কামারপাড়ার হত্যাকাণ্ডে নায়েব পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী খুবই মর্মাহত। দশরথের মৃত্যুর দুইদিন পর মুকুন্দ সাহাকে খবর দিয়ে কাছারিতে সে ডেকে এনেছে কামারপাড়ার লোকদের, কেষ্ট পালকে খরব দেওয়া হয়েছিলো, সেও এসেছে কয়েকজনকে নিয়ে। টাউনের সতীশ মুক্তার আর সেরপুরের অনিল সান্যাল ছাড়াও আরো দুজন বাবু বসে সিগ্রেট টানছিলো, এদের একজনের চিকন ফ্রেমের চশমা, আরেকজনের হাতে ইংরেজি খবরের কাগজ।
আগে খবর দিলে ভালো চিকিৎসা করা যেতো। বাপটাকে হয়তো বাঁচাতেও। পারতিস। তা তোদের খাতির তো সব বেজাতের মানুষের সাথে, তাদের হাতে জান গেলেও নিজেদের মানুষের কাছে আসিস না। নায়েববাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর দশ টাকার কড়কড়ে দুটো নোট তুলে ধরে যুধিষ্ঠিরের দিকে। তার পরিত্যক্ত দীর্ঘশ্বাসে নোট দুটো উড়ে পড়ে মেঝেতে, যুধিষ্ঠির উপুড় হয়ে টাকা তুলতে তুলতে শোনে, বাপটা তোর বড়ো ভালো মানুষ ছিলো রে। এই সাদাসিধা লোকটাকেও ওরা ছাড়লো না।
কেন, এখন তো বেটাদের মুখে আবার ইউনিটির বুলি। সতীশ মুক্তার ক্ষোভ ও রাগ চেপে রাখতে কথা বলে একটু ধীরে ধীরে, সুরাবর্দি নিজের হাতে পিস্তল দিয়ে হিন্দু মারলো, মীনা পেশোয়ারিকে দিয়ে কতো কতো হিন্দুর প্রাণ নিলো। পাঞ্জাব থেকে পুলিস আনিয়ে হিন্দু মারলো কতো। আবার ধুয়া তুলেছে ইউনাইটেড সভেরিন বেঙ্গলের। নেড়েগুলো কতোরকম ফন্দিই যে জানে!
নেতাজির ভাইও তো ইউনাইটেড়, বেঙ্গলের পক্ষে। অনিল সান্যাল একটু ভয়ে ভয়েই বলে, শরৎ বোস, কিরণশঙ্কর রায়, সত্য বকসি, তারপর ধরুন আমাদের সুরেনবাবু,-।
আরে রাখেন। নেতাজির ভাই হলেই নেতাজি হওয়া যায় না। সতীশ মুক্তার এবার আর রাগ চেপে রাখতে পারে না, সাত ঘাটের মাছ খেয়ে বিড়াল সেজেছে সাধু তপস্বী! সুরাবর্দি হিন্দু মারে নি? তার সঙ্গে এরা জোটে কী করে? আমাদের শ্যামাপ্রসাদ ইজ রাইট, উই ডিমান্ড এ ডিভাইডেড বেঙ্গল ইভন ইন এ্যান আনডিভাইডেড ইনডিয়া। নো মোর উইথ দি বারবেরিয়ান মহামেডানস।
টিন থেকে আরেকটি সিগ্রেট বার করে ধরাতে ধরাতে রোল গোল্ডের ফ্রেমওয়ালা বাবু বলে, রিলিজিয়ন যে খুব বড়ো ফ্যাকটর তা নয়। কিন্তু দে বিলং টু এ ডিফারেন্ট কালচারাল লেবেল। উই ক্যান নট লিভ টুগেদার। ইস্পসিবল।
সেদিন গোলাবাড়িতে অজয় দত্ত বোর্মকে নিয়ে এসেছিলো গোলাবাড়িতে ইসমাইলের সঙ্গে। কামারপাড়ায় খুব সোয়াগ দেখিয়ে ভাত খেয়ে গেলো মণ্ডলের বাড়ি। দত্তবাড়ির ছেলে, তার অধঃপতনটা দেখুন। বলতে বলতে সতীশের রাগ চড়ে যায়, কামারপাড়ায় আগুন দিলো যারা, তাদের বাড়ির অন্ন তুলিস মুখে? এবার সে ঝাল ঝাড়ে অনিল সান্যালের দিকে, সেরপুরে নাকি কংগ্রেস পাব্লিক মিটিং করলো ঐ ইসমাইলকে নিয়ে? আপনাদের রুচির বাহাদুরি বটে!
ইসমাইলকে আর দোষ দেবে কি, সেদিন সেরপুরের মিটিঙে অনিল সান্যাল নিজেই আবেগময় এক ভাষণ ছাড়লো অবিভক্ত বাঙলার পক্ষে। কিন্তু এর কয়েকদিনের মধ্যেই জ্যাঠতুতো দাদার চিঠি পেয়ে অনিল খুব দমে যায়। দাদা লিখেছে, তোমরা হিন্দু বাঙালি কি আত্মঘাতি হইতে চাও? নিম্নবর্ণের ধর্মান্তরিত অমার্জিত কুলাঙ্গারদিগের সহিত এক রাষ্ট্রভুক্ত হইয়া বাস করিবার কুমতি বর্জন কর। এইরূপ উন্মাদনা হইতে আরোগ্য লাভ না করিলে উত্তরাধিকারিগণের প্রতি যে অন্যায় করিবে উহা ক্ষমার অযোেগ্য। দাদা তার মহাপণ্ডিত মানুষ, ইংরেজি লিখে বিলাতের সায়েবদের পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিয়েছে, এখন দিল্লী রেডিওতে ইংরেজি স্ক্রিপ্ট লেখে। দাদা বাঙলায় লেখে খুব কম, লিখলেও, সাধু ভাষার নিচে কখনোই নামে না। তা সেই দাদা পর্যন্ত নিদারুণ ক্রোধবশত পত্রের উপসংহারে গুরুচণ্ডালী দোষ ঘটিয়ে ফেলেছে, তোমরা কি বৃটিশ সাম্রাজ্যের কল্যাণে অর্জিত শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়া চাষাদের সঙ্গে থাকতে চাও?
চিঠি পড়ে অনিলের মন খারাপ হয়ে যায়, তার দলের সহকর্মীদের মধ্যে মুসলমান কম থাকলেও তারা কি সবাই চাষাভূষা? আবার তার দাদার ইংরেজি লেখা এই ছোটো জেলায় পড়ে আর কয়জন? অনিল সান্যালের চেনাজানা লোকদের মধ্যে এক ইসমাইল হোসেনের বাবাই তো দাদার ইংরেজির পরম ভক্ত। কিন্তু দাদা তার বংশের গৌরব, তার কথা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কি আর অনিলের হয়? সে এখন চুপ করে সতীশ মুক্তারের কথা শোনে।।
ইউনাইটেড সভেরিন বেঙ্গল মানেই মুসলমানদের পার্মানেন্ট মেজরিটি মেনে নেওয়া। ওদের সংখ্যা তো বাড়ে অনেক বেশি, একেকটা মুসলমান বিয়ে করে তিনটে চারটে করে, বাচ্চা প্রডিউস করে ডজন ডজন। আমরা কি এই লেভেলে নামতে পারবো?
নামা উচিত? শরৎ বোস বোঝে কী? প্যাটেল কি জওহরলালের ফারসাইটেডনেস কি তার আছে?
সতীশ মুক্তার কথা বলতেই থাকে আর নায়েববাবু নিচু গলায় উপদেশ দেয়, কামারদের, এখন আমাদের দরকার এক হওয়ার। জমিদারবাবু এখন থেকে সন্ন্যাসীর স্থানে দুর্গাপুজা করবেন। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব হিন্দু সেখানে মিলিত হবে, ভক্তিভাবে মিলিত হবে। মুসলিমদের দেখোনা, ওদের ঈদ ফিদ কী সব হলে সব পালে পালে জুটে যায় এক ময়দানে। সেখানে কি তোমাদের ঢুকতে দেয়?
কেষ্ট পাল প্রতিবাদ করে, কিন্তু পোড়াদহ মেলাত এটিকার মোসলমান সোগলি আসে। গোলাবাড়ি থাকা পোড়াদহ মেলার সন্ন্যাসীর থান পর্যন্ত ঘোড়দৌড় হয়, তার সওয়ারি তো ব্যামাক মোসলমান।
কিন্তু সন্ন্যাসীরা তো ছিলো মুসলমানের শত্রু, সে খবর রাখো?
না বাবু।
তুমি বেশি জানো? সতীশ মুক্তার কেষ্ট পালকে ধমক দেয়, সন্ন্যাসীরা ম্লেচ্ছদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলো, তা জানো? আনন্দমঠ পড়েছো?
না বাবু। বলে কেষ্ট পাল তার আনন্দমঠ না পড়ার তথ্য এবং সতীশ মুক্তারের কথায় অবিশ্বাস প্রকাশ করে এক সঙ্গে, হামাগোরে ভবানী সন্ন্যাসীর সেনাপতি আছিলো। এক পাঠান। বলতে বলতে কেষ্ট পালের আত্মবিশ্বাস এতোটাই বাড়ে যে গল্পের মধ্যে সে ইতিহাস ঢুকিয়ে দেয়, ফকির মজনু শাহ আছিলো ফকির রাজা, আর সন্ন্যাসী দলের রাজা আছিলো ভবানী সন্ন্যাসী।
কোথাকার রাজা হে? নাটক নভেল না পড়লে কী হয়, ইতিহাস বেশ মেলা পড়েছে। ইংরেজি খবরের কাগজ হাতে বাবুর ঠাট্টা না বুঝে কিংবা গায়ে না মেখে কেষ্ট পাল বলে, এই দুইজন যুদ্ধ করিছে কোম্পানির গোরা সেপাইয়ের সাথে। আর পাকুড়গাছের মুনসি শুনিছি আছিলো মজনুর সাথে। আবার বৈকুণ্ঠ কয়, না, ঐ মুনসি হলো ভবানী সন্ন্যাসীর সেনাপতি। মরার পরে মুনসি ঠাঁই লেয় পাকুড়গাছে। কয় বছর পর পর আষাঢ় মাসের অমাবস্যার রাতে বিলের মধ্যে যে কাত্রা ভার্সা ওঠে সেটাত বলি। দেওয়ার পাঠাও পাঠায়া দেয় ঐ মুনসি। বিলের গজার মাছ সেদিন পাঠার আকার পায়।
বাঃ তোমাদের ঐ মুনসি মনে হয় ম্যাজিশিয়ান। ঠাট্টা করলেও এই বাবু দেশবাসীর কুসংস্কারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, পিপল এতো সুপারস্টিশাস হলে ইনডেপেনডেন্স উইল বি মিনিংলেস! আরে তোমার ঐসব লোক রাজাউজির নয়, ফকির সন্ন্যাসীও নয়, বুঝলে? সব ডাকাত। বুঝলেন পূর্ণবাবু, নায়েববাবুর দিকে তাকিয়ে সে বলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে ল এ্যন্ড অর্ডার রেস্টোর করতে গেলে এদের সঙ্গে ক্ল্যাশ হয়।
ডাকাত লয় বাবু। এবার যুধিষ্ঠির পর্যন্ত বলে ওঠে, ডাকাত লয়, সন্ন্যাসী। এই দেখেন না, ইটখোলা করলো মণ্ডলের বেটা, পাকুড়গাছ লিয়া কোনটে উড়াল দিছে মুনসি। তার অভিশাপেই তো ইগলান অনাছিষ্টি শুরু হছে। দুই বছর হলো শুনি সন্ন্যাসী। ঠাকুরও মেলা দেখবার আসে না।
কেষ্ট পাল কথাটা তুলে নেয় নিজের মুখে, সন্ন্যাসীক দেখবার পায় বৈকুণ্ঠ, অরা তো তার সাথেই এটি আসিছিলো। তা দুই বচ্ছর বৈকুণ্ঠ তার আর দেখা পায় না। আবার। তার স্থানে যদি অন্য কোনো পূজা হয় তো হামাগোরে সব্বোনাশ হয়া যাবি বাবু!
এসব শুনে তো নায়েববাবুর ক্ষান্ত দিলে চলে না, তার দায়িত্ব অনেক বেশি। সে বলে, আর জমিদারি উঠ্যা গেলে? ওটা তো জমিদারের খাস ল্যান্ড, জমিদারি উঠ্যা গেলে। তোদের ঐ পূজা হবে?
হবি না কিসক বাবু? কেষ্ট পাল জোর দিয়ে বলে, দলিল দেখেন। দলিলে ল্যাখা আছে, সন্ন্যাসীর থানের সাত শতাংশ জমি সাধারণ্যের ব্যবহারের নিমিত্ত নির্দিষ্ট রহিল।
এ কথা পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর ভালো করে জানা আছে। বলে, তা সন্ন্যাসী ঠাকুরের এতো ক্ষমতা, সে কি তোদের রক্তও শীতল করে দিয়েছে নাকি?
না বাবু। যুধিষ্ঠিরের স্বল্পবাক বোনাইয়ের রক্ত উত্তপ্ত হয়, অক্ত হামাগোরে গরমই আছে। আপনারা চরণে ঠাঁই দিলেই হামরা ভরসা পাই।
চোখা চোখে নায়েববাবু এই কর্মকার তরুণটিকে দেখে, চোখ না নামিয়েই সে মা বলে, মাথা গরম করে কোনো কাজ করো না বুঝলে? তুমি আমার সঙ্গে একটু কথা বলে যেও তো। সাপও মারতে হবে, লাঠিও ভাঙা চলবে না।