঘুমাও পাচ্ছে, যদিও সে জানে বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম পালিয়ে যাবে। তার পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমুবে শারমিন। তার গায়ে হাত রাখলে ঘুমের ঘোরেই সে হাত সরিয়ে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলবে— আহা! তারচে এখানে বসে-বসে মশার কামড় খাওয়াই ভালো।

অনেক রাতে নীলু টুনিকে বাথরুম করবার জন্যে দরজা খুলল!

কী ব্যাপার রফিক, জেগে আছ যে?

ঘুম আসছেনা ভাবী।

গ্রামার কাছে কে যেন এসেছিল। কী এক স্যানেজার। বাবার সঙ্গে গল্প

করছিল।

রফিক কোনো রকম উৎসাহ দেখাল না। ক্লান্ত গলায় বলল, শারমিন তোমাকে কি কিছু বলেছে ভাবী?

কোন প্রসঙ্গে?

বাইরে যাবার ব্যাপারে।

না তো! কোথায় যাচ্ছে?

রফিক জবাব না দিয়ে উঠে পড়ল। বাতি নেভাতে-নেভাতে বলল সকালে বলব।

যা ভাবা গিয়েছিল তাই। ঘুম আসছেনা। পাশেই শারমিন। গায়ের সঙ্গে গা লেগে আছে, তবুও দু জনের মধ্যে অসীম দূরত্ব। এই দূরত্বকে কমানোর কোনোই কি উপায় নেই? রফিক ছোট্ট, নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বুজল। কবির মামার কথাটা ভাবীকে বলা হয় নি। তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। ঝামেলার উপর ঝামেলা।

রফিক একটু লজ্জিত বোধ করল। নিজের সমস্যাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্য সব এখন ঝামেলা।

নীলুও জেগে আছে। শফিক বাড়িতে না থাকলে তার এ-রকম হয়। সারাক্ষণ একটা চাপা ভয় বুকের উপর বসে থাকে। মনে হয় এ বাড়িতে যেন কোনো পুরুষমানুষ নেই। বড়ো কোনো বিপদ-আপদ হলে কে সামলাবে? হয়তো আগুন লেগে গেল, চোর এল বাড়িতে, কিংবা ডাকাত পড়ল। তখন কী হবে? নীলু মাঝে মাঝে ভাবে সব মেয়েরাই কি তার মতো ভাবে? এই নির্ভরশীলতার কারণটা কী?

টুনি শক্ত করে তার গলা চেপে ধরে আছে। ফাঁসের মতো লাগছে। বিশ্ৰী অভ্যাস মেয়েটার। ঘুমের সময় হাতের কাছে যা পাবে তাই শক্ত করে ধরবে। নীলু ক্ষীণ স্বরে বলল, টুনি ঘুমাচ্ছিস?

টুনি জবাব দিল না।

হাতটা একটু আলগা কর মা। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

টুনি আরো শক্ত করে গলা চেপে ধরল। ঘুমের ঘোরেই বলল, কমলা খাব না। বললাম তো খাব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *