৩৬.
বসো বসো। খবরটা তা হলে পেয়েছিলে। স্নেহের উষ্ণতা রাকীব সাহেবের কণ্ঠে।
জী। কাউচের কোণায় জড়সড় হয়ে বসে মালু।
মৃদু হেসে কী এক আশাকে যেন রাঙিয়ে তোলেন রাকীব সাহেব। চোখ জোড়া তাঁর বারেক নেচে যায় মালুর দিকে চেয়ে।
বয়স তাঁর পঞ্চাশের গা ঘেঁষে। কিন্তু মুখটাতে নেই বয়সের ছাপ। মুখে তার শিশুর সারল্য আর মিষ্টি এক কোমলতা। যখন হাসেন সে মুখ কচি সবুজের দীপ্তি ছড়ায়। কচি সবুজ দীপ্তি ছড়িয়ে হাসছেন রাকীব সাহেব। কেন আসতে বলেছিলেন? যেন জড়ান মালুর স্বরটা।
কাল সকাল সাড়ে আটটায় মাইক্রোফোনে তোমার কণ্ঠ-পরীক্ষা। শৈলেন বাবুর সাথে কথা হয়ে গেছে আমার। একটা এনগেজমেন্টও করে এসেছি আজ বিকেল চারটায়। আগে থেকে একটু পরিচয় করে রাখা ভালো। বুঝলে না?
ও, এই জন্যই এমন মুচকি মুচকি হাসছিলেন রাকীব সাহেব? আনন্দে নেচে ওঠে মালুর মন। তুচ্ছ মনে হয় একটুক্ষণ আগের লাঞ্ছনাটা। আর এই মুহূর্তেই মালু যেন স্পষ্ট করে চিনল ওর সেই যন্ত্রণাকে যা ওকে অস্থির করে তুলেছিল অশোকের মেসে। সে তো ওর সুর, ওর গান। ওরা টেনে নিতে চায় মালুকে সেই মহাজগতের দিকে যেখানে মানুষ, যেখানে অগুনতি শ্রোতা, যেখানে ওর সকল গানের সকল সুরের সার্থকতা। অশোকের মেসে সে পথের সন্ধান পাচ্ছিল না মালু। তাই অস্থির হয়ে ছিল, মাথা কুটে মরছিল ওর গান, ওর সুর। সুরের হৃদয় আজ পেয়ে গেছে তার প্রকাশের পথ।
ভাবতেই কেমন লাগে মালুর। মনে মনে সে তো এই খবরটিরই অপেক্ষা করছিল গত কয়েক মাস ধরে।
তুমি তো দেখছি রেডি হয়ে আসনি। যাও, তিনটে বাজতে চলল প্রায়। এতক্ষণ আনন্দের আসমানে উঠিয়ে এবার বুঝি ওকে ধপ করে মাটিতে ফেলে দিলেন রাকীব সাহেব। কেমন করে তাকে বলবে মালু, ভদ্র সমাজে চলার মতো সেই যে তার এক জোড়া ধূতি আর পাঞ্জাবী, সেটা এখন উদ্ধারের অতীত?
এর চেয়ে ভালো পোশাক নেই আমার, মিথ্যে কথাই বলল মালু।
বিব্রত হয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন রাকীব সাহেব। তার পর উঠে গেলেন। ওয়ারড্রোবটা খুলে কয়েকজোড়া ধূতি-পাঞ্জাবী এনে রাখলেন মালুর সুমুখে। বললেন তুমি তো আবার লম্বার ধাড়ি। আমি হলাম গিয়ে ঠিক উল্টো, বেঁটেখাটো মানুষ। হাঁটু সমান কয়েকটা পাঞ্জাবী আছে আমার। দেখতো কোনো রকমে ভদ্রতা রক্ষা হবে কী না তোমার?
পরে দেখল মালু। কোনো রকমে কোমর অবধি এসেছে পাঞ্জাবীর ঝুল। চোখে ঠেকে, তবু ভদ্রতায় উতরে যাবে হয়ত।
কী হল? মুখ বেজার কেন? ভ্রূ কুঁচকে ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলেন রাকীব সাহেব। অমন চমৎকার খবর পেয়েও উৎফুল্ল হয় না ছেলেটা, বুঝি চিন্তায় পড়ে গেলেন রাকীব সাহেব
খাওয়া হয়নি। বলেই মুখটা নীচু করল মালু। এবার হো হো করে হেসে ওঠেন রাকীব সাহেব, তা এতক্ষণে বলতে হয়?
বয় এল।
কিছুক্ষণ বাদে খাবার এল।
আজ থেকে থাকার জায়গাও গেল, খেতে খেতে বলল মালু।
কেন গেল, কী হয়েছিল, কিছুই শুধালেন না রাকীব সাহেব। এক মনে মালুর খাওয়াটাই যেন দেখে গেলেন। মালুর খাওয়াটা শেষ হলে পরে বললেন, এখানেই থাকবে। কী বল?
বেশ। মালুর মুখ দেখে মনে হল না হাতে স্বর্গ পেয়ে তেমন খুশি হয়েছে ও।
কিন্তু মালু বুঝি আজ মরিয়া। কতটুকুইবা পরিচয় রাকীব সাহেবের সাথে। অথচ খাবার মাংলো তাঁর কাছে। আশ্রয় চাইল।
মালুর কোনো কথাই যেন না বলার নয় এই লোকটার কাছে।
একটি কাজ চাই আমার, আবার বলল মালু।
কী কাজ?
যে কোনো কাজ। বৌ বাজারে তো বাবুর্চি ছিলাম।
বাবুর্চি? বিশ্বাস করতে বুঝি কষ্ট হয় রাকীব সাহেবের। মালুকে তিনি দেখেছেন সুন্দর স্বাস্থ্য, পরিষ্কার পোশাকে উজ্জ্বল এক তরুণ। কণ্ঠের সুর যার ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।
গায়ে গতরে খাটতে আমার আলসেমি নেই। রাকীব সাহেবের আস্থা অর্জন করার জন্যই যেন বলল মালু।
সরল মুখখানিতে এবার ভেসে উঠল কী এক ব্যথার ছায়া। চোখের কোলে যেন অপার কোনো বেদনার ঠাঁই। ধরা গলায় বললেন রাকীব সাহেব : শিল্পী জাতটাই বড় অভাগা, মালেক। বড় অভাগা। এদের পেটে থাকে না ভাত, মাথা গুঁজবার মতো থাকে না একটুখানি আশ্রয়। তবু যে পথে অর্থ নেই, যে পথে নেই সচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তা সে পথটাই আঁকড়ে থাকবে এরা!
থামলেন রাকীব সাহেব। ব্যথা ছল ছল তাঁর চোখ জোড়া। সে চোখ গভীর এক মমতায় স্থির হয়ে থাকে মালুর মুখের উপর। বললেন, মালেক, এত কষ্টেও গান যখন ছাড়নি তুমি পুরস্কার তার পাবেই।
জাহেদের মতো অশোকের মতো রাকীব সাহেবও বুঝি ভবিষ্যৎবাণী করলেন। কিন্তু, সে নিয়ে এখন ভাববার সময় নয় মালুর। অথবা রাকীব সাহেবের আকস্মিক ভাবালুতায় আছন্ন হয়ে চুপ করে থাকবারও অবস্থা নয় তার। ও বলল : আমার চাকরির কী হবে?
হবে হবে। চল এখন বের হই। ওর কথাটাকে চাপা দিয়ে উঠে পড়লেন রাকীব সাহেব।
ধার করা ধূতি আর ধার করা পাঞ্জাবীতে জীবনের প্রথম পরীক্ষার প্রথম অঙ্কটা শেষ করে এল মালু।
যথা সময় অকৃতকার্যতার খবরটাও পেল।
আহা, মন খারাপ করো না। আমি বলছি, সাধনার ফল তুমি এক দিন পাবেই। সান্ত্বনা দেন রাকীব সাহেব।
ফুঃ। ফাঁকা আশ্বাস। সংগ্রাম সাধনা ধৈর্য তিতিক্ষা, সেই কবে থেকে অশোকের মুখে মালু শুনে আসছে কথাগুলো। আর সেই ছোট্ট বেলা থেকে গানই তো ওর ধ্যান মন। তবু তো রেডিও কর্তারা বলে দিয়েছেন, গলা তার এখনো উপযুক্ত হয়নি। মাইক ফিট করে না। অডিশন বড় খারাপ হয়েছে। আরো গলা সাধতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম চোট খেয়েই অতটা ভেঙে পড়লে? আরো কত যে চোট খেতে হবে? আবারও বললেন রাকীব সাহেব।
হুঁ, বলতে অমন সবাই পারে। সুর সরস্বতী আর লক্ষ্মী যার পায়ে লুটোপুটি খায়, গানের রেকর্ড যার ঘরে ঘরে তার তো মূল্যবান সব উপদেশ বিলানোরই কাজ। কিন্তু মালু তাতে আশ্বস্ত হবে কেমন করে? ওর এতদিনের সাধনা, এতবড় আশায় বুক বেঁধে অচেনা কলকাতার পথে নিঃসম্বল পাড়ি দিয়েছিল ও, সবই তো নস্যাৎ হয়ে গেল এক নিমিষে।
দেখ আগেই তো বলেছিলাম তোমায়, ভীষণ প্রতিযোগিতা এখানে। তার উপর মুসলমান তুমি। ভালো গায়ক-গায়িকা সবাই হিন্দু, যারা বাছাই করবেন তাঁরাও হিন্দু, সহজে কী আর ওরা চান্স দিতে চায় কোনো মুসলমানকে? মালুর অন্তর্নিহিত প্রতিভায় আস্থা সৃষ্টির উদ্দেশেই বুঝি কথাগুলো বললেন রাকীব সাহেব।
ধোপে যারা টেকে না তাদের জন্য এ ছাড়া আর সান্ত্বনাই বা কী! কেমন ম্লান হেসে বলল মালু। যেন আলপিনের খোঁচা খেয়ে চমকে তাকালেন রাকীব সাহেব। বাবুর্চিগিরি করে যে ছেলে গান শিখে এ তো তার কথা নয়?
তা ছাড়া ওরা তো একেবারে নাকচ করেননি তোমাকে। এক মাস পরে তো আবার যেতে বলেছেন। এবার একটা নিশ্চিত আশা মালুর সুমুখে তুলে ধরলেন রাকীব সাহেব।
হু, অসম্ভবের আশা নিয়েই তো বেঁচে থাকে মানুষ। কথাটা বলে আবার কেমন ম্লান করে হাসল মালু।
রাকীব সাহেবও হাসলেন।
হাসির মাঝে পরস্পরকে যেন বুঝে নিল ওরা।
মালু নেবে গেল নিচে, ওর কাজের জায়গায়।
সাজে গোজে মাঝারি গোছের দেশীয় হোটেল। তিন তলা। দোতলা আর তিন তলাটা আবাসিক। এক তলায় ভোজন ঘর এবং রেস্তোরাঁ। অপরিষ্কার নয়। পরিষ্কারও নয়। যেমনটি হয় মাঝারি পর্যায়ের হোটেলগুলো। তিন তলায় দুটো কামরা নিয়ে একক বাস রাকীব সাহেবের। নিউ গ্র্যান্ড হোটেলের আট আনা মালিক ষোল আনা পরিচালক শচীন বাবু। রাকীব সাহেবের গুণমুগ্ধ এবং বন্ধু। সেই খাতিরেই নতুন কাজটা হয়ে গেল মালুর। বিল লেখা এবং হিসেব মেলানো। ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তিন তলার চিলেকামরার এক অংশে, বাকী অংশটা ভাঙা আসবাব এবং ইঁদুর পরিবারের দখলে।
মন্দ লাগে না মালুর নতুন কাজটা। সবাই বাঁধা খদ্দের, বাকীর খাতায় সই দেয়ার দলের। ঝামেলা কম। যথেষ্ট সময় পায় মালু গলা সাধবার। তার চেয়েও বড় কথা রাকীব সাহেবের সান্নিধ্য। তাঁর সুরভরা কণ্ঠটি শোনবার অবিমিশ্র সুযোগ।
যত দেখছে রাকীব সাহেবকে ততই অবাক হচ্ছে মালু। মুখে যেমন শিশুর সারল্য তেমনি ভেতরটা। অন্তর তাঁর সারাক্ষণ যেন কেঁদে চলেছে পৃথিবীর অনন্ত বেদনায়। যে বেদনা সমস্ত রাগিণীর উৎস। সেই অনন্ত বেদনারই একটি খণ্ডরূপ তার আপন সমাজ, আপন পরিবেশ, সে পরিবেশের বিরুদ্ধে যুঝে যুঝে আপনার সুরের জগৎটাকে দিনে দিনে বিস্তৃত করে চলেছেন তিনি।
মালুর মনে পড়ে সেই প্রথম দিনটির কথা। আসর বসেছে অশোকের সেই ঘরটিতে। একটি ভাটিয়ালী শোনালেন রাকীব সাহেব। তন্ময় হয়ে শুনল মালু। এ যেন সেই দখিন ক্ষেতের বুক চিরে তর তর করে বয়ে যাওয়া বড় খালের সুর, তালতলি বাকুলিয়ার সুর। মালুর আপনার সুর, ওর অস্থি পাঁজরে মিশে থাকা সুর। তবু রাকীব সাহেবের মতো অত দরদ, অত আবেগ দিয়ে তো কোনো দিন গাইতে পারেনি মালু?
গান থেমে গেলেও সুর চলছে মালুর সূক্ষ্ম তন্ত্রীলোকে। কী এক আচ্ছন্নতা ঘিরে নিয়েছে ওকে।
আমাদেরই দেশের ছেলে, শুনুন ওর গান। হঠাৎ হারমোনিয়ামটা ওর দিকে এগিয়ে দেয় অশোক।
সেই আচ্ছন্নতার ঘোরেই তালতলির একটি পরিচিত গান গেয়ে যায় মালু। শুনে কী এক উল্লাসে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠেন রাকীব সাহেব। আহা এ-যে আমার গ্রাম বাংলার মিঠে সুর গো। গাও গাও। আর একটি গাও। কলকাতা শহরে বসে অমন খাঁটি আর মিঠে সুর কী মাথা কুটলেও পাওয়া যায়?
পল্লীগীতির সম্রাট রাকীব সাহেব। জনপ্রিয়তার শিখরে সার্থক শিল্পী, নাম তাঁর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। মুকুটহীন সেই সম্রাটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়, অভিভূত আচ্ছন্নতায় মুক হয়েছিল মালু।
সেই যে প্রশংসা, সে তো শুধু মামুলি দুটো উৎসাহ-বচন ছিল না? সে ছিল এক স্বীকৃতি মালুর শিল্পী-জন্মের এক মহাসনদ।
অপার বিস্ময়ে সেদিন নিজের দিকে তাকিয়েছিল মালু। আপনার গভীরে কী এক আলোড়ন, কী এক সত্তার এক চকিত স্পন্দন। চমকে উঠেছিল মালু। সে ছিল বুঝি পরিপূর্ণ এক শিল্পী-সত্তার উন্মেষ লগ্ন। যে সত্তা জন্ম দিল একটি চেতনার, শিল্পীর গুণাবলীর নিজস্ব এক মূল্য-উপলব্ধির। আশ্চর্য সেই অনুভব, জনপ্রিয় শিল্পীর সাথে ওর যে দূরত্ব সে দূরত্বটা যেন এক নিমেষেই ঘুচিয়ে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল মালুর, ওরা সমধর্মী নয় শুধু, ওরা সমমর্মী।
সে জন্যই বুঝি রাকীব সাহেবের কাছে অমন অকপটে নিজের কথাগুলো আজ বলতে পেরেছে ও। দ্বিধা আসেনি খাবার চাইতে সাহায্য প্রার্থনা করতে। বাকুলিয়ার মালু হৃদয়ে যার সুরের মন্থন, তার কাছে এ ছিল এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার। একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা। অপরিচিত এক অনুভূতি। দেশে দেশে সকল সৃষ্টি-সাধকই বুঝি এমনি আচমকা খুঁজে পায় আপনার শিল্পী সত্তা, আপনার সৃষ্টি-চৈতন্য। আর তখন ভেঙে যায় দেশ কাল ধর্ম গোত্রের গণ্ডি। ওরা তখন পৃথিবীর আনন্দ উৎসবে এক সুর এক হৃদয়।
গালে হাত দিয়ে ভাবনাটা শেষ হলে পর এই বিলগুলো টোটাল করে রাখবেন। কয়েক তোড়া বিল মালুর সুমুখে টেবিলের উপর রেখে মৃদু হাসলেন শচীন বাবু।
এটাই শচীন বাবুর স্বভাব। শিল্পানুরাগী মনটি তাঁর সব সময় প্রশ্রয় দিয়ে চলে মালুকে। সকালের দিকে গলা সাধতে গিয়ে দেরি হয়ে যায় মালুর। কখনো ডেকে পাঠান না শচীন বাবু। রাকীব সাহেবের ঘরে দুজনে মিলে কোনো একটি গানের সুর অথবা উৎপত্তি নিয়ে মেতে যায় আলোচনায়, নিঃশব্দে পাশে গিয়ে বসবেন শচীন বাবু। একমনে শুনবেন ওদের আলোচনা। আলোচনা শেষ না হলে পাড়বেন না কাজের কথাটা।
তাড়াতাড়ি হিসেবে মন দিল মালু। মোট অঙ্কগুলো নামে নামে মিলিয়ে তুলে রাখল খাতায়। কয়েকটা নতুন বিল তৈরি করে হাই তুলল। ফরমাশ দিল, এক কাপ চা।
এ ভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছ কেন? দু একটা জলসা টলসায় আস। চল রেডিওতে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি তোমায়। বার দুই ওর গান শোনার পরই কথাটা পেড়েছিল রাকীব সাহেব। আর সেই প্রথম বেতারে কণ্ঠ তুলবার একটি প্রচ্ছন্ন অভিলাষ বাসা বেঁধেছিল ওর মনের ভেতর। কিন্তু এড়িয়ে গেছিল মালু। নিজেকে নিয়ে তখনো তার অনেক লজ্জা।
রাকীব সাহেব, যেন পথ চলতে চলতে কুড়িয়ে পেয়েছেন মানিক। সে মানিক নিয়ে তার মহা আনন্দ। ব্যস্ত মানুষ তিনি। চারিদিকে তাঁর ডাক। তবু অশোকের আসরে সহজে কামাই দেন না তিনি। মালু, গান শুনতে এলাম তোমার। চোখ বুজে তন্ময় হয়ে শোনেন মালুর গান। কদাচ এখানে সেখানে শুধরিয়ে দেন দু একটি টান। আসর শেষে গল্প করেন। গল্প শেষে মালু এগিয়ে দেয় বাস স্টপে।
জান ভাই। মুসলমান ছেলেরা বাজনা শিখছে গান শিখছে দেখলে বড় ভালো লাগে আমার। ভালো লাগার কথাটা বলেই বিষণ্ণ আর ম্লান হয়ে যান রাকীব সাহেব। বুঝি হারিয়ে যান ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিতে। টুকরো টুকরো কথায় উঠে আসে তার অতীত। বি.এ. পাস করে সরকারি চাকুরে হব এই ছিল বাবার স্বপ্ন। আমিও সেই স্বপ্নটাকেই মেনে নিয়েছিলাম। চাকরিতেই সচ্ছল জীবন, সামাজিক মর্যাদা। কিন্তু কী যে হল মনটার। বইয়ের পাতা ফেলে সুরের পেছনে ছুটে যায় মন। যেখানে গান সেখানে ছুটে যাই। বি.এ পরীক্ষা না দিয়েই পালিয়ে যাই বাড়ি থেকে। বাড়ি বিমুখ। আত্মীয়-স্বজনের মুখ ভার। বি. এ. পাস করে ছেলে হবে জজ ম্যাজিস্ট্রেট নতুবা কাছাকাছি কিছু। তা না, ছেলে চলেছে গান শিখতে? ছিঃ। গাইয়ে বলে কী ছেলের পরিচয় দেয়া যায় সমাজে না পাওয়া যায় ভালো একটা বিয়ের সম্বন্ধ? তা ছাড়া গাইয়ে ছেলের ভবিষ্যৎ-ই বা কী?
তবু মন আমার ফিরল না। সুরের পৃথিবী যে আমায় টেনে নিয়েছে তার কোলে। আত্মীয়-পরিজনের বিরাগ ভ্রূকুটি, সমাজের নীরব অবহেলা আরও কত দুর্গতি যে জুটল কপালে। আশীর্বাদ বলে গ্রহণ করলাম সে সব লাঞ্ছনা। সময় সময় উত্যক্ত হয়ে ক্ষেপে যেতাম, মুষড়ে যেতাম হতাশায়। তবু গান ছাড়বার কথা ভাবতে পারতাম না। সুরের সুধা একবার যে পান করেছে, সে কী ছাড়তে পারে তার মায়া? বলতে বলতে রাকীব সাহেবের চোখ জোড়া ছল ছল করে উঠত।
.
শ্রদ্ধায় মাথা নত করত মালু। শিল্পীর চিরন্তন বেদনায় টনটন করে উঠত ওর বুকের ভেতরটা।
নিউ গ্রান্ড হোটেলে দিন কাটে।
একমাস। দুমাস। যথারীতি কণ্ঠ পরীক্ষা দিয়ে আসে মালু। যথা পূর্বং উত্তর পায় আবার আসবেন।
স্বীকৃতির পথ যে কঠিন পথ, মালেক। আশ্বাস যুগিয়ে চলেন রাকীব সাহেব।
কেন মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছেন রাকীব ভাই?
মিথ্যে আশ্বাস? বুঝি আহত হন রাকীব সাহেব।
ওসব রেডিও ফেডিও আমার ভাগ্যে হবে না, বুঝে নিয়েছি, এখন অন্য পথ ধরতে হবে আমায়।
অন্য পথ?
রাস্তায় রাস্তায় গাইব আমি। তবু তো মানুষ শুনবে আমার গান?
হাসেন রাকীব সাহেব, দুষ্টু ছেলের পাগলামো দেখে যেমন করে হাসেন বড়রা, বলেন, বড্ড অস্থির হয়েছ।
নীরব হয় মালু। অস্থিরতা যদি অভিযোগ হয়, সেটা অস্বীকার করবে না মালু। ওর অন্তরের গভীরে যে অস্থির কল্লোল। ওর সুর ওর গান খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ডানা ঝাপটিয়ে প্রকাশের মুক্তি কামনায় অধীর। এই সুরের প্রাণটাই তো ওকে টেনে এনেছিল শহর কলকাতায়। এই সুরের প্রাণটি নিভৃত ঘরের একাগ্র সাধনায় আজ আর তৃপ্তি পায় না। সে চায় প্রকাশ। সে চায় গান শোনাতে। এই প্রকাশের বেদনাই তো অশোকের মেসে অস্থির করে তুলেছিল ওকে। রাকীব ভাই কী বুঝে না এই অস্থিরতার অর্থ?
আচ্ছা আমি নিজে যাচ্ছি। দেখি কী করতে পারি। এবার শুধু আশ্বাস নয়, একটা প্রতিশ্রুতি দিলেন রাকীব সাহেব।
দুটো টেলিফোন করলেন রাকীব সাহেব। ঘুরে এলেন রেডিও অফিসটা। মালুকে ডেকে বললেন, ক্যাজুয়েল আর্টিস্টের লিস্টিতে তোমার নাম ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম। এবার একটা চান্স তুমি পাবেই। অধৈর্য হয়ো না। কবে আসবে সেই চান্স?
কাবার হয়ে যায় মাস অধীর প্রতীক্ষায়। মাসের পিঠে মাস যায় ফুরিয়ে। এমন সময় গান গেল থেমে।
সুর হল স্তব্ধ।
৩৭.
দূরে কিসের যেন হল্লা। প্রথমে লঘু পরে কিঞ্চিৎ ভারি হয়ে আসে হল্লার মিশ্র আওয়াজ। কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করল মালু। অনেক কণ্ঠের শ্লোগান। আওয়াজ তার ক্রমশ উঁচুতে উঠেছে। স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল শ্লোগানগুলো। ছ্যাঁত করে কানে এসে ধাক্কা খেলো কয়েকটি পরিচিত স্লোগান।
নারায়ে তকবীর–আল্লাহ-আকবার।
এ পাড়ায় তো এ ধ্বনি শোনার কথা নয়?
মাসিকের পাতায় চোখ বুলোতে বুলোতে বুঝি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন রাকীব সাহেব। শ্লোগানের ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠলেন। আলগোছে ধরে রাখা মাসিকটা পড়ে যায় তার হাত খসে।
হঠাৎ চুপ চাপ। অসংখ্য ত্রস্ত পলায়নী পায়ের প্রতিধ্বনি দেয়ালে দেয়ালে আঘাত খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্লোগানগুলো প্রথমে বিক্ষিপ্ত পরে ক্ষীণতর হয়ে আসে। আবার সব কিছু স্তব্ধ হয়ে যায়।
ঠুক ঠুক টোকা বাজে দরজায়
ভেতরে আসুন।
প্রায় হুড় মুড় করে ঘরে ঢুকলেন শচীন বাবু। সে উত্তেজনাটা চাপতে গিয়েই শ্বাস পড়ছে তাঁর ঘন ঘন।
ব্যাপার-স্যাপার তো খুব ভালো ঠেকছে না রাকীব ভাই। দাঙ্গা বুঝি লেগেই গেল। তুমি এখুনি সরে পড়। বলা তো যায় না…
কী বললে? বুঝি তড়িতাঘাতে ছিটকে পড়েন রাকীব সাহেব। কিন্তু তক্ষুণি সামলে নেন। বসেন, পিঠটা খাড়া করে। দপ করে জ্বলে ওঠেন, কেন, কেন আমাকে সরতে বলছ শচীন?
আকস্মিক উগ্রতার মুখে চট করে কথা জোগায় না শচীন বাবুর। আর এই উগ্রতাটা যে বন্ধুত্বের অভিমান সেটা লক্ষ করে কী এক বেদনার কাতরতায় স্নান হয়ে আসে শচীনবাবুর মুখখানি।
বিপদ আছে বলেই তো বলছি। গলাটাকে খাট করে বললেন শচীন বাবু।
বিপদ? দশ বছর রইলাম এ পাড়ায় কোন লোকটা আমায় চেনে না বলতো? আর এখানে আমার বিপদ? সেই আহত অভিমানের কণ্ঠ রাকীব সাহেবের।
চেনে বলেই তো আশঙ্কাটা বেশি আমার। দিন কাল খারাপ। কার মনে কী আছে কে জানে?
বুঝেছি…। বাকী শব্দগুলো উচ্চারণ না করেই থেমে গেলেন রাকীব সাহেব। কী বুঝেছেন সেটাই বুঝি একটু খতিয়ে দেখছেন।
গোঁয়ার্তুমির কোনো অর্থ হয় না, নীরব বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন শচীন বাবু।
নীরবে ভাবছেন রাকীব সাহব।
দূর থেকে আবার হল্লা ভেসে আসে। ভাববার সময়ও যে বড় অল্প। সব দিক বিচার করে চলে যাওয়াই স্থির করলেন রাকীব সাহেব। একটা মিনিট দাঁড়াও। রাস্তাটা পরিষ্কার হল কিনা দেখে আসি। হুঁশিয়ার মানুষ শচীন বাবু। সব রকমের সতর্কতা না নিয়ে বন্ধুকে রাস্তায় ছেড়ে দিতে নারাজ। আস্তে করে দরজাটা ভেজিয়ে বেরিয়ে যান শচীন বাবু।
পাশের কোনো ঘরে টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। সে শব্দটা কী এক বিলম্বিত লয়ে ওদের ঘরে পৌঁছে যেন আর বেরুবার পথ পাচ্ছে না।
এক মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট কাটিয়ে ফিরে আসেন না শচীন বাবু। এবার উল্টোদিকে হল্লা উঠেছে।
হল্লার আওয়াজটা কখনো বাড়ছে কখনো কমছে।
টিক টিক, সময়ের গতির সেই শব্দটা মাঝে মাঝেই মনে হয় থমকে থাকছে। অবশেষে ঘণ্টা কাবার করে ফিরে এলেন শচীন বাবু। চোখ মুখ উদ্বেগ ব্যাকুল।
রাস্তার ভিড়টা কমেছে। কিন্তু চৌমাথায় আর হোটেলের উল্টোদিকের রোয়াকে জটলা। আলাপী মানুষের জটলা নয়। পাড়ার বখাটে সব ছোকরা আর সন্দেহভাজনদের কী যেন ফিস ফিস পাঁয়তারা। ওদের হাবভাব মোটেই ভালো মনে হচ্ছে না শচীন বাবুর।
তা হলে? চিন্তান্বিত স্বরেই শুধালেন রাকীব সাহেব।
তা হলের জবাব না দিয়ে খবরগুলো জানিয়ে যায় শচীন বাবু। এখানে সেখানে হানাহানি লুঠতরাজ শুরু হয়ে গেছে। কর্পোরেশন স্ট্রীটের সোনারুদের দোকানগুলো সবই নাকি লুঠ হয়ে গেছে। মানিকতলার মুসলমানদের একটা বস্তি নাকি পেট্রল ছিটিয়ে মানুষ সুদ্ধ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়েছে। সেই ছাই গায়ে মেখে কুচকাওয়াজ করছে ভলান্টিয়ার বাহিনী। হোটেলের দোতলায় সেই যে ইম্পিরিয়াল টোব্যাকোর মুসলমান ভদ্রলোকটি ছিলেন তাঁকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিল শচীন বাবু সন্ধ্যা সন্ধ্যিই। শচীন বাবুর ছোট ভাই তাকে পৌঁছে দিয়ে এই মাত্র ফিরে এল। তার কাছে থেকেই এসব খবর নিয়ে এসেছেন শচীন বাবু। নিজেও কিছুদূর গিয়ে দেখে এসেছেন শচীন বাবু। বেশি দূর এগুনো যায়নি। মোটকথা রাস্তায় বের হওয়াটাই এখন বিপজ্জনক।
তা হলে? আবার শুধালেন রাকীব সাহেব। এ অবস্থায় হোটেলে থাকাটাই তো সমীচীন মনে করছি আমি।
হোটেলে আমি রয়েছি, কোন ব্যাটা কী করবে? এবার রাকীব সাহেবের প্রশ্নটার জবাব দিল শচীন বাবু।
ঠিক হল কামরাতেই থাকবে ওরা। শচীন বাবু নিজে পাহারা দেবেন। শেষ রাতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে দাঙ্গাবাজরা তখন ওদের পৌঁছিয়ে দেবেন নিরাপদ অঞ্চলে।
যাবার আগে বাতিটা নিবিয়ে দেন শচীন বাবু। কয়েকটা মোম টেবিলের উপর রেখে বলেন, তোমার ঘরটা তো কারুর না চেনার কথা নয়? একান্ত প্রয়োজন পড়লে মোমবাতি ধরিয়ে নিও।
শুয়ে পড়লেন রাকীব সাহেব। মালুকেও ডাকলেন, উপরে গিয়ে আর কাজ নেই তোমার, এস এখানেই একটু গড়িয়ে নেয়া যাক।
কিন্তু, গড়ান তার হল না। পাড়া কাঁপিয়ে, আকাশ ফাটিয়ে স্লোগান উঠেছে বন্দে মাতরম্। ধুস ধাস শব্দ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা খুলে যাচ্ছে বাড়ির জানালা। সব লোক নেবে এসেছে রাস্তায়, বাড়ির ভেতর শাঁখ বাজাচ্ছে মেয়েরা।
হোটেলের বাসিন্দারা সব বারান্দায়।
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন রাকীব সাহেব।
খড়খড়িটা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকাল মালু। রাস্তা আর গলিতে গিস গিস মানুষের ভিড়। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে চেলা ফাড়বার ভোঁতা দা। কারো হাতে ইটের টুকরো। খবর পাওয়া গেছে ওদিক থেকে মুসলমানরা নাকি নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসছে। যে কোনো সময় এ পাড়ার উপর হামলা হতে পারে। এ পাড়াও তাই প্রস্তুত হচ্ছে।
সবার মুখে শঙ্কিত উত্তেজনা। চাপা কণ্ঠের ফিস ফিসানি। কানে কানে কথা বলা। চাপা হুংকার। মানব কণ্ঠে যে কত রকমের ধ্বনিতরঙ্গ সম্ভব এর আগে কখনো বুঝি জানবার বা শুনবার সুযোগ পায়নি মালু। হ্রস্বদীর্ঘ চিকন মোটা কর্কশ মোলায়েম খনখনে ঝনঝনে ভীতি চাপা হিস হিস তর্জন গর্জন, এ যেন কণ্ঠধ্বনির কোনো সমবেত যজ্ঞকাণ্ড। সেই ধ্বনি যজ্ঞের আড়ালে কী এক জান্তব বীভৎসতা যেন ওত পেতে রয়েছে। ক্ষীণ সেই শব্দাবরণ খুঁড়ে এখুনি বুঝি কোনো বিকট দানব ভয়ঙ্কর মুর্তিতে আত্মপ্রকাশ করবে।
হঠাৎ ছিঁড়ে গেল সন্দেহ ফিস ফিসানির ভারি পর্দাটা।
বন্দেমাতরম্। এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি, এ পাড়া থেকে সে পাড়া ক্রমশ দূরে সরে যায় আওয়াজটা।
যেন তীর খেয়ে লাফিয়ে ওঠেন রাকীব সাহেব। ভয়ে, ত্রাসে শুকিয়ে এসেছে তাঁর মুখটা।
বন্দেমাতরম্। বন্দেমাতরম্। এবার সেই দেয়াল কাঁপা, আকাশ ফাটা গর্জন ওদের চারপাশ ঘিরে। হোটেলের ভেতরেও। সে কী গর্জন! কানে যেন তালা লাগবে।
দুহাতে কান ঢেকে চোখ বোজেন রাকীব সাহেব। খড়খড়িটা বন্ধ করে দেয় মালু। কী মনে করে আবার একটুখানি ফাঁক করে রাখে।
সেই আগের মতোই স্লোগানটা ক্রমশ পেছনে থেকে পেছনে সরে যায়। তার পর সবই স্তব্ধ।
হোটেলবাসীরা যে যার ঘরে গিয়ে খিল এঁটেছে। মুসলমানরা নাকি আপাতত আসছে না এ পাড়ায়।
আল্লাহু-আকবর আর বন্দেমাতরম, দুটো শব্দ দুটো ধ্বনিই আবাল্য শোনা মালুর। কী এক ঝংকার, কী এক ছন্দের মতো শব্দ দুটো বাজতো ওর কানে। কিন্তু, আজ শুধু পাশবিকতার হুংকার হয়েই যেন ধেয়ে আসছে সে ধ্বনি। উলঙ্গ হিংস্র এক মৃত্যুর ঘোষণা সে ধ্বনির আড়ালে।
বুঝলে মালু? বড় ভুল হয়ে গেছে। সন্ধ্যেসন্ধিই আমাদের কেটে পড়া উচিত ছিল। এখন তো দেখছি একেবারে বেঘোরে মৃত্যু। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না রাকীব সাহেবের চেহারা। কিন্তু শুকনো গলার কম্পিত স্বরে লুকোনো থাকছে না তার ভয়টা।
ঘণ্টা আড়াই আগেও পালানোর কথায় ক্ষেপে গেছিল সে লোক। এ কী তার গলা? মনে মনে না হেসে পারল না মালু।
ভয়ডর যে মালুর নেই তা নয়। কিন্তু রক্ত মাংসের শরীরটার প্রতি যে এক ধরনের ভীরু মমতা সেটা যেন কোনো দিনই অনুভব করেনি ও। জানের ভয়টা কখনো বেচাইন করেনি ওকে। হয়ত তেমন পরিস্থিতিতে এখনো পড়েনি ও। অথবা মৃত্যুকে ভয় করবার মতো বয়সই হয়নি ওর।
নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল।
মোমটা জ্বালিয়ে কাউচে গিয়ে বসলেন শচীন বাবু।
ভয়ে বুঝি কাঠ হয়ে বসে আছেন রাকীব সাহেব। কাউচের কোলে তাঁর আড়ষ্ট শরীরখানা কিছুতেই যে সহজ হতে পারছে না। শচীন বাবুকে কাছে পেয়ে ধড়ে যেন প্রাণটা ফিরে এসেছে তাঁর। কী ব্যাকুলতায় শুধালেন, কী খবর শচীন।
খবর খুব ভালো না রাকীব ভাই, এই যে পেছনের গলিতে দুঘর মুসলমান ছিল, ওদের সব শেষ হয়ে গেল। শচীন বাবুর থমথমে মুখে উদ্বিগ্ন মনের ছায়া।
স…ব। জান মাল?
স…ব। বাইরের মৃত্যুটা যেন চুপিসারে ঢুকে পড়েছে ওদের ঘরে। মৃত্যুর মতোই স্তব্ধতা ঘরময়। শুধু মোমের শিখাটি মৃদু কাঁপছে।
বদ্ধ জানালার পাশে বসে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে রাতের কোলে পড়ে থাকা নিঃসাড় রাস্তাটাকেই যেন একমনে দেখে চলেছে মালু। এরি মাঝে বুঝি পাড়ার রক্ষী বাহিনী তৈরি হয়ে গেছে। কয়েকজন রক্ষী এদিক সেদিক ঘুরে এসে রোয়াকের উপর বসে পড়েছে। ওদের দেখাদেখি গলির ভেতর থেকে বড় রাস্তার বাড়ি থেকে দুচার জন করে লোক এসে জমছে। আবার সেই হিস হিস কথা কানে কানে ফিসফিসানি।
মালুর মনে হল গোটা পাড়াটাই আসলে ভীতির কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। ভয় পেয়েছে বলেই মানুষগুলো চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে পরস্পর থেকে সাহস সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। ফিস ফিস গলাটা আর কিছুই নয়, শুধু পড়শির কাছে থেকে একটু ভরসা চাওয়া পড়শিকে জানিয়ে দেয়া আমিও আছি।
রাকীব ভাই, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। আমি আছি নিচে। আস্তে করে দরজাটা ভেজিয়ে নেবে যান শচীন বাবু।
ঘুম কোথায়!
সকালে উঠে সূর্যালোকে ঝলমল পৃথিবীটার উপর চোখ বুলিয়ে, বুক ভরে বাতাস টেনে নিশ্বাস নেবার নিশ্চয়তাটা যখন খুঁজে পাওয়া যায় না, মনের ভেতর তখন কী ঘুম আসে চোখে?
জানালার পাশেই বসে বসে কখন নাক ডাকাতে শুরু করেছে মালু। ফুঁ দিয়ে মোমটা নিবিয়ে দিলেন রাকীব সাহেব। বসে বসে বুঝি ঝিঁ ঝিঁ লেগে গেছে পায়ে। বার কয় পায়চারি করলেন। খুলে দিলেন রাস্তার দিকের দুটো জানালা।
কিন্তু, একি! তাঁর চোখের ধাঁধা? তাঁর মনের ভয় আশঙ্কা দুশ্চিন্তা রেণু রেণু খসে পড়ে কী আগুনের সমুদ্র বানিয়েছে তার অজানতে, তারই চোখের সুমুখে? সে আগুনের লাল আলোয় ভরে গেছে অন্ধকার ঘর? চোখ কচলিয়ে জানালার দিকে আর একটু এগিয়ে যেতে বুঝি মালুর গায়ে হোঁচট খেলেন রাকীব সাহেব। ভেঙে গেল মালুর ঘুমটা।
কলকাতার বিজলী আলোকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে বুঝি আগুনের আলো জ্বলছে আকাশে।
ইস্ রাকীব ভাই। কী রকম আগুন লেগেছে, দেখেছেন! এতক্ষণে বুঝি টের পেল মালু।
কোথায়? কেমন বিভ্রান্ত স্বর রাকীব সাহেবের।
আকাশের দিকে চেয়ে তো মনে হয় গোটা কলকাতায়, বলল মালু। নিস্তব্ধ হোটেল।
ঘুমের মতো নিস্পন্দ চৌ-মাথা, গলিপথ। শুধু দূর আগুনের লাল ছায়া কেঁপে কেঁপে যায় ওদের ঘরের ভেতর।
দুম দাম। পটাপট কয়েকটা শব্দ হল।
হোটেলের ফটকে কিল পড়ছে।
একটা। দুটো। তারপর অনেক ঘুষি।
পা টিপে টিপে নিঃশব্দে শচীন বাবু এসে ঢুকলেন ঘরে।
এই, নেবে এস শীগগীর। কয়েকটা গুণ্ডা কিসিমের লোক দরজা খুলতে বলছে। অনবরত ধাক্কা দিয়ে চলেছে।
শীগগীর এস।
চেতনালুপ্ত সম্মোহিতের মতো শচীন বাবুর পিছু পিছু নেবে আসে ওরা। প্যান্ট্রির পেছনে কয়লালাকড়ীর অন্ধকার ঘরটায় ওদের সেঁদিয়ে দেয় শচীন বাবু। ফিস্ ফিসিয়ে বলে, চুপ চাপ পড়ে থাক। কোনো ভয় নেই। কামরায় কামরায় বাতি জ্বলে উঠেছে। হোটেলবাসীরা বেরিয়ে এসেছে চত্বরে, বারান্দায়। কৈফিয়ত চাইছে ওরা…দুটো মুসলমানকে বাঁচানোর জন্য এতগুলো হিন্দু সন্তানের জীবন বিপন্ন করার কী অধিকার আছে শচীন বাবুর।
বাইরের লোকগুলোরও মেজাজ বিগড়েছে। করাঘাতের পরিবর্তে পদাঘাত পড়ছে দরজায়। চিৎকার করে বলছে, প্রাণের মায়া থাকলে দরজা খোল শীগগীর। আবার অভয় দিচ্ছে জাত ভাইদের। আপনাদের কোনো ভয় নেই। খুলে দিন দরজাটা। ওই দুটো মুসলমানকে নিয়েই চলে যাব আমরা। যেন এতক্ষণ কিছুই টের পায়নি, শোরগোলে ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় ঈষৎ বিরক্ত হয়েছেন মাত্র, এমনি একটা নির্দোষ মুখভাব করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন শচীন বাবু।
আসুন, কী চাই।
শালা এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে বলে কিনা আসুন? শচীন বাবুকে কনুইর গুঁতোয় পাশে সরিয়ে ভিতরে ঢুকল ওরা। টপাটপ সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে গেল তেতলায়।
ঘর খালি।
সেই চিলে কোঠা, ছাদ, তেতলা দোতলা একতলা সব ঘরই তন্ন তন্ন খুঁজল ওরা।
না। মুসলমানগুলো নেই।
শালা আস্ত শয়তান। সরিয়ে দিয়েছে। কাট, এই শালাকেই কাট। কোমরের ভাঁজ থেকে ছুরি বের করে নেয় ওদের একজন। ছুরির ফলাটাকে বার দুই চক্কর খাইয়ে ছুটে আসে শচীন বাবুকে লক্ষ্য করে। চুপচাপ চেয়ে রয়েছেন শচীন বাবু। যেন কেটে ফেললে খুব বেশি অসুবিধা হবে না তাঁর।
না কেটে লাভ নেই। ছেলে পুলে সায় সম্পত্তি সহ পুড়িয়ে মার শালাকে। পেট্রোল ছিটিয়ে শালার হোটেলে আগুন লাগিয়ে দাও। নির্ঘাত অপমৃত্যু। পুড়িয়েই হোক আর কেটেই হোক মৃত্যুটা বুঝি বিনা ভোটেই পাস হয়ে যায়। দু পা এগিয়ে আসেন শচীন বাবু। বললেন : আপনারা এসব কী বলছেন : রাকীব সাহেব যে সেই বিকেলে বেরিয়েছেন আর তো ফেরেননি।
শালা মিথ্যুক। সেই প্রথম লোকটি, কেটে মারার পক্ষেই যার মত, সে-ই বলল।
চল চল ওই পাকঘরগুলো সার্চ করতে বাকী আছে এখনো। সর্দার গোছের লোকটা ডায়নিং হল দেখে এসে ডাক দিল ওদের। প্যান্ট্রির দিকে এগিয়ে গেল ওরা।
৩৮.
কী ভীষণ রাত! দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণার মতো, ভয়াল জন্তুর থাবার মতো গলার উপর চেপে থাকা এক রাত। এমন রাত-ও আসে মানুষের জীবনে? দোর গোড়ায় অপেক্ষা করছে মৃত্যু। নিষ্ঠুর নৃশংস মৃত্যু। ভেতরে কয়লা স্তূপের আঁধারে ধুক ধুক করছে দুটো প্রাণী সে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। এমন কালো রাতে, বিনা নোটিশে নির্দয় মৃত্যুর এমন অতর্কিত হানা, মৃত্যুকে তো এমন বীভৎসতায় কখনো কল্পনা করেননি রাকীব সাহেব? মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সম…কতদিন আত্মস্থ ধ্যানস্থ রাকীব সাহেব আহ্বান করেছেন এই শ্যামসম সুন্দর স্নিগ্ধ মধুর মৃত্যুকে। আর আজ? মিথ্যা। মিথ্যা মৃত্যুর সেই আধ্যাত্ম কল্পনা। মৃত্যু ভয়ঙ্কর বীভৎস। মৃত্যু জীবনেরই শেষ।
চাক চাক কয়লার স্তূপ। ছাদ অবধি কয়লার পাহাড়। এরি মাঝে কেমন একটা খোরলের মতো জায়গা করে বসে আছে ওরা। কোনো ধারাল কয়লা সুঁচলো মুখ দিয়ে অনবরত বিঁধে চলেছে ওদের। দম আসছে বন্ধ হয়ে। অন্ধকারে মৃত্যুর বিকট মূর্তিটাই নাচছে ওদের চোখের সুমুখে। আর সেই অবস্থাতেই জীবন মৃত্যুর একটি নতুন দার্শনিক সংজ্ঞা খুঁজে চলেছেন রাকীব সাহেব।
আর এক রাতের কথা মনে পড়ল মালুর। সেদিনও এমনি আগুনে আগুনে লাল হয়েছিল কলকাতার আকাশ। মানুষগুলোও ক্ষেপে গেছিল। কেন ক্ষেপেছিল, সবটা সেদিন বুঝতে পারেনি মালু, যেমন বুঝতে পারছে না আজকের এই নির্বোধ হল্লাটা। সে রাতের কথাটা মনে পড়তেই রাবুর মুখটাও ভেসে উঠলো মালুর চোখের সুমুখে। দিনভর গোটা শহরটাই বুঝি পায়ে পায়ে মাড়িয়েছে রাবু। বিকেলের দিকে টিয়ার গ্যাস খেয়েছিল ধর্মতলায়। সেখান থেকেই মালুকে বিদায় দিয়ে বলেছিল : রাত দশটার সময় জ্যাঠার বাসা থেকে তুলে নিবি আমায়। হোস্টেলে পৌঁছিয়ে দিবি।
শুনে হেসেছিল মালু। যে সংস্কার থেকে ভীতির জন্ম সেটা বুঝি এক জন্মেও তাড়াতে পারে না কেউ। বিশেষ করে মেয়েরা। নইলে ছোট বেলায় গাছে চড়া, এখন ইউনিভার্সিটি-পড়া জিন্দাবাদ দেয়া মেয়ে কলকাতার মতো শহরেও সন্ধ্যার পর একলাটি বের হতে সাহস পায় না কেন?
ঠিক সময়ই পৌঁছেছিল মালু। পার্ক স্ট্রীটে জাহেদের বাসায়। কিন্তু ফিরে আসতে পারেনি। গাড়ি ঘোড়া বন্ধ। তামাম শহরের ছেলে মেয়েরা ঘর ছেড়ে রাস্তাগুলো সব দখল করে বসে আছে। এখানে সেখানে ট্রাম পুড়ছে, টায়ার ফাটছে। গুলির শব্দে আতঙ্কিত কাকগুলো ডানা ঝাপ্টিয়ে অস্থির হয়েছে। কী এক উন্মত্ত উল্লাসে মানুষগুলো আগুনের হোলি খেলছে। আজকের মতোই পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়ার পুরু আস্তরে আচ্ছন্ন হয়েছে সে রাতের মহানগরী।
কী আজব এই কলকাতা। এমন সব কাণ্ড ঘটে যার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষগুলো যেমন বছরের পর বছর পড়শি হিসেবে বাস করেও চেনে না একে অন্যকে, চেনার কথা ভাবেও না, জানা তো দূরের কথা। তেমনি এখানকার সব ঘটনা বিচ্ছিন্ন, সূত্রহীন। হয়তো আছে যোগসূত্র আছে একের সাথে অন্যের গ্রন্থি যা এখনো জেনে উঠতে পারেনি মালু।
আঁতকে উঠে দুজনেই সচকিত হল ওরা। মৃত্যু বুঝি দরজার সুমুখেই। মড় মড়িয়ে এগিয়ে আসছে মৃত্যুর পা।
কারা যেন উঁকি মারল। কে যেন লাঠি ঠোকাল কয়লার চাকে। কোত্থেকে যেন টর্চের আলো পড়ল। ঘরের বালবটা বুঝি কবে থেকেই খারাপ হয়ে আছে।
ধ্যাৎ শালা, এ-তো কয়লা ঘর! চল্।
মৃত্যুটা কী দরজা থেকেই ফিরে গেল?
মৃত্যুর শেষ মৃত্যুই। মৃত্যুর শেষ জীবন, সে কদাচিৎ। কেননা জীবনের জন্য মৃত্যুটা দুর্লভ। কিন্তু রাতের পর দিন প্রকৃতির অমোঘ ধর্ম। সেই ধর্মের বিধানেই শেষ হল রাত। মৃত্যুর শেষ মৃত্যু। সে মৃত্যু এল না। এল দিন।
.
পূব আকাশে দিনের হাতছানিটা স্পষ্ট হবার আগেই ওদের গাড়িতে পুরে ষাট মাইল স্পীড নিল শচীন বাবু। এরা জীবনের রাজ্যে ফিরে এল। অনুরক্ত বন্ধু, শিষ্যটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় ছলছলিয়ে উঠল রাকীব সাহেবের চোখজোড়া। মনের অনুভূতিটা ব্যক্ত করতে গিয়ে শচীন বাবুর হাত ধরে কেঁদে ফেললেন তিনি। চোখের অশ্রু জানিয়ে দিল গভীর অন্তরের কথাটা।
বিশ্রী রকম ঝাঁকুনি খাচ্ছে গাড়িটা। কলকাতার মসৃণ রাস্তাগুলো কখন গাঁয়ের চাক উঠা ক্ষেতের মতো এ্যাবড়ো থ্যাবড়ো হয়ে গেছে ওরা জানে না। এখানে ভাঙা ইটের স্তূপ। ওখানে সেই রেল লাইনের সাদা কালো পাথর কুচির ঢিবি। কী হবে এই সব দিয়ে? কার মাথায় ছুঁড়ে মারবে?
ওকি? দিনের রাজপথে মানুষের লাশ? একটি দুটি নয়, অসংখ্য। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঢেলার মতোই রাস্তাময় ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য মরা মানুষ। কেন মেরেছে কারা মেরেছে ওদের? আর কী বীভৎস ওই মৃত মুখ, চোখের দৃষ্টি!
কলকাতা জনারণ্যের জ্যান্ত মানুষেরা সব গেল কোথায়? সার্সি এঁটে অর্গল তুলে ঘরের অন্ধকারে অধর্মরা? ভয়ঙ্কর কোনো আশঙ্কায় ধুক ধুক মুহূর্তগুলো গুণে চলেছে? না, ওরাও মৃত। তাই মহানগরীতে আজ জ্যান্ত মানুষ নেই, শুধু মরা মানুষ।
মানুষ আর যন্ত্রের বিচিত্র শব্দ গর্জনে চঞ্চল কোলাহলময় কলকাতা। তার সব শব্দ, সব কোলাহল কোনো নির্দয় গৌতমের অভিশাপে চির মৌনতার রাজ্যে হারিয়ে গেছে যেন। মালুর মনে হল গল্পে পড়া সেই দৈত্য বিধ্বস্ত কোনো পাতালপুরীর মতোই আজকের কলকাতা। আর এই প্রথম কী এক ভীতির কাঁপুনিতে শিরার রক্ত যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল মালুর। এই মৃতের নগরীতে শুধু ভয়। একটা মরা মানুষের বুকের উপর দিয়েই গাড়ির চাকাটা এগিয়ে যায়।
আ-হা-হা শচীন, একটু সামলে চল ভাই। দুহাতে মুখ ঢাকলেন রাকীব সাহেব। মৃতের ব্যথা হয়ত জ্যান্তদের চাইতে একটুও কম নয়।
শচীনদা শচীনদা থামুন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মালু।
থামবে কী! কোন গলিতে কারা ওত পেতে আছে কে জানে? তবু পেছনে সিটের দিকে ঘাড়টাকে একটু কাত করে দেখে নিলেন শচীন বাবু। হ্যান্ডেলটা আল্গা করে একখানি পা বের করে দিয়েছে মালু।
আরে কর কী? পড়ে যাবে যে?
আমাকে যে নামতে হবে রাকীব ভাই। রাবু আপার খবর নেব না? একটা ভাবনা ট্রাক সুমুখে পড়ে শচীনের স্পীডটা কমে যায়। রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে মালু।
আরে পাগল হলেন নাকি? এ বড় খারাপ পাড়া। শচীন বাবু গাড়ি থামিয়ে নামবার জন্য তৈরি হলেন বুঝি।
না। ও বড় গোঁয়ার। আসবে না। তুমি চালিয়ে যাও। পেছন থেকে বললেন রাকীব সাহেব।
৩৯.
তড়বড় করে নেবে মালু দেখল, ভুল জায়গায় নেবেছে। বিবেকানন্দ রোডটা আরো সামনে।
আশে পাশে সামনের দিকে একটু দূরে তাকাতে কেমন ভয় করে মালুর। তাই দৃষ্টিটাকে ঠিক পায়ের মাথায় ধরে রেখে হনহনিয়ে চলে ও। তবু ভয়টা যেন পায়ের সাথেই জড়িয়ে থাকে। পা গিয়ে ঠোক্কর খায় মৃত নগরীর বিকৃত বীভৎসতার মুখে।
মানুষের পেট। আধেকটা দূরে বিক্ষিপ্ত। বাকী আরেকটার ছিটানো নাড়িভুঁড়ি মালুর সামনেই পথটা আগলে রয়েছে। পাশ কাটাল না মালু। লাফ মেরে পেরিয়ে গেল।
একটি খোলা হাইড্রেন্ট। ল্যাংটা এক আদমের ছেলে। মাথার দিকটা হাইড্রেন্টের মধ্যে, পা জোড়া আকাশের দিকে কী এক ফরিয়াদের মতো উঁচিয়ে রয়েছে। ঘাতকেরা হয়ত তাড়াহুড়োয় ওর গোটা দেহটা গুম করতে পারেনি। অথবা ঠাসা হাইড্রেন্ট, ওর গোটা শরীরখানি ধরবার মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই সেখানে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মালু। ভুলে যায় এখানে যে কোনো গলির ঘুপচিতে ওর জন্য ওত পেতে রয়েছে মৃত্যু।
গলির মুখের বাড়িটায় কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। লেলিহান অগ্নিশিখা লাফিয়ে লাফিয়ে আপন গ্রাসে টেনে নিচ্ছে একটার পর একটা জানালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ-আসবাব সবই একাকার হবে।
ছাইয়ের গাদায় দাঁড়িয়ে থাকবে কিছু পোড়া ইট কিছু বা দগ্ধ লোহা। বাড়িটার কোনো কিছু আর নজরে পড়ে না। শুধু ধোঁয়া আর আগুন। তারই ভেতর থেকে বাতাস চিরে বেরিয়ে আসে মুমূর্ষ পুরুষ-নারী-শিশুর আর্তচিৎকার-বাঁচাও বাঁচাও, দয়া কর, বাঁচাও আমাদের! প্রাণ ভিক্ষার সেই আর্ত-আবেদনে পাষাণ গলবে, ব্যাধের তীর খসে পড়বে হাত থেকে। কিন্তু পশুত্বের বর্বরতায় উন্মত্ত এই মহানগরীতে কে দেবে সাড়া মৃত্যুমুখী মানুষের আর্তচিৎকারে?
দ্রুত পা ফেলল মালু।
এই তো রাবু আপার হোস্টেল।
কিন্তু, ফাঁকা। দারোয়ানটা নেই। জানালাগুলো বন্ধ। একটুকরো শাড়িও উঁকি দিচ্ছে না কোনো ছিদ্র দিয়ে। তবে কী?
সেটা ভাবতে পারে না মালু। পথে পথেই তো দেখে এল ও।
কাকে চাই?
আচমকা কী এক ভয়ে কাঁটা দিয়ে গেল মালুর গাটা। ছেলেটাকে ভালো করে দেখল ও। হোস্টেলেরই পাশের বাড়ির রোয়াকে বসেছিল। মালুকে দেখে উঠে এসেছে। পেছনে ওরই বয়সী আর একজন।
এই হোস্টেলের ছাত্রীরা কোথায় গেছে বলতে পারেন? শুধাল মালু।
জবাব না দিয়ে ছেলেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল মালুকে। পেছনের সঙ্গীর দিকে তাকাল ছেলেটা। যে কোনো অর্থ হতে পারে এমন একটা দৃষ্টি বিনিময় হল ওদের দুজনার। সঙ্গীটি যেন মাথা নাড়ল। একটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে সন্ধানী চোখে যেন জরিপ করে গেল মালুর আপাদ মস্তক। তারপর একপা এগিয়ে কেমন রুক্ষ গলায় শুধাল : ঠিক কাকে চাই বলুন তো? মানে নাম… রাবেয়া খাতুন। ফিফথ ইয়ার ইতিহাসের ছাত্রী। যেন মরিয়া হয়েই বলে ফেলল মালু।
কিন্তু, বলেই ওর চক্ষু স্থির, রক্ত হিম। কোন্ গুপ্ত সংকেতে বেরিয়ে এসেছে এক ডজনেরও উপর জোয়ান জোয়ান ছেলে। হাতে ওদের সব ধরনের অস্ত্র, বন্দুক, ছোরা, লাঠি। নিমেষের মাঝেই ওরা ঘিরে ফেলল মালুকে। তা হলে…এখানে সব শেষ? ওর নিশ্বাসে আর ভারি হবে না এ পৃথিবীর বাতাস? সেই বাকুলিয়ার ছেলেটা রাশু, যাকে সোহাগ করে ডাকত মালু বয়াতি, এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত আলো নিভে যাবে তার জন্য? …কিন্তু, রাবু আপা? রাবু আপাকে কী কেটে ফেলেছে ওরা?
আরে মশায় কথা বলছেন না কেন? কী হল আপনার?
কে! মালু কথা বলছে না। আশ্চর্য তো? মারবার আগেও কৌতুক করছে এরা?
দুদুবার এটাক হয়েছে। শেষের বার তো ঠেকাবার জন্য বন্দুকই ছুঁড়তে হল। খবর গেছে লালবাগে। তবু এখনো আসছে না পুলিশ। বলা তো যায় না কখন আবার এটাক করে বসে। তা আমরাও রেডি, দেখছেন তো বন্দুক, এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে চলব। দুচারটে মরে মরুক, মরা দরকার।
ও কী, ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছেন কী? যান না ভেতরে। দেখা করে আসুন গিয়ে। আপনার দিদি বুঝি? তা মশায় আপনারাও তো বেশ লোক! দেখছেন হাঙ্গামা পাকিয়ে উঠেছে, কাল বেলা-বেলি এসে নিয়ে গেলেই পারতেন?
একটি রাত। একটি সকাল। পদে পদে মৃত্যুর আতঙ্ক। মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক, পল পল মৃত্যু ভয়ের নিদারুণ যন্ত্রণা। এতে যদি মানুষের বুদ্ধি চেতনা লোপ পায়, বেশি কী? এক গাল বোকার হাসিতে কিম্ভুত মুখ করে সপ্রতিভ হতে চেষ্টা করল মালু। আর ছেলেগুলোও হেসে উঠল। কাল থেকে তো হাসবার অবকাশ পায়নি ওরা! তাই হাসির এই মওকাটা পেয়ে পরম সুখে হাসছে।
রেসকিউ পার্টি এসে গেল। খোলা দুটো ট্রাক রিভলভারধারী সার্জেন্টের পাহারায়।
হোস্টেলের সেই পাশের বাড়িটা থেকে একে একে বেরিয়ে এল মেয়েরা। উঠে বসল ট্রাকে।
ওরা মুক্ত। মুক্তির আনন্দ ওদের মুখে। তবু আঁচলের খুঁটে চোখ মুচছে ওরা। প্রেম প্রীতি ভালোবাসার উৎস যে মানবতা সেই মানবতার প্রতি শ্রদ্ধায় মন ওদের নুয়ে এসেছে। ভেদ বুদ্ধির আর অমানুষিকতার মাঝে মনুষ্যত্বের যে মশাল ওদের জন্য জ্বলে উঠেছিল যাবার আগে বুঝি তারই উদ্দেশে দুফোঁটা অশ্রুর অর্ঘ্য রেখে যেতে চায় ওরা।
ছেলেগুলো হাত নাড়ল। রুমাল উড়াল। ওদের চোখে সেই আশ্চর্য জ্যোতি, যা গত কালকের ঘন দুর্যোগের রাতে ওদের পথ দেখিয়েছে। ধর্ষিত কলকাতার বেহুঁশ রাজপথ ধরে ছুটে চলে ওদের ট্রাক। এখানে ছিন্ন মুণ্ড ট্রাকের চাপায় থ্যাতলান শব। ওখানে ঘর পুড়ছে। লুট হচ্ছে পাশের একটি দোকান। আর ধোঁয়ায় আকাশটা যেন প্রেতের আলিঙ্গনে টেনে নিয়েছে গোটা শহরটাকে।
কেন? কেন এই মৃত্যু নির্মম, এই হানাহানি? সেই গলির মোড়ে লকলকে আগুনের শিখায় দগ্ধ নারী আর শিশুদের কাতর প্রাণ ভিক্ষার মতোই তীক্ষ্ণ এক আর্তনাদ বেরিয়ে এল মালুর বুক চিরে।
ওয়েলেসলি স্ট্রীটের ইভাকুউ ক্যাম্পে ট্রাকগুলো নাবিয়ে দিল ওদের। চল পার্কস্ট্রীটে পৌঁছিয়ে দিবি আমায়। এতক্ষণে মুখ খুলল রাবু। সেই যে ট্রাকে উঠে মালুর হাতের সাথে প্যাঁচিয়ে রেখেছিল পাঁচটি আঙ্গুল এবার আঙ্গুলগুলো খুলে নিল ও। হাতটা সরিয়ে নিল মালু।
মালু তাকায় রাবুর মুখের দিকে। নরক রাতের ছাপটা এখনো মিলিয়ে যায়নি ওর মুখ থেকে।
বাঁয়ে মোড় নিয়ে ইলিয়ট রোডে পড়ল ওরা।
ফিরিঙ্গীগুলোর বেজায় ফুর্তি মনে হচ্ছে। একটা কিছু বলার জন্যই যেন বলল মালু।
আজ তো ওদেরই ফুর্তির দিন সংক্ষেপে বলে পথ চলে রাবু।
ওর হাতের জিনিসটার উপর নজর পড়ল মালুর। চিনল সে। মালুকে সাথে নিয়েই কিনেছিল জাহেদ, রাবুর জন্মদিনের ওই উপহারটা।
মেজো ভাই কী বলবে জান? কৌতুক করে বলল মালু।
কী?
বলবে, রাবুটার কোনো আক্কেল নেই। আক্কেলই যদি থাকত তাহলে পালাবার সময় শাড়ি নয়, গহনা নয়, একটা ছড় ওঠা পুরনো হাতব্যাগ নিয়ে পালিয়ে আসে?
হেসে দেয় রাবু। আর হাসির সাথে রাঙিয়ে যায় ওর ঝিনুক-মসৃণ দুটো গাল।
মালুও হাসে, মনে মনে বলে এ-ই ভালো, আজকের দিনের টুঁটি চেপা আতঙ্ক-স্তব্ধতাকে হাসি দিয়েই উড়িয়ে দাও।
হঠাৎ রাবুর পায়ের দিকে চোখ পড়ে হো করে হেসে উঠল মালু। হাসি ওর থামে না।
রাবুর এক পায়ে স্যান্ডেল আর এক পা খালি।
এ তো ভারী মজা! তুমি এখনও টের পাওনি? অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে শুধাল মালু। বিব্রত রাবু তাড়াতাড়ি স্যান্ডেল খানা রাস্তার পাশে ছুঁড়ে দিল। উভয় পা স্যান্ডেল মুক্ত করে মালুর হাসিতে যোগ দিল।
সত্যি আজকের দিনে হুঁশ রাখা দায়। রাবুর বেখেয়ালীর পক্ষেই একটা যুক্তি তুলে ধরল মালু।
আসলে কখন ট্রাক আসবে, কখন বিবেকানন্দ রোড ছেড়ে নিরাপদ এলাকা মানে মুসলমান এলাকায় পৌঁছুবো, এ দুশ্চিন্তাটা সারাক্ষণ ঢিপ ঢিপ করছিল বুকের ভিতর। ট্রাকগুলো যখন এল তখন কী ভাবে যে বেরিয়ে এসেছি সেটা জানিনে। বলার প্রয়োজন নেই তবু কথাগুলো বলল রাবু। আচ্ছা রাবু আপা বলতে পার? কেন এমন হল, কেন এমন হয়?
কিছুক্ষণ চুপ রইল রাবু একটু বুঝি ভাবল। বলল, গোলামিকে সহ্য করা পাপ। দুশো বছরে অনেক পাপের বীজ জমেছে আমাদের রক্তে। এ হয়ত তারই ফল।
মালুর কাছে স্পষ্ট নয় কথাগুলো। জিজ্ঞাসু চোখে ও চেয়ে থাকে রাবুর মুখের দিকে। রাবু ততক্ষণে শেষ করেছে ওর কথাটা-নইলে বিদেশি শত্রুকে ভুলে গিয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি কাটাকাটি করব কেন আমরা? মালু আরও নির্দিষ্ট করে আরো স্পষ্ট করে বুঝতে চায় ব্যাপারটা। তুমি তা হলে বলতে চাও পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে হিন্দু-মুসলমান মিলিত সংগ্রাম সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়? ক্ষেতে ওরা লাঙ্গল দেয় একসাথে, আপিসে কারখানায় কাজ করে এক সাথে। ইংরেজের লাথি খায় এক সাথে। সংগ্রামটা এক সাথে করতে পারবে না কেন?
রাবুর মুখে, রাবুর কথায় ক্রোধ, ঘৃণা, বিক্ষোভ। চমকে তাকাল মালু। শুধাল, এ বিক্ষোভ কার বিরুদ্ধে রাবু আপা?
যারা এসব করে এবং করায় তাদের বিরুদ্ধে। নিজের বিরুদ্ধেও।
নিজের বিরুদ্ধে কেন?
কেননা, এই অমানুষিকতাকে, এই বিশ্বাসঘাতকতাকে আমি রুখতে পারছি। শক্তি নেই আমার। বিরুদ্ধপক্ষ আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি…
কিন্তু শক্তির অভাবটা কখন হয় রাবু আপা? রাবুর কথাটা শেষ হবার আগেই শুধাল মালু।
জানি জানি, তুই বলবি যেখানে নিষ্ঠার অভাব সেখানেই শক্তির ঘাটতি, বিশ্বাসের মূল্য যেখানে দৃঢ় সেখানে কখনো শক্তির অভাব ঘটে না। কিন্তু বলতে পারিস, গুণ্ডারা যখন হোস্টেলের উপর হামলা করল–মানবতার উপর অটল বিশ্বাসী হয়েও আমি কেন এত অসহায় বোধ করেছিলাম?
কিন্তু যারা গুণ্ডাদের রুখে দাঁড়াল, তোমাদের রক্ষা করল তারা মোটেই অসহায় বোধ করেনি।
ঠিক কথা। কিন্তু তারাও তো আমাদের এক রাতের বেশি রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারল না? তারা আমাদের শুধু সাহায্য করল নিরাপদে পালিয়ে আসতে। আমরা কৃতজ্ঞ, আমরা ভাবলাম–ওদের স্বদেশপ্রেম, ওদের মানবপ্রীতির তুলনা নেই। ওরা ভাবল, ওদের পবিত্র দায়িত্ব সমাধা করে ওরা মহত্ত্বের অধিকারী। কিন্তু সত্যি কী তাই?
এদের সংখ্যা তত বাড়বে, রাবু আপা। এরাই একদিন বিজয়ী হবে। তখনও কী তুমি একথাই বলবে?
না। কিন্তু যদ্দিন তা না হচ্ছে তদ্দিন তুই আমি-কেউ কী আত্মধিক্কার থেকে মুক্তি পাব?
ওরা এখন সার্কুলার রোডে এসে পড়েছে। যে দৃশ্য মালু দেখে এসেছে গ্রে স্ট্রীটের মোড়ে কর্ণোয়ালিস স্ট্রীটে, এখানেও সেই একই দৃশ্য। প্রায় জনহীন রাজপথ, এখানে সেখানে মৃতদেহ; একটি বাড়ি জ্বলছে ধিকি ধিকি ভেতরের মানুষগুলো হয়ত আগেই মরেছে। একটি আলকাতরার দোকান পুড়ছে।
আমার মুশকিলটা কী জানিস?
রাবুর প্রশ্নে ওর দিকে মুখ ফেরাল মালু।
আমি জানি কী আমার উচিত, কী আমার করা উচিত, কী হওয়া উচিত।
কিন্তু মনের এই ইচ্ছার সাথে আমার নিষ্ঠা আর ধৈর্যের বড় গরমিল। তাই হাত পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে চিল্লিয়েই দায়িত্বটা শেষ করি। পরিশ্রান্ত হই। অবাক হয়েও অবাক হয় না মালু। কলকাতার এই কবছরে খুব অল্প দিনই রাবুর সাথে দেখা হয়েছে ওর, কথা হয়েছে ঢের। মালু দেখেছে চৌদ্দ বছরের যে কিশোরীটি ষাট বছরের বুড়ো কলমা-পড়া স্বামীটির ঘর করবে বলে গোঁ ধরেছিল আত্মজিজ্ঞাসা আর আত্মবিশ্বাসে আজ সে এক সজাগ নাগরিক।
জাহেদকে আমার এজন্যই ভালো লাগে, ওর সমস্ত ইচ্ছা, সমস্ত কর্ম একটি মাত্র কেন্দ্র বিন্দুকে ঘিরে আবর্তিত। তাই নিবেদিত প্রাণ। রাবুর মুখে জাহেদের প্রশংসা, এই প্রথম শুনল মালু। এবার সত্যি অবাক হল মালু। অবাক হয়েই রাবুর দিকে চোখ ফেরাল, দেখল, রাবুর মুখে কী এক লজ্জার আবীর।
দেড় গণ্ডা জেনানার খসম ওই বুড়ো জোব্বাওয়ালার চেয়ে আমি যে সুপাত্র এবং সুপুরুষ, সেটা মানবি তো?
না। যেন ছিপি আঁটা বোতল থেকে এক দলা গ্যাস ছাড়া পেয়ে সশব্দে বেরিয়ে এসেছিল।
বিধ্বস্ত বাসর ঘরে সেদিন আরো অনেক কথা, অনেক কান্না ঝরেছিল। কিন্তু রাবুর ওই শেষ উত্তরটা আর সেই উত্তর শুনে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া জাহেদের মুখখানা মালুর মনে গভীর দাগ কেটে বসে গেছে। সে দাগ আজও মোছেনি।
আজও কী রাবু তাই ভাবে?
তবে মেজো ভাইয়ের সামান্য একটু প্রশংসা করতে গিয়ে অমন রাঙিয়ে উঠল কেন রাবু আপা? প্রাণ নিয়ে পালাবার মুহূর্তেও তার দেওয়া সামান্য উপহারটা ভুলে গেল না কেন?
দারুণ ইচ্ছে হলেও প্রশ্নটা মুখ দিয়ে উগরে ফেলবার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারল না মালু। জিজ্ঞেস করল অন্য কথা, কিন্তু এই কদিন আগেই তো তুমি তুমুল তর্ক বাধিয়েছিলে মেজো ভাইর সাথে। বলেছিলে, ভুলে করেছ মেজোভাই।
এখনো তাই বলি এখনো বলি ও ভুল করছে। কিন্তু ভুল হোক শুদ্ধ হোক ওতো কিছু করছে। ওতো রয়েছে মানুষের মাঝে, কর্মের মাঝে।
ওর রয়েছে ত্যাগের স্পৃহা। কর্মের মাঝেই ভুল শুধারাবার পথ ও পেয়ে যাবে, আজ হোক কাল হোক। কিন্তু আমি, আমরা অকম্মার দল? গলাবাজি ছাড়া আর কী করছি আমরা?
করতে না করছে কে, রাবু আপা?
মালুর খোঁচাটা এক ঢোকে গিলে ফেলল রাবু। তারপর চুপ করে গেল।
জনহীন সার্কুলার রোডে কয়েকটা শকুন জড়ো হয়েছে। হয়ত ওরা খবর পেয়েছে, এন্তার মানুষ খুন হয়েছে এই শহরে। পচা মাংসের লোভে তাই আকাশ ছেড়ে নেবে এসেছে ওরা।
শকুনগুলোকে পাশ কাটিয়ে মালু আর রাবু উল্টো ফুটপাতে এসে মোড় নেয় পার্ক স্ট্রীটের দিকে। যেন খুব মনোযোগ দিয়ে ফুটপাতের চতুষ্কোণ ঘরগুলো গুণছে রাবু। গুণতে গুণতে পা ফেলছে।
আমাকে খোঁচা দিয়ে কোনো লাভ নেইরে, মালু। হঠাৎ বলল রাবু। কেন? নিজেকে মুক্ত করতে পারলাম না আমি। আমি কেমন করে দেশকে, মানুষকে জাগাবার ব্রত নেব?
স্বস্তির হাওয়া বইল পার্ক স্ট্রীটের বাড়িটায়।
রাবু তাহলে অক্ষতই ফিরে এসেছে? সেদিনের পার্কসার্কাসে বুঝি এর চেয়ে বড় বিস্ময় আর কিছুই ছিল না।
আমরা তো ভেবে ভেবে মরি। কত টেলিফোন কত দৌড়াদৌড়ি তোর জ্যাঠাজীর। কিন্তু না ছিল যাবার উপায়, না খবর পাবার। শেষে রেসকিউ কমিটির কারা এসে বলে গেল মেয়েরা নিরাপদ, তবে গিয়ে একটু নিশ্চিন্তি। শেষ করে লম্বা দম নিলেন সৈয়দ গিন্নী। বয়স আর সুখের ভারে বেশ ওজনী হয়েছেন সৈয়দগিন্নী। ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরল রাবুকে। ওমা হিন্দুরা হাতের মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিল তোমায়? স্কুলে পড়া কচি কচি ছেলেমেয়ে, ওরাই যেন সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে।
আমরাও ছাড়িনি। ওই দেখ মল্লিক বাজার থেকে এখনো ধুঁয়ো উঠছে। এদিকে ডাক্তার ঘোষ কী করেছিল জান? বন্দুক দেখিয়ে ছিল। আর যায় কোথায়। মার মার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোক। আচ্ছা এখন থাম তোমরা। ওদের থামিয়ে দিল রাবু। বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখেছে মালুকে। পর্দাটা ফাঁক করে ডাকল ওকে, আয় ভেতরে আয়। বৈঠক ঘরের পর লম্বাবারান্দা। বারান্দার ডান পাশ ধরে ঘরের সারি। প্রথম কামরাটি জাহেদের। দ্বিতীয় কামরাটি ওরা ছেড়ে দিয়েছে রাবুর জন্য। মালুকে সে ঘরে এনেই বসাল ও।
বেরিয়ে গেল রাবু। ফিরে এল এক তশতরী মোহনভোগ আর পেয়ালা ভর্তি চা নিয়ে। তশতরী আর চায়ের কাপটা মালুর সুমুখে রেখে আবার বেরিয়ে গেল রাবু।
মোহনভোগের গন্ধটা মালুকে স্মরণ করিয়ে দিল, সকাল থেকে পেটে পড়েনি কিছু। গতরাতের আতঙ্ক উত্তেজনার মাঝে খাওয়াটা ছিল জবরদস্তি, না খাবার শামিল। চনচনিয়ে উঠল ওর ক্ষিধেটা। গরম তাপে যেন পুড়ে যাচ্ছে নাড়ি ভুঁড়িটা। তবু হাত তুলে তশতরিটা স্পর্শ করতে পারল না মালু।
ওকি, খাচ্ছিস না যে? খাবারটা তো আমি দিলাম। কখন আবার এসে পড়েছে রাবু।
তুমি দিলেই বা…কথাটা শেষ করতে পারে না মালু।
তীক্ষ্ণ বুঝিবা রূঢ় দৃষ্টিটা সূঁচের আগার মতো ওর মুখের উপর ধরে রাখে রাবু। বলে, আজ ওসব অভিমান রাখতো। খেয়ে নে।
মুখটা নাবিয়ে নেয় মালু। আশ্রিতের অন্নে ওর লালন। দয়ার অন্নকে তাই ওর ঘৃণা। পারলে বার বছর ধরে গিলে আসা সেই পরান্নটা উগরে ফেলত মালু। রাবু কী সেটা জানে না?
আর এই সেদিনের কথাটাও কী ভুলে গেছে রাবু? হ্যারিসন রোডের মোড়ে দেখা হয়ে গেছিল জাহেদের সাথে। হতচ্ছাড়া, কোলকাতায় এসে কোথায় কোথায় ঘুরছিস তুই, আমার সাথে দেখা না করে? বেশ রেগেই বলেছিল জাহেদ। আর অনিবার্য ভাবে হাতটাও বাড়িয়ে দিয়েছিল মালুর কানের দিকে। কিন্তু, অনেকগুলো বছর পেরিয়ে রীতিমতো জোয়ান হয়েছে মালু। তাছাড়া রয়েছে প্রকাশ্য রাজপথের ভিড়। বুঝি সে সব ভেবেই হাতটাকে অর্ধেক পথ থেকেই ফিরিয়ে এনেছিল জাহেদ। কিন্তু ওকে ট্রামে তুলে সোজা বাসায় নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, বিছানাপত্র নিয়ে আয়, এখানেই থাকবি।
ঘোর আপত্তি তুলেছিলেন সৈয়দগিন্নী।
গাঁও বাড়িতে দুজন দশজন খায় থাকে, গায়ে লাগে না। কিন্তু বাপু, দুটো জাগির, পাঁচটা চাকর, কলকাতার কন্ট্রোলের বাজারে ওই নিয়েই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি আমি। তার উপর আর একজনের ঝামেলা। অত বরদাশত হবে না আমার।
বুঝি শরমে মরছিল রাবু। প্রতিবাদ করেছিল জাহেদ : কত লোকই তো ফালতু খাচ্ছে। তাছাড়া আমাদের বাড়িতেই জন্ম মালুর। আমাদের বাড়িতেই মানুষ। ওর তো দাবীও রয়েছে।
ছেলের যুক্তিতে বুঝি বা এক পা হটে আসেন সৈয়দগিন্নী। আল্লাহ যখন তৌফিক দিয়েছে গরিব কাঙ্গাল খাবেই তো। আমি বলছি ঝঞ্ঝাট; ঝঞ্ঝাট আমার ভালো লাগে না এ বয়সে। তা ছাড়া লোকের ভিড় রাশেদ একদম বরদাশত করতে পারে না।
সৈয়দ সাহেবের বড় ছেলে রাশেদ। কিছুদিন আগেই মুখে পাইপ আর বগলে মেম নিয়ে ফিরে এসেছিল বিলেত থেকে।
প্রত্যুত্তরে কী বলেছিল জাহেদ, শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি মালু। সৈয়দ বাড়ির ফালতুর জীবনের ইতি টেনেছে ও অনেক আগে। পুনরায় পরভৃতিকার গ্লানি গায়ে মাখবার ইচ্ছে নেই ওর।
সেদিন বাড়িতেই ছিল রাবু। তার চোখের সুমুখ দিয়েই তো বেরিয়ে গেছিল মালু। তবু আজ অমন জিদ ধরেছে কেন রাবু? থাক, কষ্ট করে আর গিলতে হবে না তোকে। তশতরীটা সরিয়ে রাখল রাবু। চায়ের কাপটা অমনি পড়ে রইল।
কী এক লজ্জা থেকে যেন বেঁচে গেল মালু। কৃতজ্ঞ চোখ মেলে ও তাকায় রাবুর দিকে। ছোট্ট করে হাসে রাবু যেন বলে–বুঝেছি। উঠি এবার। দরজার দিকে পা বাড়ায় মালু।
এমন সময় বাইরের ঘরে শোরগোল শোনা গেল। ওকি? মেজ ভাই? রাবুই প্রথম চিনল।
কয়েকজন অপরিচিত লোক, ওদের কাঁধে জাহেদের অর্ধচেতন রক্তাক্ত দেহ। এই যে এদিকে। বারান্দার ডানে প্রথম ঘরটাই ওদের দেখিয়ে দিল রাবু। আস্তে আস্তে কাঁধ থেকে নাবিয়ে জাহেদকে বিছানায় শুইয়ে দিল ওরা। সংক্ষেপে বলে গেল ঘটনাটা।
রেসকিউ পার্টি নিয়ে কয়েকটা বিপন্ন পরিবারকে উদ্ধার করতে যাচ্ছিল জাহেদ। পথে লরীর উপর কে বা কারা ছেড়ে দিয়েছে দেশি বোমা। মাথায় চোট লেগেছে জাহেদের। ফার্স্ট এইড দেয়া হয়েছে। আশঙ্কার কারণ নেই।
ওদের মেলা কাজ। তাই ওরা চলে গেল।
যা তো মালু, ওই মোড়ে ডিসপেন্সারী। সঙ্গে করে নিয়ে আসবি ডাক্তারকে। মালুকে হুকুমটা দিয়েই জাহেদের দিকে মন দিল রাবু। মাথার পেছনটা ব্যান্ডেজ করা। সেখানেই বুঝি চোট লেগেছে বেশি। ঘাড়ে পিঠে চড়ে গেছে চামড়া। পাঞ্জাবিটা দুএক জায়গায় রক্তের দলায় কুচকে এসে সেঁটে গেছে গায়ের সাথে। কাঁচি দিয়ে ফড়ফড় করে পাঞ্জাবিটা কেটে ফেলল রাবু। ভেজা ন্যাকড়ায় ধুয়ে ফেলল জমাট বাঁধা ক্ষত।
ডাক্তার এল। ওষুধ দিল।
চড় চড় করে গায়ের তাপটা একশো চারে উঠে গেল জাহেদের।
মাথায় আইসব্যাগ চাপিয়ে ওর শিয়রের কাছে বসে রইল রাবু।
বের কর। এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের করে দাও ওই বেতমিজ কমবখতটাকে। কার হুকুমে তাকে বাড়ি ঢুকতে দিলে তুমি। আদ্যোপান্ত শুনে গিন্নীর উপর হুংকার ছাড়লেন সৈয়দ সাহেব। ইংরেজ সরকারের অনুগত কর্মচারী এবং শান্তিপ্রিয় প্রজা সৈয়দ সাহেব। হাঙ্গামা হুজ্জত তাঁর না-পছন্দ। জেহাদই হোক আর ইংরেজ খেদার লড়াই-ই হোক, নিজের ছেলে সে-সবে জড়িয়ে পড়বে মাথা ফাটিয়ে আসবে, তাতে ঘোর আপত্তি সৈয়দ সাহেবের। আহা থামুন তো। ছেলের জান নিয়ে টানাটানি আর আপনি লেগেছেন গাল পাড়তে। সৈয়দগিন্নীর সংযত কণ্ঠে চিরন্তন মাতৃ-প্রতিবাদ।
রাখ তোমার মেয়েলি আদর। বলে দাও তোমার ছেলেকে–আমার বাড়িতে থেকে, আমার খেয়ে ওসব ভূতের বেগার চলবে না। চেঁচিয়ে চলেন সৈয়দ সাহেব।
পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল রাশেদ। এগিয়ে এসে বলল : আব্বা তো ঠিকই বলছেন, আম্মা। জাহেদটা স্রেফ ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাচ্ছে। ওকে আর আশকারা দেয়া যায় না। স্ট্রিক্ট কন্ট্রোলে আনতে হবে।
বড় ছেলের কথাটা টেনে নিয়ে সৈয়দ সাহেব আরও শক্ত কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হয়ত, কিন্তু তার আগেই ওদের সুমুখে বন্ধ হয়ে গেল ঘরের দরজাটা। ভেতর থেকে শুনা গেল রাবুর গলা, প্লিজ বড় ভাই চেঁচিওনা এটা রুগির ঘর।
ওষুধ আর ঘুমের ক্রিয়ায় দিন দুইয়ের মধ্যেই উঠে বসল জাহেদ। একটুকরো হাসির ঝিলিক মেলে মেঘমুক্ত আকাশের মতোই উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাবু।
কপাল ফেটেছিল সেই কবে, এবার মাথাটাও ফাটল। বুঝলি? রাবুর উজ্জ্বল আভা ছড়ান মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল জাহেদ।
বারে বারে অমন খোঁচা দাও কেন, মেজো ভাই?
তুই যেন মোটেই দিস না।
আমি যা করব তুমিও তাই করবে?
চুপ করে যায় জাহেদ।
খোলা ব্যান্ডেজটা ধীরে ধীরে পাট করে রাখে রাবু। তুলোগুলো ফেলে দেয় চিলুমচিতে। সযত্নে চিরনি বুলোয় জাহেদের মাথায় একটি একটি করে জটবাঁধা চুল আল্গা করে দেয়।
আলিগড় থাকতে তবু কিছু লেখাপড়া করতে। এখানে এসে তো সে পার্টটাও চুকিয়ে দিলে। পরীক্ষাটাও দিলে না। তুলো চেপে ওর মাথায় নতুন ব্যান্ডেজটা বাঁধতে বাঁধতে বলল রাবু।
কী বলতে চাস তুই?
বলতে চাই সারা জীবন কী এই হৈ-হুজ্জুতেই কাটবে নাকি?
তুই, তুইও একথা বললি? রাবুর হাত থেকে মাথাটা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নেয় জাহেদ। উঠে বসে। ব্যান্ডেজের কাপড় আর তুলো ছিটকে পড়ে মেঝেতে।
রাবু ভাবলেশহীন। ব্যান্ডেজ আর তুলোটা কুড়িয়ে নেয় রাবু। ফেলে দেয় চিলুমচিতে। বের করে আনে ব্যান্ডেজের নতুন কাপড় নতুন তুলো। তারপর দুহাতের তালুতে জাহেদের মাথাটাকে টেনে আবার শুইয়ে দেয় ওকে। তুলো চেপে ব্যান্ডেজ বেঁধে চলে, যেমন বাঁধছিল একটু আগে। শুধু হৈ হৈ করলেই দেশসেবক হওয়া যায় না। পড়াশোনাও করতে হয়। শান্ত কণ্ঠে বলল রাবু।
মানে এম.এ. পরীক্ষাটা দিতে হবে, ডিগ্রীর লেজটা আর একটু দীর্ঘ করতে হবে। এই তো?
মানেটা মোটেই তা নয়। ডিগ্রী নেওয়া, না নেওয়া সে তোমার ইচ্ছে। কিন্তু দেশটাকে চিনতে হলে জানতে হলে যে একটু পড়াশোনার দরকার, এই সহজ কথাটা বুঝছো না কেন?
ও, এই পড়াশোনার কথা বলছিস? তবে যে খামোখা রাগ করলাম তোর উপর?
সে আর কী করা যাবে, অর্ধেকটা শুনেই তো রেগে বসলে তুমি। আচ্ছা আর রাগবো না, কখনো রাগবো না। বুঝলি? বলতে বলতে কী এক খুশিতে উচ্ছ্বসিত হল জাহেদ; দুহাত বাড়িয়ে ফস করে ধরে ফেলল রাবুর মুখটা। টেনে আনল; তারপর চেপে রাখল ঠোঁটের উপর। কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্ত। জাহেদের ঠোঁটের উষ্ণতায় মুখটা বিছিয়ে নিঃসাড় পড়ে থাকে রাবু। বুঝি ফুরিয়েছে ওর সংস্কারের আয়ু। বুঝি ভেঙে গেছে ওর অর্থহীন প্রতিরোধের দেয়াল।
রাবু আলগা হতে চায়। কিন্তু পারে না। দুটো শক্ত বাহুর আলিঙ্গনে আটকা পড়েছে ও। আর ওর নিস্তেজ স্নায়ুতে নেই আলগা হবার মতো সামান্য একটু শক্তি।
হয়ত অনেক কথা মনে পড়ছে ওদের। হয়ত কোনো কথাই এই মুহূর্তে মনে পড়ার মতো নয়, মনে পড়ছে। না এখন এই মুহূর্তে দুজোড়া ঠোঁটের উষ্ণতায় নিঃশেষ হওয়াটাই বুঝি একমাত্র সত্য।
অনেকক্ষণ পর নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রাবু। বলল, ছাড় লক্ষ্মীটি কেউ এসে পড়বে।
৪০.
খেয়েছিস?
আলবৎ।
মিথ্যে কথা।
সহসা রাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে সত্য কথাটা গোপন করতে পারল না মালু। চুপ করে রইল।
আমার পয়সা দিয়ে বাজার থেকে কিছু আনিয়ে দিই। খাবি তো? নাকি এ বাড়িতে বসে খেতেও তোর আপত্তি।
হা না কী যে বলবে মালু ভেবে পায় না, ইতস্তত করে ও।
তার চেয়ে এক কাজ করি, আমিও খাইনি; চল্ কোনো হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসি আমরা।
চল।
খেতে বসে অনর্গল কথা বলে গেল রাবু। অনেক নতুন খবর শোনাল মালুকে। পার্ক সার্কাস ময়দানে দাঙ্গা বিরোধী মিটিং হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম মিলনের দাবী জানিয়ে সে মিটিংয়ে জাহেদ আর রাবু বক্তৃতা দিয়েছে। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি এবং শান্তির জন্য, দাঙ্গাবাজদের রুখবার জন্য শান্তি কমিটি হয়েছে। রাবু সে কমিটির মেম্বার হয়েছে। মেজো ভাই নেই? শুধাল মালু।
হা হা, সেও আছে কমিটিতে। কথার মাঝে বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়েই বলল রাবু। বলে চলল : ব্রেবোর্ন কলেজে যে ইভাকুই ক্যাম্প হয়েছে সেখানে। ভলান্টিয়ার হয়েছি। কলাবাগান গিয়েছিলাম, সেখানে বস্তির লোকেরা রায়ট ঠেকিয়েছে; কাউকে রায়ট করতে দেয়নি। বাইরে থেকে গুণ্ডারা গেছিল রায়ট বাধাতে। ওদের হটিয়ে দিয়েছে। তিলজলায় প্রায় সব বাড়িতেই লুটের মাল মজুদ ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! আমরা অনুরোধ করলাম, আমি ছোটখাটো একটা বক্তৃতাও দিয়ে ফেললাম। ওরা সব লুটের মাল আমাদের হাতে তুলে দিল। বলল, এগুলো যাদের জিনিস তাদের কাছে তোমরা পৌঁছে দিও। আর বলল, যারা চলে গেছে ঘর ছেড়ে অন্য পাড়ায় তাদের ফিরিয়ে নিয়ে এস। আমরাই তাদের পাহারা দেব। অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা, তাই না?
রাবুর চোখে দীপ্তি। রাবুর মুখে অপার্থিব কোনো আনন্দের গর্বিত ঘোষণা। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে মালু। রাবুর এমন সহজ আনন্দিতরূপ সেই ছোটবেলার পর আর কখনও দেখেছে কিনা মনে পড়ল না মালুর।
রাবু বলে চলেছে, গতকাল মাওলালির দিকে আমরা শান্তি মিছিল বের করেছিলাম। জাহেদ তো কিছুতেই আমায় যেতে দেবে না মিছিলে। আমি বললাম, যাবই। অদ্ভুত এক যুক্তি দিল জাহেদ, গুণ্ডারা আক্রমণ করলে মিছিল সামলাব, নাকি তোমাদের রক্ষা করব? আমি বললাম, নিজেদের সামলিও তোমরা, দয়া করে আমাদের নিয়ে মাথা ঘামিও না, আমরা আত্মরক্ষা করতে জানি।
সেই দিঘলদেহী মেয়েটাকে মনে আছে তোর?
মালু ঠিক ধরতে পারল না। শুধাল, কোনটার কথা বলছ?
আরে, আমাদের ব্রেবোর্ন কলেজের সেই মেয়েটা, স্ট্রাইকের লিডার ছিল এই অজুহাতে যাকে কলেজ থেকে বের করে দিল প্রিন্সিপাল মিস গ্রস। আর আমরা আন্দোলন করলাম, মনে নেই?
হাঁ হাঁ চিনেছি, সেদিন ডালহৌসি স্কোয়ারের মিছিলেও ছিল তোমাদের সাথে।
সে মেয়ে তো প্রায় লাফিয়ে পড়ল জাহেদের ঘাড়ে; আপনারা পেয়েছেন কী? চিরকাল মেয়েদের অবলা ভেবে এসেছেন, আজও তাই ভাবেন, ভাবেন আমরা কী আর আত্মরক্ষা করতে জানি? আমি হলফ করে বলছি গুণ্ডাদের আমরা ঠেঙ্গাতে পারি এবং ঠেঙ্গাব।
কিন্তু পত্রিকায় দেখলাম তোমার মিছিল নাকি গুণ্ডারা আক্রমণ করেছিল শুধাল মালু।
আক্রমণ বলে আক্রমণ? রীতিমতো হামলা। তিন দল তিন দিক থেকে উন্মুক্ত ছোরা নিয়ে উন্মাদের মতো হামলা করেছিল। সত্যি কথা বলতে কী ভয় পেয়ে গেছিলাম, বাব্বাঃ ওরকম ছোরার নাচনে কার না ভয় লাগে।
তারপর? রুদ্ধশ্বাস মালু।
তারপর আর কী? মিছিলের কয়েকটা বেপরোয়া ছেলে লাঠি নিয়ে তাড়া করল ওদের। ওরা পালিয়ে গেল।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার কী দেখলাম, জানিস?
কি?
গরিব লোকরাই ক্ষেপেছে বেশি, অথচ এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে ওদেরই সবচেয়ে বেশি।
ওরা ক্ষেপেনি, আমার মনে হয় ওদের ক্ষ্যাপানো হয়েছে।
সেটা অবশ্য ঠিক।
সহসা খাওয়া ছেড়ে সশব্দে হেসে উঠল রাবু। হেসে চলল।
পরিবেশকরা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। মালুর হাতের চামচটা থেমে গেল। ভ্রূ কুঁচকে কী যেন বিড়বিড় করল পার্শ্ববর্তী টেবিলের নিঃসঙ্গ ভোজনকারী এক প্রৌঢ়।
কী হল, হঠাৎ বেপরোয়ার মতো হাসতে শুরু করলে?
ওই দেখ। ইশারায় দূরের টেবিলটা দেখিয়ে দিয়ে মুখে আঁচল পুরল রাবু। হাসিটা কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না ও।
মালু ঘাড় ফিরিয়ে দেখল দূরের সেই টেবিলে পড়ে রয়েছে চায়ের সরঞ্জাম। চেয়ারটায় হেলান দিয়ে নাক ডাকছে জাহেদ আর উর্দি পরা পরিবেশক চায়ের প্রতি ঘুমন্ত খদ্দেরের মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টায় হিমশিম খেয়ে চলেছে।
মালুও হেসে দিল। দূরের সেই পরিবেশকটিও যোগ দিল ওদের হাসিতে। হয়ত সেই হাসির শব্দেই জাহেদের চোখ খুলে গেল।
তাড়াতাড়ি ঢেলে নিল এক কাপ চা। দু ঢোকেই গিলে ফেলল। এসে বসল রাবুদের টেবিলে। শুধাল আচ্ছা তোরা এখানে? এতক্ষণ তো দেখিনি?
ওমা! ঘুমুলে কেউ কী আবার চোখে দেখে নাকি? জানতাম না তো? চোখ কপালে তুলল রাবু।
যাহ্ ঘুমুচ্ছিলাম কোথায়? চোখ বুজেছিলাম। প্রতিবাদ করল জাহেদ।
তা বটে, চোখ বুজে একটু নাক ডাকছিলে। ঘুমুচ্ছিলে কোথায়?
নিশ্চয় না, আমি নাক ডাকছিলাম না। তুই শুনেছিস?
আলবত শুনেছি। সাক্ষী চাই? হাত তুলে সেই পরিবেশককে ডাকল রাবু।
বেশ ডাক, সাক্ষী।
ওদের খুন সুড়িতে মনে মনে হাসে মালু। ওদের ও ছেলেমানুষি ঝগড়াটা কেন যেন ভালো লাগল ওর। ও বলল থাম মেজ ভাই আমিও সাক্ষী তোমার বিপক্ষে।
হাঁ দেখ না কাণ্ডটা। এতবড় হল ঘরে এতগুলো লোক খাচ্ছে তার মাঝে আক্কেলের মাথা খেয়ে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছেন তিনি, আর এখন বলেন কিনা নিশ্চয় না। এদিকে বাহাদুরীর ঠেলায় আমার ঘরে টেকা দায়। রাত দুটোয় বাড়ি ফিরবে, ভোর সাতটায় যাবে বেরিয়ে, বলবে, দেখেছিস পাক্কা কুড়ি ঘন্টা খাটি, চার ঘণ্টা ঘুমোই। কেমন খাসা স্বাস্থ্য। পারবি আমার মতো হতে?
হয়েছে, হয়েছে, আমরা বুঝলাম জবর বক্তৃতা দিতে শিখেছেন মিস রাবেয়া খাতুন বি.এ.(হন)। এবার দয়া করে থামুন। বলল জাহেদ।
রাবু থামে না। তেমনি কপট গাম্ভীর্যে বলে চলে, কেন থামব?
উঠতে বসতে তাহলে এত কথাই বা শোনান হয় কেন?
আচ্ছা, আচ্ছা আর শোনাব না। এখন ধরতো এগুলো। কতগুলো ইংরেজি টাইপ করা আর বাংলা লেখা কাগজ রাবুর দিকে বাড়িয়ে দিল জাহেদ।
কী করতে হবে?
পৌঁছিয়ে দিতে হবে সমস্ত পত্রিকায়, নিউজ এজেন্সীতে।
সঙ্গে কে যাবে?
কেউ না।
না একলা এত জায়গা ঘুরতে পারব না আমি। তুমি থাকবে সঙ্গে?
যদি যেতেই পারতাম তবে কাজটাও তো আমিই করতাম। তোকে দিতাম নাকি। পোর্টফোলিওটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল জাহেদ।
বেশ। কাজটা তাহলে হচ্ছে না।
মানে? ভ্রূ কুঁচকাল জাহেদ।
আমি যাচ্ছি না।
একটা প্রশ্রয়ের হাসি ফুটে উঠল জাহেদের ঠোঁটে, মৃদু তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে, তারপর চোখের তারায় এসে স্তব্ধ হয়ে রইল ক্ষণকাল। ও বলল, কাল যে সারাদিন ঘুরলাম তোর সাথে?
বাজে কথা। নিজের কাজে ঘুরেছ। আমাকেও ঘুরিয়ে মেরেছ।
বেশ, কথা রইল, আগামী কালও ওরকম ঘুরিয়ে মারব।
সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাবুর চোখ। পুরো গালে হাসল ও। শুধাল প্রতিশ্রুতি।
হ্যাঁ প্রতিশ্রুতি।
ওরা তিনজনেই গলা মিলিয়ে হাসল। জাহেদ বেরিয়ে গেল।
হাসির রেশটা এখনও জেগে আছে ওদের মুখে। পরিবেশক দ্বিতীয় দফা চা রেখে গেল টেবিলে।
রাবু আপা, তুমি ধরা পড়ে গেছ। বলল মালু।
কী রকম?
মেজো ভাইকে ভালোবেসেছ তুমি।
বুঝি চমকে উঠল রাবু। ঠোঁটের কোণে জেগে থাকা হাসির রেশটুকু সহসা কী এক কঠিন রেখায় রূপান্তরিত হল। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল রাবু। তারপর মালুর ঢেলে দেওয়া চাটা হাতের কাছে টেনে বুঝি একটু সহজ হতে চাইল। বলল, তাতে কী হল?
এই হল যে এবার তালাকটা নিয়ে নেবে আর মেজো ভাইকে বিয়ে করবে।
সে হয় না।
কেন হয় না?
সে তুই বুঝবি না।
বুঝিয়ে বললেই বুঝি। মালু জিদ ধরে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে। কিছুক্ষণের জন্য বুঝি অন্যমনস্ক হয়ে রইল রাবু। অথবা অন্যমনস্ক চোখজোড়ার আড়াল নিয়ে কোনো একটি চিন্তার সুতো খুঁজে নিল। বলল জাহেদকে বিয়ে করলে ওরই ক্ষতি করা হবে।
কেন?
হয়ত আমি ওকে পোষ মানাতে চাইব। হয়ত ও নিজেই পোষ মেনে যাবে। আর দশজন পুরুষের মতো বৌ আর ঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখন? তখন তো ওর মৃত্যু।
তা কেন হবে? তোমরা দুজনই তো আদর্শ সচেতন মানুষ। তর্কের জন্য তৈরি হল মালু।
নিজের উপর অতটা আত্মবিশ্বাস আমার নেই, সে তো তোকে আগেই বলেছি।
বেশ, তর্কের খাতিরে না হয় তোমার কথাটা আপাতত মেনে নিচ্ছি। কিন্তু মেজো ভাই? সে তো তোমাকে ভালোবাসে?
ওর জীবনটা এখনো যুক্তিনির্ভর নয়, আবেগনির্ভর, আমিও হয়ত তাই। সে জন্য বড় ভয় আমার। তাই তো এ সব কথা ওর সাথে আলোচনা করি না।
আলোচনা না করলেই কী সে সান্ত্বনা পাবে? তুমি পাও?
চুপ কর তো। ধমক দিতে গিয়ে বুঝি কেঁদেই ফেলল রাবু।
মালু দেখল উদ্গত কান্নার রেশটাকে সামলাতে গিয়ে রাবু মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে চোখে রুমাল চেপেছে। কিন্তু মালুর আজ জিদ চেপেছে, ও নাছোড়বান্দা। রাবুর দ্বিধা, রাবুর যন্ত্রণার উৎস খুঁজে পেতে হবে ওকে। ও শুধাল, চিরটা কাল এমনি থাকবে, রাবু আপা?
থাকলামই বা। ক্ষতি কী? বলেই উঠে দাঁড়াল রাবু। প্রসঙ্গটার এখানেই ইতি টানতে চায় ও।
রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
চল্ বিবৃতিগুলো দিয়ে আসি প্রেসে। যাবি আমার সাথে? শুধাল বাবু।
চল
ওরা ট্রামে চেপে বসল।
41-45 কোথায়?
দুঃখিত মিস হয়ে গিয়েছিল। এখানে দেখুন দেয়া হয়েছে – https://www.ebanglalibrary.com/20425/
৪১ থেকে ৪৫ অধ্যায় কই?