কবি শামসুর রাহমান ভেতরের দিকের একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে আছেন। গ্রামের নাম পাড়াতলী। নরসিংদীর পাড়াতলীর যে বাড়িতে তিনি বাস করছেন সেটা মাটির। তার জানালা আছে। গ্রামের মানুষ বড় জানালা পছন্দ করে না। রেলের টিকিটঘরের জানালার মতো ছোট্ট জানালা। সেই জানালায় ঘরের ভেতর আলো-বাতাস কিছুই আসে না। তবুও তো জানালা।
কবি জানালার পাশে বেতের মোড়ায় বসে আছেন। বেতের মোড়াটা এই বাড়ির সবচে আরামদায়ক। একটাই সমস্যা–হেলান দেয়া যায় না। সবসময় ঋজু অবস্থানের কথা মনে রাখতে হয়। অবশ্যি এখন যে সময় সেই সময়ে ঋজু থাকারই কথা। তিনি উঠোনের দুটো বেগুন গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেগুন গাছে বেগুন হয়েছে–অদ্ভুত বেগুন। হাঁসের ডিমের মতো ধবধবে সাদা রঙ। এই জিনিস তিনি আগে দেখেন নি। মনে হচ্ছে গাছে ডিম ফলে আছে। তিনি নাগরিক মানুষ। এখন গ্রামে পড়ে আছেন। গ্রামগঞ্জের অনেক খুঁটিনাটি তাকে আকৃষ্ট করছে। কোনো একটি বিশেষ দৃশ্যে যখন তাঁর চোখ আটকাচ্ছে তিনি মনে মনে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা আবৃত্তি করছেন—
Heaven gives Her glimses only to those
Not in a position to look too close.
কবি সাহেব কি আছেন? কবি সাহেব!
কেউ কি তাঁকে খুঁজছে? নাকি তিনি ভুল শুনছেন? মেয়েলি ধরনের এই পুরুষগলা তিনি কি আগেও শুনেছেন? যেখানে তিনি অজ্ঞাত বাস করছেন সেখানে কবি সাহেব হিসেবে কেউ তাকে চেনার কথা না! অপরিচিত কেউ ডাকছে?
কবি চমকালেন। এখন দুঃসময়। দুঃসময় অপরিচিত আহ্বানের জন্যে ভালো না।
কবি খালি গায়ে আছেন। কড়া সবুজ রঙের লুঙ্গি নাভির উপর পরেছেন। অন্ধকারে তাঁর ফর্সা দুধসাদা শরীর জ্বলজ্বল করছে। এই অবস্থাতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে কিছু দেবার কথা তাঁর মনে হলো না। এই গণ্ড গ্রামে নাগরিক সভ্যতা ভব্যতা দেখাবার কিছু নেই। সুরুচি? দুঃসময়ে সুরুচি প্রথম নির্বাসনে যায়।
কবি কি আমাকে চিনেছেন? আমি শাহ কলিম। আপনার খাদেম।
আমার খাদেম মানে কী? আমি কি পীর সাহেব?
আমার পীর তো অবশ্যই।
কলিমুল্লাহ কদমবুসি করার জন্যে নিচু হলো। কবি চমকে সরে গিয়েও কদমবুসির হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না। কলিমউল্লাহ হাসিমুখে বলল, আপনাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে লিভিংস্টোনের সাক্ষাৎ পেলাম।
তার মানে?
আমাজানের জঙ্গলে লিভিংস্টোন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে কমিশন করে একজনকে আমাজানে পাঠানো হলো। তিনি অনেক ঝামেলা করে লিভিংস্টোনের খোঁজে উপস্থিত হলেন। গভীর অরণ্যে একদল কালো মানুষের মধ্যে একজন সাদা মানুষ দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন,। presume you are Dr. Livingstone.
কবি কলিমউল্লাহর দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষটা হড়বড় করে কী বলছে কিছু তার মাথায় ঢুকছে না। সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে, মানুষটাকে তিনি চিনতে পারছেন না। দাড়ি রাখার কারণে কি তা হয়েছে? আজকাল অনেকেই দাড়ি রেখে চেহারা পাল্টে ফেলছে। দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় টুপি। নতুন লেবাস।
লিভিংস্টোন সাহেবের মতোই আপনার গায়ের রঙ। পড়েও আছেন বলতে গেলে আমাজানের জঙ্গলে। কবি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেন নাই। দৈনিক পাকিস্তান অফিসে আপনার সঙ্গে পরিচয়। আপনার একটা কবিতা ঝাড়া মুখস্থ বলেছিলাম। আসাদের শার্ট। মনে পড়েছে?
শামসুর রাহমান হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুঝালেন তিনি চিনেছেন। আসলে মোটেই চিনতে পারেন নি।
আপনাকে মনে মনে খুঁজছিলাম, এইভাবে যে পেয়ে যাব ভাবি নাই।
কীভাবে পেয়েছেন?
সে এক বিরাট ঘটনা। বসে বলি? ঘরে কোথাও গিয়ে বসি?
শামসুর রাহমান বিব্ৰত ভঙ্গিতে বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।
শাহ কলিম নামের মানুষটাকে তিনি এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। নিজে দুহাতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূর থেকে যে কেউ দেখলেই ভাববে, শাহ কলিম যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে। সেইজন্যে তিনি দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন।
কবি বললেন, চা খাবেন?
শাহ কলিম বাংলাঘরের বিছানায় পাতা পাটিতে বসতে বসতে বললেন, চায়ের ব্যবস্থা কি আছে?
আছে, গুড়ের চা।
বাহ ভালো। গুড়ের চা অনেক দিন খাই না। চা খাব। আপনার সঙ্গে বসে চুঢ়া খাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মহা ভাগ্য!
কবি চায়ের কথা বলতে গেলেন। সার্ট গায়ে দিতে হবে। খালি গায়ে এই মানুষের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। চা খেয়েই যে বিদায় হবে তাও মনে হয় না। এই লোকটা অবশ্যই খুঁটি গেড়ে বসা টাইপ লোক।
কলিমউল্লাহ গুড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে আহ বলে তৃপ্তির শব্দ করল।
চা ভালো হয়েছে। গুড়ের গন্ধ চায়ের গন্ধ মিলে একাকার হয়ে গেছে। এই চা এক কাপ খেলে হবে না। আরেক কাপ খাব।
শামসুর রাহমান হতাশ গলায় বললেন, অবশ্যই খাবেন। তবে আমি ব্যস্ত আছি। আপনাকে বেশি সময় দিতে পারব না।
স্যার, আমাকে কোনো সময়ই দিতে হবে না। আপনি আপনার কাজে যান। আমি আছি। চা খাব। কবি-কুটিরে কিছুক্ষণ থেকে চলে যাব।
আমার খোঁজ পেয়েছেন কীভাবে?
সেটা স্যার ইতিহাস পর্যায়ের ঘটনা। আমি চড়নদার হিসেবে একটা ফ্যামিলি নিয়ে যাচ্ছি গ্রামে। এক পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেবের ফ্যামিলি। তাঁর স্ত্রী, তিন মেয়ে, এক ছেলে। আপনার গ্রামে এসে ইন্সপেক্টর সাহেবের ছোট মেয়ে মাসুমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। নাকে রুমাল চেপে ধরলে কিছুক্ষণের মধ্যে রুমাল রক্তে লাল। এই গ্রামে তাদের আত্মীয় বাড়ি আছে। সেখানে আপাতত উঠেছি। মাসুমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আবার রওনা দেব। আমরা যাচ্ছি ফরিদপুরের দিকে। মাসুমাদের আদি বাড়ি ফরিদপুরে।
ও আচ্ছা।
পাশ করা কোনো ডাক্তার পেলাম না। হিন্দু এক ডাক্তার ছিল। হরি বাবু নাম। সে তার গুষ্ঠী নিয়ে মিলিটারির ভয়ে ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছে। এটা একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে–বন্যেরা বনে সুন্দর, হিন্দুরা হিন্দুস্থানে।
এটা কেমন কথা?
কথার কথা বলেছি স্যার। এটা গুরুত্বের সঙ্গে নিবেন না। মূল বিষয়টাই আপনাকে বলা হয় নাই, কীভাবে আপনার খোঁজ পেলাম। মাসুমার এক খালু বললেন, আপনি এই গ্রামে লুকিয়ে আছেন। তবে স্যার লুকিয়ে থাকার জন্যে জায়গাটা ভালো না।
ভালো না কেন?
কেউ যদি আপনাকে খুঁজে বের করতে চায়, তার চোখ বেঁধে দিলে সে চোখ বাধা অবস্থায় আপনাকে খুঁজে বের করতে পারবে। কারণ আপনি পালিয়ে আছেন আপনার নিজের গ্রামের বাড়িতে। পালানোর সবচে ভালো জায়গা কি জানেন স্যার?
না।
পালানোর সবচে ভালো জায়গা হলো হিন্দুস্থান। দাগি লোকজন সব বর্ডার পার হয়ে যাচ্ছে।
দাগি লোকজন মানে?
এন্টি পাকিস্তান লোকজন।
আপনি নিজে কোন দিকের মানুষ?
স্যার শুনেন, আমার দাড়ি, চোখের সুরমা সবই লেবাস। লেবাস পরে পাকিস্তানি সেজেছি। বাঁচার উপায় একটাই।–লেবাস পরিবর্তন। খোলস দেখে বিভ্রান্ত হবেন না স্যার।
কবি নিঃশ্বাস ফেললেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। লোকটি সত্যি কথা বলছে না মিথ্যা বলছে তাও ধরা যাচ্ছে না।
গ্রামে বাস করতে কি ভালো লাগছে?
কবি মাথা নাড়লেন। গ্রাম তার ভালো লাগছে কি লাগছে না—তা তাঁর মাথা নাড়া থেকে ঠিক বোঝা গেল না।
স্যার, আপনার উচিত শহরে চলে যাওয়া।
কেন?
যেখানে অনেক মানুষ থাকে, সেখানে গোপনে বাস করা যায়। গ্রামে গোপনে থাকতে পারবেন না। দেখেন না। আমি কীভাবে চট করে আপনাকে খুঁজে বের করে ফেলেছি।
হুঁ।
পত্রিকা অফিসে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করে দেন। কেউ আপনাকে ঘাটাবে না। আপনি নিজের মনে থাকবেন। কবিতা লিখবেন। মিলিটারির দিক থেকে আপনার কোনো ভয় নেই।
ভয় নাই কেন?
আপনার মতো সম্মানিত কবিকে মিলিটারি কিছু বলবে না। তারা পৃথিবীকে দেখাতে চায় ঢাকা স্বাভাবিক। আমার কথাটা স্যার রাখেন। ঢাকায় চলেন।
আপনার স্বাৰ্থ কী?
আপনি নিরাপদে আছেন। নিজের মনে লেখালেখি করছেন–এইটাই আমার স্বাৰ্থ। গ্রামে আপনার নিরাপত্তা নাই। শান্তি কমিটি আলবদর কত কিছু তৈরি হচ্ছে। কখন আপনাকে ধরে নিয়ে যায়—এইটাই আমার ভয়। এরা যদি ধরে নিয়ে যায় তার হিসাব থাকবে না। মিলিটারি ধরলে তার হিসাব থাকবে।
আপনার কি চা খাওয়া হয়েছে?
জি।
দিব আরেক কাপ?
না থাক, মনে হয় আপনি আমার ওপর নারাজ হয়েছেন। কবি, আপনি আমার ওপর নারাজ হবেন না। আমি নিজে কবিতা লিখি, আমি জানি আপনি কী!
আমি নারাজী হই নি।
কবিতা লেখেন না? মিলিটারির ক্রাকডাউনের পরে কিছু লিখেছেন?
হুঁ।
যে-কোনো একটা কবিতা কি আমি পড়তে পারি? আমার খুবই ইচ্ছা! ক্ৰাকডাউনের পরে লেখা একটা কবিতা পড়ি।
কেন?
কবিদের বলা হয় দেশের আত্মা। আমি কথাটা বিশ্বাস করি। যারা সত্যি সত্যি কবি, তারা অবশ্যই দেশের আত্মা। আমি না। আমি কবি হিসেবে দুই নম্বরি, দেশের আত্মা হিসেবেও দুই নম্বরি। আপনি তা না। আপনার এখনকার কবিতা পড়লে বোঝা যাবে দেশের অবস্থা কী?
সত্যি সত্যি পড়তে চান?
জি।
কয়েকদিন আগে দুটা কবিতা একসঙ্গে লিখেছি। আমার কাছে এরা দুই যমজ কন্যার মতো।
কবি, কবিতার খাতাটা নিয়ে আসেন পড়ি। আর যদি তেমন তাকলিফ না হয় তাহলে আরেক কাপ গুড়ের চা।
কবি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর যাবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। যেন তিনি ধরতে পারছেন না। এই মানুষটাকে তাঁর দুটি অতিপ্ৰিয় কবিতা শোনানো ঠিক হবে কি-না।
কলিমউল্লাহ অনেকক্ষণ বসে রইল। কবিতার খাতা নিয়ে আসতে এত সময় লাগার কথা না। মনে হচ্ছে কবি একই সঙ্গে কবিতা এবং চা নিয়ে ঢুকছেন। কলিমউল্লাহর ভালো ক্ষিধা লেগেছে। গুড়ের চায়ে এই ক্ষিধা যাবার কথা না। গুড়ের চা খেলে উল্টা ক্ষিধা বাড়ে। গ্রামের এই সমস্যা–চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্যে কিছুই থাকে না। বিস্কুট-চানাচুর কিছু না। দুএক জায়গায় পাকা পেপে কেটে দেয়। চায়ের সঙ্গে পাকা পোপে খাওয়া যায় না। গ্রামের বেকুবরা এটা বোবে না।
কবি নিজেই চা নিয়ে ঢুকলেন। এক কাপ চা, আরেকটা পিরিচে দুটা মুড়ির মোয়া। কবি চা এবং মুড়ির মোয়া কলিমউল্লাহর সামনে রাখতে রাখতে বললেন, আজ কবিতা শোনাতে ইচ্ছা হচ্ছে না।
কলিমউল্লাহ মুড়ির মোয়াতে কামড় দিয়ে বলল, ইচ্ছা না হলে থাক। কবির ইচ্ছার উপরে কোনো কথা চলে না।
গ্রামে বসে কবি শামসুর রাহমান যে দুটা কবিতা লিখেছিলেন তার একটির নাম স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা—
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্ৰাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খা-খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি কালবোশোখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকুল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি
পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্ৰ শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নাম পাতায় মেহেদির রঙ।
স্বাধীনতা তুমি
বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকির অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়সী বটের ঝিলিমিলি পাতা
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা
প্ৰায় সন্ধ্যা।
কলিমউল্লাহ ফিরে যাচ্ছে। অনেকটা পথ হেঁটে বাজারে উঠলে রিকশা-ভ্যান পাওয়া যাবে। কাঁচা রাস্তায় রিকশা-ভ্যানে চড়াও এক দিগদারি। বাকুনির চোটে কলিজা ফুসফুস হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ধাক্কাধাব্ধি হয়। এরচে হেঁটে যাওয়া ভালো। কলিমউল্লাহর হাঁটতে সমস্যা হয় না। তার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো! ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে হাঁটতে পারে। একটাই শুধু অসুবিধা–হাঁটার সময় তার মাথায় কবিতা আসে না। এই সময় পাকা রাস্তায় রিকশা করে যেতে পারলে অতি দ্রুত তার মাথায় কবিতা আসত। তার অধিকাংশ কবিতাই চলমান রিকশায় পাওয়া।
আজ একটা কবিতা মাথায় আসা প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন। আজ তার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ক্র্যাক ডাউনের পর বিয়ের সিজন চলছে। অবিবাহিত মেয়েদের বাবা-মা অতি দ্রুত বিয়ে দিয়ে ফেলছে। যেন বিয়েই সব সমস্যার সমাধান। বিপদ শুধু কুমারী মেয়েদের। বিবাহিতদের কোনো সমস্যা নাই। গাধারা বুঝে না মিলিটারিদের কাছে কুমারী, বিবাহিত বা বিধবা কোনো ব্যাপার না। সবই তাদের কাছে–আওরাত।
মাসুমার সঙ্গে যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে এটাকে আল্লাহর রহমত হিসেবে ভাবা যেতে পারে। অতি ভালো মেয়ে। বেশি চালাক–এটা একটা সমস্যা। স্ত্রী হলো সঙ্গিনী। সঙ্গিনী বেকুব হলেও সমস্যা। চালাক হলেও সমস্যা। শাখের করাত দুদিকে কাটে।
কলিমউল্লাহর মাথায় হাঁটতে হাঁটতেই একটা কবিতার লাইন চলে এলোসঙ্গী ছিল না কেউ পাশে। লাইনটা খারাপ না, দশ মাত্ৰা দিয়ে শুরু। ষোল মাত্রা করা দরকার। সঙ্গী ছিল না কেউ পাশে, আবেগে সন্তাপে। এটা কেমন হয়? ষোল মাত্রা। শেষ তিনটা শব্দে একারের মিল— পাশে, আবেগে সন্তাপে।
রিকশা-ভ্যানের ভাড়া নিয়ে দরদরি করার কারণেই হয়তো কবিতার লাইন মাথা থেকে পুরোপুরি মুছে গেল। ভ্যান চলছে। সে বেশ আরাম করেই ভ্যানে বসেছে। রাস্তা তেমন উঁচু-নিচু না। বাকুনি হচ্ছে না। পরিবেশ ভালো। সন্ধ্যা নামছে। আরামদায়ক বাতাস মাথায় নামছে। মনে মনে কবিতা তৈরির জন্যে অতি উত্তম ব্যবস্থা। অথচ মাথা পুরোপুরি ফাঁকা। কবিতাটা তৈরি হয়ে গেলে ভালো হতো। সে যদি কোনো দিন বড় কোনো কবি হয়ে যেত, তাহলে ইন্টারভিউতে বলতে পারত–এই কবিতাটার পেছনে একটা বিশেষ ঘটনা আছে। ঘটনা কী হয়েছে শোন–১৯৭১ সন। অতি দুঃসময়। কবি শামসুর রাহমান গ্রামে পালিয়ে আছেন। হঠাৎ তাকে দেখতে ইচ্ছা হলো। ঢাকা ছেড়ে প্রায় জীবন হাতে নিয়ে কবির গ্রামের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। কবির কাছে তো খালি হাতে যাওয়া যায় না। রিকশা-ভ্যানে বসে বসে একটা কবিতা লিখলাম। কবিতা পকেটে নিয়ে যাচ্ছি। তখন সন্ধ্যা। তোমাদের রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস।
রিকশা-ভ্যান প্রবল ঝাকুনি খেল। কলিমউদ্দিন ভ্যান থেকে উল্টে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাল। কবিতা নিয়ে চিন্তা করা আর ঠিক হবে না। চোখ-কান খোলা রেখে বসে থাকতে হবে। হাত-পা ভাঙা কবি কোনো মজার ব্যাপার না। তাছাড়া আজ রাতে তার বিয়ের সমূহ সম্ভাবনা। হাত-পা ভাঙা পাত্রের বিয়ে হবে কীভাবে?
ভ্যানওয়ালা আবার চালানো শুরু করেছে! কলিমউল্লাহর এখন সামান্য আফসোস হচ্ছে–কবি সাহেবের সঙ্গে এতক্ষণ ছিল, এক ফাঁকে সে বলতে পারত, কবি সাহেব আজ রাতে আমার বিয়ে। আপনার কাছে ছোট্ট একটা উপহার চাই। কবি বিস্মিত হয়ে বলতেন, কী উপহার? আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে আশীৰ্বাদ করে দুই-তিন লাইনে যদি কিছু লিখে দেন–আপনার জন্যে এটা কিছুই না; আমাদের জন্যে অনেক কিছু। কবি নিশ্চয়ই কিছু লিখতেন। বেচারা লাজুক মানুষ। লাজুক মানুষরা কখনো না বলতে পারে না।
কলিমউল্লাহ লাজুক মানুষ না। তবে সে লাজুক মানুষের অভিনয় ভালো করতে পারে। মাসুমার মা যখন বললেন, আপনাকে একটা কথা সরাসরি বলতে চাই। এখন সময় খারাপ। কুমারী মেয়ে ঘরে কেউ রাখছে না। আমি খোঁজ নিয়েছি মাসুমা আপনাকে পছন্দ করে। আপনার বিষয়ে আমরা তেমন কিছুই জানি না। তারপরেও আপনাকে ভালোমানুষ বলে মনে হয়। আপনি কি মাসুমাকে বিবাহ করবেন?
কলিমউল্লাহ অতি লাজুক ভঙ্গিতে বলল, আপনাকে দেখার পর থেকে আমি আপনাকে আমার মায়ের মতো জানি। কারণ আপনার চেহারা-কথাবার্তা সবই আমার মায়ের মতো। আজ যে এটা প্ৰথম বলছি তা-না, আগেও আপনাকে বলেছি। মা হিসেবে আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন, তাই আমি করব।
এখনকার বিয়ে তো বিয়ে না। মাওলানা ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া। যখন সময় ভালো হবে, তখন অনুষ্ঠান করব। আল্লাহ চাহে তো মেয়ের বাবাও তখন উপস্থিত থাকবেন।
মা, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
আমি চাচ্ছি ফরিদপুর রওনা হবার আগেই বিয়ে পড়িয়ে দিতে। আপনার কি আপত্তি আছে?
মা, আমাকে তুমি করে বলবেন। আর আমি তো আগেই বলেছি, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
কলিমউল্লাহর সেই রাতেই বিয়ে হলো। পরদিন তাদের ফরিদপুর যাবার কথা, তা না করে সে সবাইকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঢাকায় নিয়ে চলে এলো। এখন সে সঙ্গে থাকবে, কাজেই ঢাকায় থাকাই ভালো। ঢাকা নিরাপদ। তাছাড়া শ্বশুর আব্বার খোঁজ নিতে হবে। উনি যে-কোনোদিন বাসায় চলে আসতে পারেন। বড় আপার স্বামীও কোথায় আছেন কে জানে! তিনি যদি খোঁজ-খবর করেন ঢাকার ঠিকানাতেই করবেন।
সবার কাছে কলিমউল্লাহর যুক্তি অকাট্য মনে হলো। তারা ঢাকায় ফিরলো লঞ্চে করে। মাসুমা সারা পথই স্বামীর সঙ্গে লেপ্টে রইল। মহিলারা সবাই বোরকা পরে যাচ্ছে। শুধু মাসুমাই একটু পর পর নেকাব খুলে ফেলছে। সে এক ফাকে ফিসফিস করে বলছে–আমার সারাক্ষণ ইচ্ছা করে তোমাকে দেখি। বোরকার ভেতর থেকে ঠিকমতো দেখা যায় না। আমি কী করব, বলো?