৩৬. রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যৌবন প্ৰাপ্তি ও আল্লাহর আশ্রয়

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যৌবন প্ৰাপ্তি ও আল্লাহর আশ্রয়

মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যৌবনে পদার্পণ করলেন। আল্লাহ তাআলা। তার নিরাপত্তা দান করেন এবং জাহিলিয়াতের পংকিলতা থেকে তাকে রক্ষা করেন। এভাবে যখন তিনি বয়ঃপ্ৰাপ্ত হলেন, তখন তিনি ব্যক্তিত্ত্বে সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ, চরিত্রে সর্বাপেক্ষা সুন্দর, বংশ মর্যাদায় সবচাইতে কুলীন, প্রতিবেশী হিসেবে সর্বোত্তম, সহনশীলতায় সর্বশ্রেষ্ঠ, কথা-বার্তায় সর্বাধিক সত্যবাদী, বিশ্বস্ততায় সকলের সেরা এবং অশ্লীলতা ও মন্দ স্বভাব থেকে সর্বাধিক পবিত্র ও মুক্ত। সমাজের মানুষ এখন তাকে একমাত্র আল-আমীন বা বিশ্বাসভাজন বলে সম্বোধন করে।

মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বলেন, মহানবী (সা)-কে আল্লাহ তাআলা যে শৈশবে রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং জাহিলিয়াতের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখেন, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন : একদিন আমি কুরায়শ-এর কয়েকটি কিশোরের সঙ্গে অবস্থান করছিলাম। খেলার ছলে আমরা পাথর কুড়িয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিচ্ছিলাম। আমরা প্রত্যেকে পরনের লুঙ্গি খুলে তা ঘাড়ে রেখে এর ওপর পাথর বহন করছিলাম। আমি ওদের সঙ্গে একবার সামনে যাচ্ছিলাম আবার কখনো পেছনে পড়ছিলাম। এমন সময় অদৃশ্য থেকে কে একজন আমাকে প্রচণ্ড একটি ঘুষি মারলো এবং আমাকে বললো, লুঙ্গিটা পরে নাও। সঙ্গে সঙ্গে আমি লুঙ্গিটি কাঁধ থেকে নিয়ে পরে নিলাম। তারপর পুনরায় খালি কাঁধে পাথর বহন করতে শুরু করলাম। তখন আমার সাথীদের মধ্যে একমাত্র আমিই ছিলাম। লুঙ্গি পরিহিত।

এই ঘটনাটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত কাবা নির্মাণের সময়কার ঘটনার অনুরূপ। সে সময়ে তিনি এবং তার চাচা আব্বাস পাথর বহন করছিলেন। ঘটনাটি যদি সে ঘটনা না হয়ে থাকে তবে এটা ছিল তার পূর্বাভাস স্বরূপ। আল্লাহই ভালো জানেন।

আব্দুর রাযযাক বৰ্ণনা করেন যে, হযরত জাবির ইব্‌নে আব্দুল্লাহ (রা) বলেছেন, কাবা নির্মাণের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) পাথর বহনের কাজে যোগ দেন। দেখে আব্বাস বললেন, লুঙ্গি কাঁধে রেখে পাথর বহন কর। রাসূলুল্লাহ (সা) তা-ই করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং তার চক্ষুদ্বয় আকাশের দিকে নিবদ্ধ হয়। কিছুক্ষণ পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার লুঙ্গি! তখন আব্বাস তাঁকে লুঙ্গি পরিয়ে দেন। এটি বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা।

বায়হাকী ইব্‌নে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, কুরায়শ যখন বায়তুল্লাহ নিৰ্মাণ করে, তখন আব্বাস বায়তুল্লাহর দিকে পাথর বয়ে নিয়ে আসছিলেন। ইব্‌নে আব্বাস বলেন, কুরায়শরা দুজন দুজন করে লোককে জুড়ি বেঁধে দেয়। পুরুষরা পাথর স্থানান্তর করতো আর মহিলারা মশলা বহন করতো। আব্বাস বলেন, আমি এবং আমার ভাতিজাও সেই কাজে শরীক ছিলাম। আমরা লুঙ্গি কাধে রেখে তার উপরে করে পাথর বহন করতাম। কোন লোক আসতে দেখলে লুঙ্গিটা পরে নিতাম। এক পর্যায়ে আমি হাঁটছি। আর মুহাম্মদ আমার সম্মুখে। হঠাৎ তিনি উপুড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমি আমার পাথরগুলো ফেলে দৌড়ে আসলাম। দেখতে পেলাম, মুহাম্মদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী হয়েছে? তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে বললেন,  আমাকে উলংগ চলতে নিষেধ করা হয়েছে। আব্বাস বলেন, মানুষ তাকে পাগল বলবে, এই ভয়ে আমি ঘটনাটা গোপন করে রাখতাম।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত আলী (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলতে শুনেছি, জাহিলী যুগের মানুষ যে সব রীতি-নীতি পালন করত। আমার মনে কখনো তার কোনটি পালন করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়নি। তবে দুই রাতে তেমন কিছু করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আল্লাহ উভয় ঘটনায় আমাকে রক্ষা করেছেন। এক রাতে আমি ছাগলোয় পালের সঙ্গে ছিলাম। আমি আমার সঙ্গী যুবককে বললাম, তুমি আমার ছাগলগুলো দেখ, মক্কায় প্রবেশ করে আমি অন্য যুবকদের মত গল্প-গুজবে অংশগ্ৰহণ করে আসি। সঙ্গীটি বলল, ঠিক আছে, যাও। নবীজি (সা) বলেন, আমি মক্কা প্রবেশ করে প্রথম বাড়িতে পীেছেই বাজনার শব্দ শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এসব কী হচ্ছে? লোকেরা বলল, অমুক অমুককে বিয়ে করেছে। আমি বসে দেখতে শুরু করলাম। আল্লাহ আমাকে নিদ্রায় অচেতন করে দিলেন। আল্লাহর কসম, রৌদ্রের স্পর্শ ছাড়া অন্য কিছু আমাকে সজাগ করতে পারেনি। জাগ্রত হয়ে আমি সঙ্গীর কাছে ফিরে এলাম। সঙ্গীটি জিজ্ঞেস করলো, কী করেছে? আমি বললাম, কিছুই করিনি। তারপর তাকে ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনালাম।

এরপর আরেক রাতে আমি সঙ্গীকে বললাম, তুমি আমার ছাগলগুলো দেখ, আমি একটু গল্প করে আসি। সঙ্গী তাতে সম্মত হলে আমি মক্কা প্ৰবেশ করে আগের রাতের ন্যায় এ রাতেও অনুরূপ বাজনার আওয়াজ শুনতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলে বলা হলো যে, অমুক অমুককে বিয়ে করেছে। আমি বসে দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করে দিলেন। আল্লাহর কসম! রোদ্রের স্পর্শ ছাড়া অন্য কিছু আমাকে জাগ্রত করতে পারেনি। জাগ্রত হয়ে আমি সঙ্গীর নিকট ফিরে গেলাম। সঙ্গী বলল, কী করেছো? আমি বললাম, কিছুই নয়। তারপর আমি তাকে ঘটনার ইতিবৃত্ত শোনালাম। আল্লাহর কসম, এরপর আর কখনো আমি এ ধরনের কাজের ইচ্ছে করিনি। শেষে পর্যন্ত আল্লাহ আমাকে নবুয়তের মর্যাদায় ভূষিত করেন। হাদীসটি অত্যন্ত গরীব পর্যায়ের।

হাফিজ বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত যায়েদ ইব্‌নে হারিছা (রা) বলেছেন, তামার তৈরি একটি দেব মূর্তি ছিল। নাম ছিল তার আসাফ ও নায়েলা। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করার সময় মুশরিকরা তাকে স্পর্শ করত। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেন। আমিও তাঁর সঙ্গে তাওয়াফ করি। উক্ত দেব মূর্তিটি অতিক্রমকালে আমি তাকে স্পর্শ করি। দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ওটা স্পর্শ করো না। যায়েদ ইব্‌নে হারিছা বলেন, তাওয়াফের মধ্যেই আমি মনে মনে বলি, আবারও আমি মূর্তিটি স্পর্শ করব; দেখি কী হয়। আমি পুনরায় ওটা স্পর্শ করলে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাকে নিষেধ করা হয়েছিল না? বায়হাকী বলেন, অপর এক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যায়েদ বলেছেন, যে সত্তা তাকে সম্মানিত করেছেন এবং তার ওপর কিতাব অবতারণ করেছেন, আমি তার শপথ করে বলছি, তিনি কখনো কোন মূর্তি স্পর্শ করেননি। এ অবস্থায়ই মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন এবং তাঁর ওপর কিতাব নাযিল করেন।

তা ছাড়া উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, বাহীরা যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে লাত ও উন্যযার নামে শপথ করে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, এদের দোহাই দিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ! আমার নিকট এদের চাইতে ঘৃণার পাত্র দ্বিতীয়টি আর নেই।

হাফিজ আবু বকর বায়হাকী অপর এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত জাবির ইব্‌নে আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মুশরিকদের সঙ্গে তাদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। একদিন তিনি শুনতে পেলেন যে, তাঁর পিছনে দুই ফেরেশতা। তাদের একজন অপরজনকে বলছেন, চল, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। সঙ্গীটি বললেন, আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়াই কী করে; তিনি যে মূর্তি চুম্বনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। রাবী জাবির বলেন, এরপর কখনো নবীজী (সা) মুশরিকদের সঙ্গে তাদের আচার- অনুষ্ঠানে যোগ দেননি।

বলা বাহুল্য যে, আলোচ্য হাদীসটি বিতর্কিত। উক্ত হাদীসের একজন রাবী উসমান ইব্‌নে আবু শায়বার ব্যাপারে একাধিক ইমাম আপত্তি উত্থাপন করেছেন। এমনকি ইমাম আহমদ বলেছেন, তার ভাই এ হাদীসের একটি বর্ণও উচ্চারণ করতেন না।

ইমাম বায়হাকী কারো কারো থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এ হাদীসের মর্ম হলো যারা দেব মূর্তি চুম্বন করত, নবী করীম (সা) তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আর এ ঘটনাটি নবী করীম (সা)-এর প্রতি ওহী অবতরণের পূর্বের। আল্লাহই ভালো জানেন। যায়েদ ইব্‌নে হারিছার হাদীসে তো বলা হয়েছে যে, নবুওতের মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার আগে কখনো নবীজী (সা) মুশরিকদের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আরাফার রাতে মুযদালিফায় অবস্থান করতেন না। বরং লোকদের সঙ্গে আরাফাতেই অবস্থান

(রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্য থেকে কেবল তাকেই আরাফাতে উটের ওপর অবস্থানরত দেখেছি। তিনি তখনো নিজ সম্প্রদায়ের দীনের অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তাকে তাওহঁকীক দিয়েছিলেন বলেই এমনটি হয়েছে।

বায়হাকী বলেন, নিজ সম্প্রদায়ের দীন কথাটার অর্থ হলো ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর দীনের অবশিষ্টাংশ। অন্যথায় নবী করীম (সা) জীবনে কখনো শিরক করেননি।

আমার মতে উপরের বর্ণনায় একথাও বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রতি ওহী অবতারণের পূর্বেও আরাফায় অবস্থান করতেন। আল্লাহ তাওফীক দিয়েছিলেন বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে। ইমাম আহমদ ও ইয়াকুব মহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তার ভাষা হন্ত্রো ৪ আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তার প্রতি ওহী অবতারণের পূর্বে লোকদের সঙ্গে আরাফায় উটের পিঠে অবস্থানরত দেখেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের সাথেই ফিরতেন। আল্লাহ তাকে এর তওফীক দিয়েছিলেন।

হযরত জুবায়র ইব্‌নে মুতইম সূত্রে ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, একদিন আরাফায় আমার উট হারিয়ে ফেলি। আমি তার খোজে বের হলাম। হঠাৎ দেখি, নবী করীম (সা) দাড়িয়ে আছেন। মনে মনে বললাম, ইনি তো হুমস* গোত্রের মানুষ। এখানে কেন ইনি?

ফিজর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উপস্থিতি ইব্‌নে ইসহাক বলেন, ফিজর যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছে, প্লাসূলুল্লাহ (সা) তখন কুড়ি বছরের যুবক। উল্লেখ্য যে, কিনানা এবং আয়লানের কায়স পরস্পর ব্যক্তি সম্পৰ্কীয় এই দুটি গোত্ৰ নিষিদ্ধ সময়ে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে এ যুদ্ধকে ফিজর যুদ্ধ বা সীমালংঘন যুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধে কুরায়শ ও কিনানার নেতৃত্বে ছিলেন হারব ইব্‌নে উমাইয়া ইব্‌নে আবদে শামস। দিনের প্রথম ভাগে কায়স গোত্র কিনানার ওপর জয়লাভ করেছিল। দিনের মাঝামাঝিতে এসে বিজয় কিনানা গোত্রের হাতে চলে আসে।

ইব্‌নে হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সে উপনীত হন, তখন সহযোগী। কিনানাসহ কুরায়শ এবং আয়লানের কায়স-এর মধ্যে ফিজর যুদ্ধ শুরু হয়।

ঘটনার পটভূমি নিম্নরূপ : উরওয়া আর রিহাল (ইব্‌ন উতবা ইব্‌ন জাফর ইব্‌ন কিলাব ইব্‌ন রবীয়া ইব্‌ন আমির ছাছাআ ইব্‌ন মুআবিয়া ইব্‌ন বকর ইব্‌ন হাওয়াযিন) নুমান ইব্‌নে মুনযিারকে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়। এ খবর শুনে বনু যামুরা (ইব্‌ন বকর ইব্‌ন আবদে মানাত ইব্‌ন কিন্যানা) গোত্রের বারায। ইব্‌নে কায়স বলে, কিনানার স্বাৰ্থ নষ্ট করে তুমি নুমানকে ব্যবসা করার অনুমতি দিলে? উরওয়া আর রিহাল বলল, হ্যাঁ, দিয়েছি সকলের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলেও। এ কথার পর উরওয়া আর রিহাঁল চলে যায়। বারাযও প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে সুযোগের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। মক্কার উচু অঞ্চলের খী-তিলাল নামক স্থানের দক্ষিণে পেঁৗছে উরওয়া অসতর্ক হয়ে পড়ে। সুযোগ বুঝে বারাষ। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে হত্যা করে ফেলে। ঘটনাটি ঘটে নিষিদ্ধ মাসে। এ কারণে তা ফিজার নামে আখ্যায়িত হয়। এ ব্যাপারে গর্ব প্ৰকাশ করে বারায। কবিতার কয়েকটি পংক্তিও আওড়ায়। উরওয়ার এ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লবীদ ইব্‌ন রবীয়াও কযেকটি পংক্তি রচনা করেন।

ইব্‌নে হিশাম বলেন, এরপর জনৈক ব্যক্তি কুরায়শের নিকট এসে সংবাদ দিল যে, বারায। উরওয়াকে খুন করে ফেলেছে। তা-ও আবার নিষিদ্ধ মাসে, উকায মেলার স্থানে। অতএব তোমরা হাওয়াযিন গোত্র যাতে টের না পায় সেভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও। কিন্তু এর

১. হুমাস বলতে কুরায়শ গোত্ৰ বোঝানো হতো। হুমস মানে দৃঢ়তা 1 তারা দীনের ব্যাপারে অনড়-অবিচল থাকতো বলে তাদেরকে হুমাস বলা হতো

মধ্যে হাওয়াযিন ঘটনাটি জেনে ফেলে। তারা কুরায়শদের ধাওয়া করে। কুরায়শরা হারামে প্ৰবেশ করার পূর্বেই হাওয়াযিনরা তাদেরকে নাগালে পেয়ে যায়। তখন সংঘর্ষ শুরু হয়। সারা দিন যুদ্ধশেষে রাতের বেলা কুরায়শরা হারামে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। ফলে হাওয়াযিনীরা নিবৃত্ত হয়। পরদিন আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষ কয়েকদিন অব্যাহত থাকে। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোক তাদের নেতাদের ওপর পূর্ণ নির্ভর করে।

কুরায়শ ও কিনানার সব কটি গোত্রের নেতৃত্ব একজনের হাতে ছিল। আর কায়স-এর সবগুলো গোত্রের নেতৃত্ব অপর একজনের হাতে ছিল। বৰ্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক দিন এ যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছিলেন। তার চাচারা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে বলেছেন :

আমি শক্ৰদের নিক্ষিপ্ত তীর কুড়িয়ে চাচাদের হাতে তুলে দিতাম।

ইব্‌নে হিশাম বলেন, ফিজারের যুদ্ধ দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলেছিল। তা আমার উল্লেখিত বর্ণনার চাইতেও দীর্ঘতর ছিল। সীরাত সম্পর্কিত আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক বলে এখানে তা উল্লেখ করা হলো না।

সুহায়লী বলেন, আরবে ফিজার সংঘটিত হয়েছিল চারটি। মাসউদী এ যুদ্ধগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। এ যুদ্ধগুলোর সর্ব শেষটি হলো এই ফিজারুল বারায। ফিজারুল বারাযের যুদ্ধ হয়েছে চার দিন। (তখনকার দিনের নাম অনুসারে) ১. শামতা ২. আবলা। এ দুদিনের লড়াই হয়েছে। উকায-এর নিকট। ৩. আশ শুরব। চারদিনের মধ্যে এ দিনের যুদ্ধই বেশি। গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ দিনে রাসূলুল্লাহ (সা) উপস্থিত ছিলেন। এ দিনে কুরায়শ ও বনু কিনানার দুই নেতা হারুব ইব্‌ন উমাইয়াএবং তার ভাই সুফিয়ান নিজেরা নিজেদেরকে শিকলে আটকে রাখে, যাতে বাহিনীর যোদ্ধারা পালিয়ে না যায়। এই দিনে কায়স গোত্র পালিয়ে যায়। তবে বনু নাযার নিজেদের অবস্থায় অটল থাকে। ৪. হারীরা। এই দিনের যুদ্ধ হয়েছিল নাখলার নিকট। তারপর বিবদমান উভয় পক্ষ আগামী বছর উকায্যের নিকট যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। নির্দিষ্ট সময়ে তারা অঙ্গীকার পালনে লিপ্ত হলে উতবা ইব্‌নে রবীয়া উটে সওয়ার হয়ে ডাক দিয়ে বলে, ওহে মুযার সম্প্রদায়! কোন যুক্তিতে তোমরা লড়াই করছি? জবাবে হাওয়াযিনরা বলল, আপনি কী প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, বলুন। উতবা বলল, আমি সন্ধি করতে চাই। তারা বলল, সন্ধি কি শর্তে হবে বলুন। উতবা ইব্‌নে রবীয়া বললঃ আমাদের হাতে তোমাদের যে সব লোক নিহত হয়েছে, আমরা তোমাদেরকে তাদের রক্তপণ পরিশোধ করব। তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সম্পদ তোমাদের কাছে বন্ধক রাখব। আর তোমাদের নিকট আমরা যে রক্তপণ পাওনা আছি, তা মাফ করে দেব। শুনে হাওয়াযিনীরা বলল, এই চুক্তির দায়িত্ব কে নেবে? উতবা বলল, আমি। হাওয়াযিনীরা বলল, আপনি কে? উতবা বলল, আমি উতবা ইব্‌নে রবীয়া। অবশেষে উক্ত প্ৰস্তাব অনুযায়ী সন্ধি স্থাপিত হয় এবং যুদ্ধরত লোকদের নিকট চল্লিশ ব্যক্তিকে প্রেরণ করা হয়। হাকীম ইব্‌নে হিযাম (রা) তাদের একজন ছিলেন। যখন বনু আমির ইব্‌নে ছছআ দেখল যে, বন্ধক তাদের হাতে এসে গেছে, তখন তারা তাদের রক্তপণের দাবি ত্যাগ করে এবং এভাবে ফিজর যুদ্ধের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক উমাবী ফিজার-এর যুদ্ধসমূহ এবং তার দিন-ক্ষণ সম্পর্কে আছরাম সূত্রে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। আছরাম হলেন মুগীরা ইব্‌নে আলী। মুগীরা আবু উবায়দা মামার ইব্‌নে মুছান্না থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

অধ্যায়।

হাফিজ বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, জুবোয়র ইব্‌নে মুতইম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি আমার চাচাদের সঙ্গে হিলফুল মুতায়্যিদ্বীনে উপস্থিত ছিলাম। এখন আমি তা ভঙ্গ করা পছন্দ করি না; বিনিময়ে বহমূল্য লাল উট দিলেও নয়।

হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে আছে : রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, হিলফুল মুতায়্যিদ্বীন ছাড়া আমি কুরায়শদের কোন চুক্তিতে উপস্থিত ছিলাম না। এখন বিনিময়ে আমাকে লাল উট দেয়া হলেও আমি তা ভঙ্গ করা পছন্দ করি না। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, মুতায়্যিদ্বীন বলতে বোঝানো হয়েছে হাশিম, উমাইয়া, যুহরী ও মািখযুমকে। বায়হাকী বলেন, হাদীসের এই ব্যাখ্যাটি মুদরাজ বা রাবীর বাড়তি বর্ণনা। এ রাবীর পরিচয়ও অজ্ঞাত। কোন কোন সীরাত বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এখানে হিলফুল মুতায়্যিদ্বীন বলতে হিলফুল ফুযুল বোঝান হয়েছে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা) হিলফুল মুতায়্যিদ্বীন-এর সময়কাল পাননি।

আমার মতে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তার কারণ কুরায়শরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিল কুসাই-এর মৃত্যুর পর। কুসাই কর্তৃক তাঁর পুত্র আব্দুন্দারকে সিকায়া, রিফাদা, লিওয়া, নাদওয়া ও হিজাবার দায়িত্ব প্ৰদানকে কেন্দ্র করে বিরোধ ছিল। এই সিদ্ধান্তে বনু আবদে মানাফের আপত্তি ছিল। কুরায়শের সকল গোত্র এ ব্যাপারে সোচ্চার হয় এবং নিজ নিজ পক্ষের সহযোগিতা করার ব্যাপারে পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এ খবর শুনে আবদে মানাফের গোত্রের লোেকরা একটি পাত্রে সুগন্ধি রেখে তাতে হাত রেখে তারাও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। বৈঠক থেকে উঠে তারা বায়তুল্লাহর খুঁটিতে হাত মুছে। এ কারণে তাদেরকে মুতায়্যিদ্বীন বা সুগন্ধিওয়ালা নাম দেয়া হয়। এ ঘটনাটি প্রাচীন আমলের। কাজেই প্রমাণিত হয় যে, আলোচ্য অঙ্গীকার দ্বারা হিলফুল ফুযুল বোঝানো হয়েছে। হিলফুল ফুযুল সম্পাদিত হয়েছিল আব্দুল্লাহ ইব্‌ন জাদ আনের ঘরে। যেমন হুমায়াদী বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আমি আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদ আনের ঘরে একটি অঙ্গীকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলাম। ইসলামের যুগেও যদি আমাকে তেমন অঙ্গীকারের প্রতি আহবান করা হতো, আমি তাতে সাড়া দিতাম। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ তাতে নগরবাসীর ওপর অত্যাচার ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার শপথ নিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, হিলফুল ফুযুল সম্পাদিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুয়ত লাভের কুড়ি বছর আগে যুলকাদা মাসে, ফিজর যুদ্ধের চার মাস পরে। ফিজার সংঘটিত হয়েছিল একই বছরের শাবান মাসে।

হিলফুল ফুযুল ছিল আরবের ইতিহাসে সবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শপথ। এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম যিনি মুখ খুলেন এবং যিনি এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তিনি হলেন যুবোয়র ইব্‌নে আব্দুল মুত্তালিব।

যে পটভূমির ওপর ভিত্তি করে এই অঙ্গীকার সম্পাদিত হয়েছিল, তা হলো এই :

যাবীদ গোত্রের এক ব্যক্তি কিছু ব্যবসা পণ্য নিয়ে মক্কা আসে। আস ইব্‌নে ওয়ায়িল তার থেকে কিছু সওদা ক্রয় করে। কিন্তু পরে সে তার মূল্য পরিশোধ করতে অস্বীকার করে। অগত্যা যাবীদী তার পাওনা আদায় করার জন্য আহলাফ তথা আব্দুদার, মাখিযুম, জামহ, সাহিম ও আদী ইব্‌নে কাব-এর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু তারা আস ইব্‌নে ওয়ায়িল-এর বিপক্ষে তাকেসাহায্য করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় এবং তাকে শাসিয়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে যাবীদী ভোরে আবু কুবায়স পর্বতে আরোহণ করে উচ্চ স্বরে কাব্যাকারে তার অত্যাচারিত হওয়ার কথা প্রচার করে। কুরায়শরা তখন কাবা চত্বরে আলাপ-আলোচনায় রত। যুবোয়র ইব্‌নে আব্দুল মুত্তালিব বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন এবং বলেন, ঘটনাটিকে এভাবে উপেক্ষা করা যায় না। এর একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এবার হাশিম, যুহরা ও তাইম ইব্‌নে মুরা আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদ আন-এর বাড়িতে সমবেত হন। আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদ আন মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। এ বৈঠকে যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস যুলকাদায় তারা আল্লাহর নামে এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন যে, তারা অত্যাচারিতের পক্ষে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে, যাতে করে জালিম মজলুমের পাওনা আদায় করতে বাধ্যু হয়। যতদিন পর্যন্ত সমুদ্রে ঢেউ উত্থিত হবে, যতদিন পর্যন্ত হেরা ও ছাবীর পর্বতদ্বয় আপন স্থানে স্থির থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের এই অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে। আর জীবন যাত্রায় আমরা একে অপরের সাহায্য করব। কুরায়শরা এই অঙ্গীকারকে হিলফুল ফুযুল নামে নামকরণ করে এবং বলে, এরা একটি মহত কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। তারপর এই যুবকরা আস ইব্‌নে ওয়ায়িল-এর নিকট গিয়ে তার থেকে যাবীদীর পণ্য উদ্ধার করে তাকে ফেরত দেন। যুবোয়র ইব্‌নে আব্দুল মুত্তালিব এ ব্যাপারে বলেন :

কয়েক মহান ব্যক্তি এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে যে, মক্কার বুকে কোনো জালিম পা রাখতে পারবে না; নগরবাসী বিদেশী সকলেই এখানে নিরাপদে অবস্থান করবে।

একটি গরীব পর্যায়ের হাদীসে কাসিম ইব্‌নে ছবিত উল্লেখ করেন, কাছ আম গোত্রের এক ব্যক্তি হজ্জ কিংবা উমরাহ উপলক্ষে মক্কায় আগমন করে। তার একটি কন্যা তার সঙ্গে ছিল। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত রূপসী এবং তার নাম ছিল কাতুল। নাবীহ ইব্‌ন হাজ্জাজ মেয়েটিকে পিতার নিকট হতে অপহরণ করে নিয়ে লুকিয়ে রাখে। ফলে কাছআমী লোকটি তার মেয়েকে উদ্ধারের ফরিয়াদ জানায়। তাকে তখন বলা হলো, তুমি হিলফুল ফুযুল যুবসংঘের শরণাপন্ন হও। লোকটি কাবার নিকটে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, হিলফুল ফুযুল-এর সদস্যগণ কে কোথায় আছেন? সঙ্গে সঙ্গে হিলফুল ফুযুল-এর কমীগণ কোষমুক্ত তরবারি হাতে চতুর্দিক হতে ছুটে আসেন এবং বলেন, তোমার সাহায্যকারীরা হাজির; তোমার কী হয়েছে? লোকটি বলল, নাবীহ আমার কন্যার ব্যাপারে আমার প্রতি জুলুম করেছে। আমার কন্যাকে সে জোর করে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। অভিযোগ শুনে তারা লোকটিকে নিয়ে নাবীহ-এর গৃহের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হন। নাবীহ বেরিয়ে আসলে তারা বলেন, হতভাগা কোথাকার! মেয়েটিকে নিয়ে আয়। তুই তো জনিস আমরা কারা, কি কাজের শপথ নিয়েছি। আমরা! নাবীহ বলল, ঠিক আছে, তা-ই করছি, তবে আমাকে একটি মাত্র রাতের অবকাশ দিন। তারা বললেন, না, আল্লাহর শপথ! কিছুতেই তা হতে পারে না। অগত্যা নাবীহ মেয়েটিকে তাঁদের হাতে অৰ্পণ করে। তখন সে আক্ষেপের সহিত কয়েকটি পংক্তি উচ্চারণ করে।

জুরহুম গোত্র জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের সহায়তা দান বিষয়ক একটি অঙ্গীকার নিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, আলোচ্য অঙ্গীকারও জুরহুমের সেই অঙ্গীকারের অনুরূপ বলে একে হিলফুল ফুযুল নামে নামকরণ করা হয়েছে। যে তিন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উদ্যোগে

ফুযালা। ২. ফাযিল ইব্‌নে ওয়াদা আহ। ৩. ফাযল ইব্‌নে হারিছ। এটা ইব্‌নে কুতায়বার বক্তব্য। অন্যদের মতে তিনজনের নাম হলো, ১, ফাযল ইব্‌ন শুরাআ ২, ফাযল ইব্‌নে বুযাআ ৩. ফাযিল ইব্‌ন কুযাআ। এটি সুহায়লীর বর্ণনা।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বলেন : কুরায়শের কয়েকটি গোত্র পরস্পর হলফ গ্রহণের আহবান জানায়। এ উদ্দেশ্যে তারা মক্কার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও প্ৰবীণ ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদ আনের ঘরে সমবেত হন। সেদিনকার সেই বৈঠকে বনু হাশিম, বনু আব্দুল মুত্তালিব, বনু আসাদ ইব্‌নে আব্দুল উযযা, যুহরী ইব্‌ন কিলাব এবং তায়ম ইব্‌ন মুররা পরস্পর এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন যে, মক্কার বাসিন্দা হোক কিংবা ভিন দেশের লোক হোক, যখনই কেউ অন্যের হাতে নির্যাতনের শিকার হবে, তারা তার সর্বাত্মক সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। জুলুমের প্রতিকার না করা পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হবেন না। কুরায়শরা এই অঙ্গীকারকে হিলফুল ফুযুল নামে অভিহিত করে।

আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আউফ যুহরী বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :

আমি আব্দুল্লাহ ইব্‌ন জাদআনের ঘরে এক অঙ্গীকার সভায় উপস্থিত ছিলাম। সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করার বিনিময়ে যদি আমাকে লাল উটও দেয়া হয় তবু আমি তাতে সম্মত হব না। আর ইসলামের আমলেও যদি তার প্রতি আহবান করা হতো আমি তাতে সাড়া দিতাম।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন : মুহাম্মদ ইব্‌ন ইবরাহীম ইব্‌ন হারিছ আত-তায়মী বৰ্ণনা করেন যে, হুসায়ন ইব্‌ন আলী (রা) ও ওলীদ ইব্‌নে উতবা ইব্‌নে আবু সুফিয়ান-এর মধ্যে যুল-মারওয়ার কিছু সম্পদ নিয়ে বিবাদ ছিল। ওলীদ তখন মদীনার গভর্নর। তার চাচা মুআবিয়া ইব্‌নে আবু সুফিয়ান তাকে মদীনার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। ক্ষমতার বলে ওলীদ পাওনা আদায়ে হুসায়ন (রা)-এর ওপর অবিচার করেন। তখন হুসায়ন (রা) বললেন, আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আপনি হয় আমার প্রতি সুবিচার করবেন,অন্যথায় তরবারি হাতে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মসজিদে দাঁড়িয়ে হিলফুল ফুযুল-এর কমীদের আহবান করব। আব্দুল্লাহ ইব্‌ন যুবোয়র তখন ওলীদের নিকট উপস্থিত ছিলেন। হুসায়ন (রা)-এর কথা শুনে তিনি বললেন, আমিও আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি। হুসায়ন যদি এরূপ আহবান জানান তাহলে আমিও আমার তরবারি হাতে তার পাশে এসে দাড়াব। হয় তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবেন, অন্যথায় আমরা একত্রে জীবন দেব।

বর্ণনাকারী বলেন, এ সংবাদ মিসওয়ার ইব্‌নে মাখরামার নিকট পৌছলে তিনিও একই কথা বলেন। আব্দুর রহমান ইব্‌ন উছমান ইব্‌ন উবায়েদুল্লাহ আততায়মীও অভিন্ন উক্তি করেন। ওলীদ ইব্‌নে উতবা সব খবর পেয়ে অবশেষে হুসায়ন (রা)-কে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেন। তাতে হুসায়ন (রা) সন্তুষ্ট হয়ে যান।

নবীজী (সা)-এর সাথে খাদীজা বিনতে খুওয়ায়লিদের বিবাহ

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, খাদীজা বিনত খুওয়ায়ালিদ একজন সন্ত্রান্ত ব্যবসায়ী মহিলা ছিলেন। লাভে অংশীদারিত্বের চুক্তিতে পুরুষদেরকে তিনি তাঁর ব্যবসায় নিয়োগ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও সচ্চরিত্রতার কথা জানতে পেরে তিনি তার নিকট প্রস্তাব পাঠালেন, যেন তিনি ব্যবসায় পণ্য নিয়ে সিরিয়া সফর করেন। বিনিময়ে তিনি তাকে অন্যদের তুলনায় অধিক মুনাফা প্রদানের প্রস্তাব করেন। সঙ্গে থাকবে খাদীজার গোলাম মায়সারা। রাসূলুল্লাহ (সা) খাদীজার এই প্রস্তাবে সম্মত হন এবং পণ্যসামগ্ৰী নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হন। তাঁর সঙ্গে খাদীজার গোলাম মায়সারাও রওয়ানা হন। সিরিয়া পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা) জনৈক পদীর গির্জার নিকট একটি গাছের ছায়ায় অবস্থান গ্ৰহণ করেন। পট্ৰী মায়সারাকে

হারমবাসী কুরায়শী বংশের এক ব্যক্তি। পাদ্রী বললেন, এ যাবত এই গাছের নিচে নবী ব্যতীত কেউ অবতরণ করেনি। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিয়ে আসা ব্যবসা-পণ্য বিক্রি করলেন এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তাঁর পছন্দমত অন্য মাল ক্ৰয় করলেন। এরপর মায়সারাকে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, মায়সারা লক্ষ্য করেন যে, সূর্যের তাপ প্রখর হওয়ার সাথে সাথে দুজন ফেরেশতা মুহাম্মদ (সা)-কে ছায়া প্ৰদান করছেন। তখন তিনি উটের পিঠে চড়ে এগিয়ে চলছিলেন। মক্কায় এসে খাদীজাকে তিনি তাঁর পণ্য বুঝিয়ে দেন। খাদীজা দ্বিগুণ বা প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে তা বিক্রি করেন। মায়সারা খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্যর কথা এবং নবীজী (সা)-কে দুই ফেরেশতার ছায়াদানের কথা ব্যক্ত করেন। আর খাদীজা ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা, সন্ত্রান্ত ও বুদ্ধিমতী মহিলা।

মায়সারা ঘটনার ইতিবৃত্ত শুনালে খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ডেকে পাঠালেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, হযরত খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলেন, চাচাতো ভাই! আপনার সুখ্যাতি, আপনার বিশ্বস্ততা, আপনার উত্তম চরিত্র, সত্যবাদিত-এ সবের কারণে আমি আপনার প্রতি আকৃষ্ট। তারপর তিনি সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন। উল্লেখ্য যে, খাদীজা (রা) কুরায়শ মহিলাদের মধ্যে বংশগতভাবে অতিশয় সন্ত্রান্ত, মর্যাদায় সকলের সেরা ও শ্রেষ্ঠ বিত্তবতী মহিলা ছিলেন। তাঁর সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই সুযোগ সাপেক্ষে তার প্রতি লালায়িত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) বিষয়টি তার চাচাদের গোচরে দেন। শুনে চাচা হামযা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিয়ে খুওয়াইলিদ ইব্‌নে আসাদ-এর নিকট গমন করেন। খুওয়াইলিদ-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর খাদীজার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিবাহ সম্পাদন করেন।

ইব্‌নে হিশাম বলেন : মাহর হিসাবে তাকে তিনি বিশটি উট প্রদান করেন। এটিই ছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রথম বিবাহ। খাদীজা (রা)-এর মৃত্যু পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা) আর কোন বিবাহ করেন নি।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন : ইবরাহীম ব্যতীত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সকল সন্তান খাদীজার গর্ভেই জন্ম লাভ করেন। তাঁরা হলেন, ১. কাসিম। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবুল কাসিম উপনামটি এই কাসিম-এর নামেই ছিল। ২ তায়্যিােব ৩, তাহির ৪. যায়নাব, ৫. রুকাইয়া ৬. উন্মে কুলসুম। ৭. ফাতিমা (রাযিয়া আল্লাহু তাআলা আনহুম আজমায়ীন)।

ইব্‌নে হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পুত্রদের মধ্যে কাসিম ছিলেন সকলের বড়। তারপর তায়্যিাব। তারপর তাহির। আর কন্যাদের মধ্যে বড় হলেন, রুকাইয়া। তারপর যায়নাব, তারপর উম্মে কুলসুম, তারপর ফাতিমা (রা)।

উল্লেখ আছে যে, মুসআব ইব্‌নে আব্দুল্লাহ যুবায়রী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম কাসিম, তারপর যায়নাব, তারপর আব্দুল্লাহ, তারপর উম্মে কুলসূম, তারপর আব্দুল্লাহ। তারপর ফাতিমা। তারপর রুকাইয়া। আর তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইনতিকাল করেন। কাসিম। তারপর আব্দুল্লাহ। আর খাদীজা (রা) আয়ু পেয়েছিলেন পয়ষট্টি বছর। মতান্তরে পঞ্চাশ বছর। এ অভিমতটিই বিশুদ্ধতর। অন্যদের মতে কাসিম বাহনে আরোহণের উপযুক্ত এবং বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত লাভের পর মারা যান। কেউ কেউ বলেন, কাসিম যখন মারা যান তখন তিনি দুগ্ধপোষ্য শিশু। তাঁর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ ওর জন্য জন্নাতে স্তন্যদাত্রী রাখা আছে। সে তার দুধ পানের মেয়াদ পূর্ণ করবে। তবে প্রসিদ্ধ মতে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর এ উক্তিটি ছিল ইবরাহীম সম্পর্কে।

ইউনুস ইব্‌ন বুকায়রা. ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, খাদীজার গর্ভে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুই পুত্ৰ সন্তান এবং চার কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। ১. কাসিম ২. আব্দুল্লাহ, ৩. ফাতিমা ৪. উম্মে কুলসুম। ৫. যায়নাব ৬. রুকাইয়া। যুবোয়র ইব্‌নে বাক্কার বলেন, আব্দুল্লাহ তায়্যিাব ও তাহিরও বলা হতো। কারণ তিনি হযরতের নবুয়ত প্ৰাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন।

যাহোক, নবী করীম (সা)-এর অন্য পুত্ৰগণ তাঁর নবুওত লাভের আগেই মারা যায়। অবশ্য কন্যাগণ নবুওতের যুগ লাভ করেন। তারা ইসলাম কবুল করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে হিজরত করেন। ইব্‌নে হিশাম বলেন, ইবরাহীম-এর জন্ম মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে।

আলেকজান্দ্ৰিয়া-অধিপতি মুকাওকিস মারিয়াকে রাসূল (সা)-এর খেদমতে উপহাররূপে পাঠিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সকল সহধর্মিনী ও সন্তানগণের ব্যাপারে আমরা ইনশাআল্লাহ স্বতন্ত্রভাবে সীরাত অধ্যায়ের শেষে আলোকপাত করব।

ইব্‌নে হিশাম বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন খাদীজা (রা)-কে বিবাহ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। একাধিক আলিম আমার নিকট এরূপ বর্ণনা দিয়েছেন। তন্মধ্যে আবু আমার আল- মাদানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইয়াকুব ইব্‌ন সুফিয়ান এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমর ইব্‌ন আসাদ যখন খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। কুরায়শরা তখন কাবা নির্মাণ করছে।

অনুরূপভাবে বায়হাকী হাকিম থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন খাদীজা (রা)-কে বিবাহ করেন, তখন তাঁর বয়ষ ছিল পঁচিশ বছর। আর খাদীজার বয়স তখন পয়ত্রিশ, মতান্তরে পচিশ।

খাদীজাকে বিবাহ করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পেশা হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :

ما بعث الله نبیا الاً راعی غنم আল্লাহ এমন কোন নবী প্রেরণ করেন নি, যিনি ছাগল চরান নি।

এ কথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিও? নবী করীম (সা) বললেন : হ্যাঁ আমিও কয়েকটি মুদ্রা (কীরােত)-এর বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরিয়েছি। আর কারো কারো মতে এর অর্থ কারারাত নামক স্থানে বকরী চরিয়েছি। ইমাম বুখারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বায়হাকী রবী ইব্‌নে বদর, আবুয যুবোয়র ও জাবির (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, একটি জোয়ান উটনীর বিনিময়ে দুইটি সফরে আমি খাদীজার জন্য শ্রম দিয়েছি।

ইমাম বায়হাকী (র) অপর এক সূত্রে ইব্‌নে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, খাদীজার পিতা খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেওয়াকালে যতদূর মনে হয় নেশাগ্ৰস্ত ছিলেন।

ইমাম বায়হাকী অপর এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত আম্মার ইব্‌নে ইয়াসির যখনই লোকদেরকে রাসূল (সা)-এর খাদীজাকে বিবাহ করা সংক্রান্ত আলোচনা করতে শুনতেন, তখন বলতেন, রাসূল (সা)-এর খাদীজাকে বিবাহ করার বিষয়টি আমি সবচেয়ে ভালো জানি। আমি রাসূল (সা)-এর সমবয়সী ও অন্তরঙ্গ সঙ্গী ছিলাম। একদিন আমি তাঁর সঙ্গে বের হই। হায্যওয়ারা নামক স্থানে পৌছে আমরা দেখতে পেলাম যে, খাদীজার এক বোন বসে চামড়া বিক্রি করছেন। দেখে তিনি আমাকে নিকটে ডাকেন। আমি তার নিকটে ফিরে যাই আর রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে আমার অপেক্ষায় থাকেন। খাদীজার বোনটি আমাকে বললেন, আচ্ছা! তোমার এই সঙ্গী কি খাদীজাকে বিবাহ করতে আগ্রহী নয়? আম্মার (রা) বলেন, একথার কোন জবাব না দিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট গিয়ে তাকে বিষয়টি অবহিত করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, অবশ্যই আগ্রহী। খাদীজার বোনকে রাসূল (সা)-এর এ কথাটি জানালে তিনি বললেন, আগামীকাল সকালে আপনারা আমাদের বাড়িতে আসুন। আমরা পরদিন সকালে খাদীজার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখতে পেলাম যে, তারা একটি গরু জবাই করেছেন এবং খাদীজার পিতাকে উত্তম জামা-কাপড় পরিয়ে রেখেছেন। তখন তার দাড়িতে খেজাব মেখে রেখেছিলেন। আমি খাদীজার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি তার পিতার সঙ্গে আলাপ করলেন। খাদীজার পিতা তখন মদপান করে নেশাগ্ৰস্ত ছিলেন। খাদীজার ভাই তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং খাদীজাকে তার নিকট বিবাহ দেওয়ার কথা প্ৰস্তাব করেন। তিনি তাতে সম্মতি দেন এবং তাকে বিবাহ দিয়ে দেন। তারা গরুর গোশত রান্না করে তাদের আপ্যায়নের আয়োজন করেন। আমারুখ খাওয়া-দাওয়া করি।

এর মধ্যে খাদীজার পিতা ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে এই বলে চিৎকার করে ওঠেন যে, আমার গায়ে এ সব কিসের পোশাক? দাড়িতে এসব কিসের খেজাব? এ খানাপিনা কিসের? জবাবে তার যে কন্যা আম্মারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তিনি বললেন, আপনার জামাতা মুহাম্মদ ইব্‌নে আব্দুল্লাহ। আপনাকে এই পোশাক পরিয়েছেন। আর এই গাভীটি আপনার জন্য হাদিয়া এসেছিল; খাদীজার বিয়ে উপলক্ষে একে আমরা যাবাই করেছি। কিন্তু তিনি খাদীজাকে মুহাম্মদ ইব্‌নে আব্দুল্লাহর নিকট বিয়ে দেওয়ার কথা অস্বীকার করে বসেন এবং উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে হিজারে ইসমাঈল তথা হাতীমে চলে আসেন। হাশিম গোত্রীয় লোকেরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং খাদীজার পিতার সঙ্গে কথা বলেন। খাদীজার পিতা বললেন, তোমাদের যে লোকটির নিকট আমি খাদীজাকে বিবাহ দিয়েছি বলে তোমাদের ধারণা, সে কোথায়? জবাবে রাসূল (সা) তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হন। খাদীজার আব্বা নবীজী (সা)-কে এক নজর দেখে বললেন, আমি যদি এর নিকট খাদীজাকে বিবাহ দিয়ে থাকি তো ভালো, অন্যথায় এখন আমি খাদীজাকে এর নিকট বিবাহ দিয়ে দিলাম।

সুহায়লী উল্লেখ করেছেন যে,ইমাম যুহরী তাঁর সীরাত গ্রন্থে পূর্বোক্ত বর্ণনার মত খাদীজার পিতা যখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দেন, তখন তিনি নেশাগ্ৰস্ত ছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন। মুআম্মিলী বলেন, সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, খাদীজার চাচা আমর ইব্‌নে আসাদ খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দিয়েছিলেন। সুহায়লী এই অভিমতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইব্‌নে আব্বাস ও আয়েশা (রা) অনুরূপ অভিমত বর্ণনা করেছেন যে, আয়েশা (রা) বলেন, খুওয়াইলিদ ফিজর যুদ্ধের আগেই ইনতিকাল করেছিলেন। তুব্বা বাদশাহ যখন হাজরে আসওয়াদকে ইয়ামানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তখন এই খুওয়াইলিদই তার বিরোধিতা করেছিলেন। খুওয়াইলিদ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে কুরায়শ-এর একদল লোকও তার সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর একদিন তুব্বা একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন এবং হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে বহাল রাখেন।

ইব্‌নে ইসহাক সীরাত গ্রন্থের পরিশিষ্টে লিখেছেন, খাদীজার ভাই আমর ইব্‌নে খুওয়াইলিদ-ই খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট বিবাহ দিয়েছিলেন। আল্লাহই ভালো प्ठों(कान्।

অধ্যায়

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, গোলাম মায়সারা খাদীজার নিকট পাদ্রীর যে উক্তির কথা উল্লেখ করেছিল এবং সফরে দুই ফেরেশতা কর্তৃক নবীজী (সা)-কে ছায়া প্ৰদান করতে দেখেছিল, খাদীজা (রা) তার চাচাতো ভাই ওয়ারােকা ইব্‌নে নওফল ইব্‌নে আসাদ ইব্‌নে আব্দুল ওযযা ইব্‌নে কুসাইকে সে সম্পর্কে অবহিত করেন। শুনে ওয়ারােকা বললেন, খাদীজা! ঘটনাটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে এ কথা নিশ্চিত যে, মুহাম্মদ এই উম্মতের নবী। আর আমি নিজেও জানি যে, এই উম্মতের জন্য একজন নবীর আবির্ভাব হতে যাচ্ছে। এটাই সেই যুগ। এরপর থেকে ওয়ারাকা বিষয়টি সপ্রমাণিত দেখার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্ৰকাশ করতে পুরু করেন এবং নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন।

আমি অতি আগ্রহের সাথে এমন একটি জিনিসকে বারবার বলে আসছি, যা দীর্ঘদিন যাবত অনেককে কাঁদিয়ে আসছে। খাদীজার নিকট থেকেও নতুন করে সে বিষয়ে নানাবিধ গুণের বিবরণ পাওয়া গেল। শোন খাদীজা! আমার প্রতীক্ষা অনেক দীর্ঘ হয়েছে। আমার প্রত্যাশা, মক্কার উচ্চভূমি ও নিম্নভূমির মধ্যখান থেকে যেন তোমার সে কথা বাস্তবায়িত হচ্ছে বলে দেখতে পাই, যে কথা তুমি খৃস্টান ধর্মযাজকের সূত্রে জানালে। বস্তৃত ধর্মযাজকের কথায় কোন হেরফের হোক, আমি তা চাই না।

সে প্রতীক্ষিত বিষয়টি এই যে, মুহাম্মদ অচিরেই সমাজের নেতা হবেন এবং নিজের বিরুদ্ধবাদীদের তিনি পরাস্ত করবেন। পৃথিবীর সর্বত্র তিনি এমন নূয় ছড়াবেন, যা দ্বারা তিনি সমগ্ৰ বিশ্বজগতকে উদ্ভাসিত করবেন। যারা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, তাবা পর্যুদস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত

হবে। আর যারা তাঁর সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা হবে স্থিতিশীল ও বিজয়ী।

হায়! যখন এ সব ঘটনা ঘটবে, তখন যদি আমি জীবিত থাকতে পারতাম, তা হলে তোমাদের সকলের আগে আমিই তার দলভুক্ত হতাম। আমি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হতাম, যাকে কুরায়শ অত্যন্ত অপসন্দ করবে। যদিও তারা তার বিরুদ্ধে চিৎকার করে মক্কাকে প্ৰকম্পিত করে তুলবে। যাকে তারা সকলে অপসন্দ করবে, আমার প্রত্যাশা তিনি আরাশের অধিপতির নিকট পৌছে যাবেন, যদিও তারা অধঃপতিত হবে। উৰ্ধৰ্ব্বলোকে আরোহণকারীকে যারা গ্ৰহণ করে, তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া এই অধঃপতনের আর কোন কারণ নেই।

কুরায়শরা যদি বেঁচে থাকে। আর আমিও যদি বেঁচে থাকি তবে সেদিন অস্বীকারকারীরা

চিৎকার করে তোলপাড় করবে। আর আমি যদি মারা যাই তাহলে যুবকরা দুর্ভাগ্যের কবল থেকে মুক্তির পথ প্রত্যক্ষ করবে।

ইব্‌নে ইসহাক সূত্রে বর্ণিত ইউনুস ইব্‌নে বুকোয়র-এর বর্ণনা মতে ওয়ারাক ইব্‌নে নওফল আরো বলেছেন–

কী সকাল কী সন্ধ্যা, তোমার মনের ব্যথায় আমিও ব্যথিত। আমি আরো ব্যথিত সেই লোকদের বিরহে, যাদের বিরহ আমার কাম্য নয়। তুমিও বোধ হয় দুদিন পর তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আমি আরো ব্যথিত সেই সত্য সংবাদের জন্য, যা মুহাম্মদ সম্পর্কে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতিতেই যে শুভকামনাকারী তাঁর সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে।

ওহে নাজদ ও গাওর-এর শ্রেষ্ঠ রমণী! ভারী মাল বোঝাই উটের আরোহী বণিক কাফেলার সঙ্গে বুসরা বাজারে তুমি যে যুবককে প্রেরণ করেছিলে, এখন তিনি তোমার কাছে ফিরে এসেছেন। এখন তিনি আমাদেরকে সজ্ঞানে সংবাদ দিচ্ছে সার্বিক কল্যাণের। সত্য প্রকাশের অনেক দ্বার আছে, দ্বার খোলার জন্য আছে চাবি। তিনি সংবাদ দিচ্ছেন যে, এই প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলের সকলের প্রতি আব্দুল্লাহর পুত্র আহমদ প্রেরিত হচ্ছেন।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি হুদ, সালিহ, মূসা ও ইবরাহীম (আ)-এর ন্যায় সত্যবাদীরূপে আবির্ভূত হবেন অচিরেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। দিকে দিকে দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করবে তাঁর ঔজ্জ্বল্য। আর তাঁর অনুসরণ করবে, লুওয়াই ও গালির গোত্ৰ— আবাল-বৃদ্ধ সকলে। তাঁর আবির্ভাব পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকি, তবে তাকে পেয়ে আমি বড়ই আনন্দিত হব। অন্যথায় জেনে রাখা হে খাদীজা! তোমার দেশ ত্যাগ করে আমি চলে যাব অন্য কোন

প্রশস্ত ভূখণ্ডে।

উমাবী এর সঙ্গে যোগ করে আরো উল্লেখ করেছেন :

ফলে মানুষ অনুসরণ করবে। সেই ব্যক্তির দীনের, যিনি সব কল্যাণের কেন্দ্রবিন্দু, যিনি সৃষ্টির সেরা মানুষ। যিনি মক্কায় নির্মাণ করেছেন সুদৃঢ় এক ইমারত। সর্বত্র কুফরির ঘনঘটা সত্ত্বেও

যে ঘরে জ্বলজ্বল জুলছে হেদায়াতের প্রদীপ। যে গৃহ সকল গোত্রের কেন্দ্রবিন্দু, যে ঘরের প্রতি চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসে দুর্বল ও সবল উট।

আবুল কাসিম সুহায়লী কর্তৃক তাঁর আর রাউজুল উনুফ গ্রন্থে বর্ণিত ওয়ারােকা ইব্‌নে নওফলের আরো কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ :

আমি অনেককে উপদেশ দিয়েছি যে, আমি সতর্ককারী। অতএব কেউ যেন তোমাদেরকে প্রতারিত করতে না পারে। তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব করবে না।

যদি তারা তোমাদের আহবান করে, তবে বলে দিবে- তোমাদের ও আমাদের মাঝে প্রাচীর

রয়েছে।

আমরা পবিত্ৰতা জ্ঞাপন করি আরাশের অধিপতির, পবিত্রতা যার অবিচ্ছেদ্য গুণ। আমাদের আগে জুদী পর্বত আর জড় পদার্থরাজিও তার পবিত্রতা জ্ঞাপন করেছে। সৃষ্টির সবকিছু তাঁর অনুগত। তাঁর রাজত্বের প্রতি হাত বাড়ানো কারো জন্য উচিত নয়।

আমরা যা কিছু দেখছি, তার কোনটিরই ঔজ্জ্বল্য অবশিষ্ট থাকবে না। থাকবেন শুধু ইলাহ-সম্পদ-সন্তান সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। মহা শক্তিধর হরমুজ সম্রাটের ধন-ভাণ্ডার তার কাজে আসেনি। আদি জাতিও চিরদিন বেঁচে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। বায়ু বহন করে বেড়ােত যে সুলায়মান (আ)-কে তিনিও থাকতে পারেননি। মৃত্যুর পরোয়ানা পায়ে পায়ে ঘুরছে। জিন-মানব সকলের। সেই প্রতাপশালী রাজা-বাদশাহরা এখন কোথায়, যাদের কাছে চতুর্দিক থেকে দলে দলে মানুষ আগমন করতো?

মুতু্য একটি কৃপ। এই কূপে সব মানুষকে একদিন না একদিন অবতরণ করতেই হবে। যেমন অবতরণ করেছে অতীতের লোকেরা।

সুহায়লী বলেন, আবুল ফারাজ এ পংক্তিগুলো ওয়ারাকার বলে উল্লেখ করেছেন এবং আরো বলেছেন, এর মধ্যে কোন কোন পংক্তি উমায়্যা ইব্‌নে আবি সালতের বলে উল্লেখ করা হয়। উমর (রা) মাঝেমধ্যে এ সব কবিতার পংক্তি প্রমাণস্বরূপ আবৃত্তি করতেন বলে আমরা পূর্বেই বলে এসেছি

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নবুওত নাভের পাঁচ বছর পূর্বে কুরায়শ কর্তৃক কাবার পুনর্নির্মাণ বায়হাকীর মতে কাবা পুনর্নির্মাণের কাজ সম্পাদিত হয় রাসূলুল্লাহ (সা:) খাদীজাকে বিবাহ করার পূর্বে। তবে প্রসিদ্ধ মতে কুরায়শ কর্তৃক কাবা নির্মাণের ঘটনা ঘটে রাসূল (সা) খাদীজাকে বিবাহ করার দশ বছর পরে। ইমাম বায়হাকীর বর্ণনা মতে, পবিত্র কাবা সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আমলে। ইবরাহীম (আ)-এর কাহিনীতে আমরা সে সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছি। ইমাম বায়বাকী সহীহ বুখারীতে এ বিষয়ে বর্ণিত ইব্‌নে আব্বাস (রা)-এর একটি হাদীসও উল্লেখ করেছেন। সাথে সাথে পবিত্র কাবা হযরত আদম (আ)-এর আমলে নির্মিত হওয়া সংক্রান্ত ইসরাঈলী বৰ্ণনাগুলোও উল্লেখ করেছেন। সে সব বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়। কেননা কুরআনের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ইবরাহীম (আ)-ই সর্বপ্রথম কাবা নির্মাণ করেন এবং তার ভিত্তি স্থাপন করেন। বলা বাহুল্য, কাবার অবস্থান স্থলটি পূর্ব থেকেই কেন্দ্রীয় মর্যাদার অধিকারী সকল যুগে, সব সময় সম্মানিত ছিল। যেমন আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :

নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতো বাক্কায় (অর্থাৎ মক্কায়) তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম। আর যে কেউ সেখানে প্ৰবেশ করে, সে নিরাপদ।। মানুষের মধ্যে যার

সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য। (আলে-ইমরান : ৯৬-৯৭)

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু যর (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, আবু যর (রা) বলেন, আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন মসজিদ সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : আল-মাসজিদুল হারাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? নবী করীম (সা) বললেন : আল- মাসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই দুয়ের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল কতটুকু? তিনি বললেনঃ চল্লিশ বছর।।

এ বিষয়ে পূর্বে আমরা আলোচনা করে এসেছি এবং একথাও উল্লেখ করেছি যে, মসজিদুল আকসার ভিত্তি স্থাপন করেন ইসমাঈল তথা হযরত ইয়াকুব (আ)।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আছে যে, এই মক্কা নগরীকে আল্লাহ তাআলা আসমান যমীন সৃষ্টি করার দিন থেকেই সম্মানিত করেছেন। ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত সম্মানিতই থাকবে।

ইমাম বায়হাকী আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগেও বায়তুল্লাহ বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরআনের (৩৯,১।। 13,

…..) (আর যখন পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হলো) এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এই বায়তুল্লাহর নিচ থেকেই পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। মানসুরও মুজাহিদ থেকে অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

আমার মতে, এই বর্ণনাটি অতিশয় গরীব পর্যায়ের। সম্ভবত এটি সেই দুই থলের একটি থেকে নেয়া, যা ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর (রা)-এর হস্তগত হয়েছিল। এ দুটি ইসরাঈলী বর্ণনায় ভরপুর ছিল। তাতে মুনকার ও গরীব বর্ণনাও ছিল অসংখ্য। ইমাম বায়হাকী আরো বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর ইবনুল আস (রা) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : আল্লাহ্ তাআলা জিবরাঈল (আঃ)-কে আদম ও হাওয়া (আ)-এর নিকট প্রেরণ করেন। জিবরাঈল (আঃ) তাদের বললেন, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি ঘর নির্মাণ করা। এই বলে জিবরাঈল (আঃ) তাদেরকে ঘরের চৌহদ্দি চিহ্নিত করে দেন। আদম (আ) মাটি খনন ও হাওয়া (আ) মাটি স্থানান্তরের কাজ শুরু করে দেন। এক পর্যায়ে নিচ থেকে পানি তাদেরকে বলে, হে আদম! যথেষ্ট হয়েছে। আদম ও হাওয়া (আ) গৃহ নির্মাণ কাজ শেষ করলে আল্লাহ্ তাআলা আদম (আ)-এর প্রতি ঘরটি তাওয়াফ করতে প্রত্যাদেশ করেন এবং তাঁকে বলা হলো, তুমিই প্রথম মানুষ আর এটি প্রথম ঘর। এরপর কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর হয়রত নূহ (আ) সেই ঘরের হজ্জ করেন। এরপর আবার কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হলে পরে এক সময় হযরত ইবরাহীম (আ) গৃহটি পুনর্নির্মাণ করেন। বায়হাকী বলেন, ইব্‌নে লাহীআ এমনি এককভাবে মারফু সূত্ৰে হাদীসটি বর্ণনা করেন। আমার মতে এ রাবী যায়ীফ এটা আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর-এর উক্তি হওয়ার অতিমতই অধিকতর শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য।

রাবী বর্ণনা করেন যে, আদম (আ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করেন। তখন একদল ফেরেশতা তাঁর নিকট এসে বলেন যে, আপনার হজ্জ কবুল হয়েছে। হে আদম! আপনার পূর্বে আমরা দুই হাজার বছর ধরে হজ করে আসছি।

ইউনুস ইব্‌নে বুকায়ার ইব্‌নে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, ইব্‌নে ইসহাক বলেন, মদীনার নির্ভরযোগ্য একদল আলিম আমার নিকট উরওয়া ইব্‌নে যুবোয়র থেকে বর্ণনা করেন যে, উরওয়া বলেন, কোন নবীই এমন ছিলেন না যে, তিনি বায়তুল্লাহর হজ্জ করেন নি। তবে হুদ। ও সালিহা (আ) এর ব্যতিক্রম। পূর্বে আমরা হুদ ও সালিহা (আ) বায়তুল্লাহর হজ্জ করেছেন বলে উল্লেখ করেছি। তার অর্থ পারিভাষিক হজ্জ নয়- বরং কাবার অবস্থানস্থল প্ৰদক্ষিণ যদিও সে সময় ওখানে কোন গৃহ ছিল না।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, খালিদ ইব্‌ন আর আরা বলেন, এক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-এর নিকট আল্লাহর বাণী :

সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যে, এটি কি পৃথিবীতে নির্মিত সর্বপ্রথম ঘর? জবাবে তিনি বললেন, না, বরং এটি সর্বপ্রথম সেই গৃহ, যাতে মানবজাতির জন্য বরকত, পথের দিশা ও মাকামে ইবরাহীম রক্ষিত হয়েছে। আর এটি সর্বপ্রথম এমন ঘর, যাতে কেউ প্ৰবেশ করলে সে

নিরাপদ। যদি তুমি বল, চাইলে আমি তোমাকে এই ঘর নির্মাণের ইতিবৃত্ত শোনাতে পারি। শোন তবে —

আল্লাহ্ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রতি প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি পৃথিবীতে আমার উদ্দেশে একটি ঘর নির্মাণ করা। প্রত্যাদেশ পাওয়ার পর হযরত ইবরাহীম (আ)-এর হৃদয় ভয়ে সংকুচিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ তাআলা সাকীনা পাঠান আর তা হলো মস্তকবিশিষ্ট একটি প্রবল বায়ু প্রবাহ। ঐ বায়ু প্রবাহটি হযরত ইবরাহীম (আ)-কে আরবে নিয়ে আসে। তারপর তা বায়তুল্লাহর স্থানে সাপের মত কুণ্ডলী পাকায়! ইবরাহীম (আ) সেই স্থানে কাবা। নির্মাণ করেন। নির্মাণ কাজের শেষ পর্যায়ে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় তিনি পুত্ৰ ইসমাঈলকে বললেন, আমাকে একটি পাথর খুঁজে এনে দাও। পাথর খুঁজে শূন্য হাতে ফিরে এসে ইসমাঈল (আ) দেখলেন, হাজরে আসওয়াদা যথাস্থানে স্থাপিত হয়ে আছে। পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি কোথায় পেলেন? জবাবে ইবরাহীম (আ) বললেন, তোমার ওপর ভরসা করতে পারেন না। এমন এক সত্তা অর্থাৎ জিবরাঈল আকাশ থেকে এটি এনে দিয়েছেন। তখন ইবরাহীম (আ) কাবার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন।

হযরত আলী (রা) বলেন, এভাবে এক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক সময়ে কবাগৃহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তখন আমালিকা সম্প্রদায় তা পুনর্নির্মাণ করে। তারপর আবার বিধ্বস্ত হলে জুরহুমরা পুনর্নির্মাণ করে। আবার বিধ্বস্ত হলে এবার কুরায়শ সম্প্রদায় তা নির্মাণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন পরিণত যুবক। নির্মাণ কাজে সর্বশেষ হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে স্থাপন করতে গিয়ে কুরায়শদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সর্বপ্রথম যিনি এখানে উপস্থিত হবেন, তিনি আমাদের মাঝে এই বিরোধের সমাধান দেবেন। আমরা সকলে তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেব। দেখা গেল, তারপর সর্বপ্রথম যিনি তাদের কাছে উপস্থিত হলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের মধ্যে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এভাবে প্রদান করেন যে, পাথরটিকে একটি চাদরে বসিয়ে তাদের সব কটি গোত্র প্রধান পাথরটিকে যথাস্থানে নিয়ে যাবে।

আবু দাউদ তায়ালিসী আলী ইব্‌নে আবী তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী (রা) বলেন, জুরহুমের পর যখন বায়তুল্লাহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তখন কুরায়শরা তা পুনর্নির্মাণ করে। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে তারা এই মর্মে একমত হয় যে, অতঃপর যিনি সর্বপ্রথম এই দরজা দিয়ে কাবায় প্রবেশ করবেন, তিনি হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে স্থাপন করবেন। তারপর কাবার বনু শায়াবা দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সা) প্রবেশ করেন। কাবায় প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ (সা) একটি চাদর আনার আদেশ দেন। চাদর আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সা) হাজরে আসওয়াদটি তার মধ্যখানে রাখেন এবং প্রত্যেক গোত্রপতিকে চাদরটি এক এক অংশ ধরবার আদেশ দেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আদেশমত গোত্রপতিরা পাথরটি তুলে নিয়ে যায়। শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজ হাতে কাপড় থেকে তুলে পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করে দেন।।

ইয়াকুব ইব্‌নে সুফিয়ান বর্ণনা করেন যে, ইব্‌নে শিহাব বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন এক মহিলা কাবায় সুগন্ধির ধুনি দেয়। তখন একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কাবার গিলাফে গিয়ে পড়ে। এতে আগুন ধরে যায় এবং কাবা ঘরটি পুড়ে যায়। তখন তারা তা ভেঙে ফেলে। তারপর কুরায়শ পুড়ে যাওয়া ঘরটি মেরামত করে। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত এসে তারা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, কোন গোত্র তা যথাস্থানে স্থাপন করবে। অবশেষে তারা বলে যে, এসো সর্বপ্রথম যিনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন, তার ওপর মীমাংসার ভার অর্পণ করি। দেখা গেল,এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) সর্বপ্রথম তাদের সামনে উপস্থিত হন। গায়ে তাঁর পশমী চাদর। কুরায়শ তাঁর ওপর মীমাংসার ভার অর্পণ করে। তিনি পাথরটিকে একটি কাপড়ে তুলে নেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রের সরদারগণ বেরিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রত্যেককে কাপড়ের এক একটি অংশ ধরিয়ে দেন। তারা পাথরটিকে বহন করে নিয়ে যায় আর রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ হাতে পাথরটি কাপড় থেকে তুলে যথাস্থানে স্থাপন করে দেন। সেই থেকে কুরায়শ তাঁকে আল-আমীন নামে অভিহিত করতে থাকে। তখনো তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হয়নি। এরপর থেকে মক্কার লোকেরা উট জবাই করার আগে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করতো। বর্ণনাটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যুহরীর সীরাত থেকে নেয়া হলেও আলোচ্য বর্ণনাটি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্ম। যেমন বর্ণনায় বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন অথবা প্রসিদ্ধ মতে যখন এই ঘটনাটি ঘটে, তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক ইব্‌নে ইয়াসার তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। মুসা ইব্‌নে উকবা বলেন, কাবার পুনর্নির্মাণের ঘটনা সংঘটিত হয় নবুওতের পনের বছর আগে। মুজাহিদ, উরওয়া, মুহাম্মদ ইব্‌নে জুবোয়র ইব্‌নে মুতইম প্ৰমুখের অভিমতও অনুরূপ।

মূসা ইব্‌নে উকবার ভাষ্যমতে ফিজর ও কাবা নির্মাণের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল পনের বছর।

আমার মতে, ফিজার ও হিলফুল ফুযুলের ঘটনা সংঘটিত হয় একই বছরে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স বিশ বছর। এই উক্তিটি মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাকের মতকে শক্তিশালী

করে।

মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন, কুরায়শের কাবা গৃহ পুনর্নির্মাণের প্রতি উদ্ধৃদ্ধ হওয়ার পটভূমি এই যে, বিভিন্ন সময়ের প্লাবনের ফলে কাবার দেয়াল কিছুটা খসে পড়ে। তাতে কুরায়শ কাবার অভ্যন্তরে পানি ঢুকে পড়ার আশংকা বোধ করে। অপরদিকে মালীহ নামক এক ব্যক্তি কাবার সুগন্ধি চুরি করে নিয়ে যায়। তাই কুরায়শ কাবার ভিত্তি আরো শক্ত করার এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ রোধ করার জন্য কাবার দরজা আরো উচু করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে। এরজন্য তারা অর্থ ও শ্রমিক সংগ্রহ করে। এবার তারা কাবার গৃহ ভেঙে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং এই বলে অন্যদের সতর্ক করে দেয় যেন কেউ এতে বাধা দিতে না আসে। ওলীদ ইব্‌নে মুগীরা সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন এবং কাবার কিয়দংশ ভেঙে ফেলেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও তার অনুসরণ করে।

এতে কুরায়শরা আনন্দিত হয় এবং এর জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে। কিন্তু একজন শ্রমিকও এক পা সামনে অগ্রসর হতে পারছে না। তারা যেন দেখছে যে, একটি সাপ কাবা ঘর জড়িয়ে আছে। সাপটির লেজ আর মাথা একই জায়গায়। এতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা আশংকা বোধ করে যে, কাবা ঘর ভেঙে ফেলার চেষ্টার ফলেই এমনটি হয়েছে। অথচ কাবাই ছিল তাদের রক্ষাকবচ ও মর্যাদার হেতু। কুরায়শরা এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এবার মুগীরা ইব্‌নে আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর ইব্‌নে মািখযুম এগিয়ে আসেন। তিনি কুরায়শদের যথোপযুক্ত উপদেশ প্ৰদান করেন এবং তাদের আদেশ দেন যেন তারা ঝগড়া-বিবাদ না করে এবং কাবা নির্মাণে বিদ্বেষ পরিহার করে। তারা যেন কাবা নির্মাণের কাজকে চার ভাগে ভাগ করে নেয় এবং এই মহান কাজে কোন হারাম সম্পদের মিশ্রণ না ঘটায়। বর্ণনাকারী বলেন, এবার কুরায়শরা মুগীরা ইব্‌নে আব্দুল্লাহর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করার উদ্যোগ নিলে সাপটি আকাশে চলে যায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের ধারণায় তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়েছিল। মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন, অনেকের ধারণা, একটি পাখি সাপটিকে ছোঁ। মেরে ধরে নিয়ে আজইয়াদের দিকে নিক্ষেপ করে।

মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন পঁয়ত্রিশ বছরে উপনীত হন, তখন কুরায়শরা কাবা নির্মাণের জন্য সম্মত হয়। তাদের এ আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কাবার ছাদ স্থাপন করা। আরেকটি কারণ, তারা কাবা গৃহ ধ্বসে যাওয়ার আশংকা করছিল। উল্লেখ্য যে, সে সময় কবা ঘর উচ্চতায় একজন মানুষের উচ্চতার চেয়ে সামান্য বেশি উচু ছিল। তারা কাবা গৃহকে আরো উচু এবং ছাদবিশিষ্ট করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঘটনার পটভূমি নিম্নরূপ :

একদল লোক কাবার একটি মূল্যবান সম্পদ চুরি করে। তা কাবার মধ্যস্থলে একটি গর্তে রক্ষিত ছিল। পরবর্তীতে তা বনু মালীহ ইব্‌নে আমর ইব্‌নে খুযাআর দাবীক নামক জনৈক গোলামের নিকট পাওয়া যায়। ফলে কুরায়শরা তার হাত কেটে দেয়। কুরায়শদের ধারণা ছিল, ওটি যারা চুরি করেছিল তারাই তা দাবীক-এর নিকট রেখেছিল।

অপরদিকে রোম দেশীয় এক বণিকের একটি জাহাজ সমুদ্রে ভেসে ভেসে জেদ্দায় এসে পৌঁছে এবং ভেঙে যায়। কুরায়শরা তার কাঠগুলো সংগ্রহ করে তা দিয়ে তারা কাবার ছাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। উন্মুখী বলেন, জাহাজটি ছিল রোম সম্রাট কায়সার-এর। জাহাজটি পাথর, কাঠ, লোহা ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্ৰী পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। কায়সার বাকুম রুমীর সঙ্গে জাহাজটি সেই গির্জা অভিমুখে রওয়ানা করিয়েছিলেন, যা পারস্যবাসীরা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিল। জাহাজটি জেদ্দায় ঠেকে যাওয়ার পর আল্লাহ তার উপর দিয়ে প্রবল বায়ু প্রেরণ করেন। সেই বায়ুর ঝাপটায় জাহাজটি ভেঙে যায়।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, মক্কায় একজন কিবতী ছুতার ছিল। কাবা মেরামতের অনেক সরঞ্জাম সে প্রস্তুত করে দেয়। অপর দিকে একটি সাপ কাৰ্যার কূপ থেকে বেরিয়ে এসে কিবতী তার প্রতিদিন যে কাজ আঞ্জাম দিত, তা লণ্ডভণ্ড করে দিত। ভয়ংকর সেই সাপটি কাবার দেয়ালে উঠে। উকি ঝুকি মারত। কেউ তার নিকট অগ্রসর হলে সে মুখ হা-করে ফণা তুলে তাকিয়ে থাকত। এতে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। এমনিভাবে প্রতিদিনকার ন্যায় একদিন সাপটি কাবার দেয়ালে উঠে। উকি দিলে আল্লাহ একটি পাখি প্রেরণ করেন। পাখিটি সাপটিকে ছো মেরে নিয়ে যায়। ফলে কুরায়শ বলে, আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ আমাদের পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাদের আছে দক্ষ কারিগর, আছে কাঠ। আর সাপের সমস্যা থেকেও আল্লাহ্ আমাদের মুক্তি দিলেন।

সুহায়লী রাষীন থেকে বর্ণনা করেন, জুরহুমের আমলে এক চোর কাবার গুপ্ত ভাণ্ডার চুরি করার উদ্দেশ্যে কাবায় প্রবেশ করে। চুরি করার জন্য লোকটি কুপে অবতরণ করলে কৃপের পাড় তার ওপর ভেঙে পড়ে। সংবাদ পেয়ে কুরায়শরা তাকে বের করে আনে এবং চুরি করা সম্পদ উদ্ধার করে। এরপর থেকে সেই কূপে একটি সাপ বসবাস করতে শুরু করে। সাপটির মাথা ছিল একটা ছাগল ছানার মাথার মত। পেট সাদা আর পিঠ কালো। সাপটি এই কূপে দীর্ঘ পাঁচ শ বছর অবস্থান করে। এটাই ছিল সেই মুহাম্মদ ইব্‌নে ইসহাক বর্ণিত সাপ।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, কুরায়শ যখন কাবার পুরনো ভিত্তি ভেঙে নতুনভাবে ভিত্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আবু ওহাব আমর ইব্‌নে আয়িদ ইব্‌নে আবদ ইব্‌নে ইমরান ইব্‌নে মািখযুম —ইব্‌ন হিশামের মতে আয়িদ ইব্‌ন ইমরান ইব্‌ন মািখযুম কাবার একটি পাথর খসিয়ে নেয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি তার হাত থেকে লাফ দিয়ে স্বস্থানে ফিরে যায়। তা লক্ষ্য করে সে বলে, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! কাবা নির্মাণে তোমরা তোমাদের উপার্জিত পবিত্র সম্পদ ব্যতীত। অন্য কিছু মিশিয়ো না। এতে কোন গণিকার উপার্জন এবং সুদের এবং জুলুমের অর্থ যেন না ঢুকে। অনেকের ধারণা, এই উক্তিটি ওলীদ ইব্‌ন মুগীরা ইব্‌নে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন মািখযুম-এর। কিন্তু ইব্‌নে ইসহাক উক্তিটি আবু ওহাব ইব্‌নে আমরের হওয়ার মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইব্‌নে ইসহাক বলেন, উক্ত আবু ওহাব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতার মামা। তিনি অত্যন্ত সন্ত্রান্ত ও প্রশংসাৰ্ছ ব্যক্তি ছিলেন।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, তারপর কুরায়শরা কাবাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে নেয়। দরজার অংশ নির্মাণের দায়িত্ব নেয় বনু আবদ মানাফ ও যুহরী গোত্রদ্বয়; রুকন আসওয়াদ ও রুকন ইয়ামানীর মধ্যবর্তী স্থানের দায়িত্ব পায় বনু মািখযুম। আর কুরায়শের আরো কয়েকটি গোত্র তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করে। কাবার পিছনের অংশ পায় বনু জামহ ও বনু সাহিম।

অপরদিকে বনু আব্দুদার ইব্‌নে কুসাই, বনু আসাদ ইব্‌নে আবদুল উদ্যযা ও বনু আদীি ইব্‌নে কাব। হিজর তথা হাতীম নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়।

কিন্তু মানুষ তা ভাঙার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছিল এবং প্রত্যেকেই গা-বঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছিল। তখন ওলীদ ইব্‌নে মুগীরা বলেন, ঠিক আছে, আমি তোমাদেরকে কাবা গৃহ ভাঙার কাজ শুরু করে দিচ্ছি। এই বলে তিনি গাইতি নিয়ে কাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং বলতে শুরু করেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মন থেকে ভীতি দূর করে দাও। কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু তো আমাদের অভীষ্ট নয়। তারপর তিনি দুই রুকনের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেন। সেই রাতের মত এর ফল কি দাঁড়ায় তা দেখার জন্য লোকজন অপেক্ষা করে এবং বলে, আমরা অপেক্ষা করছি। ওলীদ ইব্‌ন মুগীরা যদি কোন বিপদে পতিত হন, তা হলে আমরা কাবার একটুও ধ্বংস করতে যাবো না এবং যা ভাঙা হয়েছে, তাও পূর্বের মত করে দেব। আর যদি তাকে কোন বিপদ স্পর্শ না করে তা হলে বুঝে নেব, আমরা কাবা ভাঙার যে পরিকল্পনা নিয়েছি, আল্লাহ তাতে সন্তুষ্ট আছেন। পরদিন সকালে ওলীদ আবার কাবা গৃহ ভাঙার কাজ শুরু করেন। তার সঙ্গে অন্যরাও ভাঙতে শুরু করে। অবশেষে ভাঙার কাজ যখন ইররাহীম (আ)-এর ভিত্তি পর্যন্ত পৌছে, তখন তারা একটি সবুজ পাথর দেখতে পায়। পাথরটি দন্তসারির ন্যায়; যেন একটি অপরটিকে জড়িয়ে আছে। ইয়ায়ীদ ইব্‌ন রুমান থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর এক হাদীসে u১ 1 a_2, …< বলা হয়েছে। অর্থাৎ পাথরটি দেখতে উটের কুজের মত। সুহায়লী বলেন, আমার ধারণা সীরাতের বর্ণনায় শব্দটি ৭ মি.। [< রূপে (জিহবার ন্যায়) ব্যবহার রাবীর ভ্ৰম মাত্র।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, কাবাগৃহ ভাঙার কাজে অংশগ্রহণকারীদের একজন কাবার দুইটি পাথরের মাঝে শাবল ঢুকিয়ে চাপ দেয়। তাতে একটি পাথর নড়ে উঠলে সাথে সাথে সমগ্র মক্কানগরী কেঁপে ওঠে। ফলে তারা ঐ অংশ ভাঙা থেকে বিরত থাকে।

মূসা ইব্‌নে উকবা বলেন : হযরত আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আব্বাস (রা)-এর ধারণা, কুরায়শ-এর কতিপয় প্রবীণ ব্যক্তি বলতেন যে, কুরায়শরা যখন কাবার কিছু পাথর ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ)-এর ভিত্তির নিকট সরিয়ে নিতে সমবেত হয়, তখন তাদের একজন প্রথম ভিত্তির একটি পািখর সরাতে উদ্যত হয়। অবশ্য তার কথা জানা ছিল না যে, এটি প্রথম ভিত্তির পাথর।

সরানোর উদ্দেশ্যে লোকটি পাথরটি তুলে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা পাথরের নিচে বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পায, যেন তা লোকটির চোেখ ঝলসে দেয়ার উপক্রম হয় এবং পাথরটি তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে যথাস্থানে বসে যায়। তা দেখে লোকটি নিজে এবং নির্মাণ শ্রমিকরা ভীত হয়ে পড়ে। পাথরটি যখন তার নিচের বিদ্যুৎ ঝালকানি ঢেকে ফেলে, তখন শ্রমিকরা পুনরায় নির্মাণ কাজে আত্মনিয়োগ করে এবং বলাবলি করে- কেউ এই পাথর এবং এই স্তরের অন্য কিছু সরাবার চেষ্টা করো না।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, আমার নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, কুরায়শরা রুকন-এ সুরিয়ানী ভাষায় লিখিত একটি লিপি পেয়েছিল। কিন্তু তারা তার মর্ম উদ্ধার করতে পারেনি। পরে জনৈক ইহুদী তাদেরকে লিপিটি পাঠ করে শোনায়। তাতে লেখা ছিল :

আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। এই মক্কাকে আমি সেদিন সৃষ্টি করেছি, যেদিন আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে আকৃতি দান করি। এবং তাকে আমি সাতটি রাজ্য দ্বারা

আচ্ছাদিত করি। এর পাহাড় দুটি স্থানান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত এর কোন নড়াচড় হবে না। এর অধিবাসীদের জন্য এটি পানি ও দুধসমৃদ্ধ, বরকতময়।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, আমার নিকট বর্ণিত হয়েছে যে, কুরায়শা রামাকামে ইবরাহীমে একটি লিপি পায়। তাতে লেখা ছিল ৪ এটি আল্লাহর পবিত্র মক্কা। এর তিন পথে এখানকার অধীবাসীদের জীবিকা আসে। এর অধিবাসীদের কেউ এর মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারবে না।

ইব্‌নে ইসহাক বলেন, লাইছ ইব্‌নে আবী সুলায়ম-এর ধারণা মতে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আবির্ভাবের চল্লিশ বছর আগে কুরায়শরা কাবায় একটি লিপি পায়। তাতে লেখা ছিল :

– যে ব্যক্তি কল্যাণের বীজ বপন করবে, সে ঈর্ষণীয় ফসল তুলবে। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের বীজ বপন করবে, সে অনুতাপের ফসল তুলবে। মানুষ কাজ করে অসৎ। আর প্রতিদান চায়

সৎকাজের? এটা যেমন কাটাময় বৃক্ষ থেকে আঙ্গুর ফল লাভ করা আর কি?

সাঈদ ইব্‌নে ইয়াহয়া আল-উমাবী বলেন, যুহরী সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : মাকামে ইবরাহীমে তিনটি লিপি পাওয়া যায়। এক পাতায় লেখা ছিল-

আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। চন্দ্ৰ-সূৰ্য সৃষ্টি করার দিনই আমি তৈরি করেছি এবং সাতটি রাজ্য দ্বারা তাকে আবৃত করেছি ও তার অধিবাসীদের জন্য গোশতে ও দুধে বরকত দান করেছি।

দ্বিতীয় লিপিতে ছিল—

আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। আমি রাহিম (আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকে তার নামকরণ করেছি। অতএব, যে লোক তা বজায় রাখবে। আমি তাকে কাছে টেনে আনবো। আর যে তা ছিন্ন করবে, আমিও তাকে ছিন্নভিন্ন করব?

তৃতীয় লিপিতে ছিল :

আমি মক্কার অধিপতি আল্লাহ। আমি কল্যাণ অকল্যাণ ও তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছি।

সুতরাং সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য, যার দুই হাতে আমি কল্যাণ চালু করেছি। আর ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য, যার দুই হাতে আমি চালু করেছি। অকল্যাণ।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, তারপর কুরায়শ গোত্রগুলো কাবা নির্মাণের জন্য পাথর সংগ্রহ করে। প্রত্যেক গোত্ৰ স্বতন্ত্রভাবে পাথর সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। তারপর তারা কাবা নির্মাণ করে। নির্মাণ কাজ রুকন (হাজরে আসওয়াদ)-এর স্থান পর্যন্ত পৌছলে তারা বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। প্ৰত্যেক গোত্ৰই চাইছিল যেন তারাই তাকে স্বস্থানে পুনঃস্থাপন করে, অন্য কেউ নয়। তাদের এই বিবাদ চরম আকার ধারণ করে। তারা পরস্পর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। বনু আবদুন্দার রক্ত ভর্তি একটি পাত্ৰ উপস্থিত করে। তারপর তারা এবং বনু আদীি ইব্‌ন কাব। ইব্‌ন লুআই মৃত্যুর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং পাত্রের রক্তে হাত ঢুকায়। তাকে তারা লাকা তুদাম তথা রক্ত চুক্তি নামে আখ্যা দেয়। কুরায়শরা এই অবস্থায় চার কি পাঁচ দিন অতিবাহিত করে। তারপর তারা মসজিদে সমবেত হয়ে পরামর্শ করে। কোন কোন বর্ণনাকারীর ধারণা, সে সময়ের কুরায়শদের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইব্‌ন মুগীরা (ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইবুন মািখযুম) বললেন, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! তোমাদের বিবাদের মীমাংসা তোমরা এভাবে কর যে, মসজিদের এই দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি প্ৰবেশ করবে, তার হাতে তোমরা এর মীমাংসার ভার অর্পণ করবে। সে তোমাদের মাঝে এই বিবাদের মীমাংসা করবে। এ প্রস্তাবে তারা সম্মত হয়। দেখা গেল, যিনি সর্ব প্রথম মসজিদে প্রবেশ করলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে দেখে তারা বলে উঠল, এই যে আমাদের আল-আমীন। মুহাম্মদ এসেছেন, তার সিদ্ধান্তে আমরা রাজী। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের নিকটে গেলে তারা বিষয়টি তাঁকে জানায়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ আমাকে একটি কাপড় এনে দাও। কাপড় দেওয়া হলো। রাসূলুল্লাহ (সা) রুকন অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ নিজ হাতে তুলে সেই কাপড়ের ওপর রাখলেন। তারপর বললেন : প্রত্যেক গোত্ৰ কাপড়ের এক একটি কোন ধর। তারপর সকলে মিলে তা তুলে নিয়ে যাও। তারা তা-ই করল। তা নিয়ে তারা যথাস্থানে পৌঁছলে তিনি নিজ হাতে তা স্থাপন করে দেন। উল্লেখ্য যে, কুরায়শরা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ইতিপূর্বেই আল-আমীন নামে ডাকতো।

ইমাম আহমদ বলেন, সাইব ইব্‌ন আবদুল্লাহ বৰ্ণনা করেন যে, তিনি জাহেলী যুগে কাবা নির্মাতাদের একজন ছিলেন। তিনি বলেন, আমার একটি পাথর ছিল। আল্লাহর স্থলে আমি তার ইবাদত করতাম। আমি গাঢ় দুধ নিয়ে আসতাম, যা ছিল আমার অতি প্রিয়। সেই দুধ উক্ত পাথরের গায়ে ছিটিয়ে দিতাম আর একটি কুকুর এসে তা চেটে খেত এবং এক পা উঠিয়ে তাতে পেশাব করে দিত। কাবা নির্মাণের এক পর্যায়ে আমরা হাজরে আসওয়াদের স্থানে উপনীত হলাম। কিন্তু কেউ পাথরটি দেখতে পেলো না। হঠাৎ দেখা গেল, পাথরটি আমার পাথরগুলোর মধ্যখানে, দেখতে ঠিক মানুষের মাথার ন্যায়, যেন তা থেকে মানুষের মুখমণ্ডল আত্মপ্ৰকাশ করবে। দেখে কুরায়শের একটি গোত্র বলল, এটা আমরা স্থাপন করব; আরেক গোত্র বলল, না আমরা স্থাপন করব। লোকেরা বলল, এর সমাধানের জন্য তোমরা একজন সালিস নিযুক্ত কর। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, বাহির থেকে সর্বপ্রথম যিনি এখানে আসবেন, তিনিই এ সমস্যার সমাধান করবেন। আসলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা)। তাঁকে দেখে লোকেরা বলে উঠল, তোমাদের মাঝে আল-আমীন এসে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তারা বিষয়টি অবহিত করল। তিনি পাথরটি একটি কাপড়ে রাখলেন। তারপর প্রত্যেক গোত্রকে ডাকলেন। তারা কাপড়ের এক একটি প্রান্ত ধরে পাথরটি তুলে যথাস্থানে নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজ হাতে তা যথাস্থানে স্থাপন করেন।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আমলে কাবা আঠার হাত লম্বা ছিল। প্রথমে কাবাকে মিসরীয় কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখা হতো। তারপর বারূর বস্ত্র দ্বারা ঢাকা হয়। সর্বপ্রথম যিনি কাবায় রেশমী কাপড়ের গিলাফ পরান, তিনি হলেন হাজ্জাজ ইব্‌ন ইউসুফ।

আমার মতে, কুরায়শরা কাবা থেকে হিজরকে বের করে ফেলে। পরিমাপে তা উত্তর দিক থেকে ছয় কি সাত হাত। এর কারণ অর্থের অভাব। কাবাকে হুবহু ইবরাহীমী ভিত্তির ওপর নির্মাণ করার সামৰ্থ্য কুরায়শদের ছিল না। তারা পূর্ব দিকে কাবার একটি মাত্র দরজা রাখে। আর তা স্থাপন করে উচু করে। যাতে ইচ্ছা করলেই যে কেউ তাতে প্রবেশ করতে না পারে, যেন প্ৰবেশাধিকার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে তুমি কি জানো না যে, তোমার সম্প্রদায় অর্থ সংকটে ছিল? তোমার সম্প্রদায় নওমুসলিম না হলে আমি কাবাকে ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতাম। তখন পূর্বমুখী একটি দরজা আর পশ্চিম মুখী একটি দরজা রাখতাম। আর হিজর তথা হাতীমকে কাবার অন্তর্ভুক্ত করে নিতম!

এ কারণে আবদুল্লাহ ইব্‌ন যুবোয়র ক্ষমতাসীন হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্দেশনা মোতাবেক কাবাকে পুনঃর্নির্মাণ করেন। তাতে কাবা পরিপূর্ণরূপে ইবরাহীম (আ)-এর ভিত্তিতে ফিরে আসে এবং যারপরনাই আকর্ষণীয় গৃহে পরিণত হয়। তিনি মাটি সংলগ্ন করে দুটি দরজা তৈয়ার করেন। একটি পূর্বমুখী আর অপরটি পশ্চিমমুখী। একটি দিয়ে মানুষ প্রবেশ করতো, অপরটি দিয়ে বের হতো। তারপর হাজ্জাজ ইব্‌ন ইউসুফ ইব্‌ন যুবায়রকে হত্যা করে খলীফা। আবদুল মালিক ইব্‌ন মারওয়ানের নিকট পত্র লেখেন। তাতে তিনি ইব্‌ন যুবায়র কর্তৃক কাবা পুনঃনির্মাণের কথা উল্লেখ করেন। তখন তাদের বিশ্বাস ছিল, ইব্‌ন যুবোয়র কাজটি নিজের মর্জিমত করেছিলেন। তাই খলীফা আবদুল মালিক ইব্‌ন মারওয়ান কাবাকে পূর্বের মত করে নির্মাণ করার আদেশ দেন। তখন উত্তর দিকের দেয়াল ভেঙে হিজরকে বের করে ফেলা হয় এবং তার পাথরগুলোকে কাবার মাটিতে সযত্নে পুঁতে রাখা হয়। দরজা দুটো উচু করা হয়। এবং পশ্চিম দিককে বন্ধ করে দিয়ে পূর্ব দিককে আগের মত রাখা হয়। পরবর্তীতে খলীফা। মনসুর কাবাকে ইব্‌ন যুবায়রের ভিতের ওপর ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ইমাম মালিকের মতামত চাইলে তিনি বলেন, রাজা-বাদশারা কাবাকে তামাশার পাত্রে পরিণত করুক আমি তা পছন্দ করি না। ফলে খলীফা মনসুর কাবাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দেন। এখনও তা সেই রূপেই दिप्लाधान्।

কাবার আশপাশ থেকে সর্বপ্রথম ঘরবাড়ি সরিয়ে দেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। মালিকদের নিকট থেকে ক্রয় করে তিনি সেগুলো ভেঙে ফেলেন। পরে হযরত উসমান (রা) আরো কয়েকটি বাড়ি ক্রয় করে সেগুলোও ভেঙে ফেলেন। তারপর ইব্‌ন যুবোয়র (রা) তার শাসনামলে কাবার ভিতকে আরও মজবুত করেন। দেয়ালগুলোর সৌন্দর্য এবং দরজার সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তবে তিনি আর কিছু করতে পারেননি। তারপর আবদুল মালিক ইব্‌ন মারওয়ান খলীফা হয়ে কাবার দেয়াল আরো উঁচু করেন এবং হাজ্জাজ ইব্‌ন ইউসুফের মাধ্যমে কাবাকে রেশমী কাপড়ের গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন। সূরা বাকারার আয়াত :

এর তাফসীরে আমরা কাবা নির্মাণের কাহিনী এবং এতদসংক্রান্ত হাদীসসমূহ উল্লেখ করেছি। প্ৰয়োজনে সেখানে দেখে নেয়া যেতে পারে।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, যখন তারা কাবার নির্মাণ কাজ তাদের ইচ্ছানুযায়ী শেষ করে তখন যুবোয়র ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে সেই সাপটির কাহিনী শোনান, যার ভয়ে কুরায়শরা কাবা নির্মাণের কাজ করতে পারছিল না। ঘটনাটি তিনি কাব্যাকারে বিবৃত করেন :

যে সাপটি কুরায়শের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, একটি ঈগল পাখি কিরূপ নির্ভুলভাবে তাকে ছোঁ। মেরে নিয়ে গেল, তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। সাপটি কখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে কখনো ফণা তুলে ছোবল মারার ভঙ্গিতে থাকত। যখনই আমরা কাবা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি, তখনই সে রুখে দাঁড়িয়েছে এবং তার স্বভাবসুলভ ভীতিপ্ৰদ ভঙ্গিতে ভয় দেখিয়েছে। আমরা যখন এই আপদের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম, তখন ঈগলটি এসে আমাদেরকে রক্ষা করল এবং সংস্কারের কাজে আমাদের আর কোন বাধা থাকল না।

পরদিন আমরা সকলে বিবস্ত্র অবস্থায় সংস্কার কাজে লেগে গেলাম। মহান আল্লাহ এ কাজটি করার সুযোগ দিয়ে বনু লুওয়াইকে অর্থাৎ আমাদেরকে গৌরধানিত করলেন। তবে তাদের পরে বনু আদী এবং বনু মুররাও এ কাজে এসে জড়ো হয়েছে। বন কিলাব ছিল এ কাজে তাদের চেয়েও অগ্রণী। আল্লাহ আমাদেরকে কাবার নিকট বসবাসের সুযোগ দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আশা করা যায়, এ কাজের প্রতিদান আল্লাহর নিকট পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য যে, এর আগে একটি অধ্যায়ে আমরা বলে এসেছি, আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জাহেলিয়াতের পঙ্কিলতা থেকে সর্বতোভাবে নিরাপদ রেখেছিলেন। যেমন কাবা নির্মাণের সময় তিনি এবং তার চাচা আব্বাস (রা) পাথর স্থানান্তরের কাজ করতেন। এক পর্যায়ে তিনি পরিধানের কাপড় খুলে তা কাধের ওপর রেখে পাথর বহন করে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাকে কাপড় খুলতে বারণ করে দেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তিনি কাপড় পরে নেন।

অধ্যায়।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, কুরায়শদেরকে হুমুস নামে অভিহিত করা হতো। এর ধাতুগত অর্থ দীনের ব্যাপারে চরম কঠোরতা। তাদেরকে এই নামে নামকরণের কারণ হলো, তার হারম শরীফকে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতো। যে কারণে তারা আরাফার রাতে এখান থেকে বের হতো না। তারা বলত, আমরা হলাম হারমের সন্তান এবং এর অধিবাসী। ফলে তারা এ কথা আরাফায় অবস্থান বর্জন করত। এটা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর অন্যতম স্মৃতি। একথা জানা থাকা সত্ত্বেও তারা তা বর্জন করত। মনগড়া কুসংস্কার থেকে তারা একটুও নড়াচড় করতো না। ইহরাম অবস্থায় তারা দুধ থেকে ছানা ঘি চর্বি কিছুই সংগ্ৰহ করত না। তারা পশমের তৈরি তাঁবুতে প্ৰবেশ করত না এবং ছায়ায় বসার প্রয়োজন হলে চামড়ার ঘর ছাড়া অন্য কোন ঘরের ছায়ায় বসত না। হজ্জ ও উমরা পালনকারীদেরকে তারা তাদের সরবরাহকৃত পোশাক ব্যতীত অন্য পোশাকে তাওয়াফ করতে এবং তাদের দেয়া খাবার ব্যতীত অন্য খাবার খেতে বারণ করত। হজ্জ উমরাহ পালনকারীদের কেউ যদি কুরায়শ, তাদের বংশধর কিংবা তাদের দলভুক্ত কিনানা ও খুযাআ কারোর নিকট থেকে কাপড় না পেত, তবে তাকে বিবস্ত্ৰ তাওয়াফ করতে হতো। মহিলাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতো। এ কারণে এমন পরিস্থিতিতে মহিলারা যথাস্থানে হাত রেখে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করত। আর বলত :

আজ আমার লজ্জাস্থানের অংশবিশেষ বা পুরোটা বিবন্ত্র হয়েছে ঠিক কিন্তু আজকের পর আর এমনটি হতে দেব না।

যদি কেউ কোন হুমসীর কাপড় পাওয়া সত্ত্বেও সে নিজের কাপড় পরে তাওয়াফ করত। তবে তাওয়াফ শেষে তাকে সেই কাপড় খুলে ফেলে দিতে হতো। পরে সেই কাপড় আর সে ব্যবহার করতে পারত না। তার বা অন্য কারো জন্য সেই কাপড় স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না। আরব সেই কাপড়ের নাম দিয়েছিল আল-লাকি। ইব্‌ন ইসহাক বলেন, কুরায়শ এমনি কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। এই অবস্থায় আল্লাহ মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণ করেন এবং মুশরিকদের মনগড়া কুসংস্কার প্রতিরোধে তাঁর ওপর কুরআন নাযিল করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

তারপর অন্যরা যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে, তোমরাও সেখান থেকে প্ৰত্যাবর্তন করবে: আর আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বস্তৃত আল্লাহ ক্ষমালীল পরম দয়ালু। (২ বাকারী ৪ Sho-

অর্থাৎ আরবের সর্বসাধারণ যেভাবে আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করে, তেমনি তোমরাও আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন কর।

আমরা আগেও উল্লেখ করে এসেছি যে, ওহী নাযিলের পূর্ব থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ প্রদত্ত তাওফীক অনুযায়ী আরাফায় অবস্থান করতেন।

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কুরায়শরা লোকদের ওপর যে পোশাক ও যে খাবার হারাম করে নিয়েছিল, তা বাতিল ঘোষণা করে বলেন :

– অর্থাৎ হে বনী আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে, আহার করবে ও পান করবে; কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। বল, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন, তা কে হারাম করলে? (আরাফ : ৩১-৩২)

যিয়াদ আল বুকায়ী ইব্‌ন ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, কুরায়শের এসব কুসংস্কার আবিষ্কারের ঘটনা হাতীর ঘটনার আগে ঘটেছিল, নাকি পরে তা আমার জানা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *