৩৬. মিসেস হারবার্টের কথাটা

৩৬.

মিসেস হারবার্টের কথাটা রেমি ঠিক বুঝেও বুঝতে পারছে না যেন। কিং জুন? মানে কিং রিচার্ডের ভাই কিং জন?

হ্যাঁ, গ্রেস হারবার্ট বললেন।

আমার জানামতে তো সেই সম্পদের পরিমাণ প্রচুর, রেমি বলছে। প্রায়। সত্তর মিলিয়ন পাউন্ডের মতো।

 কিন্তু গল্পগুলো তো সত্য না, তাই না? এই গল্প কেউ বিশ্বাসই বা করবে কেন?

 বলা কঠিন, স্যাম বলল। আপনি কি গল্পটা একটু বলতে পারবেন? আপনার যতটুকু মনে আছে ততটুকুই বলেন।

হুমম…, বলে স্যামের দিকে তাকালেন মহিলা। এগুলো আসলে অনেকটা ফেয়ারিটেলসের মতো। ইংল্যান্ডকে বাঁচানোর জন্য উইলিয়াম দ্য মার্শালকে রাজ্যের সম্পদ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিং জন। কথিত আছে এই সম্পদটা নাকি এক জলার ধারে হারিয়ে গিয়েছিলো। আর সত্যটা হলো তরুণ রাজকুমারকে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য লুকিয়ে ফেলা হয়েছিলো এই সম্পদগুলো, বা এরকমই কোনো এক কারণ ছিলো। আমি আসলে কখনোই গল্পগুলোর প্রতি অতোটা মনোযোগ দেইনি। শৈশবে আমার কাজিনদেরকে এটুকুই বলতে শুনেছিলাম।

আপনার কাজিনদের এখন কী অবস্থা? রেমি জানতে চাইলো।

কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো জন দশবছর আগে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আর ছোটোজন মারা গেছে গতবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।

 এছাড়া আর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই? স্যাম জিজ্ঞেস করলো। অন্য আর এমন কেউ কি আছে যে এই গল্পটা শুনেছে?

 না। আমার ভাইদের কারোরই নিজের সন্তান ছিলো না। আর আত্মীয় বলতে আমি শুধু নটিংহ্যামের ঐ কাজিনের কথাই জানি… বাক্যটা শেষ করার আগেই থেমে গেলেন মহিলা। ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবছেন। তারপর বলে উঠলেন, সত্যি বলতে, আরেকজন আছে। মেজ ক্রাওলি, আমার কাজিনের প্রাক্তন-স্ত্রী। তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ডিভোর্সের পর থেকে আসলে অনেক বছর ধরেই তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আমার। নরফোকের দিকে থাকে খুব সম্ভবত। আপনাদের দরকার লাগলে তার ঠিকানাটা খুঁজে দেখতে পারি।

ঠিকানাটা দিলে খুবই উপকার হবে আমাদের, স্যাম বলল।

কিছুক্ষণের মধ্যের মেজ ক্রাওলির ঠিকানাটা খুঁজে পেলেন মিসেস গ্রেস হারবার্ট-মিলার। কিংস লিনে থাকেন মহিলা। ঠিকানা নিতেই নিতেই পুলিশ অফিসারও এসে হাজির হলো খামারে। স্যাম অফিসারকে তার স্টেটমেন্ট দিলো, সাথে সাথে কেস নিয়ে তদন্ত করা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দার কথাও জানালো অফিসারকে।

সব শুনে অফিসার তার নোটবুক থেকে চোখ তুলে তাকালো স্যামের দিকে। আপনি নিশ্চিত আপনাদের ঘটনাটার সাথে চুরির কোনো সম্পৃক্ততা আছে? আপনি তো বললেনই যে, মিউজিয়ামেই ফিস্ক তার জিনিসটা পেয়ে গেছে। পেয়ে যাওয়ার পরও এখানে আসবে কেন?

আমরা যেন জিনিসটা খুঁজে না পাই সেটা নিশ্চিত করা জন্য।

শুনে দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে দেয়ালের শূন্যস্থানটার দিকে তাকালো অফিসার। তারপর গ্রেস হারবার্টকে জিজ্ঞেস করলো, মূল্যমান কেমন ঐ ঢালটার?।

জবাবটা দিলো রেমি। পুরোনো আর্টিফ্যাক্ট। অন্য কারো কাছে এটার মূল্য না থাকলেও, মিউজিয়ামের কাছে এটা অমূল্য সম্পদ।

 ইতিহাস। জানি না ইদানিং সবাই এই ইতিহাস নিয়ে এতো মেতে আছে। কেন, বলতে বলতে সবগুলো তথ্য নোটবুকে লিখে নিলো অফিসার। লেখা শেষে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু জানতে পারলে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো আমি।

ধন্যবাদ, বলে অফিসারকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলেন গ্রেস হারবার্ট। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলেন বৈঠকখানায়।

মহিলায় ফিরে আসতেই রেমি বলল, আশা করছি আমাদের ক্ষমা করবেন আপনি। শুরু থেকেই আপনার সাথে পুরোপুরি সৎ থাকতে পারিনি আমরা। অবশ্য সত্যি বলতে, আমরা নিজেরাও শুরু থেকে অতোটা জানতাম না।

 আমি যদি জানতাম এমন কিছু হতে পারে, তাহলে অন্য জিনিসগুলোর সাথে ঢালটাও মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দিতাম, বলে মচকি হাসলেন মিসেস গ্রেস হারবার্ট-মিলার। আমার মনে হয় আপনাদেরও আর কিছু জানার নেই এখানে? যে ধকল গেলো, এখন আমার সাধারণ জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারলেই খুশি হতাম।

কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো স্যাম ও রেমি। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো ওরা।

মিসেস গ্রেস হারবার্টও এগিয়ে আসছেন তাদের সাথে সাথে। যদি আপনারা কিছু খুঁজে পান, তাহলে অবশ্যই মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দিয়েন ওগুলো। আমাকে কিছু দিতে হবে না। আমার যা আছে তা দিয়ে খুব সুখে শান্তিতেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।

 মিসেস হারবার্ট-মিলারকে আরো একবার ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো ওরা। গাড়িতে উঠেই মেজ ক্রাওলির ঠিকানাটা রেমির দিকে বাড়িয়ে দিলো স্যাম। কিংস লিন। প্রায় সাড়ে তিন-চার ঘন্টার যাত্রা। অনেক সময়।

হোক, আমার সমস্যা নেই তাতে। তোমার ব্যাপারে জানি না, তবে আমার আজ সারাদিনে অন্য কোনো কাজ নেই।

 আমারও নেই, বলে ঘড়িতে সময় দেখে গাড়ি চালু করলো স্যাম। সেলমা হয়তো এতোক্ষনে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তাকে কল দাও। আশা করছি আমাদের তোলা ঐ ছবিগুলো ও কাজে লাগাতে পারবে।

শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে জিপিএস ডিরেকশনটা সেট করে নিলো রেমি। তারপর স্পিকার অন করে সেলমাকে কল করে বলল, বেশ কিছু কাজ করতে হবে তোমাকে। প্রথমত, আমরা কিংস লিনের দিকে যাচ্ছি। তো, থাকার জন্য জায়গা ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

ওকে, লেগে যাচ্ছি কাজে। স্যাভয়র স্যুইট কি ছেড়ে দিবো তাহলে?

না, ওটা ওভাবেই থাকুক। কিংস লিনে তো আর বেশিদিন থাকবো না, বলে এরপর গ্রেসের থাকা জানা পারিবারিক ইতিহাস এবং কিং জনের সম্পদের ব্যাপারে পাওয়া সবগুলো তথ্যই সেলমাকে জানিয়ে দিলো রেমি।

যত যাই হোক, স্যাম বলল, এখন ঐ চামড়ার ঢালের ওপরই বেশি আগ্রহ আমার। বিশেষ করে ঢালের কেন্দ্রে থাকা ঐ বৃত্তটার ওপর। আমাদের পাঠানো ঢালের ঐ ছবিগুলো দিয়ে কি কোনো কাজ করা যাবে?

দাঁড়ান, একটু দেখে নিই।

সেলমার সাথে সাথে রেমিও তাদের তোলা ছবিগুলো আরেকবার দেখে নিচ্ছে। তাদের তোলা ছবিগুলোর কিছু হয় ফ্ল্যাশের কারণে ঝলসে গেছে, নয়তো আলোর অভাবে বেশি কালো হয়ে আছে। প্রথমদিনের মতো এবারও তার নজর পড়লো ঢালের কেন্দ্রে থাকা কেল্টিক নকশাটার ওপর। বৃত্তের সীমানায় থাকা ছোটো রুনের মতো চিহ্নগুলোকে প্রথম দেখায় কেল্টিক নকশার বর্ধিত অংশ বলেই মনে হয়েছিলো। হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই নকশাটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে সাইফার কোডটা কারো নজরে না পড়ে। চোখের সামনেই লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা। হাজার হোক, একটা পুরোনো চামড়ার ঢালে চোখ বুলাতে যাবে কে?

ছবিগুলো দেখলাম, সেলমা বলল।

পরীক্ষা করে দেখো ওগুলো, স্যাম বলল। খুব সম্ভবত ওটাই আমাদের সাইফার হুইল।

কিছুক্ষণ কোনো জবাব দিলো না সেলমা। তারপর বলল, এটা নিশ্চিতভাবেই অনেক কিছু বদলে দিচ্ছে।

কপাল খারাপ যে এটা এখন হারিয়ে গেছে, স্যাম জানালো। এজন্যেই তোমাকে কল করেছি। তুমি কি ছবিটা জুম করে বৃত্তের সীমানায় থাকা চিহ্নগুলো পড়তে পারবে?

আচ্ছা, পিট আর ওয়েন্ডির যোগাযোগ করছি। ছবি জুম করায় তাদের দক্ষতা ভালো।

ওকে, তাই করো। দ্রুত ফলাফল জানিয়ো আমাদেরকে, বলল স্যাম।

****

কিংস লিনের সাউথ গেটে গিয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় বিকেল চারটার মতো লেগে গেলো তাদের। কিংস লিন একসময় ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দরের একটা ছিলো। শতবর্ষী পুরোনো দালান এবং খোয়া বিছানো রাস্তাটা যেন সেই সময়েরই ছাপ প্রকাশ করছে।

শহরের অন্যান্য আরো কয়েকটি দালানের মতো মেজ ক্রাওলির বাড়িটাও তৈরি করা হয়েছিলো সেই পুরোনো সময়কালেই। বাড়ির সামনের ইটের গেটে নেমপ্লেট অনুযায়ী ১১০০ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়েছিলো এই বাড়িটা। মুগ্ধ হয়ে বাড়িটার দিকে তাকালো রেমি। বাড়ির ছাদের চিমনির ছিদ্র দিয়ে ধোয়ার পাক বেরুতে দেখে আশা করলো যে মহিলা হয়তো এখন বাড়ির ভিতরেই আছেন।

গাড়ি থেকে নেমে খোয়াবিছানো চত্বরটা পেরিয়ে দরজায় টোকা দিলো স্যাম। টোকা দেওয়ার কিছুক্ষণ পর বাদামি-চুলো এক স্থূলকায় মহিলা দরজা খুলে এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। মহিলার বয়স প্রায় গ্রেসের বয়সের কাছাকাছিই হবে। চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলা।

স্যাম আলতো হেসে মহিলাকে বলল, আমরা মেজ ক্রাওলির কাছে এসেছিলাম।

আমিই মেজ ক্রাওলি।

গ্রেস হারবার্ট-মিলার আপনার ঠিকানাটা দিয়েছেন আমাদের। তিনি বলেছেন আপনি হয়তো একটা পুরোনো পারিবারিক কিংবদন্তির ব্যাপারে কিছু জানেন। কিং জনের সম্পদ রক্ষার কিংবদন্তিটা নিয়ে।

শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন মহিলা। মহিলাকে একদম চুপ করে যেতে দেখে রেমি ভাবছে মহিলা হয়তো এখনই তাদেরকে ধাপ্পাবাজ ভেবে তাড়িয়ে দিবেন। কিন্তু তার বদলে হাত নেড়ে তাদেরকে ভিতরে ঢোকার ইশারা করে বললেন, জানতাম যে কেউ না কেউ একদিন অবশ্যই এটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসবে।

.

৩৭.

আমি কি জানতে পারি আপনারা কেন তাদের ব্যাপারে খোঁজ করছেন? মানে গ্রেস আর…? বলে মুচকি হাসলেন মহিলা। আশা করছেন যে স্যাম ও রেমিরা শূন্যস্থানটা ভরাট করে নিতে পারবে।

জবাবটা দিলো স্যাম, মিসেস হারবার্ট বলেছেন আপনি পারিবারিক কিংবদন্তি টার সম্পর্কে জানেন! মানে কিং জনের গুপ্তধনের কিংবদন্তিটার সম্পর্কে।

হা, জানি। তবে বড় প্রশ্ন হলো আপনারা কেন খোঁজ করছেন ওটার?

কেউ একজন মিসেস হারবার্টের বাড়ি থেকে সদ্যই উত্তরাধিকারে পাওয়া একটা আর্টিফ্যাক্ট চুরি করে নিয়ে গেছে। আমাদের ধারণা ওটার সাথে কিংবদন্তিটার সম্পৃক্ততা আছে।

মানে গুপ্তধনের সাথে সম্পৃক্ততা আছে?

 হ্যাঁ, বলল স্যাম।

কিছু না বলে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস ক্রাওলি। তারপর বললেন, আপনারা যদি আপনাদের আগ্রহের কারণটা ভেঙে বলতেন, তাহলে হয়তো আমি সাহায্য করতে পারতাম।

আমরা গুপ্তধন শিকারি, স্যাম বলল।

গুপ্তধন শিকারি? অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন মিস ক্রাওলি।

 নিজেদের লাভের জন্য করি না কাজটা, রেমি বলল। আমরা প্রাপ্ত সম্পদগুলো হয় কোন দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে দিই, অথবা সঠিক মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিই। ইন্টারনেটে ঢুকলেই আমাদের সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে পারবেন।

 ওসব তথ্য যে সত্য তাই বা আমি বুঝবো কী করে? এখনকার যুগে ওয়েব পেজ বানানো খুব কঠিন কিছু না, মিসেস ফার্গো।

বুঝবেন, কারণ- বলতে গিয়েও থেমে গেলো রেমি। আসলেই বলার মতো কিছু নেই তার। দুঃখিত, আমাদের মুখের কথাই বিশ্বাস করতে হবে আপনাকে।

আরো কিছুক্ষণ চুপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস ক্রাওলি। তারপর বললেন, আমি নিজেকে মানুষ চেনায় দক্ষ বলে ভাবতে পছন্দ করি। আশা করছি আপনারা আমাকে ভুল প্রমাণ করবেন না। কী কী জানতে চান আপনারা?

জবাবে স্যাম বলল, হারবার্ট পরিবারের সাথে গুপ্তধন সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানার প্রতিই আমাদের আগ্রহ বেশি।

 তথ্যগুলো একসাথে জড়ো করে রেখেছিলাম আমি। একটু অপেক্ষা করুন, আমি ওগুলো খুঁজে বের করে নিয়ে আসছি, বলে সিঁড়ি ধরে ওপরতলায় চলে গেলেন মিস ক্রাওলি। কয়েকমিনিট পর একটা ম্যানিলা খাম নিয়ে ফিরে এলেন আবার।

পাঠ্যক্রম? মহিলার হাত থেকে খামটা নিয়ে খুলে ভিতরের কাগজটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল স্যাম।

 হ্যাঁ, এই বিষয়ের ওপর একটা বই লিখার পরিকল্পনা করেছি আমি। ওটারই একটা খসড়া এটা। আমি একজন লাইব্রেরিয়ান। আমি যে লাইব্রেরিতে কাজ করি সেখানে প্রতিমাসেই ইতিহাসে আগ্রহীদের একটা গ্রুপ মিটিং হয়। কয়েকবছর আগে গ্রুপের এক মিটিংএ আমি কিং জনের ব্যাপারটার ওপর একটা গবেষণাপত্র উত্থাপন করেছিলাম। ভেবেছিলাম গবেষণাটা হয়তো সবাই উষ্ণভাবে নিবে। তবে, নাইজেল রিজওয়েল নামের গ্রুপ মেম্বারদের একজন এতে অহোটা মুগ্ধ হতে পারেনি। নাইজেল রিজওয়েল এক স্থানীয় কলেজের সাবেক ভাষাবিদ ও ইতিহাস অধ্যাপক। তার মতে আমার গবেষণাটা নাকি ইতিহাস পরিবর্তন বা সংশোধনের অপচেষ্টা। ভদ্রলোক বেশ অভিমানও করেছিলো এতে।

দুঃখজনক, রেমি বলল। আপনি ভালো করে ভাবলেই দেখবেন যে কিং জনের গুপ্তধনের কিংবদন্তির চেয়ে বড়ো ইতিহাসের পরিবর্তন তো আর কোনোটাই হতে পারে না।

একদম ঠিক বলেছেন। আমারও একই মত, বললেন মিস ক্রাওলি। অবশ্য আমি বেশি চমকেছি আরো পরে, যখন নাইজেলকে আমার গবেষণা ও কাজের ওপর ভিত্তি করে নিজের নামে বই প্রকাশ করতে দেখে। শুধু তাই নয়, তার এক ক্লাসের কোর্সের জন্য আমার পাঠ্যক্রমও চুরি করে নিয়েছিলো। তবে এতে বেশি সুবিধা করতে পারেনি। সত্যটা জানাজানি হয়ে যেতেই কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয় তাকে। তার জন্য বেশ খারাপ লাগে আমার, তবে তাকে তো আর আমার কাজ চুরি করতে দিতে পারি না আমি।

খুবই স্বাভাবিক এটা, বলল স্যাম।

শিক্ষকতার চাকরি হারানোর পর এখন ট্যুর গাইডের কাজ বেছে নিয়েছে ও। আমাদের গ্রুপের আরেক সদস্যের থেকে জানতে পেরেছি, ভ্রমণকারীদের কাছে সে এখনো আমার তথ্যগুলোকে গুপ্তধনের কিংবদন্তির অনেকগুলো গল্পের একটি হিসেবে বর্ণনা করে।

সাধারণ জনগণ সত্যিই কিংবদন্তির গল্প পছন্দ করে, বলল রেমি।

হ্যাঁ, আসলেই। একবার ভেবেছিলাম আমি তাকে থামতে বলবো, পরে ভাবলাম একটা মানুষকে তার বিপদের সময় আর কতোটাই বা বিপদে ফেলা যায়?

কাগজগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে স্যাম বলল, আপনি কি পুরোটা একটু সংক্ষেপে বলতে পারবেন?

সহজে বললে, হারবার্টরা পেমকের প্রথম আর্ল উইলিয়াম দ্য মার্শালের বংশধর। রাজকুমারকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কিং জুন তার রাজসম্পদ লুকানোর দায়িত্ব দিয়েছিলো উইলিয়ামকে। জলের ধারে সম্পদের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটা আসলে রটানো হয়েছিলো আসল ঘটনাটা লুকানোর জন্য।

রেমির হাতে কাগজগুলো তুলে দিয়ে স্যাম জিজ্ঞেস করলো, আর আপনার ধারণা আপনি জানেন আসলে কী ঘটেছিলো?

কাগজেই পুরোটা বর্ণনা করা আছে। উইলিয়াম পেমব্রুক সম্পদগুলো কোনো গুপ্তজায়গায় লুকিয়ে ফেলেছিলো। আর এই গুপ্ত তথ্যটা রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছিলো তার বাছাইকৃত বংশধরদের ওপর। পেমব্রুকের ছেলেরা মারা যাওয়া পর গুপ্ত তথ্যটা রক্ষার দায়িত্ব পড়ে তার মেয়ে মাওদ ডি ব্রুজের ওপর, সেখান থেকে এটা রক্ষার দায়িত্ব বর্তায় ব্রুজের ছেলে এডমুন্ড মর্টিমারের ওপর। এডমুন্ড মর্টিটার এই তথ্যের কপি তৈরি করে একটা দেয় তার বৈধ সন্তান রজার ডি মর্টিমারকে এবং আরেকটা দেয় তার অবৈধ ছেলে স্যার এডমুন্ড হারবার্টের কাছে। যেটা সত্যি বলতে বেশ বুদ্ধিমানের একটা কাজ ছিলো বলেই ধরা হয়। মর্টিমারের বৈধ ছেলে রানি ইসাবেলার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং ফলাফলস্বরূপ একসময় প্রাণ হারায়, বলতে বলতে মৃদু হেসে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন মিস ক্রাওলি। খুব সম্ভবত মর্টিমার তার ছেলের ব্যাপারে জানতে এবং বুঝতে পেরেছিলো যে তার অবৈধ ছেলেই বেশি সৎ। তবে এটা শুধু গুপ্ততথ্যটা কার হাত থেকে কার কার গেছে তারই ইতিহাস মাত্র; সম্পদগুলো কোথায় লুকানো আছে তা কিন্তু জানা যায়নি কোথাও থেকে।

মহিলার কথা শেষ হতেই রেমি খামটা দেখিয়ে বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি আমরা এটা ধার নিতে পারি? কপি করেই আবার আপনাকে ফিরত দিয়ে দিবো।

ওটার দরকার নেই। আমি যতোই এই গল্প নিয়ে মেতে থাকি না কেন, এটা আমার বলার গল্প না। গল্পটা বলার দায়িত্ব আমার প্রাক্তন স্বামী হেনরি ম্যাকগ্রেগর এবং তার কাজিন গ্রেসের। যদিও তাদের কারোরই এটার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। বছরের পর বছর ধরেই আমার কাছে পড়ে আছে এটা। এখন এটা আপনাদের। নিশ্চিতভাবেই গ্রেস আপনাদেরকে বিশ্বাস করে, নাহলে সে কখনোই আপনাদেরকে আমার কাছে পাঠাতো না। কী খুঁজে পেলেন আমাকে শুধু সেটা জানালেই চলবে।

অবশ্যই জানাবো। সাহায্যের জন্য আরো একবার ধন্যবাদ আপনাকে।

বলে মিস ক্রাওলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। গাড়িতে উঠেই খাম থেকে আবারো কাগজগুলো বের করে আনলো রেমি। অনেক অনেক তথ্য রয়েছে এখানে।

তবে কাজে লাগার মতো তেমন তথ্য কিন্তু পাওয়া যায়নি, বলল স্যাম।

এখানে সাইফার হুইলের একটা অরিজিনাল কপি থাকলে বেশি ভালো হতো, কাগজের পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে বলল রেমি? সেলমাকে এটা দেখানো উচিৎ আমাদের। কয়েকজন মিলে দেখলে হয়তো কিছু না কিছু জানা যাবে এখান থেকে।

হোটেলে পৌঁছেই কাগজগুলো স্ক্যান করে সেলমাকে ইমেইল করে দিলো রেমি! হোটেল রুমটাও সেলমাই বুক করে দিয়েছে তাদের জন্য। অবশ্য ইমেইল পাঠিয়ে তারা নিজেরাও অবসরে বসে নেই। তারাও কাগজের গাদাগুলোর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে একবার একবার করে।

কাগজগুলো পড়তে পড়তে রেমি বলল, এডমুন্ড মর্টিমার যদি গুপ্ত তথ্যটা তার দুই ছেলের মধ্যে বন্টন করে দিয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু সাইফার হুইলগুলোর একটার হারিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা পাওয়া যায়।

কথাটা শুনেই স্যাম তার ভাগে থাকা কাগজগুলোর ওপর থেকে চোখ তুলে তাকালো রেমির দিকে। মিউজিয়ামে মর্টিমারের অবৈধ ছেলের ডিসপ্লেতে থাকা লেখাটার কথা কি মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ, মনে আছে।

আর রাজার একসময়ের প্রেমিক যে পরবর্তীতে জলদস্যুতার পথ বেছে নিয়েছিলো তার কথা?

হ্যাঁ, হিউ ডেসপেন্সর। এবং তার অবৈধ ছেলে ব্রিজম্যানের কথাও মনে আছে।

এভেরির পূর্বপুরুষকে কি আর এতো সহজে ভুলা যায়? বলে আবারো কাগজের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো স্যাম। মর্টিমারদের ওপর রাজা কোনো কারণে ক্ষেপে ছিলো, তাই না? খুব সম্ভবত ডেসপেন্সর মর্টিমারদের থেকে কিছু একটা চুরি করে নেওয়ার কারণেই তাদের ওপর রাজা ক্ষীপ্ত হয়েছিলো।

হ্যাঁ, এটাই, বলল রেমি। ডেসপেন্সর মর্টিমারদের থেকে সাইফার হুইলের একটা কপি চুরি করেছিলো। সেটাই কয়েকশো বছর পর সমুদ্রের তলায় হারিয়ে গেছে।

 এভেরির এটা ফিরে পাওয়ার মোহের কারণটা কিন্তু এখন ভালোভাবেই বুঝা যাচ্ছে।

এটা আসলে তার মোহের একটা অংশ মাত্র। আমি নিশ্চিত যে সে নিজেই এই গুপ্তসম্পদটা খুঁজে বের করতে চাচ্ছে।

ভালো বলেছো, বলে কাগজগুলো আবার একত্র করে খামে ঢুকিয়ে রাখলো স্যাম। তারপর বলল, আশা করছি এভেরি খুঁজে পাওয়ার আগেই আমার খুঁজে পাবো গুপ্তধনটা।

****

পরদিন খুব সকালে অফিস ডেস্ক থেকে সেলমা স্কাইপেতে ফোন করলো তাদেরকে। ওয়েন্ডি আর পিট ছবিগুলো কিছুটা জুম করতে পেরেছে, আর লাযলো এখন ম্যাপের অর্থ বের করার কাজ করে। বলে এডিট করা ছবিটা পর্দার সামনে তুলে ধরলো সেলমা। ছবির একটা অংশ আলোর অভাবে এখনো অনেকটা কালো হয়ে আছে। আলোটা খুব ভালো ছিলো না। এডিট করার পরও খুব একটা পরিষ্কার হয়নি। যাই হোক, তারপরও কয়েকটা চিহ্ন মোটামুটি স্পষ্টভাবেই পড়া যাচ্ছে এখন। যদিও এগুলোর অর্থ কী তার ব্যাপারে নিশ্চিত না আমরা।

মোদ্দা কথা হলো…? রেমি জানতে চাইলো।

এটার ওপর এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। লাযলো অর্থ বের মোটামুটি কিছুটা চেষ্টা করেছে, তবে অনুবাদের ফলে মূল অর্থ বিকৃত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

ঠিক তখনই পর্দায় লায়লো ভেসে উঠতে দেখা গেলো। সেলমা ঠিকই বলেছে। তবে আশা করছি অর্থ খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। উত্তর আমেরিকার বদলে আপনাদের দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠানোর মতো অতোটা বদলায়নি অর্থ।

কথাটা শুনেই একজন আরেকজনের দিকে তাকালো স্যাম ও রেমি। তারপর আবার পর্দার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে স্যাম বলল, আমাদের কি এখন দক্ষিণ আমেরিকায় যেতে হবে?

আরে না, বলল লাযলো। আমি শুধু অনুবাদের ভুলের প্রভাব কী হতে পারে তার একটা উদাহরণ দিচ্ছিলাম মাত্র। মানে অতোটা বড়ো ভুল হবে না আর কী।

তো আমরা কোথায় যাচ্ছি এবার? রেমি জানতে চাইলো।

 ভালো প্রশ্ন। যদি মিস ক্রাওলির তথ্যগুলো নিখুঁত হয়ে থাকে… যদিও মহিলা এগুলো গবেষণা করেই সংগ্রহ করেছেন, তারপরও ভিত্তিটা কিন্তু সেই শৈশবের গল্পই, তাই কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত…

ওটা জানি আমরা, লাযলোকে থামিয়ে দিয়ে বলল স্যাম।

যাই হোক, মহিলার তথ্যগুলো সঠিক হয়ে থাকলে, এখন আপনাদেরকে নাইজেল রিজওয়েলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

রিজওয়েল? স্যাম বলল। তুমি নিশ্চিত?

 মোটামুটি। পুরোনো ইংরেজির ওপর ভালো দক্ষতা আছে লোকটার। প্রাক্তন অধ্যাপক। ম্যাপ থেকে আমি যা যা ডিসাইফার করেছি, তার অর্থ বের করতে ভদ্রলোকের সাহায্য লাগবে আপনাদের। অবশ্য, আপনারা অন্য কোনো বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলে আলাদা কথা।

 ইন্টারেস্টিং বলল স্যাম। সত্যি বলতে, এই নাইজেল রিজওয়েলই মেজ ক্রাওলির গবেষণা চুরি করেছিলো।

.

৩৮.

হোটেলের লবিতে আলেক্সান্দ্রা এভেরিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রচণ্ড চমকে গেছে কলিন ফিস্ক। মহিলাকে দেখে কোনোরকমে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, মিসেস এভেরি? আমি জানতামই না যে আপনি লন্ডনে আছেন।

 আসলেই জানতে না তুমি, মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বলল আলেক্সান্দ্রা। আমি চমক পছন্দ করি খুব। তুমি করো না?

 এখানে কী করছেন আপনি?

আমার মনে হয় তুমি যে কারণে এসেছো, আমিও একই কারণে এসেছি। আমার স্বামীর মতো আমিও রহস্যময় ঐ গুপ্তধনটা খুঁজছি। তো, কতোটা এগুলে?

এই তো কিছুটা এগিয়েছি মাত্র।

হুমম। আর ফার্গোদের ব্যাপারটা বলো? তারা নিশ্চয় তোমার পথে খুব বেশি বাগড়া দিচ্ছে না?

 আপাতত কয়েকদিন আর বাগড়া দিবে না। আলেক্সান্দ্রা ফার্গোদের ব্যাপারে জানে দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত বোধ করছে ফিস্ক। যদিও সে ভালো করেই জানে যে তার এখন একেবারেই চমকানো সম্ভব না। চার্লস এভেরির অধীনে কাজ করার সময় থেকেই ফিস্ক জানে, মহিলা খুব একটা সামাজিক প্রকৃতির মানুষ না। অন্ততপক্ষে চার্লস এভেরি যতোটা বলে দাবি করে ততোটা না। মি, এভেরি কি আপনার ব্যাপারে জানেন?

শুনে হেসে উঠলো আলেক্সান্দ্রা। একদমই না। আমি চাই সে যেন সবসময়ই আমার থেকে এক কদম পিছনে থাকে। যাই হোক, আমি আসলে এখানে এসেছি তোমার সাথে কথা বলতে। আমাকেও তোমার এডভেঞ্চারের অংশ করে নাও। নাহলে মিশন পরিচালনার জন্য চার্লস তোমাকে যে ফান্ড থেকে টাকা দিচ্ছে সেটা কিন্তু হুট করেই বন্ধ হয়ে যাবে। বলে মিষ্টিভাবে হাসলো আলেক্সান্দ্রা। আমার মনে হয় সে তোমাকে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আটকে দেওয়ার কথাটা বলেছে?

হ্যাঁ, বলেছে।

সে হয়তো এটা বলেনি যে তোমাকে সে কোথা থেকে টাকা দিচ্ছে। আমার ফরেনসিক অ্যাকাউন্টেন্ট অবশ্য উৎসটা খুঁজে বের করে ফেলেছে। টাকাটা যাচ্ছে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে। তো হিসাব অনুযায়ী তোমার এই মিশনের অর্থায়ন কিন্তু আমি করছি। তবে আপাতত এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি কাউকে কিছু বলবো না। অবশ্য আমি এটা একটা শর্তেই করবো যদি তুমি আমার এখানে আসার ব্যাপারটা গোপন রাখো, বলে আবারো মিষ্টি হাসি হাসলো আলেক্সান্দ্রা।

সাথে সাথেই ফিস্ক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দেরিতে হলেও মিশনে স্বাগতম আপনাকে।

আলেক্সান্দ্রাও ফিস্কের সাথে হাত মিলিয়ে বলল, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছো দেখে ভালো লাগলো। যাই হোক… তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

 চলুন ড্রিংক করতে করতে এটা নিয়ে আলোচনা করি? বলল ফিস্ক। আলেক্সান্দ্রা এভেরির মতো মহিলার সাথে কাজ করার কোনো ইচ্ছাই নেই তার। তাই ড্রিংক করার ফাঁকে ফাঁকে মহিলার খপ্পর থেকে কিভাবে রেহাই পাওয়া যাবে সেটা নিয়েই ভেবে দেখতে চাচ্ছে ও।

 আচ্ছা ঠিক আছে। চলো।

আপনি আসলে লন্ডনে কোথায় উঠেছেন? বারের টেবিলে গিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো ফিস্ক।

অবশ্যই, এখানে, তোমার হোটেলে। তবে মাত্র এক রাতই থাকবো এখানে। কাল কিংস লিনের দিকে যাবো।

কথাটা শুনেই চমকে উঠলো ফিস্ক।

তুমিও তো ওখানেও যাচ্ছো, তাই না?

আপনি কিভাবে জানেন এটা?।

 আবারো হাসলো আলেক্সান্দ্রা। তবে এবারের হাসিটা আর আগের মতো নিষ্পাপ বা মিষ্টি না। তথ্য জানার জন্য ভালো পরিমাণ টাকা খরচ করি আমি, মি. ফিস্ক। চার্লসের থেকেই শিখেছি এটা। বলে হাত বাড়িয়ে ফিস্কের হাতে মৃদু চাপড় দিলো সে। যাই হোক, আমি কিভাবে তথ্যটা জেনেছি সেটা নিয়ে আর কথা বলে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। আমার মনে হয় এখন আমাদের পরিকল্পনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ। হয়তো এতে করে আমরা আমাদের নিজেদের উপকারিতাটা বুঝতে পারবো।

ভালো আইডিয়া, ভাবলো ফিস্ক। হয়তো মহিলার উপস্থিতিটা কাজে লাগিয়ে কিছু সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। এমনিতেও ইভান আর জ্যাক খুব বুদ্ধিমান না। এখন তাদের সাথে বুদ্ধিমান কেউ যুক্ত হলে হয়তো অবশেষে ফার্গোদের থেকে কয়েক পদক্ষেপ এগিয়ে যেতে পারবে ওরা।

যত ভাবছে, আইডিয়াটা ততোই ভালো লাগছে তার। চার্লস এভেরি মহিলাকে যতোই বোকা বলুক না কেন, মহিলা কিন্তু যথেষ্ট চালাক। স্পষ্টতই, কোনো কায়দায় স্বামীর ফোন-কম্পিউটারের নজর রাখছে মহিলা, কিংবা কে জানে হয়তো চার্লসের অফিসে কোনো বাগ রেখে দিয়েছে। তা নাহলে তাদের পরিকল্পনার ব্যাপারে তো আলেক্সান্দ্রার কিছুই জানার কথা না। ব্যাপারটা তাদের জন্য দুঃশ্চিন্তার হলেও, মহিলাকে ঠাণ্ডা রাখার কায়দাও জানা আছে তার। আর এমন না যে চার্লসকে সে আলেক্সান্দ্রার ব্যাপারে কখনোই বলবে না। অবশ্যই একটা সময় সব খুলে বলবে, তবে এখন না…

…আগে মিশনটা ভালোভাবে সফল হোক, তারপর।

.

৩৯.

পরদিন বিকালে পারফ্লিট জেটির টাউন সেন্টারে নাইজেল রিজওয়েলের সাথে দেখা করতে গেলে স্যাম ও রেমি। কার পার্কে গাড়ি রেখে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। এখানে কাস্টম হাউজের ইনফরমেশন সেন্টারে কাজ করে নাইজেল।

কাস্টম হাউজের সামনে বেশ কয়েকজন ট্যুরিস্টের একটা দল জমায়েত হয়ে আছে। কয়েকজন আবার দাঁড়িয়ে নদীর ছবি তুলছে। আর এই দলটার নেতৃত্ব দিচ্ছে বাদামি চুলের এক হ্যাংলাপাতলা লোক। লোকটার বয়স প্রায় ত্রিশের কোঠায়। তাদেরকে এগিয়ে যেতে দেখেই লোকটা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে ঘুরতে এসেছেন নিশ্চয়? ভিতর থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন আপনারা।

 জবাবে স্যাম বলল, আমরা আসলে এখানে নাইজেল রিজওয়েলের সাথে দেখা করতে এসেছি।

 আমিই নাইজেল। তারপর দলটার উদ্দেশ্যে কিছু বলে তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনারাই নিশ্চয় ফার্গো দম্পতি?

ট্যুরিস্ট সেন্টারের সামনে জমে থাকা ভিডের দিকে একবার তাকিয়ে স্যাম বলল, আমরা হয়তো ভুল সময়ে চলে এসেছি। আমি যতদূর জানতাম আপনিই আমাদেরকে এখানে দেখা করতে আসতে বলেছিলেন।

 দুঃখিত। আমার আসলে বিকালের দিকে ফ্রি থাকারই কথা ছিলো, কিন্তু আমাদের গাইডদের একজন আজকে আসতে পারেনি। তাই আমাকেই তার কাজটা করে দিতে হচ্ছে। আপনাদের সাথে সন্ধ্যায় কথা বললে চলবে না?

হ্যাঁ, সন্ধ্যায় হলেও অসুবিধা নেই, বলল স্যাম। কয়টার দিকে?

ছয়টার দিকে? তাহলে শেষ টুরের পর কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আপনাদের সাথে বসতে পারবো আমি। অবশ্য আপনারা চাইলে আমার সাথে টুরেও আসতে পারেন। অথবা পাঁচ পাউন্ড বাঁচাতে চাইলে ভিতর থেকে একটা ম্যাপ সংগ্রহ করে নিজেরাই নিজেদের টুর তৈরি করে নিতে পারেন।

ধন্যবাদ, বলল স্যাম। আমরা নিজেরাই ঘুরে দেখতে পারবো।

এরপর আর কিছু না বলে আবার ট্যুরিস্ট দলটার কাছে ফিরে গেলো নাইজেল। চলুন তাহলে যাত্রা শুরু করা যাক। বলতে বলতে দলটাকে নিয়ে একটা কোনার দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলো নাইজেল। কিংস লিন, মধ্যযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দরগুলোর একটি এটি। এককালে এটা বিশপস লিন নামে পরিচিত ছিলো…

লোকটাকে যথেষ্ট ভালোই মনে হচ্ছে, বলল রেমি।

হ্যাঁ, চুরির ব্যাপারটা বাদ দিয়ে ভাবলে লোকটা খারাপ না, ভাবলো স্যাম। মেজ ক্রাওলির গবেষণা চুরির ব্যাপারটা বেশ বিরক্ত করছে তাকে।

এসব ভাবতে ভাবতেই কিংস লিনের বিভিন্ন টুরের ব্যাপারে লিখে রাখা ক্ষুদ্র পুস্তিকাটা হাতে তুলে নিলো স্যাম। মেরিটাইম হিস্টোরির ভ্রমণের কাগজটা নিয়ে দেখছে, ঐ সময়ই রেমি বলে উঠলো, এটা তো বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। লিনের অন্ধকার অংশগুলো। খুন, বিশ্বাসঘাতকতা ও ডাকিনিবিদ্যার গল্পসমূহ। তবে এরপরই কাগজটা আবার তাকে রেখে দিয়ে বলল, যাই হোক, বাদ দাও। গ্রীষ্মকাল ছাড়া এই ট্যুরের অনুমতি দেয় না তারা।

 তাহলে দেখছি মেরিটাইম হিস্টোরির ট্যুরই জিতে গেলো, হাতের কাগজটা রেমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল স্যাম।

এরপর আর কিছু না বলে ট্যুরে বেরিয়ে পড়লো ওরা। গাইডের নির্দেশনা পুরোপুরি অনুসরণ না করে নিজেদের মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরার ফাঁকে ফাঁকে কিংস লিনের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবিও তুলে নিচ্ছে। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে নেলসন স্ট্রিটের মাঝপথে থাকা ধনু আকৃতির একটা প্রবেশমুখ চোখে পড়লো রেমির। প্রবেশমুখের পাশের প্রেক্যার্ডের লেখাটা দেখে রেমি বলল, ডেভিলস অ্যালি। হুমম, শয়তানের গলি। এর পিছনের গল্পটা ইচ্ছা হচ্ছে আমার।

স্যাম তার হাতের পুস্তিকাটা একবার ঘেটে দেখে বলল, এখানে এই ব্যাপারে কিছু লেখা নেই।

 হয়তো ট্যুরের অন্ধকার অংশে লেখা আছে এটা। ডাইনি আর খুনীদের অংশে হয়তো।

ঠিক তখনই এক বৃদ্ধা মহিলা বেরিয়ে এলো ধনু আকৃতির গলির অপর পাশ থেকে। মহিলার হাতে থাকা লাঠিটা ঠকঠক করে কাঁপছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরেই কালো পোশাক পরে রেখেছে মহিলা। বয়সের ভারে মহিলার কাঁধও কিছুটা ঝুলে গেছে। গলি থেকে বেরিয়ে স্যামদের দেখেই মহিলা সাইনবোর্ডের দিকে নির্দেশ করে বলে উঠলো, সে ওখানে আছে।

কে? ডেভিল? জিজ্ঞেস করলো রেমি।

হ্যাঁ। একদিন জাহাজে করে এসেছিলো এখানে। তখন এক বিশপের প্রতিনিধি পবিত্র জল ও প্রার্থনার মাধ্যমে থামিয়ে দেয় ওকে। ডেভিল হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলো ঐ গলিতে। এখনো তার পায়ের ছাপ আছে ওখানে। এমনটাই কথিত আছে শুনেছি।

পুরোনো কিংবদন্তি শুনতে বেশ পছন্দ করে রেমি। তাই স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, চলো, গিয়ে একবার দেখে আসি।

মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্যামও রেমিকে অনুসরণ করতে যাবে ঠিক তখনই বৃদ্ধা আবারো বলে উঠলো, কালো দানোর থেকে সাবধানে থাকবেন।

কালো কী?

দানো। নরকের লাল-চোখা নেকড়ে ওগুলো। অন্ধকার হলেই বেরিয়ে আসে ওগুলো। শুনেছি ওগুলো এখনো ডেভিলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওখানে, বলে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে উলটো দিকে পা বাড়ালো মহিলা। লাঠিতে ভর করে যেতে যেতে আরো কী কী যেন বলতে বলতে যাচ্ছে।

বৃদ্ধা চলে যেতেই রেমির দিকে ফিরে তাকালো স্যাম। রেমি এখন খোয়া পাথরে বিছানো রাস্তাটায় ডেভিলের পায়ের ছাপ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে আছে। সূর্যও ঐদিকে ডুবতে বসেছে। প্রকৃতিও ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যেতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় ডেভিলের পায়ের ছাপ খোঁজাটা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

পেলে কিছু? কিছুক্ষণ খোঁজার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

না। কিছু না পেলেও গলির কয়েকটা ছবি ঠিকই তুলে নিলো রেমি।

এরপর আবারো পা বাড়ালো সামনের দিকে। দুটো খালি পার্কিং লটের ভিতরের রাস্তা দিয়ে দক্ষিণ জেটি বরাবর এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। পানির ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ম্যারিয়ট ওয়্যারহাউজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে সময় থাকায় সেখানে মহানদী উজের ধারে বসে কিছুক্ষণ ড্রিংক করারও সিদ্ধান্ত নিলো। সবসময়ের মতো এবারও গিনিস পান করছে স্যাম। ধীরে ধীরে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই কুয়াশা জমতে শুরু করেছে নদীর ওপর। নাইজেলের সাথেও তাদের দেখা করার সময় ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। তাই আর বেশিক্ষণ বসে না থেকে আবারো কাস্টম হাউজে ফিরে এলো ওরা।

অবশ্য নাইজেল এখনো তার টুর থেকে ফিরে আসেনি। তাই কাস্টম হাউজের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে স্যাম ও রেমি। সন্ধ্যা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশার ঘনত্বও বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ঘড়িতে সময় দেখলো স্যাম। দেখা করার নির্ধারিত সময়ের প্রায় বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। তাই সেলমার থেকে নাইজেলের ফোন নম্বর নিয়ে ভয়েস মেইল দিলো যে তারা কাস্টম হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। এভাবেই আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করার যখন ভাবলো যে আজকের মতো ফিরে যাবে, তখনই দেখলো যে কুয়াশার ভিতর থেকে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে তাদেরকে। তবে ছায়ামূর্তিটা নাইজেলের না, অন্য কারো।

আপনাদের কোনো সাহায্য করতে পারি? তাদের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

নাইজেল রিজওয়েলের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা।

আচ্ছা! শেষ টুর থেকে ফিরতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। যাই হোক, সে বলেছিলো যে কারো সাথে তার এখানে দেখা করার কথা। অপেক্ষা করুন। তবে।

ধন্যবাদ।

এরপর আর কিছু না বলে দরজার তালা খুলে বিল্ডিংর ভিতরে চলে গেলো লোকটা।

লোকটা চলে যেতেই রেমি তার শরীরের কোটটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল, আশা করছি লোকটা জলদিই চলে আসবে। ঠাণ্ডা বাড়ছে প্রচুর।

কিছুক্ষণ পরই আবার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো লোকটা। দরজার তালা লাগিয়ে বিদায় নিতে যাবে, ঠিক তখনই স্যাম লোকটাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এক্সকিউজ মি, আপনি কি জানেন মি. রিজওয়েল লাস্ট কোন টু্যর নিয়ে বেড়িয়েছিলেন?

 খুব সম্ভবত মেরটাইমের টুরে। এমনটাই জানতাম। দক্ষিণ জেটির ম্যারিয়ট ওয়্যারহাউজে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা টুরটার। ওখানে গিয়ে দেখতে পারেন আপনারা। টুরিস্টদের অনেকেই ডিনারের জন্য যায় ওখানে।

 লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিতেই রেমি বলে উঠলো, কিন্তু আমরা তো কিছুক্ষণ আগেই ওখানে ছিলাম।

 চলো আবার ফিরে গিয়ে একবার খুঁজে দেখি, রেমিকে বলল স্যাম। যদি লোকটা ওখানে গিয়ে থাকে, তাহলে হয়তো কেউ না কেউ দেখে থাকবে তাকে।

আর যদি গিয়ে না থাকে?

 তাহলে অন্যান্য জায়গায় খোঁজা শুরু করতে হবে।

কুয়াশার পরিমাণ আরো বাড়তে শুরু করেছে এখন। তাদের ওয়্যারহাউজের ক্যাফেতে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কুয়াশার কারণে এক হাত সামনেরও কিছু দেখা যাচ্ছে না আর। পানিতে ঢেউ তোলার শব্দ না থাকলে তারা বুঝতেই পারতো না যে তীরের দিকে একটা নৌকা এগিয়ে আসছে। এতই কুয়াশা যে স্ট্রিটল্যাম্পের আলোগুলোকেই একদম ম্রিয়মান দেখাচ্ছে।

ক্যাফেতে ঢুকেই চারপাশে তাকালো ওরা। নাইজেলকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। তবে তাদেরকে দেখে ক্যাফের পরিচারিকা এগিয়ে এসে বলল, কিছু ফেলে গিয়েছেন এখানে? একটু আগে এই মহিলাই সার্ভ করেছিলো তাদেরকে।

আসলে একজনকে খুঁজছি, বলল স্যাম। নাইজেল রিজওয়েল নামের টুর গাইডের সাথে পরিচয় আছে আপনার?

হ্যাঁ আছে, তবে আজ রাতে তার সাথে দেখা হয়নি আমার। যদিও তার একটা টুর ছিলো। তবে তার মেহমানদের কয়েকজন আছে এখানে। বলে জানালার পাশের টেবিলে বসে ওয়াইন খেতে থাকা দুই দম্পতির দিকে ইশারা করে দেখালো মহিলা। স্যাম মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রেমির দিকে ফিরে বলল, আমি আবারো কল করছি লোকটাকে।

 ওকে, আর আমি দম্পতিদের কাছে খোঁজ করে দেখি, বলে জানালার ধারে থাকা টেবিলটার দিকে পা বাড়ালো রেমি।

অন্যদিকে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আবারো নাইজেল রিজওয়েলকে কল করলো স্যাম। বেশ কয়েকবার রিং বাজার পর অবশেষে অপর পাশ থেকে উত্তরে ভেসে এলো, হ্যালো?

মি. রিজওয়েল?

কে-আপনি কে বলছেন?

স্যাম ফার্গো। আমাদের সাথে দেখা করার কথা ছিলো আপনার। আপনি কোথায় এখন।

জবাবে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতাই ভেসে অপর পাশ থেকে, তারপর বলল, সাইলোতে… আ…আমার মনে হয় কেউ ছিনতাই করেছে আমাকে।

নাইজেলের কণ্ঠস্বরটা বেশ টাল-মাতাল লাগছে স্যামের কাছে। সাইলোট কোথায় জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই বীপ বীপ শব্দ ভেসে এলো ফোনের স্পিকার থেকে। লাইন কেটে গেছে। ফোন পকেটে রেখে আবারো ক্যাফের ভিতরে ঢুকলো স্যাম। রেমি এখনোও নাইজেলের টু্যরে থাকা অতিথিদের সাথে কথা বলছে। সেও ঐদিকে এগিয়ে যেতে যাবে, তখনই পরিচারিকাকে কাউন্টারে কাছে ফিরে যেতে দেখে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এখানে সাইলো খুঁজে পাওয়া যাবে কোথায়?

সাইলো? ওগুলো তো আর নেই এখন।

নেই মানে?

কয়েক বছর আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে ওগুলো। কেন?

যদি কেউ বলে যে সে সাইলোতে আছে, তাহলে জায়গাটা কোথায় হতে পারে?

ঐদিকের রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই পাবেন, বলে দক্ষিণের রাস্ত টার দিকে দেখালো মহিলা। ওদিকে গেলেই চোখে পড়বে। ওখানের লটগুলো এখনো খালিই হয়ে আছে।

স্যাম বুঝতে পারলো যে মহিলা আসলে ডেভিলস অ্যালির পাশে থাকা শূন্য লটগুলোর কথা বুঝাচ্ছে। রেমি ফিরে আসতেই মহিলাকে বিদায় জানিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো স্যাম। মহিলার নির্দেশ করা রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে রেমিকে বলল, নাইজেলের কিছু একটা হয়েছে। লোকটা বলছে। তার থেকে নাকি ছিনতাই করেছে কেউ।

পুলিশকে জানিয়েছে?

জানি না আমি। তুমি কিছু জানতে পারলে?

তেমন কিছু না। ক্যাফেতে একবার এসেছিলো ঠিকই, তবে বেশ তাড়াহুড়োয় ছিলো নাকি।

আর কিছু না বলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো স্যাম। ঘন কুয়াশার কারণে আরেকটু হলেই ধনু আকৃতির প্রবেশমুখটা চোখ এড়িয়ে যেতে নিয়েছিলো তার। জায়গাটায় পৌঁছেই শব্দ শোনার চেষ্টা করলো, কিন্তু পানির ঢেউ তোলার শব্দটা ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।

 এখানে কেন এসেছি আমরা? স্যামকে থেমে যেতে দেখে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো রেমি।

নাইজেল বলেছে সে সাইলোতে আছে।

এখানে তো কোনো সাইলো নেই।

একসময় ছিলো, বলে রেমির হাত খাবলে পথটা ধরে পা বাড়ালো স্যাম। তবে কুয়াশার কারণে সামনের কিছু দেখতে না পারায় কয়েকগজ এগুনোর পরই থেমে গেলো আবার।

তখনই রেমি বলে উঠলো, কিছু একটা শুনতে পাচ্ছি আমি।

স্যামও শুনতে পেয়েছে শব্দটা। শব্দটা তাদের বামে থাকা লট থেকে আসছে। শব্দের উৎসের দিকে ঘুরে নাইজেল বলে ডাক দিলো স্যাম। কিন্তু কোনো জবাব ভেসে এলো না। বরং পায়ের শব্দ ভেসে আসছে এখন। তুমি এখানেই দাঁড়াও, রেমিকে উদ্দেশ্য করে বলে পদচারীদের পথ আটকে রাখা ক্যাবল ব্যারিয়ারটার ওপরে চড়ে বসলো স্যাম। পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে পাথুরে মাটিতে জন্মানো লম্বা ঘাসের ওপর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ও। ঘাসগুলো এখনো সমানই আছে, কারো হেঁটে যাওয়ার কোনো ছাপ নেই। তবে আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো যে ঘাসগুলো একটু এলোমেলো হয়ে আছে। কাউকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এইদিক দিয়ে। দাগটা অনুসরণ করে এগিয়ে যেতেই একটা ঘন ঝোঁপ দেখতে পেলো স্যাম। নড়াচড়ার শব্দ ভেসে আসছে ঝোঁপের ভিতর থেকে।

 উঁবু হয়ে ঝোঁপের দিকে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলতেই নাইজেলকে দেখতে পেলো স্যাম। নাইজেলকে খুঁজে পেয়েছি আমি, রেমির উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলল ও।

আলো পড়ায় চোখ পিটপিট করছে নাইজেল। উঠে বসতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে লোকটার। বেশ দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে।

 আপনি ঠিক আছেন? জিজ্ঞেস করলো স্যাম। এতোক্ষণে রেমিও এসে পৌঁছে গেছে তাদের কাছে।

মনে হয়। একটু আগে আপনার সাথেই কথা হয়েছিলো আমার?

হ্যাঁ। আমিই ফোন করেছিলাম।

আচ্ছা।

হাত বাড়িয়ে নাইজেলকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো স্যাম। হাঁটতে পারবেন তো।

হ্যাঁ, বলে সামনের দিকে পা ফেলল নাইজেল। তবে বেশিক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। টলতে টলতে পড়ে যাওয়ার অবস্থা প্রায়।

হাত বাড়িয়ে নাইজেলকে পড়া থেকে আটকে ধরে রেমি বলল, আমাদের মনে হয় অ্যাম্বুলেন্স ডাকা উচিৎ।

না। আমি ঠিক আছি। একটু সময় দিন শুধু।

রেমি ঠিকই বলেছে, স্যাম বলল। আপনার এখন ডাক্তার দেখানো দরকার।

ঠিক আছে বুঝানোর জন্য জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো নাইজেল। আরে নাহ। আমার আসলে এখন একটা কড়া ড্রিংক দরকার।

লোকটাকে ধরে ধরে পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্যাম। রেমি আছে। নাইজেলের অন্যপাশে। নাইজেলকে অতোটা গুরুতর আহত মনে হচ্ছে না। স্যামের কাছে। কোনো রক্তের ছাপ নেই লোকটার শরীরে, শুধু ধুলো আর কিছু পাতা লেগে আছে লোকটার ধূসর স্যুটে। তবে যেটাই ঘটে থাকুক না কেন, ঘটনাটায় খুব চমকে গেছে লোকটা। এখনো ঐ চমকের মধ্যেই আছে। এভাবেই কোনোরকমে ক্যাবল ব্যারিয়ারটা পার হওয়ার পর রেমি আবারো জিজ্ঞেস করলো, আপনি নিশ্চিত যে আপনি ঠিক আছেন?

হ্যাঁ, তবে হালকা একটু মাথাব্যথা করছে শুধু, জবাবে বলল নাইজেল।

কী হয়েছিলো তা কি বলতে পারবেন? জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

 নিশ্চিত না। ট্যুর শেষ করে ওয়্যারহাউজ থেকে আপনাদের সাথে দেখা করার জন্যই ফিরে আসছিলাম। তখনই কেউ একজন এগিয়ে এসে বলল দক্ষিণ জেটির দিকে কী যেন নড়াচড়া করছে, তাই আর ওদিকে না গিয়ে অ্যালির শর্টকাট ধরেই পা বাড়ালাম। হালকা কিছুটা এগিয়েছি, তখনই কে যেন পিছন থেকে মাথায় আঘাত করলো আমাকে।

হুম, ছিনতাইয়ের ঘটনার মতোই শোনাচ্ছে, বলল স্যাম।

পকেটে একবার হাত দিয়ে হেসে উঠলো নাইজেল। আমার ওয়ালেটটা নিয়ে গেছে। তবে লাভ নেই, ওয়ালেটে বোধহয় পাঁচ পাউন্ডের মতো ছিলো। হতাশ হতে হবে তাদেরকে।

স্যাম নাইজেলকে পুলিশের কাছে ফোন করার কথা বলতে যাবে তখনই জেটির দিক থেকে মৃদু গর্জন ভেসে আসতে শুনতে পেলো ও। অন্য দুজনও শুনেছে শব্দটা। শব্দ শুনে ঘুরতে যাবে তখনই কুয়াশার ভিতর থেকে কালো রঙের বিশাল বড়ো একটা কুকুর বেরিয়ে এলো তাদের সামনে। তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে গরগর করছে কুকুরটা।

তাড়াতাড়ি করে রেমিকে তার পিছনে টেনে নিলো স্যাম।

কুকুরটা দেখেই ধীর পায়ে একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে শুরু করেছে তিনজন। পিছিয়ে যেতে যেতে স্যাম নজর রাখছে কুকুরটার দিকে। শুধু কুকুরটাই নয়, এর পিছনে উদয় হওয়া চওড়া-কাঁধের মানুষের ছায়ামূর্তিটার দিকেও নজর রাখছে ও।

.

৪০.

রেমি? ফিসফিসিয়ে ডাকলো স্যাম। তোমার কাছে কী…?

প্রশ্নটা শেষ করার আগেই পেপার স্প্রের ছোটো কন্টেইনারটা বের করে স্যামের দিকে বাড়িয়ে দিলো রেমি।

দৌড়াও এখন, বলল স্যাম।

সাথে সাথেই ঘুরে উলটো দিকে দৌড় লাগালো রেমি ও নাইজেল। আর স্যাম কন্টেইনাটার তাক করে ধরে স্প্রে করতে যাবে, তখনই বিপদ বুঝতে পেরে সামনে থেকে সরে গেলো কুকুরটা। তাই কুকুরের বদলে স্প্রেটা ছায়ামূর্তির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ঘুরে অন্যদের দিকে দৌড় লাগালো স্যাম। স্প্রেটা লোকটার মুখে লেগেছে সেটা জানার প্রতিও কোনো আগ্রহ নেই তার। পিছন থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনতে পেলো স্যাম। সেই সাথে অন্য কারো পায়ের শব্দও ভেসে আসছে। এরমানে হয় স্যামের ছুঁড়ে দেওয়া স্প্রেটা লোকটার মুখে লাগেনি, নয়তো লোকটার সাথে কোনো সঙ্গী আছে।

 রেমি ও নাইজেল এতক্ষণে অনেকটা এগিয়েছে। ডেভিলস অ্যালির ধনু আকৃতির প্রবেশমুখের নিচ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে।

একদম সঠিক নামকরণ, ভাবতে ভাবতে দৌড়ে অন্য দুজনের কাছে পৌঁছালো স্যাম। পিছনে ফিরে তাকালো একবার, কিন্তু কুয়াশার জালের কারণে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। | এই পথে আসুন, ডান দিকে মোড় নিতে নিতে বলল নাইজেল। পুলিশ স্টেশনটা খুব একটা দূরে না।

পাঁচ মিনিটের ভিতরেই পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে আক্রমণের ব্যাপারে রিপোর্ট করলো ওরা। ডিউটিতে থাকা অফিসার ইন্টারভিউ রুমে নাইজেলের সাথে কথা বলছে। আর ঐ ফাঁকে লবিতে অপেক্ষা করছে স্যাম ও রেমি।

লবির চেয়ারে বসতে বসতে রেমি বলল, কপাল ভালো যে ঘটনাটা ঘটার সময় আমরা ওখানেই ছিলাম।

 স্যাম ওদিকে রুমের ভিতর পায়চারি করতে করতে বলল, আমরা যে লোকটার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তার ওপরই আক্রমণ হলো। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

হ্যাঁ, খুব বেশি কাকতালীয় ব্যাপার।

এতোদিন ধরে আমাদের সাথে যা কিছু ঘটছে, তারপর নিশ্চিতভাবেই এটা খুব বড়ো ধরনের কাকতালীয় ঘটনা। তারপর হুট করে পায়চারি থামিয়ে রেমির দিকে তাকিয়ে বলল, ডেভিলস অ্যালির কালো দানোর গল্পটা…।

 তোমার কি মনে হয় আক্রমণের ঘটনাটা ঘটানোর জন্য ফিস্ক বা এভেরি ঐ মহিলাকে গল্পটা বলার জন্য আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলো? বৃদ্ধার ব্যাপারটা কিন্তু কাকতালীয়ও হতে পারে। তবে আক্রমণের ব্যাপারটা…

নাইজেলকে আক্রমণ করেই বা কার কী লাভ?

হয়তো আমাদের সাথে কথা বলে থেকে বিরত রাখার জন্যই আক্রমনটা করেছিলো। বলে ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেমি। কে জানতো যে আমাদের সাথে কথা বলাটা কারো জন্য এতো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে?

ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে স্যাম ও রেমির স্টেটমেন্ট নিয়ে নিলো অফিসার। স্যামের কাছে থেকে কুকুরওয়ালা লোকটার কথা বলতেই অফিসার মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলো, ডেভিল আর কালো দানোই তো, তাই না? জেটির ওদিক থেকে এই ব্যাপারে যে এখন পর্যন্ত কতো অভিযোগ পেয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। ওদিকে কেউ কুকুর নিয়ে ঘুরতে বেরুলেই অভিযোগ আসে। গত বছর রুপার্ট মিডলফিল্ডও তার মেস্টিফ কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলো। কপাল ভালো যে তাকে গুলি করিনি আমরা। বলে শূন্য হাসি হাসলো অফিসার। যাইহোক, এছাড়া কি আর কিছু বলার আছে আপনাদের?

এরপর আর কিছু না বলে অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। বাইরে বেরিয়েই নাইজেলকে কড়া ড্রিংকের জন্য অফার করলো স্যাম। লোকটা সায় দিতেই কাছাকাছি থাকা একটা পানশালায় গিয়ে ঢুকলো ওরা। জায়গাটা বেশ নীরব ও শান্ত। কথা বলার জন্য বেশ ভালো একটা জায়গা। গুণ্ডা

টেবিলে ড্রিংক না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো স্যাম। ড্রিংক চলে আসতেই তাদের এখানে আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কথা তুললো স্যাম। অনুবাদের ব্যাপারে বলুন। আপনি কি ওটা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন?

 হ্যাঁ, দেখেছি ওটা, স্কচের বোতলটা টেবিলে রেখে কোটের পকেটে হাত দিতে বলল নাইজেল। সাথে সাথেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তার। উঠে দাঁড়িয়ে কোটের অন্য পকেট এবং প্যান্টের পকেটগুলোও চেক করে দেখলো নাইজেল। হয়তো তারা শুধু আমার ওয়ালেটটাই নিয়ে যায়নি।

কথাটা শুনেই একজন আরেকজনের দিকে তাকালো স্যাম ও রেমি। নাইজেলকে কে আক্রমণ করেছিলো তা নিয়ে আর এখন কোনো সন্দেহ নেই স্যামের। আমরা ছাড়াও কি অন্য কেউ পুরোনো ইংরেজি প্রবাদ অনুবাদের ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলো আপনার সাথে?

আপনি কিভাবে জানলেন এটা?

আন্দাজ করছি শুধু, বলল স্যাম। মনে হয় নোটবুকটা নেওয়ার জন্যই আপনাকে আক্রমণ করেছিলো ওরা।

কিন্তু এটা তো আরেকবার অনুবাদ করতে বেশি সময় লাগবে না আমার। অরিজিনাল লেখাটা তো লাযলো আমাকে ইমেইলে দিয়েছিলো। তো এটা চুরি করেই বা লাভ কী?

ওটা আমাদের হাতে পড়তে দিতে চায়নি আর কী।

যাই হোক, অনুবাদটা কী নিয়ে সেটা কি মনে আছে আপনার? জিজ্ঞেস করলো রেমি।

কিছুটা। দুর্গ, পাথর, গর্ত নিয়ে কী যেন ছিলো। পুরোপুরি মনে নেই আমার। অনেক কিছুরই কোনো মানে বুঝতে পারিনি আমি। তবে ওটাতে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো না, বলে শ্রাগ করলো নাইজেল। নিশ্চিতভাবেই, ছিনতাই করার মতো এমন কিছু ছিলো না ওটাতে। তো, এখন আসল ঘটনা বলুন তো। আমাকে আক্রমণ করলো কেন?

 আপনি কিং জনের সম্পদের ব্যাপারে মেজ ক্রাওলির পরিবর্তিত ইতিহাসটা সম্পর্কে কিছু জানেন?

কিছু না বলে টেবিল থেকে স্কচ নিয়ে একটা চুমুক দিলো নাইজেল। তারপর স্যামের দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল, তার গবেষণা চুরি করে আসলে খুব একটা ভালো কাজ করিনি আমি। আপনারাই ভাবুন, আমি তখন তরুণ ছিলাম, অতোটা বুদ্ধি ছিলো না, প্রচণ্ড জেদি ছিলাম… যাই হোক, আপনাদের প্রশ্নের উত্তরটা হলো, হ্যাঁ, ইতিহাসটা জানি আমি। এটার সাথে আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার কী সম্পর্ক আছে?

আমাদের পরিচিত একজন এই পরিবর্তিত ইতিহাসটা বিশ্বাস করে। এতোটাই বিশ্বাস করে যে তাদের কাঙিক্ষত জিনিসটা কারো কাছে আছে শুনলেই লোকটা তাদের পিছনে লেগে যায়।

 দুঃখিত। আপনি বলছেন আপনার বন্ধুর করতে দেওয়া ঐ অনুবাদটাই… না, অসম্ভব। ব্যাপারটা হাস্যকর। মেজের তত্ত্বটা ভালো হলেও, এটা একদমই ভুল। সম্পদগুলো সব পানিতে হারিয়ে গিয়েছিলো। সবাইই জানে এটা।

সবার জানাটা যদি ভুল হয়ে থাকে? জিজ্ঞেস করলো রেমি। সম্পদগুলো যদি এখনো থেকে থাকে কোথাও? হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো ওগুলোকে?

 এটা… আপনারা নিশ্চয় সিরিয়াস না এই ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করে আশা করছিলো রেমি হয়তো মাথা নাড়বে, কিন্তু রেমিকে কিছু বলতে না দেখে স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, কিং জনের সম্পদ?

মাথা ঝাঁকালো স্যাম। সত্যি বলতে, সম্পদটা এখনো কোথাও আছে কিনা সেই ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই আমাদের। তবে এই পরিবর্তিত ইতিহাস নিয়ে ভাবানোর মতো এখন পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর আপনি যদি ম্যাপ থেকে পাওয়া পুরোনো ইংরেজি প্রবাদগুলোর অনুবাদটা আমাদের করে দেন, তাহলে সেটা আমাদের অনুসন্ধানে ভালো সহায়তা করতে পারে।

ওয়েট্রেসকে ডেকে টেবিলের জন্য আরেক রাউন্ড ড্রিংক করে স্যাম আবারো বলল, আপনি এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াতে না চাইলেও কোনো সমস্যা নেই। নিশ্চিতভাবেই খুব ভয়ংকর কিছু মানুষের বিরুদ্ধে লড়ছি আমরা। তবে, তারপরও এমন সুযোগ তো আর সবসময় পাওয়া যায় না।

সত্যিই, এমন সুযোগ জীবনে বারবার পাওয়া যায় না, বলল নাইজেল। আমি আছি আপনাদের সাথে। এখন বলুন, আমার থেকে সত্যিকার অর্থে কী চাচ্ছেন আপনারা?

লাযলো পাঠানো ঐ ইমেইলটার অনুবাদ দিয়েই শুরু করা যাক, স্যাম জানালো।

আমার মোবাইলে লাযলোর পাঠানো ইমেইলটা এখনো আছে। আপনাদের কাছে এক টুকরো কাগজ থাকলে ভালো হতো। লেখাগুলোর বেশ কয়েকটা শব্দের অর্থ আমি আসলে এখনো বের করতে পারিনি, তবে অন্যগুলোর অর্থ সাথে সাথেই ধরে ফেলতে পেরেছি। বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মেসেজগুলো স্ক্রল করা শুরু করলো নাইজেল। আর ওদিকে রেমিও তার পার্সে কোনো কাগজের টুকরো আছে কিনা খুঁজে দেখছে। তারপর হঠাৎই নাইজেল মাথা উঁচিয়ে বলে উঠলো, একটা প্রশ্ন আছে আমার। পুরোনো ইংরেজিতে আমিই একমাত্র বিশেষজ্ঞ না, আরো অনেক দক্ষ বিশেষজ্ঞও আছে। নিশ্চিতভাবেই আমি বিখ্যাত দক্ষদের কেউও না। আর তাছাড়া আপনারা মেজের সাথে আমার ঘটনাটার ব্যাপারেও জানেন। তারপরও আমাকে বেছে নিলেন কেন?

 জবাবটা দিলো রেমি, এটাকে আসলে ভাগ্যই বলা যায়। আমাদেরও জলদি দরকার ছিলো এটা, আর আপনিই ছিলেন সবচেয়ে কাছাকাছি। বলে এরপর পার্স থেকে কাগজ-কলম বের করে আনলো।

জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে আবারো মেসেজ ঘাটা শুরু করলো নাইজেল। মেসেজটা পেতে বেশি দেরি হলো না। আপনাদেরকে আগেই একটা কথা বলে দিচ্ছি, কাগজটা হাতে নিয়ে লিখতে লিখতে বলছে নাইজেল, অনুবাদে কিন্তু প্রচুর ভুল থাকার সম্ভাবনাও আছে। পুরোনো ও মধ্যযুগীয় দুটো ইংরেজি নিয়েই কাজ করেছি আমি। সময়ের ব্যবধানে শব্দগুলোর বানান বদলেছে অনেক, সেই সাথে অনেক শব্দের অর্থ এবং লেখার ধারাও বদলেছে প্রচুর। আমি এটাই বলতে চাচ্ছি যে, আপনারা যদি এই লেখাটা অন্য কোনো বিশেষজ্ঞকে দেখান, সে হয়তো পারলে পুরোপুরি ভিন্ন অনুবাদও করতে পারে! বলে কাগজটা স্যামের দিকে বাড়িয়ে দিলো নাইজেল। লাযলো আমাকে এই শব্দগুলোই পাঠিয়েছে। প্রথম তিনটা শব্দ একদম সহজ। ইন্টারনেটে ঢুকলে যে কেউই এই শব্দগুলোর অর্থ বের করে ফেলতে পারবে।

কাগজটা হাতে নিয়ে শব্দের তালিকাটা দেখলো স্যাম। প্রথম তিনটা শব্দের অর্থগুলো হচ্ছে, গর্ত অথবা কূপ, দুর্গ, পাথর অথবা পাহাড়। কোনো ধারণাই নেই বাকিগুলোর ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করলো স্যাম। সে নিজেও কোনো অর্থ বের করতে পারছে না এগুলোর। শব্দগুলো হলো, wul hol আর wul eshea od…

 এই অংশটাই বেশি কঠিন লাগছে আমার। দুঃখিত, কোনো ধারণাই নেই এগুলোর ব্যাপারে।

রেমিও স্যামের হাত থেকে তালিকাটা নিয়ে দেখলো একবার। তো, প্রথম কয়েকটা শব্দই শুধু জানতে পেরেছি আমরা। এরপর কী?

বাক্যের প্রসঙ্গটাই সব কিছু, বলল নাইজেল। এটা থেকেই আসলে বাক্যের উৎপত্তি এবং কোথায় লেখা হয়েছিলো সেটা জানা যায়। বিশেষ করে কোনো শব্দের দ্বৈত অর্থ আছে কিনা তা বুঝা যায়। এই যেমন শেষ শব্দটাই দেখুন। এর অর্থ কিন্তু পাথর বা পাহাড় দুটোই হয়। বাক্যের প্রসঙ্গ জানা থাকলে সঠিক অর্থটা ধরা যেতত।

কাগজটা আবারো রেমির হাত থেকে নিয়ে স্যাম বলল, একটা পুরোনো ম্যাপে লেখাগুলো খুঁজে পেয়েছি আমরা। খুব সম্ভবত ১৬৯৬ সালের ম্যাপ ওটা। তবে শব্দগুলো খুব সম্ভবত লেখা হয়েছিল কিং জনের মৃত্যুর সময়কালের দিকে।

 শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো নাইজেলের। আপনি বলছেন এই শব্দগুলো কিং জনের হারানো সম্পদগুলো কোথায় আছে তা নির্দেশ করছে? মানে সম্পদগুলো এই কিংস লিনে আছে?

 এই ব্যাপারে আসলে কিছু জানি না। এই শব্দগুলো আমরা পেয়েছি এক সাংকেতিক গুপ্তবার্তা থেকে। ওটার অর্থও এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি।

 শব্দগুলো কি আবার দেখতে পারি আমি? বলে কাগজটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো নাইজেল।

স্যামের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে আরো কিছুক্ষণ ভেবে নিলো নাইজেল। তারপর বলল, ধরে নিচ্ছি যে সাংকেতিক বার্তা থেকে বের করা এই অর্থটাই সঠিক। তো যদি এটাই সূত্র হয়ে থাকে, তাহলে খুব সম্ভবত রাজসম্পদগুলো এই শব্দগুলো লুকানোর জায়গার অবস্থানটা নির্দেশ করছে। তবে জায়গাটা নির্ণয় করাটাই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা।

এখানের কোনো কিছুর সাথে কি শব্দগুলো ম্যাচ করছে? জিজ্ঞেস করলো রেমি।

হ্যাঁ, করছে। কিন্তু এখানের সব জায়গাতেই তো কোটি কোটিবার খুঁজে দেখা হয়েছে। সম্পদগুলো তো কখনোই পাওয়া যায়নি।

হয়তো খুঁজেছে, বলল স্যাম। তবে তারা তো আমাদের মতো গবেষণা করে দেখেনি। তো, কোন জায়গায় আছে বলে ধারণা আপনার?

এখানের গর্ত বা কুপটা সম্ভবত কিং জনের সমাধিকে নির্দেশ করছে। এখান থেকে লং সাটনে যাওয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে পড়ে ওটা। আর এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে কাদামাটির ত্রিশ ফুট নিচে রয়েছে সম্পদগুলো। তবে

তবে কী? নাইজেলকে থেমে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

তবে এর সাথে থাকা অন্যান্য শব্দগুলোর কোনো মানে বুঝতে পারছি না আমি। দুর্গ আর পাহাড়র? কোনো মানেই বুঝতে পারছি না। অথবা, দুর্গের ভিতরে থাকা কূপ বা পাহাড়ের ওপর থাকা দুর্গর কথাই ভাবুন একবার। এখানে তো এরকম অনেক দুর্গই আছে।

কিং জনের সময়কালে ছিলো এরকম কোনো দুর্গও কি আছে?

 হ্যাঁ, ক্যাসল রাইজিং।

তাহলে মনে হচ্ছে আগামিকাল সকালে এক্সপ্লোরিং-এ নামতে হচ্ছে আমাদের।

সাথে রেমিও তার গ্লাস উঁচিয়ে ধরে টোস্ট করে বলল, সফল গুপ্তধন শিকারের প্রতি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *