একাদশ পরিচ্ছেদ
অবতার কি এখন নাই?
গৃহস্বামী আসিয়া প্রণাম করিলেন। তিনি মারোয়াড়ী ভক্ত, ঠাকুরকে বড় ভক্তি করেন। পণ্ডিতজীর ছেলেটি বসিয়া আছেন। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, “পাণিনি ব্যাকরণ কি এদেশে পড়া হয়?”
মাস্টার — আজ্ঞে, পাণিনি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — হ্যাঁ, আর ন্যায়, বেদান্ত এ-সব পড়া হয়?
গৃহস্বামী ও-সব কথায় সায় না দিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন।
গৃহস্বামী — মহারাজ, উপায় কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাঁর নামগুণকীর্তন। সাধুসঙ্গ। তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা।
গৃহস্বামী — আজ্ঞে, এই আশীর্বাদ করুন, যাতে সংসারে মন কমে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কত আছে? আট আনা? (হাস্য)
গৃহস্বামী — আজ্ঞে, তা আপনি জানেন। মহাত্মার দয়া না হলে কিছু হবে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সেইখানে সন্তোষ করলে সকলেই সন্তুষ্ট হবে। মহাত্মার হৃদয়ে তিনিই আছেন তো।
গৃহস্বামী — তাঁকে পেলে তো কথাই থাকে না। তাঁকে যদি কেউ পায়, তবে সব ছাড়ে। টাকা পেলে পয়সার আনন্দ চেড়ে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিছু সাধন দরকার করে। সাধন করতে করতে ক্রমে আনন্দ লাভ হয়। মাটির অনেক নিচে যদি কলসী করা ধন থাকে, আর যদি কেউ সেই ধন চায়, তাহলে পরিশ্রম করে খুঁড়ে যেতে হয়। মাথা দিয়ে ঘাম পড়ে, কিন্তু অনেক খোঁড়ার পর কলসীর গায়ে যখন কোদাল লেগে ঠং করে উঠে, তখনই আনন্দ হয়। যত ঠং ঠং করবে ততই আনন্দ। রামকে ডেকে যাও; তাঁর চিন্তা কর। রামই সব যোগাড় করে দেবেন।
গৃহস্বামী — মহারাজ, আপনিই রাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি, নদীরই হিল্লোল, হিল্লোলের কি নদী?
গৃহস্বামী — মহাত্মাদের ভিতরেই রাম আছেন। রামকে তো দেখা যায় না। আর এখন অবতার নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কেমন করে জানলে, অবতার নাই?
গৃহস্বামী চুপ করিয়া রহিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — অবতারকে সকলে চিনতে পারে না। নারদ যখন রামচন্দ্রকে দর্শন করতে গেলেন, রাম দাঁড়িয়া উঠে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম কল্লেন আর বললেন, আমরা সংসারী জীব; আপনাদের মতো সাধুরা না এলে কি করে পবিত্র হব? আবার যখন সত্যপালনের জন্য বনে গেলেন, তখন দেখলেন, রামের বনবাস শুনে অবধি ঋষিরা আহার ত্যাগ করে আনেকে পড়ে আছেন। রাম যে সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম, তা তাঁরা অনেকে জানেন নাই।
গৃহস্বামী — আপনিই সেই রাম!
শ্রীরামকৃষ্ণ — রাম! রাম! ও-কথা বলতে নাই।
এই বলিয়া ঠাকুর হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিলেন ও বলিলেন — “ওহি রাম ঘটঘটমে লেটা, ওহি রাম জগৎ পসেরা! আমি তোমাদের দাস। সেই রামই এই সব মানুষ, জীব, জন্তু হয়েছেন।”
গৃহস্বামী — মহারাজ, আমরা তো তা জানি না —
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি জান আর না জান, তুমি রাম!
গৃহস্বামী — আপনার রাগদ্বেষ নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন? যে গাড়োয়ানের কলকাতায় আসবার কথা ছিল। সে তিনআনা পয়সা নিয়ে গেল, আর এলো না, তার উপরে তো খুব চটে গিছলুম!
কিন্তু ভারী খারাপ লোক, দেখ না, কত কষ্ট দিলে।