দশম পরিচ্ছেদ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বড়বাজারে মারোয়াড়ী ভক্তমন্দিরে
আজ ঠাকুর ১২নং মল্লিক স্ট্রীট বড়বাজারে শুভাগমন করিতেছেন। মারোয়াড়ী ভক্তেরা অন্নকূট করিয়াছেন — ঠাকুরের নিমন্ত্রণ। দুইদিন হইল শ্যামাপূজা হইয়া গিয়াছে। সেই দিনে ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে আনন্দ করিয়াছিলেন। তাহার পরদিন আবার ভক্তসঙ্গে সিঁথি ব্রাহ্মসমাজে উৎসবে গিয়াছিলেন। আজ সোমবার, ২০শে অক্টোবর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ কার্তিকের শুক্লা প্রতিপদ — দ্বিতীয়া তিথি, বড়বাজারে এখন দেওয়ালির আমোদ চলিতেছে।
আন্দাজ বেলা ৩টার সময় মাস্টার ছোট গোপালের সঙ্গে বড়বাজারে আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর তেলধুতি কিনিতে আজ্ঞা করিয়াছিলেন, — সেইগুলি কিনিয়াছেন। কাগজে মোড়া; একহাতে আছে। মল্লিক স্ট্রীটে দুইজনে পৌঁছিয়া দেখেন, লোকে লোকারণ্য — গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি জমা হইয়া রহিয়াছে। ১২ নম্বরের নিকটবর্তী হইয়া দেখিলেন, ঠাকুর গাড়িতে বসিয়া, গাড়ি আসিতে পারিতেছে না। ভিতরে বাবুরাম, রাম চাটুজ্যে। গোপাল ও মাস্টারকে দেখিয়া ঠাকুর হাসিতেছেন।
ঠাকুর গাড়ি থেকে নামিলেন। সঙ্গে বাবুরাম, আগে আগে মাস্টার পথ দেখাইয়া লইয়া যাইতেছেন। মারোয়াড়ীদের বাড়িতে পৌঁছিয়া দেখেন, নিচে কেবল কাপড়ের গাঁট উঠানে পড়িয়া আছে। মাঝে মাঝে গরুর গাড়িতে মাল বোঝাই হইতেছে। ঠাকুর ভক্তদের সঙ্গে উপর তলায় উঠিলেন। মারোয়াড়ীরাও আসিয়া তাঁহাকে একটি তেতলার ঘরে বসাইল। সে ঘরে মা-কালীর পট রহিয়াছে — ঠাকুর দেখিয়া নমস্কার করিলেন, ঠাকুর আসন গ্রহণ করিলেন ও সহাস্যে ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
একজন মারোয়াড়ী আসিয়া ঠাকুরের পদসেবা করিতে লাগিলেন। ঠাকুর বলিলেন, থাক্ থাক্। আবার কি ভাবিয়া বলিলেন, আচ্ছা, একটু কর। প্রত্যেক কথাটি করুণামাখা।
মাস্টারকে বলিলেন, স্কুলের কি —
মাস্টার — আজ্ঞা, ছুটি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — কাল আবার অধরের ওখানে চণ্ডীর গান।
মারোয়াড়ী ভক্ত গৃহস্বামী, পণ্ডিতজীকে ঠাকুরের কাছে পাঠাইয়া দিলেন। পণ্ডিতজী আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। পণ্ডিতজীর সহিত অনেক ঈশ্বরীয় কথা হইতেছে।
[শ্রীরামকৃষ্ণের কামনা — ভক্তিকামনা — ভাব, ভক্তি, প্রেম — প্রেমের মানে ]
অবতারবিষয়ক কথা হইতে লাগিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — ভক্তের জন্য অবতার, জ্ঞানীর জন্য নয়।
পণ্ডিতজী — পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
“অবতার, প্রথম, ভক্তের আনন্দের জন্য হন; আর দ্বিতীয়, দুষ্টের দমনের জন্য। জ্ঞানী কিন্তু কামনাশূন্য।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — আমার কিন্তু সব কামনা যায় নাই। আমার ভক্তিকামনা আছে।
এই সময়ে পণ্ডিতজীর পুত্র আসিয়া ঠাকুরের পাদবন্দনা করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতজীর প্রতি) — আচ্ছা জী! ভাব কাকে বলে, আর ভক্তি কাকে বলে?
পণ্ডিতজী — ঈশ্বরকে চিন্তা করে মনোবৃত্তি কোমল হয়ে যায়, তার নাম ভাব, যেমন সূর্য উঠলে বরফ গলে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা জী! প্রেম কাকে বলে?
পণ্ডিতজী হিন্দীতে বরাবর কথা কহিতেছেন। ঠাকুরও তাঁহার সহিত অতি মধুর হিন্দিতে কথা কহিতেচেন। পণ্ডিতজী ঠাকুরের প্রশ্নের উত্তরে প্রেমের অর্থ একরকম বুঝাইয়া দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (পণ্ডিতজীর প্রতি) — না, প্রেম মানে তা নয়। প্রেম মানে ঈশ্বরেতে এমন ভালবাসা যে জগৎ তো ভুল হয়ে যাবে। চৈতন্যদেবের হয়েছিল।
পণ্ডিতজী — আজ্ঞে হ্যাঁ, যেমন মাতাল হলে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা জী, কারু ভক্তি হয় কারু হয় না, এর মানে কি?
পণ্ডিতজী — ঈশ্বরের বৈষম্য নাই। তিনি কলপতরু, যে যা চায় সে তা পায়। তবে কল্পতরুর কাছে গিয়ে চাইতে হয়।
পণ্ডিতজী হিন্দীতে এ-সমস্ত বলিতেছেন। ঠাকুর মাস্টারের দিকে ফিরিয়া এই কথাগুলির অর্থ বলিয়া দিতেছেন।
[সমাধিতত্ত্ব ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা জি, সমাধি কিরকম সব বল দেখি।
পণ্ডিতজী — সমাধি দুইপ্রকার — সবিকল্প আর নির্বিকল্প। নির্বিকল্প-সমাধিতে আর বিকল্প নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ‘তদাকারকারিত’ ধ্যাতা, ধ্যেয় ভেদ থাকে না। আর চেতনসমাধি ও জড়সমাধি। নারদ শুকদেব এঁদের চেতনসমাধি। কেমন জী?
পন্ডিতজী — আজ্ঞা, হাঁ!
শ্রীরামকৃষ্ণ — আর জী, উন্মনাসমাধি আর স্থিতসমাধি; কেমন জী?
পণ্ডিতজী চুপ করিয়া রহিলেন; কোন কথা কহিলেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা জী, জপতপ করলে তো সিদ্ধাই হতে পারে — যেমন গঙ্গার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া?
পণ্ডিতজী — আজ্ঞে তা হয়, ভক্ত কিন্তু তা চায় না।
আর কিছু কথাবার্তার পর পণ্ডিতজী বলিলেন, একাদশীর দিন দক্ষিণেশ্বরে আপনাকে দর্শন করতে যাব।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা, তোমার ছেলেটি বেশ।
পণ্ডিতজী — আর মহারাজ! নদীর এক ঢেউ যাচ্ছে, আর-এক ঢেউ আসছে। সবই অনিত্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তোমার ভিতরে সার আছে।
পণ্ডিতজী কিয়ৎক্ষণ পরে প্রণাম করিলেন, বলিলেন, পূজা করতে তাহলে যাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আরে, বৈঠো, বৈঠো!
পন্ডিতজী আবার বসিলেন।
ঠাকুর হঠযোগের কথা পাড়িলেন। পণ্ডিতজী হিন্দিতে ঠাকুরের সহিত ওই সম্বন্ধে আলাপ করিতেছেন। ঠাকুর বলিলেন, হাঁ, ও-একরকম তপস্যা বটে, কিন্তু হঠযোগী দেহাভিমানী সাধু — কেবল দেহের দিকে মন।
পণ্ডিতজী আবার বিদায় গ্রহণ করিলেন। পূজা করিতে যাইবেন।
ঠাকুর পণ্ডিতজীর পুত্রের সহিত কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কিছু ন্যায়, বেদান্ত, আর দর্শন পড়লে শ্রীমদ্ভাগবত বেশ বোঝা যায়। কেমন?
পুত্র — হাঁ, মহারাজ! সাংখ্য দর্শন পড়া বড় দরকার।
এইরূপ কথা মাঝে মাঝে চলিতে লাগিল।
ঠাকুর তাকিয়ায় একটু হেলান দিয়া শুইলেন। পণ্ডিতজীর পুত্র ও ভক্ত কয়টি মেঝেতে উপবিষ্ট। ঠাকুর শুইয়া শুইয়া গান ধরিলেন —
হরিষে লাগি রহ রে ভাই,
তেরা বনত বনত বনি যাই,
তেরা বিগড়ী বাত বনি যাই।
অঙ্কা তারে বঙ্কা তারে, তারে সুজন কসাই
শুগা পড়ায়কে গণিকা তারে, তারে মীরাবাঈ।