৩৬-৪০. মোনা ফুঁসছিল

৩৬.

কিছু বুঝতে না পেরে মোনার মুখের দিকে চেয়ে থেকে অমল বলল, বিছানায় কন্ডোম কী করে এল তা আমি কী করে জানব?

 মোনা ফুঁসছিল, চাপা হিংস্র গলায় বলল, তুমি ছাড়া কে জানবে? হোয়েন উই ওয়্যার অ্যাওয়ে, তখন তুমি এই ফ্ল্যাটে একা ছিলে। জবাব তো তোমারই দেওয়ার কথা।

অমল অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।

এত নীচে তুমি নামতে পারলে? তোমার যদি মেয়েমানুষের দরকার ছিল তাহলে তুমি তো তাদের কাছেই যেতে পারতে! আমার বেডরুমে, আমাদের বিছানায় বাইরের মেয়ে নিয়ে আসতে তোমার ঘেন্না হল না?

অমলের ঘোলা মাথায় যেন জল ঢুকে আছে। বোধবুদ্ধি কাজ করছে না। সে শুধু অবাক হয়ে বলতে পারল, আমি! আমি! তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ মোনা?

সেটা কি অন্যায়? সবাই জানে তুমি লম্পট, কিন্তু তা বলে বেডরুমের স্যাংটিটিটাও বজায় রাখবে না এটা কীরকম?

লম্পট কথাটা তার মাথার মধ্যে দুম দুম করে দেয়ালে দেয়ালে হাতুড়ি মারছে। চরিত্র নিয়ে তার তো বড়াই করার কিছুই নেই। এই আক্রমণের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবেই বা কী করে সে? অমল তাই গুটিয়ে যেতে লাগল নিজের মধ্যে। মানুষ পুরোপুরি গুটিপোকা হতে পারে না কখনও। দুর্গ নেই, প্রাকার নেই, পরিখা নেই তার। অনায়াসে আক্রান্ত আর পর্যুদস্ত হওয়া ছাড়া তার কীই বা করার আছে। অমল তবু মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বলে, আমি কিছু করিনি মোনা। আমি কিছুই করিনি…

তা হলে কে ঢুকেছিল বেডরুমে? আর কারও তো অ্যাকসেস নেই। বেডরুমে চাবি দেওয়া থাকত। চাবি ছিল শুধু তোমার কাছে। এই জিনিসটা কি তাহলে উড়ে এল বিছানায়?

বেডরুমের খবর আমার জানা নেই। আমি ও-ঘরে একদিনও ঢুকিনি। চাবিটা খুঁজে পেতাম না। বাইরের ঘরে ডিভানটায় পড়ে থাকতাম।

অ্যান্ড দ্যাটস এ লাই। তোমার চোখ বলছে তুমি মিথ্যে কথা বলছ।

তার জীবনের স্থির ও নির্দিষ্ট মহিলাটির চোখে চোখ রাখতে পারছিল না অমল। আজকাল তার এই একটা রোগ হয়েছে, কারও চোখের দিকেই স্পষ্ট তাকাতে পারে না। অস্বস্তি হয়, ভয়-ভয় করে। চোখ নামিয়ে নিয়ে সে মৃদুস্বরে বলল, তোমার সন্দেহ হলে তুমি বাসুদেবকে জিজ্ঞেস করতে পার।

বাসুদেব বাড়ির চাকর। টাকা দিলেই তাকে ম্যানেজ করা যায় বা একবেলা ছুটি দেওয়া যায়। বুঝেছ? তা ছাড়া ওকে জিজ্ঞেস করাটা বিলো মাই ডিগনিটি।

যুক্তিটা অকাট্য। বাড়ির চাকরকে বাবুর চরিত্র নিয়ে জেরা করা যায় না।

অমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চরিত্র জিনিসটার কোনও মূল্য আছে বলে তার কখনও মনে হয়নি। আজকাল কেউ বড় একটা মূল্য দেয় না। তবে লুকোছাপা যখন আছে তখন ধরে নিতে হবে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন এখনও লোপাট হয়ে যায়নি।

ও-ঘরে সোহাগ কম্পিউটার নিয়ে বসে তার ই-মেল চেক করছে। কম্পিউটারে বসলে তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না। দরজাটাও ভেজানো। তবু হয়তো একটা দুটো কথা কানে চলে গেছে। তার চেয়েও ভয়াবহ হল, ঘটনাটা মোন হয়তো ছেলেমেয়ের কাছে বলেই দেবে। আজকাল তার প্রতিশোধস্পৃহা বেড়েছে।

একটু বাথরুমে যাওয়া দরকার। এক কাপ চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। দু-একটা টেলিফোন করলে ভাল হয়। অমল এসব মৃদু প্রয়োজনগুলিকে আমল না দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে অনির্দিষ্টভাবে যেন পঞ্চভূতকে বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি।

চাপা গলায় মোনা বলল, হ্যাঁ যাও। আর ওসব ব্যাপার বাইরেই মিটিয়ে এসো।

একটু দাঁড়িয়ে অমল ফের এগোতে যাচ্ছিল।

 মোনা মৃদু স্বরে বলল, মিথ্যেবাদী কোথাকার! বেডরুমে ঢোকোনি। তাহলে জামাপ্যান্ট কোথায় পেলে? ওয়ার্ডরোব তো আমাদের বেডরুমে।

অমল দরজার কাছ থেকে ফিরে বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ, বুডঢার ওয়ার্ডরোবেও আমার কয়েকটা জামাপ্যান্ট রাখা আছে।

তুমি বেডরুমে ঢুকতে না কেন?

 চাবিটা কোথায় রাখতাম মনে পড়ত না। মাঝেমধ্যে এমনিতেই তো আমি ডিভানে শুই। আফটার এ ফিউ ড্রিংকস।

তুমি মিথ্যেবাদী। ইউ আর লায়িং।

শোওয়ার ঘরে কন্ডোম, এ রহস্যকাহিনীর ভিলেন বানিয়ে এখন তাকে আরও কয়েকদিন ছিবড়ে করে ছাড়বে মোনা। তার কিছুই করার নেই। নানা প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত সময়ে শব্দভেদী বাণে বিদ্ধ হতে হবে তাকে। আজকাল তার অনুভূতি ভোতা হয়ে যাচ্ছে, মান অপমানের বোধও কমে গেছে অনেক। তবু মোনা যখন তাকে আক্রমণ করে তখন তার বুকের মধ্যে দমাস দমাস শব্দ হয়। মনে হয়, দুম করে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।

কান মাথা দুটোই এখন ঝাঁ ঝাঁ করছে। গরম আর অস্থির লাগছে ভীষণ। বুকের মধ্যে সেই অদ্ভুত শব্দ। মাথা নিচু করে সে হলঘরে বেরিয়ে এল।

বাইরের হলঘরটা খুব বড়। ইংরেজি এল অক্ষরের মত। খাঁজের অংশটায় কম্পিউটারের সামনে ঝুঁকে বসে আছে সোহাগ। মগ্ন। এ সময়ে ওর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। ইন্টারনেট এক সাংঘাতিক নেশা। হেরোইনের চেয়ে কম মারাত্মক নয়। ওরা ভাইবোন রাতের পর রাত জেগে সার্ফিং আর চ্যাট করে। টেলিফোনের বিল বেড়ে যায়।

অমল নিঃশব্দে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সোহাগ মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমরা কি এতক্ষণ ঝগড়া করছিলে?

থতমত খেয়ে অমল বলে, না তো।

বিরক্তির গলায় সোহাগ বলল, ওখান থেকে ফিরে আমার মনটা এখনও ভাল আছে। দয়া করে আমার মনটা আবার চটকে দিয়ো না। তোমরা যত ঝগড়া পাকাবে তত আমার মনটা বিগড়ে যাবে। আজকাল তোমাদের ঝগড়া আমি সহ্য করতে পারি না।

অমল আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো কোনও কথাই খুঁজে পাচ্ছিল না। একবার গলাখাঁকারি দিল। মুখ একবার খুলে ফের বন্ধ করে ফেলল। না, কথা দিয়ে শুধু কথা দিয়ে আজকাল সে কাউকেই কিছু বোঝাতে পারে না। বোঝানোর কিছু নেই তার।

তোমাদের মধ্যে কেন যে এত আকচাআকচি হয় বুঝি না বাবা। বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করো কেন? কী হয় তোমাদের? ইগো প্রবলেম?

সোহাগ যদি মোনার কথাগুলো শুনে থাকে তবে ভারী লজ্জার কথা। অমলের ভিতরে একটা হিজিবিজি অনুভূতি পাকিয়ে উঠছে। মাথার ভিতরে অদ্ভুত সব পাগলাটে ভাব আসছে। আজকাল তার সন্দেহ হয়, পাগল হয়ে যাচ্ছে কিনা।

সে আর দাঁড়াল না। বেরিয়ে লিফট ধরে নেমে এল নীচে।

চমৎকার সিলভার গ্রে রঙের দামি গাড়ি তার। গায়ে ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে।

গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে ঝুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথাটা স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করল সে। মাথার ভিতরে ঘূর্ণিঝড়ে যেন নানা কুটোকাটা, ধুলোবালি, আবর্জনা পাক খাচ্ছে। পূর্বাপর কিছু মনে পড়ছে না তার। কান গরম, মাথা গরম, ঘাড়ে তীব্র ব্যথা। সে কি অজ্ঞান হয়ে যাবে! ভীষণ ঘাম হচ্ছে যে তার!

কোনওরকমে কাঁপা হাতে চাবি ঢুকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে এ-সি মেশিনটা চালু করে দিল। কিন্তু তেলের কাটা নেমে এসেছে প্রায় ই-এর ঘরে। তার মানে তেল ফুরিয়ে এসেছে। অথচ যাওয়ার আগের দিন সন্ধেবেলা সে দশ লিটার তেল নিয়েছিল গাড়িতে। জ কুঁচকে সে চেয়ে রইল ড্যাশবোর্ডের দিকে। এ-সি বন্ধ হয়ে যাবে। তেলের কাঁটা নেমে যাচ্ছে।

স্টার্ট বন্ধ করে জানালার কাঁচটা নামানোর জন্য হাত বাড়িয়েছিল সে। না, থাক। বাইরের শব্দ আসবে। গায়ের সোয়েটারটা ছেড়ে জামার কয়েকটা বোতাম খুলে দিল এবং এটুকু করতেই যেন ভীষণ পরিশ্রম হল তার। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে চোখ বুজে বসে রইল অমল। ঘাম হচ্ছে, বড্ড ঘাম হচ্ছে তার। অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ঘাড়ে পিন ফোঁটার মতো যন্ত্রণা। মাথায় ঘূর্ণিঝড়। বুকে হাতুড়ির ঘা।

মরে যাচ্ছে নাকি? মরে যাওয়ার কথা মনে হতেই সে হাত বাড়িয়ে দরজায় হাতলটা ঘোরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু দরজার হাতলটা অবশ হাতে খুঁজেই পেল না। কাঁচ নামানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে তার অসহায় ভারী হাতটা ঝুলে পড়ে গেল। এভাবেই মরে যায় মানুষ? এত আচমকা! এত তুচ্ছভাবে? একটা অন্ধকার নেমে এল চোখে, চেতনায়। সব মুছে গেল।

ঘরদোর সারতে সারতে অনেক রাত হয়ে গেল মোনর। বাড়িতে না থাকলে যে কত অগোছালো হয়ে যায় সব কিছু! বিছানার চাদর, বেডকভার, বালিশের ওয়াড় সব বদলাতে হল। কী ঘেন্না! কী ঘেন্না! এই বিছানায় রাতে শুতে হবে ভাবতেও তার বমি আসছিল। বাড়িতে গঙ্গাজল নেই। থাকলে তাও একটু ছিটিয়ে দিত মোনা।

কাজকর্ম শেষ করে যখন ঘড়ি দেখল মোনা তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে। কম্পিউটারের সামনে এখনও ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে সোহাগ। বুডঢা বেরিয়েছিল, ফিরে এসে তার ঘরে বসে কার সঙ্গে যেন আধঘণ্টা ধরে টেলিফোনে কথা বলে যাচ্ছে। বাসুদেব রান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে সব সাজিয়ে রাখছে। অমল এখনও ফেরেনি।

ঘড়ির দিকে চেয়ে একটু ভ্রূ কোঁচকাল মোনা। অমল এত রাত অবধি বাইরে থাকে না। পার্টি বা কাজ থাকলে অন্য কথা। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে নয়। আজ অবশ্য রাগ করে গেছে। রাগ! না, ভুল হল। আজকাল অমল বিশেষ রাগ-টাগ করে না। কেমন নেতিয়ে যায়।

এবার যন্ত্রটা বন্ধ করো সোহাগ। খিদেতেষ্টাও নেই নাকি? বিকেলে তো কিছুই খেলে না।

সোহাগ তার গভীর অন্যমনস্ক মুখটা একবার তার মায়ের দিকে ফিরিয়ে বলল, খাব।

ব্যস! খাব বললেই হবে? হাত মুখ ধোও। আজ আমার একটু বিশ্রাম দরকার। ওঠো।

উঠছি মা। পাঁচ মিনিট।

 বুডঢার ঘরে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল মোনা।

 আর কতক্ষণ কথা বলবে? খেতে দিয়েছে। এসো।

হাত তুলে মাকে চুপ করতে বলে টেলিফোনে কথা কইতেই থাকে বুডঢা।

বাথরুমে ঢোকার আগে ফের ঘড়িটার দিকে তাকাল মোনা। পৌনে এগারোটা। সামান্য জ্ব কোঁচকাল সে। পৌনে এগারোটা! অমল ফেরেনি এখনও!

বাথরুমে মোনার একটু সময় লাগে। গিজারের গরম জলে ভাল করে স্নান করল আজ। যখন বেরোল তখন ফের ঘড়ির দিকে চোখ গেল তার। সোয়া এগারোটা।

ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে বুডঢা আর সোহাগ।

বুডঢা বলল, বাবা কোথায় মা?

কী জানি। সন্ধেবেলা তত বেরোল। বুঝতে পারছি না।

 এগারোটা তো বেজে গেছে মা।

মোনা একথাটার কোনও জবাব দিল না। সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। এত রাত করার কথা তো নয়!

সোহাগ হঠাৎ বলল, এখনই টেনশন করার দরকার নেই। আরও দশ পনেরো মিনিট দেখা যাক।

বুডঢা বলল, তারপরও যদি না ফেরে?

ফিরবে না কেন? নিশ্চয়ই ফিরবে। তোমরা খাও। কথাটা বলল বটে মোনা, কিন্তু গলায় কোনও জোর পেল না।

সোহাগ সামান্য বিরক্ত গলায় বলল, তোমরা কী নিয়ে আজ ঝগড়া করছিলে বলো তো!

 মোনা ফুঁসে উঠে বলে, তা দিয়ে তোর কী দরকার?

 তোমাদের মধ্যে যে কেন এত ঝগড়া হয় তা বুঝতে পারি না।

তোর বুঝে দরকার নেই। যখন আমার মতো অবস্থায় পড়বি তখন বুঝবি।

 শোওয়ার ঘরে এসে মোনা বিছানায় বসে একটু হাঁফ ছাড়ল। উদ্বেগ বাড়ছে। ঘড়ির কাটা সাড়ে এগারোটা পেরিয়ে যাচ্ছে। অমল ফিরছে না।

বাসুদেব এসে দরজায় দাঁড়াল, খাবেন না বউদি?

খাব। তোমার বাবু কোথায় গেলেন বলো তো!

 আমি তো সাতটায় ফিরেছি। বাবু তো তার আগেই বেরিয়ে গেছেন।

নীচে গাড়ি আছে?

হ্যাঁ। গাড়ি নেননি তো।

আচ্ছা, ঠিক আছে, একবার দরোয়ানদের জিজ্ঞেস করে এসো তো বাবুকে তারা কোন দিকে যেতে দেখেছে।

ঠিক আছে। বলে চলে যাচ্ছিল বাসুদেব।

মোনা তাকে ডেকে বলল, থাক, ওদের জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমার খাবারটা একটু পরে দিও।

 আচ্ছা।

রাত বারোটায় বুডঢা এসে দরজায় দাঁড়াল।

মা।

ডিমলাইটটা জ্বেলে চোখে হাতচাপা দিয়ে একটু শুয়েছিল মোনা। শরীর পরিশ্রান্ত বলে একটু তন্দ্রার মতোও এসে গিয়েছিল।

চমকে উঠে বলল, এসেছে?

না মা, বাবা এখনও আসেনি। উই মাস্ট ডু সামথিং।

কী করা যায়?

কোথায় যেতে পারে বলে মনে হয় বলো তো! টেলিফোন করে দেখতে পারি।

মোনা একটু চিন্তা করে বলল, সেটা একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে না? লোকে কী ভাববে? তোর বাবার তো কলকাতায় তেমন বন্ধু বা আত্মীয়ও কেউ নেই।

চুপ করে তো বসে থাকা যায় না। হাসপাতাল বা লালবাজারে খোঁজ নেব?

রাত বারোটা বাজে, না?

হ্যাঁ মা।

মোনা উঠে ড্রয়িংরুমে এসে এ-ঘরের ঘড়িটাও দেখল।

সোহাগ এখনও কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। তবে কম্পিউটার অন্ধকার।

লেক-এর ধারটা দেখে আসব মা?

মোনা অন্যমনস্ক চোখে ছেলের দিকে চেয়ে বলে, লেক! এত রাতে কি আর সে লেক-এর ধারে বসে থাকবে? এই ঠান্ডায়!!

কিছু তো করা উচিত। বারোটা বেজে দশ মিনিট।

ভাবছি কোথাও গিয়ে ড্রিংক করে পড়ে আছে কি না।

বুডঢা মাথা নেড়ে বলে, বাবা তো বাইরে ড্রিংক করে না কখনও!

আজ রাগ করে গেছে।

রাগ করে কেন?

সামান্য একটু রাগারাগি করেছিলাম।

সোহাগ চুপ করে বসেছিল এতক্ষণ। এবার মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমার গলা আমি এখান থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। ও-ঘরের দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও।

মোনা গম্ভীর হয়ে বলল, রাগ করার যথেষ্ট কারণ ছিল বলেই করেছি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওরকম হতেই পারে। আমাকে উপদেশ দিয়ো না।

স্বামী-স্ত্রী হলেই বুঝি ঝগড়া হবে। জেঠিমা আর জেঠুর মধ্যে তো হয় না! এতদিন থেকে এলাম সেখানে একদিনও তো তাদের ঝগড়া শুনিনি।

ওদের সঙ্গে আমার তুলনা করছ? তোমার লজ্জা করে না?

কেন, লজ্জা কীসের? তুলনা করলে কি তোমার প্রেস্টিজে লাগে নাকি?

তোমার জেঠুর ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। হি ইজ ডোমিনেটেড বাই হিজ ওয়াইফ। ওদের স্ত্রৈণ বলে।

বাঃ, বেশ কথা তো! ব্যক্তিত্ব থাকা মানেই বুঝি ঝগড়ুটে হওয়া! ব্রাভো!

শোনো সোহাগ, তুমি যদি আর বাড়াবাড়ি করো তাহলে কিন্তু আমি তোমার চুলের মুঠি ধরে গালে চটাস চটাস করে থাপ্পড় মারব। একেই টেনশন হচ্ছে, তার ওপর…

বুডঢা তাড়াতাড়ি এসে মাকে ধরল, হোয়াই সো অ্যাগ্রেসিভ মা? কাম ডাউন!

শুনছিস না কী বলছে!

শুনছি। কিন্তু এটা হেস্টি হওয়ার সময় নয়। ইট ইজ অলরেডি টুয়েন্টি পাস্ট টুয়েলভ। এবার আমাদের কিছু করা উচিত।

কী করবি তোরা ঠিক কর। আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

 তুমি বরং একটু ঠান্ডা জল বা কোল্ড ড্রিংস খাও। মাথা ঠান্ডা করো।

 শোওয়ার ঘরে যেতে যেতে মোনা চাপা গলায় বলছিল, একটা লম্পট, চরিত্রহীন লুম্পেন আমাকে ভাজাভাজা করে খেল। ডিসগাস্টিং!

সোহাগ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।

কোথায় যাচ্ছিস দিদি?

ছাদে।

এত রাতে ছাদে?

মাথা গরম লাগছে।

তুই ছাদে! মা বেডরুমে! আমি একা কী করব বল তো! বাবার যে কী হল।

 পারহ্যাপস হি হ্যাজ কমিটেড সুইসাইড। এ-বাড়িতে এরকমই একটা কিছু হওয়ার কথা।

 যাঃ, কী যা তা বলছিস!

 লিভিং টুগেদার ইজ অ্যান আর্ট বুডঢা। আর আমরা সেটাই শিখিনি।

 রেগে যাচ্ছিস কেন? লেট আস টক অ্যান্ড সর্ট আউট দি থিংস। বাবা কটার সময় বেরিয়েছে?

 ঠিক জানি না। ঘড়ি দেখিনি। পাঁচটার পর।

 কিছু বলে যায়নি?

না। হি জাস্ট লেফট।

পোশাক?

যেটা পরনে ছিল। পোশাক ছাড়ার আগেই দে হ্যাড দি ফাইট।

খুব ভায়োলেন্ট কিছু?

দে আর অলওয়েজ ভায়োলেন্ট।

কী নিয়ে ঝগড়া শুনেছিস?

সোহাগ একটু ভেবে মাথা নেড়ে বলল, না। বেডরুম কথাটা কানে এসেছিল। দে পিকাপ এভরিথিং অ্যান্ড এনিথিং ফর এ ফাইট।

বুডঢার বয়স এখনও ষোলো পূর্ণ হয়নি। তার মুখশ্রীতে এখনও নাবালকত্বের ছাপ। চোখ দুটো একটু ছলছল করছে। অসহায়ভাবে বলল, ইট ইজ টুয়েলভ থার্টি অলরেডি। কী করব বল তো!

সোহাগ গোঁজ মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবাকে আমার খুব সিক মনে হয়েছিল।

শোওয়ার ঘরের দরজা খুলে হঠাৎ মোনা বেরিয়ে এসে বলল, ডোরবেলের শব্দ শুনলাম না?

 বুডঢা মাথা নাড়ল, না মা। অন্য কোনও ফ্ল্যাটের আওয়াজ।

 ডাইনিং টেবিলেই একটা চেয়ার টেনে ক্লান্ত মোনা বসে পড়ল, ফের বর্ধমানে ফিরে যায়নি তো!

বুডঢ়া বলে, দুর! কী যে বলো! দিদি বলছে বাবাকে সিক দেখাচ্ছিল। আমি ভাবছি রাস্তায় অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল কি না।

কপালটা ডান হাতের দু আঙুলে চেপে ধরে মোনা বলে, আমার মাথা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়।

তুমি শুয়ে থাকো না!

তোরা কী করবি?

 বাসুদেব টেবিল পরিষ্কার করছিল। বলল, কিছু ভাববেন না বউদি, আমি নীচে নেমে আশেপাশে খোঁজ নিয়ে আসছি।

বুডঢা বলল, আমিও যাচ্ছি। চলো। দিদি, তুই যাবি?

হ্যাঁ।

মোনা বলল, বাসুদেব, থাক এখন থাক। তাড়াতাড়ি যাও।

তিনজন বেরিয়ে যাওয়ার পর মোনা বেডরুমে এল। লকার থেকে কন্ডোমের প্যাকেটটা বের করল। খুবই শস্তা, দিশি ব্র্যান্ড। এ-জিনিস নিশ্চয়ই কোনও অভিজাত বা রুচিশীল মানুষ ব্যবহার করবে না।

প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সে ভাবতে লাগল।

.

বিলিয়ার্ড টেবিলে একটা বলের সঙ্গে আর একটা বলের ধাক্কা লাগল। মৃদু টক করে একটা শব্দ। একটা বল গড়িয়ে গিয়ে আরও দুটো বলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল দু ধারে। টক টক। দুটো বল গড়িয়ে গিয়ে ধাক্কা মারল আরও দুটো করে বলে। টক টক টক টক। তারপর বলগুলো ছোটাছুটি করতে লাগল চারধারে। এ ওকে ধাক্কা মারছে। ও তাকে। সে একে। টকটক শব্দে জ্বালাতন হয়ে গেল অমল। টেবিল জুড়ে বলের বিশৃঙ্খলা আর টক টক শব্দ। পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কান চাপা দিতে হাত তুলেছিল অমল। কিন্তু হাতটা আটকে যাচ্ছে কোথায় যেন। তুলতে পারছে না।

কিন্তু হাতটা তুলবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়েই গভীর আচ্ছন্নতা থেকে চোখ মেলে জেগে উঠল অমল। টের পেল, অসাবধানে সে তার ডান হাতের ওপরেই চেপে বসে আছে।

কোথায় বসে আছে তা বুঝতে একটু সময় লাগল তার। না, সে ঠিক বসেও নেই। একটু কাত হয়ে আছে ডানদিকে। সিটের পাশে তার ঘুমন্ত মাথা গড়িয়ে খাজটায় আটকে রয়েছে। আর তার কানের পাশেই জানালার কাঁচে শব্দ হচ্ছে টক টক।

খুব ক্ষীণ একটা ডাকও শুনতে পেল সে, বাবা! বাবা!

অমল সোজা হয়ে বসল। গাড়ির ভিতরটা ভ্যাপসা, দম বন্ধ করা অবস্থা। সে দরজার লকটা খুলে দিল।

এক ঝটকায় বাইরে থেকে দরজাটা খুলে বুডঢা আর্তস্বরে ডাকল, বাবা! কী হয়েছে তোমার?

কী হয়েছে তা অমলের মনে পড়ল না প্রথমে। কিছুই মনে পড়ল না। বাইরের এক ঝলক ঠান্ডা বাতাসে শ্বাস টানল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কিছু হয়নি।

কিছু হয়নি?

না তো। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধহয়।

 বাইরে বুডঢার পিছনে সোহাগ, বাসুদেব, তিন-চারজন দারোয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে অমল বলল, কটা বাজে এখন?

বুডঢা বলল, রাত দুটো।

 মাই গড!

আর ইউ অলরাইট?

মাথা নেড়ে অমল বলল, হ্যাঁ, আই ফিল ফাইন।

কী করে গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে তুমি?

জানি না। বুঝতে পারছি না। শরীরটা খারাপ লাগছিল খুব। তারপর আর মনে নেই।

 নামতে যাচ্ছিল অমল, বুডঢা ডান হাতটা চেপে ধরে বলল, এসো, ধরছি। আর ইউ রিয়েলি ও কে?

না, অমল ও কে নয়। তার হাত পা ঠিক বশে নেই। দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরছে। তবু সে নামতে পারল।

আমাকে ধরতে হবে না। পারব।

অমল ধীরে ধীরে হেঁটে লিফটে এসে উঠল। কী হয়েছিল তা সে খুব আবছা মনে করতে পারছিল মাত্র। এখনও মাথায় পারম্পর্য নেই। নট ইন অর্ডার।

ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা। ভিতরে সব কটা আলো জ্বলছে। দরজায় দাঁড়িয়েই সে মুখোমুখি মোনাকে দেখতে পেল। ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ও কি বাঘিনীর মতো ডিনারের জন্য বসে আছে। ওর ডিনার কি সে নিজে? তাকেই খাবে বলে ওত পেতে আছে নাকি?

.

৩৭.

ডি এন এ, জিন, শুক্রকীট–এসব নিয়ে মাথাটা মাঝে মাঝে বড্ড ডোম্বল হয়ে যায়। কী অশৈলী কাণ্ডকারখানা বাপু! জীবাণুর মতো ছোট এক চিজ, তার মধ্যে প্রাণ। শুধু প্রাণই বা কেন! তার মধ্যে স্বভাব, চরিত্র, মেধা, সব প্রোগ্রাম করা আছে। মাতৃগর্ভের জ্বণ থেকে কত বড় মানুষটা হয়ে দাঁড়ায় একদিন।

কোথায় পড়েছিল মহিম যে, অত মানে চলা, অর্থাৎ গতি। ওই অত থেকে আত্মা। যে কেবলই চলে। বাপের বীজ থেকে মাতৃগর্ভ হয়ে তার দুর্বার গতি। বেড়ে চলে, বেড়েই চলে। বংশগতির এই প্রবহমানতার কথা যত ভাবে মহিম তত এই বুড়ো বয়সে নতুন করে অবাক হয়। কত কাল, কত যুগ আগে সৃষ্টি হয়েছিল মানুষ, তখন থেকে তার চলা, অলিম্পিক মশালের মতো প্রাণ চলেছে, প্রাণ থেকে প্রাণ, ফের প্রাণ থেকে প্রাণে।

এই যে সে, মহিম রায়, সে কি একজন আলাদা আলটপকা মানুষ? তা তো নয়। কোন হাজার হাজার বছর আগে ছিল তার পূর্বপুরুষ, হয়তো বর্বর, ন্যাংটো, ভাষাহীন, সভ্যতাহীন। কেউ তার নামও জানে না। নামই ছিল না হয়তো। তার থেকে ধারা বয়ে এত দূর এল! তার পরও চলল কমল হয়ে, অমল হয়ে তাদের ছেলেপুলে হয়ে। বিচার করলে, জগতের সব মানুষেরই টিকি বাঁধা কোনও অজানা অন্ধকার যুগের এক অনামা মানুষ আর অজানা নারীর কাছে। আদম বা ঈভ হতে পারে তারা। বা অন্য কেউ।

মহিম ভাবতে ভাবতে থই পায় না। কী করে যে হচ্ছে ব্যাপারটা! কে চালাচ্ছে এই অদ্ভুত সৃষ্টির লীলা! যত বয়স হচ্ছে ততই যেন সব বেড়ে যাচ্ছে মায়া।

কাল ওরা চলে গেছে। আজ সকালে মহিম টুক টুক করে দোতলায় উঠে মুখোমুখি ঘরটায় তালা খুলে ঢুকল। বড্ড অগোছালো রেখে গেছে ঘরখনা। বেডকভার কুঁচকে আছে, মেঝেময় পড়ে আছে। নানা বর্জিত জিনিস। দেয়ালে মাথার টিপ সাঁটা। টেবিলের দেরাজ টেনে দেখল, তাতেও মাথার ক্লিপ, রিবন, সেফটিপিন, ফুরিয়ে যাওয়া লিপস্টিক পড়ে আছে। এখনও ঝটপাট হয়নি ঘরটা। সেন্ট পাউডারের গন্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মাঝখানের দরজাটা এখনও ছিটকিনি দেওয়া। দেখে একটু অবাক হয় মহিম। পাশের ঘরটায় অমল থাকত। কিন্তু মাঝখানের দরজাটা ছিটকিনি এবং বাটাম দেওয়া কেন? কে কাকে আটকাতে চেয়েছিল? স্বামী-স্ত্রী মধ্যে ছিটকিনি-দেওয়া দরজা থাকার তো কথা নয়! তার ওপর অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য আবার বাটামটাও আটকানো! দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই ক্ষীণ অ্যালকোহলের গন্ধ পেল মহিম।

অমল মদ খায় তা মহিম জানে। যেদিন মধ্যরাতে মহিমের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছিল অমল সেদিনও গন্ধ পেয়েছে। মদ-টদ খাবে সে আর বেশি কথা কি? তবে টেবিলের নীচে পিছনের পায়ার কাছে সাত-আটটা মদের খালি বোতল দেখে মহিম –কোচকায়। এত মদের বোতল নিয়ে তো অমল কলকাতা থেকে আসেনি!

বিছানায় একটা ক্যালকুলেটর গোছের জিনিস পেয়ে মহিম হাতে নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে দেখল। এসব জিনিস মহিম চেনে বটে কিন্তু ব্যবহার জানে না। ঢাকনা খুলে দেখে, ছোট ছোট অনেক বোতাম। শুধু ক্যালকুলেটর ছাড়াও অন্য সব ব্যবহারও আছে নিশ্চয়ই। একবার ইচ্ছে হল বোতামগুলো এক-আধটা টিপে দেখে কী ঘটনাটা ঘটে।

কিন্তু সাহস হল না। কে জানে বাবা আনাড়ির হাতের টেপাটেপিতে খারাপ-টারাপ না হয়ে যায়। কাজের জিনিসটা ফেলে গেছে, হয়তো অসুবিধেয় পড়বে। রতনকে দিয়ে একটা ফোন করিয়ে দিতে পারলে হয়।

রতনকে ডেকে লাভ নেই। এখন সে ঘুমোচ্ছে। আগে গাঁয়ের ছেলেপুলেরাও ভোর-ভোর উঠে পড়ত। আজকাল রাত জেগে সব টি ভি-তে সিনেমা দেখে মাঝরাত অবধি। দু-একদিন মহিমকেও জোর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে হিন্দি, বাংলা সিনেমা দেখানোর চেষ্টা করেছিল। মহিমের বেশিক্ষণ ভাল লাগে না। সিনেমা-টিনেমা একটা বিশেষ বয়সের পক্ষেই বোধহয় ভাল। বয়স গড়িয়ে গেলে ধৈর্যও কমে যায় কিনা।

নিচু হয়ে টেবিলের তলা থেকে বোতলগুলো টেনে আনল মহিম। সব কটায় একই লেবেল আঁটা। ঢাকনা খুলে একটু গন্ধও শুক মহিম। গন্ধ কিন্তু বিকটেল নয়, একটু ঝাঝালো, এই যা। একটা বোতলে দেখল, একটু তলানি পড়ে আছে এখনও। সন্ধ্যাকে ডেকে বোতলগুলো দিয়ে দিলে হয়। ধুয়ে কাসুন্দি-টাসুন্দি রাখতে পারবে। এমনিতে অ্যালকোহল বিশুদ্ধ জিনিস, তাতে জীবাণু বাঁচে না।

খাটের ওপর বসে মহিম অমলের কথাই ভাবছিল। ছেলেপুলে বড় হলে ঘাটের সঙ্গে মাঝদরিয়ার নৌকোর মতো তফাত হয়ে যায়। তবু সেই হামাটানা অমল, সেই পৈতের দিন ন্যাড়ামাথা অমলের চুলের জন্য কান্না, সাঁতার শিখতে গিয়ে হাবুডুবু অমলের সেই বাপের গলা জড়িয়ে ধরা, সব মনে পড়ে যাচ্ছিল আজ। মায়া কি ছাড়তে চায়! অমলের কথা থেকেই আরও কথা এল মনে। জিন, ডি এন এ, বংশগতি। কী সাংঘাতিক সব ব্যাপার-স্যাপার! যতদিন যাচ্ছে ততই যেন দুনিয়াটা বুঝ-সমঝের বাইরে চলে যাচ্ছে। ততই মনে হচ্ছে, জীবনটাকে ওপরসা ওপরসা দেখে তেমন কিছু বোঝা যায় না বটে, কিন্তু তার পরতে পরতে কত যে রহস্য লুকিয়ে আছে।

মদের খালি বোতলগুলো টেবিলের ওপর সাজাল মহিম। তারপর চেয়ে রইল। সে শুনেছে এক এক বোতল বিলিতি মদের দাম অনেক। এই আট বোতল মদের দাম কত তা ভাবতেও ভয় করে। এত পয়সা খরচ করে এত মদ কেন খায় কে জানে! এত মাথা ছেলেটার, অত ভাল রেজাল্ট করা, তারপর মোটা বেতনের চাকরি, তবু মুখখানায় কোনও সুখের ছাপ নেই। লেখাপড়া শিখে তা হলে কী হয় মানুষের? এত শিখে, এত জেনে মদের বোতলে এসে ঢুকতে হয় কেন?

বিছানায় বসে অনেকক্ষণ ছেলেকে অনুভব করল মহিম। না, ছেলেটা বোধহয় সুখী হল না। কেন হল না তার কারণ খুঁজে বের করা হয়তো মহিমের সাধ্য নয়। তার চিন্তা ক্রমে অমলকে ছেড়ে মোনা, বুডঢা, তারপর সোহাগে এসে থামল। কোনও প্যাটার্ন নেই ওদের মধ্যে। এক এক জন এক এক রকম। কিন্তু প্যাটার্নটা নেই কেন? কোথায় গণ্ডগোলটা হচ্ছে?

জানালা দিয়ে নীচের উঠোনে সন্ধ্যাকে দেখতে পাচ্ছিল মহিম। ভাল করে আলো ফোঁটার আগেই উঠে পড়ে মেয়েটা। তারপর সারাদিন মোষের মতো খাটে। রূপ নেই, গানের গলা নেই, বিয়ে টিকল না–এইসব অভাব শরীর খাটিয়ে পুষিয়ে নিতে চায়। ভাল, ভাল, কিছু নিয়ে মেতে থাক। মনের ক্ষতচিহ্নগুলো নিয়ে বেশি নাড়াচাড়ার সময় না পাওয়াই ভাল।

এই সাত-সকালেই দু-চারজন মাল নিতে চলে এসেছে। বেলা হলে আরও আসবে। সন্ধ্যার জিনিসপত্র আজকাল খুব বিক্রি হচ্ছে। একদিক দিয়ে ভগবান বঞ্চিত করেছেন বটে, তাই কি অন্য দিক দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছেন? বছর খানেক আগেই সন্ধ্যা একদিন মহিমকে কথায় কথায় বলে ফেলেছিল, তার নাকি সত্তর হাজার টাকার ওপর জমে গেছে। গ্রামদেশে একটা মেয়ের পক্ষে ঘরে বসে এত টাকা রোজগার বড় কম কথা তো নয়। এখন হয়তো ওর হাতে লাখ টাকার ওপরেই আছে, মাঝে একদিন বলেছিল, পেষাই মেশিন কিনে গুঁড়ো মশলার ব্যবসা শুরু করবে।

এই টাকার লোভেই কিনা কে জানে, একটা ছোকরা ওর সঙ্গে বোধহয় খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মহিম কানাঘুষো শুনেছে, বিয়েও নাকি করতে চায়। মহিম তাই উদ্বেগ বোধ করে।

এ বিষয়ে সন্ধ্যাকে কিছু জিজ্ঞেস করাটা অনুচিত হবে ভেবে চুপ করেই ছিল মহিম। উদয়াস্ত খাটে মেয়েটা, প্রেম-ট্রেম করার সময়ও তো পায় না। হয়তো রটনাই হবে ভেবে নিয়েছিল মহিম।

সন্ধ্যার ঘর মহিমের ঘর থেকে দু কদম। তবু সন্ধ্যা বাপের সঙ্গে দেখা করার সময় পায় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখাচোখি হয় হয়তো, কিন্তু কথা বলার ফুরসত কই ওর? এখন কয়েকটা মেয়েকে মজুরি দিয়ে রেখেছে, তাদের কাজকর্ম তদারক করা, আদায়-উশুল, হিসেব-নিকেশ সবই তো একা সামলায়।

দিন কয়েক আগে একটু ফাঁক পেয়ে সন্ধেবেলা এল মহিমের কাছে।

বাবা, তোমার শরীর নাকি খারাপ?

কে বলল তোকে?

সোহাগ বলছিল, দাদুর জ্বর হয়েছে।

মহিম প্রসন্ন হেসে বলল, সেরকম কিছু নয়। ঠান্ডা লেগে সর্দি মতো হয়েছে একটু। সেরে যাবে।

 সোহাগ তোমার কাছে খুব আসে, না?

আসে মাঝে মাঝে। গল্প-টল্প করে।

 খুব অদ্ভুত মেয়ে, তাই না? আমার ভারী ভাল লাগে ওকে। আমার যদি ওরকম একটা মেয়ে থাকত বেশ হত।

মহিম চুপ করে থাকে। সন্ধ্যার যে ঘর-সংসার-সন্তান হল না তার জন্য নিজেকেই দায়ি বলে মনে হয় মহিমের। পাত্র পছন্দ করেছিল সে নিজেই। এমনিতে পাত্র কিছু খারাপও মনে হয়নি। কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনা-বিচার কত যে ওলট-পালট হয়ে যায়।

কালোজিরে ন্যাকড়ায় বেঁধে ছোট একটা পুঁটুলি করে এনেছিল সন্ধ্যা। আর এক প্যাকেট শুকনো আদাকুচি বাবার হাতে দিয়ে বলল, রাত্রে একটা কাথ তৈরি করে নিয়ে আসব। মা করত, মনে নেই?

মহিম হাসল। সবই মনে আছে। চেয়ার টেনে বাপের বিছানার কাছে বসে সন্ধ্যা বলল, সারাদিন এত ঝামেলা যায় যে তোমার সেবা-টেবা কিছু করতে পারি না। তোমার তো চিরকালের চাপা স্বভাব, মরে গেলেও নিজের অসুবিধের কথা কাউকে বলবে না।

ভাবছিস কেন? অসুবিধে হলে তো বলব! সামান্য সর্দিজ্বর, তা জ্বরটাও এখন নেই।

এ বাড়িতে তোমার দিকে তাকানোরও কারও সময় নেই দেখছি। মা মরে যাওয়ার পর থেকেই তোমার বড় অযত্ন হচ্ছে।

মহিম একটু হাসল। কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। সন্ধ্যার মা কোনওদিনই মহিমকে মূল্য দেয়নি, আমলও দিত না। মহিমের নালিশ ছিল না বটে, কিন্তু অবহেলাটা সে খুব টের পেত। আর সেই অবহেলার মনোভাব মহিমের ছেলেমেয়ের মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী যদি স্বামীকে সম্মান বা শ্রদ্ধা না করে তা হলে ছেলেপুলেরাও বাবাকে শ্রদ্ধা করতে শেখে না। মহিমের যত্ন কেউ কখনও করেনি। তার জন্য তার বিশেষ দুঃখও নেই। ..

তবে সন্ধ্যার কথাটার প্রতিবাদও করল না মহিম। প্রিয় মানুষরা স্মৃতিতে মহান হয়ে যায়। প্রতিবাদ করবেই বা কেন মহিম! করে লাভ কী?

সে মৃদুস্বরে বলল, আমার তো অসুবিধে হচ্ছে না। তোরা সব কাজকর্ম নিয়ে আছিস। যদি অচল হয়ে পড়ি তখন দেখা যাবে।

তবু মায়ের মতো যত্ন কি আর কেউ করতে পারবে?

মহিম হেসে বলল, আমাকে নিয়ে কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়লে বরাবরই আমার অস্বস্তি হয়। মানুষের উৎপাতের কারণ যত না হওয়া যায় ততই ভাল।

না বাবা, তোমার কথা ভেবে মাঝে মাঝে আমার কিন্তু কষ্ট হয়। মুখ ফুটে কিছু বল না বটে, কিন্তু অসুবিধে কি আর না হচ্ছে!

দুর পাগল, অসুবিধে আবার কী? বেশ আছি।

খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ সন্ধ্যা বলল, বাবা, একটা কথা বলব? আমার বাকি জীবনটা কীভাবে কাটবে বলো দেখি!

মহিমের বুকে যেন শক্তিশেল এসে পড়ল। এটা সন্ধ্যার অনুযোগ নয়, নালিশ নয়। বাপের বিরুদ্ধে অভিমান বা রাগও নয়। খুব স্বাভাবিক গলায় নিরাবরণ একটা প্রশ্ন। তাই বোধহয় সেটা রাখঢাক না করেই সোজা এসে পড়ল হাতুড়ির ঘায়ের মতো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহিম বলল, সেটাই তো ভেবে ভেবে সারা হই।

আমিও ভাবি বাবা। টাকা কিছু কম তো রোজগার করি না। ব্যবসা বাড়বে, কাজকর্ম বাড়বে, রোজগারও বাড়বে। কিন্তু শুধু টাকা দিয়ে কী হবে বল তো!

মহিম এ কথার কী জবাব দেবে? টাকার উপযোগিতা এক এক বয়সে হয়তো এক এক রকম। আশি বছর বয়সে মহিমের এখন টাকা জিনিসটার প্রতি কোনও মোহ নেই। হয়তো অভাবি, উপোসি হলে মোহ থাকত। ঠেকায় না পড়লে টাকার চিন্তা এখন কদাচিৎ মাথায় আসে।

সে মৃদু স্বরে বলল, সেটা তো মস্ত প্রশ্ন মা। টাকা দিয়ে সব সমস্যার তো সমাধান হয় না।

হ্যাঁ বাবা, আমার কত বয়স হল বল তো! এখনও কতদিন বাঁচতে হবে! ভাবলে কেমন মাথাটা পাগল পাগল লাগে। কাজকর্মে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে বুকটা মুচড়ে ওঠে।

মহিম মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারল না। অপরাধী চোখ নেমে এল নীচে।

সন্ধ্যা বলল, সেই মানুষটাকে সামনে পেলে একবার জিজ্ঞেস করতাম, আমার দোষটা কী ছিল। কুচ্ছিত! কত কুচ্ছিত হ্যাঁক-ছিঃ মেয়েও কেমন দিব্যি সুখে ঘর করছে বল তো! আমি কুচ্ছিত হলেও তাকে ভরিয়ে দিতে পারতাম, কোথাও খুঁত থাকত না একটুও।

একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে মহিম বলে, কতবার ভেবেছি একবার ওর কাছে যাব। গিয়ে কী দেখব কে জানে, হয়তো দ্বিতীয় বিয়েটা সুখের হয়নি। হয়তো তোর কথা মনে করে ওর অনুশোচনা হয়।

সন্ধ্যা বোকা হলেও ব্যবসা-ট্যাবসা করে বাস্তব বুদ্ধি হয়েছে খানিকটা। মুখখানা ভার করে বলল, ও কথা আমারও মনে হত বাবা, পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটে। কিন্তু আমার কপালে ওরকম হবে না বাবা।

মহিম চুপ করে থাকে।

সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আজকাল তাই বড্ড একাও লাগে। তাই ভাবছি–

 কী ভাবছিস রে মা?

সে তোমাকে আর একদিন বলবখন। আগে ভাল করে ভেবে নিই, তারপর বলব। একদিন তো বলতেই হবে।

সেই একদিনটা আজও আসেনি। না আসাই ভাল। সন্ধ্যা যা-ই বলুক সেটা মহিমের খুব পছন্দসই হওয়ার কথা নয়। যে ছোকরাটি আসে সেও আর পাঁচজনের মতোই সন্ধ্যার তৈরি আচার, কাসুন্দি, আমলকী নিয়ে গাঁয়েগঞ্জে দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেয়। পরিশ্রমী, কেজো চেহারা। একদিন সোহাগ মহিমের ঘরে বসেছিল দুপুরবেলা। গল্প করতে করতে জানালা দিয়ে কী দেখে থেমে গেল।

তারপর বলল, দাদু, দেখো।

কী দেখব রে?

দেখো না ওই লোকটাকে।

মহিম দেখল। কালো, বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার বছর ত্রিশ বয়সি একটা ছেলে।

ও কে রে দিদিভাই?

 ভাল করে দেখেছ?

 দেখলাম তো!

পিসিকে ওর সঙ্গে মানাবে?

মহিম চমকে উঠে বলে, তার মানে কী রে?

 মুখটা খুব করুণ হয়ে গিয়েছিল সোহাগের। বলল, পিসিটা না ভীষণ লোনলি।

তা তো জানি। কিন্তু মানানোর কথা কী বললি দিদিভাই?

ও কিছু না।

 কথাটা ওখানেই থেমে গিয়েছিল।

কয়েকদিন পর সোহাগ আর একদিন মহিমের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ বলেছিল, পিসির একজন বয়ফ্রেন্ড হলে ভাল হয়, না দাদু?

মহিম অবাক হয়ে বলেছিল, সে কী! বয়ফ্রেন্ড কেন?

সোহাগ বলল, কোনও কোনও মহিলা আছে যারা সিংগল থাকতেই পছন্দ করে। বিয়ে-টিয়ে পছন্দ করে না, করলেও অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে পারে না। আবার কোনও কোনও মহিলা আছে যাদের কাছে ম্যারেজ ইজ এভরিথিং। বিয়ে না করে থাকার কথা তারা ভাবতেই পারে না। জান? পিসি হল এই সেকেন্ড টাইপের।

সেটা যে মহিম জানে না তা নয়। সন্ধ্যা ছেলেবেলা থেকেই ঘর-গোছানো মেয়ে। কাজেকর্মে পরিপাটি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কখনও আলসেমি বলে তার কিছু দেখেনি মহিম। ওর মাও বলত মুখখানা সুন্দর নয় বটে, কিন্তু যার ঘরে যাবে তার ঘরে লক্ষ্মীশ্রী ফুটে উঠবে।

মহিম বলল, তুই পিসিকে নিয়ে খুব ভাবিস বুঝি?

ভাবব না? শি ইজ এ ডেজার্টেড উওম্যান!

 আমিও খুব ভাবি। হ্যাঁ রে দিদিভাই, তোর পিসি কি আবার বিয়ে করার কথা ভাবে?

একটু দ্বিধায় পড়ে সোহাগ বলেছিল, নট একজ্যাক্টলি।

তা হলে?

আমার মনে হয়, পিসি ওয়ান্টস এ ফ্যামিলি অ্যারাউন্ড হার।

 এটাও তো একটা পরিবার, তাই না?

 না না এরকম নয়। পিসি ওয়ান্টস হার ওন ফ্যামিলি। ক্রিয়েটেড বাই হার।

মহিম চুপ করে গিয়েছিল। সতেরো বছর বয়সি নাতনির সঙ্গে এ বিষয়ে আর অধিক কথা বলাটা শোভন হত না।

কিন্তু হঠাৎ স্বগতোক্তির মতো একটা কথা বলেছিল সোহাগ, জান দাদু, লোকটা কিন্তু পিসিকে দিদি ডাকে।

কে লোকটা?

ওই যে সেই লোকটা।

দিদি ডাকলে ক্ষতি কী? অনেকেই তো ডাকে!

সোহাগ খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল। তারপর বলল, তুমি কিচ্ছু বোঝো না!

মহিমকে ভাবনার সমুদ্রে ফেলে রেখে উধাও হয়েছিল সোহাগ।

মহিম সেই থেকে ভেবে যাচ্ছে। ভেবেই যাচ্ছে।

বেলা সাতটায় উঠোনে রতনকে দেখতে পেয়ে ডাকল মহিম। রতন ওপরে এলে মহিম বলল, এগুলো তোর পিসিকে দিয়ে আয়। কাসুন্দি-টাসুন্দি রাখতে তো বোতল লাগেই।

রতন হাসল, পিসি ও বোতল নেবে নাকি?

কেন নেবে না?

ও তো মদের বোতল!

মহিম চিন্তিত হয়ে বলে, নেবে না বুঝি? তা হলে থাক।

পিসি নেবে না। আমি তো কালই ওদের মালপত্র নামাতে গিয়ে বোতলগুলো দেখে পিসিকে বলেছিলাম। পিসি যা রেগে গেল!

রেগে গেল কেন?

বলল মদের বোতলে আমি কাসুন্দি বিক্রি করব? ছিঃ ছিঃ! খবরদার ও কথা আর মুখে আনবি না। আমি ভয়ে আর কিছু বলিনি বাবা! মা বলেছে শিশিবোতলওয়ালা এলে বেচে দেবে। ওরা নাকি মদের বোতলের দাম বেশি দেয়।

মহিম রতনের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ওকে এত মদ কে এনে দিত বল তো! তুই?

না, কাকা নিজেই কিনত। তবে আমিই মোটরবাইকে করে কাকাকে বর্ধমান নিয়ে গেছি দুদিন। মদ কিনতে। তুমি মদ নিয়ে এত ভাবছ কেন দাদু? ওসব আজকাল জলভাত, সবাই খায়।

তাই দেখছি।

দুনিয়ায় যে মদ্যপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে সে খবর একটু জানে মহিম। যৌবন বয়সে সেও খেয়েছে কখনও-সখনও। তবে শখ করে। কথাটা হল, মদ্যপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে কেন?

এমন নয় যে, মদের বিরুদ্ধে মহিমের কোনও জেহাদ আছে। বহু বহু যুগ আগে থেকেই সুরার প্রচলন রয়েছে মানুষের সভ্যতায়। দেবতারাও নাকি খেতেন-টেতেন। তবু যে ক্ৰমে ব্যাপারটা খুব চারিয়ে যাচ্ছে তার মানে কী, আলাদা একটা পিপাসা তৈরি হয়েছে? নাকি মানুষের নানা ব্যর্থতা আর হতাশা থেকেই বাড়ছে মদের আসক্তি!

প্রশ্নটার সমাধান সহজ নয়।

বেলা দশটায় মহিম গৌরহরির বাড়ির উঠোনের রোদে মোড়া পেতে বসা। সামনে একটা জলচৌকিতে বউঠান।

অনেকদিন পরে এলেন ঠাকুরপো! অমলরা ছিল বলে বোধহয় আসার সময় পাননি।

মহিম মাথা নেড়ে বলে, তা নয় বউঠান। ওরা ওদের মতো ছিল, আমি আমার মতো। আসলে গৌরদাই তো নেই, তাই আসতে একটু কেমন কেমন লাগত! বুকটা ছ্যাত করে উঠবে হয়তো, সেই ভয়েই আসতাম না।

বলাকার মুখখানা ভারী করুণ হয়ে গেল।

তবেই বুঝুন তাকে ছাড়া আমি কী করে আছি। আমার বুক তো ছ্যাঁত করে ওঠে না, সব সময়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।

এত বড় বাড়িটায় একা কী করে থাকবেন বউঠান? গৌরদা ভাইয়েদের অংশ কিনে নিলেন, আমি তখন বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, এত বড় বাড়ি তার কোনও কাজে লাগবে না। তা অন্যের কথা শুনে চলবেন তেমন মানুষ তো ছিলেন না।

সে তো সত্যি কথা। বাড়িটা তো সারাদিন আমাকে গিলে খাচ্ছে। তবু পড়ে আছি। আমার তো অন্য গতি নেই।

কলকাতা বা নেহাত বর্ধমান শহর হলেও না হয় প্রোমোটারকে দিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু গ্রামদেশে তো তা হওয়ার জো নেই।

না ঠাকুরপো, কলকাতা হলেও এবাড়ি আমি কক্ষনও প্রোমোটারকে দিতাম না। যার বাড়ি সে এখনও এ-বাড়ির সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। আমি তো সব সময়ে তাকে টের পাই। ওই যেখানে আপনি বসে আছেন ওখানে বসেই এই শীতকালে তেল মাখত। সেই দৃশ্য যে এখনও দেখতে পাই।

আপনি নমস্যা বউঠান। লোকেও বলে, এমন সতীলক্ষ্মী আজকাল আর দেখা যায় না।

বলাকা মিষ্টি করে হেসে বলে, সেসব কিছু বুঝি না, শুধু জানি, সে ছাড়া আমি নেই। সত্যি কথা বলতে কী, এখন আমি নেই-এর দলেই পড়ে গেছি। বেঁচে আছি, আবার নেইও।

এইসব কথা শুনলে কান, মন সব পবিত্র হয়। ভালবাসা নিয়ে আজকাল যত বড় বড় লেকচার দেয় লোকে, কিন্তু ভালবাসা কি সোজা জিনিস! তার পিছনে কত ত্যাগ, ধৈর্য, অধ্যবসায় থাকে, কত সেবা, কত স্বার্থহীনতা। এ যুগে হালকা মনের বেলুন-মানুষেরা তা কী করে বুঝবে! এই বলাকা বউঠানকে সেই কিশোরীবেলা থেকেই তো দেখছে মহিম। এক ফোঁটা একটা রোগাটে গড়নের মেয়ে। মুখখানা তিরতির করত। খুব ফর্সা রং আর মেঘের মতো এক ঢল চুল ছিল। গৌরহরি তখন মধ্যযৌবনের রাঙা এক যুবাপুরুষ। মহিমের চোখের সামনেই সম্পর্কটা গড়ে উঠল। একদিকে একজন নাবালিকা, অন্য দিকে একজন শক্তসমর্থ পূর্ণবয়স্ক পুরুষ। বয়সের তফাত শুনলে এ যুগের ফচকে ছেলেমেয়েরা আঁতকে উঠবে। হয়তো বলবে বাপের বয়সি। তা কথাটা মিথ্যেও তো নয়। পতি আর পিতা একই ধাতু নিষ্পন্ন শব্দ। পতি অনেকটা পিতার মতোই। এখনকার দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে অনেক ফিচেলপনা ঢুকে গেছে, আকচা-আকচি ঢুকে গেছে, ইয়ারবন্ধুর মতো হাবভাব, ওতে স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারটাই ফুটে ওঠে না মোটেই। যেন সেক্স পার্টনার। সম্পর্কের দফার ওখানেই গয়াপ্রাপ্তি ঘটে যায়।

নাবালিকা বউকে নিয়ে গৌরহরির ঘর করা স্বচক্ষে দেখেছে মহিম। কী স্নেহ আর নরম কথা দিয়ে বাপের বাড়ির বিরহে কাতর বলাকাকে ভুলিয়ে রাখতেন গৌরহরি। বাড়ির লোকের চোখের আড়ালে গোপনে তাকে পড়াতেন, গল্প বলতেন। একবার বাড়ির সবাই তীর্থভ্রমণে গেল, তখন বলাকার হল টাইফয়েড। অন্য কেউ হলে ঝামেলা এড়াতে বউকে ঠিক বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিত বা শাশুড়ি-শ্বশুরকে ডেকে আনত। গৌরহরি তা করেননি। গু-মুত পরিষ্কার করা থেকে পথ্য পর্যন্ত সবকিছু সামলেছেন। একটুও বিরক্ত নেই, ঘিনপিত নেই।

একদিন মহিম বলেই ফেলল, গৌরদা এ যে দেখি বানরে সংগীত গায়, পিংলা জলে ভাসি যায়, দেখিলেও না হয় প্রত্যয়। জীবনে আপনি কখনও এক গ্লাস জল অবধি গড়িয়ে খেয়েছেন বলে তো শুনিনি। তা এত সব শিখলেন কোত্থেকে?

গৌরহরি একটু লজ্জা পেলেন বটে, কিন্তু নরম গলায় বললেন, মেয়েটার আমি ছাড়া কে আছে বল। আমার মুখ চেয়েই তো সব আপনজনকে ছেড়ে এসে আছে। ওর যদি এখন মনে হয় যে, মা বাবা কাছে নেই বলে ওর যত্ন হল না, তা হলে সেটা তো খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। তাই ওকে বুঝতেই দিই না।

একটু সময় লেগেছিল বলাকার মানুষটাকে বুঝতে। যখন বুঝল তখন তার মনোজগৎ জুড়ে গৌরহরি ভাস্বর হলেন। সেই মুগ্ধতা আজও বলাকার চোখে-মুখে ছড়িয়ে আছে। মারা গিয়েও গৌরদা যে কী ভীষণভাবে বেঁচে আছেন তা মহিম রায়ের মতো আর কে জানে! অথচ পরবর্তীকালে খামখেয়ালি গৌরহরি অন্যায্য অত্যাচারও তো কিছু কম করেননি। যখন তখন এটা সেটার ফরমাশ, বায়না, হঠাৎ অতিথি নিয়ে এসে চড়াও হওয়া। কোনওদিন এতটুকু কথা কাটাকাটি অবধি হয়নি দুজনের।

এইসব শিক্ষা নিতেই তো মহিম আসে এ বাড়িতে। দেখতে আসে গৌরহরি নিজের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে কত দূর পর্যন্ত নিজের ছায়াকে প্রলম্বিত করে রেখেছেন। এইভাবেই মানুষ বাঁচে।

দেবিকাকে যখন বিয়ে করে আনে মহিম তখন মহিমের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। দেবিকার কুড়ি-একুশ। পয়সাওলা ঘরের মেয়ে। মেলা দানসামগ্রী, নগদ পেয়েছিল মহিম। ওই অত সব পেয়েই বোধহয় একটু অধমর্ণ ভাব ছিল তার।

না, সম্পর্ক তাদের ভালই ছিল। ভাব ভালবাসার কিন্তু খামতি ছিল না। যেটার অভাব ক্রমশ প্রকট হল তা হল শ্রদ্ধা। আর ওই শ্রদ্ধার অভাব ঘটলে বোধহয় ভালবাসাটাও নিবু নিবু হয়ে আসে। ক্রমে ক্রমে, খুব ধীরে ধীরে সংসারের একজন গুরুত্বহীন সদস্যে পরিণত হচ্ছিল মহিম। তার মতামতের দাম নেই, তার পরামর্শ কেউ চায় না, তার অনুমতিরও প্রয়োজন হয় না কারও।

শীতের রোদে সাদা থান পরা দেবীমূর্তির মতো বসে আছে বলাকা। দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তবে যৌবন বয়সে মহিমের মনোভাব মাঝে মাঝে পঙ্কিল পথে ধাবিত হত না যে তা নয়।

মনে আছে বলাকা যখন ষোলো বা সতেরো বছরেরটি হল তখন তার রূপ যেন পেখম মেলে দিল। সেই সৌন্দর্যের যেন লেখাজোখা নেই। ওই আশ্চর্য রূপ দেখতে পিপাসার্তের মতো, দুখানি কাঙাল চোখ নিয়ে রোজ ছুটে আসত মহিম। এ-বাড়িতে তার বরাবরই অবারিত দ্বার। কারও কিছু মনে করার ছিল না। বউঠানের সঙ্গে খুনসুটিরও বাধা ছিল না কোনও।

মনের কথা কে টের পাবে! মনে এক নরকখানায় নিত্য কত পাপের জন্ম হয়, কত পঙ্কিলতা বাসা বেঁধে থাকে সেইখানে। মানুষের ভাগ্য ভাল যে তারা অন্তর্যামী নয়। হলে মানুষের দুঃখ শতগুণে বাড়ত।

কিন্তু মেয়েরা ঠিক টের পায়। কিছু না কিছু তারা বুঝতেই পারে পুরুষের চোখ দেখে। ও ব্যাপারে তাদের মেয়েলি মনে ঠিক সংকেত বেজে ওঠে।

বলাকাও কি টের পেয়েছিল?

 একদিন, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে বাগানে আম কুড়োচ্ছিল বলাকা।

মহিম হাজির হয়ে বলল, কী হচ্ছে বউঠান?

আম কুড়োতে নিচু হয়েছিল বলাকা, হঠাৎ যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন তার ফর্সা কপালে কুচো চুল ঘামে আটকে আছে, মুখখানায় যেন নেমে এসেছে স্বর্গের আলো। মহিমের স্বীকার করতে বাধা নেই, ওই একটি মুহূর্তে সে এমন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল সে যা খুশি করে ফেলতে পারত। হঠাৎ যেন বাঁধ ভাঙার জন্য তার ভিতরে প্রলয়ংকর বন্যার জল ফুঁসে উঠেছিল।

কিছু কি টের পেয়েছিল বলাকা? নির্জন আমবাগানে তখন জনপ্রাণী নেই। খর গ্রীষ্মের বিকেলে রৌদ্র-ছায়ার তীব্র নাচানাচি। পাখি ডাকছিল, হাওয়া দিচ্ছিল। বলাকা হঠাৎ তার দিকে চেয়ে হঠাৎ দু পা পিছিয়ে গেল কেন যে!

কম্পিত গলায় মহিম বলল, বউঠান।

 বলাকা হঠাৎ পিছু ফিরে লঘু পায়ে দৌড়ে বাগান পেরিয়ে উঠোনে গিয়ে উঠল।

বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল মহিম। বড্ড গ্লানি হল। ভাগ্যিস সে কিছু করে বসেনি!

দুদিন পর এক সন্ধেবেলা গৌরহরির বৈঠকখানায় যখন বসে আছে মহিম, তখন বলাকা তাকে চা দিতে এসে হঠাৎ মুখ টিপে একটু হেসে বলেছিল, ঠাকুরপো, এবার আপনি একটা বিয়ে করে ফেলুন।

বলাকার কি সেই আমবাগানের কথা মনে আছে? সেই দুপুর গড়িয়ে বিকেলের তীব্র স্মৃতি!

 হয়তো আছে। হয়তো নেই। আয়ুর মোহনায় পৌঁছে গেছে মহিম। সেই জল এত দূর গড়িয়ে আসবে না।

.

৩৮.

সে কেন দেখা দিল রে, না দেখা ছিল যে ভাল। অন্তত আবছায়া দেখাটুকু না হয় থাকত তার!

মায়ের কখনও প্রেশার ছিল না। অন্তত টের পাওয়া যায়নি এতদিন। আশ্বিনের শেষে যখন বেশ শীত শীত ভাব পড়ছিল তখনই হঠাৎ শিলাবৃষ্টি হয়ে একদিন বেশ হু হু হাওয়া দিল। তখন শীতের ঠকঠকানি উঠে গেল। তার বীর বাবা রামহরি পর্যন্ত মোটা খদ্দরের হলুদ রঙের চাদরটা বের করে গায়ে জড়িয়ে ফেলল সকালবেলা। তাকে চা দিতে এসেছিল মা। রামহরি স্ত্রীর দিকে চেয়ে যা কখনও করে না তাই করে ফেলল হঠাৎ। বলল, তোমার কপালে ঘাম দেখছি যেন! ঘেমেছ নাকি?

মেয়েদের শরীর-টরীরের খোঁজখবর নেওয়া পুরুষদের রেওয়াজ নয়। যেন মেয়েমানুষের শরীর খারাপ হতে নেই। আর হলেও সেসবের খোঁজখবর নেওয়া পুরুষের পক্ষে আত্মাবমাননাকর। রামহরিও কদাচিৎ তার স্ত্রীর শরীরের খবর নিয়েছে।

আর মহিলাও সেরকমই। শরীর খারাপকে কোনওদিনই খারাপ বলে মানে না, কাউকে বলে না ও কিছু কখনও। স্বামীর প্রশ্ন শুনে ভারী অবাক হয়ে বলল, ওমা! ঘামব না। যা গরম।

রামহরিও অবাক হয়ে বলে, গরম! সত্যি বলছ?

 গরম না তো কী! আমার তো বাপু হাঁসফাস লাগছে।

রামহরি চিন্তিতভাবে বলে, তাহলে কি আমারই শরীর খারাপ হল নাকি! আমার যে বেশ শীত করছে! জ্বর-টর আসছে নাকি? দেখো তো গাটা।

মাধুরী স্বামীর কপালে হাত দিয়ে বলল, না! গা তো ঠান্ডা!

তাহলে! তোমার গরম লাগছে, কিন্তু আমার শীত করছে কেন?

শীত! শীত কোথায়! তা বাপু, রাতে ভাল ঘুম হয় না বলে বোধহয় আমার মাথাটা একটু গরম হয়েছে।

রামহরি হাঁ করে চেয়েছিল! মাধুরীর ঘুম হয় না এ একটা আশ্চর্য কথা বটে। বরাবর মাধুরীর ঘুম ছিল বিখ্যাত। বেশি রাতে তাদের বিয়ের লগ্ন ছিল। আর কেউ টের না পাক, পাশেই বরের পিড়িতে বসা রামহরি বউয়ের হাতে হাত রেখে যখন অংবং মন্ত্র পড়ে যাচ্ছিল তখন সে পরিষ্কার টের পেয়েছিল বউ ঘুমে তার গায়ে ঢলে পড়ছে। কী লজ্জা! সবাই জানে বালিশে মাথাটা রাখলেই মাধুরী নেই। সেই মাধুরীর ঘুম হচ্ছে না শুনে রামহরি তো রামহরি, গোয়ালের গোরুটা পর্যন্ত জাবর ভুলে অবাক হয়ে চেয়ে থাকবে।

সংসারের পাঁচটা কাজ এসে কথা ভণ্ডুল করে দেয়। তাই স্বামী-স্ত্রীর কথা ওই পর্যন্তই হয়ে রইল।

পরদিনই দুপুরে রান্নাঘরে গ্যাস উনুনের বদলে কয়লার আঁচে ময়লা জামাকাপড় সেদ্ধ বসিয়েছিল মাধুরী। গোলা সাবানের কুচি জলে দিয়ে, জামাকাপড় খুন্তি দিয়ে উলটে-পালটে দিতে গিয়ে এমন শরীর অস্থির করল যে, উঠে এসে পান্নাকে কোনওক্রমে একটু যা তো মা, জামাকাপড়গুলো একটু দেখ, শরীরটা কেমন করছে যেন বলেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। বড় বড় শ্বাস ফেলছে, হাঁফ ধরা ভাব।

পান্নার সঙ্গে এমনিতে মাধুরীর একটু আড়াআড়ি আছে। পান্নার ধারণা, মা সবচেয়ে বেশি দাদাকে আর তার পরেই হীরাকে ভালবাসে। সে হল মায়ের কুড়িয়ে-পাওয়া মেয়ের মতো। অসুখ-বিসুখ হলে একটু-আধটু আদিখ্যেতা করে বটে, অন্য সময়ে নয়। মাধুরীর মুখে জীবনে কখনও শরীর খারাপের কথা শোনেনি পান্না। ওই এক ধরনের মহিলা যারা মরে গেলেও নিজের শরীরের কথা কয় না। তাই পান্না গিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের মুখের ওপর, কী হয়েছে মা! কেমন লাগছে?

কিছু নয় তেমন! বোধহয় পেটে একটু বায়ু হয়েছে। সেদ্ধটা গিয়ে দেখ মা।

মাধুরীর মুখটা টকটক করছে লাল। সারা গা ঘামে ভিজে জবজব করছে।

চুলোয় যাক সেদ্ধ, পান্না ছুটে গিয়ে তার বাবাকে দুপুরের ভাত-ঘুম থেকে টেনে তুলে আনল।

রামহরি যথেষ্ট ভ্যাবাচ্যাকা। সত্যি বটে, স্ত্রীলোকের স্বাস্থ্য বিষয়ে ভাবনার অবকাশ তার হয় না। কিন্তু এই স্ত্রীলোকটা গত হলে এই গড়ানে বয়সে যে তার অঙ্গহানির মতো একটা কিছু ঘটনা ঘটবে এটা বুঝতে তার লহমাও লাগল না।

কী হয়েছে? অ্যাঁ! কী হয়েছে! বলতে বলতে কী করতে হবে বুঝতে না পেরে রামহরি তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে হিমঠান্ডা জল গেলাসে গড়িয়ে এনে মাধুরীর চোখে-মুখে ঝাপটা দিতে লাগল।

মাধুরী চমকে উঠে বলল, উঃ, কী করছ কী! আমি কি মুছে গেছি নাকি? কিছু হয়নি আমার। একটু চোখ বুজে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। অবেলায় খেয়েছি তো, তাই বোধহয় কেমন করছে।

অবেলায় তো তুমি রোজই খাও।

মাধুরী আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ওরে বাবা, আর তোমাকে আমার সেবা করতে হবে না গো। একটু জিরোতে দাও দয়া করে, তাহলেই হবে।

রামহরিরও তাই মনে হল। রোদে-জলে, কাজে কর্মে পোক্ত শরীর, মরার বয়সও কিছু হয়নি। তার একাত্তর চলছে, মাধুরীর মেরেকেটে বাষট্টি। তত ভয়ের কিছু নেই।

একটু নার্ভাস হেসে শিয়রের কাছে বসা পান্নার দিকে চেয়ে বলল, পেটে গ্যাস হয়েছে, বুঝলি!

আজকাল মানুষের একটা গ্যাস-বাতিক হয়েছে খুব। ভাল-মন্দ কিছু হলেই বলে পেটে গ্যাস। এই গ্যাসের থিয়োরিটা পান্নার ভাল লাগে না মোটেই। সে বলল, বাবা, তুমি বরং ডাক্তারকে খবর দাও।

ডাক্তার! বলে রামহরি যেন আকাশ-পাতাল ভাবল খানিক। তারপর বলল, আজ অনল বাগচীর আসার দিন। তবে সন্ধের আগে তো নয়। কুঞ্জ ফার্মেসিতে একজন ডাক্তার বসেন বটে, তবে সবাই বলে হাতুড়ে।

মাধুরী বলল, ডাক্তার লাগবে না। আমার কিছু হয়নি। পান্না একটু হাতপাখা দিয়ে মাথায় বাতাস করুক, তাহলেই হবে। বড় হাঁসফঁস লাগছে। চোখে মাঝে মাঝে অন্ধকার দেখছি যেন। জামাকাপড় সেদ্ধ বসিয়ে এসেছি, ও পান্না, হাঁড়িটা নামিয়ে রেখে আয় মা। নইলে সব পুড়ে ঝামা হয়ে যাবে। সাবানজল আছে, সাবধানে ধরে নামাস, নইলে হাত পিছলে পড়ে গেলে পুড়ে মরবি।

সংসারের আসল খুঁটিটা নাড়া খেলে কী হয় তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাইকে বুঝিয়ে ছাড়ল মাধুরী। মা দুর্গার দশটা হাত আছে, কিন্তু তার মায়েরও যে বড় কম নেই, তা বুঝতেও পান্নার দেরি হল না বড় একটা।

দুপুরটা এপাশ ওপাশ করে কাটাল মাধুরী। শ্বাসকষ্টের ভাব, মাথা অস্থির, গরম, ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা।

সন্ধেবেলা রামহরি গেল ডাক্তার অনল বাগচীকে ডেকে আনতে।

 মায়ের কাছে স্কুলফেরত হীরাকে বসিয়ে ঠাকুরের আসনে ফুলজল দিয়ে ঘরে ঘরে জলছড়া আর ধুপধুনো দিতে দিতে ভারী লজ্জা-লজ্জা করছিল পান্নার। জ্বরের ঘোরে রাজপুত্রের মতো একজন মানুষকে দেখতে পেয়েছিল সে। যেন ডাক্তার নয়, রাক্ষসপুরীতে বন্দি রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে এসেছে।

পান্না টুক করে এক ফাঁকে একটু সেজেও নিয়েছে। একখানা ভাল শাড়ি, মুখে একটু প্রসাধন, কপালে টিপ, চুলে এলো খোঁপাটি সাবধানে রচিত, চোখে একটু কাজল আর ঠোঁটে ন্যাচারাল লিপস্টিকও। এইটুকুতে দোষ নেই। রাজার দুলাল যাবে আজি মোর ঘরের সুমুখপথে…

জীবনে এই প্রথম মাধুরী বিছানা নিয়েছে। জ্ঞানবয়স থেকে সে কখনও মায়ের শরীর খারাপ দেখেনি, এখন এই প্রথম মা শয্যা নেওয়াতে পান্না মায়ের জায়গা নিতে হাড়েহাড়ে বুঝছে এই মহিলা কী পরিমাণ ওয়ার্কলোড নিজের ঘাড়ে নিয়ে এ বাড়ির অন্য সব মানুষকে নিষ্কর্মা সময় কাটাতে দিয়েছে। রান্নাঘর থেকে গোয়ালের সাঁজাল, ঝি-এর কাজ তদারকি থেকে মুনিশদের সামাল দেওয়া, ঘরদোর সারা থেকে বাড়ির লোকের বায়নাক্কা সামলানো–অফুরন্ত কাজ। পান্না হাঁফিয়ে উঠেছে এক দিনেই। এ ছাড়াও আছে সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখা, বাজারের ফর্দ করা, ধোপার হিসেব, মুদির হিসেব, ধান-চাল বিক্রির হিসেব। ভাগ্যিস সেগুলো করতে হচ্ছে না এখনও। বিয়ের পর সংসার হলে যদি তাকে তার মায়ের মতোই জীবনযাপন করতে হয় তাহলে সে তো মরেই যাবে! বাবার চায়ের চিনি বেশি হয়েছিল। মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু অর্ধেকের ওপর চা ফেলে দিয়েছিল। স্কুল থেকে ফিরে ভাত পাতে মাছ-ভাজা হয়নি বলে মুখ গোঁজ করে ছিল হীরা। রোজ নাকি তাকে মা গরম মাছ-ভাজা দেয় পাতে। কে জানবে বাবা অত।

শুয়ে শুয়ে অসুস্থ শরীরেও মা মাঝে মাঝে বকুনি দিচ্ছিল তাকে, ধিঙ্গি মেয়ে একটা কাজ যদি ঠিকমতো করতে শিখেছে। পটের বিবি সেজে ঘুরে বেড়ালেই হবে! একদিন শুয়ে থাকার জো নেই। অমনি সব বেসামাল করে ফেলল। আমি মরলে কী যে হবে তোদের! সংসার উড়ে পুড়ে যাবে।

বাঁধা গৎ। কানে না তুললেও চলে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সে যে এক স্বপ্নের পুরুষের অপেক্ষায় আছে সেও কি আসলে ওই বাপ-জ্যাঠাদের মতোই নিতান্তই স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, গদ্যময় পুরুষ মাত্র? আর কিছু নয়? অন্য কিছু নয়? ধুস, তাহলে স্বপ্ন দেখাটার মানে কী? আর স্বপ্ন ছাড়া পান্না কি বাঁচে?

তবু অনল বাগচী আসবে আজ। জ্বরের ঘোরে স্বপ্নের মিশেল দেওয়া চোখে দেখা এক পুরুষ। কতটা লম্বা? খুব ফর্সা? স্বপ্ন-স্বপ্ন মেদুর চোখ না? আর গলার স্বরটা কী গম্ভীর গমগমে!

একটু সেজেছে তাই পান্না। একজন ডাক্তারকে বিয়ে করার খুব শখ হয়েছে আজকাল তার। ডাক্তারই ভাল। কারণ ডাক্তারদের সে একটু ভয় পায়। সেই ভয় ভাঙানোর জন্যই একজন ডাক্তারকে কাছে পেলে তার ভাল হয়।

সন্ধের পর একখানা ছোট্ট মিষ্টি মারুতি গাড়ি এসে যখন বাড়ির সামনে থামল তখন পান্নার বুকের মধ্যে স্পষ্ট ধুকুর-পুকুর। দরজার আড়াল থেকে সে দেখল, একজন নামছে। হাতে ডাক্তারি ব্যাগ, গলায় স্টেথোস্কোপ। বাইরে তত আলো নেই। অস্পষ্টতার মধ্যে মনে হল, লম্বা, বেশ লম্বা।

রামহরি ভারী আপ্যায়িত ভঙ্গিতে, আসুন আসুন বলে ঘরে নিয়ে এল তাকে।

 জুতো ছাড়তে হবে নাকি?

রামহরি তাড়াতাড়ি বলল, আরে না, না, জুতো থাক। আপনি আসুন।

একটু বিরক্ত হল পান্না। এবাড়িতে জুতো ছেড়েই শোওয়ার ঘরে ঢোকার নিয়ম। বাবা যে কেন জুতো ছাড়তে বারণ করল। তার মানে ডাক্তার চলে গেলে শোওয়ার ঘর থেকে বৈঠকখানা অবধি তাকে জলন্যাকড়া দিয়ে মেঝে মুছতে হবে।

স্পষ্ট আলোয় যখন অনল বাগচী ঘরে এসে দাঁড়াল তখনই যেন তার স্বপ্নের গোটা ইমারতটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেল। সেই ভাঙচুরের শব্দও যেন শুনতে পেল পান্না।

অনল বাগচীর বয়স চল্লিশের ওপর।

শুধু তা-ই নয়। তেমন সুপুরুষই বা কোথায়? ফর্সা নয় না-ই হল, মুখশ্রীও কি তেমন ভাল কিছু? মাথার চুল উঠে গিয়ে কপালটা বড় চওড়া দেখাচ্ছে। হাসলে সঁতের সেটিং বিশ্রী দেখায়। ধুস।

গোমড়ামুখো ডাক্তার মাধুরীকে পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ মুখ তুলে বলল, আগে ডাক্তার দেখেননি?

রামহরি মাথা নেড়ে বলে, না তো। দরকার পড়েনি।

 রোগটা তো আজকের নয়, বেশ পুরনো।

রোগটা কী ডাক্তারবাবু?

গম্ভীর ডাক্তার বলল, প্রেশার একশো নব্বইয়ের ওপর, নীচেরটা একশো কুড়ি। যে কোনও সময়ে একটা স্ট্রোক হয়ে যেতে পারত। হার্টেরও প্রবলেম আছে মনে হচ্ছে। ওষুধগুলো এখুনি এনে শুরু করে দিন। আর পারলে কালকেই ই সি জি আর ব্লাড টেস্ট করিয়ে নিন।

অবস্থা কি সিরিয়াস?

 চিকিৎসা না করালে সিরিয়াস তো বটেই। অনেক আগেই ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল।

উনি ডাক্তার দেখাতেই চান না যে!

 তা বললে তো হবে না। সময়মতো ডাক্তার না দেখালে অবস্থা জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে!

 মাধুরী ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমার তো তেমন কিছু হয়নি ডাক্তারবাবু, শুধু একটু বায়ু হয়ে কেমন যেন লাগছিল।

ডাক্তার একটু হেসে বলল, আপনার কী হয়েছে তা যদি আপনিই বুঝবেন তাহলে তো আমাকে ডাকার দরকারই ছিল না। আপনি এখন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকবেন কয়েকদিন। ফুল রেস্ট।

তাই কি হয়। ওই তো এক ফোঁটা রোগা মেয়েটা আমার। ও কি পারে সংসার সামলাতে?

 কিন্তু আপনি যদি একেবারে বেড রিডন হয়ে পড়েন তাহলে তো ওর ওপর আরও প্রেশার পড়বে। সংসারের কথা যে এখন কিছুদিন আপনার ভাবা চলবে না!

কতদিন শুয়ে থাকতে হবে?

পাঁচ-সাত দিন তো বটেই।

 অসহায় গলায় মাধুরী বলে, কী যে হবে!

দুশো টাকা ভিজিট নিয়ে ডাক্তার চলে গেল। পান্নার দিকে ফিরেও তাকাল না।

পান্না খোঁপা খুলে ফেলল, টিপ তুলে ফেলল, মুখটায় জল দিয়ে পরিষ্কার করল। দুস! রাত্রিবেলা তার রান্না মাছের ঝোল খেয়ে বাবা খুব প্রশংসা করল। বাবারা যেমন করেই থাকে।

 হীরা মুখ বেঁকিয়ে বলল, নুন কম হয়েছে। পানসে স্বাদ।

ভাতটা একটু বেশি সেদ্ধ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু কেউ সে নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না। তবে এসব যে থ্যাঙ্কলেস জব সে বিষয়ে পান্নার কোনও সন্দেহ নেই। বিবাহিত জীবনের স্বপ্ন শত খণ্ড হয়ে এখন তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে।

সকালে খবর পেয়ে এল পারুল।

ছোটমা, তুমি আবার কী বাধিয়ে বসেছ!

আর বসিস না মা, ডাক্তারগুলো পয়সা লোটার জন্য কত কী যে বলে যায়। ডাক্তারি না শিখলে কী হবে, আমাদের বয়স কি আর কম হল, অভিজ্ঞতা বলে একটা জিনিসও তো আছে। আমার শরীর আমি বুঝলুম না, বুঝল কিনা বাইরের ডাক্তার! তাও পাঁচ মিনিটে!

তাই তো! এ যে ভারী অন্যায়। তোমার শরীর নিয়ে ডাক্তারের অত মাথাব্যথা কীসের? সংসারের মুষলপর্বের মধ্যেই যে তুমি ভাল থাক তা কি আর ডাক্তাররা জানে! যাও না, উঠে গিয়ে একটু কেঁকিতে পাড় দিয়ে এসো, না হয় পাহাড়প্রমাণ খার কাঁচতে বসে যাও।

মাধুরী হেসে ফেলে বলে, আর ঠাট্টা করতে হবে না। ওই তো পান্নার ছিরি। কাজকর্ম কোনওদিন করেছে! শুনলুম তো ভাত গলিয়ে ফেলেছে, কঁচা তেলে ডাল ফোড়ন দিয়েছে, আরও কত কী। ও কেন পারবে বল! শেখেওনি তো কিছু।

যা পারে করবে, সবাইকে ওই গলা ভাত আর এই কাঁচা তেলের ডালই খেতে হবে। এখন তো আর বায়নাক্কা চলবে না।

আজ সকালে শরীরটা তো বেশ ঝরঝরেই লাগছে রে! কিন্তু উঠতেই সবাই এমন খা-খা করে তেড়ে এল যে ভয়ে আবার শয্যা নিতে হল। যাই বলিস বাপু, পাঁচ-সাত দিন বিছানায় পড়ে থাকা আমার পোষাবে না। কর্তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না। হীরারও পেট ভরছে না।

পারুল হাসছিল। বলল, আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও ওদের। কদিন না হলে ওখানেই খেয়ে আসুক। মা সেটাই বলে পাঠিয়েছে।

তেমন আতান্তরে পড়লে না হয় যাবে। কিন্তু তা বলে মেয়েরা সংসার সামাল দিতে শিখবে না, এটাই বা কেমন কথা বল! দুদিন পরে যখন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে তখন কী হবে বল তো!

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া মানেই বুঝি উদয়াস্ত সংসারের ঘানি টানা তোমার মতো?

ও মা! ঘানি না টানলে সংসারে কি লক্ষ্মীশ্রী থাকে? কোনটা না দেখলে চলে বল তো! পঁয়তাল্লিশ বছরের ওপর সংসার করছি। আজও মনে হয়, সংসারের কত কিছুই এখনও শিখিনি।

একটা শ্বাস ফেলল পারুল। ছোটমাকে বুঝিয়ে কিছু লাভ নেই। যেমন বুঝিয়ে লাভ হয় না তার মাকেও। পৃথিবী দ্রুত পালটে যাচ্ছে বাইরের দুনিয়ায়। তার ঢেউ এখনও এসে পৌঁছায়নি এখানে। সেদিন কেবল টিভি-তে একটা হিন্দি সিরিয়াল চলছিল। তাতে একটা মেয়ে বোধহয় তার মাকে বলছিল, তোমাদের যুগ চলে গেছে। আমার জীবন নিয়ে আমি কী করব তা আমাকেই ভাবতে দাও। বা ওরকমই কিছু কথা। তার মা বিরক্ত হয়ে বলল, বন্ধ কর তো। ও আর ভাল লাগে না। মেয়েটা একটা স্বামী ছেড়ে আর একটার সঙ্গে লটরপটর করছে। মা ভাল কথা বলতে এসেছে। অমনি লেকচার দিচ্ছে দেখ। টিভিগুলোও হয়েছে আজকাল, উলটো-পালটা শেখাচ্ছে লোককে।

রামহরি গাড়ি ভাড়া করে এনেছে। বর্ধমান নিয়ে যাবে স্ত্রীকে। মুখখানা গম্ভীর। বউ নামক বস্তুটি নিয়েও যে এরকম মাথা ঘামাতে হবে, অপচয় করতে হবে এত টাকা, সময় ও শ্রমের, এটা যেন তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

দেখ তো, কী ঝামেলাই বাধাল তোর ছোটমা!

পারুল হাসল, ঝামেলা বলছ কেন? শরীর থাকলে খারাপও তো হবেই।

ডাক্তার তো স্ট্রোকেরও ভয় দেখিয়ে গেল।

অত ভয় পেয়ো না ছোটকাকা, প্রেশার তো মায়েরও আছে। রেগুলার ওষুধ খেলে কিছু হবে না। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সঙ্গে কে যাচ্ছে?

বিজু, তার সব চেনাজানা আছে বর্ধমানে।

দঙ্গলটা বর্ধমানে রওনা হওয়ার পর পারুল পান্নার দিকে ফিরে বলল, কী রে মুখপুড়ি, খুব নাকি কাজকর্ম করছিস?

আর বোলো না পারুলদি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সংসার যে এরকম বিচ্ছিরি তা তো জানা ছিল না!

দুর পাগল, সংসার বিচ্ছিরি হবে কেন? তুই আসলে ঘাবড়ে গেছিস।

পান্নার চোখ ছলছল করছিল। বলল, হ্যাঁ পারুলদি, ভীষণ ঘাবড়ে গেছি। খুব মন দিয়ে রান্না করলাম, তবু ভাত গলে গেল, ডালে কাঁচা তেলে ফোড়ন দিয়ে ফেললাম। এত করছি তবু মা বকুনি দিচ্ছে।

আচ্ছা, এবেলাটা চালিয়ে নে। রাত থেকে আমাদের ওখানে সবাই খাস। আমাদের তো রান্নার বামুন আছে, প্রবলেম হবে না।

তাহলেই কি মা কথা শোনাতে ছাড়বে? বলবে ধেড়ে মেয়ে বাড়িতে থাকতে ও বাড়িতে সবাই খাচ্ছে, পাঁচ জনে বলবে কী?

যা খুশি বলুক, কান না দিলেই হয়। ছোটমাকে আমি বুঝিয়ে বলবখন। আয়, গল্প করি।

এক গাল হেসে পান্না বলল, তুমি এসে বাঁচালে আমাকে। কাল থেকে এত মন খারাপ লাগছিল! একে মায়ের অসুখ তার ওপর ডাক্তারটা বেরোল বুড়ো।

কে ডাক্তার রে? অনল বাগচী?

হ্যাঁ তো!

ও মা সে বুড়ো হবে কেন? চল্লিশের বেশি তো নয়! তা তার বয়স দিয়ে তোর কী হবে রে মুখপুড়ি?

 কাঁদো কাঁদো হয়ে পান্না বলল, বলব তোমাকে? কাউকে বলে দেবে না তো!

পারুল হাসছিল, প্রেমে পড়েছিলি নাকি?

দেখ না কাণ্ড! পুজোর ভাসানে গিয়ে ঠান্ডা লেগে আমার কীরকম জ্বর হয়েছিল মনে আছে?

তা থাকবে না কেন?

তখন তো ওই অনল বাগচীই দেখতে এল আমাকে।

হ্যাঁ, তা জানি। খুব নামকরা ডাক্তার। বর্ধমান মেডিকেল কলেজে পড়ায়।

হ্যাঁ তো। জ্বরের ঘোরে আমি দেখেছিলাম ভারী সুন্দর দেখতে একটা ছেলে যেন। খুব লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা, গম্ভীর আর কী গমগমে গলা। খুব পারসোনালিটি, দেখে এত ভাল লাগল যে অসুখের মধ্যেও গা সিরসির করছিল।

পারুল হেসে গড়িয়ে পড়ছিল, এত কাণ্ড?

আর বোলো না। আমার তো মনে হয়েছিল যাকে এতকাল মনে মনে খুঁজছি এ-ই সে। একজন ডাক্তারকেই তো আমার বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল, তাই বোধহয় ভগবান ঠিক লোকটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ও মা! কোথায় যাব রে! কী পাগল তুই?

তাই তো বলি। তারপর অনল বাগচী নামটা শুনলেই কেমন যেন শিহরন হতে লাগল। নামটাও কী সুন্দর বলো!

তারপর কী হল?

তারপর আর কী! অসুখ-টসুখও করছে না যে অনল বাগচি আবার আসবে। ভিতরে ভিতরে চাইছি একটা অসুখ-টসুখ কিছু করুক আমার। তাহলে আসবে।

তোর বদলে শেষে অসুখ হল কিনা ছোটমার!

হ্যাঁ। বিশ্বাস করবে না কাল বাবা ডাক্তারকে ডাকতে গেলে আমি একটু সেজেগুজেও গিয়েছিলাম। তারপর যখন ডাক্তার এল তখন এক গাল মাছি। ধুস!

পারুল মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খানিকক্ষণ হেসে নিয়ে বলল, আজ কতদিন পর এত হাসলাম।

পান্না কান্না-হাসি মেশানো মুখে বলল, তুমি তো হাসছ! আমার অবস্থাটা ভাব তো! কত রোমান্টিক চিন্তা করে রেখেছিলাম। মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে গেল এক ঘটি। এত রাগ হচ্ছে লোকটার ওপর।

ওমা! লোকটার দোষ কী বল! সে তো কিছু করেনি!

আহা, করেনি আবার! অত বয়স হওয়ার কী দরকার ছিল লোকটার! আর একটু সুন্দর হলেই বা কী ক্ষতি ছিল বলো! বারেন্দ্র হওয়ারও কোনও দরকার ছিল না।

শুধু বারেন্দ্র? শুধু বয়স? আর কিছু নয় বুঝি রে মুখপুড়ি?

আরও কিছু আছে বুঝি?

নেই! ওর যে মেম বউ!

 জিব কেটে পান্না বলে, ওই যাঃ, বিয়ের কথাটা তত একদম ভুলে গিয়েছিলাম। তাই তো! বিয়ে তো হতেই পারে। জ্বরের ঘোরে সেসব কি আর খেয়াল ছিল? পরেও আর মনে হয়নি কথাটা।

কেন মনে হয়নি?

 মনে হয়েছিল ওকে ভগবান আমার জন্যই পাঠিয়েছে।

 আহা রে! তাহলে বুক ভেঙে গেছে বল!

না সেরকম কিছু তো হচ্ছে না। শুধু রাগ হচ্ছে। লোকটা একদম যাচ্ছেতাই।

 তুইও একটা যাচ্ছেতাই। পছন্দ করতেও সময় লাগে না, নাকচ করতেও না।

আসলে কী জান! বলব?

 বল না।

আমার বড্ড নাক-উঁচু তো। কোনও পুরুষকেই তেমন পছন্দ হয় না। মনটা কেবল খুঁতখুঁত করে। ওর দাঁত উঁচু, এ বেঁটে, সে কেমন ম্যাদামারা, কেউ হয়তো একটু বেশি পুতুল-পুতুল। ঠিক মনের মতো কেউ নয়।

তাই তো রে! তাহলে তো মুশকিল!

ভীষণ মুশকিল। আমার বন্ধুরা তো বলে, তুই যেমন খুঁতখুঁতে, হয় তোর বরই জুটবে না, না হয় তো একটা কালো মোটা ঘেমো জাম্বুবান জুটবে।

ইস! তা কেন? তোর বর আমি খুঁজে দেব।

ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে পান্না বলে, পাবে না। আমি যাকে চাই তাকে আমিই ভাল বুঝতে পারি না। রোজ তার চেহারা পালটে যায়।

এই রে, তাহলে কী হবে?

কাঁচুমাচু হয়ে পান্না বলে, সেটাই তো হয়েছে মুশকিল। আজ একরকম ভাবি কালই যে অন্যরকম হয়ে যায়। চেহারা পালটায়, স্বভাব, চরিত্র, গুণ তাও কি আর এক রকম থাকে? আমার এক সময়ে মনে হত আমার পুরুষটা খুব ভাল রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারবে। তারপর হল কী একদিন বিজুদা বলছিল, পুরুষমানুষ হারমোনিয়াম নিয়ে বসে প্যানপ্যানে রবীন্দ্রসংগীত গায় ও আমার একদম সহ্য হয় না। ব্যস, পরদিন থেকেই আমি রবীন্দ্রসংগীত জানা পুরুষ বাতিল করে দিলাম।

আচ্ছা পাগলি যা হোক। যাকে পাবি তার দোষগুণ নিয়েই তো সেই মানুষটা, একদম মনের মতো কি হয়?

আমার হবে না পারুলদি। আমি বড্ড ন্যাকা।

ভ্যাট, তুই একটুও ন্যাকা নোস। ন্যাকা হলে কখনও অনল বাগচির কথা আমাকে অত সরলভাবে বলতে পারতিস না।

তোমাকে যে আমার সব বলতে ইচ্ছে করে। তোমার যা বুদ্ধি। কী করব বলল তো! মা একটা দিন শুয়েছিল, আমাকে একটু সংসারের কাজ করতে হয়েছে, অমনি আমার মন বিগড়ে বসে আছে। কাল রাত থেকে কেবল ভাবছি বিয়ে করলে আমাকে তো মায়ের মতোই জীবন যাপন করতে হবে! সে আমি পারব না। থাক বাবা দরকার নেই আমার বিয়ের। স্বপ্নের পুরুষ স্বপ্নেই থাক।

বিয়ে করলে একটু স্বপ্নভঙ্গ তো হয়ই। কিন্তু তোর যে বিয়ের আগেই হয়ে বসে আছে।

হবে না! এত কিছু করলুম, তার কারও মন উঠল কি? সংসারটা ভারী অকৃতজ্ঞ। মাও কথাটা বলে।

সে তো বটেই। কিন্তু ছোটমা সেরে উঠলে জিজ্ঞেস করিস তো এই সংসার ছেড়ে যদি তাকে অন্য একটা সুখের জীবন দেওয়া যায়, যেখানে কাজকর্ম করতে হয় না, কারও দায় ঘাড়ে নিতে হয় না, চারদিকে চোখ রাখতে হয় না তাহলে ছোটমার কেমন লাগবে।

কেন পারুলদি, ভালই তো লাগবে।

জিজ্ঞেস করে দেখিস না। এইসব ঝামেলা ঝঞ্ঝাট দায়িত্ব এসব নিয়ে যতই চেঁচামেচি করুক না এই খোঁট ছাড়া ছোটমা এক মুহূর্ত থাকতেও পারবে না। নিজেকে দিয়ে তো বুঝি।

কী বোঝো বলো না পারুলদি, বলো।

 বিয়ের পর মেয়েদের একটা স্বপ্নভঙ্গ হয়। সে তুই এখন ঠিক বুঝবি না। ভীষণ প্রেম-ট্রেম করে বিয়ে করলেও হয়। জীবনটা তো স্বপ্নের মতো নয়। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের পরও দেখবি দিব্যি বেশ আছিস দুজনে। বয়সে ভারভাত্তিক হলে দেখবি কিছু খারাপ লাগছে না। নতুন একটা ইমপেটাস পাওয়া যায়।

কিন্তু আমার কী হবে পারুলদি?

তুই কি আলাদা? ওরকম মনে হয়। তারপর দেখিস তুইও যা আমিও তা।

কিন্তু পারুলদি।

বল।

একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না?

না রে, বল না, এখন বড় হয়ে গেছিস, লজ্জা কীসের?

অমলদার কথাই বলছি, তোমার প্রেমে পড়েছিল তো?

 হদ্দমুদ্দ। বলে হেসে ফেলল পারুল, শুধু অমলদা নয়, আমিও তো।

কীরকম প্রেম ছিল তোমাদের?

গাঁ-দেশে তো আর হাত ধরাধরি করে ঘুরিনি। একটু ভাব হয়েছিল, দুপক্ষের মা বাবারা বিয়েও ঠিক করে ফেলেছিল। অমলদা আমাদের বাড়ি আসত, আমি ওদের বাড়ি যেতাম।

তারপর কী হল?

অমলদা যদি ভালবাসাটাকে গলা টিপে মেরে না ফেলত তাহলে বিয়ে হত। তারপর কী হত জানি না।

তোমার কথা শুনে কী মনে হয় জানো?

কী?

মনে হয় তোমার সেই ভালবাসার স্মৃতিও আর নেই।

একটা শ্বাস ফেলে পারুল বলল, থাকার কথা নাকি?

কিন্তু অমলদার অবস্থা দেখেছ?

কী অবস্থা?

তোমার জন্যই কিন্তু বেচারা একদম সুখী হতে পারল না।

 কে বলল তোকে?

তাই তো মনে হয়। মদ খায়, কেমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে, বউয়ের সঙ্গে নাকি সবসময়ে খিটিমিটি। সোহাগ বলে সব তোমার জন্যই।

বাজে কথা।

তোমার জন্য নয়?

আমি তা জানি না। আমার মনে হয় আমি ওকে বিয়ে করলেও অমলদা এরকমই হত যেমনটা এখন আছে। যা হয়েছে ভালই হয়েছে।

একটু হেসে পান্না বলল, আমারও বিরহটাই ভাল লাগে।

তার মানে?

আই লাইক ট্র্যাজিক এন্ডিং। প্রেম-ট্রেম হয় তোক বাবা, কিন্তু তারপর যেন শরৎচন্দ্রের মতো একটা বেশ সেন্টিমেন্টাল ট্র্যাজেডিও ঘটে যায়। নইলে প্রেমটা একদম আলুসেদ্ধ হয়ে যাবে।

.

৩৯.

জলের পাম্পটা খারাপ হয়েছে কাল থেকে। ছাদের ট্যাংকে জল উঠছে না। বাসন্তীর আজকাল অল্পেই ভারী উদ্বেগ হয়। পাম্প খারাপ হওয়া মানে সুমনের বাথরুমে জল আসবে না। তাহলে কী হবে?

জিজিবুড়ি রোজকার মতোই সকালে তার বরাদ্দ চা খেতে এসে রান্নাঘরে ঘাপটি মেরে বসা, বলল, মরণ! পাম্প খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে রে বাপু? গাঁ-গঞ্জের কটা লোকের ঘরে আবার পাম্পের জল ওঠে লা? ওই ধেড়ে ছেলে নীচে নেমে তো টিপকলেই কাজ সারতে পারে। গতরে তো আর খুঁয়োপোকা ধরেনি বাছা। তুই হেদিয়ে মরছিস কেন?

আহা, ওদের শহরে থেকে অভ্যেস। কিছু যদি মনে করে?

তাহলে আর কী, গলবস্ত্র হয়ে গিয়ে পায়ে পড়। যা আদিখ্যেতা করলি অ্যাদ্দিন সতীন পোকে নিয়ে! বলি কারো পাকা ধানে মই তো দিসনি, অমন চোর-চোর হয়ে থাকিস কেন? সতীন পো তো গতরখানাও নাড়ে না। দিন-রাত ফুলবাবুটি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কত বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবি? পুজোর ছুটি শেষ হয়ে এল, এখনও নড়ার নাম নেই। বলি মতলবখানা কী ওর?

আচ্ছা মা, তোমার মনে এত বিষ কেন বলো তো! এসে আছে দুদিন আমার কাছে, তোমার সহ্য হচ্ছে না কেন? এখানটায় ভাল লাগছে বলেই তো আছে! নাকি! যত্নআত্তি করি যাতে বড়গিন্নির কাছে গিয়ে কুচ্ছো না গায়। একেই তো আমি চক্ষুশূল, সৎমা, অযত্ন করলে রক্ষে আছে?

ওরে ভালমানুষের ঝি, তোর বুদ্ধির বলিহারি যাই। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে কি এমনি? হিসেব-নিকেশ কষছে, বুঝলি? বাঙাল কত টাকা ঢালছে এখানে, সম্পত্তি কত, জমিজমা কত, সব গিয়ে লাগাবে। আমি তোর জায়গায় হলে তেরাত্তির কাটবার আগেই ঝেটিয়ে বিদেয় করতুম। রোখাচোখা না হলে বিষয়সম্পত্তি কেউ রাখতে পারে? বাঙালেরও সাঁট আছে এই বলে দিলুম। একটা ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলছে।

বাসন্তী রাগ করে বলল, তোমার অত কু গাইতে হবে না মা। সুমন কাল বাদে পরশুই চলে যাবে। আজ ওর বাবা আসবে। মাঝখানে শুধু কালকের দিনটা। কটা দিন ছিল, বড্ড মায়া পড়ে গেছে। কাল যাবে বলে মনটা খারাপও লাগছে। আর তুমি এসে সকালবেলাটায় আমার কানে বিষ ঢালছ। দুনিয়ায় কি ভাল জিনিস কিছু তোমার চোখেও পড়ে না!

ভাল হলে ঠিকই চোখে পড়ত। যাক বাবা, বিদেয় হচ্ছে তাহলে? বাঁচলুম।

কিন্তু বাসন্তীর মনটা খচ খচ করছে। শেষে দুটো দিন পাম্পটা খারাপ না হলেই তো পারত। বর্ধমান থেকে মিস্তিরি আনিয়ে পাম্প সারাতে এখনও তিন-চার দিন লাগবে। মুনিশ দিয়ে ওপরের বাথরুমে জল দেওয়ানো হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে বাসন্তী খুশি হচ্ছে না। পাম্পটা যে কেন খারাপ হল!

সুড়ুক সুড়ুক চা খেতে খেতে জিজিবুড়ি যেন তার মনের কথা টের পেয়ে বলল, তা পাম্প সারানো এমনকী হাতিঘোড়া কাজ। ওই শকুনটা তো রোজ এসে চা বিস্কুট খেয়ে যায়। ওকে বলিস না কেন!

কোন শকুনটা! কার কথা বলছ?

কেন, ধীরেন কাষ্ঠ।

ধীরেন খুড়ো! সে কী করবে?

ওই তো একসময়ে কলকবজা সব সারাত। গাঁয়ে কারও কিছু খারাপ হলে সবাই তো ওকেই ডাকত। সেলাই মেশিন রে, টিপকল রে, সাইকেল রে, ধীরেন না সারাত কী? ওকে বল, ঠিক সারিয়ে দেবে। রোজ এসে গুচ্ছের গিলে যাচ্ছে। ঘাড়ে ধরে কাজ করিয়ে নে। তাতে যদি কিছু শোধবোধ হয়।

বাসন্তী অবাক হয়ে বলে, তাই তো? ছেলেবেলায় ধীরেন খুড়োকে যন্ত্রপাতির থলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখতুম বটে! কিন্তু তুমি সেদিন এমন গালমন্দ করলে যে ধীরেন খুড়ো সেই থেকে আর আসে না। লজ্জা পেয়েছে বোধহয়।

আহা, দুকানকাটার আবার লজ্জা! ওর যেদিন লজ্জা হবে সেদিন কাকেরও কোরণ্ড হবে, ধুলায় লুটায়ে যাবে।

কী যে সব বলো না মা!

মরণটাকে পাঠা না ওর কাছে, ধরে নিয়ে আসুক। ছুঁকছুঁকুনি স্বভাব বটে, কিন্তু ধীরেন মিস্তিরি ভাল।

বেলা আটটার মধ্যেই চলে এল ধীরেন কাষ্ঠ।

একগাল হেসে বলল, ডেকে পাঠিয়েছ মা?

বাসন্তী বলল, হ্যাঁ খুড়ো। বড্ড বিপদে পড়েছি। আমাদের পাম্প মেশিনটা খারাপ হয়ে গেছে। দোতলায় জল না উঠলে কী বিপদ বলুন। আজ আবার মরণের বাবাও আসবে।

ধীরেন কাষ্ঠ হাসিটা ধরে রেখেই বলল, পার্টস পুড়ে বা ভেঙে গিয়ে থাকলে নতুন পার্টস লাগবে মা। আর তা না হয়ে থাকলে সারানো কঠিন হবে না।

আপনি বসুন। আগে দুখানা গরম রুটি খেয়ে নিন, তারপর মেশিন দেখবেন।

ধীরেন শশব্যস্তে বলে, তার দরকার নেই মা। সকালে চাট্টি চালভাজা খেয়েছি।

আহা, ভারী তো চালভাজা! রোদে মোড়া পেতে বসুন একটু। ওরে ও মরণ, দাদুকে মোড়াটা পেতে দে বাবা।

আজ রুটিতে বেশ জবজবে ঘি পড়েছে, ঘি গড়াচ্ছে একেবারে। আর মুখে দুখানা বললেও আদতে পাঁচখানা রুটি বেড়ে দিয়েছে বাসন্তী। সঙ্গে ধোঁয়া-ওঠা ফুলকপি আর আলুর তরকারি এক বাটি। কয়েকটা ডুমো ডুমো আলু ভাজা আর কাঁচা লঙ্কা।

একটু ডাল দিই খুড়ো? ফুটন্ত ডাল?

লজ্জা পেয়ে ধীরেন বলে, আবার ডালও দিবি? তা দে একটু। এ যে বেশ গুরুভোজন হয়ে যাচ্ছে রে মা।

খান খুড়ো, আপনাকে খাওয়ালে পুণ্যি হয়। পেট ভরে খান।

তোর মনটা মা, বাঙালের মতোই। বাঙালটাও বড্ড দিলদরিয়া মানুষ। তোদের দুটিতে মিলেছিস বড় ভাল, তা দে মা, ডালও একটু দে, ডালে ভিজলে রুটি নরম হয়।

ডালও নিয়ে এল বাসন্তী। ঘন সোনা মুগের ডাল। বাটিখানা বেশ বড়ই। ডালেও ঘি ভাসছে।

আরও রুটি লাগলে চাইবেন। লজ্জা করবেন না যেন। আর খুড়ো!

হ্যাঁ মা।

আমার মায়ের কথায় কিছু মনে করবেন না যেন। বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে। তার ওপর আফিং খেয়ে খেয়ে মাথাটাই গেছে একেবারে।

ধীরেন একটু করুণ হেসে বলে, কী জানিস মা, তোর মায়ের মতো অমন লক্ষ্মীমন্ত বউ তখন এ গাঁয়ে আর একজনও ছিল না। কী চুলের ঢল, প্রতিমার মতো মুখ, কী হাত পায়ের গড়ন! গেলে যত্নআত্তিও করতেন খুব। সেসব দিন কোথায় চলে গেল বল তো! না মা, তোর মায়ের কথায় কিছু মনে করিনি।

আপনি যেমন রোজ আসতেন তেমন আসবেন। বাড়িতে অতিথি-বিথিতি না এলে কি সে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী থাকে? মরণের বাবাও আপনাকে ভারী পছন্দ করে।

সে আর জানি না! আচ্ছা মা, আসব।

আপনার কথা তো মা-ই বলল আমাকে। বলল, ধীরেন ঠাকুরপোকে খবর দে। ঠাকুরপো সব রকম কল-টল সারাতে পারে।

ধীরেন ভারী আপ্যায়িত হয়ে বলে, তা পারতুম মা, এককালে। বাদ্যযন্ত্র থেকে শুরু করে সব রকম কাজই শিখেছিলুম। চর্চার অভাবে এখন ভুলেও গেছি অনেক। তখন তো আর কেউ পয়সা দিত না, বেগার খেটে খেটে মরতে হত।

না খুড়ো, আমি কিন্তু আপনাকে মজুরি দেব। যা লাগবে বলবেন।

 মজুরি? তোর কাছ থেকে কি নিতে পারি মা? কত যত্নআত্তি করিস! ও তোকে ভাবতে হবে না।

ধীরেন যত্ন করে খেল। কাঁচালঙ্কাটা বড্ড ঝাল। খেয়ে হেঁচকি উঠে গেল। তবু সেটাও শেষ করল ধীরেন। কিছু ফেলল না।

দেখা গেল, এই বুড়ো বয়সেও ধীরেন কাষ্ঠ কাজ জানে বটে। মাত্র আধঘণ্টা কী যেন খুটখাট করল পাম্পঘরে বসে। পাশে বসে খাপ পেতে দেখছিল মরণ। আধঘণ্টা বাদে সুইচ দিতেই পাম্প চলতে শুরু করল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বাসন্তী। পাম্প নিয়ে যে কী উদ্বেগ হচ্ছিল তার বলার নয়।

কুড়িটা টাকা ধীরেন কাষ্ঠর হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখুন খুড়ো। আপনার তো হাতখরচও লাগে।

না, না, তোর কাজ করে কি টাকা নিতে পারি মা? ও তুই রেখে দে।

খুড়ো, পরিশ্রমের দাম দিতে হয়। নইলে ভগবান খুশি হন না। এটা আপনি রাখুন। আমার দরকার পড়লে তো আপনাকেই ডাকতে হবে।

খুব কুণ্ঠার সঙ্গে টাকাটা নিল ধীরেন। বলল, আমার এক গুরু ছিল। তার নাম অনন্ত হালদার। তার কাছে ট্রাক্টর মেশিনের কাজ শিখতুম। সে আমাকে বলত, তুই সব রকম কাজ শিখতে চাস বলে তোর কিছু হয় না। একটা কাজ যদি মন দিয়ে শিখতিস তাহলে কিছু করতে পারতিস। আজ ভাবি, হালদারের পো কিছু খারাপ কথা বলেনি। সব কাজের কাজী হতে গিয়ে আমার সবই ফসকে গেল। তা হ্যাঁ মা, পাম্পসেটটা কিন্তু এবার একটু ওভারহলিং করিয়ে নিস। সার্ভিসিং না হলে মেশিন বসে যাবে। আপাতত চলছে বটে, কিন্তু ভাল করে মাজাঘষা দরকার। বেল্টটাও ঢিলে হয়ে গেছে।

আপনিই করে দিন না খুড়ো! অন্য নোক ডাকব কেন?

বুড়ো শরীরে অতটা কি পারব মা? পরিশ্রমের কাজ।

না খুড়ো, আপনিই করবেন, যা টাকা লাগে দেব।

পার্টস লাগবে কয়েকটা, বাঙাল এলে বর্ধমান থেকে পার্টসও যেন আনিয়ে নিস।

আপনিই করবেন তো!

 দেবোখন করে, তুই যখন ছাড়বিই না।

আমি চাই, আমাদের কাজটাও হোক, আপনারও দুটো পয়সা হোক। বাইরের লোক এসে পয়সা নিয়ে যাবে কেন বলুন।

ধীরেন কাষ্ঠ বিদেয় নেওয়ার পর মরণ দোতলায় উঠে দুটো ঘরেই উঁকি দিল। তাদের ঘরে খাটের ওপর ছোট্ট ফোল্ডিং মশারির নীচে বোনটা ঘুমোচ্ছে। বেচারা খুব ঘুমোয়। বাচ্চাদের নাকি ওই স্বভাব, বোনটা আজকাল তাকে দেখলে হাসে। কোলে আসার জন্য হাতও বাড়ায়। কিন্তু কোলে নিতে ভরসা হয় না মরণের। বড্ড নরম-সরম শরীর। ভয় হয় হাত ফসকে পড়ে যাবে। তবে বোনটিকে ইদানীং বেশ ভালবাসে মরণ। ঘরের মেঝেয় বসে বোনকে পাহারা দিতে দিতে চাল বাচছে মুক্তাদি। আজ রাতে পোলাও হবে বলে শুনেছে মরণ। পোলাও তার খুবই প্রিয় জিনিস।

দ্বিতীয় ঘরটার খোলা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে মরণ দেখল, দাদা এখনও ঘুমোচ্ছে। গায়ে লেপ, মশারি ফেলা। সুমন একটু দেরি করে ওঠে বটে, কিন্তু এত দেরি করে নয় তা বলে, এখন নটা বাজে।

চুপি চুপি চলে আসছিল মরণ, হঠাৎ শুনতে পেল, সুমন খুব কাতর গলায় বলে উঠল, উঃ মা গো!

মরণ ফিরে গেল জানালার কাছে।

দাদা, ও দাদা, তোমার কী হয়েছে? সু

মন ফের একটা অস্ফুট যন্ত্রণার শব্দ করল।

ও দাদা!

উঃ!

তোমার কী হয়েছে?

 লেপের ভিতর থেকে মুখটা বের করে সুমন বলল, ভীষণ শীত করছে। আর বড্ড মাথার যন্ত্রণা।

মাকে ডাকব?

না না, তার দরকার নেই। ঠিক হয়ে যাবে।

 দরজাটা খুলতে পারবে?

হ্যাঁ, দাঁড়া উঠছি।

বেশ কষ্ট করেই উঠল সুমন, বোঝা যাচ্ছিল, সে টলছে। কোনওক্রমে এসে দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, আমি একটু শুয়ে থাকি।

তোমার গা দেখি।

কপালে হাত রাখতেই মরণের হাতে যেন ছ্যাঁকা লাগল, এত গরম।

তোমার তো খুব জ্বর।

আমারও তাই মনে হচ্ছে। শেষ রাত থেকে শীত, মাথা ধরা আর আড়মোড়া হচ্ছিল। বাড়িতে প্যারাসিটামল আছে, জানিস?

কী বললে?

 প্যারাসিটামল, জ্বর কমানোর ওষুধ।

দাঁড়াও, মাকে জিজ্ঞেস করে আসছি।

এক দৌড়ে নেমে এসে সোজা মায়ের কাছে গিয়ে মরণ বলল, মা, দাদার ভীষণ জ্বর, গা পুড়ে যাচ্ছে!

ও মা! সে কী! বাসন্তী তাড়াতাড়ি উনুন থেকে ফোড়নের কড়াই নামিয়ে রেখে একটা গরম জলের হাঁড়ি চাপিয়ে দিয়ে বলল, চল তো দেখি!

কপালে হাত দিয়েই মুখ শুকোল বাসন্তীর।

ও বাবা! তোমার তো ভীষণ জ্বর বাবা।

হ্যাঁ। ভাববেন না, বোধহয় ঠান্ডা লেগে হয়েছে। গতকাল মরণের সঙ্গে পুকুরে স্নান করেছিলাম তো।

 দাঁড়াও, থার্মোমিটার নিয়ে আসি।

জ্বরের কোনও ওষুধ নেই বাড়িতে?

তোমার বাবা কিছু ওষুধপত্র সবসময়েই কিনে রেখে যায় বাড়িতে। কোনটা কীসের তা তো জানি না, বাক্সটা এনে দিচ্ছি, দেখ। কিন্তু আমার মনে হয় ডাক্তার দেখিয়েই ওষুধ খাওয়া ভাল।

ডাক্তার লাগবে না, ঠান্ডা লেগে জ্বর দু-চার দিন ভোগায়।

বাসন্তী মশারিটা খুলে নিল। পুবের জানালা খুলে দিতেই রোদ এল ঘরে।

থার্মোমিটারে জ্বর উঠল একশো চারের কাছাকাছি।

দাঁড়াও বাবা, তোমার মাথা ধোয়াতে হবে। আমি ব্যবস্থা করছি।

আরে না না, অত ঝামেলা করতে হবে না, প্যারাসিটামল খেলাম তো, জ্বর নেমে যাবে।

 ওই ওষুধে জ্বর নামবে, কিন্তু আবার তেড়ে উঠবে। ও মরণ, যা তো, ফার্মাসিতে খবর দিয়ে আয়। ডাক্তার অনল বাগচী এলেই যেন আমাদের বাড়িতে আসে। তোর বাবার নাম লিখিয়ে দিয়ে আসিস। তাহলে গরজ হবে।

মরণ সঙ্গে সঙ্গে ছুটল।

সুমন একটু হেসে বলল, ডাক্তার ডাকার কোনও দরকার ছিল না। সামান্য জ্বর, ঠিক হয়ে যেত।

না বাবা, আজকাল বড্ড তেড়াবাঁকা অসুখ হয়। আগে থেকে সাবধান হওয়া ভাল।

এখানকার ডাক্তার কী রকম? গাঁয়ে তো ভাল ডাক্তার পাওয়া যায় না শুনেছি।

আগে তাই ছিল বাবা। হাতুড়ে চিকিৎসা করত। আজকাল বর্ধমান থেকে ডাক্তাররা আসে। অনল বাগচী শুনেছি ভাল ডাক্তার। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পড়ায়। বিলেত ফেরত।

ওঃ, তাহলে তো ভালই হবে।

হ্যাঁ বাবা। ডাক্তারের খুব নাম। এবার মাথাটা একটু ধুইয়ে দিই? তোমার কোনও কষ্ট হবে না, টেরও পাবে না।

আগে আমি একটু বাথরুম থেকে ঘুরে আসি। তারপর দেখা যাবে।

যাও বাবা। ততক্ষণে বিছানাটা ঝেড়ে দিই।

আপনি কেন করবেন? মুক্তা বা পুটু কাউকে বলুন না।

আমরা ছেলেবেলা থেকে দেখেছি, বাড়িতে কারও অসুখ করলে সেই ঘরে বাড়ির কাজের লোককে ঢুকতে দেওয়া হয় না। একে তো ওরা অত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না। তার ওপর যদি ছোঁয়া লেগে ওদেরও অসুখ করে তবে হয়তো মনে মনে শাপশাপান্ত করবে।

কিন্তু আপনারও তো ইনফেকশন হতে পারে।

আমি তো মা। মায়েদের কিছু হয় না।

কী জানি কেন কথাটা শুনে সুমনের মুখটায় একটা ভারী স্নিগ্ধ হাসি ফুটল। আর কিছু না বলে সে ধীরে ধীরে উঠল। বাথরুমে গেল।

বাসন্তী বিছানা ঝেড়ে, ঘর ঝাঁটপাট দিয়ে, চোখের পলকে সব ফিটফাট করে ফেলল। এক বালতি জলে জোরালো ফিনাইল ফেলে ঘরটা মুছেও দিল তাড়াতাড়ি। গরিব ঘরের মেয়ে বলেই সে এসব কজে যে কোনও কাজের লোকের চেয়ে অনেক বেশি পাকা।

বাথরুম থেকে অনেকক্ষণ বাদে যখন বেরোল সুমন তখন সে টলছে, হাফাচ্ছে। চোখ দুটোও লাল। বাসন্তী তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল। গায়ে লেপ চাপা দিয়ে বলল, দাঁড়াও, হট ওয়াটার ব্যাগ এনে দিচ্ছি।

না না, অত কিছু লাগবে না।

ঠান্ডা জলে মাথা ধোয়ানোর সময় তোমার শীত করবে। তখন হট ওয়াটার ব্যাগটা থাকলে আরাম লাগবে। কোনও ঝামেলা হবে না বাবা, জল আমি উনুনে চাপিয়েই এসেছি।

তার কপালে একটা অডিকোলোন মাখানো জলপট্টি লাগিয়ে বাসন্তী নীচে গেল।

সুমন চেয়ে দেখল খুব কৌশল করে উত্তরের জানালা বন্ধ রেখে পুবের জানালা খুলে দিয়েছে মরণের মা। ঘরটা ঝলমল করছে আলোয়।

প্যারাসিটামল তার ক্রিয়া শুরু করেছে। টের পেল সুমন। শরীরটা গরম হচ্ছে। জ্বরের ঘোর ভাবটা পাতলা হচ্ছে।

বাসন্তী এক কাপ চা নিয়ে এল। বলল, শোনো বাবা, এখন ওষুধ খেয়ে তোমার জ্বর নামছে। এখন তোমার মাথাটা তাহলে ধোয়াব না। দুপুরে ফের যখন জ্বর আসবে তখন আর ওষুধটা খেও না। ওই ওষুধ নাকি বেশি খেতে নেই। দুপুরে মাথা ধুইয়ে গা স্পঞ্জ করে দেব।

আপনাকে ভীষণ মুশকিলে ফেললাম।

ছিঃ বাবা। ওরকম কথা বলতে নেই। আমি তোমাকে কখনও দূরের মানুষ ভাবিনি। তুমি কেন ভাববে?

না, আসলে, হঠাৎ কেন জ্বরটা যে হল!

জ্বর হয়েছে তো কী হয়েছে? এটা তোমার নিজেরই বাড়ি।

চা-টা মুখে দিয়ে দেখল সুমন। বিটনুন লেবু চিনি দিয়ে করা। চমৎকার স্বাদ। সবটুকু নিঃশেষে খেয়ে নিল।

গরম রুটি আর তরকারি নিয়ে আসছি।

আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না যে!

বেশি খেও না। একটা বা দুটো, আমার রান্না তোমার পছন্দ হয় তো।

সুমন হেসে ঘাড় কাত করল, হ্যাঁ খুব ভাল।

শুনেছি তুমি ধনেপাতা ভালবাসো। আজ ফুলকপিতে ধনেপাতা আর কড়াইশুঁটি দিয়েছি। কলকাতায় সারা বছর সব কিছু পাওয়া যায়। গাঁয়ে তো তা নয়। ধনেপাতা এখন বাজারে ওঠে না। তোমার বাবা ভালবাসেন বলে আমি বাগানে ধনেপাতা লাগাই।

আমার কলকাতায় যাওয়ার খুব দরকার।

 যাবে, জ্বরটা কমলেই যাবে।

হাঁফাতে হাঁফাতে মরণ এসে বলল, খবর দিয়ে এসেছি মা। ডাক্তার আজ তাড়াতাড়ি আসবে। এলেই পাঠিয়ে দেবে পানুকাকু।

আচ্ছা, এখন দাদার কাছে বসে থাক। বেশি বকবক করবি না। জলপট্টিটা মাঝে মাঝে পালটে দিস। বাটিতে অডিকোলন মেশানো জল আছে। আমার উনুন জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, আপনি আসুন।

এখন তোমার কেমন লাগছে দাদা?

একটু ভাল, প্যারাসিটামল খেয়েছি তো, জ্বর কমে যাচ্ছে। এফেক্ট কেটে গেলে আবার জ্বর আসবে।

সুমনের বালিশের নীচে একটা চিঠি আছে। কালকেই কেউ চিঠিটা তার বিছানায় ফেলে গেছে। যে চিঠি দিয়েছে তাকে চেনে না সুমন। নাম শুভশ্রী। আজকাল গাঁয়ের মেয়েদেরও বেশ সুন্দর সুন্দর নাম রাখার রেওয়াজ হয়েছে। চিঠিটা সংক্ষেপে এরকম : আপনাকে আমার ভীষণ ভাল লাগে। খুব আলাপ করতে ইচ্ছে হয়, আবার ভয়ও করে। যদি কিছু মনে করেন। আমার বয়স সতেরো। মাধ্যমিক পাস করেছি। একটু গাইতেও পারি। আমার সঙ্গে ভাব করতে রাজি? যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনার পুব দিকের জানালায় একটা সাদা রুমাল বেঁধে রাখবেন কাল বিকেলে। প্লিজ, বাঁধবেন কিন্তু।

হ্যাঁ রে, শুভশ্রী বলে কোনও মেয়েকে চিনিস?

 শুভশ্রী?

হ্যাঁ।

না তো! মনে পড়ছে না।

ভাল করে ভেবে দেখ।

মরণ ভাবল। মাথা নেড়ে বলল, নামটা শুনিনি তো, কেন দাদা?

এমনিই।

পদবি কী বলো তো!

জানি না।

তাহলে বলতে পারছি না। কেমন দেখতে?

 তা কে জানে! শাকচুন্নির মতোই হবে হয়তো।

যাঃ! বলে হেসে ফেলে মরণ, শাকচুন্নি কি দেখতে খারাপ?

না হলে শাকচুন্নি বলবে কেন?

 হ্যাঁ দাদা, শাকচুন্নি কাদের বলে? যারা শাক তোলে তাদের?

তাও হতে পারে। এ গাঁয়ের তুই সবাইকে চিনিস?

বাঃ, চিনব না?

এই তো শুভশ্রীকে চিনতে পারলি না!

হয়তো ভাল নামটা জানি না, ডাকনামে ঠিক চিনব।

হুঁ, সেটা একটা কথা বটে।

মাকে জিজ্ঞেস করে আসব?

ভ্যাট। ওসব জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।

আচ্ছা।

.

৪০.

সারা রাত কেউ তার শিয়রের কাছে বসে আছে, মাথায় সুগন্ধী জলপট্টি দিচ্ছে এবং ডেকে তুলে ক্যাপসুল খাওয়াচ্ছে ঘড়ি ধরে, এ জিনিস সুমন কখনও ভাবতে পারে না। তার নিজের মা অন্তত করে না। মাকে দোষ দেওয়া যায় না। মা নানা রকম অসুখ-বিসুখে বারো মাস ভোগে। সুমনেরও তেমন অসুখ-বিসুখ করে না কখনও। কয়েক বছর আগে জলবসন্ত হয়েছিল। তখন একজন আয়া রাখা হয়েছিল তার জন্য।

সুমন অস্বস্তি বোধ করে বলল, আপনি কেন এভাবে আমার কাছে বসে আছেন? আমি তো বেশ আছি।

বাসন্তী বলে, একটু আগেও তোমার জ্বর একশো চারের ওপর ছিল, তা জানো বাবা? আগে রুগি ঘুমোলে ওষুধ খাওয়ানো বারণ ছিল। ঘুমন্ত রুগিকে নাকি ডাকতে নেই। কিন্তু এখনকার ডাক্তাররা তো অন্যরকম। অনল বাগচী বলে গেছে ঠিক ছয় ঘণ্টা পর পর ক্যাপসুল খাওয়াতে। একবারও নাকি বাদ দেওয়া যাবে না।

আচ্ছা, সে না হয় আমিই খেয়ে নেব। আমার তো তেমন ঘুম হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই জেগে যাচ্ছি।

তা হয় না বাবা। ও-ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলেই কি আর আমার ঘুম হবে? দুশ্চিন্তা রয়েছেনা মাথায়! তোমার মা কাছে থাকলে আরও কত করত! আমি কি আর অত পারি?

সুমন হাল ছেড়ে দিল। এই মহিলার সঙ্গে সে পেরে উঠবে না।

রাত আড়াইটের সময় একবার রসিক উঠে এসেছিল। ক্যামন বুঝত্যাছ? জ্বরটা কি কমের দিকে?

না। জ্বর তো বাড়ছে দেখছি। জলপট্টি দিয়ে দিয়ে একটু যেন কমছে মনে হচ্ছে। মাথাটা একবার ধুইয়ে দিলে হত।

এই শীতের মইধ্যে? কাল ঠান্ডা পড়ছে, মাথা বোয়াইলে যদি হিতে বিপরীত হয়?

 হবে না। মাথা ধোয়ালে জ্বরটা নামবে।

প্রবল আপত্তি তুলেছিল সুমন, না না, এত রাতে মাথা ধোয়ানোর দরকার নেই।

 বাসন্তী বারণ শুনল না। বরং সুমনকে এই প্রথম একটা ছোট্ট ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে, একদম চুপ করে থাকবে। লক্ষ্মী ছেলের মতো যা বলছি সব শুনতে হবে। বুঝেছ? তোমার ভালমন্দের দায় এখন আমার।

অগত্যা রসিক বালতি করে জল নিয়ে এল। বাসন্তী অনেকক্ষণ ধরে হিম-ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দিতে লাগল তার। আরামে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুমন খেয়ালই নেই। মাথা ধোয়ানোর সময় হাতপাখা দিয়ে হাপুর-হুপুর মাথায় বাতাস করছিল তার বাবা। যে বাবাকে কখনও সে ছেলেপুলের সেবা-টেবা করতে দেখেনি।

সুমন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, হাতপাখার বাতাস কেন? সিলিং পাখা চালিয়ে নিলেই তো হয়।

বাসন্তী মাথা নেড়ে বলল, হয় না। সিলিং পাখার বাতাস বুকে লাগবে। এ সময়ে শুধু মাথায় বাতাস দেওয়ার নিয়ম। চুপ করে শুয়ে থাকো।

মাথা ধোয়ানোর পর শুকনো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুখ মুছিয়ে বালিশে শুইয়ে থার্মোমিটার দেখে বাসন্তী বলল, তিন ডিগ্রি নেমে গেছে।

মুর্গির স্টু, শিং-মাগুরের সুরুয়া, ফলের রস কোনও আয়োজনই বাকি রাখেনি বাসন্তী।

রসিক একবার ভয় খেয়ে বলল, আরে, তুমি শুরু করছ কী? এত খাইলে পেট ছাইড়া দিব না?

কিচ্ছু হবে না। ডাক্তার বলে গেছে জোর করে খাওয়াতে। নইলে দুর্বল হয়ে পড়বে। আগেকার দিনে খেতে দিত না বলেই রুগি দুর্বল হয়ে পড়ত।

প্রথমে টাইফয়েড বলে সন্দেহ করলেও ব্লাড রিপোর্ট দেখে ডাক্তার অনল বাগচী বলল, ভয়ের কিছু নেই। ভাইরাল ফিবার।

চার দিনের দিন সকালে জ্বর নেমে গেল।

জ্বর যখন নেমে যাচ্ছিল, তখন সুমন খুব অস্থির বোধ করে ঘুম ভেঙে শিয়রে বাসন্তীকে খুঁজেছিল। সে সময়ে বাসন্তী ছিল না। ভারী অসহায় লেগেছিল সুমনের। জলতেষ্টা পাচ্ছিল, মাথাটা কেমন করছিল আর শরীরে যেন হাজার মাইল দৌড়ের পর নিঝুম ক্লান্তি। তার মনে হচ্ছিল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। চোখ যখন সত্যিই অন্ধকার হয়ে আসছে সে তখন বাচ্চা ছেলের মতো ক্ষীণ কণ্ঠে ডেকে উঠেছিল, মা! মা! কোথায় আপনি?

অত ক্ষীণ কণ্ঠ পাশের ঘর থেকে শোনার কথা নয় বাসন্তীর। তবু শুনতে পেল ঠিকই।

 এক ছুটে চলে এল সুমনের কাছে, বাসন্তীর কোলে হাম্মি। কী হয়েছে বাবা? কী হয়েছে?

 শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।

বাসন্তী গায়ে হাত দিয়েই বলল, জ্বর নেমে গেছে যে! ইস, অত হাই টেম্পারেচার এক লাফে নেমে যাওয়ায় এরকম হচ্ছে। দাঁড়াও বাবা, হট ওয়াটার ব্যাগ দিচ্ছি।

আপনি একটু কাছে থাকুন। আমার ভীষণ অস্থির করছে।

হ্যাঁ বাবা, আমি তো কাছেই আছি।

হট ওয়াটার ব্যাগ, পাখার বাতাস আরও কীসব করল বাসন্তী কে জানে। কয়েক মিনিট বাদে অস্থিরতা কমে গেল সুমনের। শরীর এত দুর্বল যে চোখ খুলতে পর্যন্ত পরিশ্রম হচ্ছে। সে শুনেছে খুব বেশি টেম্পারেচার হঠাৎ নেমে এলে রুগি হার্টফেলও করে অনেক সময়ে। অন্তত আগের দিনে করত।

বাসন্তীর দিকে কৃতজ্ঞ চোখে একবার চেয়ে সে গভীর ক্লান্তিতে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে চোখ চেয়ে দেখল, পুবের রোদে ভেসে যাচ্ছে ঘর। চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। তার চেয়ে বেশি ঝলমল করছে তার শিয়রে বসে থাকা বাসন্তীর মুখ।

কেমন লাগছে বাবা? আমার জ্বর বোধহয় রেমিশন হয়ে গেছে, না?

হ্যাঁ বাবা। জ্বর নেই, গা একদম ঠান্ডা।

সুমন লজ্জার হাসি হেসে বলল, আপনাকে খুব জ্বালিয়েছি।

ওটুকু যে দরকার ছিল বাবা। না জ্বালালে কি মাকে চেনা যায়?

সুমন চুপ করে রইল। নিজের মাকে সে ভীষণ ভালবাসে। তেমন সে আর কাউকেই কখনও ভালবাসতে পারবে না। ঠিক কথা। তবু এই অদ্ভুত ভদ্রমহিলা সেই ভালবাসায় অনেকটা ভাগ বসিয়েছেন। একে তার মা বলেই ভাবতে ইচ্ছে করছে। এমনকী তার কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে একটু যেন কষ্টই হচ্ছে।

আমি একটু রোদে বসব!

 বসবে বইকী বাবা, দাঁড়াও, জানালার ধারে ইজিচেয়ার পেতে দিচ্ছি।

না না, ঘরে নয়। উঠোনে গিয়ে বসব।

 ওমা! এই দুর্বল শরীরে সিঁড়ি ভাঙতে পারবে নাকি? মাথাটাথা ঘুরে যায় যদি?

 পারব। ধরে ধরে নামলেই হবে।

আচ্ছা, তোমার বাবা বরং ধরে ধরে নামিয়ে নেবে।

শরীর যে কতটা দুর্বল তা সিঁড়ি ভেঙে নামবার সময় টের পাচ্ছিল সুমন। তার বাবা শক্তিমান মানুষ। শক্ত কেঠো হাতে ধরে সাবধানে নামাতে নামাতে বলছিল, পাতলা হইয়া গেছস, এক্কেরে পাতলা হইয়া গেছস!

উঠোনে খাটিয়া পেতে, তোশক বালিশ দিয়ে একেবারে রাজশয্যা রচনা করে রেখেছে বাসন্তী। শরীরটা রোদে আর মাথাটা যাতে ছায়ায় থাকে তারও ব্যবস্থা করেছে। সে শুতেই গলা পর্যন্ত একটা পাতলা কম্বলে ঢেকে দিয়ে বাসন্তী বলল, উত্তুরে বাতাস দিচ্ছে, হুট করে দুর্বল শরীরে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। কিছুক্ষণ গায়ে ঢাকাটা থাক। শরীর গরম হলে ঢাকাটা সরিয়ে দিও।

চার দিন পর ঘর থেকে বেরিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল সুমন। উলটো দিকেই উঠোনের এক প্রান্তে একটা প্রকাণ্ড ঝুপসি নিমগাছ। তাতে সকালে রাজ্যের পাখিদের ডাকাডাকি। এখনও ফটকের পাশে শিউলি গাছটায় কেঁপে ফুল আসে। তলাকার ঘাসজমিতে সাদা-কমলা ফুলের যেন একখানা কার্পেট বিছানো রয়েছে। গোটা কুড়ি-পঁচিশ নারকোল গাছ উত্তুরে হাওয়ার ঝাপটা লেগে সাঁই সাঁই শব্দ তুলছে। মুনিশরা খাচ্ছে বারান্দায় বসে। পান্তা আর বাসি তরকারি, তেঁতুল আর লঙ্কা দিয়ে। উঠোনে নেচে বেড়াচ্ছে চড়ুই, শালিক। এই সামান্য দৃশ্যই যেন চোখ ভরিয়ে দিল সুমনের।

সোয়েটার আর কানঢাকা টুপিতে ঝুল্লুস হাম্মিকে উঠোনে ছেড়ে দিল মুক্তা। হাম্মি হামা দিয়ে সোজা এসে সুমনের খাটিয়া ধরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল সুমনের দিকে। তারপর হাত বাড়িয়ে যা যা যা যা করে কী যেন বলার চেষ্টা করতে লাগল।

দুহাতে হাম্মির মুখটা ধরে আদর করল সুমন। কদিনেই বোনটা তার ভারী ন্যাওটা হয়েছে। ইদানীং মায়ের কোল থেকেও ঝাঁপ খেয়ে তার কোলে চলে আসে। ওর গায়ে মুখে আশ্চর্য শৈশবের স্বর্গীয় গন্ধ! কী নরম তুলতুলে শরীর। তারা দুই ভাইবোন কাছাকাছি বয়সের বলে বড় হয়ে সুমন চটকানোর মতো কোনও শিশুকে পায়নি। এখন হাম্মির জন্য আর একটা মায়া তৈরি হয়ে রইল এখানে।

মায়া আর একটাও আছে। সে হল পান্না। জ্বরের ঘোরের মধ্যেও পান্নার মুখ বারবার হানা দিয়েছে মনের মধ্যে। এই সকালের বাতাসেও তো তার দেহস্পর্শ! ভাবলে গা শিউরে ওঠে।

রান্নাঘরে খদ্দরের চাদরে মুড়িসুড়ি দিয়ে উনুনের ধারে বসে দুধ-চা খাচ্ছিল জিজিবুড়ি।

গজগজ করতে করতে বলল, আদিখ্যেতা দেখালি বটে বাবা! বলি গু মুতও কাচলি নাকি ওই ধেড়ে ছেলের।

বাসন্তীর মনটা বড় ভাল আছে কদিন। কান ভরে সুমনের গালভরা মা ডাক শুনেছে। বুক ঠান্ডা। বলল, দরকার হলে কাচতাম। দরকার পড়েনি তাই।

ওঃ, একেবারে নবদ্বীপের গোঁসাই এয়েছেন যেন। একটু গা গরম হয়েছে কি হয়নি অমনই একেবারে অনল ডাক্তার এসে হাজির। অমন ভালুক জ্বর তো আমাদেরও কতই হয় বাপু, কোথায় ডাক্তার, কোথায় বদ্যি! কাঁথামুড়ি দিয়ে পড়ে থাকলেই হয়।

খর চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বাসন্তী বলল, থলিতে বিষ জমেছে, না মা? রোজ এসে এই সকালবেলাটায় তুমি আমার মেজাজ বিগড়ে দিয়ে যাও।

তা বাছা, ভাল কথা বললে বাঁকা করে ধরিস কেন? সংসারের তো একটা রীতি আছে, নাকি? সতীনপো হল সতীনপো, সাপের বাচ্চা, যতই দুধ কলা দিয়ে পুষিস না কেন, ছোবল দিতে ছাড়বে ভেবেছিস?

সে যদি দেয় তো দেবে। কপালে যা আছে তা কি খণ্ডানো যায়? গাল ভরে মা বলে তো ডেকেছে। সে-ই আমার ঢের।

তবে আর কী, পিটুলিগোলা খেয়ে দুধ খেয়েছি বলে নেত্য করগে। বলি দিনরাত অত লোক দেখানো সেবা দেওয়ার কী দরকারটা ছিল? ঠান্ডা লেগে একটু গা গরম হয়েছে বৈ তো নয়। তার মতো হ্যাঁবাকান্ত দেখিনি বাপু। অমন ভালমানুষি করলে দুনিয়ার সবাই তোর মাথায় হাত বুলিয়ে নেবে। এখন থেকে শক্ত হ।

তোমাকে আর হিতোপদেশ দিতে হবে না মা। আমি যা ভাল বুঝেছি করেছি।

গেলাসটা বাড়িয়ে জিজিবুড়ি বলল, দে তো গরম দুধে একটু লিকার ফেলে। যা ঠান্ডা পড়েছে, তেমন জুত হচ্ছে না যেন।

গরম দুধের হাঁড়ি থেকে হাতা দিয়ে গেলাসে দুধ দিতে দিতে বাসন্তী বলে, আফিং-এর মাত্রা বাড়িয়েছ নাকি?

না বাড়িয়ে উপায় আছে? পেটটা ছেড়ে দিচ্ছে যে মাঝে মাঝে। এত আফিমের জোগানই বা আসবে কোত্থেকে।

তোমাকে আফিং ধরিয়েছিল কে?

কে আবার ধরাবে। নন্দ কোবরেজই ধরিয়েছিল। একটা সময়ে পেটের এমন ব্যামো হয়েছিল যে ওষুধে ধরে না। বোতল বোতল পাঁচন খেয়ে নলি-খলি পায়খানা। তা নন্দ কোবরেজ তখন আফিং ঠুসে দিয়ে বলল, এ হল মোক্ষম দাওয়াই। তখন কি আর জানতুম শেষে একটু আফিং-এর জন্য এমন হেদিয়ে মরতে হবে! সে আমলে কি আর চিকিৎসা ছিল মা?

দুধটুকু খেয়ে জিজিবুড়ি উঠল। বলল, ছেলে এসে সব দেখে-টেখে গেল। এবার মেয়ে আসবে। তারপর বড়বউ এসে হাজির হবে। তখন কী করবি ভেবে রেখেছিস?

অবাক হয়ে বাসন্তী বলল, ভাবাভাবির কী আছে? এলে আসবে। তারা তো আর ফ্যালনা নয়।

তারা ফ্যালনা নয় সে জানি। কিন্তু ফ্যালনা যে তুই।

তার মানে?

ভগবান তো তোকে বুদ্ধিসুদ্ধি দেননি, তাই বোকার মতো বলিস। বলি বড়বউ যদি এসে গেড়ে বসে আর তোকে দাসীবাঁদীর মতো খাটায় তাহলে তোর দশা কী হবে জানিস?

দাসীবাঁদীর মতো খাটাবে!

তুই তো দাসীবাঁদী হওয়ার জন্য মুখিয়ে আছিস। ছেলের জন্য যা করলি তা তো দেখলুম। বড়গিন্নি এলে তো তোর আঁচলে পা মুছবে। এখন থেকে একটু মাথা খাটিয়ে চল। ওরা সব বাঙাল দেশের মানুষ, তুই ডালে ডালে চলিস তো ওরা চলে পাতায় পাতায়। তোর অত আদিখ্যেতার দরকার কী? নিজেরটা নিয়ে থাকবি। পারিস তো জমিজমা কিছু আমার বা ভাইদের নামে বেনামী করে দে। তাহলে আর গাপ করতে পারবে না।

বেনামী করব? কেন বলো তো!

তুই যা বোকা, কোথায় কোন কাগজে সইসাবুদ করিয়ে নেবে তার ঠিক কী? আমাদের নামে থাকলে তোরই থাকল, ওরাও দাঁত বসাতে পারবে না।

বাসন্তী গম্ভীর হয়ে বলল, তাই বুঝি তোমাদের নামে লিখে দিতে হবে! বেশ বললে তো মা, পালিশ করা কথা।

ভাল কথা তো আজকাল তোর সয় না। তোকে যে গুণ করে রেখেছে। যখন সব যাবে তখন এ কথার মর্ম বুঝবি।

মর্ম বুঝে আর কাজ নেই মা। তোমার ছেলেরা যে সাঁট করে তোমাকে পাঠায় সে আমি জানি। বলি আমার ভালটা তোমার কাছে এমন বিষ হয়ে গেল কেন বলো তো! আমাকে কি পেটে ধরোনি, নাকি?

খারাপ বলেছি কিছু? সবটা তো আর দিতে বলিনি। বললুম, অদিনের জন্য কিছু জমিজমা বেনামী করে রাখ, বিষয়ী লোকেরা তো তাই করে।

আমার আর বিষয়ী হয়ে কাজ নেই। তুমি এবার এসে গিয়ে।

যাচ্ছি বাছা যাচ্ছি, তাড়াতে পারলে যেন বাঁচিস। একটু উঁকি মেরে দেখ, বাঙাল আবার এধারে আছে কিনা, দেখলে তো তার আবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়বে।

সে এখন কাককে রুটি খাওয়াচ্ছে।

 জিজিবুড়ি বিদেয় হওয়ার পর বাসন্তী হাঁফ ছাড়ল। রোজ সকালে মা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ যেন একটা ভয় ঘিরে থাকে তাকে। পৃথিবীকে সে যখন নিজের মতো করে বুঝে নিতে চায় তখনই জিজিবুড়ি এসে তাকে উলটো কথা শেখায়।

রান্নাঘরের পাশ দিয়ে এক চিলতে একটা গলি। কচুপাতার আড়াল দিয়ে জিজিবুড়ি বেরিয়ে এসে পিছন দিয়ে মরণের পড়ার ঘরে উঁকি দিল।

মরণ এক রাগী মাস্টারের কাছে পড়ে আজকাল।

 ও মরণ।

মরণ অঙ্ক কষতে কষতে মুখ তুলে বলল, কী বলছ?

 বলি সব ঠিক আছে তো!

হ্যাঁ।

কখন দিবি দাদা?

 তুমি যাও না, আমি ঠিক দিয়ে আসব।

বাঁচালি দাদা। জিনিসটা এসেছে তো!

তা জানি না। খুঁজে দেখবখন।

কেউ যেন টের না পায়।

 তুমি যাও না, কেউ টের পাবে না।

জিজিবুড়ি জানালা থেকে অদৃশ্য হল।

বুড়ো-বুড়িদের প্রতি এক ধরনের মায়া আছে মরণের। বুড়ো বুড়িদের কাছে গল্পের ঝুলি থাকে। কাছে বসলেই কত কথা শোনা যায়। জিজিবুড়িকে সবাই হ্যাঁক-ছিঃ করে বটে, কিন্তু মানুষটাকে মরণ তেমন অপছন্দ করতে পারে না। তার অসুখ-বিসুখ হলে জিজিবুড়ি হামলে এসে পড়ে। মায়ের সঙ্গে যখন ঝগড়া করে দু-চারদিন আর এমুখো হয় না তখনও মাঠেঘাটে যেখানে তোক জিজিবুড়ি গিয়ে তার খোঁজখবর নেয়।

কয়েকদিন আগে জিজিবুড়ি ভারী কাঁচুমাচু হয়ে এসে তাকে ধরে পড়েছিল। ও দাদা মরণ, আমাকে বাঁচাবি ভাই?

কেন, তোমার আবার কী হল?

আফিং ছাড়া যে আর বাঁচি না দাদা। আর দু-চারদিন হয়তো চলবে। তারপর আফিং না জুটলে যে পেট ছেড়ে দেবে দাদা। আর বাঁচার উপায় নেই।

আফিং! কিন্তু আমি আফিং কোথায় পাব?

সে কথাই তো বলতে আসা। তোর মা তোর বাপকে কলকাতা যাওয়ার সময় একটা ফর্দ ধরিয়ে দেয় ফি হপ্তায়। তাতে একটু লিখে দিবি আফিং-এর কথা?

মাকে বলো না লিখে দিতে।

সে লিখবে না দাদা, আমাকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। তুই একটু চুরি করে লিখে দে।

 বাবা টের পেলে পিঠের ছাল তুলে ফেলবে।

তোর মাকে আমি বুঝিয়ে বলে রাখবখন। সে যদি বলে সে-ই লিখেছে তাহলে বাঙাল মোটেই রাগ করবে না। লিখবি ভাই? প্রাণটা তাহলে আমার বাঁচে।

না জিজিবুড়ি, মা ভীষণ বকবে।

বকলে আমাকে বকবে, তোকে তো আর নয়। আমি তোর মাকে বুঝিয়ে বলবখন।

কাজটা খুব কঠিন ছিল না। মা ফর্দ করে টেবিলের ওপর পাউডারের কৌটো চাপা দিয়ে রাখে। ফর্দের শেষে মায়ের হাতের লেখা নকল করে মরণ লিখে দিয়েছিল, আফিং–দুই ভরি।

বাবা ফর্দমতো জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। শোয়ার ঘরে ব্যাগ ভর্তি জিনিস রাখা আছে। কিন্তু সেই গন্ধমাদন হাঁটকানোর সময় বা ইচ্ছে হয়নি মরণের। মা ঠিক বের করে দেবে।

মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর বইপত্র গুছিয়ে রাখছিল মরণ। বাবা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ সে লক্ষ্মী ছেলে। নইলে এতক্ষণে দুই লক্ষে কাঁহা কাঁহা মুলুক চলে যেত!

বইপত্র গুছিয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েই থমকে গেল মরণ। তার বাবা কাককে রুটি খাইয়ে ফিরছে। ঠিক সেই সময়ে দাদাকে ফলের রস দিতে উঠোনে বেরিয়ে এসেছে মা।

বাবা হঠাৎ তার মায়ের দিকে চেয়ে বলল, আগো, আফিং কার লিগ্যা আনতে দিছিলা? ঠাইরেনের লিগ্যা নাকি?

মরণ শিউরে উঠে ঘরের মধ্যে ফের সেঁদিয়ে এল।

 বাসন্তী অবাক হয়ে বলে, আফিং! আফিং-এর কথা আবার তোমাকে কখন বললাম?

মনে নাই? তাজ্জব মাইয়ালোক! ফর্দের মইধ্যেই তো লেখা আছিল, আফিং দুই ভরি।

ও মা গো! দেখি ফর্দটা!

ব্যাগের মইধ্যেই আছে। ক্যান, তুমি লেখ নাই?

 হঠাৎ বোধহয় বাসন্তীর কাণ্ডজ্ঞান মাথাচাড়া দিল। সুমনের হাতে রসের গেলাসটা দিয়ে বলল, দাঁড়াও ভেবে দেখি। এই ছেলের অসুখ নিয়ে আমার মাথা এত গরম যে কিছু মনে থাকছে না।

তাই কও। আমি তো ভাবলাম ভূতে লেখল নাকি। যাউক গা, আফিং আনছি৷ ঠাইরেনরে পাঠাইয়া দিও।

ঠিক আছে।

মরণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক সময়ে মা ব্রেক না কষলে তার কপালে বিস্তর দুঃখ ছিল। জিজিবুড়িটা মহা পাজি। মাকে বলে রাখার কথা ছিল, কিন্তু রাখেনি।

মায়ের বকাঝকা বা মারধর তেমন গ্রাহ্য করে না মরণ। মায়ের হাতে মোটেই জোর নেই, মারলে লাগেও না। আর বকুনি তো অহরহ হচ্ছে, নতুন কিছু নয়।

সে গিয়ে চুপ করে দাদার কাছটিতে বসল।

 সুমন মুখটা করুণ করে বলল, খুব রোগা হয়ে গেছি, না রে?

না তো! একটু ফর্সা দেখাচ্ছে।

 ফর্সা নয়, ফ্যাকাশে। খুব দুর্বল।

আমারও খুব জ্বর হয়। আর পেট ছাড়ে।

 বলে হি-হি করে হাসল মরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *