1 of 2

৩৭. বিরাহিমপুর গ্রামটি একেবারে জনশূন্য

বিরাহিমপুর গ্রামটি একেবারে জনশূন্য। এ গ্রামের কিছু বাড়ি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত, দু-একটিতে এখনো ধিকিধিক আগুন জ্বলছে। যেসব বাড়িতে আগুনের স্পর্শ লাগেনি, সেখানেও আছে তাণ্ডবের চিহ্ন, যেন একপাল ক্রুদ্ধ দৈত্য সব কিছু তছনছ করেছে। শিশুদের ক্ৰন্দন বা হাস্যমুখর প্রাঙ্গণগুলিতে এখন শুধু বসে আছে ছন্নছাড়া, বিস্মিত দু-একটি বিড়াল বা কুকুর। এই দুটি প্রাণী মানুষের সঙ্গ ছাড়া বাঁচতে পারে না। অকস্মাৎ মনুষ্য-পরিত্যক্ত হওয়ায় তারা হতভম্ব; মাঝে মাঝে শোনা যায় তাদের অদ্ভুত করুণ ডাক।

এ গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা দূরের গ্রামগুলির দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিছু সক্ষম জোয়ান পুরুষ আশ্রয় নিয়েছে পাতিসরের জঙ্গলে। উজানী নদীর দক্ষিণ দিকে এই জঙ্গল খুব প্রাচীন নয়। এককালে পাতিসর নাকি ছিল বেশ সমৃদ্ধ এক জনপদ, কোনো এক সময় মারাত্মক বিসূচিকা রোগ সেখানে মহামারী রূপে দেখা দেয়। প্ৰতিদিন একশো-দেড়শো করে চিতা জ্বলতো, তারপর আর চিতা জ্বালাবার লোক পাওয়া যায়নি। যারা প্ৰাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিল তারা তো কেউ আর ফিরে আসেইনি, বহু বৎসর ধরে ভয়ে কেউ আর পাতিসারে পা দিত না। পরিত্যক্ত সেই জনপদে ধীরে ধীরে গজিয়ে ওঠে জঙ্গল। এখনো সেখানে দেখা যায় ইতস্তত কিছু কিছু গৃহের ভগ্নস্তূপ। বিষধর সাপ আর হিংস্র পশু সেখানে বাসা বেঁধে আছে।

পাতিসরের জঙ্গলে পলাতকদের মধ্যে রয়েছে গঙ্গানারায়ণ। তাকে এখন দেখায় কোনো দসু্যু দলপতির মতন, তার হাতে বন্দুক। নীলকর সাহেবরা যখন তাদের কাছারি বাড়িতে আগুন দিতে আসে, তখন নায়েব ভুজঙ্গ ভটচাজ চম্পট দেবার আগে এই সাবেকী বন্দুকটা সঙ্গে নিয়ে নিয়েছিল। গোঁয়ারের মতন গঙ্গানারায়ণ চেয়েছিল তখনই প্রতিরোধ করতে, কিন্তু ভুজঙ্গ ভটচাজ সে সময় তাকে। উচিত পরামর্শই দেয় যে, সাহেবদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে নামা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভুজঙ্গ ভট্টচাজ। অবশ্য ওই জঙ্গলে আশ্রয় নেয়নি, সে সপরিবারে এই জেলা ছেড়েই চলে গেছে। বন্দুকটা এবং কিছু কার্তুজ রয়ে গেছে গঙ্গানারায়ণের কাছে।

 

চারপাশ ঘন গাছপালায় ঘেরা একটি ভগ্ন গৃহের চাতালে আস্তানা গেড়েছে গঙ্গানারায়ণ। তার সঙ্গে রয়েছে জনা পনেরো বলিষ্ঠকায় চাষী। একটি ব্যাপারে গঙ্গানারায়ণ রীতিমতন বিস্মিত। তারই জন্য বিরাহিমপুর গ্রামে যে এমন বিপদ ও বিপর্যয় নেমে এলো, সেজন্য কেউ কিন্তু তাকে দুষছে না। বরং গঙ্গানারায়ণের প্রতি তাদের সমীহ অনেক বেড়ে গেছে। এই জন্য যে, সে সর্বসমক্ষে একজন সাহেবকে প্রহার করেছে। কয়েক পুরুষ ধরে তারা মার খেয়ে শুধু সহ্য করতেই শিখেছিল। এই প্রথম দেখলো একজন অন্তত অত্যাচারীকে ভূপাতিত হতে। ম্যাকগ্রেগর সাহেব একেবারে যমের দোসর, তার গায়েও হাত দিয়েছে গঙ্গানারায়ণ।

বস্তুত, বিরাহিমপুর গ্রামে এ আগুন জ্বলতেই, গঙ্গানারায়ণ যেন নিমিত্ত মাত্র। এই অঞ্চলের চাষীরা একেবারে বদ্ধপরিকর হয়েছিল যে এ বৎসর তারা কিছুতেই নীল চাষ করবে না। ভিতরে ভিতরে তারা ধূমায়িত হচ্ছিল, গঙ্গানারায়ণ শুধু আগুনের শিখাটি জ্বেলে দিয়েছে। বিঘা প্রতি দাদন মাত্র দুটি টাকা, অথচ নীল উৎপাদনের ব্যয় তার চেয়ে বেশী। এর পরও আছে প্ৰতি পদে পদে নীলকুঠির কর্মচারীদের উৎকোচ। উৎপাদন বেশী হলেও ফাজিলটুকু যাবে সাহেব ও তাদের কর্মচারীদের উদরে আর উৎপাদন কম হলে বা নীলফসলের মান নিকৃষ্ট হলে সহ্য করতে হবে বেদম প্রহার, ধারাবাহিক অত্যাচার, ঘরে যুবতী স্ত্রী বা কন্যা থাকলে তার শরীর দিয়ে মেটাতে হবে ঘাটতি। যে অবস্থায় হেলে সাপও ফণা তোলে, চাষীরা সেই অবস্থায় পৌঁছেচে।

গঙ্গানারায়ণের কাছে বন্দুক থাকায় লুক্কায়িতদের বুকে এসেছে বিপুল বল। তারা জানে, নীলকরদের কুঠিতেও একটি মাত্র বন্দুক আছে, সুতরাং তারা গঙ্গানারায়ণের নেতৃত্বে কুঠি আক্রমণ করলে সাহেবদের এবার একেবারে ঝাড়ে বংশে নির্বংশ করে দিতে পারবে। বনের মধ্যে দু-তিনদিন থাকার পরই তারা ক্রমশ এই পরিকল্পনায় উত্তেজিত হতে লাগল। তারা শুধু তাদের গ্রাম, বড়জোর পরগণাটুকুর কথা চিন্তা করে, বাকি পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই তাদের কাছে।

গঙ্গানারায়ণ অবশ্য রূপকথার গল্পের নায়ক হতে চায় না। তার মস্তিষ্ক অনেক ঠাণ্ডা, রুল অব ল-তে তার এখনো দৃঢ় বিশ্বাস। তার হাতে একটি বন্দুক আছে বটে কিন্তু বন্দুক চালনায় তার দক্ষতা নেই। এই চাষা-ভুষোর দল প্রত্যেকেই হাতে একটা করে ডাণ্ডা বা লাঠি নিয়েছে বটে কিন্তু নীলকুঠির সুশিক্ষিত লাঠিয়ালদের তুলনায় এরা কিছুই না। এদের নিয়ে হই হই করে নীলকুঠি আক্রমণ করা কাজের কথা নয় মোটেই। ধরা যাক, যদি বা এখানকার নীলকুঠি দখল করেই নেওয়া যায়, তাতেই বা কী লাভ হবে?

 

গঙ্গানারায়ণের এখনো ধারণা, আইনের আশ্রয় নিয়েই চাষীরা নিজস্ব জমিতে ইচ্ছামত চাষের অধিকার ফিরে পেতে পারে। শুধু সেই আইনের কাছে একবার পৌঁছোনো দরকার। নীলকর সাহেবরাও এ কথা জানে বলে দরিদ্র হীনবল চাষীদের ওপর হাজার রকম অত্যাচার চালিয়ে পদানত করে রাখে যাতে তারা আইনের আশ্রয়ে পৌঁছোতে না পারে।

ম্যাকগ্রেগর এবং তার চ্যালা-চামুণ্ডারা বিরাহিমপুর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, এটা বেআইনী কাজ। এর উত্তরে রাতের অন্ধকারে দলবল নিয়ে রূপকথার নায়কের মতন গঙ্গানারায়ণও যদি নীলকুঠি আক্রমণ করে তবে সেটাও হবে একটা বেআইনী কাজ। অত্যাচারিতেরও অধিকার নেই আইনের বিচারভার স্বহস্তে গ্ৰহণ করার। তবে আগেকার তুলনায় অন্তত একটি বিষয়ে গঙ্গানারায়ণ দৃঢ় নিশ্চিত হয়েছে, চোখের সামনে কোনো অন্যায় সঙ্ঘটিত হতে দেখলে তখুনি তার প্রতিবাদ করতে হবে। পরে কখন বিচার হবে এই জন্য অন্যায় সহ্য করে গেলে মনুষ্যত্বের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সেইজন্যই সে ম্যাকগ্রেগরের চাবুক সহ্য করেনি।

সঙ্গে কিছু চাল-ডাল যে যা পারে নিয়ে এসেছিল, তাই ফুটিয়ে কোনো রকমে ক্ষুন্নিবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু যে সব মানুষ মরীয়া হয়ে সর্বস্ব খোয়াবার ঝুঁকি নিয়েছে, তারা কখনো চুপ করে বসে থাকতে পারে না। কিছু একটা করার জন্য, এমন কি সর্বনাশের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যও তারা চঞ্চল।

গঙ্গানারায়ণ ঠিক করলো, আগে এই এলাকার থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আইন প্রয়োগের ভার পুলিসের হাতে, পুলিস মঙ্গে নিয়ে সবাই মিলে আবার গ্রামে ফিরবে। তখন যদি নীলকর সাহেবরা আবার ধেয়ে আসে, তখন তাদের মোকাবিলা করবে পুলিসের সেপাইরা। থানা আছে কালীগঞ্জে, পাতিসর জঙ্গল পার হয়ে সেখানে যাওয়া যায়।

গঙ্গানারায়ণের সঙ্গীরা তাকে অনেকভাবে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলো। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে পুলিস ফৌজ তাদের মতন সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসবে। পুলিস বরাবর জমিদারের স্বার্থরক্ষা করে এসেছে আর নীলকর সাহেবরা তো পুলিশের বাপ। কোনো সাহেবের গায়ে কোনো দেশী পুলিস সেপাই কখনো হাত তুলতে পারে? এটা অসম্ভব কথা নয়?

গঙ্গানারায়ণ কোনো কথা শুনলো না, সে যাবেই। অবশ্য সে পথ চেনে না। এক যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু তার সঙ্গে কে যাবে? শেষ পর্যন্ত তোরাপ বলল, লয়েন কত্তা, মুই আপনেরে রাস্তা দেখামু। মরলে আপনার লগে এক সাথে মরুম!

বন্দুকটা উঁচু একটি বৃক্ষচুড়ায় লুকিয়ে রেখে রাতের অন্ধকারে জঙ্গল থেকে বেরুলো গঙ্গানারায়ণ আর তোরাপ। উজানী নদীর ধার ঘেঁষে উত্তর দিকে গেলেই কালীনগর পড়বে। এই কালীনগরে তোরাপের এক ফুফাতো ভাই থাকে। আগে তার কাছে গিয়ে ওরা জেনে নেবে এদিককার হালচালের সন্ধান।

ওরা যখন পৌঁছেলো তখন কালীনগর গঞ্জটি ঘুমন্ত। এমনই চুপচাপ, নিঃসাড় যে ঘুমন্তের বদলে মৃত বলে ভ্ৰম হয়। তোরাপের পিসীর সন্তানকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। সেখান থেকে জানা গেল কালীনগরের অনেক যুবকই গা ঢাকা দিয়েছে। নীলকর সাহেবরা এখানেও খুব জোর-জুলুম শুরু করেছে। গঙ্গানারায়ণ একটুখানি দমে গেল। কালীনগরে থানা আছে। সেখানে পুলিসের নাকের ডগার ওপরেই যদি এ রকম কাণ্ড হয়, তা হলে আর ভরসা কোথায়?

তোরাপ চাইলো জঙ্গলে ফিরে যেতে। জঙ্গলই একমাত্র নিরাপদ স্থান। সেখানে নীলকর কিংবা পুলিস কেউই যায় না। গঙ্গানারায়ণ একটা খিরিশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর সে সিদ্ধান্ত নিল একবার অন্তত থানার দারোগার সঙ্গে দেখা করা দরকার। অসহায়, অশিক্ষিত গ্রামবাসীরা সরকারের নতুন নির্দেশেব কথা কিছুই জানে না, তারা কিছু দাবি করে না বলেই পুলিস থেকেও তাদের অধিকার সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা হয় না। অথচ হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় গঙ্গানারায়ণ পড়েছে যে কৃষকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও জোরজুলুম করে নীল চাষ চালাবার পক্ষপাতী নয় সরকার।

কালীনগর থানার দ্বারের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে একটি মশাল, পাশে বশ্য হাতে নিয়ে বসে বসে ঢুলছে একজন সিপাহী। গঙ্গানারায়ণ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সিপাহীটি জেগে ওঠার পর গঙ্গানারায়ণের বক্তব্য শুনে সে বাড়িয়ে দিল বাম হস্তটি। অর্থাৎ কিছু দর্শনী বা পার্বণী না দিলে দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অনেক বাক-ধস্তাধস্তির পর শেষ পর্যন্ত তাকে ভবিষ্যতে কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিলে সে গা মোচড়া-মুচড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

দারোগাবাবুর বাসগৃহ সন্নিকটেই। গায়ে একটা মলিদা জড়িয়ে তিনি একজন গৃহস্থ ভদ্রলোকের মতন সেজবাতির আলোকে একটি ইংরেজী গ্ৰন্থ পাঠ করছিলেন। এই রাতে আগন্তুকদের দেখে তিনি খেকিয়ে উঠলেন না বা সেপাই ডেকে ফাটকে পুরে দেবার আদেশ দিলেন না। গ্রন্থটি মুড়ে রেখে তিনি একটি সক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কী, ঘর পুড়িয়েচে তো? কোন গা? ক বছরের দাদন? এলাকা চাষ, না বে-এলাকা?

গঙ্গানারায়ণ বিনীতভাবে বললো, আজ্ঞে, গোটা গ্রামেই আগুন জ্বালিয়ে দিয়েচে। গাঁয়ের নাম বিরাহিমপুর। ওদের অত্যোচারে গাঁয়ে আর একটাও মানুষ নেই।

দারোগাবাবু বলেন, বসো, ওখেনেই বসে পড়ো, তারপর বলো। প্ৰাণ খুলে বলে। কত আর শুনবো, এই নিয়ে আজ পাঁচজন এলো।

তোরাপ দাঁড়িয়ে আছে বাইরের অন্ধকারে শরীর মিশিয়ে, সে দারোগাবাবুকে দেখাই দেয়নি। গঙ্গানারায়ণ উবু হয়ে বসলো, তারপর বললো, আমি হিন্দু পেট্রিয়ট কাগচে একটা খবর পড়িচি…। দারোগাবাবুর দৃষ্টি তখনও সামনের বইটির ওপর ন্যস্ত ছিল, এবার তিনি চমকিত হয়ে মুখ তুললেন। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়োচো বললে? কে তুমি? তুমি কি চাষী? গঙ্গানারায়ণ বললো, না, আমি চাষী নই বটে, তবে কয়েকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আপনি যদি সবিস্তারে শোনেন–

সেজবাতিটি উঁচু করে তুলে গঙ্গানারায়ণের মুখের সামনে ধরে দারোগাবাবু বললেন, তুমি-তুই-গঙ্গা না?

এবার গঙ্গানারায়ণেরও স্তম্ভিত হওয়ার পালা। সেও দারোগার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো।

দারোগাবাবু বললেন, তুই-গঙ্গা-আমাদের গঙ্গানারায়ণ নোস? গলার স্বর শুনেই কেমন কেমন বোধ হচ্ছিল। আমায় চিনতে পাচ্ছিসনি? আমি ভগীরথ। হিন্দু কলেজে আমরা একসাথে পড়তুম, মধু, রাজনারায়ণ, ভূদেব, বেণী, গৌর-আমার বাড়ি থেকে ভূদেবের বাড়ি খুব কাচেই—।

এবার গঙ্গানারায়ণের মনে পড়লো। এই মধ্যবয়স্ক, স্ফীতোদর, গুম্ফবান ব্যক্তিটি তার সহপাঠী ভগীরথই বটে। তবে ছাত্র হিসেবে তার তেমন চাকচিক্য ছিল না বলে সে ঠিক গঙ্গানারায়ণের বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল না।

ভগীরথ বললো, এ কী চেহারা করিচিস তুই? খালি গা, খালি পা…তোর মতন বংশের সন্তান-তোদের বাড়িতে কত খেয়েচি! কী ব্যাপার বলা তো! এ কী বিচিত্র বিধিলিপি, এমনভাবে, এমন অবস্থায় তোর সঙ্গে দেকা হবে–।

গঙ্গানারায়ণ কিছু বলতে শুরু করার আগেই ভগীরথ আবার বললো, থাম, থাম! বিরাহিমপুরে এক ইণ্ডিগো প্ল্যান্টারকে একজন কেউ মেরেচে, সে কি তুই? ওরে বাপ রে বাপ! তা নিয়ে যে হুলুস্থুলু পড়ে গ্যাচে রে! সিংগীবাড়ির এক ছেলে এই কীর্তি করেচে, এমন শুনিচিলুম বটে, কিন্তু তুই কখনো কারুর গায়ে হাত তুলিবি, সে যে অকল্পনীয়!

গঙ্গানারায়ণ এবার সব বৃত্তান্ত খুলে বললো। মাঝখানে বার বার বাধা দিচ্ছিল ভগীরথ। সে এ ব্যাপারের অনেক কিছুই জানে। সব শুনে সে বললো, গঙ্গা, আমার হাত-পা বাঁধা। তোকে দেকলে অ্যারেস্ট করার কতা! ইণ্ডিগো প্ল্যাণ্টারদের কতখানি প্ৰতাপ এদিকে তুই জানিস না, তুই তো মাত্তর একজন দুজনকে দেকিচস।

গঙ্গানারায়ণ বললো, তুই বারাসতের হাকিমের পরোয়ানার কতা কিছু শুনিসনি? তিনি থানার দারোগাদের নির্দেশ দিয়েচেন—।

ভগীরথ বললো, শুনিচি, সব শুনিচি। ঐ হাকিমের বদলি হলো বলে! অমন দু-একটা আইডিয়ালিস্ট ছোঁকরা সদ্য বিলেত থেকে এসে এখানকার নেটবদের হেল্প কত্তে চায়। তারপর ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরে বদলি হয়ে কয়েক বচর পড়ে থাকার পরই তাদের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ঐ বারাসতের আরও দুজন হাকিম এমনধারা চাষীদের সাপোর্ট কত্তে গেসলো। তারাও বদলি হয়ে গ্যাচে!

গঙ্গানারায়ণ বললো, কিন্তু দেশের এত চাষীকে জমি ছাড়া করে সরকারের কী লাভ? নীলকরদের স্বার্থরক্ষা করবার জন্য সরকার কি নিজের ক্ষতি করবে?

ভগীরথ বললো, এ নীলের বাণিজ্যে অনেক সরকারী হোমরা-চোমরার স্বাৰ্থ আচে। তোকে আরো একটা কতা বলি, এই জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ঐ ম্যাকগ্রেগরের কতায় ওঠেন বসেন। মাসে দুবার তিনি ম্যাকগ্রেগরের কুঠিতে আসেন খানা খেতে। লোকে বলে ম্যাকগ্রেগরের ওয়াইফের সঙ্গে নাকি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের রোমান্স চলচে অনেকদিন। তুই এই জেলায় বসে ম্যাকগ্রেগরের বিরুদ্ধে দাঁড়াবি কী করে? চাষীদের মারধোর খাওয়া কিংবা এ ধরনের অত্যাচারের অভ্যেস আচে, কিন্তু তুই এর মধ্যে জড়ালি কেন? তোকে পেলে ওরা তো একেবারে শেষ করে দেবে!

গঙ্গানারায়ণ একটু রেগে গিয়ে বললো, তুই বলতে চাস, এ সব অত্যোচারের কোনো প্ৰতিকার নেই! তা হলে তোরা রয়িচিস কেন? কুইনের প্রোক্লামেশানের পর প্রজা হিসেবে একজন নীলকর আর একজন চাষীর তো সমান অধিকার।

ভগীরথ হেসে উঠে বললো, তুই এখুনো তেনিই রয়ে গেচিস, গঙ্গা! ইমপ্র্যাকটিক্যাল, রোমাণ্টিক–। বিজয়ী আর বিজিত মানুষ কখুনো সমান হয়? সাহেবরা কি আমাদের মানুষ বলে মনে করে?

হাসি থামিয়ে আবার গম্ভীর হয়ে গেল ভগীরথ। মুখে একটা ম্লান ছায়া পড়লো। আস্তে আস্তে বললো, এতকাল পর তোর সঙ্গে দেখা, কত কী মনে পড়চে, কিন্তু প্ৰাণ খুলে যে তোর সঙ্গে দুটো কতা কইবো, এখুন সে সময় নেই। তুই আমার এখেনে এসেছিলি, এ কতা পাঁচ কান হলেই আমার গর্দান যাবে। তোকে আমি এক পরামর্শ দিচ্চি, শোন। এই রাতেই তুই নৌকো ধরে কেষ্টনগরের দিকে পাড়ি দে। তারপর যত শিগগির সম্ভব কলকেতায় চলে যা। একমাত্র কলকেতায় গেলেই তুই নীলকরদের ক্ৰোধ থেকে বাঁচতে পারবি। আমি তোর জন্যে নৌকের ব্যবস্থা করে দিচ্চি।

গঙ্গানারায়ণ বিবৰ্ণ মুখে বললো, আমি পালাবো?

ভগীরথ বললো, তা ছাড়া তুই এখেনে আর কী করবি? এখেনে তোর প্রাণ সংশয়। আমি মিথ্যে মিথ্যে তোকে ভয় দেখাচ্চিনি, একজন মানুষকে গুমখুন করা ওদের পক্ষে কিচুই না।

গঙ্গানারায়ণ একটুক্ষণ নীরব রইলো। বিরাহিমপুরের চাষীদের ভাগ্যের সঙ্গে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। এখন সে ওদের ছেড়ে শুধু নিজের প্রাণ বাঁচাবে?

ভগীরথ বললো, আর দেরি করিসনি, গঙ্গা, গা তোল, এই রাতের মধ্যেই তোকে কেষ্টনগর পৌঁচে যেতে হবে!

গঙ্গানারায়ণ অস্ফুট কণ্ঠে বললো, আমি এসেচিলুম ভাগ্যহত চাষীদের পক্ষ নিয়ে বলবার জন্য। যদি তাদের প্রতি অন্যায়ের কোনো প্ৰতিকার করতে পারি। এখন তাদের সেই একই অবস্থায় ফেলে রেখে আমি চলে যাবো?

ভগীরথ বললো, চাষীদের তুই সাহায্য কত্তে চাস, বেশ তো ভালো কতা। এখেনে তুই কী করবি ওদের জন্য? বেশ তো কালকেতায় গিয়ে তুই ওদের হয়ে লড়ে যা। যদি মামলা কত্তে চাস কলকেতায় সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে মামলা দায়ের কর। সাহেবদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা কি মফস্বলে হয়? তুই এটাও জনিস না? ওদের সাহায্য কত্তে গেলে তোকে কলকেতায় যেতেই হবে!

গঙ্গানারায়ণ একবার ভাবলো, এটাই বোধ হয় একমাত্র পন্থা। তোরাপকে দিয়ে সে চাষীদের কাচে খবর পাঠিয়ে দেবে। কলকাতায় মামলা দায়ের করে সেখান থেকে সে সাহায্য পাঠাবে।

পরীক্ষণেই গঙ্গানারায়ণের সারা শরীরটাতেই একটা ঝাঁকুনি লাগলো। আবার প্রতিশ্রুতি? কয়েক বছর আগে সে এ রকমই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারপর মধ্যরাত্ৰে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আবার সে ওদের এই অবস্থায় ফেলে চলে গেলে আর ওরা তাকে বিশ্বাস করবে? কলকাতায় গেলে তার নিজেরই কোন রূপান্তর ঘটবে কে জানে!

সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, না, ভগীরথী, আমার কলকাতায় যাওয়া হবে না এখন। আমি ওদের সঙ্গেই থাকবো।

আরও কিছুক্ষণ ধরে নানান যুক্তি দেখিয়েও ভগীরথ আর টলাতে পারলো না গঙ্গানারায়ণকে। গঙ্গানারায়ণ বাইরে বেরিয়ে এসে বললো, কই তোরাপ, চল রে!

ভগীরথও বেরিয়ে এলো বাইরে। জমিদারনন্দন গঙ্গানারায়ণের এই পরিবর্তন এখনো যেন সে ঠিক হৃদয়ঙ্গম করত পারলে না। গঙ্গানারায়ণকে চলে যেতে দেখে সে বললো, গঙ্গা, এই শীতের রাতে তুই যাবি-তোর খালি গা, এটা তুই অন্তত নে।

নিজের অঙ্গ থেকে শীতবস্ত্র খুলে সে তুলে দিল গঙ্গানারায়ণের হাতে। গঙ্গানারায়ণ এতে আর আপত্তি করতে পারলো না। অবিলম্বেই সে আর তোরাপ আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *