“Male domination is so rooted in our collective unconscious that we no longer even see it. It is so in tune with our expectations that it becomes hard to challenge it. Now, more than ever, it is crucial that we work to dissolve the apparently obvious and explore the symbolic structures of the androcentric unconscious that still exists in men and women alike.” — Pierre Bourdieu
সেদিন কলকাতা টিভির একটি অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে কবি লেখক এবং সাধারণ পাঠকদের কিছু সদ্য সংগ্রহ করা মন্তব্য ছিল। প্রথম মন্তব্যটি নবনীতা দেবসেনএর। নবনীতার আমি অনুরক্ত। বিশেষ করে তাঁর রসবোধের। অসাধারণ তাঁর রসবোধ। কিছুদিন আগে দিল্লিতে একটি নারীবাদী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দুজনই একসঙ্গে কলকাতায় ফিরেছি। আমাদের সেই ফেরাটি যেমন ত্তানে মানে সমৃদ্ধ ছিল, তেমনি রসে ছিল টইটম্বুর। সময় উড়ে গেছে পলকে। সেই নবনীতা, যিনি অনেকবারই বলেছেন আমার লেখা তাঁর ভালো লাগে, বিশেষ করে পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে যেগুলো লেখা। মনে আছে মাত্র ক’দিন আগে তেমনই একটি লেখা আমি নিজেই পড়ে শুনিয়েছিলাম, আমার বাড়িতে বসেই তিনি সেটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন, সেই নবনীতা দেখলাম কলকাতা টিভিতে আমার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘তসলিমার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল, আমরা পুরুষতন্ত্রের বিরোধী, ও তা নয়। মানে আমরা সিসটেমের সমালোচনা করি, কিন্তু তসলিমার ব্যাপারটা ভিন্ন, ও তা করে না, ও পুরুষতন্ত্রবিরোধী নয়, ও হল পুরুষবিদ্বেষী।’ এই মন্তব্য শুনে আমি অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ বসে ছিলাম। এই যে দু দশক ধরে নারীর অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ধর্ম, মৌলবাদ এবং পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করছি, এ নিয়ে বইএর পর বই লিখছি, এ কারণে নিজের দেশ থেকেও যুগ পার হয়ে গেল নির্বাসিত, আর একজন নমস্য নারীবাদী বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে কি না আজ এই প্রতিদান পেলাম! আমার জীবন নিয়ে তিনি কী ক্তূর রসিকতাই না করলেন!
আমি বিশ্বাস করি না যে নবনীতা দেবসেন আমার কোনও বই পড়েননি। কোনও বই বা কোনও লেখা না পড়ে মন্তব্য করার লোক যে সমাজে নেই, তা নয়। কিন্তু তাদের কাতারে আমি তাঁকে ফেলবো কেন! তিনি দায়িত্ববান মানুষ। নিজে যখন বক্তব্য পেশ করছেন, নিশ্চয়ই দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো তা করেননি। আমি জানি তারাই এই ধরনের মন্তব্য করে যারা আমার লেখা পড়েনি অথবা পড়লেও বোঝেনি। বাংলাদেশেও লোকে করেছে, পশ্চিমবজ্ঞেও করে। কিন্তু নবনীতা দেবসেনএর মাপের কোনও লেখকের কাছ থেকে এমন অপবাদ আমার জোটেনি কোনওদিন। এ অনেকটা চরিত্রহননের মতো। আমি আমার মানববাদী আদর্শ আর নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকি যদি, সত্য বলার সততাকে যদি খুইয়ে ফেলি, আমি নিজেই বলবো চরিত্র বলে কিছু নেই আমার। কিন্তু আমি যা নই, আমাকে যদি বলা হয় আমি তা, তবে তা চরিত্রহনন ছাড়া আর কী! আমার সংত্তায় চরিত্রহীনতার সঙ্গে যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে শঠতা, নীচতা, অসততা, মিথ্যে, প্রতারণা, ছলনা, চাতুরির সঙ্গে।
ইটিভির পরম্পরায় নবনীতা দেব সেন এবং আমাকে নিয়ে দুটো অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আরও অনেক কবি সাহিত্যিক শিল্পী যাদের ডাকা হয়েছিল পরম্পরায়, তাদের অনুষ্ঠান প্রচার হয়ে গেছে। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে নবনীতা-তসলিমা জুটির দুটি অনুষ্ঠানের একটিও, বছর পার হয়ে গেছে, আজও প্রচার হয়নি। ওখানে আমি আবার জানতে ইচ্ছুক ছিলাম নবনীতা দেবসেনএর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের স্বামীর পদবী ধারণ করার কারণ। সই নামে তাঁর নারীলেখক সংগঠনে আর যে নারীলেখকেরই যোগ দেওয়ার অধিকার আছে, আমার কেন নেই, এ নিয়েও জানতে চেয়েছিলাম। দুটো অনুষ্ঠানই বেশ বিদণ্ড নারীবাদী অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু বেছে বেছে নারীবাদের ওপরই কাঁচি চালানোর প্রবণতা আজকাল প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের।
অনেককাল যাবৎ ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে লিখছি, বলছি। কারণ মানবাধিকারে বিশ্বাসী আমি। যেহেতু মানবাধিকারে বিশ্বাসী, সেহেতু নারীর অধিকারে বিশ্বাসী। আমার কাছে মানব বলতে নারী পুরুষ উভয়ে । নারী যেহেতু সমাজে নারী হওয়ার কারণে নিগৃহীত হচ্ছে, নিষ্পেষিত হচ্ছে, যেহেতু নারীর স্বাধীনতা এবং সমানাধিকার পাওয়ার বিরুদ্ধে নানারকম পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র বিরাজমান, তাই এসব নারীবিরোধী নিয়মনীতি আর কুটিল জটিল ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করি। করি বলেই কেউ আমাকে নারীবাদী বলে, কেউ বলে মানববাদী। আর মূর্খরা নিশ্চিন্তে বলে যায় যে আমি নাকি পুরুষবিদ্বেষী।
পুরুষবিদ্বেষী শব্দটি ভয়ংকর। ভালো কলঙ্ক লেপন হয়। হই রই করে তেড়ে আসে লোক। ঘেন্না দেয়। নারীকে যারা পুরুষের অধীন করে রাখতে চায়, তারা সুযোগ পেলে আমাকে প্রায় কাঁচা খেয়ে ফেলে। খেতে না পারলে প্রায় খাওয়ারই মতো একটি জিনিস করে, পুরুষবিদ্বেষী অপবাদ দেয়। দীর্ঘদিন যাবৎ অপবাদের শিকার আমি। মৌলবাদী এবং একই সঙ্গে যৌগবাদীরাও ঘেন্নায় থুতু ছুড়েছে আমার দিকে। ‘ও সাহিত্য জানে না, ও প্রচার চায়’ — এরকম মুখরোচক নিন্দা বাতাসে ভাইরাসের মতো ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে সত্যের জন্য সাম্যের জন্য আমার লড়াইকে মানুষের চোখে গুরুত্বহীন করার রাজনীতি চলেছে। এ নতুন নয়।
‘পুরুষ ভালো, পুরুষতন্ত্র মন্দ।’ এই হল সোজা কথা, সাফ কথা এবং সবার কথা। এটি শুনতে চমৎকার। কিন্তু আমার প্রশ্ন একটি, সবার কাছে এবং নিজের কাছেও, পুরুষতন্ত্র কি আকাশ থেকে পড়েছে? পুরুষতন্ত্র একটি তন্ত্র যেখানে পুরুষের স্বপক্ষে আইন কানুন, পুরুষের স্বপক্ষে সামাজিক এবং পারিবারিক বিধি ব্যবস্থা, সমাজ সংসারে যাবতীয় যা কিছু সবই পুরুষের স্বপক্ষে, সবই পুরুষকেন্দ্রিক। না, এই তন্ত্রটি আকাশ থেকে পড়েনি, এটি পুরুষের তৈরি, এবং পুরুষেরা এই তন্ত্রের সুযোগ সুবিধে সব ভোগ করছে, বেশির ভাগ নারীর ভূমিকা হল, পুরুষদের এটি ভোগ করতে সাহায্য করা। পুরুষতন্ত্রের সমালোচক আমি, কিন্তু আমি দাবি করতে পারি না পুরুষতন্ত্রের জনক পুরুষ নয়। যখন বলি, আমাকে সত্য কথা বলতেই হয়, যে, আমরা যখন সভ্যতার বড়াই করছি, উন্নত প্রযুক্তি এবং নানাবিধ শিল্প সংস্কৃতি দর্শন বিত্তানের সাফল্যের পাশাপাশি মহাসমারোহে বেঁচে থাকছে একটি অসভ্য বর্বর প্রথা, পুরুষতন্ত্র যার নাম। এটিকে কে টিকিয়ে রাখছে? হাওয়া? না হাওয়া নয়, সত্যি বলতে গেলে পুরুষ। নারীও। নারী হলেই যে নারীবাদী হবে তা নয়। আমি অনেক পুরুষকে দেখেছি, যারা অনেক নারীবাদীর চেয়েও বেশি নারীবাদী। আবার এমন অনেক নারীর দেখা আমি পেয়েছি, যারা প্রচণ্ডভাবে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক।
সমতার জন্য বিশ্বজুড়ে কম আন্দোলন হয়নি। আন্দোলনের ফলে বৈষম্য টিকিয়ে রাখে এমন অনেক পুরোনো প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের গায়ে কোনও আঁচড় আজ অবধি লাগেনি। এর কারণ কী বলে মনে হয়? আকাশ থেকে পড়া পুরুষতন্ত্রটির গা গতর লোহায় গড়া বলে? নাকি এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ প্রাণপণ চেষ্টা করে বলে? যারা করে, তাদের কি দোষ দেওয়া অন্যায় নাকি অন্যায় নয়? পুরুষতন্ত্র যেহেতু নারীবিরোধী একটি প্রথা, নারীর অধিকারের সঙ্গে যেহেতু পুরুষতন্ত্রের জন্ম জন্মান্তরের বিরোধ, আমাকে তাই মানবাধিকারের কথা বলতে গিয়ে পুরুষতন্ত্র এবং একই সঙ্গে এই তন্ত্রকে যারা টিকিয়ে রাখছে তাদের কথাও বলতে হয়। তা না হলে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো ব্যাপারটি দাঁড়ায়। আমাকে দেখিয়ে দিতে হয় যে নারীর স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিগুলো ঠিক কী কী।
‘পুরুষতন্ত্র মন্দ, পুরুষ ভালো’ — এই কথাটি ঠিক সেই কথার মতো, ‘পুঁজিবাদ মন্দ কিন্তু পুঁজিবাদীরা ভালো।’ আমাকে যদি পুরুষবিদ্বেষী বলে অপবাদ না দেওয়া হত, তা হলে হয়তো পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা যেমন করছিলাম, তেমনই করে যেতাম, এর হোতাদের সন্ধান করতাম না। যারা হোতাদের আদর আহ্লাদ দিয়ে খুশি রেখে শুধু তন্ত্রকে ঢিল ছোঁড়ে, তারা কি জানে না তন্ত্রের কোনও শরীর নেই, নিজস্ব কোনও বোধ বুদ্ধি নেই! তন্ত্র কথা বলতে জানে না? তারা কি জানে না যে তন্ত্র ‘তন্ত্র’ চালায় না, চালায় মানুষ! তারা কি জানে না ঢিল ছুঁড়লেও তন্ত্র যেমন বহাল তবিয়তে আছে, তেমনই থাকবে। তন্ত্রকে চালায় যারা, তাদের যদি অক্ষত অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়, কলকব্জায় তেল ঢেলে তাদের যদি আরও সক্তিয় করা হয়, তবে পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কারে জগতের সর্বনাশ হতে বেশি বাকি নেই!
আমার সন্দেহ, যারা শুধু সিস্টেমের ওপর রাগ দেখায়, সিস্টেম প্রস্তুতকারক, ও সিস্টেম রক্ষাকারককে ক্ষমা করে দেয়, তারা আসলে পুরুষশাসন এবং শোষণটাই ছলে কৌশলে চায় যে বজায় থাকুক।
না, আমি পুরুষবিদ্বেষী নই, কোনও কালেও ছিলাম না। ব্যক্তি পুরুষের ওপর রাগ করে, পুরুষের ওপর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে আমি এই সংগ্রামে লিপ্ত হইনি। পুরুষদের মধ্যে আমার প্রেমিক আছে, প্রাণের বন্ধু আছে, সহমর্মী, সহযোদ্ধা সবই আছে। আমি শুধু সেই পুরুষদের চিহ্নিত করতে চাই যে পুরুষেরা পচা পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছুই বদলাতে দেবে না, নিজেদের নারীবিরোধী মানসিকতাও সামান্য পাল্টাবে না, যারা নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে না, যারা পুরুষতন্ত্রকে দুধকলা দিয়ে পুষছে, যারা নারীকে পায়ের তলায় জীবনভর পিষবে বলে পণ করেছে। আমি চাই তারা মানুষ হোক। সেই নারীরাও মানুষ হোক, যারা পুরুষতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেতনভাবেই সব রকম সহযোগিতা করছে, চাই তারা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকে অস্বীকার করুক, সততায় আর সাম্যে প্রবলভাবে বিশ্বাসী হোক। মানবতন্ত্রে সত্যিকার বিশ্বাসী হলে, মানবতন্ত্র জীবনে চর্চা করলে, নারী পুরুষের অধিকারে কোনও ফারাক থাকে না।