৩৬. মোনাদিরের আর একটি পত্র

তিন-চার মাস পরে মোনাদিরের আর একটি পত্র আসিল। সে ঠিকানা বদল করিয়াছে। এক বাড়িতে জায়গীর ছিল। কোন কারণে তাহারা আর ছাত্র রাখিতে পারে না। তাই অন্যত্র গিয়াছে মোনাদির। সেখানে মাসিক পনেরো টাকার কম খরচ পড়ে না। এখন সে কি করিবে, তাহাই ভাবনার ব্যাপার।

দরিয়াবিবির মনে আন্দোলন করিতে লাগিল। পনেরো টাকায় তাহাদের সমস্ত মাস নির্বিঘ্নে চলিতে পারে। ধান যে কয় মণ পাওয়া যায়, তাহা দিয়া চার মাসের মাত্র খোরাক হয়। বাকি দিন আল্লাই চালান। কখনো আমজাদ চন্দ্রের সঙ্গে মুনিশ খাঁটিতে যায়। এত ছোট ছেলে লোকে লইতে চায় না। শুধু চন্দ্রের খাতিরে তিন আনা চার আনা দেয় মাত্র। গরু, বাছুর, মুরগি-হাস ডিম বিক্রি ইত্যাদির উপর দিয়া কোনো রকমে দিন গুজরান। ইহার উপর মুনির এই অনুরোধ। দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল। উপায় একটা স্থির করিতে হইবে। আবার ইয়াকুবের ধর্ণা! না তা সম্ভব নয়। তবু একই কেন্দ্রে সমস্ত চিন্তা স্রোতায়িত হইতে লাগিল। শেষে দরিয়াবিবি স্থির করিল, ইয়াকুবকে বলিয়া দেখিতে হইবে।

ইয়াকুব প্রস্তাব শুনিয়া হাসিয়া বলিল, ভাবী, আপনার যা দরকার, আমাকে বলেন না কেন?

ভাই, তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছ। আমার বলতেও লজ্জা লাগে।

কোনো লজ্জা করবেন না। আপনার মুখের হাসি আমি দেখতে চাই।

হাসি কি সহজে আসে!

মন নরম থাকলে আসে বৈকি।

ইয়াকুব দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া আবার মৃদু হাসিল। বৈধব্যের পর দরিয়াবিবির শরীরের তেমন পরিবর্তন ঘটে নাই। চেহারায় আর একটু রুক্ষতার ছাপ লাগিয়াছে। মাত্র। তার ফলে আরো আপ্তরমণীর মতো দেখায় দরিয়াবিবিকে। হঠাৎ কারো চোখে পড়িলে মনে হইবে, যেন কত দেমাকী। কিন্তু দরিয়াবিবি নিজের দিকে চাহিয়া আর কিছু দিশা করিতে পারে না। সে যেন আসেকজানের মতো হইয়া যাইতেছে। ভয়ে বিবর্ণ হইয়া যায় তখন দরিয়াবিবি।

না ভাই। বাইরে থেকে আমি দেখতে অমন। খুব মোলায়েম সুরে দরিয়াবিবি জবাব দিল।

আপনি কষ্ট পান খামাখা। আমাকে বললেই হয়। পনেরো টাকা আমি মাস-মাস দেব। আপনি যাওয়ার সময় তিন মাসের আগাম চেয়ে নেবেন।

আল্লা তোমার মঙ্গল করুক, ভাই। ধনে-দৌলতে তিনি তোমাকে আরো বাড়ান। প্রায় গদগদভাবে দরিয়াবিবি উচ্চারণ করিল।

আপনার দোয়া। তারপর ইয়াকুব আবার নির্লজ্জের মতো তাকাইয়া বলিল, আপনার হাসির দাম লাখ টাকা।

খামাখা লজ্জা দাও, ভাই। আমরা গরিব-দুঃখী, আমাদের আবার হাসি– তার আবার দাম! ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া দরিয়াবিবি বাক্য সমাপ্ত করিল।

ইয়াকুব হাসি ছাড়িয়া বোধহয় আর কিছু মূল্য যাচাইয়ের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। দরিয়াবিবি তার সুযোগ দিল না। ওদিকে হাঁড়ি চড়িয়ে এসেছি, এঁচে গেল, গন্ধ উঠেছে– বলিয়া দরিয়াবিবি রান্নাঘরের দিকে ছুটিল।

ইয়াকুব দরিয়াবিবির ছন্দময় দেহাবয়বের দিকে পশ্চাৎ হইতে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল ও মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।

উপবাস এই সংসারে দরিয়াবিবির জন্য অচেনা কিছু নয়। মাঝে মাঝে কোনোদিন ক্ষুধার্ত ছেলে-মেয়েরা হাঁড়িতে ভাত থাকা পর্যন্ত আর ক্ষান্ত হয় না। দরিয়াবিবি তখন পরিবেশন করিয়াই খুশি। এই চালাকি মাঝে মাঝে ধরা পড়ে। তখন আমজাদ লজ্জিত হয়। নঈমা, শরীফা কি-বা বোঝে। আমিরন চাচির কাছে ধরা পড়িলে দরিয়াবিবি খুব বকুনি খায়। একদিন তো চাচি অভিমান করিয়া চলিয়া গেল। বলিয়া গেল, আমরা তো আত্মীয়-স্বজন নই, আমাদের কাছে কেন কিছু বলবেন, বুবু। দুমুঠো চাল কি তরকারী আমজাদকে দিয়ে আনালে কি আমি অসুবিধায় পড়তাম?

কিন্তু দরিয়াবিবি আরো অভিমানী। কোনো কিছু যাঞ্জার বেলা সে যেন মর্মে মর্মে মরিয়া থাকে। নিজের অতীতের দিকে চাহিয়া সে নিজেকেই আর বিশ্বাস করে না। আত্মবিশ্বাস ক্রমশ অন্তর্হিত হইয়াছে। পর্বে অন্নহীন দিন এমন বিষণা বোঝা মনে হইত না।

সেইদিন রাত্রে আমজাদ ও নঈমার জন্য দরিয়াবিবির ঠোঁটে আর ভাত উঠে নাই। সকালে শরীর বড় ঝিমঝিম করিতেছিল। ইয়াকুব আসিল সেই সময়। রাজগীর কমতি নাই তার। ভালো চাল, মাছ শাক সজি, ঘি কিছু বাদ পড়ে নাই তার আড়ম্বর-লীলায়।

দরিয়াবিবি অগত্যা রান্নায় বসিল। তারপর সকলের শেষ খাওয়া। দরিয়াবিবি অভুক্ত শরীরে সেদিন আহার করিল। রীতিমতো আহার। পর্বে অপরের দেওয়া অন্ন সম্মুখে, সে আসেকজানের চল্লিশার খাওয়ার কথা স্মরণ করিত। আজ অতৃপ্তির কোনো বালাই ছিল না। ক্ষুধার্ত জঠর বাকিটুকু পরিবেশন করিল।

দুপুরের পর আমজাদ চন্দ্ৰকাকার কাছে কাজের তল্লাশে গেল। নঈমা শরীকে কোলে করিয়া হাসুবৌর বাড়ি পৌঁছিল। আগের দিন বৌ তাহাদের দাওয়াত করিয়া গিয়াছিল। নূতন ছাঁচিলাউ কাটা হইয়াছে, ক্ষীর রান্না হইবে আজ।

হাতে বহু কাজ। হাঁড়িপাতিল মাজা হয় নাই, গৃহপালিত আগল-পাগলদের খবরদারী বাকি আছে। তবু ভরা খাটে খোয়ারী ধরিয়াছিল। একটু গড়াইয়া উঠিয়া পড়িবে, এই আশায় শোয়ামাত্র কিন্তু দরিয়াবিবির বেশ ঘুম পাইল। অভুক্ত শরীর মাঝে মাঝে যদি ছুটি চায়, তা বিচিত্র কিছু নয়।

বাইরে বৈশাখের উত্তপ্ত দিন। এখানে ঝোঁপ-জঙ্গল ভেদ করিয়া গরম ঝামাল আসে না। তাই ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা মনে হয়। জানালার পাশে কাঁঠাল গাছে ঘুঘু ডাকিতেছিল। একটানা স্বরে। আজ কোনো উদ্বেগ দরিয়াবিবির-ক্লান্ত ভার শরীরে হানা দিতে পারে না। বেশ ঘুম ধরিয়া গেল।

কিন্তু ঘুম তাহার আবার আচমকাই ভাঙিল। দরিয়াবিবি হঠাৎ অনুভব করে, কার যেন গভীর আলিঙ্গনে সে একদম নিষ্পিষ্ট। চোখ খুলিয়া দেখিল, ইয়াকুব। দরিয়াবিবি প্রথমে ঘরের খোলা টাটির দিকে চাহিল। বাঁশের দরজা খোলা ছিল, এখন বন্ধ। দরিয়াবিবির মনে হয় হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা হইয়া আসিতেছে তার সমস্ত শরীর। আর একজনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস শুধু নাকে লাগিতেছে। একবার উঠিতে গেল সে। কিন্তু দুর্দান্ত দৃঢ়তায় আর একজন তাহাকে সাপটিয়া বাঁধিতেছিল। নিস্তেজ নিথরতায় দরিয়াবিবি চুপ করিয়া রহিল। আর চোখ খুলিল। সে যেন অন্ধ হইয়া গিয়াছে। সমস্ত পৃথিবী তাহার নিকট নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে আবৃত।

বাহিরে পুত্র-হারা ঘুঘু জননী এক মনে শুধু ডাকিয়া খুন হইতে লাগিল।

.

৩৭.

সন্ধ্যায় আহারের সময় আমজাদ বলিল, মা, ইয়াকুব চাচা হঠাৎ চলে গেল। কাল তো যাবার কথা।

দরিয়াবিবি প্রথমে জবাব দিল না। পরে হঠাৎ আগুন হইয়া বলিল, খাচ্ছিস, খা। তোর আবার এত কথা কেন? আমজাদ মার দিকে একবার চাহিয়া আবার আহারে মনোনিবেশ করিল।

সকালে সে আবার বকুনি খাইল। বাড়ির পাঁদারে সকালে উঠিয়া আমজাদ দেখে, রান্না তরকারী নয়, শুধু-কাঁচা শাক-সজি পর্যন্ত পড়িয়া রহিয়াছে। কাল ইয়াকুব চাচা এইসব আনিয়াছিল, সে জানে। তাই তাড়াতাড়ি মার কাছে উধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া আসিল।

মা, আস্তাকুঁড়ে কত তরকারী কে ফেলে দিয়েছে তুমি দেখবে এসো।

দরিয়াবিবি হাঁস-মুরগিদের একমনে খুদ-কুড়া খাওয়াইতেছিল, সে যেন পুত্রের কথা শুনিয়াও শুনিল না।

পুত্র আবার এত্তেলা দিল।

দরিয়াবিবি তখন ধমক দিয়া বলিল, হাতে কাজ আছে দেখছিস নে? চোখ কি ফুটো হয়ে গেছে তোর?

আমজাদ মার থমথমে চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছিল, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন নয়।

তিন চার দিন আমজাদ নিরীহ ছেলের মতো ঘরে রহিল। মার এমন মূর্তি সে আর পূর্বে দেখে নাই। এমনভাবে কত দিন কাটিত কে জানে, আবার ইয়াকুব চাচার আগমনে সব শান্ত হইল। এবার সে একা আসে নাই। সঙ্গে পুত্র ও রসদসম্ভার আনিয়াছিল। তার ছেলের বয়স নয় কি দশ। আমজাদের প্রায় সমবয়সী। হঠাৎ পুত্র সঙ্গে কেন? দরিয়াবিবি অচেনা ছেলের সম্মুখে স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হইল, ইয়াকুবকে জিজ্ঞাসাবাদ করিল। দেবরের চাল বোঝার সাধ্যি দরিয়াবিবির নাই।

মোনাদির আবার পত্র লিখিয়াছিল। তাই পুত্রসহ বাড়ি ফেরার আগে দরিয়াবিবি ইয়াকুবের নিকট হইতে পনেরোটি টাকা চাহিয়া লইল।

আমজাদ বুঝিতে পারে, মার মেজাজ ঠিক হয় নাই। আজকাল সে বকুনি খায়, নঈমা–এমনকি শরী পর্যন্ত কান্নাকাটি করিলে প্রহার ভোগ করে। মা এমন ছিলেন না। একদিন সে আমিরন চাচির কাছে বেড়াইতে গিয়া অভিযোগ করিয়া আসিল।

কাজের চাপে কদিন আমিরন চাচি এই বাড়িতে আসিতে পারে নাই।

একদিন আসিয়া জেরা শুরু করিল, বুবু, তুমি নাকি ছেলেদের বড় মারধোর কর?

পোড়াজানে যদি মারধোর করি, কী অন্যায়টা করি? এগুলো মরলে আমার হাড় জুড়োয়।

আমিরন চাচি বাধা দিল, ছি ছি বুবু, এমন অপয়া কথা মুখে আনে! আমার একটা। সেও কম জ্বালায় না।

একটা আর দুটো। এরা জ্বালাতেই আসে। একজন তো মুখই আর দেখায় না। তার জন্য জ্বলছি। আর সঙ্গে যে কটা আছে, তারাও কম জ্বালাচ্ছে না। আল্লা এগুলো তুলে নিতে পারে না?

দরিয়াবিবি খুব অপ্রকৃতিস্থ। আমিরন চাচি কাজের বাহানায় সেদিন আর বেশিক্ষণ বাক্যালাপ করিল না। চলিয়া গেল।

দুপুরে কুঁড়া পায় নাই, উঠানে তাই কতগুলি মুরগি কটকট শব্দে কান ঝালাপালা করিতেছিল। দরিয়াবিবি ক্রোধে হাতের নাগালে পাওয়া একটি মুরগি ধরিয়া এক আছাড় দিল। আহত প্রাণী ঝটপট করিতে লাগিল।

নঈমা চোখে ভালো দেখে না, দাওয়ায় বসিয়াছিল। সে সেখানে হইতে বলিল, মা, মুরগি জবাই করছ? দরিয়াবিবি চিৎকার করিয়া উঠিল, দাঁড়া হারামজাদি, তোকে। জবাই করব।

আমজাদ এই সময়ে খেলা সারিয়া ফিরিতেছিল। সে মার হুঙ্কার শুনিয়া ধীরে ধীরে দহলিজের দিকে চলিয়া গেল। হাওয়া ফিরিলে, সেও ফিরিয়া আসিবে। আসিয়া বসিল আর নড়িতে চাহিল না। হাসুবৌর কাছে তো মোনাদির আর মুখ খুলিতে পারে না। হাঁ-না দিয়া জবাব দায়সারা করে। হাসুবৌ মোনাদিরের উদ্ধারে আসিল, চাচা, কথা বল, তুমি কেমন হয়ে গেছ।

মোনাদির মাথা হেঁট করিল। মার আদেশে সে আসিয়া চাচিকে সালাম করিয়াছিল। আর মুখ খুলিতে পারে নাই।

এমন লাজুক কেন, চাচা। আমিরন চাচি মোনাদিরের দিকে চাহিল।

পুত্রের বদলে জবাব দিল মা, বড় হয়েছে এখন সব বোঝে তো। মুরুব্বিদের সামনে কি বেশি কথা বলে? বেয়াদবী হয় যে!

তোমরা খেলা কর গে। যা, যা আম্বিয়া, যা। আমিরন চাচি মেয়েকে এক ঠেলা দিল।

 আমজাদ মুনিভাইয়ের সঙ্গ পাইলে আর কিছু চায় না। সে বলিল, চল দাদা।

এতক্ষণে মনমতো প্রস্তাব আসিয়াছে। মোনাদির সাড়া দিতে বিলম্ব করিল না। আম্বিয়া তখন সলজ্জ ধীরপদে অগ্রসর হইতে লাগিল। কয়েক মুহূর্ত পরে সে এক দৌড়ে আমজাদ ও মোনাদিরের পথে অদৃশ্য হইয়া গেল।  মেয়েরা হাসিয়া উঠিল। হাসুবৌ কহিল, চাচির মেয়ে একখানা। বড়া তাজা। দেখলে, কীভাবে দৌড় মারল।

যাক যাক। ও একটা জ্বালানি।

মেয়ের প্রশংসা মা সহ্য করিতে পারিল না।

বুবু, ছেলে এবার তোমার হল না? আমিও তো বলেছি, না এসে পারে?

আমার কোনো ভরসা নেই।

এমন অলক্ষুণে কথা মুখে এনো না।

দরিয়াবিবি কোনো জবাব দিল না, শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। চাচি আবার জিজ্ঞাসা করিল, কদিন থাকবে?

স্কুলের ছুটি আছে চারদিন। পরশু আবার চলে যাবে।

ও, বলিয়া আমিরন চাচি একটু চিন্তান্বিত হইল।

তোমরা খুব বুঝিয়ে বল, বোন। আবার যদি চলে যায়, আমি আর বাঁচব না।

হাসুবৌ ও আমিরন চাচি এক জোটে সায় দিল, নিশ্চয় বলব।

আম্বিয়া হি হি করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া আসিল। তার দিকে সকলের লক্ষ্য।

এই পোড়ামুখি, হাসছিস কেন?

আম্বিয়া মার মধুর সম্বোধনে হাসি ক্ষ্যান্ত দিল। পরে বলিল, মুনিভাই গাছে চড়ে গান ধরেছিল। হঠাৎ একটা বাঁদর দেখে নামতে নামতে কাঠপিঁপড়ে কামড়েছে। তাই হাসি।

আবার কোথা থেকে মড়ার বাঁদর এসেছে। গাছপালা রাখা দায়। সেদিন আমার শিমগাছ খেয়ে গেছে। আমিরন চাচি উঠানের গাছপালার দিকে তাকাইল।

কথায় কথায় বেলা শেষ। মোনাদির ফিরিয়া আসিলে আজ চাচি নানা উপদেশ দিলেন। আম্বিয়ার জড়তা কাটিয়াছে। সে সকলের সঙ্গে খুব চাকুম চাকুম শব্দে মুড়ি ও নাড় খাইল।

দরিয়াবিবি বলিল, অবেলাটা বড় সুখে কাটল আমিরন বোন।

আবার এসো মুনি চাচা। তুমি পরশু দিন সকালে যাবে, তখন আমি থাকব এই হতভাগীকে সঙ্গে নিয়ে। চাচি সহাস্যে মেয়ের দিকে আঙুল বাড়াইল।

হাসুবৌ শুধু বড় ম্রিয়মাণ। তার আবার শাশুড়ির ভয় জাগিয়াছে।

আজ আমিরন চাচি সকলের সঙ্গে সড়কের অনেক দূর পর্যন্ত আগাইয়া আসিল কথা বলিতে বলিতে। কথা আর ফুরায় না।

.

৪০.

 চন্দ্র কোটালের প্রস্তাব মোনাদিরের খুব ভালো লাগিয়াছিল। মুনি চাচা লেখাপড়া জানে, আমাদের গানের দলের অধিকারী হবে, আর সমস্ত গান লিখে রাখবে। আজকাল গেঁয়ো, সোজা গান বাবুরা পছন্দ করে না। চাচা ভাষা ঠিক করে দেবে?

কিন্তু যথাসময়ে মোনাদির চলিয়া গেল। এই বাড়িতে কেন যেন মন টেকে না। মাঝে মাঝে মায়ের হৃদয়ের উত্তাপহীনতা সে উপলব্ধি করিতে শিখিয়াছিল। এই তিনদিনেই সে বুঝিয়াছিল, মা আগের মতো তার জন্য আকুলি-বিকুলি করে না। দরিয়াবিবির আকস্মিক ব্যবহারে আমজাদ দুঃখ পাইত, মোনাদির বিস্মিত হইয়াছিল। কিন্তু কিশোরের মনে তার কোনো বিশেষ দাগ পড়িল না। যাওয়ার দিন দরিয়াবিবি বারবার অনুরোধ করিল, সে যেন ছুটি পাইলেই চলিয়া আসে।

হাসুবৌ ইদানীং এই বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত করে। কাছে সহানুভূতিশীল আর কোনো প্রতিবেশী নাই। বন্ধ্যা জীবনে জুলুম সহ্য করিতে হয়। এইখানে তবু মনের ভার হালকা করা যায়। দরিয়াবিবি এই নিরীহ সরল বধূটির প্রতি বড় স্নেহশীল। সাকেরের মা তাই লইয়া মনে মনে গজ গজ করিত, অবশ্য মুখে কিছু বলিত না। কারণ সাকের দরিয়াবিবির কথা সহজে অবেহলা করে না। দরিয়াবিবির খাতিরে সে তার মার সঙ্গে বিবাদ জুড়িতেও প্রস্তুত।

মোনাদির চলিয়া যাওয়ার দিন খুব সকাল সকাল হাসুবৌ এখানে আসিয়াছিল। অনেক বেলা হইয়া গেল, তবু বাড়ি যাওয়ার নাম নাই। দরিয়াবিবির সহিত এ কথা সে কথা ও গৃহস্থালীর ছোটখাটো কাজ করিয়া দিল।

বুবু, মন খারাপ কর না, এমন সোনার চাঁদ ছেলে। ও তোমার ছাড়া কার? এমন বহু সান্তুনা-বাক্য হাসুবৌর মুখে আজ যেন লাগিয়াই ছিল।

দরিয়াবিবি বড় বিষণ্ণ। কাজকর্ম করিতেছিল, কিন্তু সহজ কথোপকথনে তার মন। ছিল না।

বাঁশের একটি চুপড়ি ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। হাসুবৌর সহযোগিতায় দরিয়াবিবি তা মেরামত করিতে বসিল।

বুবু, আল্লার মরজি, তোমার শরীর বেশ আছে। তুমি বেশ মোটা হচ্ছ।

দরিয়াবিবি কোথায় কাপড় অসম্বৃত এই আশঙ্কায় নিজের দিকে চাহিয়া লইয়া জবাব দিল, লোকে বলে, আছে ভালো, কিন্তু ওদিকে শালুক খেয়ে যে দাঁত কালো তার খবর কেউ রাখে না।

হাসুবৌ চুপ করিয়া গেল। দরিয়াবিবির কণ্ঠে সৌহার্দ্যের লেশ ছিল না। যেন ঝগড়ার মুখে আর একজনের সঙ্গে সে কথা কাটাকাটি করিতেছে।

শাশুড়ির চিৎকার শোনা গেল। হাসুবৌ হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। দরিয়াবিবির যেন তার উপর কত খাপ্পা। হাসুবৌ তাই ভয় পাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, এখন যাই, বুবু।

দরিয়াবিবি নিজের মনে একটি কঞ্চি ফাড়িতে লাগিল। কোনো জবাব দিল না হয়ত শুনিতে পায় নাই। সে নিজের কাজে মগ্ন। হাসুবৌ অপরাধীর মতো বিদায় লইল।

সেদিন বিকালে ইয়াকুব আসিল। সঙ্গে পুত্র। তাহাকে দরিয়াবিবির কাছে রাখিয়া চলিয়া গেল। আবার দুদিন পরে আসিবে সে।

সমগ্র পরিবারের রসদ দিয়া গিয়াছে, দরিয়াবিবির কোনো অসুবিধা ছিল না। নিজের ছেলে আজই প্রবাসী, আবার পরের সন্তান ঘাড়ে। কিন্তু দরিয়াবিবি কোনো অবহেলা দেখাইল না। ছেলেটার নাম ওয়ায়েস। বেশ ফুটফুটে কথা বলে। আর বড় সুন্দর জবাব দিতে পারে। দরিয়াবিবি মানসিক ভার কাটাইবার উদ্দেশ্যে ছেলেটিকে ইয়াকুবের অন্দর মহলের অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল।

তোমার দুই মা, না?

হ্যাঁ, চাচি। ছোটমা আর বড়মা। আমি বড় মায়ের ছেলে। আমরা দুভাই।

তোমার ছোটমা কেমন?

খুব ঝগড়া করে মায়ের সঙ্গে বাপের সঙ্গে।

তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে?

হ্যাঁ। আজ ঝগড়া হয়েছে। তাই আমাকে বাপ নিয়ে এল।

ঝগড়া হল?

 রোজ ঝগড়া হয়। আজকাল বাপ ঘরে থাকে না।

কোথায় থাকে?

দহলিজে ঘুমায়। আর বাপের অসুখ আছে। শরীর খারাপ।

দরিয়াবিবি চুপ করিয়া যায়। ছেলেটিকে নিজের পাশে শোয়াইয়া আরো তথ্য সংগ্রহ করিল। ইয়াকুবের অন্দর মহল একটি দোজখ। মোটামুটি গ্রাম্য জীবনের সচ্ছলতা আছে, তাই বাড়ির মেয়েরা রান্না-খাওয়া ছাড়া বেকার। টাকার গরম, শাড়ির গরম দেখাইতে পরস্পরে হিংসা, ঝগড়া। এইটুকু ছেলেও কেমন কূটচক্রের ইতিহাস জানে।

দুদিন পর ইয়াকুব ছেলেটিকে লইয়া যাইবার সময় বলিল, দরিয়াভাবী (আর ভাবী সাহেব বলে না) ছেলেটাকে এনে রেখে দেব। ওখানে থাকলে আর মানুষ হবে না।

কথার জবাব দিতে হয়, আমজাদ সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। দরিয়াবিবি বলিল, তোমার পাকা বাড়ি, এখানে বাঁশের ঘরে কেন?

সেখানে ছেলেগুলা মার জন্য খারাপ হবে। খালি কিচামিচি ঝগড়া-ঝাটি।

দরিয়াবিবি আর কোনো জবাব দিল না।

ইয়াকুব পুত্রকে লইয়া পথাভিমুখী হইল। আমজাদের সঙ্গে ওয়ায়েসের খুব খাতির জমিয়াছে। সেও পিছন পিছন গেল।

একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মা, তোমাকে পনেরো টাকা দিয়েছে। ভুলে গিয়েছিল। ওয়ায়েসের বাপ বললে।

মুনি মাত্র দুটাকা সঙ্গে নিয়ে গেছে। কালই টাকা পাঠিয়ে দিতে হয়। মনে মন দরিয়াবিবি সাত-পাঁচ ভাবিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *