৩৭
দেশে ও বিদেশে এত বেশি কনফারেন্স, সেমিনার এবং বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে হয় তাকে যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটা ঠিকমতো করে উঠতে পারে না। এ ব্যাপারে কৃষ্ণজীবনের অপরাধবোধ প্রবল। চাকরি ছেড়ে দিলেও এখন তার বিশেষ ক্ষতি নেই। বিদেশে ভাল চাকরির প্রস্তাব তো আছেই, তা ছাড়া এমনিতেই বিদেশ থেকে বক্তৃতা বাবদ সে বিদেশী মুদ্রা যা পায় তাতে স্বচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে দিতে পারে। স্ত্রীর রোজগারের টাকাটাও কম নয়। কিন্তু কলকাতার চাকরিটার ওপর তার একটা মায়াও আছে। বিজ্ঞানহীন, ঔৎসুক্যহীন, উৎসাহহীন এই দেশের নিরুদ্যম ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত করতে চায়। সংসারে বা সমাজে তাকে যতই বাস্তববোধহীন, অন্যমনস্ক এবং প্রায় বোকা বলে মনে হোক না কেন, সে যখন ক্লাস নেয় তখন সমস্ত ক্লাস থাকে চিত্রার্পিত, সম্মোহিত। তার চেহারা ভাল, গলার স্বর ভাল, চমৎকার ইংরিজিও বলতে পারে, কিন্তু সে সবচেয়ে ভাল পারে নিজেকে উজার করে দিতে। ক্লাসে কে শুনছে বা শুনছে না, কে নোট নিচ্ছে বা নিচ্ছে না সেটা বড় কথা নয়। সে মগ্ন হয়ে যায় তার বিষয়বস্তুতে। এত ডুবে যায় যে, ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা অবধি কানে যায় না।
এবার পুজোর আগে কয়েকটা দিন কৃষ্ণজীবন প্রাণ ঢেলে পড়াল। তার ছাত্রী ও ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই কৃতী হবে, যশস্বী হবে কৃষ্ণজীবন জানে। দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে এরা। কিন্তু শেষ অবধি এদের বেশির ভাগই মোটা বেতনের চাকরি করবে। চাকরিই করবে। প্রভূত ধনাগম হবে এদের। গাড়ি-বাড়ি হবে। নাম হবে। অহঙ্কার হবে। তাতে পৃথিবীর কিছু এসে যাবে না। কিছুই ইতরবিশেষ হবে না এই বিশাল গরিব ভারতবর্ষের। রুজি-রোজগারেই সীমাবদ্ধ থাকবে এদের জ্ঞান। গবেষণার ভিতর দিয়ে পৃথিবীর কিছু উপকারও করবে বটে এরা, তবু সীমাবদ্ধ থাকবে নিজেদের সীমাবদ্ধতায়। ওই খোলসটা ভাঙা দরকার। পৃথিবীতে জ্ঞানী ও কৃতীর কোনও অভাব নেই। অভাব নিজের সংসার, নিজের অভ্যাস ও চরিত্রের খোলে বন্দী নয় এমন মানুষের। কে কত বড় বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক হল, কে পেল কোন শিরোপা তা জেনে কোন লাভ হবে চব্বিশ পরগনার মূর্খ এক গরিব চাষীর?
নিজের সীমাবদ্ধতাকে বড় বেশি টের পায় বলেই কৃষ্ণজীবন আজকাল আরও একটু বেশি অস্থির। সে কিছুতেই অর্জিত জ্ঞান ও দার্শনিকতার সঙ্গে জনজীবনের যোগাযোগের রাস্তাটা খুঁজে পায় না।
তার এক প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে ওয়াশিংটনে দেখা হয়েছিল তার। ধীরেশ। একটা বেসরকারি সংস্থায় বিশাল চাকরি করে। তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল নিমন্ত্রণ করে। বেশ বড়সড় বাড়ি। ডলারের তেজে বাড়ি যেন ঝলমল করছে। ঝলমল করছে সুন্দরী বাঙালী স্ত্রী এবং মেয়ে। অনেকক্ষণ ধীরেশের সফলতার চিহ্নগুলো লক্ষ করে মিতবাক্ কৃষ্ণজীবন বলেছিল, তুমি অল্প বয়সেই খুব উন্নতি করেছে।
ধীরেশ লজ্জার সঙ্গে বলল, এ কোম্পানিতে আমিই একমাত্র বাঙালী স্যার।
কৃষ্ণজীবন ধীরেশের দিকে চেয়ে বলে, এতে তুমি খুশি তো!
ধীরেশ উজ্জ্বল হাসি হেসেছিল।
কৃষ্ণজীবন তার ধীর, অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলল, এর পর যদি কখনও আসি আমি জানতে চাইবো পৃথিবীর ঋণ তুমি কতটা শোধ করেছে।
তার মানে স্যার?
আমাকে অনেকেই পাগল বলে জানে, অ্যাবনরমাল মনে করে। কিন্তু আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষই এই পৃথিবীর কাছে নানাভাবে ঋণী। যে যেমনই হোক, যত বড় বা ছোট, তার উচিত সেই ঋণ একটু করে শোধ করা। রোজ শোধ করা। যে-মানুষ পৃথিবীর ঋণ শোধ করে না, কিন্তু সুখভোগ করে, ঐশ্বর্য সঞ্চয় করে, সে লুটেরা, তস্কর। আর যাই করো, শুধু নিজেকে নিয়ে থেকো না।
ধীরেশ অপ্রস্তুত। তার সুন্দরী বউয়ের মুখভার। কৃষ্ণজীবন তাদের ডিনারের আসরটি প্রায় মাটি করে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে আরও সব অতিথিরা এসে যাওয়ায় আবহাওয়া পাল্টে গেল। রবীন্দ্রসঙ্গীত, সুরা, সুস্বাদু খাবার ও নানা প্রসঙ্গের আড্ডায় মাটি হতে হতেও ডিনারটা বেঁচে গিয়েছিল।
সেই থেকে কৃষ্ণজীবন কিছু সাবধান হয়েছে।
ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় সেই ধীরেশের একটা চিঠি পেল কৃষ্ণজীবন। ধীরেশ চিঠির সঙ্গে পাঁচ হাজার ডলারের একটা চেক পাঠিয়েছে। লিখেছে, স্যার, অনেকদিন ধরে আপনার কথা ভাবছি। মনে হচ্ছে, আমি সত্যিই পৃথিবীর জন্য কিছু করছি না। হয়তো সেরকম কিছু করার কথা ভাবলেও কী করব তা স্থির করতে পারব না। কিন্তু আপনি কিছু করার চেষ্টা করছেন। আপনি যা করছেন তাতে আমার সমর্থন ও সহযোগিতা জানাতেই চেকটা পাঠাচ্ছি। আপনি টাকাটা কাজে লাগালে মনে করব আমিও পৃথিবীর খানিকটা কাজে লাগলাম। শুনলাম আপনি অক্টোবরে লস এঞ্জেলেসে আসছেন। আমার বাড়িতে যদি পায়ের ধুলো দেন তবে ধন্য হবো।
কৃষ্ণজীবন চেকটার দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ ভাবল। তাই তো! বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানো এবং ভাবনা-চিন্তা করা ছাড়া সে তো এমন কিছু করে না যাতে টাকাটা কাজে লাগানো যাবে! সে কি ধীরেশের চেয়ে কম স্বার্থপর?
চেকটা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরল কৃষ্ণজীবন। তারপর ভাবতে বসল, কী করা যায়! কীভাবে কাজে লাগানো যায় টাকাটা? ধীরেশ তো তার পৃথিবীর ঋণ শোধ করতে লেগেছে। কিন্তু সে এখন কী করে?
বাড়িতে কেউ ছিল না। বিকেল পার হয়ে সন্ধে ঘনঘোর হল সাততলার ঘরে। একা ভূতগ্রস্ত কৃষ্ণজীবন বসে রইল তার চেয়ারে। কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারল না।
সন্ধের পর রিয়া ফিরল তার ছেলেমেয়ে নিয়ে।
কি গো, বসে বসে কী করছে অন্ধকারে?
একটা কথা ভাবছি।
কী কথা?
আমার একটি ছাত্র কিছু টাকা পাঠিয়েছে। তার ইচ্ছে, কোনও সৎ কাজে টাকাটা খরচ করা হোক।
ওমা, এ তো ভাল কথা! দুশ্চিন্তার কী আছে?
আমি ভেবে পাচ্ছি না। তুমি বলতে পারো টাকাটা কিভাবে খরচ করা যায়?
কত আশ্রম, মিশন আছে। দিয়ে দাও। দুর্গতের সেবা হবে।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সেটাও ভেবেছি। কিন্তু সেটা তো ধীরেশ নিজেই করতে পারত। আমাকে টাকাটা পাঠাল কেন?
তুমি সব ব্যাপারই কেন জটিল করে নাও বলো তো!
কৃষ্ণজীবন ম্লান হেসে বলে, খুব বেশি সহজ আর শর্টকাট করাই কি ভাল? ধীরেশ তো আমেরিকাতেই টাকাটা কোনও সমাজসেবায় দিতে পারত। দেয়নি।
তা হলে যা ভাল বোঝো করো।
কৃষ্ণজীবন চুপ করে গেল। ধীরেশ তাকে একটু বিপাকে ফেলেছে।
দোলন কৃষ্ণজীবনের অন্ধ অনুকারী। বাবা যা বলে তাই তার কাছে বেদবাক্য। কৃষ্ণজীবন কবে তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, বাইরে থেকে ফিরে হাত পা মুখ ধুতে হবে, সে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে। আজও হাত মুখ ধুয়ে পোশাক পাল্টে তবে বাবার কাছে এল দোলন।
বাবা, আজ আকাশে মেঘ নেই, তারা দেখবে না?
চলো যাই।
টেলিস্কোপ আর দোলনকে নিয়ে ছাদে উঠে এল কৃষ্ণজীবন। দোলন তারা দেখতে লাগল, কৃষ্ণজীবন বসে রইল তার পাশে।
আচ্ছা বাবা, আকাশে কটা যেন নীহারিকা আছে!
আমাদের জানার মধ্যে কয়েক শো কোটি। জানার বাইরে কত আছে তার তো হিসেব নেই। গুনে শেষ করা যাবে না?
না। সংখ্যাকে হার মানতেই হয় এক সময়ে। সংখ্যা দিয়ে আকাশের তারার হিসেব অসম্ভব।
দোলন অসহায়ভাবে বাবার দিকে চেয়ে বলে, তা হলে?
কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, আকাশের দিকে চাইলে তুমিও যা আমিও তা। শিশুমাত্র।
তুমি তো কত জানো বাবা!
হ্যাঁ বাবা, যত জানছি, ততই বোকা হয়ে যাচ্ছি। থই পাই না।
আলোর গতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল তো, বাবা!
হ্যাঁ।
ওই স্পীডে যদি যাওয়া যায় তা হলেও কি আমরা কখনও আমাদের ছায়াপথের শেষে পৌঁছতে পারব না?
না। আলোর গতিতে কোনও বস্তু কখনও ছুটতে পারে না। যদি পারে তবে সে আর বস্তু থাকে না।
তা হলে?
আকাশের কথা আকাশের কাছেই থেকে যাবে। কিছু জানা যাবে, অজানা থেকে যাবে আরও অনেকটাই।
আমি তো গল্পের বইতে পড়ি, অনেক দূরের গ্রহ থেকে নানারকম মানুষ আসে। সত্যি বাবা?
না দোলন। আজ অবধি আকাশের কোথাও কেউ আছে বলে জানা যায়নি।
একদম না?
তা বলা যায় না। কিন্তু নক্ষত্রগুলো এত দূরে যে, তাদের গ্রহমণ্ডল আছে কি না তা ধরা যাচ্ছে না। আমরা যে সব নক্ষত্রের আলো দেখতে পাই সেগুলো হাজার, লক্ষ, কোটি বছর আগেকার পুরনো আলো, পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে অতটা সময় লেগেছে তাদের। এখন সেখানে কী হচ্ছে তা জানা যাবে ফের হাজার, লক্ষ, কোটি বছর পর।
উরেব্বাস!
সত্যিই উরেব্বাস। ওসব নিয়ে ভেব না, মন খারাপ হবে।
আমি যখন ইস্কুলে বন্ধুদের কাছে তোমার কথাগুলো বলি তখন সবাই খুব অবাক হয়। বিশ্বাস করতে চায় না।
কী বলে?
আমি আকাশ আর গ্রহ নক্ষত্রের কথা বলি। ওরা কেউ আমার মতো এত জানে না। বলে, ভ্যাট, গুল মারছিস।
জানে না বলেই বলে।
সুকান্ত নামে একটা ছেলে আছে, তার বাবা নাকি বলেছে মানুষ একদিন আকাশটা জয় করে নেবে। তাই বাবা? আমি কিন্তু বলেছি, পারবে না।
নেগেটিভ কথা না বলাই ভাল। তবে তুমি বোধ হয় ঠিকই বলেছে। মানুষের ক্ষমতা খুব সামান্যই।
কোনওদিন পারবে না বাবা?
না পারাটাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞান নাকি সব পারে বাবা?
কৃষ্ণজীবন স্তিমিত গলায় বলে, বিজ্ঞান আমি কতটুকু জানি দোলন? যতটুকু জানি তা দিয়ে কিছু অনুমানও করা যায় না। তোমরা বড় হয়ে তেমন বিজ্ঞানের সন্ধান কোরো। এখন অবধি মানুষের বিজ্ঞান বড় দুর্বল। বড় সামান্য।
বিভু বলে একটা ছেলে আছে, সে বলে, ভগবান-টগবান নেই। সব বাজে কথা। বিজ্ঞানের যুগে কি কেউ ভগবান মানে? সত্যি বাবা?
আমি জানি না দোলন। মানুষের অজানা কত কি আছে এখনও।
ভগবান নেই বাবা?
কৃষ্ণজীবন একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, হয়তো আছেন। বিজ্ঞান কিন্তু বলেনি যে ভগবান নেই।
বিজ্ঞান তা হলে কী বলেছে, বাবা?
বিজ্ঞান বলে, যতদূর জানা যায় ততদূর পর্যন্ত ভগবান বলে কাউকে পাওয়া যায়নি।
ভগবান কি অনেক দূরে?
হয়ত খুব কাছেই। আমরা ভুল করে দূরে তাঁকে খুঁজি।
আচ্ছা, ভগবান তো দূরের তারাগুলোকে চেনে, না বাবা? ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারে?
যারা ভগবানকে মানে তারা ওরকমভাবে বলে না। তারা বলে ভগবানই এই সব গ্রহ-নক্ষত্র হয়ে আছেন, গাছপালা হয়ে আছেন, জীবজন্তু হয়ে আছেন, তুমি-আমি হয়ে আছেন।
সত্যি বাবা?
তাই তো শুনি।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তো!
তুমি তো খুব ছোট। এসব বুঝতে সময় লাগে।
আকাশের কথা ভাবতে ভাবতে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়।
কেন যায় দোলন?
ওই যে তুমি বলো, মানুষ কখনও আকাশের অন্য সব নক্ষত্রে যেতে পারবে না।
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কিছু জিনিস আমাদের জানার বাইরেও থাক না দোলন।
কেন বাবা?
মানুষ চোখ দিয়ে দেখে, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে। কিন্তু চোখ আর বুদ্ধিই তো সব নয়। অনুভব করতে হয়। ভাবতে হয়। বিশ্বজগতের সঙ্গে নিজেকে একাকার করে দিতে হয়।
সেটা কেমন বাবা?
আমি কি সব কথার জবাব দিতে পারি? ওই যে বললাম, আমার আজকাল কেবলই মনে হয়, আমি কিছুই জানি না।
দোলন বাবার কাছ ঘেঁষে বসে মুখের দিকে চেয়ে বলে, তুমি যখন ফরেনে যাও তখন আমার খুব কান্না পায়। কেন যাও বাবা? এবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে?
তোমার যে ইস্কুল থাকে!
পুজোর ছুটিতে আর সামারে নিয়ে যাবে?
আর একটু বড় হও, তখন নিয়ে যাবো। এখন মাকে ছেড়ে বাইরে গেলে তোমার কষ্ট হবে।
মাকেও নিয়ে যাবো। দিদিকেও। দাদাকেও।
ও বাবা, অত পয়সা কোথায় পাবো দোলন? প্লেনের টিকিটের যে অনেক দাম!
তবে তুমি যে যাও!
আমার টিকিটের টাকা অন্যেরা দেয়। নইলে কি যেতে পারতাম?
কেন দেয় বাবা? তারা আমাদেরটা দেবে না?
আমি তাদের কাজ করে দিই বলে তারা আমার ভাড়া দেয়। তুমি বড় হয়ে যখন কাজ করবে তখন তোমারটাও দেবে।
ব্যাপারটা গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ ভাবল দোলন। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, চলো বাবা, রিমোট কন্ট্রোলের গাড়িটা চালাই দুজনে মিলে।
প্রস্তাবটা কৃষ্ণজীবনের খুবই পছন্দসই। বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে খেলতে তার এখনও ভাল লাগে। ব্যাটারিচালিত ছোট ভিডিও গেম, রিমোট গাড়ি বা রুবিক কিউব নিয়ে মাঝে মাঝে সে দোলনের সঙ্গে মেতে যায়। তাতে তার মাথার ভার কমে যায়, মন হালকা হয়।
আজও দোলনের রিমোট গাড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে মনটা ভালই লাগছিল তার। কিন্তু একটা পিন ফোটার মত ছোট্ট খোঁচা বিধেই রইল ভিতরে। ধীরেশ টাকাটা তাকেই কেন পাঠাল?
সামান্য সব চিন্তা ও উদ্বেগ কৃষ্ণজীবনকে বড্ড অন্যমনস্ক করে দেয়। গুরুতর চিন্তা-ভাবনায় ছেদ পড়ে। চেকটা সে কি ভাঙাবে, না কি ফেরত পাঠাবে? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
রাত গভীর হল। রাতের খাওয়া শেষ করে সবাই শুতে চলে গেলে রোজই অধিক রাত অবধি কিছু পড়াশুনো করে কৃষ্ণজীবন। এটা তার প্রিয় অভ্যাস।
ফোনটা এল অনেক রাতে। বারোটা বাজবার দশ মিনিট পর।
কী করছেন?
কে বলছেন?
হিঃ হিঃ! আমি অনু।
অনু! ওঃ, এত রাতে জেগে আছো কেন?
আজ আমার ঘুম আসছে না। আমি তো জানি আপনি রাত জেগে পড়েন, তাই ফোন করছি। কেমন আছেন আপনি?
তুমি কেমন আছো?
ভাল নেই। মন খারাপ।
কেন মন খারাপ?
আমার মাঝে মাঝে ভীষণ মুড অফ্ হয়ে যায়।
তুমি খুব মুডি, তাই না?
খুব। আচ্ছা, আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না তো!
না। আমি ছেলেমানুষদের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসি।
আমি মোটেই ছেলেমানুষ নই। আপনি আমার ফ্রেন্ড না? ফ্রেন্ডকে বিলিটল্ করতে নেই, জানেন না?
ওঃ, তাই তো। কিন্তু দোলনও তো আমার খুব বন্ধু।
দোলন আর আমি তো এক নই। আপনি বড্ড সেকেলে। এত ওল্ডি সেজে থাকেন কেন বলুন তো!
আমি একটু ওল্ডিই বটে।
মোটেই না। ইউ আর এ নাইস পারসোনেল ম্যান। আই লাইক ইউ ভেরি মাচ।
কৃষ্ণজীবন শঙ্কাজড়িত এক রকমের হাসি হাসল। তারপর বলল, তুমি একটি পাকা আর বিচ্ছু মেয়ে।
পাকা আর বিচ্ছু? তা হলে ছেলেমানুষ নই তো!
এত অ্যাডাল্ট হওয়ার ইচ্ছে কেন? যতদিন পারো শৈশবকেই ধরে রাখো। শৈশবের মতো সুন্দর সময় আর নেই। বড় হলে দেখবে পৃথিবীটা একদম বিচ্ছিরি।
কিন্তু আপনি তো পৃথিবীটাকে খুব ভালবাসেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৃষ্ণজীবন বলে, তা বাসি। সেই ভালবাসার জ্বালায় জ্বলেপুড়ে মরছি।
কবে দেখা হবে বলুন তো! আপনাকে আমার ভীষণ দরকার।
তাই বুঝি? তবে আসো না কেন?
যদি হ্যাংলা ভাবেন সেই ভয়ে ঘন ঘন যাই না। যদিও খুব যেতে ইচ্ছে করে। আপনার কথা শুনতে শুনতে আমার কেমন একটা হিপনোটিক কন্ডিশন হয়।
এটা কি কমপ্লিমেন্ট?
না। স্টেটমেন্ট অফ এ ফ্যাক্ট।
শোনো অনু, তুমি রোজ এলেও তোমাকে হ্যাংলা ভাববো না। এতে হ্যাংলামির কি আছে?
আপনি বিরক্ত হবেন না?
একদম না।
আসলে আমার স্কুলেও পড়ার ভীষণ প্রেশার ছিল। সময় পাচ্ছিলাম না। বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় আমার অনেক ব্যাক লগ জমে গেছে।
তোমার বাবা এখন কেমন আছেন?
অফিসে যাচ্ছে। নাউ হি ইজ ও-কে। কিন্তু হার্ট একটা ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল থিং। তাই না?
ঠিকই বলেছো।
অনু হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল।
হাসলে কেন?
হার্টের কথায়। আপনার হার্ট, আমার হার্ট, সব হার্ট-ই কিন্তু আনপ্রেডিক্টেবল।
কথাটার মানে কি অনু?
আমাদেরও তো হার্ট অ্যাটাক হতে পারে? পারে না?
তুমি খুব দুষ্টু মেয়ে।
আপনি মিনিংটা ধরতে পারলেন কি?
পারলাম।
আপনি কি জানেন যে, ইউ আর কোয়াইট অ্যাট্রাকটিভ?
জানি না। কেউ এরকমভাবে আমাকে বলেনি কখনও।
আমি বলছি বলে রাগ করবেন না তো!
এটা তো খুশি হওয়ার মতোই কথা অনু। এই বয়সে টিনএজারদের কাছ থেকে এরকম কমপ্লিমেন্ট তো রেয়ার জিনিস।
শুনুন, আমার কিন্তু খুব বকবক করতে ইচ্ছে করছে।
করো না!
আপনি যে হাই তুললেন এইমাত্র!
যাঃ, কোথায় হাই তুলেছি?
তোলেননি তো!
না। আমার হচ্ছে ইচ্ছে-ঘুম।
আমার আজ কেন ইনসোমনিয়া হচ্ছে, জানেন?
কি করে জানবো? শুনলাম তো মুড অফ্।
হ্যাঁ, তাই। আজ আমি সকাল থেকে অনেকের সঙ্গে ঝগড়া করেছি।
ও বাবা, ঝগড়াও করো নাকি?
আসলে ঝগড়া করে আমি সকলের কাছে হেরে যাই।
সেটা কিন্তু খুব ভাল। কি নিয়ে ঝগড়া হল?
তার কোনও মাথামুণ্ডু ছিল না। এটা সেটা নিয়ে। মুড অফ্ থাকলে যা হয়। আজ যেমন আমার একজন বন্ধুকে বলেছিলাম, তোর নাকটা কিন্তু বিচ্ছিরি। ব্যস লেগে গেল। তারপর মায়ের সঙ্গে লাগল, দিদির সঙ্গে লাগল। রাতে ঘুম আসছে না, শুয়ে শুয়ে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ আপনার কথা মনে হল। মনে হল, আপনার মতো ভাল বন্ধু আমার আর কেউ নেই।
সত্যি?
সত্যি। ভীষণ সত্যি।