কী এক অশান্তির সময় এসে পড়লো। রেডিওর সংবাদ, কাগজের সংবাদ, সব যেন অশান্তিতে কাঁপছে। কোথাও কি আনন্দ উচ্ছ্বসিত হবে? সে আনন্দে কি কান্না জড়ানো থাকবে, কিংবা দুঃখ ঢাকার বেপরোয়া হাসি? এ কি এক নতুন দর্পিত বৈশাখ আসছে তার ঝড়ে পুরনো সব কিছুকে ধ্বংস করে? কারো কারো মনে হতে পারে–পদ্মা নতুন খাত নিতে পারে, সংবাদটা এরকমই যেন। যে প্লাবন পলি আনে তা নয়, বরং যেন কীর্তিনাশা রূপ নেবে। ভয় হতে থাকে, ভয়কে অবিশ্বাস করতে সাধ যায়।
রূপুর মনে হয়েছিলো সংবাদগুলো সকলেরই জানা দরকার। সে সদর থেকে একটা রেডিও আনিয়ে যে ঘরগুলোতে সদানন্দর স্কুল বসতো সেখানে রেখেছে। গ্রামের সকলেই যেন তাদের ইচ্ছা আর সময়মতো শুনতে পারে, এরকম ব্যবস্থা।
বৈশাখের মাঝামাঝি। সুমিতিকে নেবার জন্য তার কাকা এসেছেন চিঠি পেয়েই। মনসা তাকে দুদিন থেকে যেতে রাজি করেছে।
তিনি কলকাতার ব্যারিস্টারপাড়ার মানুষ। তার কথা শুনে মনে হয়, রেডিও ও খবরের কাগজে সেসব সংবাদে দিগমণ্ডল আচ্ছন্ন হয়ে আসছে পাকা আবহবিদের মতো তার অন্তরস্থিত গতিপ্রকৃতির খবরও তিনি রাখেন। বিভিন্ন মত থাকতে পারে, তা সবেরই নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যারিস্টাররা। কলকাতাই আসল। তাকে দখলে রাখতেই শলাপরামর্শ। শুনে রূপু সুমিতিকে বলছিলো, দেখো, বউদি, এ যেন সেই কনৌজের জন্যই যুদ্ধ আবার।
সকালে সুমিতির কাকা সদানন্দকে সঙ্গে করে গ্রামের পথে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় সান্যালমশাইয়ের লাইব্রেরিতে গ্রামের কথাই হচ্ছিলো।
গ্রামের অনেক পথ আছে যেখানে গত বিশ বৎসরে সান্যালমশাই একবারও পদার্পণ করেননি। সেসব পথের ধারে যে-মানুষগুলি এককালে বাস করতো তাদের বংশধররা এখন বাস করে কিনা এ খবরও তার জানা ছিলো না। সদানন্দর মুখে বর্ণনা শুনে তার মনে হলো এইসব পথের উপরে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ছোটোখাটো দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে এবং যুদ্ধের এই পর্যায়ে অন্তত মানুষেরই বড়ো রকমের একটা হার হয়েছে। আর সে সব যুদ্ধে তার সংযোগ ছিল না।
এরপরে গ্রামের পুরাতন সমৃদ্ধির কথা উঠলো। কোনো কোনো পথে ধুলোর আস্তরণের নিচে ঘুটিং আছে বলে অনুমান হয়। সুমিতির কাকা এ থেকে গ্রামের সেকালের সমৃদ্ধি নির্ণয় করার উদ্যোগ করছিলেন।
সদানন্দ বললো, দরিদ্রের সংখ্যা আগের তুলনায় অবশ্যই বেড়েছে। ধনীদের সংখ্যাও, অন্যদিকে, বাড়েনি তাতে। গ্রামের গড় আয় তখন বেশি ছিলো। কারণ কৃষির সঙ্গে তখন শিল্পও ছিলো, এখন যাঁরা ধনী আছেন গ্রামে তাদের মতো মানুষের সংখ্যা নিশ্চয়ই তখন বেশি ছিলো।
সেসব পথঘাট ধনীরা কি নিজেদের জন্যই করেছিলেন?
সব ধনীরা নয়। পাটের সাহেবরা করেনি। অন্তত দুটি ভালো পথ, যার কিছু কিছু অংশ এখনো মজবুত আছে, নীলকর সাহেবরা তৈরি করেছিলো। কিন্তু কৌতুকের বিষয় এই যে, পথ দুটোর একটা গেছে পদ্মার পুরনো খাতের দিকে, অন্যটা কবরখানায়। সেখানে দু-তিনটি কবর আছে। তার মধ্যে একটি এক আর্মেনি বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মুন্সেফের। মনে হয়, এ-গ্রামে এক মুন্সেফি আদালত ছিলো।
এই সুবাদে মুন্সেফি আদালত থাকার গুরুত্ব থেকে গ্রামের আরও নেমে যাওয়ার কথায় স্তরে স্তরে যারা ধনী ছিলো তাদের কথা হলো। সেকালেই সেই ধনী কারিগর আর কুঠিয়াল দালাল থেকে নীলকর হয়ে পাটের সাহেবদের স্তর পর্যন্ত গ্রামের ধন ক্রমশ বেশি করে বাইরে গিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
তা ছিলো। বললেন সান্যালমশাই, সেরেস্তার পুরনো কাগজের মধ্যে চিকনডিহি মুন্সেফি আদালতের মোহর দেওয়া কাগজ পাওয়া যায়।
তাদের সকালের ভ্রমণ বুধেডাঙার প্রান্ত ছুঁয়েছিলো। বুধেডাঙার বয়স কম। দেখলে ছায়াসুনিবিড়তার কথা মনে আসেনা। সান্দাররা ফৌৎহওয়ার পরেনতুন করে যে চাষীরা বসেছে তারা তাদের জমিতে জঙ্গল হতে দেয়নি। দূর দূর বিস্তৃত তাদের নিরাবরণ জমি যেন জলের তৃষ্ণায় ক্লান্ত। ছোটো ছোটো কুঁড়েঘর, দু-একটি বিরলপত্র গাছ। পদ্মা থেকে বুধেডাঙার উপর দিয়ে প্রচুর ধুলো নিয়ে বাতাস এসে লেগেছিলো গায়ে।
ব্যারিস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, ফসলহীন এ চৈত্র-বৈশাখেই তো খাজনা দেয়া-নেয়ার ঝোঁক পড়ে।
সদানন্দ বললো, বছর শেষ হয় যে।
সান্যালমশাই ভাবলেন, বুধেডাঙার বয়েস বাড়তে বাড়তে এমন একসময় আসবে যখন। সেটাও প্রাচীন গ্রামের সবগুলি লক্ষণ অর্জন করবে। তার গাছপালাগুলি বেড়ে বেড়ে সূর্যালোক রোধ করবে। চাষের জমির জন্য সেখানকার কৃষকরা অন্যত্র দৃষ্টি দেবে। এমন হতে পারে, এখন যে বয়োজীর্ণ চিকন্দিকে দেখা যাচ্ছে, তখন সেটা বুধেডাঙার চাষীদের চাষের জমিমাত্র হবে। তাদের হাতে পড়ে চিকন্দি আবার নতুন হবে, কিন্তু তার আগে কি তার মৃত্যুই অপরিহার্য?
সুমিতির কাকা বললেন, আজকাল যেসব গ্রামোদ্যোগের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে তার ফলে এসব গ্রামের চেহারা বদলে যাবে। সদানন্দ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো।
গ্রামের চেহারা বদলে গেলে ব্যাপারটা কী রকম হয় সেটা কল্পনা করায় কৌতুক আছে। সান্যালমশাইয়ের মনে বঙ্কিমবাবুর উপন্যাসে পড়া সীতারাম প্রভৃতির রাজধানীর চিত্রটা ভেসে উঠলো। চওড়া চওড়া মাটির পথে বড়ো বড়ো পাল্কি চলছে। সেই ছবিতে তারপরে লালমুখো নীলকরদের দাদন নিয়ে শামলা-আঁটা দিশি মুৎসুদ্দিরা ঢুকে পড়লো।
অলস অবসর। সদানন্দ কথায় কথায় উন্নীত একটা গ্রামের ছবি এঁকে ফেলো।
সুমিতির কাকা বিলেতি বারে আহুত হয়েছিলেন। তিনি শহরের উপান্তে স্লেট, সিমেন্ট, কাঠ ও কাঁচের তৈরি ছোটো ছোটো কটেজগুলোর কথা বললেন, সেই সব বিলেতি গ্রামের বাঁধানো পথ ও ইলেকট্রিসিটির আলোর কথাও।
সান্যালমশাই হেসে বললেন, সদানন্দর কল্পনার গ্রামে বিলেতি সেসব গ্রামের ছাপই পড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এদেশের কয়েক কোটি কুটিরে খড়ের বদলে স্লেট, নলখাগড়ার বদলে সিমেন্ট :হার করতে গোটা হিমালয়টাকেই গলিয়ে নিতে হবে বোধহয়। আর সেই কয়েক লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা ভারতে ছড়াতে একটা নতুন মহাদেশ শোষণ করা দরকার হবে সম্ভবত।
এ তোমার অতিরিক্ত পড়ার ফলে কিনা জানি না সদানন্দ, একটুপরে আবার বললেন সান্যালমশাই, কিন্তু এখানে তুমি গ্রামোদ্যোগের সাহায্যে ট্রাকটর রাখার কল্পনাও কোরো না। এ দেশের চাষীরা তো রেডইন্ডিয়ান নয় যে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে খোঁয়াড়ে পুরে রেখে এসে মনের আনন্দে শূন্য জমিতে কলের মই টানবে।
.
অন্য আর-এক সময়ে অনসূয়ার সঙ্গে সান্যালমশাইয়ের কথা হলো।
সান্যালমশাই বললেন, এ অঞ্চলে সান্যালবংশটা রায়দের দৌহিত্র বংশ।
অনসূয়া এসব কথা জানেন। তিনি বুঝতে পারলেন সান্যালমশাই রায়দের সম্বন্ধে কিছু বলতে চান, এটা তার ভূমিকা।
সান্যালমশাই বললেন, রায়দের সঙ্গে আমাদের প্রধান পার্থক্য এই,তারা বেহিসেবি ছিলেন। এবং আমার আগেকার সান্যালমশাইরা তাদের বেহিসেবিচালে সুখী হতেন,কারণ সম্পত্তি বন্ধক রেখে নগদ টাকা সংগ্রহ করা রায়দের রেয়াজ ছিলো। কলকাতায় যে ফ্যাসন ষাট-সত্তর বছর কিংবা তারও আগে আধুনিক ছিলো, তাকেই আঁকড়ে ধরে ছিলেন রায়েরা। গরমকালেও মোজা পায়ে দেওয়া, তাঁতের ধুতির পাড় ছিঁড়ে পরা, পাঞ্জাবিতে লেস বসান, এসব ব্যাপারকে তারা সযত্নে লালিত করতেন এই সেদিন পর্যন্তও। কিন্তু দীর্ঘ ও আপাতদৃষ্টিতে বলিষ্ঠ দেহ নিয়েও তারা পঞ্চাশে পৌঁছতেন না। এখন জানি, সেটা অ্যালকোহহালিজমের ফল। শেষের দিকে রায়বাড়ির মেয়ে বউদের মধ্যেও সুরার প্রচলন হয়েছিলো। আমাদের প্রথা ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে স্ত্রী সংগ্রহ করার। পাকাপাকিভাবে বোহেমিয়ানা সেজন্যেই আমাদের উপরে ভর করেনি। কিন্তু
সান্যালমশাই তার কথার মাঝখানে থেমে গেলেন। অনসূয়া বুঝতে পারলেন, সান্যালমশাই। ‘কিন্তু’ বলে কী নির্দিষ্ট করতে চান। এত সতর্ক পদচারণার শেষে আজ সান্যালরাও যেন সেই লুপ্তির কিনারায় এসে পৌঁছলো, এই যেন তার বক্তব্য। অনসূয়া ভাবলেন–জমিদারি প্রথা নিয়ে পিতাপুত্রে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হবে এই আশঙ্কা ছিলো তার। কিন্তু যে ঘটনাগুলো ছেলেদের বেড়ে ওঠার মতো স্বাভাবিক তা যেন একটা পরাজয়ের মতো বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছে।
না-না, তিনি ভাবলেন, তিনি তো সেই অন্ধকার মন্দির বারান্দায় বসেই স্থির করে নিয়েছেন, সুমিতির এসবই আধুনিকতা, আধুনিক কালে স্বচ্ছন্দ হওয়ার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কখনো ভাবা উচিত নয় সুমিতির এসব সান্যালবাড়ির ভিত নড়িয়ে দেয়ার মতো কোনো স্রোত। রূপু ফিরে এলে তার চালচলনেও কত য়ুরোপের ঢং থাকবে। নিঃশব্দ সান্যালমশাইকে দেখে নিয়ে তিনি আবার ভাবলেন; তাছাড়া, দেখো, এই যে কী এক ঝাঁপটা লাগছে কালের, হয়তো এক প্রচণ্ড ঝড় আসছে, সুমিতিদের এসব হয়তো সেই ঝড়োবাতাসকে কাজে লাগিয়ে বাঁচার আদিম জ্ঞান। সমুদ্রে এরকম পাখি থাকে।
কবোষ্ণ জলে সান্ধ্যস্নান শেষ করে সান্যালমশাই স্টাডিতে গিয়ে বসেছিলেন। কিছুদিন থেকে তিনি কখনো কখনো অনুভব করছিলেন, পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছে তার কারো কারো সঙ্গে। পূর্বের পরিত্যক্ত সঙ্গী রায়দের কথা মনে পড়ছে মাঝে মাঝে। সুমিতি এসেছিলো এবং সে চলে যাবে, এ যেন তার জীবনের সম্ভাব্য ভবিষ্যতের অকালে মঞ্চাবতরণ এবং অন্তর্ধান। নিঃসঙ্গ নয় শুধু, পরাজিতও মনে হচ্ছে নিজেকে। চিন্তার এই পটভূমিকায় নতুন করে বাড়িঘর তৈরি করা হাস্যকর কিছু বলে মনে হলো। দাঙ্গায় যে দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন তা যেন নাটকীয়তার চূড়ান্ত। লাল কাপড় পেঁচিয়ে পরে যেনবা যাত্রাদলের রাজা সেজেছিলেন তিনি।
মেজেছিলেন তিনি। রায়েদের কথাই মনে জাগছে। তাদের সকলের প্রতীকরূপে প্রথম যৌবনে যাকে মধুরতা এবং রূপের কেলাসিত মূর্তি বলে মনে হয়েছিলো তার মুখখানা বারংবার মনে পড়ছে দীর্ঘ দু তিন যুগের ব্যবধানে। বিরহ নয়, অনুতাপও নয়, একটি বেদনার মতো বিষণ্ণতা।
তাঁর মনে হলো কে যেন লিখেছে–দুদিনে আমাদের কণ্ঠরুদ্ধ হবে, রেহাই দাও। সেই ইংরেজ কবিকে খুঁজবার জন্য তিনি পুঁথিঘরে ঢুকলেন।
সান্যালমশাই কবি সম্বন্ধে মত বদলালেন। কে যেন কানাগলি সম্বন্ধে কিছু বলেছে, তার মনে পড়লো। ভারি লাগসই কথা-বজ্রপাত নয়, হুড়মুড় করে পাহাড়ের চূড়া ভেঙে পড়া নয়, ককিয়ে কাতরিয়ে বিদায় নেওয়া। যে কবি রেহাই চেয়েছিলো,এ যেন তার চাইতেও স্পষ্টভাষী।
শিশু যেমন মায়ের প্রতি অন্ধ আবেগে নির্ভরশীল বই হাতে নিয়ে চলতে চলতে তার মনে হলো-মাটি ও পদ্মার উপরে তিনি তেমনভাবে আর আকৃষ্টনন, সেজন্যই কি তিনি এখানে নিজের জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। সম্বন্ধটা কৃত্রিম মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে রামচন্দ্রর কথা মনে হলো। সে যেন মাটি থেকে জন্মেছে। সুমিতির কাকা চাষী দেখতে চেয়েছিলেন, তার থেকে রূপু নায়েবমশাইকে বলেছিলো, চোপদারকে দিয়ে রামচন্দ্রকে ডেকে পাঠাতে। মনে হয়েছিল, সে ই এই মাটির বলবত্তম সন্তান, মাটির মতোই ধ্রুব। খবর এসেছিলো, রামচন্দ্র তীর্থে গেছে। পরে তিনি লজ্জা বোধ করেছিলেন এই ভেবে যে, রামচন্দ্রকে যেন দ্রষ্টব্য একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর মতো ব্যারিস্টারি চোখের সম্মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছিলো। কেন যে এখন এমন ভুল হচ্ছে। তার! এখন তার মনে পড়লো,নায়েব বলেছিলো–রামচন্দ্র উইল করতে চায়, তাকে দিয়ে জমির শক্ত কাজ আর হবে না। ছিদামের আত্মহত্যার ব্যাপারে রামচন্দ্র জড়িয়ে পড়ার কথাও তিনি জেনেছেন। আকস্মিকভাবে তার অনুভব হলো, একটি বেদনার আর্তিতে বিকল মানুষগুলো একত্র হয়েছে।
না, তিনি ভাবলেন, এ বিষণ্ণতার কারণ অন্য কোথাও। নৃপ গৃহী হবে এখানে–এ আশা তো অযুক্তির। রূপু দীর্ঘদিন কাছে থাকবে না, এ তো তার নিজেরই ব্যবস্থা। কিংবা বলবে, এই এক সূর্যোদয়ের ক্ষণে এই এক মেঘে মেঘে কালো দিন আসছে, যখন চোখের সামনে মেলে না ধরলে নিজের হাতকে যেন দেখা যাবে না, তখন তাদের দূরে যাওয়ায় এমন নিঃস্ব বোধ হচ্ছে?
কয়েকটা আলমারি পাশাপাশি সাজানো, সান্যালমশাই তার পিছন থেকে মানুষের সাড়া। পেলেন। সদানন্দ, নূপনারায়ণ, রূপু, সুমিতি এবং মনসা হাসাহাসি করছে, কথা বলছে।
সদানন্দ ওদের কাছে টাকা চাইছে, গুরুদক্ষিণার কথাও কী একটা বলছে।নৃপনারায়ণ তাকে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করছে। সকলেই প্রশ্নগুলির রসিকতায় হাসছে। পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকার বিনিময়ে মুঘল বাদশাদের কিছু ছবি আঁকা হাতে লেখা পুঁথি কিনতে চায় সদানন্দ। অবশ্য এ কথাও সে বলছে, যদি অনসূয়া, সুকৃতি, মনসা ও সুমিতির পোরট্রেটগুলো তাকে দেওয়া হয় তার মত বদলাতে পারে। রূপু জিজ্ঞাসা করলো, একক এগজিবিশান? মনসা বললো, শেষ সামন্ততান্ত্রিক জীবনের নজির। সকলে একসঙ্গে হেসে উঠলো।
সান্যালমশাই বই হাতে নিজের টেবিলে ফিরে এলেন। হঠাৎ তিনি যেন আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলেন। ইংরেজরা চলে যাচ্ছে তবু তাদেরই এক কবিকে তিনি তার মনের সাময়িক আশ্রয় হিসাবে গ্রহণ করছেন। এটাই তুলনা হতে পারে। দুটি মানুষ একত্র হলে পরস্পরের মনে ছাপ রেখে যাবেই। একটি বিশিষ্ট জীবনপদ্ধতি যেন আর-একটির সঙ্গে মিলিত হয়। তারা লোপ পেয়ে গেলেও কখনো তাদের একটা কথা, তাদের কোনো মন্দিরের একটি কালজীর্ণ স্তম্ভ আমাদের কালে খুঁজে পেয়ে সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জীবনের উত্তাপ আমরা অনুভব করি। জীবনের এই পরিণাম, এই একমাত্র লাভ, যদি লাভের কথা তোলো। যে ভাষার মৃত্যু অনিবার্য তার বার্ধক্যের কোনো সাহিত্যিকের প্রচেষ্টা যেন এই জীবন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন? কবোষ্ণ রক্তধারায় যা প্রবাহিত হলো?
রাত হয়েছে তখন। অনসূয়া এসে বললেন, খেতে দিচ্ছি।
সুমিতির কাকা, রূপু,নৃপ এবং সান্যালমশাই পাশাপাশি আহারে বসেছেন। রূপু এবং নৃপর নানা কথায় এটা বোঝা যাচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য ভালো আছে এবং জীবনের প্রতি তাদের আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই প্রবল। সান্যালমশাই তাদের আলাপে যোগ দিচ্ছেন এবং তার আলাপের সুরে মনে হলো সন্ধ্যার কথাগুলি যেন অবান্তর এবং প্রক্ষিপ্ত কিছু। কিন্তু হাসিমুখে পরিবেশনের খুঁটিনাটি নির্দেশ দিয়ে সুমিতিকে সাহায্য করতে করতে অনসূয়া যেসব আলোচনার অবতারণা করলেন তার সঙ্গে তার চিন্তাগুলির পার্থক্য থেকে গেলো। হাল্কা নীলে সাদা ডুরে খদ্দর পরেছে। সুমিতি। অনসূয়াকে উপদেশ দেওয়ার সময়ে তার শাশুড়ি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন খেতে দেওয়ার সময়ে শুধু পরিচ্ছন্ন নয়, সুরুচিসম্পন্ন বেশভূষাও কেন করা দরকার। অনসূয়া তখন বালিকা ছিলেন। সুমিতি যেন বলমাত্র বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে অনসূয়াও শাড়ি পালটেছেন। সুমিতির কাকা অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সের। এ-রকম আত্মীয়ের সম্মুখে সাদা শাড়ি পরাই অনসূয়ার প্রথা। আজ কিন্তু তার পরনের শাড়িতে ধূপছায়ার ছোঁয়াচ লাগলো। তার অন্তরের সঙ্গে বক্তব্যের মতোই পরিস্থিতির সঙ্গে পরিধেয়ের সচেতন পার্থক্য থেকে গেলো।
অনসূয়া কুটুম্বকে সমাদৃত করার ফাঁকে ফাঁকে চিন্তা করলেন, সান্যালমশাইয়ের মনের অবস্থাটা তার অনির্দিষ্টআলাপচারিতায় অত্যন্ত নির্দিষ্ট হয়ে ফুটেছে। রূপু চলে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের জন্য। সে যখন ফিরে আসবে তখন এই গ্রাম্য আবহাওয়ার কাছে তার কিছু পাওয়ার থাকবে না। নৃপ স্বভাবতই গ্রামের প্রতি বিমুখ। এসব কারণ থেকেই সান্যালমশাই নিজের পারিবারিক অবস্থাটাকে রায়বংশের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু সত্যি কি সব হারাচ্ছে?
কিন্তু অনসূয়া বললেন, আপনি কিছু খাচ্ছেন না, বেয়াইমশাই; আমার মনে হচ্ছে টেবিলে না বসে নিজেকে কষ্ট দিলেন।
না না। আজকালকার দিনে এমন সাহেব আর কেউ নেই। সাহেবরাই এ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সুমিতি তোমার সেই কলেজের চাকরির কথা শ্বশুর-শাশুড়িকে বলেছে তো?
এক মুহূর্ত বিচলিত হলো সুমিতি, মৃদু হেসে বললো, চাকরিটা হওয়ার মতো হলে তখন
ব্যারিস্টার চোখ তুলে অনসূয়ার মুখের দিকে চাইলেন। অনসূয়ার আশঙ্কা হলো, তার চোখের পাতা কি ঘনঘন পড়ছে? সামলালেন তাকে। বললেন, আমার বেটা বউ ঠিক বলেছে। কী যেন বলেন আপনারা, এখনই অনুমতি চাওয়াটা হাইপথেটিক্যাল হতো।
আহারাদির পর সান্যালমশাই যখন অতিথির সঙ্গে আলাপ করার জন্য স্টাডির দিকে যাচ্ছিলেন, অনসূয়া তার হাতে পান দিতে দিতে বললেন, যদি সময় করতে পারো ঘুমোনোর আগে আমার কাছে একটু এসো।
সান্যালমশাই অনসূয়ার ঘরে এসে দেখলেন তাঁর প্রিয় গড়গড়াটা শয্যার পাশে রয়েছে। ক্ষীণ সুগন্ধির ধোঁয়া উঠছে। অনসূয়া যেন বা ইতিমধ্যে শাড়ি পালটেছেন। সুমিতি যেমন পরেছিলো কতকটা যেন তেমন শাড়ি বলেই ধোঁকা লাগে। কিন্তু চেয়ে দেখলে বোঝা যায় হালকা নীলের জমিতে হালকা মটিফ তোলা ঢাকাই শাড়ি সেটা। অনসূয়ার কণ্ঠলগ্ন ন-কোনি তারার মধ্যে কাকের ডিমের চাইতে কিছু বড়ো একটা পান্না জ্বলছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে পান্নাটা তুলে ধরে সান্যালমশাই বললেন, কোথায় যেন, কার গলায় যেন এমনটা দেখেছিলাম?
অনসূয়া হাসলেন, তার কানের পাশ দুটি লাল হয়ে উঠলো, তিনি বললেন, বোধ হয় সে আমি।
সান্যালমশাইয়ের হৃদয়ে মধুবর্ষণ করলো অনসূয়ার কথার মধ্যে লুকোনো’বোধহয়’শব্দটির মৃদু ইঙ্গিত।
সান্যালমশাই বসলে অনসূয়া বললেন, আমাকে যদি কোনো বরের প্রতিশ্রুতি দিতে, আমি বলতাম সেবর এখুনি চাই।
তোমার গলার এই মালাটির জন্যই আমি বর দেব। কী চাই বলো?
কোথাও বেড়াতে চলো।
সঙ্গে কে কে যাবে?
মনসার শাশুড়ি যদি রাজী হন তবে মনসা যাবে।
সান্যালমশাই চুপ করে রইলেন।
অনসূয়ার মনে পড়লো হঠাৎ, সুকৃতির সেই ব্যাপারে সান্যালমশাই-এর রিভলবারসমেত হাত দুটোকে চেপে ধরতে হয়েছিল।
কিন্তু সান্যালমশাই হেসে বললেন, কী ভাবছো? ছেলেরা এতদিনে রুচিতেও মধ্যবিত্ত হলো?
অনসূয়া বললেন, আগেকার দিনে রাজারাজড়ারা এত হিসেব করতেন না তোমার মতো।
সান্যালমশাই হেসে গড়গড়ার নলটা সাগ্রহে তুলে নিতে নিতে বললেন, তথাস্তু।
কিছুক্ষণ আলাপ করে সান্যালমশাই যখন নিজের ঘরে ফিরলেন তার কিছুপরেই মনসা এসে ডাকলো, জ্যাঠামশাই।
দরজা খোলা ছিলো। সান্যালমশাই বই পড়ছিলেন!
মনসা বললো, জ্যাঠামশাই, বউদির সঙ্গে ধাত্রী যাচ্ছে, তারণের মা যাচ্ছে। তুমি নাকি রামপিরিতকেও যেতে বলেছে?
যাকে না। ওর বয়স হয়েছে এখন। দেশ-টেশ দেখুক না। ট্রামে বাসে চড়ার অভ্যাস করুক। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছিস যে?
মনসা বললো, ওর ভাব দেখে মনে হয়, ও সংকোচ বোধ করছে।
বোধহয় ব্যারিস্টারসাহেবের আর্দালির লাল আর সোনালি পোশাক দেখে। ওকে বলে দিয়ে এখানে যেন রঙিন ধুতির কোমরে উড়নি জড়িয়ে হাতে পাকা লাঠি নিয়ে বরকন্দাজী করে সেটাই যেন ও সর্বত্র বহাল রাখে। ওকে বলতে হয় না, বিদেশে গেলে মেরজাই পরে ঠিকই।
কথাটা আসলে বলেছিলো সুমিতি, সংকোচটা তারই।
মনসা উঠে দাঁড়ালোলা।
সান্যালমশাই বললেন, মণি, টাকা দেওয়ার ব্যাপারে কী করি বল তো? ধাত্রীদের বেতন, বউমার হাতখরচ, এসব কীকরে দেবো, কাকে দেবো? আর তাছাড়া বউমা যদি দীর্ঘদিন থাকেন কলকাতায়, একটা গাড়ি কিনে দেওয়া উচিত নয়? তাছাড়া খোকার ফ্ল্যাটটাই কি যথেষ্ট হবে?
মনসা হাসিমুখে বললো, আচ্ছা, কয়েক রকম প্রস্তাব করে তার একটিতে বউদিকে রাজী করাবো। কিন্তু জ্যাঠামশাই, ইংরেজদের কাছ থেকে রাজনীতির চালগুলো তুমি খুব ভালোই শিখেছো। বউদিরা আপাতত এই ডোমিনয়ন স্ট্যাটাস নিয়ে থাকুক।
এই বলেও মনসা হাসলো ঝিকমিক করে।
মনসা চলে গেলে সান্যালমশাই কিছুকাল রাজনীতির কথা ভাবলেন। তারপর তার মনে হলো ওরা চলে যাচ্ছে।নৃপ যদি কিছু না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটোছুটি করে বেড়ায় তা হলেও অন্যায় হয় না। যে আদর্শটাকে সামনে রেখে প্রথম যৌবনের আনন্দঘন দিনগুলিকে তপস্যার মতো ক্লেশে সে কাটিয়ে দিচ্ছিলো সেটা যদি অর্থহীন বোধ হয় তবে অস্থিরতা আসে বৈকি মনে। সদানন্দ পাসপোর্ট ইত্যাদির জোগাড় করতে পারলে রূপুর কাছে গিয়েই থাকবে। আর তা যদি না হয়, তবে সে নৃপকেই সাহার্য দিক। সাহচর্যের প্রয়োজন নৃপরই যেন বেশি।
অনসূয়া ঘুমোত পারলেন না সহজে। তিনিও দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। একটা অস্পষ্ট জ্যোৎস্না উঠেছে। বারান্দায় তারই আলো। রান্নামহলে দু-একজন লোক এখনো কাজ করছে। বাগানের কোনো গাছ থেকে একটা বক ডাকছে। অন্দরমহলের কার একটি শিশু ঘুমের ঘোরে একবার কেঁদে উঠলো। পাওয়ার-হাউসের শব্দটাও আসছে।
কে, মনসা? ঘুমোতে যাসনি?
রান্নার মহলে এখনো কাজ শেষ হয়নি ওদের। রুপোর বাসনগুলো দিয়ে গেলেই ভাঁড়ারে চাবি দিয়ে আমি ঘুমোতে যাবো।
হ্যাঁ রে মণি, আমি কি ওদের কাল খুব সকালেই কাজে আসতে বলে দিয়েছিলাম? মনে পড়ছে না।
সকালেই আসবে। আমি মনে করিয়ে দিয়েছি সকলকেই।
অনসূয়া নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরলেন। শিবমূর্তিটির সম্মুখে যে প্রদীপটি ছিলো সেটার বুক পুড়তে শুরু করেছে। প্রদীপটা নিবিয়ে দিলেন অনসূয়া। ঘরের অতি মৃদু আলোটা গিয়ে পড়লো মূর্তিটির গায়ে। মনে হলো সেটার জটায় শ্যাওলা পড়েছে। শ্যাওলা ঠিক নয়, তামার বাসনে যে কলঙ্ক পড়ে তেমনি কিছু যেন।
কথাটা অনসূয়ার মনে পড়লো। যারা কাল চলে যাচ্ছে তাদের সম্বন্ধে গৃহিণীর অনেক কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। একটি সাদৃশ্য কথাটাকে শুধু সোজা পথে মনে এনে দিলো। এবং এ কথাও বোধহয় সত্যি, মনসার বর্তমান মনোভাবের সঙ্গে সেদিনের মনোভাবেরও সাদৃশ্য নয় শুধু, ঐক্যও আছে। সেরাত্রিতেও অনসূয়া রান্নামহলের তত্ত্বাবধান করে ফিরে আসতে আসতে দেখতে পেয়েছিলেন মনসা আলসেতে আজকের মতোই হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপুর। রেডিওর কোনো সুর যেন মনসাকে সংসারের কলরোল থেকে আড়াল করে রেখেছিলো।
কী হয়েছে মণি?
অনসূয়া লক্ষ্য করলেন মনসার গালের উপরে অশ্রুর রেখা।
মনসার উত্তর না পেয়ে অনসূয়া তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।
অনসূয়ার মনে হয়েছিলো, সেই দাঙ্গার পর রেখেই মেয়েটাকে এমন ভাবতে দেখা যায়। আবাল্য অভ্যস্ত নিরাপত্তার বোধ চলে গেলে তাহয় আর এখন তো পুরুষদের পৃথিবীটাইটলমল করছে। এ অবস্থায় মেয়েদের হাসি আর ঝর্ণার মতো চমকায় না, নদী-প্রমত্ততা অন্তর্লীন হয়, হ্রদের স্নিগ্ধ ঔজ্জ্বল্য হয়ে উঠতে পারে একটা মেয়ে। কিন্তু তার আগে রাতের অন্ধকারকে সঙ্গী করে এমন কাঁদতে হয়।
অনসূয়া আবার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে, দেখলেন মনসা তখনও আলসেতে হাত দুখানা রেখে তেমন দাঁড়িয়ে। মনসার পাশে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো সে কি পুরুষদের কথা ভাবছে? সে তত ভাবনার কথাই। বললেন, দাদার কথা ভাবছিস? তুই কি নৃপর খদ্দর থেকে সিল্কে যাওয়াটাকে খুব মনে করেছিস? সদানন্দ ওসব নিশ্চয় খাদি থেকেই জোগাড় করেছে।
মনসার গাল বেয়ে চোখের জল নামলো। এই অন্ধকারেও সেই জল দূরের কোন দেয়ালগিরির আলোকে ধরলো।
অনসূয়া বললেন, মণি, তোর দাদা তো সেই কবে থেকেই–আর তার জন্য সদানন্দই দায়ী সেই যে সামন্তদের পরে বেনেরা এমন সবকীকী,আবার একটু ভাবলেন তিনি, আবার বললেন, কে পড়তিস রে, তুই না নৃপ?–এক বুড়ো বিধে দিয়ে ঢিল বেছে ফেলছে, কুশঘাসের স্তূপ থেকে হালকা সাদা ধোঁয়া, সেই যে আ মেইড অ্যান্ড হার ওয়াইট কাম্ হুইস্পারিং বাই, সংগ্রামের ইতিহাস মুছে গেলেও, তাদের গল্প ফুরাবে না।
মনসা বললো, কিন্তু ওরা যদি আর ভালোবাসতে না পারে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার লজ্জাই তবু ওদের একত্র রাখে?
অনসূয়া খুঁজে পেলেন না কী করবেন। তার চারপাশ দিয়ে মুহূর্তগুলো এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছে। তিনি নিচের সেই ম্লান আলোর চকটাকে দেখতে দেখতে ভাবলেন, ভালোই যে পুরুষরা এখন ঘুমিয়েছে।বললেন, মণি, তাহলে তুই রূপোভাঁড়ারে তুলেই শুতে যাবি তো? তাই যাস।
ঘরে ফিরে এলেন অনসূয়া। মৃদু আলো জ্বালা সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
একবার তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলতে গেলেন, আমিও মধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসেছিলাম এই পরিবারে। শিখতে হয়, এখানে এই দেয়ালগুলোর মধ্যে, অনেক ব্যাপারে, প্রথা নয়’ এই দুটো শব্দই শেষ কথা।
কিন্তু কোথাও যেন কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদলো তার মনের মধ্যে। সুকৃতির জন্য যে আবেগ তার অন্তরে সঞ্চিত তার সহোদরাকেই যেন তিনি সুমিতির জন্যও অনুভব করলেন।
কিছুক্ষণ তিনি চিন্তা করলেন:সবকিছুতে আস্থা হারিয়ে ফেলেনতুন কিছুতে পৌঁছে যাওয়ার দুঃসাহসের এই পরিণাম, সুমিতি? আহা, তোমরা, বোধ হয়, সব কিছুই নিখাদ করতে চেয়েছিলে। যেন আমাদের এই পৃথিবীতে তা সম্ভব! দেখো সুমিতি, পুরুষদের পৃথিবী ফেটে যাচ্ছে। তুমি
বললেও তারা জানবে তাদের প্রত্যাশা ভেঙে পড়ছে। এখন কি কূলনাশিনী টান দিতে হয়? স্তব্ধ তড়াগের মতো থাকতে হয় না। নতুবা সুপেয়তার আশ্বাস কোথায় পায় তারা?
অনসূয়া বোধহয় নিজেকে মনকে অবগাহনযোগ্য করতে গেলেন। যেন সম্মুখবেগে সংহত করার চেষ্টাতে সেখানে আবর্ত আলোড়ন ঘটে গেলো। আবেগগুলো গলার কাছে চাপ দিচ্ছে। তিনি নিজের চারিদিকে চাইলেন। তার সুবিধা হলো। ঘরটা প্রায়ান্ধকার আর স্নিগ্ধ, তৈজস আসবাব পৃথক হয়ে চোখে পড়ছে না। বরং কাদের যেন স্নেহশীলা আশ্রয়গুহা। তিনি নিজেকে সেই ঘরের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন।