ষড়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
মসজিদের ভিতর লোকে লোকারণ্য। মিস্টার আবু হাছানের আজ এমদাদ মিঞার সর্বগুণালঙ্কৃতা কন্যা আমেনার সহিত বিবাহ।
আবদার রহমান বরের কাছেই বসিয়াছিলেন।
এক বিপদ উপস্থিত হইয়াছে মৌলবী এমদাদ সাহেব ও তাহার স্ত্রী আমেনাকে কবুল’ বলাইতে পারিতেছেন না। কত রকমের বুঝান হইতেছে। জাতি যাইবার ভয় দেখান হইতেছে কিছুতেই আমেনা বলিবে না–“বিবাহের রাজি আছি।”
পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের মতো লজ্জা ও শরমে সে নিজের গলায় নিজে ছুরি দিয়া ভদ্রতার পরিচয় দিতেছিল না সে রানীর মতো নিজের দাবি বুঝিয়া লইবার জন্য কঠিনভাবে বলিতেছিল ”একে বিবাহ করিতে আমি রাজী নহি।”
সভার লোক আমেনার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া একেবারে অবাক। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল এমন ভয়ানক মেয়ে তারা কখনো দেখে নাই। হবে না কেন, লেখাপড়া শিখিলেই মেয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মা-বাপকে পর্যন্ত গ্রাহ্য করে না।
সভাস্থ সকল লোক চিন্তাযুক্ত! হাছানের পিতা রাগিয়া আগুন হইতে ছিলেন।
আবদার রহমান হাছানের কানের কাছে মুখ লইয়া বলিল, “বেশ মেয়ে! পল্লীগ্রামের হাবা মেয়ে বিবাহ করা অপেক্ষা এইরূপ মেয়ে বিবাহ করাই ভালো। তার ভিতরে সে একটা মানসিক বল আছে তা বুঝতে পাচ্ছ বোধ হয়। পরের কথায় সহজে দমিতা হবার পাত্রী সে নয়। তার নিজের বিশ্বাস ও চিন্তার উপর একটা ভয়ানক শ্রদ্ধা আছে। এরূপ মেয়ে বিবাহ করেই সুখ।”
হাছান মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “অপমানের কোনো কারণ আছে কি?”
“কিছু না! চুপ করে বসে থাক আর খাও। আমার প্রাণ থাকতে তোমার অপমান হবে, এ বিশ্বাস তুমি কর?”
আবু যাহাই বলুন ব্যাপার অত্যান্ত শোচনীয় হইয়া পড়িল। দুপুরবেলা তারা মসজিদে এসেছেন। মৌলভী পবিত্র হইয়া হাছানের পার্শ্বে কোরআন
শরীফ হাতে লইয়া বসিয়াছিলেন। গহনা-পত্র আগেই দেওয়া হইয়াছে। শুধু আমেনার সম্মতির জন্য সকলে বসিয়া আছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ হইবার কথা।
প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমেনা কঠিনভাবে বলিতেছে, মিস্টার হাছানকে সে বিবাহ করিবে না।
আমেনা মলিন বসনে নিজের ঘরে মাটির উপর বসিয়াছিল। চুলে তার তেল নাই। একখানা গহনা সে পরে নাই।
পিতা কাঁদিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “মা, আমার জাতি যে যাবে। তোমার যে এত অমত আছে একথা তোমার মাও তা কোনোদিন বলেন নাই।”
আমেনা রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “আব্বা! অনেক আগেই আমি মাকে বলেছিলাম, এই, বিবাহে আমার বিপদ হবে।”
পিতা বলিলেন, “তোর কী বিপদ হবে? আমার যা সামান্য সম্পত্তি আছে। তাতে তোর সারাজীবন বসে খেলেও ফুরাবে না। তুই কার কি ধার ধারিস?”
আমেনা বলিল, “আব্বা, ভাতের জন্যই কি লোকে কন্যার বিবাহ দেয়? বাপের কি কন্যার জন্য ভাত-কাপড়ের অনটন হয়? আপনি কি আমার মঙ্গল চান না।”
আমেনার পিতা আমেনাকে অত্যান্ত ভালবাসিতেন। কিন্তু সে ভালবাসার অর্থ কি কন্যার মঙ্গল চিন্তা নহে?
মৌলবী এমদাদ আলী সাহেব তার কথা কহিতে পারিলেন না। মুখ ঢাকিয়া দারুণ। মানসিক যন্ত্রণায় ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
অনেক রাত্রি হয়ে গেল। আমেনা তেমনি কঠিন হয়ে বসে রইল।
সকাল বেলা উপাসনা করা শেষ করিয়া সকলে আবার মসজিদে আসিয়া বসিলেন। আর দূরে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয় ভাবিয়া আবদুর রহমান একবার আমেনার সহিত দেখা করিতে গেলেন।
পূর্বেই বলা হইয়াছে; সম্পর্কে আমেনা আবদুর রহমানের চাচাত বোন।
আমেনা একা একা বসে পড়ছিলো। আবুকে দেখে সে চোখের জল মুছিয়া বলিল, “ছোট ভাই আপনি ও আমার বিরুদ্ধে?”
আবু অত্যন্ত বিস্মৃত হইয়া বলিল, “কেন হয়েছে কি?”
“আপনি জানেন না?”
“জানি বই কি। দু’নি থেকে তুমি এতগুলি লোককে কষ্ট দিচ্ছে।”
“সে দোষ কি আমার?”
“তোমার নয় তো কার?”
“আপনার, আমার পিতারও আমার মায়ের।”
“কেমন করে?”
“আপনারা আমার সুখ-দুঃখে বুঝতে পাচ্ছেন না।”
“তুমি বলতে চাও, তোমার সুখ-দুঃখের কথা তুমি নিজেই চিন্তা করো।”
“আর কেউ করে না।”
“এত লেখাপড়া শিখে তুমি, এত বড় অকৃতজ্ঞের মত কথা বলছো?”
আমেনা নরম হইয়া পড়িল। অনেকক্ষণ হাত রগড়াইয়া আমেনা বলিল, “এ বিবাহে সুবিধা হবে না।”
“কেন? কোনোদিক দিয়ে?”
“আমার মন এগোয় না। কিছুতেই এগোচ্ছে না।”
“তুমি কি মিস্টার হাছানকে ঘৃণা কর?”
”না, কখনো না। কখনো না। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।”
“তবে তোমার এ কি ব্যবহার?”
“তিনি আমাকে বিবাহ করে সুখী হবেন না। আমি তার চেয়ে অনেক হীন। যেচে সেধে আমি কাহারো সহিত বিয়ে পুষতে চাই না।”
“কে বললে তোমাকে বিয়ে করে সুখী হবে না? তুমি জান না, সে তোমাকে অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছে ইহা সাময়িক নহে। তার মনের এই ভাব চিরকাল থাকবে। তুমি তার চেয়ে হীন? মিথ্যা কথা। রূপ-গুণে তুমি তার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। তার সঙ্গে মিশতে তোমার কোনো সঙ্কোচ আবশ্যক নাই। ভয়ে ভয়ে তোমাকে কাল কাটতে হবে না। তোমার স্বাধীনতা নষ্ট হবে না। যেচে-সেধে কেউ তোমাকে বিয়ে দিচ্ছে না। বরং কারই আগ্রহ বেশি। মানের ঘোরে যদি কেউ আগে বিয়ের প্রস্তাব না করে তবে বিয়ে কী করে হবে? আমরা আগে প্রস্তাব করেছি বলে কি আমাদের মান গিয়েছে? আমাদের মেয়ে তুমি। চির জীবনের মতো তোমাকে একটা অগৌরবের মধ্যে ফেলে দেবো এই যদি তোমার বিশ্বাস হয় তবে সেটা মিথ্যা ধারণা।”
০ ০ ০ ০
বেলা ১২টার সময় আবদুর রহমান ফিরে এসে বললেন, মেয়ের মতে ১২ হাজার টাকার কাবিন হোক। আর কোনো কথা নেই।
কেহ আপত্তি তুলিলেন না।
অবিলম্বে সুখ ও দুঃখের ভবিষ্যৎ লইয়া দুটি অপরিচিত আত্মার আচ্ছেদ্য বন্ধন হয়ে গেল!
বিবাহের পরের দিনই তার এলো মিস্টার হাছান ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ হয়েছেন। কাজ শিক্ষার জন্য তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রেনিং-এ যোগ দিতে হবে।
.
সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ
অন্নদা পতিতা, তার ঘরের মধ্যে সে বিহারীর কাঁধের উপর হাত রাখিয়া বলিল, “দেখতে কেমন?”
বিহারী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “কী বলেন? দেখতে যেন কাঁচা হলুদ। আগুনের দলা। ঠিক যেন দুর্গা ঠাকুরুণ।”
বিহারী ধীরব মানুষ। পতিতাদের গহনা ও কাপড়ের চটক দেখিয়া মনে করিত, তারা এক একজন মহারানী। সুতরাং সে ভয়ে তাহাদের সহিত খুব সম্ভমের সহিত কথা বলিত।
অন্নদা বলিল, “তাহলে পঞ্চাশ টাকাতেই স্বীকার?”
“আমার যেন বড় অধর্ম হবে।”
“তুই তো আর কচ্ছিস না। তুই গরিব মানুষ, একটা ভদ্র লোককে বাড়ির ভিতর স্থান দেওয়া কি তোর পক্ষে সম্ভব? তার আর ভদ্রলোকদের কোপনজরেও তুই পড়তে পারিস। কাজ তো এত ঝঞ্ছট দিয়ে! আমার ঘাড়ে পার করে দে। তোর কিছু অধর্ম হবে না। যা করবার আমিই করবো।”
“পঞ্চাশ টাকায় আমি পারবো না।”
“কেন?”
“সাজো বছরে তোমার বাড়িতে সে দালান তুলে দেবে। শহরের সব বাবু তোমার গোলাম হয়ে যাবে।”
উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিয়া অন্নদা উৎসাহে আবার প্রস্তাব করিল ”আচ্ছা তাহলে মোট একশত টাকা নিবি?”
বিহারী কোনো কালে একশত টাকার মুখ দেখে নাই। একেবারে হাতের উপর সে এতগুলি টাকা দেখতে পাবে। সুতরাং সে আর বেশি আপত্তি করতে সাহস করিল না!
বিহারী বলিল, “রাজি হতে পারি, কিন্তু সে যে পোষ মানবে, তা তো মনে হয় না। শেষকালে তুমি আমার কাছে টাকা ফেরত চাবে তা কিন্তু হবে না।”
অন্নদা বলিল, “সে যা করতে হয় আমি করবো টাকা একবার দিয়ে আবার ফিরে চাবো? তেমন অধার্মিক আমি নই। কত সাবিত্রী দেখেছি? অন্নদার জঁকো হাতে পড়ে সব পাখির মতো পোষ মেনেছে!”
বিহারী বলিল–“তাতো ঠিক তোমাকে কি আমি জানি না। কিন্তু দেখো ধর্ম খেয়ো না!”
“সে সন্দেহ করো না।”
“কেমন করে কি করবো?”
বাড়িতে যেয়ে বলল–“আমরা গরীব মানুষ, এখানে থেকে আপনার কষ্ট হচ্ছে। এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাবুর স্ত্রী খুব ভালো লোক। আপনার কথা শুনে কত কাঁদলেন। বাবুর স্ত্রী আপনার সকল সুবিধা করে দেবেন। তাঁর অনেক মেয়ে আছে। অনেক ঘর আছে। আপনাকে এত ঘর ছেড়ে দেবেন।”
“কবে আনতে লোক পাঠাবেন?”“কাল দুপুর রাত্রে। তুই সব ঠিক করে রাখবি।”
অন্নদা পঞ্চাশ টাকা গনিয়া বিহারীর হাতের উপর দিল। সঙ্গে আর এক জোড়া ধোয়া কাপড় দিয়ে বললে–“এখন পঞ্চাশ টাকা দিলাম। বাকি টাকা কাল রাত্রে দেবো।”
আনন্দে বিহারী উদ্বেল হইয়া গেল। জীবনে তার এমন সৌভাগ্য ঘটে নাই। অন্নদাকে নমস্কার করিয়া বিহারী বিদায় হইল।
সে মাসে মোটেই টাকা আসে নি। জেলেদের ভাঙ্গা ঘরের মধ্যে বসে সৌদামিনী ভাবছিল ভগবান এমনি করে জীবনকে শ্মশানে পরিণত করলো!
কাপড় একেবারে ফেটে গিয়েছে। ঘরে মাত্র সকাল বেলার জন্য দুমুঠো চাল আছে।
আর এক নূতন কথা। কোনো কোনো ইতর রমণী হেসে হেসে কানাকানি করে বলছিল–বিহারী এই মাগীরে নিয়ে……
সৌদামিনীর লজ্জায় ঘৃণায় ইচ্ছা করিতেছিল–প্রাণ তার বেড়িয়ে যাক। সে তার নিজের শরীর নিজে ছিঁড়ে ফেলে। হায়! ধর্মে কেন বলে আত্মহত্যা কর মহাপাপ? তাতে
অনন্তকাল নাকি নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে?
অতিদুঃখে সে অভিশাপ দিয়ে শ্যামাচরণ লক্ষ্য করে বললে–“এই তোমার প্রেম? এই তোমার হিন্দু ধর্ম? এই ধর্মের তোমরা বড়াই করো? জীবনের অতি আপনার সতী অর্ধাঙ্গিনীক ফেলে দিয়ে ধর্ম রক্ষা করো।”
এমন সময় বিহারী পিছন হইতে ডাকিয়া কহিল–“কি কথা একটা?”
সৌদামিনী কহিলেন–“কি কথা বিহারী?”
“আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারি। বিশেষ করে আমাদের মতো। ছোটলোকের বাড়িতে ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব।”
“আমি আর এখন ভদ্রলোক নহি বিহারী! এখন আমি অত্যন্ত ছোট। তোমরা যে আমাকে একটু জায়গা দিয়েছ এতেই আমি কৃতজ্ঞ ইচ্ছা করেছিলাম তোমাদিগকে ভালো করে পুরস্কার দেবো, কিন্তু তাহলো না। বিহারী এর পরে আমার কি হবে তা বুঝতে পারি না। কাল আমি রানী ছিলাম, আজ পথের ভিখারিণীর চেয়ে নিকৃষ্ট!”
“আপনি অত বিচলিত হবেন না। আপনার একটা কূল করেছি।”
“সৌদামিনী আগ্রহের সহিত বলিল, “কি কূল করছো বিহারী?”
“এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাবুর স্ত্রী খুব ভদ্রলোক। আপনার কথা শুনে কতো কাদলেন। বাবুর স্ত্রী আপনার সকল সুবিধা করে দেবেন। তার অনেক মেয়ে আছে অনেক ঘর আছে। আপনাকে এক ঘর ছেড়ে দিবেন।”
সৌদামিনী কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল–“বিহারী তুমি কি স্বপ্নে দেখছো, ভালো করে বলো। কে এমন দেবী আছেন। তুমি কি সত্য কথা বলছো?”
“আমি খুব সত্য বলছি। এরপরে আর আপনার কষ্ট হবে না। ভগবান আপনার দুঃখ, মোচন করেছেন।”
“করে যাবো সেখানে?”
“আজই!”
সৌদামিনী অত্যন্ত বিস্ময়ে বলিয়া উঠিল–“আজই!”
“হ্যাঁ আজই!”
সৌদামিনী পাল্কি হইতে যখন অনুদার বাড়ির উঠানে নামিল তখন পাল্কির দুই পাশে সাতটি যুবতী মেয়ে। সকলেরই সাজ-সজ্জা খুব চমৎকার।
সৌদামিনী অত্যন্ত সঙ্কোচের সহিত জিজ্ঞাসা করিল–“তিনি কই?”
একজন প্রৌঢ়া অত্যান্ত আগ্রহের সহিত মেয়েগুলিকে ঠেলিয়া সৌদামিনীর হাত জড়াইয়া ধরিল। সৌদামিনী রমণীর পদধূলি গ্রহণ করিল।
অত্যন্ত স্নেহ ও ভালবাসা দেখাইয়া অন্নদা সৌদামিনীকে এক সজ্জিত ঘরে লইয়া বসাইল। যুবতীদের মধ্যে কেহ তাহাকে বাতাস করিতে লাগিল, কেহ বসিবার আসন ঠিক করে দিল, কেহ জলখাবারের বন্দোবস্ত করিল।
ঘরের ভিতর একখানা মুল্যবান কৌচ, দুইখানা চেয়ার, একখানা ইজিচেয়ার; একটা বড় আয়না, আর অনেক কুৎসিত ছবি!
অন্নদা কৌচের উপর সৌদামিনীকে বসাইয়া নিজে তাহার পার্শ্বে বসিয়া হাজার মমতা
ও ভালবাসার পরিচয় দিতে লাগিল।
অন্নদা কহিল–“আপনাকে এই ঘর একেবারে দিলাম। এখানে উঠবেন বসবেন, মোট কথা, এ ঘর আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হল।”
অন্নদা এই সময় শৈল বলিয়া কাহাকে যেন ডাকিল। শৈল অনতিবিলম্বে এক থালা, খাবার আর গ্লাসে করিয়া লইয়া আসিল।
সৌদামিনীর খাবার ইচ্ছা না থাকিলেও অন্নদার অনুরোধে সে খাইতে বসিল। তার পর গ্লাসটা হাতে নিয়ে সৌদামিনী বললে–“এটা কী জিঞ্জার? এত বন্দোবস্ত কেন? সাদা জলেই আমার তৃপ্তি হয়!”
অন্নদা শৈলকে আরও দুই গ্লাস জিঞ্জার লাল আনিতে বলিল। পিপাসিতা সৌদামিনী পর পর চারি গ্লাস জিঞ্জার পান করিল। তারপর দেহ যেন অবশ হয়ে এলো। চোখ অজ্ঞাতসারে মুদিত হয়ে গেল। সৌদামিনী ধীরে ধীরে বিছানার উপর ঘুমাইয়া পড়িল।
অতি উৎকৃষ্ট বিলাতি সুরা সৌদামিনীর সারা শরীরে অতি সুখের চৈতন্য-অপহারক শক্তি ছড়াইয়া দিয়াছিল।
প্রভাতের অরুণ কিরণ খোলা জানালা দিয়ে সৌদামিনীর গায়ের উপর যেয়ে পড়ছিল। চোখ খুলতেই তার সর্বনাশের দৃশ্য সে দেখতে পেল।
নিমেষের মধ্যে তার মাথায় প্রলয়ের আগুন জ্বলে উঠল। লাফ দিয়ে মেজে পড়ে সে এক পদাঘাতে দরজা ভেঙ্গে ফেলে। যখন সে মনের ভিতর একটা অতি প্রচণ্ড প্রলয় নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো, তখন তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সে তখন একেবারে পাগল।
.
অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
মাসের পর মা আনন্দে মধুর স্বপ্নে কেটে যাচ্ছিল।
ঘরের মধ্যে মিটি মিটি আলো জ্বলছিল। ফিনি মিস্টার এবাদকে গভীর প্রণয়ের আবেগে কত ভালবাসা জানাইতে ছিল। জীবনের চরম সুখে-বিশ্ব-সংসার ভুত-ভবিষ্যৎ ভুলে এবাদ ফিনির প্রেমে আপনারা সীমাহীন বাসনা ও মাদকতার আগুন নিয়ে এবাদ ফিনির জন্য একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছেন।
আজ কত বছর বাড়ি ছাড়া, তার যে, বাড়িতে এক স্ত্রী ছিল তা কি তার মনে আছে? স্বপ্নের মতোও সে কথা এবাদের মনে হয় না। এক বছর হলো বাড়িতে সে মোটেই পত্র লেখে না।
তখন রাত্রি তিনটা। আগের দিন বৈকাল বেলা ফিনি এবাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ইচ্ছা থাকলেও সে যেতে পারে নাই।
ফিনি এবাদের মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিল, “আমার প্রিয় ভারতবর্ষের বন্ধু! তোমাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তে থাকতে পারি না। কিন্তু দিবারাত্র এখানে থাকলেও পিতা সন্দেহ করতে পারেন।”
এবাদ গম্ভীর আবেগে বলিল–“প্রিয়ে, আমারও তোমারি মতো অবস্থা। যতক্ষণ তুমি এখানে থাক না ততক্ষণ আমি পাগলের মতো পথের পানে চেয়ে থাকি।”
“আমি এক যুক্তি ঠিক করেছি।”
“কী যুক্তি?”
“তুমি একেবারে আমাদের বাড়িতে চলো।”
“যদি তোমার পিতা জানতে পারেন?”
“আমি তোমাকে আমাদের আঁধার ঘরে রেখে দেবো। আঁধার ঘর প্রত্যেক বাড়িতে থাকে। সেখানে কেউ থাকে না, না কেউ যায় না। নীরব আঁধার নিয়ে সেই কামরাটির মধ্যে মাটির নীচে আমরা থাকব। চাবী আমার কাছেই থাকে।”
“সেখানে আমরা আহার, জল কে দেবে?”
“আমার প্রিয় বিশ্বসী ভৃত্য বেলা।”
“ওকে কি বিশ্বাস করতে পারা যায়?”
“বেলা অত্যন্ত বিশ্বাসী ভৃত্য। তাকে প্রাণ দিতে বললে সে প্রাণ দেবে।”
“বেশ যুক্তি রাতদিন তখন তোমার সঙ্গসুখ উপভোগ করতে পারবো কিন্তু কেন যে আমার একটু ভয় হচ্ছে।”
“সেটা তোমার মনের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের সেই নিষ্কলঙ্ক নির্বাত সুখ-সমুদ্রে কোনোও প্রকার দুশ্চিন্তার স্থান হওয়া উচিত নহে।”
“কেমন করে সেখানে যাবো?” বাহিরের দিকে এক গুপ্তদ্বার আছে। সেই পথ দিয়ে গভীর রাতে তোমাকে নিয়ে যাবো।”
এমন সময় বাহির হইতে দরজায় যা পড়লো। ফিনি বিছানা হইতে উঠিয়া কাপড় পড়িয়া কহিল–“ওহে প্রিয়! বেলা এসেছে!”
কয়েক মিনিট বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বেলা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মিস্টার এবাদ ও ফিনিকে নমস্কার করিল।
ফিনি বেলাকে জিজ্ঞাসা করিল–“পিনাস ঠিক হয়েছে?”
বেলা আর একটা নমস্কার করিয়া কহিল, “হয়েছে।”
সেদিন ফিনি এবাদকে লইয়া সাগর-ভ্রমণে বাহির হইবে। পূর্বদিনেই একখানা পিনাস ঠিক করিতে বেলাকে সে বলিয়া দিয়াছিল। বেলা তাহার কত্রীর আজ্ঞা পালন করিয়া অতি প্রত্যুষেই সংবাদ দিতে আসিয়াছে।
বেলা অত্যান্ত বিশ্বাসী তাহা আগেই বলা হয়েছে। তার কত্রী–ফিনির কাছে সে অত্যান্ত ঋণী। শোকে-দুঃখে সে সর্বদা ফিনির সাহায্য পায়। ফিনির যতই দোষ থাকুক না কেন, সে সর্বদা তার কত্রীর দোষ সকলের নিকট হইতে গোপন করিয়া রাখিত এবং শহরময় সে প্রচার করিয়া বেড়াইত যে, তাহার কত্রী মিস ফিনির মতো মেয়ে সারা শহরে নাই।
বেলা তার কত্রী ও মিস্টার এবাদকে স্নান করাইয়া দিয়া প্রাতঃভোজনের বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।
|||||||||| অতঃপর আহারাদি করিয়া অতি প্রত্যষেই মিস ফিনি, তাহার বিশ্বাসী ভৃত্য বেলা এবং এবাদকে লইয়া সাগরাভিমুখে যাত্রা করিল।
প্রায় আধ ঘণ্টার ভিতর গাড়ি সাগর উপকূলে উপস্থিত হইল।
প্রকাণ্ড পিনাসে চড়িয়া এবাদ মিস ফিনির সহিত সমুদ্রবিহারে বাহির হইলেন। পিনাসে তিনটা কামরা। বেলা পিছন দিককার কামায় যাইয়া দরজা বন্ধ করিল। এবাদ তার প্রিয় ফিনিকে লইয়া সম্মুখের প্রকোষ্ঠে উপবেশন করিলেন।
সমুদ্রের ঢেউগুলি পিনাসে আছাড় খাইয়া পড়িতেছিল ফিনি এবাদের বাহু ধরিয়া তাহার কোমল পেলব দেহ এবাদের গায়ের উপর এলাইয়া দিল। এবাদ ফিনির লাল কুসুম কোমল গণ্ডে চুম্বন করিতে লাগিল।
ফিনি কহিল–“প্রিয় বন্ধু আমরা কত সুখি। দেবতা প্রসন্ন ছিলেন তাই তোমাকে পাইয়াছি। সেবারে যখন তোমারে সহিত সমুদ্রে-বিহারে হইয়াছিলাম তখন একটুও ভারি নাই যে, আমাদের এত সুখের দিন আসিবে। তোমার দিকে চাহিয়া চাহিয়া আমি প্রেমের আগুনে মরিয়া যাইতাম, কিন্তু, তুমি কিছুই বুঝিতে পারিতে না।”
এবাদ কহিল–“প্রিয় ফিনি, তোমার ভিতর যে এত প্রেম ছিল তাহা আমি ভাবিতে পারি নাই। তখন ভাবতাম; তুমি আমার সাধারণ শ্রেণীর একজন বন্ধু! কে জানিত, তুমি আমাকে এত ভালবাস।”
প্রখর রৌদ্রে ঢাকা শহর মরুভূমির মতো ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কুলসুম–তার নিজের কামরায় বসে সীমাহীন আকাশের পানে তাকিয়েছিল। বাহিরের উষ্ণ বাতাস তাহার শরীরে উষ্ণ দীর্ঘ নিশ্বাসের মতো আগুনের হাল্কা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।
কি দারুণ বেদনা তাহার কোমল বুকখানিকে পিষ্ট করে দিতেছিলো। সে আজ দশ বৎসরের কথা, কত আঁখি জলে সে স্বামীকে বিদান দিয়েছিলো। আর কতকাল সে এমনি করে দারুণ বেদনা নিয়ে কাল কাটাবে। কুলসুম ভাবিতেছিল–“এত বছর কি পড়িতে লাগে? একখানা চিঠি কি লিখিতে নিয়ে কাল কাটাবে। কুলসুম ভাবিতেছিল–“এত বছর কি পড়িতে লাগে? একখানা চিঠিও কী লিখতে নাই? একটা প্রাণীকে এমনি করে হত্যা করে বিদেশে পড়ে থাকা কি ধর্ম? এমন শিল্প-শিক্ষার কী ফল? অর্থ যদি এর উদ্দেশ্যে হয় তবে সে অর্থ আমি চাই না। ভিখারিণী হয়ে স্বামীকে নিয়ে ভিক্ষা করে খাবো। এত অর্থ, এত গহনা, এত রূপ দিয়ে আমার কি লাভ? সামান্য দরিদ্র কৃষক রমণীও ভাগ্য যে আমার চেয়ে অনেক ভালো। কেন এখানে আব্বা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন? একটা নির্মম হৃদয়হীন মানুষের অত্যচার সইতে?” বাহিরে পৃথিবী লতা, পাতা ও আলো-বাতাস পুড়িয়া ছাই হইতেছিল। কুলসুমের মুখোনিতেও তেমনি আগুন ধরে উঠলো।
দারুণ বেদনায় বালিশটাকে বুকে লইয়া সে বিছানার উপর শুইয়া পড়িল। চোখ দিয়া অজস্রধারে জল পড়িতে লাগিল।
সেদিন তার শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন না। তার শ্বাশুড়ী দুপুর বেলায় আপন কামরায় ঘুমিয়েছিলেন। একে বৃদ্ধাবস্থা, তাহার উপর প্রায় এক বৎসর বড় ছেলের কোনো চিঠি না পাইয়া তাহার শরীর ক্রমশ শোচনীয় হইতেছিল। দিনের বেলা দুপুরে একটু ন্দ্রিা ছাড়া আর কোনো সময়ে তার দ্ৰিা হয় না। সারা রাত্রি বসিয়া কাটাইয়া দেন।
পেছন হইতে এবাদ তার ভাবিকে ডাকিল–“ভাবি!”
এত দুঃখ ও বেদনার ভিতর কুলসুম তাহার ছোট দেবরের নানা রহস্য কথা বলিয়া অনেকটা শান্তি পাইত। দেবর এবাদ তাহার সহিত রহস্য করিলেও সে তাহাকে খুব শ্রদ্ধা করিত।
মানুষ যখন আপনাকে অত্যন্ত অসহায় মনে করে তখন সে সামান্য শত্রুতা মার্জার শিশুকে ভালবাসিয়া ও সান্ত্বনা পাইতে চায়। আপন ভাইয়ের সহিত যাহার অত্যান্ত শত্রুতা হয়, সে পথের অপরিচিত লোককে ভালবাসিয়া সুখ পাইতে চায়। যে মাতাল সন্তান মরিয়া গিয়াছে সে পরের ছেলেকে আগ্রহে বুকের সহিত জড়াইয়া ধরে। মানুষ একটা আকর্ষণ ব্যতীত বাচিতে পারে না। সে আকর্ষণ আপনার জন্যই হউক বা পর হউক, মানুষ হোক বা কর্ম হোক, একটা কিছু হইবেই। আত্মার এই অংশ কখনও শূন্য থাকে না।
অত্যন্ত বেদনায়, জীবনের এই কঠিন শূন্যতায় কুলসুম, তাহার দেবর এবাদকে অত্যন্ত ভালবাসে। এবাদের আহারের বন্দোবস্ত কুলসুম নিজেই করে, নিজ হাতে সে তাহাকে খাওয়ায়, নিজেই পার্শ্বের কামরায় তার শয্যা রচনা করিয়া চুপেচুপে শ্বশুরের অগোচরে ভীত এবাদকে তামাক সাজিয়া দেয়।
এবাদকে দেখিয়া কুলসুম অনেকটা সোয়ান্তি অনুভব করিল। কুলসুম অত্যন্ত স্নেহের স্বরে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া কহিল–“এবাদ! ভাই আমার, আয়!”
এবাদ তাহার ভাবির পায়ের কাছে আসিয়া শুইয়া পড়িল। এবাদের মুখ স্বেদসিক্ত। কুলসুম অত্যন্ত স্নেহে এবাদের মুখোনি আঁচল দিয়া মুছাইয়া দিলেন।
ভাবি আর দেবরে অনেক কথা হইল। কেবল স্নেহ আর শ্রদ্ধাতে।
এবাদের মুখে একটা ফোট হইয়াছিল। কুলসুম হাত দিয়া সেটা টিপিয়া দিলেন, হাতের চাপে এবাদের উজ্জ্বল রক্তময় মুখোনি আরও রক্তময় হইয়া উঠিল।
.
উনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
তখন সন্ধ্যা। দিবালোক ধীরে ধীরে সরিষা যাইতেছিল। পল্লীপথের নির্জনতা মশার গুঞ্জনধ্বনিতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিল। সেই নির্জন পথের নির্জন কালিমার ভিতর দিয়া রমা ও নিহার নইমুদ্দিন শেখের বাড়িতে যাইতেছে।
গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ভালবাসার পাত্র-চির পরিচিত সরল ধর্মভীরু নইমুদ্দিন শেখ তখন উপসনা শেষ করিয়া তামাক খাইতেছিল।
বেশি দূরে তার বাড়ি নয়। মাঝে একখানা পতিত জমি, তার পর কয়েকখানা বাড়ি, তার পর একটা গ্রাম্য ছোট রাস্তা, দু’পাশে তার সুপারী গাছ, তারপর ঘোষদের বাড়ি। দুঃখিনী বিধবার ভাঙ্গা একখানা ঘর, আর বেদনা-ভরা একখানা উঠান পার হয়ে রমা আর তার বন্ধু নিহার নইম শেখের বাড়ির উপস্থিত হলো।
বৈকাল বেলা রমা আর নিহার তাদের মায়ের কাছে তাদের পুরানো আত্মীয় না হলেও আত্মীয় ঠাকুরদার নইমুদ্দীন শেখের বাড়িতে যাবে বলে প্রস্তাব করেছিল। কোনো মা তাতে আপত্তি তুলেন নাই।
নইম আর নাতনী রমা আর নিহারকে দেখে হুঁকো ধুয়ে চীৎকার করে বললে, “ওগো, নাতনীরা এসেছেন। কই, এদিকে এসে বসতে দাও”–বলিয়া গৃহিণীর জন্য অপেক্ষা করিবার সময় তার সহিল না। নিজেই সে একখানা ছালা এনে নিহারকে বসতে দিলো।
তার পর কতো স্নেহের কথা এই সেদিন রমা-নিহার নইমের চোখের সামনে ছোট কচি খুকী ছিল। আজ তারা সেয়ানা, তারই সামনে তাদের বিয়ে হয়েছিল, তারই সামনে…। নইম কহিতে পারিল না। গলার স্বর তাহার আর্দ্র হইয়া উঠিল।
তারপর আরও কত কথা হইল। অনেক কথার পর নিহার বলিল,–“একটা কথা।”
নইম কহিল–“দিদি?”
“খুব গোপন কথা।”
“যদি ঘৃণাক্ষরে কেউ জানতে পারে তা হলে সর্বনাশ হবে।”
নইম আরও একটু এগিয়ে এসে বললে–“কী কথা বোন। কেউ শুনবে না, তুমি আস্তে আস্তে বল। আমাকে তোরা আপন ঠাকুর দাদা মনে করবি। তোদের দুঃখে; তোদের ব্যথার কথা মনে হলে সেদিন আমার খাওয়া হয় না। রাত্রে ঘুম আসে না। মুখে কি বলবো ভাই? খোদা জানে। আহা! তোরা যদি হিন্দুর ঘরে ন. জন্মিতিস তাহলে তোদের জীবন এমন শ্মশান হতো না। কী করতে পারি; কী ক্ষমতা আছে আমার? খোদার কাছে মোনাজাত করি–এদৃশ্য যেন আর আমার দেখতে না হয়।”
নিহার বলিল–“সত্যিই বলবো, কিছু মনে করবে না তো? তুমি আমাদের দাদা হও বলেই বলতে সাহস পাচ্ছি, নইলে বলতে পাত্তেম না।”
“বলো কোনো ভয় নেই। তোমাদের প্রত্যেক কথা আগ্রহের সাথে শুনবো।”
“দাদা, তুমি আমাদেরকে অত্যন্ত ভালবাস তাই বলতে সাহস পাচ্ছি। যদি অন্যায় হয় তবে প্রতিজ্ঞা করো কারো কাছে এ কথা প্রকাশ করবে না।”
মহিউদ্দিন রংপুরের এক পল্লীগ্রামে একটা মাদ্রাসা খুলেছেন। সেখানকার বড় মৌলবী তিনি। নিকটস্থ আট-দশ গ্রামের লোক তাহাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। …
গ্রামে কোনো মারামারি হয়েছে, মহিউদ্দিন তাহা মিটমাট করিয়া দেন। কাহারো বিবাহ তিনি যাইয়া সমস্ত বন্দোবস্ত করেন। কেহ, পীড়িত হইয়াছে, তিনি যাইয়া চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন, কাহারো আত্মীয়ের মৃত্যু হইয়াছে, মহিউদ্দিন যাইয়া তাহার অন্ত্যেষ্ট্রিক্রিয়া সমাধা। করেন। মাদ্রাসা ছাড়া বাহিরের লোক এইসব কাজে তাঁহাকে বহু অর্থ দিয়া শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
প্রাতকালে তিনি তাঁহার ছাত্র কছিমুদ্দিনকে পড়াইতেছিলেন। কছিমুদ্দিনও নদিয়ার মানুষ। অর্থ ব্যয় করিয়া পড়িবার সাধ্য নাই বলিয়া সে তার দেশী মৌলবী মহিউদ্দিনের কাছে আজ তিন বৎসর যাবত পড়ে। শুধু কাজ করিয়া আহার করিয়াই তার দিন যায় না।
মহিউদ্দিন জ্ঞানলাভেচ্ছু কছিমকে প্রত্যহ নূতন নূতন জ্ঞান দান করেন। একই পড়া এক মাস পড়াইয়া মহিউদ্দিন নিজের কাজ-কর্মের সুবিধা করিয়া লন না এবং তিন বৎসর কছিম ইংরেজি, বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ জ্ঞান লাভ করিয়াছে। ইংরেজি বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছেলেদের সহিত ইংরেজিতে সে কথা বলিতে পারে। খবরের কাগজও সে বেশ পড়িতে পারে এবং মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখিবার ইচ্ছা পোষণ করে। কোরানের পঠিত অংশের অর্থ বেশি বলিতে পারে। প্রতিবেশী দিল্লী পাঞ্চাবের মুসলমানের ঘরের খবর লাভের জন্য সে উর্দু পড়ে। অন্য কোনো উদ্দেশ্যের জন্য নয়। উর্দু ভাষায় কথা বলিয়া সে ভদ্রলোক হইবার কল্পনা পোষণ করে না। সে চাকরি করিবার উদ্দেশ্যে লেখাপড়া শিখিতেছে না। বাড়িতে তার অনেক জমি আছে তাতে ধান, গোল আলু ও আখ যথেষ্ট পরিমাণে হয়। সমাজে যাহাতে নিতান্ত অশিক্ষিত লোকের মতো কাল না কাটাইতে হয় এইজন্য সে অধ্যায়ন করিতেছে। দুনিয়ায় মূর্খের মতো বাচিয়া থাকাই বিপজ্জনক। লেখাপড়া শিখিয়া সে কৃষকের কাজ করিয়া খাইবে, সংসারে। কাজ করিয়া অর্থ উপায়ে। করিবে তত্ৰাচ সে একটা অপদার্থ মুখ হইয়া থাকিবে না। ইহাই তাহার ইচ্ছা। শিক্ষিত মানুষ যে কাজই করুক তাহাতে তার গৌরব। তাতেই তার মান ও প্রসার হয়। ধীরে ধীরে তার অহঙ্কারহীন আত্মশক্তি জাগিয়া উঠিতেছে।
পিয়ন আসিয়া মৌলবী সাহেবকে একখানা পত্র দিয়া গেল। পত্রখানি মৌলবী সাহেবের ভগ্নিপতি নইমুদ্দীন লিখিয়াছে অনেকদিন তিনি তাহার দরিদ্র ভগ্নি ও ভগ্নিপতির সংবাদ পান না, তজ্জন্য তিনি দুঃখিত ছিলেন। আগ্রহের সহিত চিঠি খুলিয়া দেখিলেন তাতে লেখা আছে :
দোয়াবরেষু–অনেকদিন হইল তোমার সংবাদ না পাইয়া যার পরনাই দুঃখিত আছি। একটি কথা বলিতেছি, খুব চিন্তা করিয়া যাহা ভালো বিবেচনা কর ফেরত ডাকে লিখিবে। আমি অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত, আছি। কী করিব কিছুই বুঝিতেছে না। তুমি জ্ঞানী সুতরাং তোমার কাছে বিহিত মীমংসা হইবে, সন্দেহ নাই।
চক্রবর্তী কন্যা নিহার দীনবন্ধু দাসের কন্য রমাকে তুমি চিনতে পার। বিধর্মী হইলেও বাল্যকাল হইতেই এই দুইটি বালিকার উপর আমার প্রগাঢ় স্নেহ।
আমি মুখ মানুষ হইলেও ইহাদের জন্য আমি অত্যন্ত বেদনা, অনুভব করি। তুমি জান। না বোধ হয়, ইহারা খুব বাল্যকালে স্বামীহারা হইয়াছে।
পরকথা, সেদিন সন্ধ্যাবেলা, নিহার ও রমা আমার কাছে এক অতি গোপন কথা বলিয়া গিয়াছে। সংসারের সাধারণ মানুষ তাহাদের দুঃখ ও কথার গুরুত্ব অনুভব না করিলেও প্রত্যেক হৃদয়বান তাহাদের জন্য প্রভূত বেদনা অনুভব করিবে। অত্যন্ত ও ভয় ও সঙ্কোচের সহিত তাহারা একথা বলিয়াছে, আমার সাহায্যে তাহারা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ।
করিয়া দুইজন চরিত্রবান মুসলমান যুবকের সহিত বিবাহিতা হইতে চায়। বলিতে কী, তাহাদের এই সৎসাহসে হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করিয়াছিলাম ও করিতেছি। ইসলাম যদি এই দুইটি আত্মাকে শান্তি ও মুক্তি দিতে পারে তবে অত্যন্ত ভালো কথা। কিন্তু আমরা দ্বারা এই গুরুতর কার্য কি করে সম্ভব? একে হিন্দুদের শক্তি বেশি, তা ছাড়া দুইজন যুবতী স্ত্রীলোক লইয়া কথা, তুমি কী যুক্তি দিতে চাও, সত্ত্বর লিখিবা!
মহিউদ্দিন পত্র পড়িয়া একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন। চিঠিখানি আমরা আমাদের ভাষায় লিখিলাম। বস্তুত ঠিক এরূপ ভাষায় পত্র লেখা হইয়াছিল না।
সেদিন মহিউদ্দিন মাদ্রাসায় পেলেন না। সমস্ত দিন তিনি চিন্তা করিলেন, তাহার পর সন্ধ্যাকালে তিনি একখানি পত্র লিখতে বসিলেন–তাহাতে শুধু লিখিলেন–ভাই সাহেব! পত্র পাইয়া যার পরনাই ব্যথিত হইলাম। আপনি মেয়ে দু’টিকে খুব সাবধানতার সঙ্গে এখানে লইয়া আসিবেন, তার পর যাহা করিতে হয় আমি করিব। এই দুইটি অসহায় প্রাণীর জন্য আমি করুণাময় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।
সারাদিন মহিউদ্দিন চিন্তা করিলেন–মানুষের অত্যাচারে পড়িয়া মানুষ এমন করিয়া কেন জর্জরিত হয়? দেশের কুসংস্কার ও সামাজিক অত্যাচারে প্রপীড়িত কত হাজার হাজার রমণী এমনি করিয়া আঁখিজলে সারাজীবন কাটাইয়া দেয় তাদের কে খবর রাখে? সকল জায়গায় অত্যাচার চলে, মানুষের মনের উপর অত্যাচার চলে না। মানুষের খোদার দেওয়া স্বভাবের বিরুদ্ধে কেন মানুষ একটা কঠিন লৌহ দেওয়াল তুলিয়া দিয়া এত অত্যাচার ও অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়!
সামান্য দীন অবস্থা হইতে অনেক দুঃখ বেদনার সহিত সংগ্রাম করিয়া মহিউদ্দিন বড় হইয়াছিলেন, সুতরাং অনেকখানি দৃষ্টি তাহার লাভ হইয়াছিল। মানুষের দুঃখের প্রতি তাহার মনুষ্যত্ব ভয়ানক রকমে সাড়া দিয়া উঠিত।
তিনি আরও ভাবিলেন–মৌলবীরা যদি চেষ্টা করেন তবে বহু মানুষকে দুঃখের হাত হইতে তাহারা উদ্ধার করিতে পারেন। বহু মানুষ ইসলামের গতিতে আসিয়া নির্বাণ লাভ করিতে পারে। যে বেশি অন্ধ ও মূক তাহার জন্য বেশি বেদনা অনুভূত হওয়া আবশ্যক। গায়ে যার শক্তি আছে সে নিজের স্থান নিজে করিয়া লইতে পারে; পরের সাহায্য তার দরকার হয় না। ইসলাম অর্থ কী? মানুষকে শান্তি দেওয়া, বিশ্বমানবকে দুঃখ হইতে সুখের পথে লইয়া যাওয়া। কুসংস্কার, অত্যাচার ও অন্ধকার মাথায় পদাঘাত করা শুধু ভাবহীন উপাসনা ও উপবাসে ইসলামে মুক্তির খবর নাই।
তাহার মনে হইল, এ-দুটি দুর্বলা নিঃসহায় আত্মাকে যদি সে বাঁচাইতে পারে তবে সে আল্লাহর নিকট অনেকখানি মর্যাদা পাইতে। মহিউদ্দিন ঠিক করলেন সমাজের নিকট ছোট হইবার ভয় থাকিলেও তিনি নিহারকে বিবাহ করিয়া একটা অন্ধ ধর্মহীন ব্যথিত মানুষকে জীবন দান করিবেন। তাহার শিষ্য কছিমুদ্দিনও অবিবাহিত ছিল।
মহিউদ্দিন আবার ভাবিলেন–দেশের জাতির মাথায় কি পৈশাচিক অত্যাচারের ভার চাপান হইয়াছে। শক্তি ও ভারহীন হইয়া তাহারা তাহাদের আত্মার স্বাভাবিক দাবীর কথা ভুলিয়া পরাধীন পশু হইয়া আঁধারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাল কাটাইতেছে। সারা রমণী জাতিটা দারুণ অপমানে আত্মহীন কৃপার পাত্র হইয়া বাচিতে চেষ্টা করিতেছে মাত্র।
.
চত্বরিংশ পরিচ্ছেদ
মাথার তেল ফুরিয়ে গিয়েছিলো–কাদম্বিনী রাধাকে তেল এনে দিতে বললে।
কাদম্বিনী আবার বলিল–দাঁতে তার বড় ব্যথা। একটু মাজন না পেয়ে সে বড় কষ্ট পাচ্ছে। রাতে তার ঘুম হয় না।
সেইদিনই বিকাল বেলা রাধা নিজে পছন্দ করে একজোড়া পাছাপেড়ে বাহারের শাড়ি কিনিয়া আনিয়া দিল। তাতে দোষ কী? কাদম্বিনী কী বিধবা যে সে চুল বাঁধবে না? দাঁতে মাজন লাগাবে না? রাধা এ কথা তাকে প্রায়ই মনে করে দিত। কাদম্বিনীর দুঃখ অনেককটা উপশমিত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে রাধার কাছে অত্যান্ত শক্তিহীন হইয়া পড়িল কেন? তেমনি করিয়া রাধার সহিত আর কথা বলতে আজকাল সে সাহস পায় না। কেন? স্বর তাহার শক্তিহীন ও স্ত্র।
রাধার সম্মুখে সে একেবারে দিনে দিনে ব্যক্তিত্বহীন হইয়া পড়িল। সে কি রাধার স্ত্রী? স্ত্রী কাহাকে বলে? স্বামীর সহিত স্ত্রীর সম্বন্ধ কি স্ত্রীলোকেরা সম্মান রক্ষা, তাদের সাংসারিক সুখ-দুঃখের উপশম করাই তো স্বামীর কাজ, তাই জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়, কাদম্বিনী কি রাধার স্ত্রী?
মিথ্যা কথা! রাধা তাহাকে সমবেদনা জানায় মাত্র! সে আর কেউ নয়।
০ ০ ০ ০
কাদিম্বনী যখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন একদিন দারুণ উপদংশ রোগগ্রস্ত হয়ে লোহারাম খালি হাতে বাড়ি এসে উপস্থিত।
তার এই ভয়ানক অবস্থার সময় সে তার ব্যথিতা, বিস্মৃতা, অবহেলিতা স্ত্রী কাছে ফিরে এসেছে। সংসারে তো অনেক পথ ছিল। আর কোনো পথ তাহার আজ মনে পড়ে নাই কেন?
যেদিন কাদম্বিনী বুঝিল, সে অন্তঃসত্ত্বা সেদিন তার লজ্জা হইল না। স্বামীর উপর একটা ভয়ানক ক্রোধও ঘৃণার আগুন তাহার বুকের মধ্যে জ্বলিয়া উঠিল।
উপদংশ–রোগগ্রস্ত হয়ে নিজের পত্নীর কাছে লোহারামের ফিরিয়া আসিতে লজ্জা হয় নাই, আর কাদম্বিনীরই কী এত লজ্জা?
উপদংশ রোগের অর্থ কাদম্বিনী বেশ বুঝে। লোহারাম লক্ষ্য করিল। তাহার অতিনা, চরিত্রবতী স্ত্রীর অতীত সলজ্জা ভাব সেই কথা ও হাসির ভিতর দিয়া একটা অন্তনিহিত অনুরাগের ছায়া আর নাই।
উপদংশের কী ভীষণ জ্বালা তাহা যাহার হইয়াছে সেই বোধ হয় বেশি করিয়া জানে। দারুন যন্ত্রণায় লোহারাম আত্মহত্যা করিতে যাইত, কাদম্বিনী নানা প্রকারে সান্ত্বনা দিয়া তাহাকে নিরস্ত্র করিত।
অন্তরের ভিতর দারুণ ঘৃণা পোষণ করিয়া কাদম্বিনী লোহরামের সেবা করিত। লোহরামের শরীর কিছু ভালো হইলে সে দেখিল, তাহার স্ত্রী কাদম্বিনীর রোগ আরম্ভ হইয়াছে। পাপীর সংস্রবে আসিয়া কাদম্বিনীর মাথায় নূতন বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুমাত্র সহানুভূতি হইল না।
সেদিন সন্ধ্যাকালে পাড়ার লোক হাটে গিয়াছিল। লোহারাম স্ত্রীকে সম্মুখে আসিতে বলিল। রোগযন্ত্রণায় কাদম্বিনী নড়িতে পারিতেছিল না, তত্রাচ সে লোহারামের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। কাদম্বিনী তখন আট মাস। লোকে তখন বেশ করিয়া কানাকানি আরম্ভ করিয়াছে। কাদম্বিনী কিছুমাত্র গ্রাহ্য করে নাই।
লোহারাম কহিল–“এ সব কী কানাকানি আরম্ভ হইয়াছে? প্রমাণও তো যথেষ্ট পাচ্ছি, অর্থটা কি বল।”
কাদম্বিনী তাহার সকল যন্ত্রণা তখনকার মতো ভুলিয়া গেল। দারুণ উত্তেজনায় কঠিন স্বরে কাদম্বিনী বলিল–“তুমি হয়তো আমার পেটে ছেলে হবার কথা বলিতেছ?”
লোহারাম বলিল”হ্যাঁ, ব্যাপারখানা কী?”
“ব্যাপার কিছুই নহে। রাধা আমার স্বামী! তাহারি সহবাসে আমি অন্তঃসত্তা হইয়াছি।”
একটা জ্বলন্ত অগ্নিময় স্পর্শে লোহার বুকটা অকস্মাৎ ছ্যাৎকরিয়া উঠিল। সে অত্যন্ত ঘৃণার, সহিত বলিল–“রাধা তোমার স্বামী। আর আমি? কবে সে তোমাকে বিবাহ করিয়াছিল?”
কাদম্বিনী বলিল”কোনোও কালে মন্ত্র উচ্চারণ না করিলেও সে আমার অভাব দূর করিয়াছে, ভালবাসিয়াছে ও স্নেহ করিয়াছে। দুটি না বোঝা মন্ত্রের দোহাই দিয়ে তোমার মতো লম্পট আমার জীবনকে শ্মশান করে রাখবে, ইহা কোনো শাস্ত্র অনুমোদন করে না আর স্বামীই যদি হও তবে এর জন্যে দায়ী কে? এ পাপ ও কলঙ্কের কারণ তুমি। তুমি নরপিশাচা স্বামীর মূর্তিতে তুমি আমার বুকে ছুরি দিয়েছ।”
বাঘের মতো লোহারাম কাদম্বিনীর ঘাড়ের উপর যাইয়া পড়িল। যদি আইনের ভয় না থাকিত তাহা হইলে লোহারাম তদ্দণ্ডে কাদম্বিনীকে হত্যা করিত। লোহারাম কাদম্বিনীর চুল মুড়িয়া দিল। তাহার পরিধনের বস্ত্র কাড়িয়া লইয়া তাহাকে বাড়ির বাহির করিয়া দিল।
সেই রাত্রে গৃহ হইতে তাড়িত হইয়া কাদম্বিনী রাধার করুণা ভিক্ষা করিয়াছিল। নরপিশাচ রাধা কহিল ”ভদ্রলোকের মাথায় যদি কলঙ্ক চাপাও তাহা হইলে আমি তোমাকে জেলে দিতে ছাড়িব না”।
বতাহা আঁধারে নদীর কূলে অসহায় গৃহ হইতে তাড়িতা কাদম্বিনীর মৌন আত্মাটি কেমন করে নিজের কাছে কাঁদছিল–সে খবর রাখতে সকলেই লজ্জাবোধ করে বোধ হয়?