সপ্তত্রিংশ অধ্যায় – নরকাসুরের উৎপত্তি
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–হে দ্বিজবরগণ! অনন্তর বহুদিনের পর বিদেহদেশাধিপতি বলবান, সকল-রাজগুণসম্পন্ন, রাজনীতিজ্ঞ, সত্যবাদী, সৎস্বভাব, চতুর, ব্রহ্মতেজস্বী, স্থিরচেতা, শুদ্ধ, দেব-দ্বিজ-গুরুগণের সেবায় সর্বদা তৎপর, প্রজাগণের পিতার ন্যায় পরিপালক জনক নামে রাজা ছিলেন। ১-৩
জনক, কাল অতীত হইলেও পুত্রসন্তান উৎপন্ন না হওয়ায় একদা বিমনা হইয়া চিন্তা করিতে আরম্ভ করিলেন। ৪
রাজা জনক, একদিন নারদ মুনির মুখে শুনিলেন, মহাত্মা দশরথ রাজা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করিয়া বার্ধক্যে মহাবীৰ্য্যবান পুত্ৰচতুষ্টয় লাভ করিয়াছেন। ৫
দশরথরাজা অযোধ্যা নামে নিজপুরে মহাতপস্বী-ঋষ্যশৃঙ্গ প্রভৃতি মুনিগণকে আনয়ন করত মনস্বী এবং মহাবলবান, রাম, ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্ৰুঘ্ন নামে পুরন্দরসদৃশ চারিটি পুত্র যজ্ঞফলরূপে লাভ করিয়াছেন। ৬-৭
মহারাজা জনক, দেবর্ষি নারদের মুখে এই বাক্য শ্রবণ করিয়া অতঃপুরে প্রবিষ্ট হইলেন এবং যজ্ঞফলে পুত্রোৎপত্তি বাঞ্ছায় মহিষীগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া যজ্ঞার্থে দীক্ষিত হইলেন। ৮-১০
তদনন্তর রাজা জনক, পুরোহিত গৌতম এবং তাহার পুত্র শতানন্দের আদেশানুসারে যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। ১১
সেই যজ্ঞভূমি হইতে, সুন্দর-শরীর দুইটি পুত্র জন্মিল। কল্যাণ-নিলয় ভুবন-মোহিনী এক কন্যাও পৃথিবী হইতে উৎপন্ন হইলেন। ১২
জনক, নারদের আদেশে স্বয়ং লাঙ্গলদ্বারা যজ্ঞভূমির সীমাবধি প্রদেশ কর্ষণ করিলেন। ১৩
ভুমি হইতে জনকরাজা সৰ্ব্ব-সুলক্ষণ-সম্পন্না কন্যা লাভ করিয়া আনন্দ সাগরে নিমগ্ন হইলেন। ১৪
কন্যা জন্মিবামাত্র পৃথিবী সেইস্থানে উপস্থিত গৌতম, নারদ এবং জনক রাজাকে বলিলেন,–রাজন। ভুবনমোহিনী এই কন্যা তোমাকে অর্পণ করিলাম। জনক-জননী-কুলপাবনী মঙ্গলময়ী এই কন্যাকে গ্রহণ কর। মহারাজ! এই কন্যা হইতে আমার ভার দূরীভূত হইবে। আমিও দুৰ্ব্বহ ভার বহন হইতে মুক্তি লাভ করিব। ১৫-১৭
ইহার জন্যই যমশাসক রাবণ কুম্ভকর্ণ প্রভৃতি মহাবল রাক্ষসগণ যমভবন দর্শন করিবে। ১৮
মহারাজ! তুমিও এই কন্যা হইতে পরম আনন্দ লাভ করিবে; এবং ইহা হইতে তুমি দৈবিক এবং পৈতৃক ঋণ হইতে মুক্ত হইবে। ১৯
হে নরোত্তম! কিন্তু তোমাকে একটি প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে; যে বিষয় প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে–তাহা নারদ ও গৌতমের সমক্ষে তোমাকে বলিতেছি। ২০
রাবণবীর নিহত হইলে, ভারপীড়া-রহিত হইয়া আমি তোমার যজ্ঞভূমিতে সুখে একটি সুপুত্র প্রসব করিব, তুমি রাজশ্রেষ্ঠ; যতদিন তাহার শৈশব অতিক্রম হয়, ততদিন তুমি তাহাকে পুত্রবৎ পালন করিবে। ২১-২২
রাজন্! তাহার বাল্যকাল অতীত হইলে, আমি তাহাকে পালন করিব। তাহার যাহাতে মনুষ্যস্বভাব হয়,তদ্বিষয়ে তুমি যত্ন করিবে। ২৩
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–জনকরাজা পৃথিবীর এই কথা শুনিয়া হৃষ্টচিত্তে পৃথিবীকে প্রণামপূর্বক সান্ত্বভাবে বলিতে লাগিলেন;-জগদ্ধাত্রি! তোমার কথামত আমি তাহাকে পালন করিব, কিন্তু তুমি আমার অভিলাষ পূর্ণ কর; হে পরমেশ্বরি! প্রসন্ন হও। ২৪-২৫
হে দেবি! আমি সাক্ষাৎ মূর্তিমতী তোমাকে দর্শন করিতে ইচ্ছা করি। তুমি জগজ্জননী শক্তিস্বরূপা, তোমাকে প্রণাম করি, আমার প্রতি প্রসন্ন হও। ২৬।
পৃথিবী এইরূপ জনকরাজার বাক্য শ্রবণ করত সকল মুনিগণের সম্মুখে জনককে নিজরূপ দর্শন করাইলেন ২৭
নীলকমল-শ্যামলা দীর্ঘ-বাহুযুগলে মৃণাল-সদৃশ শুভ্রবর্ণ অক্ষমালা এবং পদ্মধারিণী সুন্দরী জগদ্ধাত্রীকে দর্শন করত জনকরাজা প্রণাম করিলেন। অনন্তর পৃথিবীদেবী সদ্যোজাতা জনকাত্মজা সীতাকে নিজ হস্তে গ্রহণ করত বলিতে লাগিলেন। হে নৃপশ্রেষ্ঠ! জগজ্জননী তোমার এই কন্যা মনুষ্যভাব লাভ করিবেন। তন্নিমিত্ত কিছুকাল অপেক্ষা কর। ২৮-৩০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–পৃথিবীদেবী জনকরাজাকে ইহা বলিয়া নরদাদি মুনিগণকে সদ্ভাষণাদি দ্বারা আপ্যায়িত করিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। ৩১
মনুষরূপী জনক-রাজা সৰ্বলক্ষণ-সম্পন্না কন্যা এবং পুত্রদ্বয়কে লাভ করিয়া আনন্দ-চিত্তে নিজ গৃহে গমন করিলেন। ৩২।
তদনন্তর যথাসময়ে মনুষ্যরূপী জগৎ-প্রভু ভগবান, রাবণ-বধ করিলে বসুন্ধরা মহারাজা জনকরাজার যে যজ্ঞ-ভূমিতে সীতাদেবীর উৎপত্তি হইয়াছিল, সেই স্থানে গমন করত মহাবীর পুত্র প্রসব করিলেন। ৩৩-৩৪
জগজ্জননী পৃথিবীদেবী, পুত্ৰ উৎপন্ন হইলে পূর্ব প্রতিজ্ঞানুসারে জগৎপ্রভু বিষ্ণুকে স্মরণ করিলেন। ৩৫
স্মরণ করিবামাত্র দেবাদিদেব ভগবান, প্রতিজ্ঞাপালনার্থে পৃথিবী যে স্থানে পুত্র প্রসব করিয়াছিলেন, সেই স্থানে আবির্ভুত হইলেন। বসুন্ধরা পরমেশ্বরকে প্রাদুর্ভুত দর্শন করিয়া প্রণাম করিলেন এবং সত্যভূত-প্রিয়বাক্য বলিতে লাগিলেন,-মহাপ্রভো! এই আপনার অতি কোমলাকৃতিবালক জন্মিয়াছে, পূর্ব প্রতিজ্ঞানুসারে ইহাকে পালন করুন। ৩৬-৩৮
ভগবান্ বলিলেন, হে দেবি! মহাপরাক্রমশালী তোমার এই পুত্র মনুষ্যভাব প্রকটনকরত চিরকাল বিজ্ঞজনের ন্যায় সুখী হইবে। ৩৯
তোমার এই পুত্র যতকাল পর্যন্ত মনুষ্যভাব বিভাবিত করিবে, ততদিন পৰ্য্যন্ত সর্বদা সুখে রাজ্য ভোগ করিবে। ৪০
এই পুত্র যে কালে মনুষ্যভাব ত্যাগপূর্বক কোন কার্য করিবে, সেই কাল হইতে ইহার জীবনের আশা থাকিবে না। ৪১
এবং ষোড়শ বৎসর বয়ঃক্রমে ধন-রত্ন-গজ-ঐশ্বর্য-রথ সমূহে সমৃদ্ধ রাজ্যভার প্রাপ্ত হইবে। বীর্যবান তোমার পুত্র বিপুল অক্ষয় রাজলক্ষ্মী লাভ করত ভোগ করিবে। ৪২
মনুষ্যগণের যে যে যুগে যে যে ভাব হয়, এই বালকও তদনুসারে নিজের যুগানুরূপ ভাব করিবে, সেই বিষয়ে যত্ন কর। ৪৩
প্ৰাগজ্যোতিষ নামে অতি স্থির ইহার নগর হইবে; সেই পুরে বাস করত চিরকাল রাজ্য শাসন করিবে। ৪৪
পৃথিবীপতি জগৎপ্রভু বিষ্ণু, পৃথিবীকে এইরূপ বাক্যে সন্তোষিত করিয়া কেবলমাত্র তাহারই দৃষ্টিগোচর হইয়া সেই স্থানেই অন্তর্নিহিত হইলেন। ৪৫
পৃথিবী অর্ধরাত্রে প্রসূত মহাতেজস্বী পুত্রের জন্মবৃত্তান্ত অতিগোপনে জনকরাজাকে জানাইলেন। ৪৬
জনকরাজা পৃথিবীর পূত্রজন্ম শ্রবণ করিয়া শীঘ্র সেই রাত্রিকালেই যজ্ঞ ভূমিতে আগমন করিলেন। ৪৭
পৃথিবী জনকরাজাকে যজ্ঞভূমিভে গমন করিতে দর্শন করিয়া অন্য কোন বাক্য না বলিয়াই নৃপের সম্মুখে অন্তর্হিতা হইলেন। ৪৮
অনন্তর জনকরাজা যজ্ঞভূমিতে গমন করত তেজে সূর্য-চন্দ্র-অগ্নিসন্নিভ পৃথিবী-পুত্রকে দর্শন করিলেন। ৪৯
সেই পুত্র বারংবার রোদন করিতেছে এবং হস্তপদ ইতস্ততঃ সঞ্চালিত করিতেছে; মূর্তিমান দ্বিতীয় কার্তিকসদৃশ সুন্দর তাহার দেহ। ৫০
মহদ্যুতি সেই বালক রোদন করিতে করিতে ভূমিতে লুণ্ঠিত হইয়া যজ্ঞভূমি হইতে কিছুদূর পর্যন্ত গমন করিল। ৫১
যজ্ঞভূমি হইতে বহির্গত হইয়া একটি মৃত মনুষের মস্তকে নিজ মস্তক বিন্যস্ত করিয়া রোদন করিতে করিতে কিছুকাল সেই ভাবেই অবস্থিত হইল। ৫২।
তদনন্তর জনকরাজাও পৃথিবীপুত্রের অন্বেষণার্থ যজ্ঞভুমি হইতে বহির্গত হইয়া প্রান্তভূমিতে জাজ্বল্যমান অনলের ন্যায় দীপ্তিশালী, কান্তিতে কলানিধি সদৃশ এবং তেজে সূর্য-সন্নিভ সেই বালককে দর্শন করিলেন এবং অগ্নি যে প্রকার শরবণ-স্থিত কার্তিককে গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেই প্রকার রাজাও পৃথিবীর নিকট প্রতিজ্ঞা করাতে সেই বালককে গ্রহণ করিলেন। ৫৩-৫৫
সেই কালে সেই বালকের মস্তকসমীপে মনুষ্যমস্তক দর্শন করিয়া জনক রাজা সন্দিগ্ধচিত্তে সেই বৃত্তান্ত পুরোহিত গৌতমকে জানাইলেন। ৫৬
এবং সেই বালককে লইয়া স্বকীয় অন্তঃপুরে গমন করত পট্টমহিষীকে কার্ভিকসদৃশ পুত্রপ্রাপ্তি-সংবাদ বলিলেন এবং সেই রাজমহিষীও বিস্তীর্ণনয়ন সিংহস্কন্ধ উন্নতবাহু প্রশস্তবক্ষা কমনীয় নীলোৎপল দলের ন্যায় শ্যামবর্ণ পুত্ৰটীকে দর্শন করিয়া মহারাজকে জিজ্ঞাসা করিলেন–এ সন্তান কি আপনার সন্তোষার্থে পালন করিব? ৫৭-৫৮
মহিষীর বাক্য শ্রবণ করত জনক বলিলেন,–সুন্দরি! যজ্ঞ-ভূমিতে উৎপন্ন এ বালককে নিজ পুত্রের ন্যায় পালন কর। ১৯
স্থিরপ্রতিজ্ঞ নৃপশ্রেষ্ঠ জনক–পৃথিবী নির্জনে যে কথা বলিয়াছিলেন, মহিষীর সমীপে সেই কথা উত্থাপন করিলেন না। ৬০
এই ধরিত্রী আমার পুত্র পৌত্রাদি বংশাবলীকে পালন করিবেন; ইহা ভাবিয়া রাজা আনন্দ সহকারে দেবীকে পুত্ৰপালনে আদেশ করিলেন। দেব ও সুরকুমার সদৃশ তনয় প্রাপ্ত হইয়া “এই বালক শত্রুজেতা এবং অনাবৃষ্টি প্রভৃতি ষড়বিধ-ঈতি-বর্জিত হইবে” ভাবিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। ৬১
সপ্তত্রিংশ অধ্যায় সমাপ্ত ॥ ৩৭