৩৭. নবীনকুমারের গৃহ-শিক্ষক

একজন খাঁটি ইংরেজতনয়কে নিযুক্ত করা হয়েছে নবীনকুমারের গৃহ-শিক্ষক হিসেবে। একজন পণ্ডিত সংস্কৃত ও বাংলা পড়ান। নবীনকুমারের গানের প্রতি অত্যধিক ঝোঁক দেখে একজন গায়কও আসেন তাকে গলা সাধানো রেওয়াজ করাতে। গায়কটি বেশ পালোয়ান গোছের, তিনি তাঁর ছাত্রকে কুস্তি ও গান, দুটোই শেখান। তবে নবীনকুমারের কোনো শিক্ষকই বেশী দিন টেকেন না। ইংরেজ শিক্ষক কার্ক প্যাট্রিকও গঙ্গানারায়ণের কাছে তাঁর ছাত্র বিষয়ে নালিশ জানিয়েছেন।

নবীনকুমার সংস্কৃত ও বাংলা বেশ ভালোই শিক্ষা করছে, যদিও পণ্ডিতকে সে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। নবীনকুমারের বাল্যের দুরন্তপন্যা এখন কৈশোরে অবাধ্যাপনায় এসে দাঁড়িয়েছে, সে কারুর কোনো কথা শোনে না। বিম্ববতীর অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের ফলে তাকে শাসন করার সাহস কারুর নেই। একমাত্র সে গঙ্গানারায়ণের কথা কিছুটা মানে, তার মুখে মুখে কথা বলে না, কিন্তু গঙ্গানারায়ণকে ইদানীং প্রায়ই মহাল পরিদর্শনের ব্যাপারে মফস্বলে থাকতে হয়।

দ্বাদশ বৎসর বয়েসে নবীনকুমার এখন এক অনিন্দ্যকান্তি বালক। তার মুখমণ্ডলে প্রতিভার জ্যোতি, চক্ষু দুটি অত্যুজ্জ্বল, এ বালক যে অসাধারণ তা তার মুখের পানে একবার তাকালেই বোঝা যায়।

কিন্তু এই বালকেরই মনের মধ্যে যে কতখানি নিষ্ঠুরতা আছে, তা কল্পনা করাও দুষ্কর। গৃহের দাস-দাসীদের সে মানুষ বলেই গণ্য করে না, সামান্য কর্তব্যচ্যুতি হলেই সে তাদের অসম্ভব কটু ভাষায় গালিগালাজ করে। তার আহার-বিহার-শয্যার পারিপাট্যের জন্য বিম্ববতী এখন সাতজন দাস-দাসী নিযুক্ত করেছেন। নবীনকুমার এক জায়গায় বসে খেতে পারে না বলে একজন ভৃত্য খাদ্যের ভাণ্ড নিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে। নবীনকুমার কখনো ছাদে, কখনো বাগানে এক এক চামচ করে খাদ্য মুখে দেবে, এবং সে ইঙ্গিত করা মাত্রই ভৃত্যটি যদি খাদ্যের ভাণ্ড এগিয়ে দিতে মুহূর্তমাত্র দেরি করে, অমনি নবীনকুমার লাথি মেরে সেই ভাণ্ড ফেলে দেবে। সারা বছর ধরে তাকে স্নান করানো হয় ঈষদুষ্ণ জলে, যদি কোনো একদিনও সেই জলের উত্তাপ সামান্য কম বা বেশী হয়, তখনি নবীনকুমার সংশ্লিষ্ট ভৃত্যটিকে গরু গরু বলে গালি দিয়ে ওঠে। কখনো বা অতি ক্ৰোধবশে সে বয়স্ক কোনো ভৃত্যকে চড় মারতেও দ্বিধা করে না। বাড়ির বাইরে যেতে হলে সে সেকালের নবাবপুত্রদের মতন আরাম কেদারায় পা ছড়িয়ে বসে কোনো ভূত্যের নাম ধরে ডাকে। তৎক্ষণাৎ সে ভৃত্যটি এসে তার পায়ে জুতো পরিয়ে দেয়।

এই রকম দৃশ্য গঙ্গানারায়ণের চোখে পড়েছে। গঙ্গানারায়ণ হিন্দু কলেজের আলোকপ্রাপ্ত ছাত্র, সে এ সব পছন্দ করে না। মানুষের মধ্যে উচ্চ-নীচ জাতের সংস্কার সে মানে না। ফরাসী বিপ্লবের পর সকল মানুষের সমান অধিকারের যে বারতা পৃথিবীতে ছড়িয়েছিল, তার ঢেউ কিছুটা গঙ্গানারায়ণের মত যুবকদের মনেও এসে লেগেছে। তাছাড়া, সে দার্শনিক রুশোর কিছু কিছু রচনাও পাঠ করেছে। অর্থনৈতিক নিবন্ধনে পৃথিবীতে অনেককেই এখনো দাসত্ব বরণ করতে হয়, কিন্তু তাদের প্রতি মানবোচিত ব্যবহারেরই পক্ষপাতী গঙ্গানারায়ণ।

সে একদিন নবীনকুমারকে বলেছিল। এই কথা। নবীনকুমারকে সে আদর করে ছোটকু বলে ডাকে। সে বলেছিল, এ কি ছোটকু, তুই জুতোর ফিতাটুকুও বাঁধতে জনিস না?

নবীনকুমার সগর্বে উত্তর দিয়েছিল, না।

গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, এ তো সবাই পারে। বহারু পর্যন্ত পারে, আর তুই পারিস না?

নবীনকুমার বলেছিল, দাদা, বহারু কি সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে পারে? আমি পারি। বহারুর কাজ জুতোর ফিতে বাঁধা, আমার তো তা কাজ নয়।

অনুগ্রহণ বলেছিল, মানুষকে নিজের সব কাজই শিখতে হয়। আয়, আমি তোকে জুতো পরা শিখিয়ে দি।

নবীনকুমার বলেছিল, জুতোয় হাত দিলে হাত নোংরা হয়। মা নিষেধ করেচে।

এর পর আর গঙ্গানারায়ণ কিছু বলতে পারেনি। বিম্ববতীর নিষেধের ওপর আর কোনো কথা চলে না। বিম্ববতী পুত্ৰস্নেহে অন্ধ। এমনিতে বিম্ববতী নিজে খুবই দয়াবতী, কোমলপ্ৰাণা নারী, তিনি নিজে কখনো দাসদাসীদের কষ্ট দেন না। কিন্তু নবীনকুমার যদি এমনকি কোনো ভূত্যের মুণ্ড কাটার হুকুমও দেয়, বিম্ববতী বোধ হয় তা-ও মেনে নেবেন। গঙ্গানারায়ণ মায়ের সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে বহুবার নিরস্ত হয়েছে। নবীনকুমারের ব্যাপারে বিম্ববতী বধির।

 

ছোট ভাইয়ের তত্ত্বাবধান বিষয়ে গঙ্গানারায়ণ ইদানীং প্রায়ই চিন্তা করে। বয়সে বালক হলেও নবীনকুমারের ভাবভঙ্গি ও কথাবাতাঁর ধরন অনেকটা বয়স্কদের মতন, এটা গঙ্গানারায়ণের মোটেই পছন্দ নয়। এত অল্প বয়েসে এত বেশী প্রশ্রয়ের ফল কখনো শুভ হতে পারে না। এতে উৎসন্নে যাবার পথ যখন-তখন খুলে যেতে পারে। গঙ্গানারায়ণের মনে পড়ে তার বন্ধু মধুর কথা। পিতা-মাতার অতিরিক্ত আদরে মধু ধরাকে সারা জ্ঞান করত। শেষ পর্যন্ত সেই মধুই পিতা-মাতার মনে চরম আঘাত দিয়ে গেল। কোথায় যে হারিয়ে গেছে মধু, তার সংবাদও এখন কেউ রাখে না। তার দুঃখিনী জননী কেঁদে কেঁদেই শেষ নিশ্বাস ফেললেন, আর তার ক্ৰোধোন্মত্ত পিতা আর একটি পুত্ৰ সন্তানের আশায় পর পর আবার বিবাহ করে চললেন, শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথ হয়ে তিনিও ধরাধাম ত্যাগ করেছেন।

গঙ্গানারায়ণ যেন মধুর সঙ্গে তার ভাই নবীনকুমারে কিছু কিছু মিল খুঁজে পায়। নবীন যেন মধুরই মতন উদ্ধত আর জেদী, সেও যখন তখন কবিতা বা ছড়া আবৃত্তি করে। অবশ্য মধু ছিল বাল্যকাল থেকেই ফিরিঙ্গিঘেঁষা, ইংরেজী ছাড়া আর কোনো ভাষা তার মুখে আসত না সহজে, কিন্তু নবীন বেশী ভালোবাসে বাংলা ও সংস্কৃত। মাঝে মাঝে দু-একটি দৃশ্য দেখে গঙ্গানারায়ণ বিস্মিত হয়েছে।

দ্বিতলের একটি ছোট ছাদ নবীনকুমারের খেলার জন্য অতি প্রিয় স্থান। গঙ্গানারায়ণ দেখেছে, প্রায়ই নবীনকুমার সেখানে তার সর্বক্ষণের খেলার সঙ্গী দুলাল নামের ছেলেটিকে নিয়ে বসে থাকে। নবীনের সামনে এক থালা ভর্তি সন্দেশ। সে মুখে মুখে এক একটি ছড়া বা সংস্কৃত শ্লোক বলে দুলালকে জিজ্ঞেস করে, তুই পারবি বলতে? আমি দুবার বলচি, তিনবার বলচি, তুই যদি শুনে শুনে মুখস্থ বলতে পারিস, তোকে সন্দেশ দেব।

দুলাল চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তখন নবীন এক একটা করে সন্দেশ ছুঁড়ে ছুঁড়ে কাকদের খাওয়ায়। সন্দেশের লোভে ছাদের অলসেতে অনেক কাক, চিল, পায়রা, শালিক এসে ভিড় জমায়। এমনকি বাড়ির পোষা বেড়াল মঞ্জুরীও গুটিসুটি মেরে বসে থাকে এক পাশে। এক একবার দুলাল খানিকটা বলার চেষ্টা করে, তখন নবীনকুমার একটি সন্দেশ তুলে তার মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, আর একটু বল, আর একটু, তা হলেই সন্দেশ পাবি, এই যে দ্যাক, দেকে দেকে বল…। দুলাল এর পর একটা শব্দ ভুল করে ফেলে আর নবীন সন্দেশটা দিয়ে দেয় বেড়ালটাকে। এমন করে সব সন্দেশ ফুরিয়ে যায়।

সংস্কৃত শেখার এত আগ্রহ, তবু নবীনকুমারের জন্য সংস্কৃত পণ্ডিত প্রায়ই বদল করতে হয়। শিক্ষককে নবীনকুমার একেবারেই গুরু হিসেবে মান্য করে না, প্রায়ই দুষ্টুমি করে পণ্ডিতের শিখ ধরে টানাটানি করে পর্যন্ত। এত বড় ধনী পরিবারে উত্তম দক্ষিণায় শিক্ষকতা করার জন্য কোনো কোনো গুরু প্ৰাণপণে টিকে থাকে কিছুদিন, তারপর অতি কষ্টে একদিন সম্মান রক্ষার্থে পলায়ন করে।

 

একবার মহাল থেকে ফিরে এসে গঙ্গানারায়ণ শুনলো যে, নবীনকুমার নাকি একজন পণ্ডিতের টিকি কেটে নিয়েছে। বাড়ি ফেরা মাত্রই তার পত্নী ফিসফিস করে তাকে সম্পূর্ণ ঘটনাটা জানিয়ে দিল।

প্রতি বৎসরই পৌষ সংক্রান্তিতে বিম্ববতী সাড়ম্বরে এক ব্ৰত করেন, তাতে প্রচুর ধুমধাম হয়। সে সময় বিম্ববতী ব্ৰাহ্মণদের স্বর্ণ, বস্ত্র এবং তণ্ডুল দান করেন এবং প্রতি বৎসর একজন ব্ৰাহ্মণকে একটি গরু ও দান করা হয়। এ বৎসর যে ব্ৰাহ্মণকে একটি নধর গো-বৎস দান করা হয়েছিল, সে ব্ৰাহ্মণটি জোড়াসাঁকোর সিংহবাড়ি থেকে বেরিয়েই কিছু দূরে কলুটোলায় এক কসাইয়ের কাছে গো-বৎসটি বিক্রয় করে দেয়। দৈবাৎ সিংহবাড়ির দুজন ভৃত্য সেই ঘটনা দেখে ফেলে এবং দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসে সবিস্তারে সেই কাহিনী বিম্ববতীর কাছে বৰ্ণনা করে। বিম্ববতীর কাছেই বসে ছিল নবীনকুমার, সে অমনি ভৃত্যদের হুকুম দেয় সেই ব্ৰাহ্মণকে ধরে আনতে।

ভৃত্যরা চিরকালই ধরে আনতে বললে বেঁধে আনতে চায়। সে ব্ৰাহ্মণ পালাবার পথ পেল না, ষণ্ডামাক দাসদের হাতে ধরা পড়ে তার অবস্থা সঙ্গিন হলো। সে এসে প্রথমে নানাপ্রকার মিথ্য বলে মন ভেজাবার চেষ্টা করল বিম্ববতীর, কিন্তু ভৃত্যরা তুমুল কলরবে প্রতিবাদ জানালো তার কথার। তারা নিজের চক্ষে দেখে এসেছে যে কলুটোলার কসাই ইতিমধ্যেই সে গো-বৎসটিকে কোরবানি করে ফেলেছে।

তবু বিম্ববতী দয়া পরবশ হয়ে ব্ৰাহ্মণকে নিস্কৃতি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন নবীনকুমার পরিষ্কার কণ্ঠে দাবি জানায় যে ঐ ব্ৰাহ্মণকে টিকি কেটে দিতে হবে। ঐ টিকি তার চাই। সে কাচ দিয়ে বাঁধিয়ে রাখবে। বিম্ববতী ক্ষীণ আপত্তি করলেন, ব্ৰাহ্মণের শিখা কর্তন করলে পাপ হয়, সে কথা জানালেন, কিন্তু নবীনকুমার তা কিছুতেই মানবে না। ব্ৰাহ্মণের কাছে গরু হচ্ছে গো-মাতা, যে ব্ৰাহ্মণ গো-মাতাকে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে, তার কোনো ব্ৰাহ্মণত্বের চিহ্ন রাখবার অধিকার নেই। দ্বাদশ বর্ষীয় বালক গম্ভীর কণ্ঠে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পরই কাঁদুনে গলায় মায়ের প্রতি আবদার করে বলে, মা, ওর টিকি আমি কাটবোই! আমি কাটবোই! বিম্ববতী সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, আহা-হা, কাঁদিস না, কাঁদিস না! প্রয়োজনে বিম্ববতী ছেলের জন্য আকাশের চাঁদও পেড়ে দিতে পারেন, আর এক ব্ৰাহ্মণের শিখা তো অতি সামান্য বস্তু। তিনি আর আপত্তি করলেন না। কয়েকজন মিলে সেই ব্ৰাহ্মণকে জোর করে চেপে ধরে রইলো, নবীনকুমার নিজে কাঁচি দিয়ে কচাৎ করে সেই ব্ৰাহ্মণের শিখা সমূলে নিপাত করে খলখলি শব্দে হেসে উঠলো।

এই বৃত্তান্ত শুনে গঙ্গানারায়ণ রীতিমতন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। অশিক্ষিত, বাগাড়ম্বরপ্রিয় ব্ৰাহ্মণদের সম্পর্কে তার নিজেরও খুব একটা শ্রদ্ধা নেই, তবে ইদানীং সংস্কৃত সাহিত্যের রস গ্রহণ করতে শুরু করার পর সে যথার্থ সংস্কৃত পণ্ডিতদের ভক্তি করে। একজন গরীব ব্ৰাহ্মণকে গো-বৎস দানের উপযোগিতাই বা কী? গাভী কেউ দান করে না, সকলেই দেয় মন্দা বাছুর। সে বাছুর একদিন বলীবর্দী হয়ে উঠবে, তখন গরীব ব্ৰাহ্মণ তাকে নিয়ে কী করবে? ব্ৰাহ্মণ তো আর হালচাষে নামবে না, শুধু শুধু এক বলীবদের আহার জোগাড় করবেই বা কোন উপায়ে?

 

গঙ্গানারায়ণ শুনেছিল, কুড়ি বাইশ বৎসর আগে ডিরোজিও শিষ্য ইয়ং বেঙ্গলের দল পথেঘাটে ব্ৰাহ্মণদের শিখা কেটে নেবার জন্য তাড়া করতো। কিন্তু তখন কেউই শেষ পর্যন্ত কোনো ব্ৰাহ্মণের শিখা কাটেনি, আর নবীনকুমার এত অল্প বয়েসেই এমন দুঃসাহস দেখালো? তাহলে যুবা অবস্থায় বা পূর্ণ বয়সে সে আরও কত কী করবে? সে কোন পথে যাচ্ছে?

গঙ্গানারায়ণ আরও অবাক হলো এই ভেবে যে, বিধুশেখর এমন একটা কাণ্ড ঘটতে দিলেন? তাঁর অজান্তে তো এ বাড়িতে কোনো কিছুই ঘটা সম্ভব নয়। দেব-দ্বিজে বিধুশেখরের অসীম ভক্তি, তাঁর চোখে তো এ কাজ বিরাট অন্যায়।

সেদিনই অপরাহ্নে নবীনকুমারের দেখা পেয়ে গঙ্গানারায়ণ প্রশ্ন করলো, ছোটকু, তুই নাকি এক বামুনের টিকি কেটিচিস?

নবীনকুমার হাস্য ঝলমল মুখে বললো, গঙ্গাদাদা, তুমি তো এখুনো দেকোনি। আমি সকলকে ডেকে ডেকে দেকাই! এসো, আমার ঘরে এসো!

নবীনকুমার গঙ্গানারায়ণের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল নিজের কক্ষে। সত্যিই দেওয়ালে একটি কাচের ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় সেই একগুচ্ছ শিখা বুলিয়ে রাখা হয়েছে।

গঙ্গানারায়ণ বললো, কী দস্যি ছেলে রে তুই? বামুনের টিকি কাটলি! তোর ভয় করলো না?

নবীনকুমার বললো, গঙ্গাদাদা, তুমি থাকলে আরও মজা হত। টিকি কাটার পর সে বামুনটা মাথায় হাত দিয়ে তিড়িং তিড়িং করে লাপাতে লাগলো। আর আমাদের এক ব্যাটা হিন্দুস্থানী দারোয়ান চেঁচিয়ে বললো, হায় রাম, চৈতন চুটকি খো গ্যয়া। হায় রাম।

কথা বলতে বলতে নবীনকুমার একেবারে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলো। গঙ্গনারায়ণেরও ঠোঁটে স্মিত হাস্য এসে গেল, যদিও অন্তরে সে মৃদু অস্বস্তি বোধ করছে। তার ধারণা, এই ধরনের কাজের ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়।

সে বললো, তুই যে এমন পাগলামি করলি ছোটকু, এর পর যদি কোনো বামুন পণ্ডিত তোকে শিক্ষা দিতে না চায়? এবার তোর জন্য খুব নামকরা একজন পণ্ডিত ঠিক করা হয়েচে।

নবীনকুমার বললো, আমি সেই পণ্ডিতমশাইকে বলিচি, আপনি যদি না আসেন, তাহলে পাইক পাঠিয়ে আপনাকেও ধরে এনে আপনারও টিকি কুচ করে দেবো!

গঙ্গানারায়ণ বললেন, কী সাঙ্ঘাতিক কথা! অত বড় পণ্ডিতকে তুই এমন করে বললি? তিনি কী উত্তর করলেন?

পণ্ডিতমশাই বললেন, তুমি উত্তম কাজই করেচো বাপু। আজকাল হাজারে হাজারে নকল বামুন গজিয়েচে। তাদের এমনতর শাস্তিরই দরকার।

—দেকবি, নিউজ পেপারে এবারে আমাদের বাড়ি সম্পর্কে নানা কথা বেরুবে।

—বেরুক গে! কোন নিউজ পেপার লিকবে? তুমি সেই নিউজ পেপারটা কিনে নিও!

–ওরে বাস রে!

–তুমি বসো গঙ্গাদাদা, তুমি তো ছিলে নাকো, তাই তোমার জন্য আমি সব কথাগুলোন লিকে রেকেচি।

—কোন কথাগুলোন?

—সেদিন টিকি কাটার সময় যা হলো। তুমি বসে, আমি পড়ে শোনাই।

নবীনকুমার তার বইপত্রের মধ্য থেকে কয়েকটি আলগা কাগজ বের করলো। তাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে বাংলায় অনেক কিছু লেখা! গঙ্গানারায়ণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এমন মুক্তার মতন হস্তাক্ষর কদাচিৎ দেখা যায়। সে আরও চমৎকৃত হয়ে গেল, যখন নবীনকুমার সেই রচনাটি পড়ে শোনালো। রচনার নাম, ব্ৰাহ্মণ হইল চাঁড়াল। অতি জটিল শব্দসমন্বিত বিশুদ্ধ বাংলা।

গঙ্গানারায়ণ জিজ্ঞেস করলো, এ সব তুই নিজে লিকিচিস? না পণ্ডিতমশাই তোকে বলে দিয়েচেন?

নবীনকুমার বললো, আমি লিকিচি। আমি আরও কত লিকিচি। পণ্ডিতমশাই তো জানেই না। শুদু দুলালকে শুনিয়িচি, আর এই তোমায় শোনালুম।

—এমন তো আমি লিকতে পারি না রে ছোটকু! বাংলা লিকতে গেলে আমার কলম ভেঙে যায়। তুই তো অতি সুন্দর লিকিচিস, এ লেকা তো বিদ্যেসাগর মশাইকে দেখানো দরকার। তোর পণ্ডিতমশাইকে বলিস।

—গঙ্গাদাদা, আমি গানও বাঁধতে পারি। দুটো বাংলা গান বেঁধেচি, শুনবে?

গঙ্গানারায়ণের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। নবীনকুমার সত্যিই দুটি বাংলা গানও লিখেছে, যাতে ছন্দ ও মিল আছে রীতিমতন। গঙ্গানারায়ণের মনে হলো, তাহলে কি তার ভাইও মধুর মতন। একজন কবি হবে? পোয়েট অ্যাণ্ড অথর। কবিরা বাল্য থেকেই এমন জেদী, খামখেয়ালি আর স্বতন্ত্রতাপরায়ণ হয়?

নবীনকুমারের বাংলা রচনা-শক্তি ও জ্ঞান দেখে গঙ্গানারায়ণ মুগ্ধ হলেও সে নিজে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত, তার মনে হয় যে ইংরেজী শিক্ষা না পেলে নবীনকুমারের মনের প্রসারিতা বাড়বে না। ইওরোপের সাহিত্য ও দর্শনের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় না হলে আধুনিক পৃথিবীর অনেক কিছুই তার অজানা থাকবে।

সেইজন্য গঙ্গানারায়ণ একজন ইংরেজ শিক্ষককে নিযুক্ত করলো তার ছোট ভাইয়ের জন্য। এ ব্যাপারে বিধুশেখর প্রথমে একবার আপত্তি তুলেছিলেন। তাঁর আপত্তি সরাসরি ইংরেজী শিক্ষা সম্পর্কে নয়, এখন সকলেই, এমনকি ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতরাও ইংরেজী শিখছে, রাজভাষা শিক্ষা না করলে সমাজে স্থান পাওয়া যায় না, কিন্তু বিধুশেখর বললেন, বাড়িতে ম্লেচ্ছ ঢোকানো চলবে না। ইংরেজরা শুয়োর গরু খায়, বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেও জুতো খোলে না, কোনো হিন্দু গৃহে তার প্রবেশ করলে সে বাড়ির পবিত্রতা নষ্ট হয়। এদিকে বিম্ববতী তাঁর পুত্রকে বাড়ির বাইরে পাঠাবেন না পড়াশুনোর জন্য। নবীনকুমারকে যদি ইংরেজী শেখাতেই হয়, তবে কোনো হিন্দু ভদ্রলোককে নিযুক্ত করা হোক না।

গঙ্গানারায়ণ রাতারাতি সিংহবাড়ির সংলগ্ন উদ্যানে একটি পাঠকক্ষ নির্মাণ করিয়ে ফেললো। গঙ্গানারায়ণের পিতা বেঁচে থাকতে এ বাড়িতে বিবাহাদি উৎসবে অনেক সময় ইংরেজরা নিমন্ত্রিত হয়েছে, তখন তাদের বসানো হয়েছে ঐ উদ্যানে শামিয়ানা খাঁটিয়ে। সুতরাং উদ্যানের পাঠকক্ষে ইংরেজ শিক্ষক এসে অনায়াসে নবীনকুমারকে পড়াতে পারবে।

মিঃ কার্ক প্যাট্রিক একজন মৃদু স্বভাবের মানুষ। অনেক ভাগ্যান্বেষী বেসরকারী ইংরেজের মতন সেও এ দেশে এসেছিল ব্যবসা বাণিজ্য করে লক্ষ্মীলাভ করতে। কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। সব কাজ সকলের জন্য নয়। কার্ক প্যাট্রিক অধিকাংশ সময়ই বই পড়ে কাটায়। তার সঙ্গে কথা বলে গঙ্গানারায়ণ বুঝেছিল যে লোকটির জ্ঞানের কৌতূহল অসীম, এমন একজনই নবীনকুমারের উপযুক্ত শিক্ষক হতে পারবে। যদি সে তার দুরন্তপনাকে কিছুটা বশ করতে পারে।

কিন্তু কার্ক প্যাট্রিক প্রায়ই অভিযোগ জানাতে লাগলো, গঙ্গানারায়ণের কাছে। একবার সে উড়িষ্যা সফরে গিয়েছিল, ফিরে এসে শুনলো যে কার্ক প্যাট্রিক কাজ ছেড়ে চলে গেছে। নবীনুকমারকে প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। সে বললো, ও সাহেব তো পাগল। বিড়বিড় করে আপন মনে বকে। ও আবার পড়াবে কী!

শহরে ইংরেজ শিক্ষকের অভাব নেই। একজনের বদলে আরও দশ গণ্ডা পাওয়া যায়। কিন্তু কার্ক প্যাট্রিককে গঙ্গানারায়ণের পছন্দ হয়েছিল, সে কেন কাজ ছেড়ে গেল সেটা জানা দরকার। সে ডেকে পাঠালো কার্ক প্যাট্রিককে।

কার্ক প্যাট্রিক এলো এবং ঘণ্টাখানেক আলোচনা হলো তার সঙ্গে। সে মোটেই নবীনকুমারের ওপর রাগ করে কাজ ছেড়ে চলে যায়নি, বরং নবীনকুমার সম্পর্কে তার মনে অনেকখানি মেহ জন্মেছে। তার মতে, নবীনকুমারের মতন এমন মেধাবী ছাত্র বিরল, অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এই বালকের, এমন ছাত্রকে পড়িয়েও আনন্দ। কিন্তু এমন অদ্ভুত বালকও সে দেখেনি কখনো। এত অল্প বয়েস হলেও এই বালকের মধ্যে যেন স্পষ্ট দুটি সত্তা আছে। এক একদিন সে পড়াশুনোয় অত্যন্ত আগ্রহী, প্ৰায় শ্রুতিধরের মতন সে শিক্ষকের মুখ থেকে যা শোনে, পরীক্ষণেই তা নিজে বলে দেয়। শিক্ষককে সে নানান প্রশ্ন করে বহু বিষয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেয়। আবার অন্য এক একদিন সে পড়াশুনো সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করে না, শিক্ষকের সামনে ডিগবাজি খেয়ে নানা প্রকার কসরত দেখায় এবং ইচ্ছে করেই সে সব দিনে সে একটিও ইংরেজী শব্দ উচ্চারণ না করে বাংলায় নানান কথা বলে আর হাসে। সে সব দিনে বালকটিকে উন্মাদ বলে ভ্ৰম হয়। কার্ক প্যাট্রিকের। এই জন্যই দিশেহারা হয়ে সে এ বাড়িতে আসা বন্ধ করেছে।

গঙ্গানারায়ণ অবিশ্বাস করলো না। অতি শৈশব থেকেই নবীনকুমারের আচরণে নানা রকম অস্বাভাবিক ব্যাপার দেখা গেছে, সে জানে। কিন্তু হয়তো বা এই সব অস্বাভাবিকতাই প্ৰতিভার লক্ষণ। গঙ্গানারায়ণ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, এর প্রতিবিধান কী? অন্য শিক্ষকদের সঙ্গেও নবীনকুমার এরকম ব্যবহার করে, কোন উপায়ে এর সুচারু শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়।

সাহেবের মতে, নবীনকুমারকে কোনো স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া উচিত। অন্যান্য অনেক বালকের সঙ্গে মিশলে, খানিকটা বাধ্যতামূলক শৃঙ্খলার মধ্যে পড়লে এর স্বভাব শুধরে যেতে পারে।

গঙ্গানারায়ণ তা জানে। কিন্তু তার মা কিছুতেই নবীনকে স্কুলে পাঠাতে চান না। নইলে তার কত সাধ ছিল, তার মতন নবীনও হিন্দু কলেজে পড়বে।

কয়েকদিন বাদে অপ্রত্যাশিতভাবে সেই সুযোগ এসে গেল। নবীনকুমার নিজেই এসে বললো, গঙ্গাদাদা, আমি কলেজে পড়বো। আমার আর বাড়ির মাস্টারদের ভালো লাগে না। পথ দিয়ে দেকি ছেলেরা বই খাতা নিয়ে কলেজে যায় আমিও ওরকম যাবো। তুমি মাকে বলো।

নবীনকুমার নিজে আবদার ধরলে তো আর কোনো কথাই নেই। বিম্ববতীর এতকালের আপত্তি একদিনে মুছে গেল। তিনি প্রথমে ক্ষীণভাবে একবার না বলতেই নবীনকুমার সকালের খাওয়া বন্ধ করেছিল। অমনি বিম্ববতী গঙ্গানারায়ণকে ডেকে বললো, ও গঙ্গা, তুই ব্যবস্থা কর বাপু, ও যখন গোঁ ধরেচে একবার—। পুরুতমশাইকে বল একটা শুভ দিন দেখতে–

হিন্দু কলেজের বহু পুরোনো শিক্ষক এখনো গঙ্গানারায়ণকে চেনে। তার কয়েকজন বন্ধুও এখন ওখানে শিক্ষকতা করছে, সুতরাং ভাইকে ভর্তি করার জন্য তাকে কোনো বেগই পেতে হবে না। মফস্বল থেকে ফিরে গঙ্গানারায়ণ শুনেছে যে, হিন্দু কলেজ নিয়ে কিছু গোলমাল চলছে শহরে। কিছু গোঁড়া লোক হিন্দু কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে একটা পাল্টা নতুন কলেজ খুলেছে। তা হোক। গঙ্গানারায়ণ তার নিজের পুরোনো কলেজেই ভর্তি করবে ভাইকে। সারা দেশে হিন্দু কলেজের মতন এমন বিখ্যাত প্ৰতিষ্ঠান আর আছে নাকি?

ওস্তাগর ডেকে নবীনকুমারের জন্য ইংরেজী ফ্যাসানের পোশাক তৈরি করানো হয়েছে। একটা পৃথক জুড়িগাড়ি এবং দুজন ভৃত্যকে ঠিক করা হয়েছে, তারা প্রতিদিন নবীনকুমারকে কলেজে নিয়ে যাবে ও নিয়ে আসবে।

ভর্তি হবার আগের দিন বিকেলে এলেন বিধুশেখর। সিঁড়ির মুখে গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে দেখা। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, তোমরা নাকি নবীনকে হিন্দু কলেজে ভর্তি কচ্চো? আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করবার প্রয়োজনীয়তাও মনে করোনি?

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি ধীর পদে উঠে গেলেন। দ্বিতলে। বিম্ববতীর কক্ষের সামনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি ঐ একই বাক্য দুটি উচ্চারণ করলেন। তারপর ভিতরে ঢুকে দু পা এগিয়ে তিনি আবার বললেন, ওসব হবে না। নবীন কলেজে যাবে না। বাড়িতে যেমন পড়চে পড়ুক।

বিম্ববতী বললেন, খোকা যে কাঁদাকাটা করবে। খুব বায়না ধরেচে।

বিধুশেখর রুক্ষ স্বরে বললেন, কাঁদুক। দু দিনে আবার থেমে যাবে। হিন্দু কলেজ এখন নষ্টামির কলেজ। সেখানে বেশ্যার ছেলে পড়ে। সেখানে এ বাড়ির ছেলেকে পড়াতে পাঠাবে? এসব গঙ্গার বুদ্ধি? বংশমযদি বোঝার ক্ষমতা তার নেই। বেশ্যার ছেলে পাশে বসবে সিংহী বাড়ির ছেলে!

একটু থেমে, বিম্ববতীর মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বিধুশেখর আবার বললেন, খোকাকে মানুষ করার ভার কি শুধু একা তোমার? আমার মতামতের বুঝি কোনো মূল্য নেই?

বিম্ববতী সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠে দারুণ ভয়ার্তভাবে বললেন, না, না, আপনি যা বলবেন, তাই হবে।

একটু পরে, বিম্ববতীর ঘর থেকে ফেরার পথে বিধুশেখর আবার নিজেই গঙ্গানারায়ণকে ডেকে বললেন, নবীন কলেজে যাবে না। সে তেরো বচরে পড়লো, আমি ঠিক করিচি, এ বচরেই তার বিয়ে দেবো। পাত্রী আমার পছন্দ করা হয়ে গ্যাচে।

এবারও গঙ্গানারায়ণের কোনো উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা না করে বিধুশেখর চলে গেলেন বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *