সংস্কৃত কলেজের দ্বিতলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যাসাগর। প্রায়ই ছাত্রদের মধ্যে মারামারি লাগে। বিশেষত, পিঠোপিঠি ভাই-বোনের মতন, পাশাপাশি সংস্কৃত ও হিন্দু কলেজের ছাত্ররা তুচ্ছ কারণে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়। বয়েসসুলভ চাপল্যে ছাত্ররা এরকম পারস্পরিক লড়াই মাঝে মাঝে করবেই, অধিকাংশ সময়েই বিদ্যাসাগর ওপর থেকে সে দৃশ্য উপভোগ করেন, কখনো চেঁচিয়ে বলেন, দেখি, কে জেতে! মারামারি গুরুতর আকার ধারণ করলে অবশ্য তিনি নিজে নেমে যান তাদের থামাতে, দু-একবার পুলিসও ডাকতে হয়েছে।
রসময় দত্ত ইস্তফা দেবার পর বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি হয়েছিলেন, এখন সেক্রেটারির পদ উঠে গেছে, বর্তমানে বিদ্যাসাগর এই কলেজের অধ্যক্ষ। এবং দেশে শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে ভারতের ইংরেজ সরকার বিদ্যাসাগরের ওপরে অনেকখানি নির্ভরশীল।
আজ অবশ্য মারামারি বাধেনি, বিদ্যাসাগর দেখলেন হিন্দু কলেজের প্রবেশদ্বারের কাছে একটি জুড়িগাড়ি থেমেছে এবং সেখানে কিসের যেন গোলমাল হচ্ছে। ওপর থেকে তিনি সব ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না। তবে এটা তাঁর প্রতিষ্ঠানের ব্যাপার নয় বলে তিনি একটু পরে চলে গেলেন নিজের দপ্তরে।
হিন্দু কলেজের প্রবেশদ্বারের কাছে গোলমাল ক্রমশই বাড়ছিল। এক বালকের হাত ধরে ঝলমলে পোশাকে ভূষিতা এক উগ্রযৌবনা রমণী কলেজের মধ্যে ঢুকতে চাইছে। এমনটি আর কখনো ঘটেনি, দেশগৌরব এই বিদ্যালয়ে এর আগে আর কোনো নারী প্ৰবেশ করেনি।
আরে একি একি—বলে শোরগোল তুলেছে একদল বালক। সম্ভ্রান্ত বংশীয় বালকেরা চুপ করে দেখছে এক পাশে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে রয়েছে রামকমল সেনের পৌত্র কেশবচন্দ্ৰ, দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্ৰ সত্যেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রলাল সরকার, দীনবন্ধু মিত্র, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ইত্যাদি। কেশব অত্যন্ত ধীর স্থির ও গম্ভীর স্বভাবের বালক, সে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো স্থির দৃষ্টিতে, অন্যরা সবিস্ময়ে ফিসফিস করতে লাগলো। স্ত্রীলোকটির সঙ্গের বালকটি তাদেরই বয়েসী, লজ্জায় তার মুখ আরক্ত, সে কোনোদিকে তাকাচ্ছে না।
হীরে বুলবুল কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পুত্রকে নিয়ে সোজা ঢুকে এলো ভেতরে। সিঁড়ির পাশের বাঁ দিকের প্রশস্ত ঘরটিতে কমিটি মেম্বাররা প্রয়োজনে মিলিত হন। রাইমোহনের সংবাদ সঠিকই ছিল, আজ ইংরেজ ও ভারতীয় সদস্যরা অনেকেই এসেছেন কোনো একটি জরুরি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। পুত্ৰ সমেত হীরাকে প্রবেশ করতে দেখে মাননীয় দেশী সদস্যরা সবাই যেন আঁতকে উঠলেন।
রাইমোহন যা শিখিয়েছিল, তোতাপাখির মতন গড় গড় করে বলে গেল সে কথা। সে চক্ষু নত করেনি এবং চিবুক উঁচিয়ে রেখেছে। হীরেমণি যে একজন বারাঙ্গনা, সে কথা কারুর বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না, তাকে দেখা মাত্র বোঝা যায়।
হীরেমণির কথার মধ্যপথেই একজন দেশী সদস্য চেঁচিয়ে উঠলো, আরো মলো যা, কী উৎপাত! দ্বারবান বেটারা কই? রামটহল! ব্ৰজবাসী!
হীরেমণি বললো, আমার নাম হীরা বুলবুল। দারোয়ান বেটারা আমার গায়ে হাত দেবে? অ্যাতগুলোন ভদ্দরলোক এখানে বসে থাকতে?
ইংরেজ সদস্যরা বাধা দিয়ে বললো, আগে ব্যাপারটা শোনা যাউক। হে মহোদয়া, আপনি আসন পরিগ্রহণ করুন!
অমনি ভারতীয় সদস্যদের মধ্যেকার একজন সমাজ শিরোমণি বলে উঠলেন, সে কি মহাশয়, এক কুলটা রমণী আমাদের সম্মুখে বসিবে কি? তাহার সংস্পর্শে এই পুতঃ বিদ্যালয় অপবিত্র হইয়া যাইতেছে!
হীরেমণি কয়েকজন দেশীয় সম্ভ্রান্ত সদস্যের মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি ন্যস্ত করে রইলো, যেন এখনি সে বলে উঠবে, কী গো বাবু, আমায় চিনতে পাচ্চো না? কতদিন আমার গা ঘেঁষাঘেষি করোচো, তা মনে করিয়ে দিতে হবে?
মুখে অবশ্য সে কথা বললো না হীরেমণি, যেন তার দৃষ্টিই যথেষ্ট।
ইংরেজ সদস্যরা কৌতুক পেয়ে গেল। মুসলমান ও খৃষ্টান ছাত্রদের এ কলেজে প্রবেশ অধিকার এখনো নেই। এমনকি, কোনো হিন্দু ছাত্র বা শিক্ষক ধর্মান্তরিত হলেই হিন্দু সদস্যরা তাদের তাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লাগে। এবার ইংরেজ সদস্যরা সুযোগ পেয়েছে। তারা একযোগে বললো, আপনাদের আপত্তির কারণ তো কিছু বুঝিতে পারিতেছি না? এই রমণী কি হিন্দু নয়? হিন্দুর সন্তান অবশ্যই হিন্দু হইবে!
এক ভারতীয় সক্রোধে বলে উঠলেন, বেশ্যার ছেলের আবার জাত কী? ওর কি কোনো বাপের ঠিক আছে?
হীরেমণি চোখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর বঙ্গের মুখোজ্জ্বলকারী ব্যক্তিদের প্রত্যেকের মুখের দিকে একে একে দৃষ্টি ফেলে সে বললো, বলবো? এখেনে সকলের সামনে ওর বাপের নাম বলবো? সেটা কি ঠিক হবে? ভেবে দোকুন। একবার!
অমনি সব উজ্জ্বল মুখগুলি স্নান হয়ে গেল। মনে মনে সবাই প্ৰমাদ গুণলেন। এ পাপীয়সীর মনে কী আছে কে জানে! যদি মিথ্যেমিথ্যে যে-কোনো একজনের নাম বলে দেয়? একবার কলঙ্ক রটে গেলে তা আর সহজে ফেরানো যায় না। বেশ্যার মুখের কথা সারা শহর রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করবে। দুরাচার, সংবাদপত্রের মসিজীবীরা তাই নিয়ে বানাবে সাত কাহন।
হীরেমণি বললো, বলচি তো, লিকে নিন, ওর বাপের নাম ভগবান!
ভারতীয় সদস্যরা সদলে একযোগে প্ৰতিবাদ স্বরূপ সভাস্থল পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। ইংরেজ সদস্যরা পরীক্ষা করে দেখলো হীরেমণির সন্তানের শিক্ষাগত যোগ্যতা। চন্দ্ৰনাথের মেধা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবার কথা নয়। ইংরেজরা একতরফাভাবে চন্দ্রনাথকে হিন্দু কলেজের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নেবার সিদ্ধান্ত নিল। তদণ্ডেই কলেজের অধ্যক্ষ চন্দ্রনাথের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে এলেন ক্লাসে।
বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো হীরেমণি। কিছু দূরে অপেক্ষা করছিল জুড়িগাড়িটি, তার মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে রাইমোহন। হীরেমণি একা এসে গাড়িতে উঠতেই রাইমোহন সেই বসা অবস্থাতেই নৃত্য শুরু করে দিল যেন। দন্তপাটি বিকশিত করে সে বলতে লাগলো, কেমন, ফললো কি না! ফললো কি না! দিয়িচি সব ব্যাটার থোঁতা মুখ ভোঁতা করে। কেমুন ল্যাজ গুটিয়ে ভোগে পড়লো সব!
গাড়ি ঘরঘরিয়ে চললো, আর তার মধ্যে উল্লাসে লাফাতে লাগলো রাইমোহন।
সেদিন হিন্দু কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর বাকি সব ছাত্রদের বাড়িতে এসে স্নান করে মাথায় গঙ্গাজল স্পর্শ করতে হলো। তাদের সেদিনকার পরিধেয় বস্ত্র ফেলে দেওয়া হলো পথে। অভিভাবকদের মধ্যে সৃষ্টি হলো সাংঘাতিক উত্তেজনার। দেশ বুঝি রসাতলে যেতে বসেছে। একি অনাচার! একি অনাচার! শোভাবাজারে রাধাকান্ত দেবের প্রাসাদে, জোড়াসাঁকোয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অট্টালিকায় এবং তালতলায় রাজেন্দ্রনাথ দত্তের ভবনে পৃথক পৃথক ভাবে বড় মানুষদের সভা বসলো। এর প্রতিবিধান না করতে পারলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের বড় বড় হিন্দুরাই, আজ সে প্রতিষ্ঠান ইংরেজদের কুক্ষিগত।
পরদিন হিন্দু কলেজে বহু ছাত্রই অনুপস্থিত হলো। তৃতীয় শ্রেণীতে চন্দ্রনাথ ছাড়া আর একজনও আসেনি। বই ও খাতা নিয়ে চন্দ্রনাথ এক চুপ করে বসে রইলো ক্লাস ঘরে। হিন্দু অধ্যাপকরা অনেকেই তৃতীয় শ্রেণীতে গিয়ে চন্দ্রনাথকে পড়াতে রাজি নয়। কিন্তু ইংরেজ অধ্যক্ষ অনড়। যে-সব অধ্যাপক পড়াতে রাজি নন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা হবে। চন্দ্রনাথকে ভর্তি করানো হয়েছে যখন, তখন সে পড়বেই। একজন ইংরেজ অধ্যাপক তৃতীয় শ্রেণীতে এক চন্দ্রনাথকে পড়বার উদ্দেশে এসে বললেন, কাম অন, মাই বয়, উই শ্যাল রীড পোয়েট্রি টুডে। তুমি বায়রনের নাম শুনিয়াছ?
চন্দ্রনাথ নম্রভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করলো, ও টক নট টুমী অফ এ নেম গ্রেট ইন স্টোরি; দি ডেইজ অফ আওয়ার ইউথ আর দি ডেইজ অফ আওয়ার গ্লোরি…
সাহেব শুনে চমৎকৃত হয়ে গেলেন।
দেশীয় সমাজের প্রবল প্রতিবাদের উত্তরে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো এই যে, বারবনিতারা নিজে থেকে জন্মায় না। এই সমাজই বারবনিতা তৈরি করে। যে সমাজ বারবনিতাদের পোষণ করতে পারে, সে সমাজ তাদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ দেবে না কেন? ইংলণ্ডেও বারবনিতা আছে। সেখানে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার কোনো বাধা নেই।
দ্বিতলে বসে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর যথাসময়ে শুনলেন হিন্দু কলেজের ঘটনা। তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না। হিন্দু কলেজের সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্ৰব নেই, শুধু সেখানকার দু-একজন ইংরেজী ভাষার শিক্ষকের কাছে তিনি ছুটির পর নিয়মিতভাবে ইংরেজী সাহিত্যের পাঠ নিতে যান। সুতরাং সেখানকার সব কথাই তাঁর কানে আসে।
সেদিন কাজ সেরে বেরুতে তাঁর অনেক দেরি হয়েছে। কলেজ থেকে বেরিয়ে তিনি গেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে তাঁর বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। এখানে তিনি প্রায়ই আসেন। সর্ব ব্যাপারে রাজকৃষ্ণ তাঁর সহচর। রাত্রের আহার সেখানেই সেরে বিদ্যাসাগর আবার বাড়ির দিকে রওনা হলেন। রাজকৃষ্ণ একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর রাজি হননি। তাঁর পায়ের তলায় শর্ষে, তিনি হেঁটে হেঁটেই দুনিয়া ঘুরতে পারেন। সুকিয়া স্ট্রিট থেকে বউবাজার আর কতখানিই বা দূরত্ব। একটু একটু বৃষ্টি পড়ছে, তবু তিনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না।
পথে এক স্ত্রীলোক তাঁর পিছু নিল। সে হতভাগিনী মানুষ চিনতে পারেনি। কিংবা বেশী রাতে একা পথচারী দেখে সে উপযুক্ত খরিদ্দারই মনে করেছে। প্রথমে কিছুক্ষণ সে কানের কাছে প্যান প্যান করলো, তারপর একবার মরিয়া হয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের হাত চেপে ধরলো।
ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিদ্যাসাগর হেঁটে গেলেন হন হন করে। একটু দূরে গিয়ে থামলেন। তারপর আবার ফিরে আসতে লাগলেন মেয়েটির কাছে। হঠাৎ তাঁর চোখে জল এসে গেল। এই এক তাঁর রোগ, যখন তখন কান্না এসে যায়। যুক্তি দিয়ে তিনি মস্তিষ্কে সব বোঝেন, তবু হৃদয়দৌর্বল্য কিছুতেই কমে না।
স্ত্রীলোকটি অল্পবয়েসী, রোগা ছিপছিপে চেহারা, মুখখানি শুকনো। ঈশ্বরচন্দ্র তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে আর পথে পথে ঘুরছে কেন? বাড়ি যাও! ঈশ্বরচন্দ্ৰকে দেখে মেয়েটি একটি হতাশ নিশ্বাস ফেললো। চেহারা দেখলেই মনে হয় কোনো বাড়ির রসুই বামুন, কিংবা পুজুরী। পয়সাকড়ির মুরোদ নেই। মেয়েটির ভাগ্যে এত রাতে একটি ভুল লোকই জুটেছিল।
মেয়েটি বললো, কী করবো ঠাকুর। আজ একটা খদেরও জোটেনি। বাড়িতে একটা আধলাও নেই, খাবো কী?
ঈশ্বরচন্দ্ৰ চোখ নীচু করলেন। কোন মুখে তিনি এই ভাগ্যহীনা রমণীকে তিরস্কার করবেন? আবার তিনি একা এই সমস্যা দূর করবেনই বা কী করে? এই সমাজ স্ত্রীলোকদের লেখাপড়া শেখাতে দেয় না। এই সমাজ স্ত্রীলোকদের অতি শৈশব অবস্থায় বিবাহ করতে বাধ্য করে। তারপর দৈবাৎ কোনো স্ত্রীলোকের স্বামী মারা গেলে, সে বিধবার সমস্ত সাধ আহ্লাদ ঘুচে যায়। সারা জীবনের মতন। মৃত স্বামীর বিষয়-সম্পত্তি লুটে পুটে নেয় পাঁচ ভূতে। তারপর সেই স্ত্রীলোক যদি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য পথে নামতে বাধ্য হয়, অমনি সেই সমাজ তাকে পতিতা বলে ঘোষণা করে দেয়। হীরা বুলবুল তার সন্তানকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করে সমাজের নীচের তলার অনেক ক্লেদ প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। হীরা বুলবুলের সন্তানের জনক কে, সমাজেরই কোনো বড় মানুষ নিশ্চয়ই।
ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে যা পয়সাকড়ি ছিল মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আজ আর বৃষ্টিতে ভিজো না। আজ বাড়ি যাও।
মেয়েটি বললো, তুমি আমায় এমনি এমনি পয়সা দিচ্চো কেন? তুমি কে গা?
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, আমি কেউ না।
তারপর তিনি হন।হন করে হাঁটতে শুরু করলেন। মেয়েটি চিৎকার করতে লাগলো, ও ঠাকুর, চলে যাচ্চো কেন, লজ্জা কী? আমি তোমায় ভালো করে সুখ দেবো! ও ঠাকুর…
ঈশ্বরচন্দ্র দু হাতে কান চাপা দিয়ে ছুটতে লাগলেন প্রায়।
হিন্দু কলেজে ছাত্রসংখ্যা প্রতিদিনই কমতে লাগলো। অনেক ছাত্র বই খাতা নিয়ে এসে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকে, চন্দ্রনাথকে ঢুকতে দেখলে তারা বিদ্রুপ ধ্বনি দেয়। চন্দ্রনাথ গ্রাহ্য করে না।
সাতদিন পরে একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে তিন-চারজন লাঠিধারী জোয়ান পিছন থেকে অকস্মাৎ মারতে লাগলো চন্দ্রনাথকে। চন্দ্রনাথ দৌড়ে পালাবারও সময় পেল না, রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে গেল মাটিতে। দুৰ্বত্তরা চম্পট দিল অবিলম্বে। চন্দ্রনাথ পড়েই রইলো। সেখানে, একটা কুকুর এসে গন্ধ শুকে গেল। কিন্তু কোনো মানুষ তাকে স্পর্শ করলো না।
সেদিন আবার সন্ধের আগেই রাইমোহন মাতাল হয়ে বসে আছে। হরচন্দ্ৰ কোথা থেকে কিছু টাকা জোগাড় করেছে, সে-ই ক্রয় করে এনেছে বোতল, তারপর দুজনে মিলে উচ্চণ্ড মাতলামি শুরু করেছে। এদিকে বেলা পার হয়ে আঁধার হয়ে আসার পর হীরেমণি উতলা হয়ে উঠলো ছেলের জন্য। সে রাইমোহনের কাছে এসে কিছু বলতে এলে রাইমোহন হেসে উড়িয়ে দেয়। চন্দ্রনাথ তো আর তেমন ছেলেমানুষটি নয় যে পথ হারিয়ে ফেলবে। সাহেবরা তাকে একলা একলা পড়ায়, সেইজন্য বোধহয় সময়ের ইশবোধ নেই।
শেষ পর্যন্ত এক গাছ মুড়ো ঝাঁটা এনে হীরেমণি সপাসপ করে পেটাতে লাগলো। ওদের দুজনকে। তখন ওরা দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো পথে। গলা ধরাধরি করে দুই মাতাল চলতে লাগলো, আর মাঝে মাঝে পথের মানুষদের ডেকে ডেকে জড়িত কণ্ঠে শুধোয়, ওগো, তোমরা কেউ চাঁদুকে দেখেছে? লোকেরা কোনো উত্তর না দিয়ে ভয়ে পালিয়ে যায়। একবার পটলডাঙ্গায় হিন্দু কলেজ পর্যন্ত গিয়েও তারা ফিরে এলো, কলেজের দ্বার বন্ধ, সেখানে কেউ নেই। গোলদীঘিতে বসে আরও সুরাপান ও সামনের দোকান থেকে কাবাব এনে ভক্ষণের প্রস্তাব দিল হরচন্দ্ৰ, কিন্তু রাইমোহন বললো, না, চল, বাড়ি যাই। গিয়ে দেকবো, চাঁদু পৌঁচে গ্যাচে, আর হীরেকে বলবো, নে, এখন সব ঝাঁটার বাড়ি ফেরৎ নে।
ফেরার পথে তারা দৈবাৎ আবিষ্কার করলো চন্দ্রনাথকে। রক্তমাখা নিষ্পন্দ চন্দ্রনাথকে দেখেই তারা কেঁদে উঠলো ড়ুকরে। পথের ওপর বসে পড়ে ওরা প্রকৃতপক্ষেই শোকে আকুল হয়ে উঠলো, ওরা দুজনেই চাঁদুকে খুব ভালোবাসে। এই সংবাদ এখন হীরেমণিকে জানাবেই বা কী করে? রাইমোহনের শোক রূপান্তরিত হলো ক্ৰোধে, সে শহরের সব বড় মানুষের নাম উচ্চারণ করে করে বাপান্ত করতে লাগলো।
তার সেই গালিগালাজেই আকৃষ্ট হলেন দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এখন শহরের নামকরা চিকিৎসক, রুগী দেখে ফিরছিলেন নিজের পালকিতে, মুখ বাড়িয়ে দেখলেন এক কিশোরের শায়িত দেহের পাশে বসে চিল্লাচ্ছে দুজন মাতাল। তিনি ভর্ৎসনা করে বললেন, এই! চুপ করবি, না পুলিসে এত্তেলা পাঠাবো!
দুর্গাচরণ পালকি থেকে নেমে কিশোরটির উপুড় হওয়া দেহটি উল্টে দেখলেন। চন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়নি, মস্তিষ্কে প্ৰচণ্ড আঘাত পেয়ে সে অচৈতন্য হয়ে আছে।
দুর্গাচরণ প্রশ্ন করলেন, একে এমনভাবে কে মেরেছে? তোরাই মারিসনি তো?
রাইমোহন উন্মাদের মতন বললো, একে মেরেচেন আপনি! আর এই চারদিকের বাড়িগুলানে, এ শহরে যত ভদ্দরলোক আচে, তারা সবাই মিলে মেরেচে।
দুর্গাচরণ বললেন, তোরা এখেনে জুটলি কোন চুলো থেকে? শেয়ালকুকুরের মতন অলুক্ষণে কান্না জুড়েচে। এ ছেলেটার চিকিৎসা করালে তো এখনো বেঁচে যাবে। নে, একে পালকিতে তোল!
রাইমোহন তবু তেড়িয়া গলায় বললো, দেখুন মশায়, আগে থেকেই একটা কতা বলে দি। এ কিন্তু বেশ্যার ছেলে। একে ছুঁলে আপনার আবার জাত যাবে না তো?
হরচন্দ্র বললো, হি ইজ এ পিউপিল অব দি হিন্দু কলেজ। হিজ মাদারস নেম ইজ হীরা বুলবুল!
দুর্গাচরণও শহরের এই চাঞ্চল্যকর বৃত্তান্তটি শুনেছেন। এক নিমেষেই তিনি সব বুঝে গেলেন। তিনি বললেন, আমি ডাক্তার, আমি জাত-বিজেত বুঝি না। নে, নে, আর দেরি করিসনি। শিগগির তোল।
দু-দিনের মধ্যেই চন্দ্রনাথ সুস্থ হয়ে উঠলো। তার মাথায় বাঁধা রইল মস্ত বড় ফেটি। সেই অবস্থাতেই চন্দ্ৰনাথ বললো যে সে কলেজে যাবে।
এমন অসম্ভব কথা শুনে হীরেমণি প্রবল আপত্তি তুললেও রাইমোহন বললো, এই তো বাঘের বাচ্চার মতন কতা! কোন যাবে না। নিশ্চয় যাবে। মাতায় অমনি ফেটি বেঁধেই যাবে। সকলকে বলবে, দ্যাক, আমি পরোয়া করি না। আমি নিজে দু-বেলা ওকে দিয়ে আসবো, নিয়ে আসবো। দরকার হলে আমরাও লাঠিয়াল রাকবো। তুই একটা জুড়িগাড়ি কেন তো হীরে। আমি নিজে সেই গাড়ির কোচোয়ানের পাশে বসে থাকবো।
তারপর হরচন্দ্রর দিকে ফিরে বললো, ফের যদি কোনোদিন সন্ধ্যের আগে আমায় মদ ধারাবি তো আমি তোরই মাতা ভাঙবো, হারামজাদা!
রাইমোহনেরই জয় হলো শেষ পর্যন্ত। চন্দ্রনাথের কলেজে যাওয়া আটকাতে পারলো না। এতদিনের হিন্দু কলেজ ভেঙে পড়বার উপক্রম হলো এই এক ধাক্কায়। সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরা সবাই ছেড়ে গেল হিন্দু কলেজ। তালতলার রাজেন্দ্ৰ দত্ত রাতারাতি আর একটি কলেজ খোলার প্রস্তাব তুললেন, তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন অনেকেই। রানী রাসমণি দিলেন দশ হাজার টাকা, আরও অনেকের দানে স্থাপিত হলো হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ, হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত ক্যাপ্টেন রিচার্ডসনকে আনা হলো এই কলেজের অধ্যক্ষ করে। কেশব সেনের মতন ছাত্ররা সবাই যোগ দিল এই নতুন কলেজে।
রাইমোহন সেদিন হীরেমণিকে বললো, আজ শুধু আমার জন্য একটা আলাদা মাইফেল বসাবি, হীরে? আর কেউ আসবে না, শুধু আমার জন্য তুই সাজবি, চোখে সুমা লোগাবি, আমার জন্য জ্বলবে ঝাড় লণ্ঠন। ঘরে মা মা করবে। আতরের গন্ধ। আমি তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসে আলবোলা টানবো চোখ বুজে, তুই আমার হাতে সুরার পাত্তর তুলে দিবি, আর গান গাইবি! হোক না, আজই!
হীরেমণি বললো, মরে যাই, মরে যাই, বাবুর শক কত!
রাইমোহন বললো, দ্যাক আমি শহরের এতগুলান বাবুর থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিলুম, আজ আমার একটু বাবু হতে শক যাবে না? আমার প্রাণ চাইচে।
—অত যদি প্ৰাণ চায় তো রামবাগানে যাও না! মেয়েমানুষের কি অভাব রয়েছে কলকাতায়! ভারী আমার দু পয়সার ফুলবাবু এলেন রে!
—তুই আমায় টাকার খোঁটা দিলি? আমি টাকা রোজগার করি না? তোকে অনেক টাকা দিতে পারি না! দেকবি, আজই। টাকা রোজগার করে আনবো?
—থাক, আবার কোতও চুরি-চামারি করতে যেতে হবে না! কোন দিন রামঠ্যাঙনি খাবে!
—আমি চুরি করি না, আমি বুদ্ধি খাটাই! লোকে আমার বুদ্ধির দাম দেয়।
—হয়েচে! আমি ঢের জানি।
—তুই আমায় অন্য মেয়ের কাচে যেতে বললি? সেই কবে থেকে তোর এখেনে এসে হত্যে দিয়িচি, তারপর আর কোনোদিন আর কোনো মেয়েমানুষের দিকে তাকিয়েচি? তোর মন পাবার জন্যিই তো আমার এত সাধনা। তুই আমার দিকে থাক, তারপর দ্যাক না আমরা দুজনায় মিলে কত কী করি!
হীরেমণি হাই তুলে বললো, সারেঙ্গীওয়ালা এখুনি এসে যাবে, আমার রেওয়াজ করতে হবে, তুমি এখন বিদেয় হও!
রাইমোহন একটুও আহত না হয়ে বললো, লাথি ঝ্যাটা খেয়ে তোর এখেনে পড়ে রয়েচি, তবু এই আমার পরম সুখ। আজ আমি কিচুতেই যাচ্চিনি।
হীরেমণি তাকে আরও কিছু বাক্যবাণে বিঁধলো, তার হাত ধরে টানাটানি করলো, তবু রাইমোহন কোনোক্রমেই নড়লো না। হীরেমণির গান সে অহরহ শোনে, হীরেমণি অধিকাংশ রাতেই তার শয্যাসঙ্গিনী, তবু আজ রাতে সে হীরেমণির বাবু সাজতে চায়।
তার ঝুলোঝুলিতে হীরেমণিকে ধড়াচুড়ো পরতেই হলো। বাজার থেকে ফুলের মালা এনে রাইমোহন সাজালো হীরেমণিকে। সি নিজেও লপেটা ধুতি ও ফিনফিনে কাপড়ের বেনিয়ান পরে, গোঁফে লাগালো আতরের ছোঁয়া। মাথার চুল তেল চপচপে করে চিরুনির দিয়ে সামনে টেনে সাজিয়ে দিল কপালের ওপর। তিরিশটা মোমবাতির নতুন ঝাড় লণ্ঠন বসানো হয়েছে। ঘরে, তার উজ্জ্বল আলোয় বোঝা যায়, রাইমোহনের মুখে এতদিন পরে বয়েসের ছাপ পড়েছে। চুল পাতলা হয়ে এসেছে, মখের চামড়ায় সেই মসৃণতা নেই, চোখের দু পাশে কাকের পায়ের চিহ্ন।
সারেঙ্গীওয়ালাকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। চন্দ্ৰনাথ ঘুমিয়ে পড়বার পর শুরু হলো ওদের একা মজলিস। শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়েছে একটা, দুটি পাত্রে তরল সুরা ঢেলে ঠুকলো একবার, তারপর দুজনে চুমুক দিল।
তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আলবোলার নলটি মুখে দেবার পর সত্যিই যেন আরামে রাইমোহনের চোখ বুজে আসছে। কত রাত্রে এই কক্ষে, এই গালিচার ওপর ঠিক এই ভঙ্গিতে বসেছে শহরের কেষ্ট বিষ্ট্ররা। রাইমোহনকে চোরের মতন লুকিয়ে থাকতে হয়েচে।
রাইমোহন আবেশজড়িত কণ্ঠে বললো, এবার গান গা। সেই যে প্রথম যে গানটা শিখ্যেচিলুম, অনেকদিন আগে, সেই যে রে, তুষিতে তোমারে এ যমুনারই পারে—
গান চললো একটার পর একটা। গানে হীরেমণির ক্লান্তি নেই। আর যত শ্যাস্পেনের মাত্রা বাড়ে, তত রাইমোহনের তারিফও বেশী বেশী হয়। কখনো সে গানের দু-একটা বাণী সংশোধন করে দেয়। রাইমোহনকে দেখে মনে হয় সে আজ সত্যিকারের পরিতৃপ্ত।
রাত্রে এ পল্লী রীতিমতন সরব। গাড়ি ঘোড়া যাতায়াতের বিরাম নেই। এক এক সময় মনে হয় বুঝি কোনো গাড়ি এ বাড়ির দোরগোড়াতেই থামছে। তখন হীরেমণি উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে, গান থেকে মন চলে যায়। আর অন্যমনস্ক গানের সুরের অসঙ্গতি ঠিক ধরা পড়ে রাইমোহনের কানে।
সে ধড়ফড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করে বলে, কেউ এলো?
তারপরই সে চোখ ঘূর্ণিত করে বলে, আজ যদি কেউ আসে, সে যত বড়ই বাবু হোক, আমি তাকে অর্ধচন্দ্ৰ দিয়ে বিদেয় করবো।
তারপর সে হীরেমণিকে কাছে টেনে নিয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করে বলে, ওসব কিচু তুই শুনিসনি। হীরে। মনে কর, আজ পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই, কোনো বাবু নেই, শুধু তুই আচিস আর আমি আচি। আজ শুধু তোর জন্য আমি আর আমার জন্য তুই। আমি গান বাঁধবো, তুই গাইবি। একদিন এসব ছেড়ে ছুঁড়ে তোতে আমাতে বেরিয়ে পড়বো, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে গান গাইবো। তারপর বুঝলি হীরে, ওরকমভাবে গান গাইতে গাইতে দুজনে হাত ধরাধরি করে একদিন স্বৰ্গে চলে যাবো। কেমন? কী, বিশ্বেস হচ্চে না? দেকিস, তুই দেকে নিস, তোর জন্যে আমি স্বর্গেও একটা জায়গা করে দেবো।