৩৬-৪০. ইন্দ্রাণী ঘরে ঢুকে

ইন্দ্রাণী ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বড় ঘরে হট্টমেলা বসে গেছে। জয়মোহন আদিত্য রুনা বাপ্পা তিতির অ্যাটম কন্দর্প কে নেই! দুর্লভও রয়েছে। কথা বলছে জয়মোহনের সঙ্গে। বড় সোফার পিছনে মিনতিও দাঁড়িয়ে। চালচিত্রের মতো। আদিত্য আর কন্দর্প গল্পে মত্ত। রুনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাপ্পা তবলা বাজাচ্ছে অ্যাটমের মাথায়। তিতির ছোট সোফায়। আহা, এমন মিলনমেলা এই গৃহে বিরল।

দুর্লভ কথা থামিয়ে বলে উঠল, ওই তো বউদি এসে গেছে। এবার শুরু করলেই হয়।

 আদিত্য ইন্দ্রাণীকে দেখে দু হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল, আজই এত দেরি করলে! সবাই কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছে।

ইন্দ্রাণীর কপালে ভাঁজ ছিল। চিন্তার। স্কুলের ঝঞ্ঝাটটা মিটেও মিটছে না। শিক্ষিকাদের মিলিত চাপে কর্তৃপক্ষ শো কজ নোটিস তুলে নিয়েছে, কিন্তু সার্ভিস বুক এখনও ঠিক করেনি। সেই ক মাসের গণ্ডগোল রয়েই গেল। ছুটির পর আজ কমলিকার বাড়ি গিয়েছিল ইন্দ্রাণী, সেখান থেকে দুপুরের খাওয়া সেরে দুজনে মিলে শিক্ষক সমিতির অফিসে। তারা বলেছে, হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে এসে কথা বলবে, প্রয়োজন হলে ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গেও। তারপরেও কত দূর কি হবে তাই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, ইন্দ্রাণীর চাকরিতে জয়েন করার চিঠিটাই হারিয়ে ফেলেছে স্কুল, ইন্দ্রাণীর কাছেও কপিটা নেই। শেষে কি ডি আই অফিসে ছুটতে হবে?

ভাঁজটুকু কপাল থেকে মুছে নিল ইন্দ্রাণী। এমন এক সুন্দর পারিবারিক দৃশ্যে উদ্বিগ্ন মুখ মানায় না। স্মিত মুখে বলল, সবে তো সাতটা বেজেছে। আমি চট করে ওপর থেকে ঘুরে আসছি।

জয়মোহন বললেন, না না না। আবার ওপরে গিয়ে কী হবে? চাঁদু বলছে আড়াই ঘণ্টার ছবি, এর পর শুরু হলে আমি খাব কখন?

–কিচ্ছু দেরি হবে না। চাঁদু ততক্ষণ আপনার ঘরে ভিসিপি-টিসিপি লাগাক, আমি যাচ্ছি আর আসছি।

জয়মোহন শিশুর মতো হাসলেন, অ। চাঁদু তা হলে সকলকেই নেমন্তন্ন করে রেখেছিল! আমিই লাস্ট।

রুনা বলল, লাস্ট কেন হবেন? আপনিই প্রধান। চাঁদু তো সকালেই ঠিক করে রেখেছে আপনার ঘরে দেখানো হবে।

কন্দর্প নার্ভাস মুখে হাসল, ভেবেছিলাম বাবা যদি রাজি না হয় তাহলে…

 অ্যাটম বলল, দাদু কেন রাজি হবে না? দাদুই তো আমাদের সবার পতি।

বাপ্পা একটা উড়নচাঁটি মারল অ্যাটমের চাঁদিতে, সবার পতি কি রে! সভাপতি।

জানি জানি, যার মানে হল গিয়ে প্রেসিডেন্ট। ও জেম্মা, তাড়াতাড়ি ঘুরে এসো না।

দ্রুত কাপড় বদলে, বাথরুম ঘুরে, ইন্দ্রাণী নীচে নেমে দেখল গোটা জটলাটা সরে গেছে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে। ইজিচেয়ার আলো করে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন জয়মোহন, খাটের গ্যালারি দর্শকে পরিপূর্ণ, দুর্লভ একটা মোড়া টেনে বসেছে, মিনতি মাটিতে টিভির সামনে। দেওয়ালের ছবি থেকে হাসছেন শোভনাও।

ইন্দ্রাণী খুশি খুশি মুখে বলল, দীপুও এসে গেলে ভাল হত না!

রুনা গলা ভার করল, ওর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কত বার বলে দিলাম সন্ধে সন্ধে ফিরো আজ…! চাঁদু, তুমি স্টার্ট করে দাও।

ইন্দ্রাণী খাটে বসেছে।

সিনেমা শুরু হল। জয় পরাজয়।

টাইটেলে নায়ক নায়িকার পরেই কন্দর্পর নাম। বড় বড় হরফে। ঘরে মৃদু হর্ষধ্বনি। কন্দর্পর পিঠে আলগা কিল মারল রুনা। জয়মোহনও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ছেলেকে। গর্বিত চোখে।

আরম্ভটা পুরোপুরি ঋতুশ্রীর কবজায়। ডানপিটে মেয়ে ঋতুশ্রী লাফাচ্ছে, গান গাইছে, নাচছে, টাং টাং গাছে উঠে পড়ছে। কখনও সে জিনস শোভিত, কখনও সালোয়ার কামিজ, কখনও মিনি স্কার্ট। টাইট সাদা টিশার্ট আর শর্টস পরে টেনিসও খেলল ঋতুশ্রী। অপোনেন্ট বাবা।

জয়মোহন বিরক্ত মুখে বললেন, মেয়েটাকে বাপ মা একটা শাড়িও কিনে দিতে পারে না?

রুনা বলল, একেই বলে ফিগার। যা পরছে, তাই মানিয়ে যাচ্ছে।

আদিত্য বলল, মুখটিও ভারি টলটলে। আমাদের তিতিরের ভাব আসে।

 বাপ্পা নাক কুঁচকোল, –তোমাদের চোখে কী হয়েছে বলো তো? এই ঢ্যাপসা মুটকিটাকে তোমরা সুন্দর বলছ?

ইন্দ্রাণী বলল, –সবই তো হল, কিন্তু চাঁদু কোথায়?

বলতে বলতেই রোমহর্ষক দৃশ্য। ঋতুশ্রী জলে পড়ে গেছে, সাঁতার জানে না, হাবুডুবু খাচ্ছে। পথ দিয়ে নায়কের পিছনে মোটর সাইকেলে করে যাচ্ছিল কন্দর্প, চলন্ত দ্বিচক্রযান থেকে এক লাফে সে নেমে পড়েছে, উল্কার গতিতে ঝাঁপ দিয়েছে পুকুরে। চুল ধরে নায়িকাকে টেনে আনল পাড়ে, কোলপাঁজা করে এনে ডাঙায় শোওয়াল। সিক্ত নায়িকার মুখে ফুঁ দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে, জল বার করছে পেট টিপে টিপে।

গোটা ঘর পিন পড়লে শোনা যায় এমন নিস্তব্ধ।

আদিত্য উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, উপুড় কর চাঁদু, উপুড় কর। চিত করে জল বার করে না।

কন্দর্প মিচকি হাসল, এখন আর উপায় নেই দাদা। শুটিং, এডিটিং সব কমপ্লিট। সেনসারও হয়ে গেছে।

–তোদের ডিরেক্টরটা কী রে, কিচ্ছু জানে না!

–ডিরেক্টরের দোষ নয়, ঋতুশ্রীর দোষ। কিছুতেই উপুড় হতে রাজি হল না। ওর নাকি পিঠে কোমরে হাত ছোঁওয়ালে কাতুকুতু লাগে। এদের জানো না দাদা, কাতুকুতু ব্যাপারে নায়িকাগুলো ভীষণ সেনসেটিভ।

জয়মোহন গোমড়া মুখে বললেন, হুঁহ।

 এমত সময়ে সুদীপ ঢুকেছে। হন্তদন্ত মুখে বলল, শুরু হয়ে গেছে নাকি?

রুনা বলে উঠল, এমন কিছু মিস হয়নি। চাঁদু, তোমার সিনটা আরেক বার মেজদাকে দেখিয়ে দাও।

অ্যাটম লাফ দিয়ে সুদীপের কাছে চলে গেল, ছোটকা যা একটা সুপারম্যানের মতো ডাইভ দিল না!

মিনতি মুগ্ধভাবে বলল, ছোড়দা কী সুন্দর মেয়েটাকে দু হাতে তুলল। মেয়েটা ছোড়দার বউ হলে বেশ হয়।

আদিত্য হা হা হাসল, এই মেয়েকে তোর পছন্দ হয় চাঁদু? নাকি অন্য মেয়ে পছন্দ করা আছে?

ইন্দ্রাণী কটমট করে তাকাল আদিত্যর দিকে। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শুরু করলে আদিত্যর আর সীমাজ্ঞান থাকে না। আলগা ধমকের সুরে বলল, কথা না বলে চুপচাপ দেখো তো।

সুদীপও ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিয়েছে গ্যালারিতে। কন্দর্প পর্দায় এলেই সবাই চুপ, বাকি সময়ে কথা চলছে টুকটাক। ঠাট্টা তামাশা হচ্ছে। রুনার চটুল রসিকতায় পায়রা ওড়ানো হাসির লহর উঠল। বাপ্পার মন যত না সিনেমায়, তার চেয়ে বেশি ফুট কাটাতে। বাংলা ছায়াছবির গ্রাম্যতা নিয়ে মাঝে মাঝে ঝাঁঝালো মন্তব্য করছে বাপ্পা, কন্দর্প হাসিমুখে শুনছে। সুদীপ মিনতিকে চা করে আনতে বলল। মিনতি উসখুস করছে, উঠছে না। জয়মোহনের দুলুনি আসছে বার বার, কেঁপে কেঁপে তাকাচ্ছেন, প্রাণপণে সজাগ রাখতে চাইছেন স্নায়ু।

এই সমস্ত দৃশ্য দেখে, সকলকে দেখে, বুকটা ভরে যাচ্ছিল ইন্দ্রাণীর। এ বাড়িতে আগে কখনও এমন সুন্দর জমায়েত হয়েছে কি? ইন্দ্রাণীর তো মনে পড়ে না। শাশুড়ি বেঁচে থাকতেই তো ছোট ছোট অদৃশ্য পাঁচিলে ভরে যাচ্ছিল সংসার। ভায়ে ভায়ে পাঁচিল। বাপ ছেলেদের মধ্যে পাঁচিল। দেওর বউদির পাঁচিল। জায়ে জায়ে পাঁচিল। সাংসারিক ছোট ছোট স্বার্থ কোত্থেকে যে কখন দেওয়াল তোলে! তবুও তো একসঙ্গে ছিল সবাই। বহুদিন। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ইন্দ্রাণীই কি পাঁচিলগুলোকে প্রকট করে দিল? কীই বা আর করার ছিল তা ছাড়া? ঘরের মানুষটি যার অমন আলাভোলা, নিজের মান বাঁচাতে, ছেলেমেয়ের কথা ভেবে, তাকে তো কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।

হঠাৎ তিতিরের দিকে চোখ পড়ল ইন্দ্রাণীর। মেয়েটা ওরকম এক কোণে চুপটি মেরে বসে আছে কেন? সবার থেকে আলাদা হয়ে? যেন এই পরিবারের কেউ নয় সে, এমন একটা ভাব তিতিরের মুখে!

ইন্দ্রাণীর গা ছমছম করে উঠল। খর চোখে তাকাল মেয়ের দিকে, অ্যাই, কী হয়েছে রে তোর?

তিতির চমকেছে, কিছু হয়নি তো। সিনেমা দেখছি।

সবাই কত কথা বলছে, তুই চুপ কেন?

 কন্দর্প কথা ছুঁড়ল, ছোটকা কত ঢ্যাঁড়শ, তা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তাই না রে তিতির?

তিতির ঈষৎ চোয়াল ফাঁক করল, হুম।

সুদীপ চোখ টিপল, তিতুমিরকে এখন তোমরা কেউ ডিস্টার্ব কোরো না। ও মন দিয়ে হিরোইনকে কপি করছে।

ছোটবেলায় তিতিরকে আদর করে তিতুমির বলত সুদীপ। কত কাল পর আবার ওই নামে ডাকল!

ইন্দ্রাণী আবার সিনেমায় মন দিল। বেশ অভিনয় করছে চাঁদু। নায়িকার প্রতি একটা নীরব প্রেমের ভাব সুন্দর ফুটিয়ে তুলছে। আগে এই সব দৃশ্যে চাঁদুকে ভীষণ ক্যাবলা লাগত। মধুমিতার প্রেমে পড়েই কি চাঁদুর এই উন্নতি!

দোতলায় ফোন বাজছে। সুদীপ ত্বরিত পায়ে উঠে গেল। ওপর থেকে ডাকছে ইন্দ্রাণীকে, বউদি, তোমার ফোন। ইন্দ্রাণী সিঁড়ির মুখে গেল, কে?

–শুভাশিসদা।

এখনই ফোন করতে হল শুভাশিসকে?

ইন্দ্রাণী বলতে যাচ্ছিল পরে ফোন করতে বলল, কি ভেবে উঠে এল দোতলায়।

রিসিভার ইন্দ্রাণীর হাতে দিয়ে সুদীপ ঘরে চলে গেছে। ইন্দ্রাণী গলা ঝাড়ল, কী হল?

খুব ব্যস্ত আছ মনে হচ্ছে?

 –তা একটু আছি। বলো, কী বলছ?

কী এমন জরুরি কাজ? হাসছে শুভাশিস।

 –আমার সংসারের।

 শুভাশিস একটু বুঝি থেমে রইল। তারপর বলল, না, তেমন কিছু দরকার ছিল না। বেকবাগানের চেম্বারটা তাড়াতাড়ি হয়ে গেল, নার্সিংহোমে চলে এলাম..

–ও। ইন্দ্রাণীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আসছ কবে?

–দেখি। সময় পেলেই যাব। নার্সিংহোম স্টার্ট করেও যা টেনশান। বাই দা ওয়ে, তোমার বন্ধুর বরের পেমেন্ট কিন্তু ক্লিয়ার করে দিয়েছি।

–শেফালি বলেছে আমায়। আর কিছু?

 শুভাশিস আবার একটু থেমে থেকে বলল, বাড়ির খবর সব ভাল তো? তিতির…?

ভাল। তোমার বউয়ের শরীর এখন কেমন?

–আগের মতোই। এখনও এক জেদ, অপারেশন করাবে না।

দ্যাখো কি করবে। রাখছি।

 নার্সিংহোম চালু হওয়ার পর থেকে শুভাশিস এ বাড়িতে আসা যাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে, টেলিফোনেই খোঁজখবর নেয়। নতুন নেশা পেঁচিয়ে ধরেছে শুভকে। ভাল লক্ষণ। জটিলতা যত কমে আসে, ততই মঙ্গল।

নীচে নামার আগে সুদীপের ঘরের সামনে দাঁড়াল ইন্দ্রাণী, –কি, তুমি আর সিনেমা দেখবে না?

যাচ্ছি পরে। একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।

আবার হইহল্লার মাঝে ফিরেছে ইন্দ্রাণী, কিন্তু কিছুতেই আর আগের মতো মনোযোগী হতে পারছে না। কোথায় যেন তাল কেটে গেল। যখনই এই পরিবারে ইন্দ্রাণী আপ্লুত হতে চায়, কেন যে তখনই টোকা দিয়ে যায় শুভ! ইন্দ্রাণীর এ কেমন নিয়তি।

সুদীপ আর নামল না। সিনেমা শেষ। গ্যালারি খালি হচ্ছে। সবার আগে ছুটল দুর্লভ। পিছন পিছন তিতিরও উঠে গেল। সেদিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল বাপ্পা। কন্দর্পকে বলল, ব্যাড লাক ছোটকা। তোমার মেইন ফ্যান আজ কোনও ওপিনিয়ন দিল না।

কন্দর্প ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করছিল। বলল, তাই তো দেখছি। প্রিন্সেসের আজ মুড অফ কেন বল তো?

কত কি হতে পারে! স্কুলে ঝাড় ফাড় খেয়েছে হয়তো।

অ্যাটম দু পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে দরজায়, না গো। দিদিভাইয়ের আজ বন্ধু এসেছিল। দুজনে মিলে ছাদে কাঁদছিল।

আদিত্য বিচলিত হয়ে পড়ল, কেন? কাঁদছিল কেন?

–ওই বন্ধুটার খুব দুঃখ, তাই।

বাপ্পা চোখ নাচাল, কী দুঃখ? অ্যা

টম প্রাজ্ঞ মুখে তিতিরের গমনপথের দিক নেত্রপাত করল। ফিক করে হেসে বলল, জানি না।

কন্দর্প বলল, টিন এজ সিনড্রোম। এই বয়সে কান্না সর্দির মতো ছোঁয়াচে হয়।

ইন্দ্রাণী নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। ছেলেকে বলল, তুই ওপরে গিয়ে ওর পেছনে লাগবি না কিন্তু।

হুঁহ, আমার যেন কোনও কাজ নেই! শিস দিতে দিতে দোতলায় যাচ্ছে বাপ্পা।

 রুনা ফিরে এসেছে দরজায়, বাবা, আপনার খাবার গরম করতে বলি?

জয়মোহন চোখ বুজে শুনছেন সকলের কথা। মিটিমিটি হাসছেন। বললেন, হ্যাঁ, এবার তো খেতে হয়।

ইন্দ্রাণী চোখের ইশারা করল কন্দর্পকে। জয়মোহনের পাশটিতে এসে ঝুঁকল কন্দর্প, বাবা?

উঁ?

–তোমার কেমন লাগল, তা তো বললে না?

–আমার একার ভাল লাগলেই হবে! লোকজন টিকিট কেটে দেখবে, তাদের বিচারই আসল।

–তা হোক, তোমার কেমন লাগল বলবে না?

জয়মোহন প্রসন্ন মুখে বললেন, বাপের চোখ তো, তোকে ছাড়া আর কাউকে তেমন চোখেই লাগল না। তবে সব চেয়ে কি ভাল লাগল জানিস? এই যে তোরা সবাই আবার এক সঙ্গে হলি…

আদিত্য মাথা ঝাঁকাল, সে তত আমরা যখন খুশি হতে পারি। কোনও একটা অকেশান বার করলেই হয়। এই যেমন ধরো…। আদিত্য মাথা চুলকোচ্ছে, মাঘ মাসে তোমার জন্মদিন না? এবার তো পঁচাত্তর হচ্ছে! ঘটা করে আমরা তোমার ডায়মন্ড জুবিলি করব। জয়িরাও আসবে…। কি, আইডিয়াটা ভাল না?

লাভ কী? খাবি তো তোরা।

রুনা ঠোঁট টিপে হাসছে, ঠিক আছে, সেদিন নয় যা খুশি খাবেন।

বলছ? তাহলে আক্তারকেও নেমন্তন্ন কোরো সেদিন। সে থাকলে মনে বলভরসা পাব। জয়মোহন ফুটছেন খুশিতে। চোখ খুলে তাকাচ্ছেন ইতিউতি, –তোমার পুত্তুর কোথায় গেল বড় বউমা?

কন্দর্পই উত্তর দিল, সে কি আর থাকে। অনেক রিকোয়েস্ট করাতে বহু কষ্টে আজ একটা বাংলা বই গিলেছে। অমূল্য সময় নষ্ট করে।

–ডাক তো ওকে।

ইন্দ্রাণী অবাক হল। আজ কি সবই উল্টো রকম হবে নাকি? শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে বাপ্পার না অহিনকুল সম্পর্ক! উৎফুল্ল মুখে প্রশ্ন করল, কেন বাবা?

-আহা, ডাকো না।

বাপ্পা এল হেলে দুলে। তাকে দেখে রহস্যময় হাসি ফুটেছে জয়মোহনের চোখে। শীর্ণ মুখে রক্তের আভা। হেঁয়ালি করার ঢঙে বললেন, আমি যদি তোকে একটা জিনিস দিই, তুই আমাকে কী দিবি?

বাপ্পা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে ঘরের প্রাণীদের দেখল। বলল, কি জিনিস?

বল তো কী?

–সরি। আমি গেস করতে পারি না।

জয়মোহন ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলেন। হাঁটছেন। ঝুঁকে তোশকের এক পাশ তুলে অনেকটা ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা লম্বা খাম বার করলেন, আমাকে তুই খুব মুখ করিস, ভেবেছিলাম তোকে দেব না। মনটা খুব ভাল লাগছে বলে, যাহ দিয়েই দিলাম।

ছোঁ মেরে খাম কেড়ে নিয়েছে বাপ্পা। ওপরটা এক ঝলক দেখে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, এ তো ওশান লাইনার্সের চিঠি! তুমি এটা এতক্ষণ আমাকে দাওনি! কী লোক!

জয়মোহন ভ্রূকুটি করলেন, কী আছে ওতে?

–আছে আমার মাথা, আর তোমার মুণ্ডু। আহ্লাদে ঝকঝক করছে বাপ্পা। দ্রুত খাম ছিঁড়ে চিঠি খুলে পড়তে পড়তে আবার চেঁচাল, আমি চাকরি পেয়েছি গো দাদু। জাহাজে। সেকেন্ড জানুয়ারি থেকে ম্যাড্রাসে ট্রেনিং শুরু হচ্ছে। তোমাদের কলকাতাকে এবার আমি কাঁচকলা দেখিয়ে চলে যাব। কত মাইনে পাব জানো?

–জেনে কাজ নেই। জয়মোহন যেন চুপসেছেন একটু, জাহাজের চাকরি ভাল নয়।

 –কেন?

অল্পবয়সী ছেলেদের জাহাজে থাকতে থাকতে মাথা বিগড়ে যায়।

হুঁহ। যত সব ব্যাকডেটেড আইডিয়া। চিঠি নিয়ে সগর্বে উড়তে উড়তে চলে গেল বাপ্পা।

আদিত্য কন্দর্প রুনা হতচকিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দ্রাণীর শরীর অবশ হয়ে আসছিল। এসেই গেল চিঠিটা! হা কপাল।

.

রাত্রে খেয়েদেয়ে উঠে বাপ্পার ঘরে এল ইন্দ্রাণী। টেবিলে পড়ে আছে খাম, খুলে চিঠিটা পড়ল নিজে। পুরো পড়ে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল ইন্দ্রাণীর। চোখে যেন আঁধার ঘনিয়ে এল। বাপ্পা যা যা বলেছে সবই ঠিক, কিন্তু মূল কথাটা তো একবারও বলেনি!

আদিত্য খাটে আধশোওয়া। সিগারেট খাচ্ছে। কি যেন ভাবছেও শুয়ে শুয়ে। বাপ্পা পাশের ঘরে। টিভি দেখছে।

ইন্দ্রাণী বাপ্পার খাটে বসল, তুমি চিঠিটা পড়েছ?

–নাহ। আদিত্য আনমনা, আমি পড়ে কী করব?

-ট্রেনিং-এ কত খরচা জানো?

–তাই বা আমি জেনে কী করব? ফোঁস করে শ্বাস ফেলল আদিত্য, কত?

–এরা যা হিসেব দিয়েছে…সব মিলিয়ে তা প্রায় চল্লিশ হাজার।

আদিত্য ধড়মড় করে সোজা হল, বলো কী! চল্লিশ হাজার!

 ইন্দ্রাণী থম মেরে বসে আছে। আকাশে মেঘ আছে। ছানাকাটা মেঘ। ঠাণ্ডা আজ কম। তা বলে এত গুমোট হবে? নীচের ঘরে অত জন মানুষ বসে ছিল এক সঙ্গে, তখন তো এমনটা লাগেনি?

ইন্দ্রাণী বিড়বিড় করে বলল, আমাকে কেটে ফেললেও অত টাকা বেরোবে না।

আদিত্য নড়ে বসল। বলল, তাহলে আর কি। এখনই ছেলেকে ডেকে বলে দাও।

ইন্দ্রাণী উত্তর দিল না।

আদিত্য নিজেই ডাকছে, বাপ্পা…অ্যাই বাপ্পা…।

বাপ্পা ঘরে এল। দেখল দুজনকে। বলল, কী?

–বোস, একটা কথা বলি।

ভুরু কুঁচকে মার পাশে বসল বাপ্পা।

আদিত্য একটু কেশে নিয়ে বলল, আমি আর তোমার মা পরামর্শ করে দেখলাম, তোমার ট্রেনিং-এর অত টাকা আমাদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়।

বাপ্পা মুখ বেঁকাল, তোমার কাছে কে টাকা চেয়েছে?

আদিত্য দার্শনিকের মতো হাসল, আমার কাছে চল্লিশ টাকা চাইলেও আমি দিতে পারতাম না রে।

–তাহলে চুপ করে থাকো।

ইন্দ্রাণীর এই মুহূর্তে মনে হল বাবাকে মান্য করতে না শিখিয়ে সে বাপ্পার উপকার করেনি। গম্ভীর গলায় বলল, বাবা ঠিকই বলছে।

বাপ্পা নিমেষে খেপে গেল, –একি কথা! এত কষ্ট করে আমি অ্যারেঞ্জমেন্ট করলাম…বম্বে গিয়ে যখন ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম, তখন তো কিছু বলোনি?

–তখন কি বলেছিলি অত টাকা লাগবে!

বলার কি আছে, এ তো জানা কথাই। ষোলো সতেরো হাজার টাকা মাইনে দেবে, তার জন্য কিছু গুড় ঢালতে হবে না? আমি এত দিন ধরে ছোটাছুটি করে মরছি..এই কথা শোনার জন্যে?

 ইন্দ্রাণী মিনতির সুরে বলল, একটু বোঝার চেষ্টা কর বাপ্পা। তুই তো আমাদের অবস্থা জানিস, হুট বলতে তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা কোত্থেকে পাব? আমার একটা গয়না পর্যন্ত নেই। দেখেছিস তো, বিয়েবাড়িতে আমি রুপোর ওপর সোনার জল করা গয়না পরে যাই।

কী চাও তোমরা বলো তো? আমার এত বড় চান্সটা গুবলেট হয়ে যাক?

–তা কেন! তুই লেখাপড়ায় ভাল, এখানেই কত সুযোগ আসবে। সিএ কর, ম্যানেজমেন্ট কর…

–আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। বাপ্পা বিকৃত গলায় চিৎকার করে উঠল, আই মাস্ট গো। আমি যাব।

ইন্দ্রাণী মাথা ঠিক রাখতে পারল না। খিঁচিয়ে উঠল, কিন্তু টাকা আমি পাব কোত্থেকে?

ধার করো, ভিক্ষে করো, চুরি করো, যেভাবে খুশি জোগাড় করো। আমার টাকা চাই।

যদি না দিতে পারি?

কী হবে দেখতেই পারে।

বাপ্পার স্বর হঠাই ভয়ঙ্কর শীতল হয়ে গেছে। এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল মুখে। দৃষ্টি ঘোলাটে। উন্মাদের দৃষ্টি।

.

৩৭.

টিফিনের বেল পড়তেই ইন্দ্রাণী স্কুলের অফিসঘরে এল। তাদের অফিসটি একটি বড়সড় হলঘর, একধারে রেলের বুকিং অফিসের মতো ক্যাশ কাউন্টার, অন্যদিকে অফিস কর্মচারীদের বসার চেয়ার টেবিল। পিছনে ঢাউস ঢাউস আলমারি, ফাইল রাখার স্টিলের র‍্যাক। অফিসে কর্মচারীর সংখ্যা সাকুল্যে চার। হেড ক্লার্ক, অ্যাকাউনটেন্ট, ক্যাশিয়ার, আর একজন ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট। মনোহর বিশ্বাস অফিসের বড়বাবু, তাঁর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন, তিনি বসেন ঘরের একদম কোণটিতে। তাঁর সামনের টেবিলটি অতিকায়, সেখানে সব সময়েই মোটা মোেটা জাবেদা খাতা থাকে।

ইন্দ্রাণীকে দেখে মনোহরবাবুর সদাপ্রসন্ন মুখে এক ফালি বাঁকা হাসি, কি দিদিমণি, আজ আবার কোনও চিঠি দিতে এলেন নাকি?

-নাহ। ইন্দ্রাণী চেয়ার টেনে বসল, আমি একটু অন্য দরকারে আপনার কাছে এসেছি।

বলেন। বলে ফ্যালেন। আমরা তো আপনাদের সেবাতেই আছি।

 কথাটা বিনয় নয়, শ্লেষ। ইন্দ্রাণীর অনেক সহশিক্ষিকা কারণে অকারণে অফিসঘরে এসে গল্পগাছা করে, কর্মচারীদের হাঁড়ির খবরাখবর নেয়, আহা উঁহু করে। মাইনের দিন ছাড়া দরকার না-পড়লে ইন্দ্রাণী এ ঘর মাড়ায়ই না। এ নিয়ে কর্মচারীদের হৃদয়ে সামান্য অভিমান আছে, তারা কেউ সোজাভাবে কথা বলে না ইন্দ্রাণীর সঙ্গে।

শ্লেষটা নীরবে হজম করল ইন্দ্রাণী। উপেক্ষাও করল বলা যায়। এমন অনেক কিছুই তাকে এখন উপেক্ষা করতে হবে, সে এখন গর্তে পড়েছে। শুকনো হেসে বলল, আমার একটা পি এফ লোন দরকার মনোহরবাবু।

–হুম, তাই বলেন। মনোহরবাবু বাড়ি থেকে আনা জলের বোতল থেকে এক ঢোঁক ফুটোনো জল খেলেন, কত চাই?

ম্যাক্সিমাম যতটা পাওয়া যায়।

–তাহলে তো আপনার অ্যাকাউন্টটা দেখতে হবে। আপনি রথীনের কাছে যান না।

 রথীন স্কুলের অ্যাকাউন্টেন্ট, বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, দিদিমণিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের কৌতূহল আছে তার। কমলিকার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে বলে একবার এক অলীক গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিল স্কুলে, নিবেদিতার সম্পর্কেও কিসব আজে বাজে কথা বলেছিল। ইন্দ্রাণী রথীনকে এড়িয়ে চলে।

মিনতির সুরে ইন্দ্রাণী বলল, আবার রথীনবাবু কেন? আপনিই একটু দেখে দিন না।

–অফিসে কাজের তো একটা নিয়ম আছে, সব কিছু কি ইচ্ছে মতো হয়?

 ইন্দ্রাণী নিচু স্বরে বলল, প্লিজ মনোহরবাবু..

মনোহরবাবু নাক-মুখ কুঁচকে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন ইন্দ্রাণীকে। গলা তুললেন, রথীন, দিদিমণিদের পি এফের খাতাটা দিয়ে যাও তো।

রথীন ক্যালকুলেটার টিপে কি যেন হিসেব কষছে। বলল, পাঁচ মিনিট বসতে হবে।

বসেন তবে। হাতের কাজটা সেরে নিক।

 ইন্দ্রাণী ঘড়ি দেখল, আমি তবে স্টাফরুম থেকে একটু ঘুরে আসি।

–আসেন।

 স্টাফরুমে খাবার এসে গেছে। মসালা ধোসা। মুখে রুচছে না ইন্দ্রাণীর, খুঁটছে। গতকাল নিউ আলিপুরের কোথায় যেন একটা ডাকাতি হয়েছে, কোন ফ্ল্যাটবাড়িতে, কতা-গিন্নি দুজনকেই মেরে রেখে গেছে ডাকাতরা, স্টাফরুম আজ তাই নিয়ে সরগরম। ভাসা ভাসা শুনছিল ইন্দ্রাণী, মন দিচ্ছিল না। কাল রাত থেকে এক জোড়া চোখ তাড়া করে চলেছে ইন্দ্রাণীকে। এক রক্ত হিম করা দৃষ্টি। টাকা না পেলে বাপ্পা যদি কিছু করে বসে…!  

খাবার অভুক্ত রেখে অফিসঘরে ফিরে ইন্দ্রাণী দেখল পি এফ-এর খাতা বড়বাবুর টেবিলে এসে গেছে।

ইন্দ্রাণী উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞাসা করল, কত জমেছে আমার?

দশ হাজার তিনশো একত্রিশ।

ইন্দ্রাণী দমে গেল। বারো তেরো বছরের চাকরিতে মাত্র এই কটা টাকা জমেছে! মিয়োনো গলায় বলল, পাব কত?

–সেভেনট্টি ফাইভ পারসেন্ট। এই ধরুন অ্যারাউন্ড সাড়ে সাত হাজার।

ইন্দ্রাণী পলকের জন্য ভাবল, কবে নাগাদ পেতে পারি?

–অ্যাপ্লিকেশান দিয়ে যান, মাসখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে।

–মাসখানেক! ইন্দ্রাণী ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল, আমার তো অদ্দিন দেরি করলে চলবে না।

–দেরি কোথায়? মাঝে বড়দিনের ছুটি পড়ে যাচ্ছে… ম্যানেজিং কমিটির কাছে পাঠাতে হবে.. চেক তৈরি করা, সই করানো…

ইন্দ্রাণী অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল। বলল, পি এফ লোন নীলিমাদি স্যাংশন করে দিতে পারেন না?

রথীন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে। কৌতূহলে লকলক করছে চোখ। বলল, কী ব্যাপার দিদিমণি, হঠাৎ লোনের জন্য এত তাড়া পড়ল কেন?

–আছে। খুব আরজেন্ট দরকার। ইন্দ্রাণী রথীনকে আমল দিতে চাইল না।

–মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন নাকি?

ইন্দ্রাণী আরও গম্ভীর হল, সাড়ে সাত হাজার টাকায় মেয়ের বিয়ে হয়?

–না, তবু সবাই তোলে তো…। আপনার মেয়ে অবশ্য ছোট। ইলেভেনে পড়ে না আপনার মেয়ে?

একে নিয়ে পারা যায় না। সব জানে, তবু পেজোমি করা চাই। ইন্দ্রাণী মনোহরবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, কি বড়বাবু, নীলিমাদি পারেন না স্যাংশন করতে?

অদম্য রথীন ফুট কেটেছে সঙ্গে সঙ্গে, আপনার সঙ্গে ঝামেলাটা মিটে গেছে?

–কোন ঝামেলা? আমার সেই জয়েনিং রিপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার? ও মিটে যাবে। তীক্ষ্ণ স্বরে কথাগুলো বলে উঠে পড়ল ইন্দ্রাণী, বড়বাবু, তাহলে কি অ্যাপ্লাই করে দেব?

–দিন। বড়দিদিমণির সঙ্গেও একবার কথা বলে নেবেন।

উনি তো আজ আসেননি। ইন্দ্রাণী অল্প ইতস্তত করল, ওঁকে বলে লাভ হবে কিছু? আপনার কী মনে হয়?

রথীন নাক বাড়িয়ে উত্তর দিল, লাভ হতেও পারে। সে বার রেবাদি তো সাত দিনে পেয়ে গেল। তেমনভাবে ধরাকরা করতে পারলে না হওয়ার কি আছে?

বিশ্রী একটা মেজাজ নিয়ে স্টাফরুমে এসে দরখাস্ত লিখছিল ইন্দ্রাণী, টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়ে গেল। অগত্যা উঠতেই হয়, চক ডাস্টার নিয়ে ছুটতেই হয় ক্লাসে। এখনও তিনটে ক্লাস বাকি।

শেষের পিরিয়ডগুলো কিছুতেই মন দিয়ে নিতে পারল না ইন্দ্রাণী। পাঠ্যবই-এর পাতা খুললেই যদি বাপ্পার চোখ এসে ভর করে, মন কি বশে থাকে! রাতভর দু চোখের পাতা এক হয়নি কাল। ছেলের জন্য এক অন্তর্নিহিত ত্রাস তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ক্ষোভ, সঙ্গে ছিল এক সুতীব্র অভিমান। তিতিরের থেকে যাকে অনেক বেশি আদর দিয়েছে ইন্দ্রাণী, সেই কিনা ওই ভাষায় কথা বলে! মাকে তুচ্ছ করে, পরিবার পরিজনকে ভুলে, শুধু নিজের কথাই ভাবছে বাপ্পা! এত স্বার্থপরতার শিক্ষা বাপ্পা পেল কোত্থেকে? ইন্দ্রাণীই দিয়েছে কি? নাকি দিয়েছে সময়, এই লোভী সময়? অথবা তাদের ভাঙা নৌকোর মতো পরিবার? যাকে যখন আঁকড়ে ধরতে চায় ইন্দ্রাণী, সেই যে কেন পিছলে যায়!

যাক। ইন্দ্রাণী আর কিচ্ছুটি বলবে না। যেখান থেকে হোক টাকা জোগাড় করে ছেলের মুখে ছুঁড়ে মারবে ইন্দ্রাণী। সামান্য চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকার তো ব্যাপার, তার জন্য তুই মাকে শাসাস, এত বড় তোর স্পর্ধা? ইন্দ্রাণীর স্কুল রয়েছে, স্কুলের বন্ধুবান্ধব রয়েছে, প্রেস রয়েছে, চারদিক থেকে ব্যবস্থা করলে ওই টাকা কি উঠে যায় না?

রাতে এরকমই ভেবেছিল ইন্দ্রাণী। রাতের আঁধারে ভাবা অনেক সহজ। আঁধারের একটা নিষ্ঠুর সম্মোহনী শক্তি আছে, রাত বড় অলীক ভাবনা ভাবায় মানুষকে। দিনের আলোয় ভাবনাকে কাজে পরিণত করা যে কী কঠিন! দিন বড় কঠোর বাস্তব। স্কুলে কাউকে টাকার কথা বলতে পারল ইন্দ্রাণী? কাকে বলবে? কার সঙ্গেই বা তার তেমন সখিত্বের সম্পর্ক আছে? কমলিকার কাছে চাইবে? কমলিকা সদ্য ফ্ল্যাট কিনেছে, চারদিকে তার এখন প্রচুর দেনা, প্রায়শই তাই নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত থাকে কমলিকা। বড় জোর তার কাছ থেকে দু-এক হাজার চাওয়া যেতে পারে, তার বেশি কখনই নয়। এক শেফালিকে বললে পনেরো-বিশ হাজার টাকা পাওয়া যায়, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে বলা কি উচিত হবে? শেফালি যদি ভাবে নার্সিংহোমের কাজটা তার বরকে পাইয়ে দিয়ে সুযোগ নিচ্ছে ইন্দ্রাণী? ছিহ।

ছুটির পর ফাঁকা স্টাফরুমে দরখাস্ত লিখে ফেলল ইন্দ্রাণী। রুটিন বয়ান, তবু কেমন লিখতে অস্বস্তি হচ্ছিল। প্লিজ, কাইন্ডলি, গ্রেটফুল শব্দগুলো বসানোর সময় কেমন যেন বিরুদ্ধতা এসে যায় মনে। নীলিমাদিকে অনর্থক তেল দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না তো? আবার এগুলো না থাকলেও চিঠি ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে। কি আর করা যাবে? যা ভাবার ভাবুক গে।

দরখাস্ত হাতে ইন্দ্রাণী আবার অফিসঘরে এল। ফাঁকা অফিসঘর। একা মনোহরবাবু কি যেন মেলাচ্ছেন বসে বসে। ভীষণ মন দিয়ে। ইন্দ্রাণীর ছায়ায় বুঝি বিঘ্ন ঘটল কাজে, মাথা তুললেন, –ও আপনি! এনেছেন?

মৃদু ঘাড় নাড়ল ইন্দ্রাণী। সংশয় নিয়ে বলল, পাব তো এ মাসের মধ্যে?

মনোহরবাবু ডটপেন বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলেন। চশমা কপালে তুলে ঘষলেন চোখ দুটোকে। বললেন, বসেন। আপনাকে কটা কথা বলি।

ইন্দ্রাণী বসে ঘড়ি দেখল। সাড়ে বারোটা। তখন টিফিনে কিছু খেতে পারল না, এখন পেট চুঁই চুঁই করছে। উদ্বেগ অশান্তি কোনও কিছুতেই কেন যে খিদে তেষ্টার বোধগুলো মরে যায় না!

মনোহরবাবু চশমা স্বস্থানে আনলেন, –হক কথা শোনেন। হপ্তা তিনেক তো লাগবেই। বড়দিদিমণি তিন দিনের ছুটি নিয়েছেন, কিন্তু সাত দিনের কমে আসবেন না। ওঁর এক পুষ্যি আছে, ভাইঝি। সে এসেছে আমেরিকা থেকে।

–তাহলে আমার কি হবে?

–আমি কাল ওঁর বাড়িতে যাব একটা ফাইল সই করাতে, তখন এটা দিয়ে দিতে পারি। তবে কি জানেন তো দিদিমণি? কিছু মনে করবেন না, মেয়েরা অনেক বেশি ভিন্ডিকটিভ টাইপের হয়। বিশেষ করে তার শত্রুপক্ষও যদি মেয়ে হয়।

ইন্দ্রাণী নিরক্ত মুখে হাসল, শত্রুতার কী আছে! যা হয়েছে তা তো অফিসিয়াল ব্যাপার।

–উনি তা মনে করেন না। আপনিও কি করেন দিদিমণি?

 ইন্দ্রাণী উত্তর দিল না।

রথীন যাই বলুক, আমি বলি কি আপনি এ সবের মধ্যে যাবেন না। সামান্য তো কটা টাকা..! আপনি তাঁকে রিকোয়েস্ট করবেন, তিনিও সুযোগ পেয়ে হয়তো চারটি কথা বলে নেবেন… আপনি একটা কজের জন্য লড়ছেন… বেআইনি কিছু বলছেন না… মনোহরবাবু বলতে বলতে হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন, টাকাটা কী জন্য দরকার?

–আছে। ইন্দ্রাণী বলব না বলব না করেও বলে ফেলল, এই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া সংক্রান্ত ব্যাপার আর কি।

–অ। ছেলেমেয়ে! মনোহরবাবু চোখ নামালেন কাগজে। দু দিকে মাথা নাড়ছেন, সব পণ্ডশ্রম। সব পণ্ডশ্রম। যা ঢালবেন, দেখবেন সবই অপচয়।

ইন্দ্রাণী কিছু বলতে যাওয়ার আগে মনোহরবাবু আবার বলে উঠলেন, কত জন তো কত ভাবে ছেলেমেয়ের পেছনে খরচা করে, কী লাভ হয়? বিষ ঢেলে দেয় ছেলেমেয়েরা। আমার ছেলের জন্য তিনটে টিউটর রেখেছিলাম, সাধ্যের অতিরিক্ত করে ভাল স্কুলে ভর্তি করেছিলাম…। কেন করেছিলাম বলুন? নিজের জোটেনি বলে, তাই তো? ভেবেছিলাম ছেলেকে যেন বাপের মতো কেরানির জীবন না কাটাতে হয়। হাতির খরচ জোগানোর জন্য সন্ধেয় পার্টটাইম, বিকেলে পার্টটাইম, কী করিনি? পরিণামে হলটা কী, সেই ছেলে এখন ড্রাগে বুঁদ হয়ে থাকে। বছরে দু বার তিন বার ড্রাগ ছাড়ানোর হোমে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতে হয়। পার্টটাইমের টাকা এখন ডাক্তাররা গিলছে, ছেলে যে কে সেই।

মনোহরবাবুর ছেলের সম্পর্কে কিছু কিছু উড়ো কথা শুনেছিল ইন্দ্রাণী। দুশ্চিন্তা ভুলে সমবেদনার সুরে প্রশ্ন করল, ছেলে এখন আছে কোথায়, বাড়িতে?

-হ্যাঁ, সেই জন্যই তো চিন্তা। মায়ের ওপর জুলুম করে টাকা নিয়ে যায়। না দিলে ঘড়ি-আংটি যা হাতের কাছে পায় বেচে দেয়। আমায় ভয় দেখায় ট্রেনলাইনে গলা দেবে। রোজই বাড়ি ফেরার সময়ে সিঁটিয়ে থাকি, কোনদিন গিয়ে দেখব এসপার-ওসপার কিছু একটা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু একটা হয়ে গেলেও বোধহয় বাঁচি। কদিন শোকদুঃখ হবে ঠিকই, তবু এই রোজ রোজ দগ্ধে মরার হাত থেকে তো মুক্তি পাব। মানুষ যে কি সুখে সংসারধর্ম করে!

খিটখিটে প্রৌঢ় মানুষটা মূহ্যমান বোবা হয়ে বসে আছেন। স্থির। ইন্দ্রাণীও ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে। কষ্ট করে ছেলের জন্য টাকা জোগাড় করলেও ছেলে যে এমন কিছু মহৎ প্রতিদান দেবে না, এ তো ইন্দ্রাণীর জানা কথা। তবু টাকা চাই। হয়তো দুঃখ পেতেই।

মনোহরবাবু বললেন যাক গে, আমার কথা ছাড়ন। আমার খারাপ হয়েছে বলে সকলেরই খারাপ হবে কেন। তা এত টাকা দরকার বলছেন, কিসে ভর্তি করবেন? কম্পিউটার ক্লাস?

ইন্দ্রাণী সত্যিটা ভাঙল না, হ্যাঁ ওরকমই একটা কিছু। শুধু জেনারেল লাইনে পড়ে তো লাভ নেই।

–ভাল। রেখে যান অ্যাপ্লিকেশানটা।

ইন্দ্রাণী অন্য কথা ভাবছিল। যদি সত্যিই এক তারিখের মধ্যে না পাওয়া যায়, দরখাস্ত দিয়ে কী লাভ? পেলেও তো পাবে মাত্র সাড়ে সাত হাজার, তা দিয়ে ঘটির কোণও ভর্তি হবে না।

ভেবেচিন্তে দরখাস্তটা তুলে নিল ইন্দ্রাণী। থাক।

মনোহরবাবু আড়চোখে দেখলেন কী হল, আপনার টাকা লাগবে না?

–দেখি, অন্য কোথাও থেকে জোগাড় করে নেব।

–আমার কথায় ডিজহার্টেনড হয়ে পড়লেন না তো? আমি কিন্তু সেরকম ভেবে কিছু বলিনি। মনের দুঃখে অনেক কথা বেরিয়ে যায়।

না না, তা নয়। আপনি কাজ করুন।

ইন্দ্রাণী বেরিয়ে এল। স্কুলগেটে এসে পিছন ফিরে তাকাল একবার। গোটা বিল্ডিং খাঁ খাঁ করছে। বিশাল চাবির গোছা হাতে একটার পর একটা ঘর বন্ধ করছে ছবিলাল। সুনসান করিডোর ধরে একা একা হাঁটছে বুড়ো দারোয়ান। ভারী পায়ে। দুলে দুলে।

ঘরের পর ঘর যেন বন্ধ হয়ে চলেছে এক নিরাসক্ত ঈশ্বরের হাতে!

 ছবিলালের হাঁটাটা কী নির্জন! কী নিঃসঙ্গ!

.

বাড়ি ঢুকেই ইন্দ্রাণী দেখল আদিত্য বেরোয়নি আজ। বড়ঘরের আলমারি খুলে কাপ-মেডেলগুলো বার করেছে, ছড়িয়ে বসেছে মেঝেতে।

বিরক্ত মুখে ইন্দ্রাণী বলল কী করছ ওগুলো নিয়ে?

ধুলো ভর্তি হয়ে গেছে, মুছছিলাম।

 নেই কাজ তো খই ভাজ। তাও যদি কাপ-মেডেলগুলোর একটাও নিজের হত। সবই তো সুদীপের পাওয়া, নয় কন্দর্পর। সুদীপ স্কুল কলেজে ভাল অ্যাথলিট ছিল, কন্দর্পর কাপ-মেডেল আবৃত্তি নাটকের। জয়শ্রীরও গানের মেডেল আছে দু-একটা। স্কুল থেকে পাওয়া। কী যে সুখ পায় আদিত্য এ সবে হাত বুলিয়ে!

ইন্দ্রাণী নাক কুঁচকে বলল, এই তো কদিন আগে সব নামিয়েছিলে…।

–সে পুজোর আগে। আগে তো মাসে মাসে করতাম। বলেই ইন্দ্রাণীর দিকে সরাসরি তাকাল আদিত্য, বাপ্পা আজ নটার পর ঘুম থেকে উঠেছে।

–ভাল। বাবার অভ্যেস রপ্ত করছে। তা শুনে আমি কী করব?

-না এমনিই। বলছিলাম আর কি। উঠেই গটগট করে বেরিয়ে গেল, চা জলখাবারটা পর্যন্ত খেল না…

পলকের জন্য ইন্দ্রাণীর বুকে যেন একটা তার নড়ে গেল। সামলে নিয়ে বলল দুপুরে এখনও খেতে আসেনি?

–নাহ। একটা রুপোলি ছোট্ট কাপ আলমারিতে ঢুকিয়ে ঢাকা বসিয়ে দিল আদিত্য।

 ইন্দ্রাণীর আর কথা বলার প্রবৃত্তি হল না। রাত থেকে চিন্তায় চিন্তায় তার পাগল পাগল দশা, অথচ এই লোকটাকে দ্যাখো, দিব্যি নির্বিকার মুখে আলমারিতে কাপ-মেডেল গোছাচ্ছে!

শীত পড়ছে। শুকনো হাওয়ায় টান ধরে চামড়ায়। দুপুরের দিকে শাওয়ারের জলে এখনও তেমন কনকনে ভাব আসেনি, তবু তার স্পর্শে ছ্যাঁক করে ওঠে শরীর, স্নানের পর গায়ে একটা চাদর জড়ালে আরাম লাগে বেশ।

স্নান খাওয়া সেরে ইন্দ্রাণী শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখের পাতা ভারীর ভারী তস্য ভারী, একটা ঘুম ঝিরঝির করে বয়ে চলেছে দেহকাণ্ডে, অথচ মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। করোটির ভেতর যেন ঢুকে পড়েছে এক ঘুরঘুরে পোকা, কিরকির করতে করতে নেমে আসছে কপালে, চক্রাকারে পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে আবার।

দু আঙুলে মাথা টিপে শুয়ে রইল ইন্দ্রাণী। ব্যথা কমছে না। উঠে ব্যাগ থেকে একটা মাথা ধরার ট্যাবলেট বার করে খেল। ব্যথার ওপর এক অবশকারী প্রলেপ ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এই ভোঁতা বোধটুকুই কী আরাম!

জোর করে তন্দ্রা ভাব ঝেড়ে ফেলে আলমারি খুলল ইন্দ্রাণী। লকারে প্রেসের টাকা কিছু সরানো থাকে, বার করে এনে বসেছে বিছানায়। প্রেসের টাকা থেকে সংসারের জন্য প্রতি মাসে হাজারখানেক সরিয়ে রাখে, এ মাসে এখনও নেওয়া হয়নি, টাকাটা আলাদা করে রাখল। পড়ে রইল চার হাজার আটশো। ব্যাঙ্কে দুটো অ্যাকাউন্ট আছে। প্রেসের। নিজের। দুটো পাশ বইই উল্টেপাল্টে দেখল। একটাতে আছে চব্বিশশো সাঁইত্রিশ, অন্যটায় একত্রিশশো। সবই এত কম! যেন সমুদ্র বাঁধার জন্য কাঠবেড়ালির মুখে বয়ে আনা নুড়িপাথর।

খুট করে একটা শব্দ হল বাইরে। বাপ্পা এল নাকি! না, বাপ্পা এলে তো দুমদাম করে সিঁড়ি দিয়ে উঠত। দু-তিনটে ধাপ এক সঙ্গে টপকে।

কয়েক সেকেন্ড কান পেতে থেকে আবার কাজে মন দিল ইন্দ্রাণী। আলগা হিসেব কষছে মনে মনে। দুর্লভ পরশুদিন কাগজের কথা বলছিল, দু রিম কাগজ কিনতে হবে। বাইন্ডারও বিল দিয়ে গেছে। পুজোর আগে কয়েক কেজি টাইপ কেনার কথা ছিল, এখনও হয়ে ওঠেনি। কম্পোজিটারদের জন্যও দু-তিন সপ্তাহের মতো টাকা সরিয়ে রাখা দরকার। এর মধ্যে নতুন কোনও পেমেন্ট আসবে কি? পুজো আর দেওয়ালিতে সবাই প্রায় বিল ক্লিয়ার করে দিয়েছে, কাজও এখন তেমন হচ্ছে না কিছু, শুধু বোধহয় শুভাশিসদের নার্সিংহোমের একটা বড় বিল পড়ে আছে। কথাটা মনে হতেই ইন্দ্রাণীর শরীর শক্ত হয়ে গেল। ওই টাকার জন্য তাগাদা করা যাবে না, মরে গেলেও না।

এভাবে বিন্দু বিন্দু করে টাকা সংগ্রহ করেই বা কত দূর পৌঁছনো যায়! দুশ্চিন্তা উদ্বেগের মধ্যেও হাসি পেয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। কথায় বলে রাই কুড়িয়ে বেল, সত্যি সত্যি কি কেউ কুড়িয়ে দেখেছে?

অন্যমনস্কভাবে মুখ তুলতেই ইন্দ্রাণী চমকে উঠল। দরজা খোলা। আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। জুলজুল চোখে দেখছে ইন্দ্রাণীকে।

গোমড়া গলায় ইন্দ্রাণী বলল কী চাই?

আদিত্যকে অন্য দিনের মতো অপ্রতিভ মনে হল না। পায়ে পায়ে খাটে এসে বসেছে। ছড়ানো টাকার দিকে একবার তাকিয়ে নিল কী এত হিসেব করছ!

 টাকা গোছাতে গোছাতে ইন্দ্রাণী বলল, আমার কপাল।

আদিত্য মুচকি হাসছে, ওর হিসেব হয় না। ওটা একদম বিধাতাপুরুষ দেগে দেয়।

লকারে টাকা তুলে চাবি লাগাল ইন্দ্রাণী। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, সে কি আর আমি জানি না!

জানোই যদি, হিসেব করো কেন?

না করে ব্যোমভোলা হয়ে থাকতে পারি না, তাই।

যার উদ্দেশে তীর ছোঁড়া সে অচঞ্চল। হাসছে, আরে, ভাবনা কি আর আমিও ভাবি না?

–ভাবো? শুনেও সুখ।

ভাবি গো ভাবি। আমার একটা পরামর্শ শুনবে?

ইন্দ্রাণী কেটে কেটে বলল, আমি ছেলেকে না বলতে পারব না।

–আমি জানি। আদিত্য মিউজিকাল লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। উচ্ছল ভঙ্গিতে বলল, যদি টাকাটা আমি জোগাড় করে দিই?

–তুমি! কীভাবে!

ধরো যদি টাকাটা কারুর কাছ থেকে ধার করে এনে দিই? মাসে মাসে শোধ দিয়ে দেব।

–কে তোমাকে চল্লিশ হাজার টাকা ধার দেবে?

যারা সবাইকে দেয় তারাই দেবে। আমার দু-একটা কাবলিঅলা চেনা আছে…

কাবলিঅলা! গলায় টেনিস বল আটকে গেল ইন্দ্রাণীর, তুমি কি কাবলিঅলার কাছ থেকে টাকা ধার করেছ নাকি?

না, এখন করিনি। ক্যাটারিং-এর ব্যবসার সময়ে এক-আধবার নিয়েছিলাম, শোধ দিয়ে দিয়েছি।

তাই বলো। ইন্দ্রাণী একটু নিশ্চিন্ত হল। ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলল, ওরা কত সুদ নেয় তা নিশ্চয়ই জানা আছে?

কত আর, মাসে পাঁচ-ছ পারসেন্ট। টুসকি দিয়ে জানলার বাইরে ছাই ঝেড়ে এল আদিত্য, –অর্থাৎ মাসে দু-আড়াই হাজার টাকা। প্রথম দু-এক মাস তুমি দেবে টাকাটা, তারপর থেকে ওটা আমিই শোধ করতে পারব।

ইন্দ্রাণীর গা গুলিয়ে হাসি এল, তুমি শোধ করবে টাকা!

–অফকোর্স। ইলেকশানের জন্য কাজ আটকে ছিল, নেক্সট উইকে পেয়ে যাচ্ছি। তারপর আর কিসের প্রবলেম?

কত কোটি টাকার কাজ তোমার?

–আপাতত ছাব্বিশ হাজার।

হুঁহ, তাতেই এত কায়দা! তোমার হাতে কত আসছে?

আদিত্য একটু যেন ফাঁপরে পড়ে গেল, প্রথম কাজে কি বেশি লাভ হয়! বড় জোর হাজার দু-আড়াই। তবে এর পর থেকে তো কাজ আসতেই থাকবে।

বুঝলাম। তুমি আমাকে একটা দয়া করবে?

–বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা? চাও তো কাবলিঅলার সঙ্গে তোমার আমি কথা বলিয়ে দিতে পারি। আগা সাহেব স্যুট প্যান্ট পরা, কাবলি বলে বুঝতেই পারবে না।

–আমার দরকার নেই। দয়া করে কাবলিঅলার চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও। নতুন বিপদে আর জড়িও না।

আদিত্য সিগারেট নিবিয়ে দিল, কিন্তু নিজে নিবল না। বিছানায় গুছিয়ে বসে বলল, আরও কটা সোর্স আছে। তুমি অনুমতি দিলে নেড়েচেড়ে দেখতে পারি।

ইন্দ্রাণীর চোখ সরু হল।

-একবার শংকরকে বলে দেখব?

ননদাই-এর নাম শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ইন্দ্রাণী। খর গলায় বলল যা বলেছ বলেছ, আর দ্বিতীয় বার ও নাম মুখে উচ্চারণ করবে না। আড়াল থেকে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাঁধানোর নকশা বানায়…

–তুমি ভুল করছ। শংকর অত কিছু ভেবে সেবার…

–একটা কথা নয়। ওটা একটা কুচক্কুরে বদমাইশ..

–ওরকম করলে তো কারুর কাছে টাকা নেওয়া যায় না। এ তো মহা ফ্যাচাং।

–কে তোমাকে জোগাড় করতে মাথার দিব্যি দিয়েছে? থাকো না যেমন আছ। খাও ঘুমোও ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে চরে বেড়াও। আমি তোমাকে বলেছি আমার ভাবনা শেয়ার করতে?

আদিত্যর মুখটা হঠাৎ পাংশু হয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, তুমি কি ডাক্তারের কাছে চাইবে ইন্দু?

ইন্দ্রাণী সেকেন্ডের জন্য থমকাল। তারপর দৃঢ় গলায় বলল, না।

আদিত্য উঠে গেল ধীর পায়ে। এগোচ্ছে সিঁড়ির দিকে।

 ইন্দ্রাণীকে সমস্ত সহজ রাস্তাগুলো দেখিয়ে দিয়ে আদিত্য কি বুঝিয়ে দিয়ে গেল, এর একটা পথেও তুমি যেতে পারবে না! বৃদ্ধ দারোয়ানটার মতো তালা ঝুলিয়ে দিল সর্বত্র! কেমন নির্বিকার নেমে যাচ্ছে। একা।

.

৩৮.

ইন্দ্রাণী দুটো দিন টাকার চেষ্টা করল না। ঠুঁটো হয়ে বসে রইল। ঠিক ঠুঁটো হয়েও নয়, নিশ্বাস বন্ধ করে। মানুষ যেভাবে জলের তলায় নাক টিপে ডুবে বসে থাকে, অনেকটা ঠিক সেই রকম। জলতলের নীচে দৃষ্টি বেশি দূর যায় না, মনে হয় সবই যেন এক শ্যাওলাটে আস্তরণে ঢাকা। ইন্দ্রাণীর পৃথিবীও যেন ঠিক তেমনই। সংসার স্কুল প্রেস সবই চোখের সামনে, অথচ যেন কিছুই নেই। শরীরে এক তীব্র দমচাপা ভাব ফুলিয়ে দিচ্ছে ইন্দ্রাণীর ফুসফুস, অসহ্য কষ্টে আঁকুপাকু করছে ইন্দ্রাণী। জল থেকে মাথা তোলারও উপায় নেই, প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা এই বুঝি তার দিকে তাক করে থাকা অদৃশ্য আততায়ীর মেশিনগান গর্জে উঠল! এই বুঝি ঝাঁঝরা হয়ে গেল ইন্দ্রাণী!

তবু মনে ক্ষীণ আশা, অলৌকিক কিছুই কি ঘটে না পৃথিবীতে? এমন তো হতেই পারে বাপ্পার মতি ফিরল! বাপ্পা হাসিমুখে বলল, আই অ্যাম সরি মা! তোমাকে বিপদে ফেলে ওরকম বড়লোকি চাকরিতে যাওয়ার আমার দরকার নেই! টেনশান ঝেড়ে ফেলো, পড়াশুনো করে আমি এখানেই আমার ফিউচার তৈরি করব!

অসম্ভব কি কখনও সম্ভব হতে পারে না ইন্দ্রাণীর জীবনে?

বিয়ের পিঁড়িতে ওঠার দিনের কথা মনে পড়ে যায়। বিনিদ্র রাত কাটানো ইন্দ্রাণীকে ডাকা হল, কাকভোরে। দধিমঙ্গল। বেলা বাড়লে ছেলের বাড়ি থেকে হলুদ এসে পৌঁছল, সেই হলুদ গায়ে মেখে কলাতলায় স্নান করল ইন্দ্রাণী। বিকেল হওয়ার আগে থেকেই ইন্দ্রাণীকে ঘিরে বসেছে মামাতো পিসতুতো বোনেরা। সাজাচ্ছে। আঁকছে চন্দন, ঘষছে পাউডার, বাঁধছে বেণী। উলুধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজের মাঝে বরের গাড়ি এসে পৌঁছল। সবই সেদিন বড় অলীক ঠেকেছিল ইন্দ্রাণীর। বড় অস্বচ্ছ, ঘোলাটে এক কাণ্ড ঘটছে যেন। যা দেখছে, যা শুনছে, যা বুঝছে, সবই যেন মায়া। প্রতি পলে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বুঝি সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটবে। মাটি খুঁড়ে, নয়তো আকাশ চিরে হাজির হবে শুভাশিস, এই বিশ্রী কল্পজগৎ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ইন্দ্রাণীকে। শুভদৃষ্টির সময়েও ইন্দ্রাণীর মনে হয়েছে, সামনের মানুষটা বোধহয় বদলে গেছে, চোখ খুললেই কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে দেখতে পাবে সে।

হল না। অসম্ভব সম্ভব হল না।

তনুময় নিরুদ্দেশ হওয়ার পরও তো এরকমই শ্বাস বন্ধ করে থেকেছে ইন্দ্রাণী। মানিকতলার বাড়িতে কড়া নাড়তে গিয়ে কতদিন ভেবেছে এই বুঝি তনুই এসে দরজা খুলল। শুভাশিস থানায় ছুটছে, লালবাজারে ছুটছে, আদিত্য ঠিকানা খুঁজে খুঁজে তনুর বন্ধুদের বাড়ি যাচ্ছে, দিলুদা একবার কার মুখে উড়ো খবর পেয়ে ছুটল বর্ধমান, আর ইন্দ্রাণী প্রতিবারই চোখ বুজে ভাবছে, এবার নিশ্চয়ই খবর এল তনুর।

হল না। অসম্ভব সম্ভব হল না।

আরও কত কি তো আশা করেছে ইন্দ্রাণী, কিছু হয়নি। আদিত্যর বোধবুদ্ধি বাড়ল না। বাবার মাথার গণ্ডগোলটা ঠিক হল না। প্রেসের অবস্থা আর একটু ভাল হয়ে ইন্দ্রাণী সচ্ছলতার মুখ দেখল না কোনওদিন। ধোঁয়াটে ছায়া হয়েই শুভাশিস রয়ে গেল জীবনে। এমনকী তিতিরটাও মরল না পেটে।

তবুও যে কেন ইন্দ্রাণীর এখনও আশা করতে ইচ্ছে করে!

তৃতীয় দিন সন্ধেবেলা হঠাৎই শুভাশিস এল। অনেক দিন পর। এসেই আগে আদিত্যর ঘরে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে আদিত্যর সঙ্গে।

ইন্দ্রাণী কাঁটা হয়ে গেল। টাকার কথা শুভকে বলে ফেলবে না তো আদিত্য?

তিতির খাটে বসে পড়ছে। ইংরিজি। মেয়েকে ইংরিজিটা অল্পস্বল্প দেখিয়ে দেয় ইন্দ্রাণী। আজও পড়াচ্ছিল। অভ্যাসের ঘোরে।

পড়ানো থামিয়ে ইন্দ্রাণী মেয়েকে বলল, –ডাক্তার আঙ্কলকে এ ঘরে ডেকে নিয়ে আয় তো।

 তিতির অন্তহীন আড়মোড়া ভাঙছে। কেন কে জানে!

ইন্দ্রাণী বকে উঠল, কী রে, কানে কথা যাচ্ছে না?

 গোমড়া মুখে তিতির বলল, তুমি ও ঘরে গিয়ে কথা বলো না। আমি এখন এখানে পড়ব।

অগত্যা ইন্দ্রাণীই উঠেছে। পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে দেখল নার্সিংহোম নিয়ে গল্প জুড়েছে শুভাশিস, নিবিষ্ট মনে শুনছে আদিত্য। প্রশ্নও করছে মাঝে মাঝে। নিজের নার্সিংহোমের কথা বলতে বলতে শুভাশিসের চোখে যেন আলো ঠিকরোচ্ছে, লালচে আভা ফুটছে ফর্সা গালে।

কষ্ট ছাপিয়ে একটু যেন তৃপ্তি এল ইন্দ্রাণীর মনে। শুভ কি তা হলে শেষ পর্যন্ত সুখী হল? মনের দোদুল্যমানতা কেটে গেল চিরতরে? আসার নিয়মটা বজায় রাখতে এসেছে শুভ, হয়তো ভবিষ্যতেও আসবে, কিন্তু আর অযৌক্তিক আবদারে পীড়ন করবে না ইন্দ্রাণীকে!

তাই হোক। শুভ ভাল থাকুক। নিজের পৃথিবীতে।

ইন্দ্রাণী দরজা থেকেই প্রশ্ন করল, –তোমার আজ গড়িয়ার চেম্বার ছিল না?

চেয়ারে বসে আছে শুভাশিস। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ইন্দ্রাণীকে। একটু যেন বেশিক্ষণ ধরে। বলল, –ওখান থেকেই তো ফিরছিলাম। এখান দিয়ে যেতে যেতে মনে হল…। তোমার মুখচোখের এই অবস্থা কেন? শরীর খারাপ?

–না, আমি তো ঠিকই আছি। ইন্দ্রাণী আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, কি গো, আমার মুখ চোখ খারাপ লাগছে?

আদিত্য তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কই, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না! তুমি তো ভালই আছ।

বললেই হল! মুখটা অ্যানিমিক হয়ে গেছে, চোখের নীচে কালি! ঘুষঘুষে জ্বরটর হচ্ছে না তো?

ডাক্তারদের চোখ শুধু অসুখ খুঁজে বেড়ায়। ইন্দ্রাণী জোর করে উচ্ছল হল, –চা খাবে?

–নাহ।

বলো তো দুধ ছাড়া লিকার করে দিতে পারি। তোমার সঙ্গে আমাদেরও খাওয়া হয়ে যাবে।

–তোমরা খেলে খাও। আমি নেই।

–সূর্য ডোবার পর অনেকে আজকাল চা খেতে চায় না। তুমি কি সেই ক্যাটিগরিতে নাম লেখালে নাকি?

–না রে বাবা। গড়িয়ার চেম্বারে এমন পানসে দু কাপ খেয়েছি…

–ও। তাই বলো। ইন্দ্রাণী বাপ্পার খাটে এসে বসল। হালকা গলায় বলল, -মধুমিতা কেমন কাজ করছে?

ভালই। তবে ছটা বেজে গেলে আর এক মিনিটও থাকতে চায় না। আমরাও জোর করতে পারি না। সত্যি তো, বাড়িতে বাচ্চা রেখে আসে…

–অনর্থক দয়া দেখিয়ো না। তোমাদের অসুবিধে হলে স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিয়ো।

–ও কিছু না, ঠিক আছে। ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার হিসেবের মাথা ভাল। ভাবছি ওকে আর রিসেপশানে বসাব না, পাকাপাকি অ্যাকাউন্টসে নিয়ে চলে আসব। একটা কম্পিউটার ট্রেনিং যদি নিয়ে নেয়, শি উইল বি আওয়ার অ্যাসেট।

আদিত্য নিজের বিছানায় বসে কথা শুনছিল দুজনের। আলটপকা প্রশ্ন করে বসল, –চাঁদু যায় নার্সিংহোমে?

শুভাশিস হাসল মুখ টিপে, যায় কখনও সখনও।

কখন যায়?

–এই ধরুন দুপুরের দিকে।

থাকে কতক্ষণ?

–বেশিক্ষণ থাকে না।

পাকা গোয়েন্দার মতো জেরা চালাল আদিত্য, বিকেলে যায় না? মেয়েটির যখন ছুটি হয়?

ধুরন্ধর ক্রিমিনালের মতো জবাব দিল শুভাশিস, –তা তো বলতে পারব না। আমি কি বিকেলে নার্সিংহোমে থাকি?

আদিত্য প্রশ্ন করার উদ্যম হারিয়ে ফেলল। শুভাশিসের বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে বিছানায়, একটা বার করে ধরাল। লাইটার জ্বালাচ্ছে। নেবাচ্ছে। জ্বালাচ্ছে। পুরোপুরি বাজতে দিচ্ছে না বাজনা।

কারণ ছাড়াই ঘর নিস্তব্ধ। ইন্দ্রাণীর অস্বস্তি হচ্ছিল। বাপ্পার কথাটা কি গোপন রাখা ঠিক হচ্ছে?

ইন্দ্রাণী একটা নিশ্বাস টেনে বলল, তোমাকে একটা খবর দেওয়ার ছিল। বাপ্পার সেই জাহাজ কোম্পানি থেকে ডাক এসেছে।

শুভাশিস মুহূর্তে ফেটে পড়ল উচ্ছ্বাসে, ইজ ইট? এ তো গ্র্যান্ড নিউজ। তোমরা এতক্ষণ আমাকে এ খবরটা দাওনি!

আদিত্য ইন্দ্রাণীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, –ভেবেছিলাম আপনাকে বলব। তারপর মনে হল থাক, ইন্দুই আপনাকে সারপ্রাইজটা দিক।

শুভাশিস চোখ ছোট করল, –তাই আপনার গিন্নির মুখ শুকনো হয়ে আছে?

আদিত্য অপ্রতিভ মুখে হাসল, –ছেলে বলে কথা! তার ওপর মাদার্স সান।

শুভাশিস সশব্দে হেসে উঠল, –ওহে মুগ্ধ জননী, খুলে দাও, খুলে দাও বাহুডোর। তোমাদের মতো মায়েদের জন্য ছেলেদের কিছু হয় না। একবার ছেড়ে দিয়ে দেখো, বাপ্পা তোমার আইফেল টাওয়ার হয়ে ফিরে আসবে। নিজের ছেলেকেই তখন ঘাড় উঁচু করে দেখতে হবে।

ইন্দ্রাণী হাসল, কিন্তু উজ্জ্বল হল না। চোখটা জ্বালা জ্বালা করছে। অস্ফুটে বলল, আমি কি ছেলেকে আটকে রেখেছি।

–মুখ দেখে তো সেরকমই মনে হচ্ছে। আরে হাসো হাসো। শুভাশিস আদিত্যর দিকে ঘুরল, বাপ্পা জয়েন করছে কবে?

–সামনের মাসের দু তারিখ থেকে ট্রেনিং। ম্যাড্রাসে।

ট্রেনিং পিরিয়ডে কত দেবে?

আদিত্য থমকে বলল, –তা তো আমি ঠিক জানি না।

–কেন, চিঠিতে লেখা নেই?

আদিত্য ইন্দ্রাণীর চোখে চোখ রাখল, –কিগো, আছে নাকি?

ইন্দ্রাণী একটু রুক্ষভাবে বলল, -ট্রেনিং-এ আবার টাকা কিসের! জাহাজে জয়েন করলে তবে তো স্যালারি।

কত দিনের ট্রেনিং?

–তিন মাস।

ব্যস, মাত্র তিন মাস! শুভাশিস উৎফুল্ল মুখে সিগারেট ধরাল। আপন মনে ঘাড় দোলাতে দোলাতে বলল, কই দেখি, চিঠিটা দেখি।

ইন্দ্রাণীর বুকটা ধক করে উঠল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। ছাইরঙা মুখে কষ্ট করে হাসি ফোটাল, –চিঠিটা তো বাপ্পার কাছে।

–ও। সে ফিরবে কখন? তাকে একবার কনগ্রাচুলেট করে যাওয়া উচিত।

ইন্দ্রাণী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, দশটার আগে ফিরবে বলে মনে হয় না।

–সে বুঝি এখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে উড়ছে?

–হুঁ। বাপ্পার প্রসঙ্গ থেকে এবার সরতে চাইল ইন্দ্রাণী। ঝুপ করে বলে উঠল, তুমি আজ একটা স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার লক্ষ করেছ?

 শুভাশিস ভুরু কুঁচকোল।

–তুমি এতক্ষণ এসেছ, তিতির কিন্তু একবারও এ ঘরে উঠে এল না। কেন বলো তো?

–দাদা চলে যাবে বলে সেও শয্যা নিয়েছে?

উঁহু, আদিত্যবাবুর মেয়ে আজকাল পড়াশুনোয় খুব সিরিয়াস হয়েছে। পরশু ইংলিশের ক্লাস টেস্ট, তাই নিয়ে সে এখন ভীষণ টেন্স।

–তা হলে তো তাকে একটু ডিসটার্ব করতেই হয়। শুভাশিস হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। ঘড়ি দেখছে। বলল–আমাকে আবার একবার নার্সিংহোম টাচ করে যেতে হবে।

শুভাশিস পাশের ঘরে এল। খুনসুটি করছে তিতিরের সঙ্গে। সরল ছেলেমানুষি খুনসুটি। তিতিরের টেক্সট বই ঘেঁটে একটা শেলির কবিতা বার করেছে শুভাশিস, চোখ বুজে আবৃত্তি করার চেষ্টা করছে, ভুলে গিয়ে আড়চোখে দেখে নিচ্ছে পাতা। অন্য দিন ডাক্তার আঙ্কলকে দেখলে ভারি খুশি হয় তিতির, আজ সে যেন কেমন উদাস উদাস। কবিতা পড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করছে শুভাশিস, তিতির আলগাভাবে উত্তর দিচ্ছে।

খানিক পরে আদিত্যর সঙ্গে বেরিয়ে গেল শুভাশিস।

 ইন্দ্রাণী হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এর মধ্যে বাপ্পা এসে পড়লে না জানি কী বিকট পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেত।

বাপ্পা অবশ্য এল সাড়ে দশটারও পরে। নীচে আদিত্য আর তিতিরকে খেতে দিচ্ছিল ইন্দ্রাণী, খাবার ঘরের টেবিলে এসে সোজা বসে পড়ল বাপ্পা।

ছেলেকে দেখে ইন্দ্রাণী কাঠ হয়ে গেছে। আদিত্যও। তিতির থমথমে চোখে দেখছে দাদাকে।

 খাবার টেবিলে বাপ্পা গোগ্রাসে খায়। চোখের পাতা পড়ার আগে সাফ হয়ে যায় তার থালা। দেখলে মনে হয় যেন এক বুভুক্ষু রাক্ষস ঘাপটি মেরে আছে তার পেটে। আজ বাপ্পা কিছু খাচ্ছিল না। রুটি খুঁটছে। কপির তরকারির বাটিটা থালায় তুলেও নামিয়ে রাখল। স্যালাড করে রেখে গেছে সন্ধ্যার মা, এক টুকরো টোম্যাটো দাঁতে কাটল অনেকক্ষণ ধরে। সহসা ইন্দ্রাণীকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, –মা, আই অ্যাম সরি।

তিতিরের খাওয়া থেমে গেছে। আদিত্যর চোখ বিস্ফারিত। ইন্দ্রাণী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এ কি অঘটন, না প্রহেলিকা?

বাপ্পা আবার বলল, -সরি মা, আমার সেদিন তোমাদের সঙ্গে ওভাবে কথা বলা উচিত হয়নি।

ইন্দ্রাণী নাক টানল, তোর রাগ বড় চণ্ডাল রে।

আদিত্য পরিবেশটা লঘু করতে চাইল। বলল, ঠিক আমার মতো। তবে আমি বেশি রাগি না, তাই না রে তিতির?

বাপ্পা আদিত্যকে আমলই দিল না। বিড়বিড় করে বলল, –তোমরা আমার রাগটাই দেখলে মা, কষ্টটা দেখলে না। প্রত্যেকেরই তো কোনও একটা স্বপ্ন থাকে। এইম থাকে। সেটা থাকা কি খুব গর্হিত কাজ?

ইন্দ্রাণী নিচু গলায় বলল, আমি কি তোকে তাই বলেছি?

বলেছ তো বটেই। মাত্র তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকা পেলে ছেলে তার এইমটাকে ফুলফিল করার চান্স পায়, তুমি তাকে বলছ মন থেকে স্বপ্নটাকেই ঝেড়ে ফেলতে? ছেলের আশা অপূর্ণ রাখলে যদি তোমার সুখ হয়, তবে তাই হোক। কিন্তু মা, আমি যদি জীবনে কিছু করে উঠতে না পারি, আর যদি তখন তোমার দিকে আঙুল দেখাই, তুমি সহ্য করতে পারবে তো? পারবে তো নিজের কাছে কৈফিয়ত দিতে?

কে কথা বলছে ইন্দ্রাণীর সামনে! এ কোন বাপ্পা! ইন্দ্রাণীর গলা বুজে এল। মেশিনগানের বদলে মুহুর্মুহু জলকামানের তোপ দাগে কেন ছেলে? ভেতর থেকে যে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রাণী!

বাপ্পা তাকাচ্ছে না কারুর দিকে। তার চোখ খাবার থালায় স্থির। আবার নিচু স্বরে বলল, আমাকে তুমি এ কথা বোলো না মা, যে, তুমি টাকাটা জোগাড় করতে পারতে না! আমাদের ফ্যামিলির কাছাকাছি কি এমন কেউ নেই যার কাছে চাইলে তুমি টাকা পেতে না? আসল কথা বলো, তুমি আমাকে টাকাটা দিতে চাও না। মা যদি ছেলের ভাল না চায়, কী আর করা যাবে!

বাপ্পা খাবার ফেলে উঠে চলে গেল।

ইন্দ্রাণী অসাড়। বাপ্পার ইঙ্গিত পরিষ্কার। মিনতির সুরে চাপ দেওয়ার ছলনাটাও। কিন্তু উপায় নেই। নরম কথার সুতোয় তাকে বেঁধে ফেলেছে বাপ্পা। ক্রোধ উন্মত্ততার থেকেও এ সুতো যেন আরও বেশি নিষ্করুণ।

তিতির চলে গেছে। আদিত্য খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল। এক সময়ে ইন্দ্রাণীকে একা রেখে চলে গেল সেও।

যন্ত্রমানবীর মতো বাসন-কোসন গুছোচ্ছে ইন্দ্রাণী। এখনও কন্দর্প ফেরেনি, বলে গেছে ফিরতে রাত হবে। দেওরের খাবার থালায় বাটিতে সাজিয়ে ভাল করে ঢাকা দিল ইন্দ্রাণী। তরকারি অনেকটাই রয়ে গেছে, ফ্রিজে তুলল। রান্নাঘরের নর্দমার মুখের শিকলগুলো ভাঙা, ছুঁচো ইঁদুর ঢোকে। সারা রাত ভীষণ উৎপাত করে, ঘরময় এঁটোকাঁটা ছড়ায়। ইট দিয়ে ভাল করে মুখটা বন্ধ করল।

জয়মোহন কাশছেন। কাশির দমক ক্ষণিকের জন্য থেমেই বেড়ে যাচ্ছে। শীতের শুরুতে শ্বশুরমশাই-এর কষ্টটা বড় বাড়ে, অনেক রাত অবধি বসে থাকেন বিছানায়।

রাতের জন্য জগ ভর্তি জল নিয়ে শ্বশুরমশাই-এর দরজায় এল ইন্দ্রাণী। রুটিন প্রশ্ন করল, –ওষুধ খেয়েছেন বাবা?

ঘরে ম্লান রাতবাতি। যেন ঘর নয়, গুহা।

ইন্দ্রাণী ফের প্রশ্ন করল, বাবা, ওষুধ খেয়েছেন তো?

মশারির প্রকোষ্ঠ থেকে ঘড়ঘড়ে শব্দ হল, –খেয়েছি।

–একটু গরম জল করে দেব? খাবেন?

–মিনতি দিয়ে গেছে। ফ্লাস্কে আছে।

বুকে তেল মালিশ করে দেব একটু?

ছায়ামূর্তি শব্দহীন। অর্থাৎ মাখবেন।

রান্নাঘরে ফিরে নিজেদের শিশি থেকে বাটিতে খানিকটা তেল ঢালল ইন্দ্রাণী। এক কোয়া রসুন ফেলে গরম করল ভাল করে। জয়মোহনের ঘরে এসে মশারির একটা কোণা খুলে দিল। বসেছে খাটে।

বালিশে হেলান দিয়ে একটু কাত হোন বাবা।

হাঁটু মাথা এক করে রাখা শরীর নড়েচড়ে উঠল।

 গায়ের চাদরটা আলতো করে সরিয়ে নিল ইন্দ্রাণী। বালিশের স্তূপে পিঠ ঠেকালেন জয়মোহন।

কাশির দমক কমেছে। চাপড়ে চাপড়ে শ্বশুরমশাইয়ের বুকে গরম তেল লাগাল ইন্দ্রাণী। ঘষছে। পাঁজরা, না হারমোনিয়ামের রিড! খাঁচা আর চামড়াই সার। শীর্ণ মানুষটা শীর্ণতর হচ্ছেন দিনদিন। বাবাও তো রোগাভোগা, তবু বাবা যেন ঠিক এমনটি নয়। মা অবশ্য ডানা মেলে ঘিরে থাকে বাবাকে। ভালবাসার উত্তাপ না পেয়েই কি এভাবে ক্ষয়ে গেলেন শ্বশুরমশাই! রুনা কর্তব্য করে ঠিকই, ডাক্তার-ওষুধ-খাওয়াদাওয়া সবই যেমন যেমনটি হওয়া উচিত তেমন তেমনটিই হয়, কিন্তু রুনার সেবায় ভালবাসা নেই। কেন যে নেই! শুকনো কর্তব্যে কি পরিতৃপ্ত হয় মানুষ? যে মানুষটার আর জীবনে কোনও দিন হয়তো বাড়ির বাইরে পা দেওয়া হয়ে উঠবে না, জানলাটুকু দিয়ে যাকে আলো বাতাসের স্বাদ নিতে হয়, দোতলাতেও যাওয়া যার মানা, সেই মানুষটা যে ভালবাসার কাঙাল হবে এ কি কোনও আশ্চর্য কথা!

ইন্দ্রাণীর আঙুল কাঁপছিল। অজান্তেই বড়সড় শ্বাস পড়ল একটা। এখন তার যা ক্ষমতা আছে তাতে কায়ক্লেশে শ্বশুরমশাইকে নিজের সংসারে এনে রাখা যায়। কিন্তু আর কি তা সম্ভব! এক ছাদের নীচে দাঁড়িয়ে শ্বশুরমশাইকে ইন্দ্রাণীর সংসারে ফিরিয়ে দিতে রুনা সুদীপের কি মানে লাগবে না!

অকস্মাৎ বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ঝলসে উঠেছে ইন্দ্রাণীর মাথায়। উপায় তো আছে, অতি সহজ উপায়। এক ছাদের নীচে না থাকলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। শুধু জয়মোহন কেন, বাপ্পার সমস্যার সমাধানও হয়ে যায় অনায়াসে।

আশ্চর্য, কথাটা আগে মাথায় আসেনি কেন?

জয়মোহন ঘুমোতেই ইন্দ্রাণী মশারির খুটটা টাঙিয়ে পা টিপে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি ভাঙছে। দুরু দুরু বুকে।

সুদীপের ঘরে আলো জ্বলছে এখনও। টিভির মৃদু সুরও শোনা যায়।

পর্দার এপারে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী অনুচ্চ স্বরে ডাকল, দীপু।

.

৩৯.

সুদীপ একটা চিঠি লিখতে বসেছিল। বড় শালাকে। হঠাৎ ইন্দ্রাণীর ডাক শুনে তার কলম থেমে গেল।

বউদি ডাকছে কেন! এত রাতে! দাদা তো বাড়িতেই আছে আজ।

গলা খাঁকারি দিয়ে সুদীপ বলল, কী হয়েছে বউদি?

–তোমার সঙ্গে একটা জরুরি পরামর্শ ছিল।

 উঠতে গিয়েও উঠল না সুদীপ। রুনার চাদরটা ভাল করে সাপটে নিল গায়ে। চেয়ার ঘুরিয়ে বাবু হয়ে বসে বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।

পর্দা অল্প সরিয়ে ঢুকল ইন্দ্রাণী। একটু যেন কুণ্ঠিতভাবে।

ঘরের মাঝখানে প্রকাণ্ড খাট। মশারির নীচে ঘুমোচ্ছে অ্যাটম। সেদিকে একবারটি দেখে নিয়ে ইন্দ্রাণী অপ্রস্তুত মুখে বলল, –তোমাকে বোধহয় ডিসটার্ব করলাম।

–তেমন কিছু নয়। রুনার দাদাকে একটা চিঠি লিখছিলাম। অ্যাঁটমের ক্রিসমাসের ছুটি পড়ছে, যাই কদিন আসানসোল থেকে ঘুরে আসি।

ইন্দ্রাণী মোড়া টেনে নিয়ে বসল, তাই অ্যাটম কাল খুব মামার বাড়ি মামার বাড়ি করছিল!

–হ্যাঁ, ওখানে গেলে ওর আর একটা লেজ বেরিয়ে যায়।

কথাটা বলে মনে মনে হাসল সুদীপ। লেজ কার না বেরোয়! রুনার বড়দা আসানসোল থেকে মাইল সাতেক দূরে কোলিয়ারির ম্যানেজার, কোয়ার্টারটি তার বিশাল এক ব্রিটিশ প্যাটার্নের বাংলো, সামনে মনোরম ফুলবাগান, গেটে চব্বিশ ঘণ্টা গাড়ি মজুত, রুনা তো সেখানে গেলে অ্যাটমের থেকেও বেশি শিশু হয়ে যায়। সারাদিন উড়ছে। এই বউদিকে নিয়ে ছুটল টাউনের দিকে, এই ভাইপো ভাইঝিদের সঙ্গে সদলবলে চলল কল্যাণেশ্বরী ম্যাসাঞ্জোর। রাজার হালে থাকা, সকাল থেকে রাত চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় চলছে, সন্ধে হলেই লনে গার্ডেন চেয়ার নিয়ে বসে ঢুকুঢুকু স্কচ, লেজ গজিয়ে সুদীপও কি মাত্রা ছাড়ায় না সেখানে! গতবার তো একদিন আকণ্ঠ মাতাল হয়ে মাঝরাতে শ্যামাসঙ্গীত জুড়েছিল। পরদিনও সকালে অ্যাটমের গোল গোল চোখে কী বিস্ময়! তুমি কাল কেন জেঠু হয়ে গিয়েছিলে বাবা!

সুদীপ একটা সিগারেট ধরাল। কোলের ওপর অ্যাশট্রে নিয়েছে। বলল, কী বলতে চাইছিলে বলল।

ইন্দ্রাণীর গলা পেয়েই রুনা উঠে এসেছে এ ঘরে। পরনে কাফতান। গোলগাল শরীর তার খানিকটা বেঢপ লাগছে ঢলঢলে পোশাকে।

রুনার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে ইন্দ্রাণী বলল, তুমি বাপ্পার চিঠিটা দেখেছ?

 সুদীপ উদাসীন মুখে বলল, না। কেউ দেখিয়েছ তোমরা?

বাপ্পা তোমাকে দেখায়নি?

–তারই বা দেখা পাচ্ছি কোথায়? সুদীপ অভিমানটা চেপে রেখে হাসার চেষ্টা করল, যাক গে, বাড়িতে থাকার সূত্রে খবরটা জানা হয়ে গেছে। গুড নিউজ।

ইন্দ্রাণীর মুখে ছায়া পড়ল, গুড কি ব্যাড জানি না। তবে একটা সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা?

–ট্রেনিংয়ের খরচা জানো? হাতির খোরাক। এক্ষুনি চল্লিশ হাজার টাকা লাগবে।

–এত টাকা

 –হুঁ। এত টাকা আমি পাই কোত্থেকে বলো তো দীপু?

মগজের ভেতর কম্পিউটার চলতে শুরু করল সুদীপের। তার কাছে কি ধার চাইতে এসেছে বউদি? ব্যাপারটা যেন ঠিক মিলছে না, যেন ঠিক মিলছে না! বাজিয়েই দেখা যাক একটু।

সুদীপ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, বাট ইউ উইল হ্যাভ টু অ্যারেঞ্জ ইট। বাপ্পার একটা এত ভাল চান্স এসেছে..

–পারছি না যে ভাই।

 রুনা ফস করে বলে উঠল, সত্যি তো, তুমি এত টাকা কোত্থেকে পাবে? হুট বলতে চল্লিশ হাজার ফেলে দেওয়া কি মুখের কথা?

সুদীপ রুনার ওপর ভীষণ বিরক্ত হল। এরকম উপর পড়া হয়ে কথা বললে জন্মে কোনওদিন বউদির পেট থেকে কিছু বার করা যাবে! হালকা ধমকের সুরে সুদীপ বলল, ও কথা বললে হবে না। টাকার ব্যবস্থা যে করে হোক করতে হবে। বাপ্পা আমাদের বাড়ির বড় ছেলে, দরকার হলে আমরা সকলে মিলে জোগাড় করে ফেলব।

রুনা আবার বলে উঠল, হ্যাঁ, চাঁদু তো এখন ভাল রোজগার করে। চাঁদু যতটা পারে দিক, বাকিটা নয় আমরা যেখান থেকে হোক ব্যবস্থা করে দেব।

সুদীপ চমৎকৃত হল। রুনা নিজে থেকে টাকা দেওয়ার কথা বলছে! মন থেকে বলছে, নাকি কথার কথা! হেসে ফেলে বলল, ধুর, চাঁদু দেবে কোত্থেকে?

-কেন, চাঁদু সিনেমায় অত বড় রোল পেল, সেখান থেকে মোটা টাকা পায়নি?

কত আর পেয়েছে! দশ-পনেরো হাজার।

 ইইহ। মিনিমাম পঁচিশ হাজার পেয়েছে। দিদি, তোমাকে চাঁদু বলেনি কত টাকা পেয়েছে?

 ইন্দ্রাণীর দু হাত কোলের ওপর জড়ো। অস্পষ্ট স্বরে বলল, না। আমি জিজ্ঞেস করিনি।

–সে যাই হোক, তুমি মুখ ফুটে চাইলে চাঁদু না করতে পারবে না। সেও তো বাপ্পার ছোটকাকা, তারও তো দায়িত্ব আছে, কী বলো?

ইন্দ্রাণীর মুখ লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ। শীতল স্বরে বলল, চাঁদুর কথা উঠছে কেন? আমি কি তোমাদের কাছেও টাকা চেয়েছি?

সুদীপ দুর্যোগের আভাস পেল। ইন্দ্রাণীর এই স্বর তার পরিচিত। তিতিরকে প্রথম স্কুলে ভর্তি করার সময়ে থোক কিছু টাকা লেগেছিল। হাজার মতন। দাদা তখন সর্বস্ব ঢেলে ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা শুরু করেছে, হাত পুরো ফাঁকা। টাকাটা যেচে দিতে চেয়েছিল সুদীপ, বউদি নেয়নি, নিজের হাতের একটা চুড়ি বেচে ব্যবস্থা করেছিল টাকার। সেদিনও ঠিক এই স্বর ছিল বউদির। তারপরেও কতবার কতভাবে টাকার প্রয়োজন হয়েছে, প্রেসের দেনা, দাদার চিকিৎসা, বাপ্পার টিউটর, প্রতিবারই বউদি নিজের গয়না বিক্রি করেছে, তবু কখনও হাত পাতেনি কারুর কাছে। সব জেনেও বউদিকে কেন খোঁচা দিচ্ছে রুনা? বউদি এখন প্রায় রিক্ত বুঝেই কি তার অহঙ্কারে ঘা দিতে চায়?

সুদীপ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, রুনা বোধহয় তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছে না বউদি। ও বলতে চায় আমি, চাঁদু আমরা দুজনেই তো বাপ্পার কাকা, আমাদেরও একটা দায়িত্ব…

আমি সে কথা জানি বলেই তো তোমার কাছে এসেছি। ইন্দ্রাণীর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা, টাকা ছাড়াও তো অন্যভাবে সাহায্য করতে পারো তুমি।

কীরকম?

ইন্দ্রাণী সোজা হল, –তোমরা তো বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট বানাতে চেয়েছিলে। প্রোমোটার ফ্ল্যাট বানালে সে তো সকলকেই ফ্ল্যাট ছাড়া কিছু কিছু করে ক্যাশ টাকা দেবে। দেবে না?

ঘরে যেন টাইম বোমা পড়ল। সুদীপ রুনাকে দেখছে, রুনা সুদীপকে।

ইন্দ্রাণী দুজনের দিকেই তাকাল, এত অবাক হচ্ছ কেন? এটাই তো এখন টাকা পাওয়ার সব থেকে সহজ উপায়।

রুনা উত্তেজিত মুখে বলল, তুমি চাইলেই বাড়ি ভাঙা হবে?

–আমি কেন চাইব? বাবা চাইবেন।

বাবা! অসম্ভব।

-সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।

তুমি বাবাকে রাজি করাতে পারবে?

ইন্দ্রাণী আর রুনার কথার উত্তর দিল না। নীরস গলায় সুদীপকে প্রশ্ন করল, তোমার প্রোমোটার যেন কত করে দেবে বলছিল?

কথা বলতে গিয়ে সুদীপের জিভ আটকে যাচ্ছিল, আমার প্রোমোটার এখন কোথায়? সে তো কবেই হাত ধুয়ে বসে আছে।

তার সঙ্গে আর একবার নতুন করে কথা বলতে পারো না?

 সুদীপ বলতে পারত নিও বিল্ডার্সের সঙ্গে সে অনেকবার যোগাযোগ করেছে। ঠিক সুদীপ করেনি, নিও বিল্ডার্সের মাখন দস্তিদার নিজেই বহুবার এসেছে সুদীপের অফিসে। প্রত্যেকবারই কাঁচুমাচু মুখে লোকটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে সুদীপ। শেষ দিন তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুদীপকে যা খুশি বলেছে লোকটা। ঘোড়েল, মেরুদণ্ডহীন, জিলিপি, কী নয়! দস্তিদারের বদ্ধমূল ধারণা তাকে খুড়োর কল দেখিয়ে অযথা ছুটিয়েছে সুদীপ।

এ সব কথা রুনাকে সুদীপ বলেনি কোনওদিন। তাতা চাটুতে কে আর ডালডা ছিটোয়!

বউদিকেই বা এ কথা বলে আজ কী লাভ? বউদি কি কখনও সুদীপের কথা ভেবেছে?

একটা রাগ ফুঁসে উঠল সুদীপের ভেতরে। গোমড়া মুখে বলল, আজ তুমি কত ইজিলি কথাটা বলছ, অথচ তুমিই একদিন আমাকে সব থেকে বেশি অপোজ করেছিলে।

–আমি! অপোজ করেছিলাম! কবে?

মুখে করনি, আচরণে করেছিলে। দাদা এসে শালা শুয়োরের বাচ্চা বলে গেল, তুমি চুপ করে রইলে। তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, উল্টে পাঁচটা কথা শুনিয়ে দিলে।

–তুমি অকারণে রাগ করছ দীপু। তুমিই তো কই একবারও বাড়ি ভাঙা নিয়ে আমাকে একটা কথাও জানাওনি।

রুনা পাশ থেকে বলল, অথচ তুমি কিন্তু সব কথাই জানতে দিদি। চাঁদু তোমায় আগেই রিপোর্ট দিয়েছিল। দেয়নি?

–আমাকে কেউই কোনও কথা খোলসা করে বলেনি ভাই। তোমরাও বলোনি, চাঁদুও না।

–তুমি তো এসে সোজাসুজি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতে।

ইন্দ্রাণী চুপ করে গেল।

বউদিকে দেখে মায়া হল সুদীপের। কতটা অসহায় অবস্থায় পড়লে বউদি এত রাতে ছুটে আসে এ ঘরে, তার সঙ্গে, রুনার সঙ্গে তুচ্ছ বাদবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়, অনুমান করার চেষ্টা করছিল সুদীপ। এককালে এই বউদির সঙ্গেই কত সুন্দর সম্পর্ক ছিল তার। বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে ঘরের কোণে সিঁটিয়ে বসে থাকত বউদি, অকারণে ভয় পেত, হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠত, মার অতি সামান্য কথাতেও একা একা কাঁদত বসে, একমাত্র সুদীপকে দেখলেই বউদির চোখমুখ আলোর ছটায় ভরে যেত। বাপের বাড়ির অতি তুচ্ছ ঘটনাও গল্প করত তার কাছে, কলেজের কথা বলত, স্কুলের কথা বলত। বিয়ের পর দাদা যেদিন প্রথম মদ খেয়ে বাড়ি ফিরল, বউদি আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এসেছিল তার কাছেই। কবে থেকে যে বউদির সঙ্গে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেল? রুনা এ বাড়িতে আসার পর থেকেই কি? অথবা বাপ্পা তিতির জন্মানোর পর বউদিই বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেল? নাকি দাদাকে সহ্য করতে করতে নিজেকে খোলসে গুটিয়ে নিল বউদি?

অথবা এর কোনওটাই নয়। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যখনই একটা পৃথক পরিবার গড়ে ওঠে, তখনই এক বিচ্ছেদের বীজও বোনা হয়ে যায়। আমি তুমি আর আমাদের সন্তান–এর বাইরে গোটা পৃথিবীর সঙ্গেই এক সূক্ষ্ম বিচ্ছেদ। সময় তাকে লালন করে, স্বার্থ তাকে পরিপুষ্ট করে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢোকা অবিশ্বাস নোনা ধরিয়ে দেয় অন্যান্য সম্পর্কে। পরিবার শব্দটার অর্থই বোধহয় এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। ভাই বোনের সঙ্গে ভাই বোনের। দেওরের সঙ্গে বউদির। ননদের সঙ্গে ভাজের।

সুদীপই বা এর ব্যত্যয় হবে কেন? অথবা ইন্দ্রাণী?

বিমর্ষ মুখে সুদীপ বলল, বাড়ি ভাঙার কথা তোমাকে নিজে কেন বলতে পারিনি শুনবে? আমার প্রোমোটার তখন তোমার প্রেসটা অ্যাবলিশনের জন্য কোনও কমপেনসেশান দিতে রাজি ছিল না। আর এ কথাটা আমার পক্ষে তোমাকে বলা যে কী কঠিন! তুমি হয়তো ভেবে বসতে আমিই প্ল্যান করে…। প্রেসটা তৈরির সময়ে দাদার সঙ্গে তো আমার কম ঝঞ্ঝাট হয়নি!

–পুরনো কথা থাক না দীপু।

–থাক। সুদীপ অ্যাশট্রে টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। রাত বাড়ছে। বাড়ছে ঠাণ্ডাও। বারান্দার দিকের দরজাটা খোলা আছে, বন্ধ করতে গিয়ে থামল সুদীপ। নীচে টিকটিক আওয়াজ হচ্ছে। কন্দর্পর স্কুটার ফিরল। শব্দটা থামা পর্যন্ত সুদীপ দাঁড়িয়ে রইল দরজায়, তারপর পাল্লা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল।

রুনা বাথরুমে গেছে। মশারির ভেতর অঘোরে ঘুমোচ্ছ অ্যাটম। ঘুমের ঘোরেই পাশ ফিরল। মোড়ায় বসে আছে ইন্দ্রাণী। আড়ষ্ট আঙুলে আনমনে আঁচলের খুঁট পাকাচ্ছে। সন্তর্পণে দেশলাইয়ে কাঠি ঠুকে সিগারেট জ্বালাল সুদীপ। পাশের ঘরে একা একা বেজে যাচ্ছে এক বোকা বাক্স। ও ঘরের ওই নির্জন শব্দ এ ঘরের নীরবতাকে আরও গাঢ় করে তুলছে প্রতি মুহূর্তে।

সুদীপ নিচু গলায় বলল, একটা কথা বলব বউদি? রাগ করবে না?

বলো।

বাপ্পার চল্লিশ হাজার টাকা আমি তোমাকে কাল পরশুর মধ্যে তুলে দিচ্ছি। তুমি লোন হিসেবে নাও।

–অত টাকা আমি তোমার কাছ থেকে নিতে পারি না দীপু।

–কেন পারো না? ইফ ইউ সো ডিজায়ার, ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্টও দিয়ো।

 ইন্দ্রাণী কি যেন ভাবছে।

সুদীপ তাড়াহুড়ো করে বলল, তুমি এগ্রি করলেই আমি টাকাটা তুলে ফেলব। হারি আপ। ডিসিশান নাও।

সুদীপ যা ভয় পাচ্ছিল, তাই বলল ইন্দ্রাণী, তুমি কথাটা রুনার কাছে গোপন রাখতে চাইছ?

-সব কথা রুনার জানার কি দরকার?

ইন্দ্রাণী ম্লান হাসল, তুমি তা হলে তোমার প্রোমোটারকে অ্যাপ্রোচ করতে রাজি নও?

–বিলিভ মি, দস্তিদার এখন আর আমাদের বাড়িতে ইন্টারেস্টেড নয়। সেলিমপুরে একটা বড় কাজ করছে, এখন বললেও ও ইমেডিয়েটলি আমাদের কাজে হাত দেবে না। প্রোমোটারদের তো জানই। যে কাজে ইমিডিয়েট গেইন নেই, সেখানে ওরা কিছুতেই ক্যাশ লাগায় না।

–আমরা অন্য কোনও প্রোমোটারের কাছে যেতে পারি।

পারো। তবে পনেরো দিনের মধ্যে কেউ তোমাকে টাকা দেবে না। মাঝে প্রচুর ফরমালিটিজ আছে। বাবার সইসাবুদ, কোর্ট, এগ্রিমেন্ট…। বাথরুমের দরজায় শব্দ হল। রুনা ফিরছে। সুদীপ কথা অসমাপ্ত রেখে ফিসফিস করে উঠল, তাড়াতাড়ি বলো কী করব? তুলব টাকা?

–তুমি তো রইলেই। অতি মৃদু স্বরে কথাটা বলেই ইন্দ্রাণী গলা তুলেছে, আমি কি একবার চাঁদুর সঙ্গে কথা বলে দেখব?

–তোমার বড় জেদ বউদি। সুদীপ দাঁতে দাঁত ঘষল, দেখো চাঁদুর সঙ্গে কথা বলে। শুনেছি আমার দস্তিদার যদি বোয়াল মাছ হয়, মুস্তাফি কুমির। সেও তোমাকে চট বলতে টাকা দেবে না।

দেখা যাক।

ইন্দ্রাণী উঠে পড়ল। অবসন্ন পায়ে দরজার দিকে যাচ্ছে। রুনার সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল, অন্যমনস্ক মুখে সরে দাঁড়াল।

রুনা বলল, তিতির এখনও জেগে আছে যে দিদি?

পরশু পরীক্ষা। পড়ছে বোধ হয়।

ও।

ইন্দ্রাণী চলে যাওয়ার পরও পর্দার ওপারে চোখ রেখেছে রুনা। ঝুঁকে দেখছে। ইন্দ্রাণী ঘরে ঢুকে যেতে দরজা বন্ধ করল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে শীতের ক্রিম ঘষছে মুখে। বাঁ হাতে চিরুনি তুলল। আয়নায় সুদীপকে দেখতে দেখতে বলল, টাকা অফার করা হয়ে গেল?

সুদীপ নড়ে গেল। অস্ফুটে বলল, মানে?

–আমি যখন ছিলাম না তখন তুমি বলোনি, বউদি তোমাকে আমি পুরো টাকাটাই তুলে দিচ্ছি?

–আমি কেন বলতে যাব? তুমিই তো টাকা দেওয়ার কথা প্রথমে তুললে?

-কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকছ ভাই? আমি বলে তোমাকে বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বাথরুমে চলে গেলাম! রুনা মিটিমিটি হাসছে, তোমার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়ে গেল তো? মটমট তেজ দেখিয়ে মুখের ওপর না বলে দিল?

চটপট সিগারেট নিবিয়ে বিছানায় ঢুকে পড়ল সুদীপ। এই মেয়েমানুষটার সামনে আর এক মুহূর্তও থাকা নিরাপদ নয়। নিজেকে এত অরক্ষিত মনে হয় মাঝে মাঝে! শালা ভগবান যে কি দিয়ে মেয়েমানুষদের গড়েছিল? সজারুর কাঁটার মতো চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও যে আত্মরক্ষায় ব্যবহার করে! কখনও যে আক্রমণে!

রুনা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে থামল হঠাৎ। ভুরু কুঁচকে বলল, টিভিটা বন্ধ করেও শুলে না?

সুদীপ রাগ রাগ গলায় উত্তর দিল, ওটা তুমি দেখছিলে, তোমার বন্ধ করার কথা।

টিভি দেখা থেকে উঠে এসেছি বলে খুব রাগ, না?

সুদীপ পায়ের কাছে জড়ো করে রাখা কম্বল গায়ে টানল।

রুনা গুটগুট করে টিভি বন্ধ করে এল। চিরুনি থেকে চুল ছাড়াচ্ছে। থুতু ছিটিয়ে গুছিটা ওয়েস্ট পেপার বাসকেটে ফেলল। হাসল ফিক করে, তোমাদের শুভাশিসদা টাকাটা দিচ্ছে না কেন?

সুদীপ বলতে যাচ্ছিল, বউদির ইচ্ছে নয় তাই। বলল অন্য কথা, শুভাশিসদা এখন কোত্থেকে দেবে? নার্সিংহোম করতে কত খরচা গেল…

ডাক্তারদের আবার টাকার অভাব! হাসিও না তো। লাল নীল হলুদ কালো কত রকম যে ইনকাম ডাক্তারদের!

যেমন তোমার বড়দার। সুদীপ পাশ ফিরে শুল, কয়লা ঘেঁটে ঘেঁটে টাকার পাহাড় বানিয়ে ফেলল।

দুপদাপ বিছানায় এল রুনা, কী বললে বড়দার নামে?

কিছু না। বলছিলাম কালো টাকা আজকাল সকলেরই থাকে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার মাস্টার থেকে শুরু করে মাছিমারা কেরানির পর্যন্ত। ওদিকে চোখ দিতে নেই।

–চলো আসানসোলে, দাদাকে বলে দেব।

–বোলো। তোমার দাদা তোমার মতো হিউমারলেস নয়। সে জোক বুঝে হাসবে। সুদীপ কথা নিয়ে যেতে চাইল অন্য দিকে, শোনো, চিঠি তো লিখছিই। তুমি কাল আর একবার ফোনে চেষ্টা কোরো। আমার মনে হয় তোমার দাদার লাইনটা ওখানে খারাপ আছে।

করবখন। বুক অবধি কম্বল টেনে ছেলেকে একবার জরিপ করল রুনা। আলো নিবিয়ে আবার ফিরল পূর্ব সংলাপে, –এই জানো, আমার মনে হয় শুভাশিসদার সঙ্গে তোমার বউদির ঝামেলা চলছে।

সুদীপ কৌতূহলের ফাঁদে পড়ল না। হাই তুলে চিত হয়ে শুল।

 –আজকাল তোমাদের ডাক্তারদাদার আসা খুব কমে গেছে।

হুঁ।

–আজ এসেছিল। বেশিক্ষণ বসল না, আধ ঘণ্টাটাক থেকেই চলে গেল।

হুঁ।

বয়স বাড়ছে তো, এবার বোধহয় মোহ কাটছে।

হুঁ।

–কি হুঁ হুঁ করছ? কেন ঝগড়া হতে পারে একটু আন্দাজ করো না।

–ঘুমোও তো। শুধু পি এন পি সি। তোমাদের ক্লাবে ছ ঘণ্টা ধরে করেও সুখ হয় না, বিছানায় শুয়েও…

–এএহ সীতাভক্ত হনুমান! রুনা পাশ ফিরে সুদীপের গাল টিপে দিল, আমি একটা ভাল পরামর্শ দেব, শুনবে?

–পরামর্শ, না হুকুম?

কথা কেটো না, যা বলি শোনো। রুনা গলা জড়িয়ে ধরল সুদীপের, একবার টাকা অফার করেছ, ভাল করেছ। কিন্তু নিজে থেকে যখন বাড়ি ভাঙার কথাটা তুলেছে, আর বেশি ঘাঁটিও না। বাবার সঙ্গে ওকে কথা বলতে দাও। বাপ্পার ধাক্কায় যদি ফ্ল্যাটটা উঠে যায়, ক্ষতি কি? মেজ ছেলে প্রোমোটার লাগিয়ে বাড়ি ভাঙাচ্ছে এ কথাও কেউ বলতে পারবে না।

সুদীপের মাথাতেও কথাটা এসেছে একবার। বউদি কি না পারে? যেরকম শক্ত হাতে মরা প্রেসটাকে দাঁড় করাল! বাবার সঙ্গে কি কথা হয়ে গেছে বউদির? অসম্ভব নয়। বউদি হয়তো আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। সুদীপকে হয়তো ভেঙে বলল না, বাজিয়ে দেখে চলে গেল। চাঁদুও হয়তো আছে বউদির সঙ্গে।

সুদীপের হঠাৎ খুব শীত করছিল। সন্দেহের বাষ্পটা কেমন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ল চিন্তায়। ঘন আঁধারে ক্রমশ যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে সুদীপ। গুটিয়ে যাচ্ছে। গুটোতে গুটোতে একটা গিরগিটি হয়ে গেল। সেখান থেকে কেন্নো। আরও ছোট হচ্ছে। এক্কেবারে ছোট্ট মাছি হয়ে গেল।

ভয়ার্ত সুদীপ আশ্রয় খুঁজছে রুনার শরীরে। আপন দেহে রুনা ধারণ করে নিল মাছি সুদীপকে। আহ, শান্তি শান্তি।

.

৪০.

এসপ্ল্যানেডের মোড় পেরিয়ে ট্যাক্সি বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে পড়তে গায়ে শালটা ভাল করে জড়িয়ে নিল ইন্দ্রাণী। বাঁ দিকে একটা সিনেমা হল, বিশাল উঁচু হোর্ডিংয়ে নৃত্যরতা নায়িকার ছবি। নায়িকার পরনে ঠিক ততটুকুই পোশাক, যতটুকু থাকলে সিনেমা হলের প্রথম সারি থেকে সিটির বন্যা বয়ে যায়। কাঁচুলির আবরণ ফুঁড়ে বুক দুটো তার বড় উঁচু হয়ে আছে, মাঝের খাঁজটিও অতিশয় প্রকট।

ইন্দ্রাণী চোখ সরিয়ে নিল, কিগো, আর কদ্দূর?

কন্দর্প সিটে হেলান দিয়ে বসেছিল। সিধে হল, এই তো এসে গেছি। বলতে বলতেই ট্যাক্সিঅলার দিকে ঝুঁকেছে, এই, বাঁ দিকে রাখুন, বাঁ দিকে রাখুন।

ইন্দ্রাণী ব্যাগ খুলতে যাচ্ছিল, কন্দর্প চটপট ভাড়া মিটিয়ে দিল। ট্যাক্সি থেকে নেমে চুল ঠিক করল আলগোছে। চারপাশের লোকজনকে দেখছে আড়চোখে, বুঝতে চাইছে তাকে কেউ দেখছে কি না। পাশের চারতলা বাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এসো, এই বাড়ি।

ইস, কী ছিরি বাড়িটার! পুরনো তো বটেই, যেন ক্লাইভের আমলে তৈরি। বাইরের চেহারাটাও ভারি খোলতাই! জরাজীর্ণ কাঠামোতে বোধহয় বছর দুতিন আগে রঙ পড়েছিল, তাতেই আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে বাড়িটাকে। প্রাচীনত্বের মর্যাদাটুকুও নেই। যেখানে সেখানে নানান মাপের সাইনবোর্ড ঝুলছে, দেওয়াল চিরে বেরিয়ে আসা অশ্বথের শিকড়ের পাশে একটা এসি মেশিন দেখা যাচ্ছে। নীচে হরেক কিসিমের দোকান। চা মিষ্টি জুতো জেরক্স ঘড়ি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। এখানেই মুস্তাফির অধিষ্ঠান।

বাড়ির সামনের দিকে কোনও সিঁড়ি নেই। বাঁ প্রান্তে প্রকাণ্ড এক লোহার ফটক। খানিকটা ভেতরে গিয়ে ডান দিকে সরু সিঁড়ি উঠে গেছে। ক্ষয়াটে উঁচু উঁচু ধাপ, নড়বড়ে রেলিঙ। প্রথম পৌষের শীত বিকেল ফুরনোর আগেই আস্তানা গেড়েছে সেখানে।

স্যাঁতসেতে আলোছায়া ভেঙে উঠছিল ইন্দ্রাণী। কন্দর্পর পিছন পিছন। দোতলায় সম্ভবত কোনও চীনা পরিবারের বাস, এক পাল মঙ্গোলয়েড দেবশিশু হাঁস-মুরগির মতো কিচমিচ করছে লম্বাটে বারান্দায়। মুখময় ভেঁড়াখোঁড়া তারজাল আঁকা এক চীনা বৃদ্ধা ভাবলেশহীন মুখে উল বুনছেন। যান্ত্রিকভাবে আঙুল নাড়তে নাড়তে চোখ জোড়া উঠল একবার, আবার নেমে গেছে উলকাঁটায়।

ইন্দ্রাণীর গা ছমছম করে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়েছে। অস্ফুটে বলল, চাঁদু, কাজটা হবে তো? কন্দর্প তেতলা ওঠার সিঁড়ি ধরেছিল। ঘুরে তাকাল, দেখা যাক।

মিস্টার মুস্তাফি তোমাকে ঠিক কী বলেছিল?

কতবার তো বললাম!

বিরক্ত হচ্ছ?

–এত টেনশান করছ কেন বলো তো? এসো না, কথা বলে দেখোই না।

–তুমি সব ঠিক ঠিক বুঝিয়ে বলেছিলে তো?

–আমার ওপর এটুকুও বিশ্বাস নেই? কন্দর্প হেসে ফেলল, যদি সিচুয়েশানটার গ্রেভনেস নাই বোঝাতে পারতাম, তা হলে কি পরদিন বিকেলেই তোমাকে আসতে বলত?

তা অবশ্য ঠিক। তবু যে কেন ইন্দ্রাণীর মন থেকে সংশয় যায় না? দিন এগিয়ে আসছে, এখনও বাপ্পাকে তেমন করে কোনও আশ্বাস দিতে পারল না। বাপ্পাটা একদম গুম মেরে গেছে, বাড়ির থেকে আর বেরোচ্ছেই না। দিনরাত মুখ কালো করে শুয়ে আছে ঘরে। কারুর সঙ্গেই কথা বলে না। কাল সন্ধেবেলা টিভিতে ফুটবল খেলা দেখাচ্ছিল, বাপ্পার প্রিয় প্রোগ্রাম। তিতির ডাকতে গেল দাদাকে, সটান উঠে ছাদে চলে গেল বাপ্পা। নামল সেই রাত সাড়ে দশটায়। খাবার সময়ে। কী যে মনে মনে ভাঁজছে ছেলেটা!

চারতলায় অশোক মুস্তাফির অফিস। বাইরে পিতলের প্লেটে পর পর কোম্পানির নাম। সব কটাতেই মুস্তাফি আছে। এ কে মুস্তাফি অ্যান্ড কোম্পানি। মুস্তাফি কনস্ট্রাকশান। অশোক মুস্তাফি ফিলমস। মুস্তাফি অ্যান্ড মুস্তাফি। …এ যে বহু রূপে ঈশ্বর!

চমকের পর চমক। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ইন্দ্রাণীর চোখ বড় হয়ে গেল। জীর্ণ বহিরঙ্গের অন্দরে এত জৌলুস! নরম ঠাণ্ডা বিশাল এক হল, দেওয়াল জুড়ে কাঠের প্যানেলিং, পায়ের নীচে কোমল কার্পেটে টলমল করে ওঠে শরীর। কাঠের পার্টিশান করা কয়েকটি ঘরও আছে, ভারি সুন্দর। খোলা হলে জনাকয়েক কর্মচারী ঝকঝকে চেয়ার টেবিলে বসে রয়েছে, এক কোণে দুজন মহিলা ঝড় তুলছে টাইপ মেশিনে।

কাচঘেরা রিসেপশন কাউন্টারের ফোকর দিয়ে সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে ফিরে এল কন্দর্প। ইন্দ্রাণীকে বলল, বোসো। অশোকদা নেই, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

ইন্দ্রাণী ঘড়ি দেখল। চাপা স্বরে বলল, সাড়ে চারটেয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না?

-সো হোয়াট? একটু দেরি হতে পারে না? অশোকদা রেলের অফিসে গেছে।

রিসেপশানের উল্টো দিকে ছোট্ট ড্রয়িংরুমের মতো করে সোফা সেন্টার টেবিল সাজানো। ফুলদানিতে ফুলও আছে। দু-তিন রঙের অ্যাসটর।

ইন্দ্রাণী লম্বা সোফাটায় বসল। পাশে কন্দর্প। এক দিকের সোফায় এক মোটাসোটা ধুতি-শার্ট পরা লোক বসে আছে, অন্য দিকের মাঝারি সোফায় দুটি সুবেশা তরুণী। দুজনেই মোটামুটি রূপসী। নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলছে তারা। হঠাৎ কন্দর্পর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মেয়েটি আড়ষ্টভাবে হাসল সামান্য।

ইন্দ্রাণী চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কে গো? তোমার চেনা?

 কন্দর্প একটু যেন এড়িয়ে গেল, হ্যাঁ। ওই আর কি।

ইন্দ্রাণীর সন্দেহ হচ্ছিল কেমন। মুস্তাফির সম্পর্কে সুদীপ পরশু যেন কি একটা মন্তব্য করেছিল! একটু জেরা করার ঢংয়েই প্রশ্ন করল, এরা কি তোমার ফিলম লাইনের?

স্টুডিও পাড়ায় ঘোরে। দেখেছি তখন।

 –এখানে এসে বসে আছে কেন?

কন্দর্পের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল, –ফিলমে রোলের জন্য অশোকদাকে ধরতে এসেছে বোধহয়।

কন্দর্পর হাসিটা ইন্দ্রাণীর ভাল লাগল না। অশোক মুস্তাফির সঙ্গে এভাবে দেখা করতে এসে কি ভুল করল সে? দুৎ, চাঁদুই তো সঙ্গে রয়েছে, ভয় কিসের!

কন্দর্প সিগারেট ধরিয়েছে। ইন্দ্রাণী জোরে নিশ্বাস নিল একটা। হালকা সুগন্ধ স্প্রে করা আছে বাতাসে, বুক ভরে যায়। কোথা থেকে যেন একরাশ অবসাদ ছুটে আসছে চোখে, আপনা-আপনি বুজে আসে আঁখিপল্লব।

আচমকা এক গমগমে স্বরে ঘোর ছিঁড়ে গেল, –একি কন্দর্প, তুমি এখানে বসে আছ?

কন্দর্প ঝটিতি সিগারেট নিবিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

বেঁটেখাটো থলথলে চেহারার লোকটা কাছে এগিয়ে এসেছে। ইন্দ্রাণীর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করল, সরি বউদি, আপনাকে আমি ওয়েট করালাম। বলেই হালকা চাপড় দিল কন্দর্পর কাঁধে, -তোমার এখনও কোনও কাণ্ডজ্ঞান হল না কন্দর্প? বউদিকে নিয়ে হাটের মাঝে বসে আছ? চেম্বারে বসানো উচিত ছিল।

ইন্দ্রাণী শালটা খোঁপার ওপর একটু তুলে দিল। ঘোমটার মতো করে। আলতো হেসে বলল, না ঠিক আছে। এখানেই ঠিক ছিলাম।

–আসুন আসুন। প্লিজ কাম।

স্যুট-প্যান্ট-টাই পরা লোকটা হেঁটে নিজের চেম্বারে ঢুকছে। দুলে দুলে। গোটা অফিস জুড়ে তটস্থ ভাব। বসে থাকা মেয়ে দুটোকে ভূক্ষেপও করল না লোকটা। কামরায় ঢুকে অপেক্ষা করল ইন্দ্রাণীদের জন্য। ইন্দ্রাণী বসার পরে বসল রিভলভিং চেয়ারে।

কী খাবেন? কোল্ড ড্রিঙ্কস, না চা কফি?

ধন্যবাদ। এখন কিছু খাব না।

–তা বললে কি হয়? আপনি হচ্ছেন কন্দর্পর বউদি, মানে আমারও বউদি। প্রথম দিন আপনাকে তো আমি শুকনো মুখে ফিরতে দেব না।

–চা বলুন তা হলে।

অশোক মুস্তাফি বেল বাজিয়ে চায়ের অর্ডার দিল। ঝাপুর ঝুপুর পা নাচাচ্ছে। এপারে বসেও স্পন্দন টের পাওয়া যায়। হঠাৎ নাচন থামিয়ে বলল, এবার বলুন বউদি, হাউ ক্যান আই সার্ভ ইউ?

কন্দর্প বলে উঠল, ওই আপনার সঙ্গে যা আলোচনা হয়েছিল…।

–তুমি থামো। আমাকে বউদির সঙ্গে কথা বলতে দাও।

ইন্দ্রাণী লোকটাকে ঠিক পড়তে পারছিল না। মনে যেন কোথায় একটা বিরূপতার মেঘ জমেছিল, কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দু-এক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলল, আপনি তো আমাদের বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট বানাতে ইন্টারেস্টেড ছিলেন, যে-কোনও কারণে হোক ব্যাপারটা মেটিরিয়ালাইজ করছিল না…

মুস্তাফি স্থির চোখে ইন্দ্রাণীকে দেখছিল। কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, যে কোনও কারণে নয় বউদি, ইউ মাস্ট বি স্পেসিফিক। আপনার শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশাই সেন্টিমেন্টাল গ্রাউন্ডে ব্যাপারটাতে রাজি হচ্ছিলেন না।

ইন্দ্রাণী সম্মোহিতের মতো ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ, অনেকটাই তাই।

-কোয়াইট ন্যাচারাল। মুস্তাফি মাথা দোলাচ্ছে, আমার পিতৃদেবের সঙ্গে আপনার শ্বশুরমশাইয়ের খুব মিল আছে। আমাদের হাওড়ার সাবেকি বাড়ি ঝুরঝুর হয়ে পড়ে যাচ্ছে, কিছুতেই আমাকে দাঁত ফোটাতে দিচ্ছেন না। অথচ জমি যা আছে, ওখানে আমি একটা প্যালেস বানাতে পারি।

ইন্দ্রাণী মৃদুস্বরে বলল, বুড়ো মানুষের স্মৃতিই তো সম্পদ।

উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল মুস্তাফি, সম্পদ নয়, বলুন চুয়িংগাম। কচর কচর চিবিয়েই যাচ্ছে। চোয়াল ব্যথা হয়ে গেল, তবুও চিবোচ্ছে। স্বাদ পায় না, তবুও চিবোচ্ছে।

ইন্দ্রাণী জোর করে প্রতিবাদ করল না। যে যেভাবে জীবনকে দেখে। তা ছাড়া মুস্তাফির কথাটা তো পুরোপুরি ভুলও নয়। সত্যিই কি স্মৃতি হাতড়ে খুব সুখে আছেন শ্বশুরমশাই? স্মৃতি যে সতত সুখের নয়, এ কথাই বা ইন্দ্রাণীর থেকে বেশি আর কে জানে!

চা এসেছে। সঙ্গে এক প্লেট বিস্কুট। মুস্তাফি উঠে দাঁড়িয়ে চা এগিয়ে দিল ইন্দ্রাণীকে, আসুন বউদি, আগে চা-টা খেয়ে নিন।

চায়ে চুমুক দিয়ে মুস্তাফির কামরায় আলগা চোখ বোলাল ইন্দ্রাণী। কয়েকটা চেয়ার টেবিল ছাড়া ঘরটা অদ্ভুত রকমের আসবাবহীন। আলমারি সেলফ র‍্যাক কিচ্ছুটি নেই। প্লাস্টিক পেন্ট করা দেওয়ালে একটা মাত্র ছবি। শিবের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মা কালী। মুস্তাফির পাশে, পিছনে, আরও দুটো কাঠের দরজা। ভেতরে ঘর আছে নাকি?

চা শেষ করে ধীরেসুস্থে ড্রয়ার থেকে পানমশলার পাউচ বার করল মুস্তাফি। ইন্দ্রাণীর দিকে বাড়াল, চলবে নাকি বউদি?

ইন্দ্রাণী খানিকটা পানমশলা ঢেলে নিল হাতে। কন্দর্পকেও দিতে গেল, কন্দর্প নিল না।

হঠাৎ ঘরের বাইরে তুমুল হট্টগোল। কে একজন সরু গলায় তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, কয়েকজন লোক মিলে বোধহয় থামাতে চাইছে তাকে। পানমশলা মুখে দিতে গিয়েও থমকে গেছে মুস্তাফি, ফিলমের ফ্রিজ শটের মতো। মুখের বিনীতভাব পলকে নিশ্চিহ্ন। গরগরে গলায় কন্দর্পকে বলল, হারামজাদাটা এসে গেছে।

বলতে বলতে এক ছোকরা কর্মচারী ঢুকেছে ঘরে, স্যার, ছোটবাবু।

মুস্তাফি খিঁচিয়ে উঠল, তা আমি কী করব? নাচব? তোমরা অতগুলো লোক মিলে সামলাতে পারছ না?

–পারছি না স্যার।

–ভরবিকেলেই! উফ কী জ্বালা। কন্দর্প যাও একটু দেখো তো।

কন্দর্প দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটু যেন স্তিমিত হচ্ছে স্বর।

কন্দর্প আবার ঢুকেছে ঘরে।

 মুস্তাফি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, আজ কত চায় শুয়োরের বাচ্চা?

 কন্দর্প হাঁপাচ্ছে। কোনওক্রমে বলল, হাজার।

মানিব্যাগ থেকে একরাশ টাকা বার করে কন্দর্পর দিকে বাড়িয়ে দিল মুস্তাফি। কন্দর্প চলে গেল। মুস্তাফি আবার চেয়ারে বসেছে। ঘুরে ঘুরে মা কালীর ছবিটাকে দেখছে।

বাইরের শব্দ মিলিয়ে গেল।

গোটা ঘটনাটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না ইন্দ্রাণী। এত দ্রুত ঘটে গেল, যেন ফিলমের সিন। সিনটা কমেডি না থ্রিলার সেটাও ঠিক মগজে ঢুকছিল না। ফিলমের লোকজনের অফিসে সবই কি সিনেমার কায়দায় হয়!

আবার কীভাবে কথা শুরু করা যায়, ইন্দ্রাণী ভেবে পাচ্ছিল না। মুস্তাফি নিজেই বলল, হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলাম আমরা। বুড়ো মানুষ, স্মৃতি, চুয়িংগাম… অল ভ্যালুলেস। জীবন ওই ব্ৰহ্মময়ীতে বিলীন হয়ে যায়।

ইন্দ্রাণী ঢোঁক গিলে বলল, কন্দর্প কোথায় গেল?

–আসছে। আমার সুপুত্তুরটিকে বিদেয় করেই আসবে।

ইন্দ্রাণীর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, যে চেঁচাচ্ছিল, সে আপনার ছেলে?

ইয়েস। ওয়ান অ্যান্ড ওনলি সান। মুস্তাফি চেয়ারে হেলান দিল, একমাত্র আপনার ওই দেওরটিকেই যা মানে। কন্দর্পই ওর পালসটা বোঝে।

কত বয়স ছেলের?

–এই চব্বিশ হল। দিনদুপুরে টঙ হয়ে ঘুরছে। লেখাপড়া তো গোল্লায় গেছে, কাজকর্মেও আসতে চায় না। প্রচুর ইয়ারদোন্ত জুটেছে..। এই জুলুম করে টাকা নিয়ে গেল, এক্ষুনি বারে বসে ফুঁকে দেবে।

জেনেও আপনি টাকাটা দিলেন? কথাটা বলতে গিয়েও কণ্ঠ রোধ হল ইন্দ্রাণীর। সন্তানের চাপের মুখে অসহায় মা হয়ে যে আজ ছুটে এসেছে মুস্তাফির অফিসে, তার মুখে ওই প্রশ্ন সাজে না। টাকা পেলে বাপ্পা ভবিষ্যতে কী হবে বাপ্পাই জানে। তবে না পেলে সে যে ওইরকম হয়ে যাবে না, তা কি জোর দিয়ে বলা যায়! চোখের সামনে আদর্শ হয়ে বাবা তো আছেই।

মুস্তাফি সোজা হয়ে বসেছে, যাক গে, আমরা পয়েন্টে ফিরি আসুন।

ইন্দ্রাণী সচকিত হয়ে বলল, হ্যাঁ, বলুন।

কীসের বেসিসে আপনি সিওর হচ্ছেন আপনার শ্বশুরমশাই বাড়ি ভাঙার অনুমতি দেবেন?

 –আমি তাঁকে বোঝাব।

মুস্তাফি আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না। পেপারওয়েট লাট্টুর মতো ঘোরাচ্ছে টেবিলে। সহসা একটা আঙুলে চেপে থামাল। টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ইমেডিয়েটলি চল্লিশ হাজার দরকার, তাই তো?

ইন্দ্রাণীর শরীরটা একটু শক্ত হয়ে গেল।

টাকাটা ক্যাশে দিলে আপনার কোনও প্রবলেম হবে?

ইন্দ্রাণীর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কান বুজে যাচ্ছে। ঘাড় নাড়ল কি না নিজেই বুঝতে পারল।

 মুস্তাফি চেয়ার ছেড়ে ঝট করে পিছনের দরজা খুলে ঢুকে গেছে ভেতরে। আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের অনেকটাই দেখা যায়। রীতিমতো সুসজ্জিত প্রমোদক। পিছনের দেওয়াল জুড়ে এক বিশাল আয়না, সামনে ডিভান, সোফা। আয়নাতে ও কীসের প্রতিবিম্ব? বিছানার?

সমস্ত স্নায়ু অসাড় হয়ে গেল ইন্দ্রাণীর। চাঁদু এখনও আসছে না কেন? এ কোথায় চাঁদু নিয়ে এল তাকে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই মুস্তাফি ফিরেছে। ইন্দ্রাণীর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল। বাঁ হাতে পাঁচটা একশো টাকার বাণ্ডিল।

ইন্দ্রাণী ঘামছিল।

ড্রয়ার থেকে বড় খাম বার করে টাকাটা ভরল মুস্তাফি। টেবিলে রেখে বলল, পঞ্চাশ হাজার দিয়ে রাখলাম বউদি। যদি আর দরকার হয়, বলবেন।

ইন্দ্রাণীর গলা কেঁপে গেল, আমাকে কোথায় সই করতে হবে?

কীসের সই?

–টাকাটা নেব…একটা ডকুমেন্ট….

মুস্তাফি হাসল। হাসিটা ঠিক হাসি নয়, গাম্ভীর্যের এক ছদ্মবেশ। বলল, বউদি, আমরা খুব সাধুসন্ন্যাসী নই, চুরিডাকাতি করেই খাই। কিন্তু আমাদের লাখ লাখ টাকার ব্যবসাও অনেক সময়ে শুধু মুখের কথাতেই চলে। ও সব কালির আঁচড়ের থেকেও আমি বেশি বিশ্বাস করি মানুষটাকে।

–আমি যদি পরে অস্বীকার করি?

করবেন। যদি করতে পারেন, তার জন্যও আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা বাজি রইল।

–যদি আমি শ্বশুরমশাইকে রাজি না করাতে পারি?

বুঝব একটা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট হয়ে গেছে। বিজনেসে এরকম কতই তো হয়।

ইন্দ্রাণীর ভীষণ গরম লাগছিল। যেন সামনে পড়ে থাকা পেটমোটা খামটা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসছে বুকে।

মুস্তাফি আকর্ণ হাসল, আপনি মিছিমিছি ঘাবড়াচ্ছেন। কন্দর্পকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন ও আমাকে আপনাদের বাড়ির কন্ট্রাক্টটা না পাইয়ে দেওয়া সত্ত্বেও ওকে কিন্তু আমি কাজ থেকে সরাইনি। কারণটা কি জানেন? আমি জানতাম কন্দর্প চিট নয়। মুস্তাফি টেবিলে ভর দিয়ে ঝুঁকল সামান্য। ভুরু কুঁচকে বলল, আশা করি আপনিও তা নন।

কথাটা সূঁচের মতো ফুটল ইন্দ্রাণীকে। মুহূর্তের জন্য মনে হল টাকাটা না নিয়েই উঠে যাবে, দরকার নেই ঝামেলার। পারল না। এত দূর এগিয়ে এসে পিছিয়েই বা যায় কী করে? বড় মুখ করে কাল রাতেই দীপুকে বলেছে চাঁদুর প্রোমোটারের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, এখন কী বলবে? দীপুকে আর টাকার কথা বলা যায় না। শেষ রাস্তা আছে। শুভর কাছে যাওয়া। ওটা রাস্তা নয়, খাদ। নিজের কাছে নিজেই অতলে নেমে যাবে ইন্দ্রাণী। সূক্ষ্ম একটা অহংবোধ চাড়া দিল মাথায়। পারবে না শ্বশুরমশাইকে রাজি করাতে?

কন্দর্প ফিরে এল। শীতের সন্ধেতেও তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

 মুস্তাফি প্রশ্ন করল, আমার লাডলাকে কোথায় ছেড়ে এলে?

–পার্ক স্ট্রিটে গেল।

সঙ্গে সাগরেদরা ছিল?

–ছিল দুজন। তরুণ আর জাকির। আপনাদের কথাবার্তা হয়ে গেল?

কথাবার্তার আবার কী আছে? তোমার বউদি মানে আমারও ফ্যামিলি মেম্বার। টাকাটা তুলে রাখো, অনর্থক বউদির টেনশান বাড়িও না।

কন্দর্প খামের দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গেল, কী রকম এগ্রিমেন্ট হবে সেটা আপনি বউদিকে ক্লিয়ার করে বলেছেন?

–ওহো, সেটাই তো বলা হয়নি। অ্যারাউন্ড সাড়ে সাতশো-আটশো স্কোয়ার ফিটের এক একটা ফ্ল্যাট হবে। মোট ষোলোখানা। গ্রাউন্ড ফাঁকা থাকবে, পার্কিং স্পেসও হতে পারে, এক আধটা দোকানঘরও থাকতে পারে। দ্যাট উইল বি মাই ডিসক্রিশান। আউট অফ সিক্সটিন আমি আপনাদের চারটে ফ্ল্যাট দেব। আপনার শ্বশুরমশাই চারটে ফ্ল্যাটই নিজের নামে রাখতে পারেন। অথবা আপনাদেরও দিতে পারেন। সেটা তাঁর ইচ্ছে। মোট চার লাখ ক্যাশ দেব। এটাও আপনার শ্বশুরমশাইয়েরই নামে। আর এই পঞ্চাশ হাজার আপনার চালু প্রেসটার জন্য কমপেনসেশান। আমি কি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পেরেছি বউদি?

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল ইন্দ্রাণী। রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল প্রেসটা, থাকবে না আর। ওই আদ্যিকালের মেশিন তুলে নিয়ে কাছেপিঠে কোথাও কি বসানো যাবে? অনেক টাকা অ্যাডভান্স সেলামি নিয়ে নেবে, পড়তায় পোষাবে না। কী আর করা! গড়ে তুলতেই তো কষ্ট, ভেঙে দিতে কতটাই বা সময়!

মুস্তাফি বলল, আমার কাছে এগ্রিমেন্টের কিছু প্রোফর্মা আছে। দেখবেন?

ইন্দ্রাণী দু দিকে ঘাড় নাড়ল, আপনি কাগজ রেডি করে পাঠিয়ে দেবেন।

–আমার কিন্তু তিনটে দিন সময় লাগবে বউদি। লইয়ারকে দিয়ে ড্রাফট করানো, টাইপ করা… ভাবছি একবার আর্কিটেক্ট-এর সঙ্গেও কথা বলে নেব, অ্যাকিউরেট মাপ কতটা কি হবে…

–আপনি সময় নিয়েই করুন।

মুস্তাফির ঘর থেকে বেরিয়ে ইন্দ্রাণী দেখল মেয়ে দুটো এখনও বসে আছে। অফিস প্রায় ফাঁকা, একজন-দুজন কর্মচারী আছে শুধু।

শীতের রাত্রি আসছে পায়ে পায়ে। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের জনঅরণ্যেও তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আকাশ মেঘহীন। হিমরেণু নামছে শহরে।

ট্যাক্সিতে চোখ বন্ধ করে বসেছিল ইন্দ্রাণী। বোজা চোখেই প্রশ্ন করল, মুস্তাফি লোকটা কেমন চাঁদু?

কন্দর্প চমকে তাকাল, কেন, কিছু বলেছে তোমাকে?

নাআ।

–তা হলে?

 –এমনি। জিজ্ঞেস করছি। বলো না লোকটা কেমন?

অতি ধুরন্ধর। জাত ব্যবসায়ী।

 –শুধু ধুরন্ধর?

কন্দর্প সয়েটারের নীচে বুশশার্টের গলার বোতামটা আটকাল, তুমি তো এতক্ষণ কথা বললে, তোমার কী মনে হল?

–হেঁয়ালি কোরো না। ইন্দ্রাণী ঈষৎ রুক্ষ, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।

কন্দর্প সিগারেট বার করে ঠোঁটে রেখেছে, ধরায়নি। সিগারেটটা মুখ থেকে নামাল, প্রচুর ভাইস আছে। নারীদোষ নেই তা বলব না, তবে মেয়েদের ব্যাপারে কিছু সেলফ রেস্ট্রিকশান ইম্পোজ করে রেখেছে। মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে না, তবে আপনা-আপনি হাতে এসে গেলে…

-হুঁ। আর?

–প্রয়োজনে ঠাণ্ডা মাথায় খুনখারাপি করতে পারে। দেদার ঘুষ ছড়ায় চতুর্দিকে। ভাল পলিটিকাল কানেকশান আছে। পুলিশের ওপর মহলের সঙ্গে যথেষ্ট র‍্যাপো। ভক্তির ভড়ং আছে খুব।

হুঁ। আর?

–পিপে পিপে মাল টানতে পারে, বেহেড হয় না। পারসোনাল লাইফে হ্যাপি নয়। কারণটাও বুঝতে পারছ? ছেলে। বউয়েরও নানান রোগব্যাধি আছে…। বাই দা বাই, একটা গুণও আছে। লোকটা মিন নয়।

এত শুনেও লোকটাকে যেন ঠিক চেনা যাচ্ছে না। আরও কি যেন আছে লোকটার মধ্যে! কী সেটা!

কন্দর্প আলগোছে প্রশ্ন করল, তুমি কি আজই বাবার সঙ্গে কথা বলবে?

-না না আজ নয়। আগে এগ্রিমেন্টটা হাতে আসুক। ইন্দ্রাণী চোখ খুলল। সঙ্গে সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের বড়দিনের আলো ধাঁধিয়ে দিয়েছে নয়ন। উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমিও আজ বাড়িতে কাউকে কিছু বোলো না।

–এত লুকোছাপা করার কি আছে? আজ বাদে কাল সবাই তো জানবেই।

 ইন্দ্রাণী কিছু বলল না। তার চোখের সামনে এখন এক বিশাল প্রান্তর। অন্ধকার। কুয়াশায় ঢাকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *