ছত্রিশ
মহীতোষ মারা যাওয়ার পর এই বাড়ির চেহারাটা যেন আচমকা পাল্টে গেল। ছোটমা সেই শূন্য ঘর ছেড়ে পারতপক্ষে বের হচ্ছেন না। হেমলতার পরিবর্তনটা আরও বেশী চোখে পড়ছে। যে মানুষ সব সময় বক বক করতে ভালবাসতেন তিনি একেবারেই নীরব হয়ে গেছেন। সারা দিন তাঁর নিজের কাজগুলো বার বার করে যাচ্ছেন। তিনি নিজের রান্না চিরকাল নিজেই বেঁধে এসেছেন। হঠাৎ যেন আরও বেশী স্বতন্ত্র হয়ে পড়েছেন। মাধবীলতা তিনবার প্রশ্ন করলে একবার হয়তো জবাব দেন আর কপালে ভাঁজ ফেলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর আচরণের মধ্যে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একই কাজ দুবার করেন এবং অর্ককে অনিবাবা বলে সম্বোধন করছেন।
এই পরিস্থিতিতে এত বড় বাড়ির দায়িত্ব এসে পড়ল মাধবীলতার ওপর। তাকেই সমস্ত কাজকর্ম করতে হচ্ছে। এখন অবশ্য রান্নাবান্নার তেমন ঝামেলা নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গৃহিণীর দায়িত্ব এড়াতে পারছে না মাধবীলতা।
মহীতোষকে দাহ করতে যাওয়ার আগে একটু চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। সকালেই এ পাড়ায় খবরটা প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ দেখেছিল ক্রমশ বেশ ভিড় জমে গেল বাড়িতে। এঁদের অনেকেই মহীতোষের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত নন কিন্তু পাড়ার মানুষ মারা গেছেন এবং তাঁর আত্মীয়রা শোকগ্রস্ত বলেই এঁরা পাশে এসে দাঁড়ালেন। এঁদের মধ্যেই কয়েকজন যখন উদ্যোগী হয়ে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন ঠিক তখনই চেঁচামেচি শোনা গেল। গেট হাট করে খোলাই ছিল, সেখান থেকে বিলাপ করতে করতে ঢুকলেন পরিতোষ, ‘ওরে তুই চলে গেলি, আমি বড় হয়ে রয়ে গেলাম আর তুই চলে গেলি।’ বিলাপ করছেন আর মাথায় চাপড় মারছেন।
অনিমেষ প্রথমে তাঁকে চিনতে পারেনি। একটা মানুষের চেহারা যে এত পাল্টে যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এবং চেনা মাত্র তার খেয়াল হল এই মানুষটা সারা জীবন দাদুকে জ্বালিয়েছে আর বাবার বিরুদ্ধে এই বাড়ির মালিকানা চেয়ে আদালতে মামলা ঠুকেছে। অথচ এখন ওঁর বিলাপ দেখলে সে সব কথা কারো মনে আসবে না। দ্বিতীয় চিন্তায় অনিমেষের মনে হল, হয়তো মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মানুষটার মনে অনুশোচনা এসেছে। যে জেদ এবং ঈর্ষা তাঁকে মামলা করিয়েছিল তা বোধ হয় ধাক্কা খেয়েছে। এই বিলাপ তারই প্রতিক্রিয়া।
পরিতোষ তখন বারান্দায়। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘কোথায় সে, আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। আমি তাকে শেষবার দেখতে চাই। মহী, মহী রে।’ পাড়ার একটি ছেলে পরিতোষকে পথ দেখিয়ে মহীতোষের ঘরে নিয়ে যাচ্ছিল। উপস্থিত মানুষগুলো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। একে মৃত্যু তার ওপর এই ধরনের বিলাপ আবহাওয়াকে ভারী করে তুলেছে। অনিমেষের দিকে পরিতোষ তাকাচ্ছিলেন না। অনিমেষের মনে হল হয়তো ওকে চিনতে পারেননি তিনি। সে দুহাতে ক্রাচ নিয়ে চুপচাপ দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এখন ঘরে বেশ ভিড়। হেমলতা সেই জানলার পাশে পাথরের মত অনড় হয়ে আছেন। প্রতিবেশী মহিলারা তাঁর পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। মাধবীলতা মহীতোষের মাথার পাশে। অর্ক সামান্য দূরে। পরিতোষ ঘরে ঢুকে এমন একটা কান্নার শব্দ করলেন যে সবাই চমকে তাঁর দিকে তাকালেন। এমন কি ছোটমা মহীতোষের পায়ের ওপর থেকে মুখ তুললেন, শব্দটা করেই পরিতোষ দৌড়ে খাটের কাছে পৌঁছে গেলেন, ‘মহী, মহী, ভাই আমার কথা বল, একবার দাদা বলে ডাক, ও হো মহী রে!’
মৃত মহীতোষের হাত জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন পরিতোষ। ছোটমার শরীর ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসল। তাঁর চোখে বিস্ময়। পরিতোষ বলছিলেন, ‘তুই চলে গেলি, আমি অভাগা রে মহী, মায়ের স্নেহ বাবার ভালবাসা কখনও পাইনি। তবু আমি রয়ে গেলাম। আঃ ভগবান!’
ঠিক তখনই হেমলতার চাপা অথচ ধারালো গলা শোনা গেল, ‘পরি!’
পরিতোষ চোখ খুললেন, ‘কে, কে ডাকল আমাকে?’ মুখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তার পর জ্যামুক্ত তীরের মত ছুটে গেলেন হেমলতার পায়ের কাছে। মাটিতে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে বললেন, ‘ক্ষমা কর, ক্ষমা কর দিদি।’
হেমলতা বললেন, ‘উঠে দাঁড়া।’
বাধ্য শিশুর মত হুকুম তামিল করলেন পরিতোষ, অনেক শাস্তি পেয়েছি দিদি। আজ মহী নেই আজ আর … আমার ছেলেরাও আমাকে দ্যাখে না।’
হেমলতা বললেন, ‘বেরিয়ে যা এখান থেকে।’
পরিতোষ যেন চমকে উঠলেন, ‘অ্যাঁ?’
‘এই বাড়িতে তোর ঢোকা নিষেধ আছে। আমার বাবার শেষ ইচ্ছে যাতে পালন করা হয় তা আমি দেখব। যা।’ হেমলতার ছোট্ট শরীরটা যেন আচমকা বিশাল হয়ে যাচ্ছিল। পরিতোষ কিছুক্ষণ স্তব্ধ ভঙ্গীতে দিদিকে দেখলেন, ‘তুমি, তুমি কি পাষাণ? এই দিনেও ওই কথা বলছ?’
‘হ্যাঁ বলছি। তোর মামলা করার খবর পাওয়ার পর থেকেই মহী –।’
‘মামলা? মরা মানুষের সঙ্গে মামলা কি! এখন মহী আমার ভাই।’ কথাগুলো বলতে বলতে দরজার দিকে সরে আসছিলেন পরিতোষ। এবং তখনই তাঁর চোখ পড়ল অর্কর ওপর। একটু থিতিয়ে গিয়েও তিনি হাত বাড়িয়ে অর্ককে ধরলেন, ‘এসো, তোমার সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা আছে।’
প্রায় টানতে টানতেই অর্ককে নিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। দরজাটা অতিক্রম করার সময় অর্ক অনিমেষের মুখের দিকে তাকাল। অনিমেষ অবাক হয়েছিল। অর্কর সঙ্গে জেঠুর সম্পর্ক সে ঠাওর করতে পারছিল না।
হলঘরে ঢুকেই পরিতোষ নিচু গলায় বললেন, ‘দিদির মাথা শোকে খারাপ হয়ে গিয়েছে। তুমি কিছু মনে করো না। এই সময় ও–রকম হয়।’
অর্ক হতভম্ব হয়ে গেল। পরিতোষ যেন তাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ওই একঘর লোকের সামনে অপমানিত হবার ব্যাপারটা যেন কিছুই নয়। তার মনে হল এই মুহূর্তে হেমলতাকেই সমর্থন করা উচিত। ‘আপনাকে যখন চলে যেতে বলা হয়েছে তখন চলে যান।’
‘আরে, তুমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছ না। তোমার তো মাথা খারাপ হয়নি।’
‘আপনি দাদুর বিরুদ্ধে মামলা করছেন আবার এখানে এসে কাঁদছেন—!’
‘করছেন না, করেছিলেন। বললাম না, মরা মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করার কোন মানে হয় না। ও মামলা আমি তুলে নেব। এখন এসো সবাই মিলে মহীর সৎকারটা ভালভাবে করি। এখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার সময় নয়।’ খুব বিচক্ষণ দেখাচ্ছিল পরিতোষকে।
অর্ক বুঝতে পারছিল না তার কি বলা উচিত। সে মুখ ফিরিয়ে অনিমেষকে দেখল। ‘আপনি আমার বাবার সঙ্গে কথা বলুন। বাবা, এদিকে এসো।’
পরিতোষ যেন খুব অবাক হলেন, ‘তোমার বাবা? ও অনি! সে কোথায়? শুনেছি হাঁটাচল করতে পারে না।’ তাঁর কথা শেষ হওয়া মাত্র অনিমেষ সামনে এসে দাঁড়াল। পরিতোষ তার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে উঠলেন, ‘হায় ভগবান, তুই অনি? একি চেহারা হয়েছে তোর? আহা রে! আমাকে চিনতে পারছিস তো? আমি তোর-।’
‘চিনতে পেরেছি।’
‘সেই এলি অনি আর একটু আগে আসতে পারলি না। বাবা গেল, মহী গেল, এই সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। আজ মহীর মৃতদেহের সামনে বসে দিদি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তুইও আমাকে তাড়িয়ে দিবি?’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি চান?’
‘আমি? কিছুই চাই না। শুধু মহী যাতে ভালভাবে যেতে পারে তাই দেখতে চাই।তোর শরীর, ঠিক নেই, তোর ছেলে এখানে কখনও আসেনি, আমি থাকলে তোদের সুবিধে হবে রে। একটু ভেবে দ্যাখ, মহী তো আমারই ভাই।’
‘কিন্তু দাদু আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এটা পিসীমা ভুলতে পারছেন না। তিনি এ বাড়ির সবার চেয়ে বড়। আপনি মামলা করেছেন-।’
‘আর লজ্জা দিস না। আমি আর মামলা চালাবো না রে। তোমার নামটা কি যেন, এই হয়েছে মুশকিল, কিছুতেই মনে রাখতে পারি না আজকাল।’
‘অর্ক।’
‘বেশ বেশ। আর সময় নষ্ট করো না। বেলা হয়ে যাচ্ছে। কিসে নিয়ে যাওয়া হবে ঠিক করেছ?’
‘না।’
‘ঠিক আছে চল আমি দেখছি। মহীর যেন একটুও অসম্মান না হয় দেখতে হবে।’ অনিমেষের আর কিছু করার ছিল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পরিতোষের নেতৃত্বে বেশ বড়সড় শ্মশানযাত্রীর দল তৈরি হয়ে গেল। ওই মানুষটির শোক এবং তার প্রকাশ বেশ উগ্র হওয়া সত্ত্বেও অনিমেষের মনে হচ্ছিল কোথাও বোধহয় ভুল হচ্ছে। হঠাৎ একটা ধাক্কা কাউকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে। পরিতোষের ক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব। তবে অর্কর সঙ্গে ওঁর পরিচয় কিভাবে হল এটা সে আঁচ করতে পারছিল না। এবং সেদিন জিজ্ঞাসা করবে ঠিক করেও শেষ পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলো।
সেই দিন থেকেই যেন এ বাড়ির প্রতিটি মানুষ অশৌচ পালন শুরু করে দিল। বিকেল হলেই এ বাড়িতে অন্ধকার এসে ঢোকে। টিমটিমে আলোগুলোকে ভূতের মত দেখায়। সন্ধ্যের পর ঠাণ্ডা পড়ছে এখানে। মেঝেতে বিছানা করে শুতে হচ্ছে। মাধবীলতা ছোটমার সঙ্গে রয়েছে। গতকাল পর্যন্ত মহীতোষের অস্তিত্ব এই বাড়িতে ছিল না বললেই চলে। মাঝে মাঝে যে গোঙানি তাও শেষ পর্যন্ত থেমে গিয়েছিল কিন্তু তখনও আবহাওয়া ভারী হয়নি। মানুষটা স্তব্ধ কিন্তু মৃত নয়, শুধু এই ধারনাই সবাইকে সচল রেখেছিল!
এখন কি করা যায় ভেবে পাচ্ছি না অনিমেষ। মাধবীলতা অনন্তকাল ছুটি পাবে না। অর্কর পড়াশুনা আছে। বড় জোর-মহীতোষের কাজ পর্যন্ত ওরা এখানে থাকতে পারে। তার পর? ছোটমা এবং পিসীমাকে কার কাছে রেখে যাবে? দ্বিতীয় জনের কাছে তার নিজস্ব ঋণ শোধ করার সময় এখন। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব? ওদের এখান থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যায় না। পরমহংস যদি নতুন ফ্ল্যাট ধরে রাখে তবু সেখানে এরা একরাতও থাকতে পারবে না। তাহলে? হঠাৎ অনিমেষের মনে হল মাধবীলতা যেচে এই সমস্যার মধ্যে তাকে ফেলে দিল। সে নিজে এই বাড়ি এবং মানুষদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। একসময় তার ভুলেও জলপাইগুড়ির কথা মনে পড়ত না। ঈশ্বরপুকুর লেনের ঘরে তার নিজের ভাবনা চিন্তা করার কোন অবকাশ ছিল না। একটা জড়পদার্থের মত বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত। তার পরেই মনে হল, যদি আজ মহীতোষ কিংবা অর্কর কাছ থেকে কেউ তাকে অনেকদূরে কোন পরিবেশে রেখে দিয়ে আসে তাহলে কি এক সময় জলপাইগুড়ির মত ওদেরও সে ভুলে যাবে? ভুলে যেতে পারবে? অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। কিন্তু একটা আশঙ্কা, ওর মনে তির তির করে কাঁপছিল। হয়তো সে ভুলে যাবে। এই পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থির হয়ে থাকে না। এই মুহূর্তে মহীতোষের মৃত্যুশোক তারই বেশী করে বাজা উচিত। কিন্তু দীর্ঘ-অনুপস্থিতি শোকের ধার নষ্ট করে দিয়েছে। অথচ ছোটমা এবং পিসীমার শোক অনেক গভীর। শুয়ে অনিমেষ নিজের বুকে হাত দিল। সে কি ক্রমশ হৃদয়হীন হয়ে যাচ্ছে। কেন আর তাকে কোন কিছু তেমন করে কাঁদায় না! অনিমেষের অস্থিরতা বাড়ছিল। পাশে শুয়ে থাকা অর্কর দিকে সে তাকাল। কেমন অসহায় ভঙ্গীতে ছেলেটা এখন ঘুমুচ্ছে। এত দ্রুত পরিবর্তন কোন মানুষের হয়? এত দ্রুত! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল তারও তো পরিবর্তন ঘটেছে। কখন তা ঘটে যায় জানা যায় না এই যা।
অনিমেষের ঘুম আসছিল না। ক্রাচ টেনে নিয়ে সে উঠল। শোওয়ার সময় মাথার পাশে যে চাদরটা ছিল সেটা কোনরকম জড়িয়ে নিল। তার পর ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভেতরের ঘরে চলে এল। ঘুট ঘুট করছে অন্ধকার। এখন কত রাত কে জানে। সে চেষ্টা করেও ক্রাচের শব্দ কমাতে পারছিল না। এই বাড়িতে দরজা জানলা বন্ধ রাখলে সামান্য শব্দ অনেকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু তাতেও কারো ঘুম ভাঙ্গছে বলে মনে হল না। দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে শেষ পর্যন্ত অনিমেষ মহীতোষের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ভেজানো, একটা সরু আলোর রেখা সামান্য ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছে। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে নিথর হল। ছোটমা এবং মাধবীলতা খানিক দূরত্বে ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘরের মাঝখানে একটা বড় প্রদীপ জ্বলছে। সলতেটা পুড়তে পুড়তে তেলের কাছাকাছি। শায়িত দুটো মানুষকে কেমন যেন অশরীরী বলে মনে হচ্ছে। মহীতোষের মৃত আত্মার জন্যে কি প্রদীপ জ্বেলে রাখা! অনিমেষ দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল। তার কাঁপুনি আসছিল। এবং হঠাৎই সে বিড় বিড় করে বলল, ‘বাবা, আমাকে ক্ষমা কর।’
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে অনিমেষ দরজা খুলে ভেতরের বারান্দায় এসে চুপ করে দাঁড়াল। এখনও চোখের ওপর প্রদীপের শেষ শিখা কাঁপছে। অথচ বাইরে চাঁদের দেওয়ালি। হিমমাখা জ্যোৎস্নায় বাগানটা ভাসছে। নাকে চোখে মুখে ঠাণ্ডা বাতাস লাগতেই সে ধাতস্থ হল। ও-পাশে পিসীমার ঘর, দাদুর পুরোনো ঘর কেমন ডুবো পাহাড়ের মত মনে হচ্ছে। সিঁড়িটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ মাথা নাড়ল। সে কি একা নামতে পারবে? কেন পারবে না? নামতে তো তার কোন অসুবিধে হয় না। তলার ধাপে ক্রাচ রেখে অনিমেষ শরীরটাকে নামাল। তারপর বাকিগুলো অতিক্রম করলো সময় নিয়ে। এখন খালি পায়ে বাগানের মাটিতে, জ্যোৎস্নায়। দাদু থাকতে এত আগাছা ছিল না বাড়িতে। এত বুনো ঘাস কখনও হয়নি। অনিমেষ সেই আধা-জঙ্গল ভেঙ্গে এগোচ্ছিল। তার কোন লক্ষ্য ছিল না। অথচ হঠাৎ এই বাগানে চলে এসে মন খুব হালকা হয়ে যাচ্ছিল। অনিমেষকে দেখেই একটা প্যাঁচা পাখায় শব্দ করে উড়ে গেল যে গাছটা থেকে সেখানে নজর গেল ওর। ওটা কি গাছ? পেয়ারা না! সেই পেয়ারা গাছটা? কত বছর একটা পেয়ারা গাছ বাঁচে? অনিমেষ দ্রুত জঙ্গল মাড়িয়ে চলে এল গাছটার তলায়। বেশ বড় ঝাঁকড়া গাছে বসে থাকা দ্বিতীয় প্যাঁচাটা এবার ভয় পেয়ে ডেকে উঠল কর্কশ স্বরে এবং সঙ্গীর অনুগামী হল। এবং তখনই অনিমেষের সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হল। এই গাছ! সে নিচের দিকে তাকাল। ঘন ঘাস আর আগাছা ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু এখানে সে মাটি রেখেছিল, ভালবাসার মাটি।
অনেক অনেক বছর আগে দাদুর সঙ্গে যেদিন চিরদিনের মত স্বৰ্গছেঁড়া থেকে সে এখানে চলে এসেছিল সেদিন রুমালে করে স্বর্গছেঁড়ার মাটি এনেছিল। তার জন্মভূমির মাটি। সাত বছরের বালক সেই মাটি এই পেয়ারা গাছের তলায় রেখে প্রতিদিন দেখত আর স্বৰ্গছেঁড়ার কথা ভাবত। ভাবত এই জায়গাও স্বগছেঁড়া হয়ে গেছে কিংবা ওই মাটির দিকে তাকালেই মনে হত সে স্বৰ্গছেঁড়াতেই আছে। কিন্তু তার পর একদিনের সামান্য বৃষ্টির পর সে দৌড়ে এসে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল একা এই বাগানে দাঁড়িয়ে। সেই মাটিটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই মাটি সেই মাটিকে নিজের করে নিয়েছিল। তার পর থেকে মনে হত জলপাইগুড়িতে স্বৰ্গছেঁড়ার মাটি মিশে রয়েছে। মনে হলে সেই বালক খুশি হত। একটু একটু করে জলপাইগুড়িকেও তাই নিজের ভাবা গেল।
আজ এতদিন পরে সেই পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এই নির্জন রাত্রে অনিমেষের মনে হল সে দিনের সমস্ত ব্যাপারটাই ছেলেমানুষী কিংবা বোকামি ছিল? ওইটুকু মাটি নিয়ে একটা ছোট্ট ছেলে কি আবেগে আক্রান্ত হয়েছিল! নিজের মনেই মাথা নাড়ল সে। কলকাতায় যাওয়ার সময় সে রুমালে মাটি বেঁধে নিয়ে যায়নি। কিন্তু কলকাতা তাকে গ্রাস করে নিল। তার শরীর থেকে একটি অদৃশ্য সিরিঞ্চ মারফৎ সমস্ত আবেগ শুষে নিল। অনিমেষের বুকের খাঁচা কেঁপে উঠল। সে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। শীতার্ত আকাশ। ঘোলাটে সাদা। শুধু চাঁদের শরীরে ঝকমকে আলো। কিছু কিছু তারাও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আঃ! কতদিন পরে আকাশ দেখা গেল! হঠাৎ অনিমেষের মনের অনেকগুলো স্তরের নিচ থেকে একটা স্মৃতি ভুল করে উঠে এল। সে উদগ্রীব চোখে সেই তারাকে খুঁজতে লাগল। খুব উজ্জ্বল তারা, জ্বল জ্বল করত। আজকের আকাশে তাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। মায়ের মৃত্যুর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে সে প্রায়ই যে তারাটার সঙ্গে কথা বলত। মৃত্যুর আগে মা বলেছিল তাঁকে মনে পড়লেই সে যেন ওই তারাটা দ্যাখে। আজ এত বছর পরে সেই তারাটাকে খুঁজতে গিয়ে হাসি পেল অনিমেষের। হায়, তারাদেরও বয়স বাড়ে, তারারাও মরে যায়।
অনিমেষ মুখ নামাতেই তার বুক ছ্যাঁত কতে উঠল। ওটা কি? সাদা, লম্বা, হাওয়ায় কাঁপছে! আধো আলো আধো জ্যোৎস্নায় মূর্তিটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যাচ্ছিল। এই নির্জন বাড়িতে প্রেতাত্মারা ঘোরাফেরা করে নাকি! এই মুহূর্তে কোন ব্যাখ্যা বা প্রমাণের কথা মাথায় আসছে না! অনিমেষের দুটো হাত ক্রাচ আঁকড়ে ছিল। এবং তখনই মূর্তিটা সামান্য নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ ধাতস্থ হল। চোর নয় তো! আজকের দিনে ওদের তো খুবই সুবিধে। কিন্তু এ বাড়িতে নেওয়ার মত কিছু নেই তা নিশ্চয়ই ওরা জানে, তবে? সাহস এল, অনিমেষ ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগোল। না, চোর নয়। চোর হলে তাকে দেখে নির্ঘাৎ পালাতো। অনিমেষ আরও একটু কাছাকাছি হলে স্পষ্ট দেখতে পেল। ছোটমা। সাদা কাপড় হাওয়ায় উড়ছে। আচমকা বুকের ভেতরটা স্থির হয়ে গেল। ছোটমা এখানে কেন?
ছোটমা তার দিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। অনিমেষ বাগান পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে উঠে এসে ইতস্তত করল। তার পক্ষে নামা যত সহজ ওঠা তত মুশকিল ওপরের ধাপে একটার পর একটা ক্রাচ রেখে দুহাতে ভর দিয়ে কোনরকমে শরীরটাকে টেনে তুলে বড় আনন্দ হল অনিমেষের। আঃ, সে পেরেছে। পরের দুটো ধাপ পার হতে একটু বেশী সময় লাগল কিন্তু এবার সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল সে। না, আর অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না সব সময়। শুধু অনভ্যাসই মানুষকে পরনির্ভর করে তোলে। সে ধীরে ধীরে ছোটমার দিকে এগিয়ে গেল।
বারান্দার এককোণে ছোটমা দাঁড়িয়েছিলেন। সম্পূর্ণ সাদা কাপড়ে তাঁকে খুব করুণ দেখাচ্ছিল। অনিমেষ মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার?’
‘আমি কি করব?’ খুব নিচু গলায় যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলেন ছোটমা।
‘মানে?’
‘এবার আমি কি করব? আমার তো কোন পিছুটান রইল না। এ বাড়িতে থাকবার কোন অধিকার নেই।’ নিঃস্ব গলা, বাতাসের সঙ্গে মেশামেশি।
‘কে বলেছে এসব?’ অনিমেষ খুব বিস্মিত হচ্ছিল।
‘কেউ না। বাপের বাড়িতে কেউ নেই। দাদারা যে যার নিজের সংসারে ব্যস্ত। এখানে যিনি ছিলেন তিনিও গেলেন। সত্যি কি আমার কখনও কেউ ছিল!’
অনিমেষ এবার একটু ধমকের গলায় বলল, ‘মাঝরাত্রে এসব কি হচ্ছে। এই বাড়ি থেকে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি!’
ছোটমা অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাসলেন। ‘মাথা খারাপ! হায়, সেটা হলেও তো আমি বেঁচে যেতাম। কিন্তু তুমি কি করছিলে? এই মাঝ রাত্রে একা একা ওই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে?
অনিমেষ থতমত হয়ে গেল। তার মুখে কোন জবাব এল না। ছোটমার মুখে সেই হাসিটা আরও ধারালো হল, ‘সেটা পাগলামো নয়?’ তারপরই হাসিটা শব্দময় হল, ‘আমি না, আমি এতদিন ঝি হয়ে ছিলাম, বিনি পয়সার ঝি। আজ বাবু মারা গেল আর আমারও ঝিগিরি চলে গেল!’
অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছোটমা!’
‘চুপ করো। আমাকে তুমি মা বল না। কি করেছ তুমি আমার জন্যে? আমি কি তোমাকে ভালবাসিনি? আমি কি তোমাকে আপন করে নিই নি? এই বাড়িতে আমি কি পেয়েছি? তোমার বাবা যৌবনে. আমাকে কি দিয়েছে? কখনও ভেবেছ এ সব! কলকাতায় গিয়ে কখনও আমার কথা ভেবেছ? স্বার্থপর, স্বার্থপর, স্বার্থপর।’ তিন রকম উচ্চারণ যেন অনেক ঘৃণা উজাড় করে ঢেলে দিল।
অনিমেষ সেই উন্মাদিনীর দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে। তার গলায় শব্দ আসছিল না। ছোটমা তখনও মাথা নাড়ছিলেন, ‘দেশ উদ্ধার করছেন তিনি। দিনের পর দিন আমি তোমার জন্যে মিথ্যে কথা বলে গেছি তোমার বাবার কাছে। পারলে দেশ উদ্ধার করতে? খোঁড়া হয়ে বউ-এর ঘাড়ে বসে খাচ্ছ আর দায়িত্ব নেবার ভয়ে লুকিয়ে রেখেছ নিজেকে। কথা বলো না, তুমি কথা বলো না। এখন দু’দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছ, আমাদের দুর্দশা দেখে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে চলে যাবে। তাই না, আমি ঠিক বলছি না?’
ছোটমার বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ মাথা নাড়ল। সেটা সমর্থনের কি প্রতিবাদের তা বোঝা গেল না। তার পর শান্ত গলায় বলল, ‘আমার ভুলগুলো এবার আমাকেই শুধরাতে হবে ছোটমা, তুমি এমন করে কথা বল না।’
চমকে মুখ তুলে তাকালেন ছোটমা। তার পর নিজের মনেই বললেন, ‘আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তোমাকে এ সব কি বললাম! ছি।’
অনিমেষ বলল, ‘ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি জানি না আমি কি করব।’
হঠাৎ যেন পাল্টে গেলেন মহিলা, ‘তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি যেমন আছ তেমনি থাক। স্রোতে গা ভাসিয়েছ এখন কি আর স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা যায়। আমি তোমাকে এ সব কথা বলতাম না। কিন্তু বারান্দায় এসে যেই দেখলাম তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছ একমনে তখনই মাথা খারাপ হয়ে গেল। কিছু মনে করো না।’
‘আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম তো কি হল?’
‘তুমি ভুলে গেছ। অনেকদিন আগে আমায় বলেছিলে আকাশের দিকে তাকালে নাকি তুমি দিদিকে দেখতে পাও। এ বাড়িতে পা দেওয়ার পর তোমার মৃত মা আমার পেছন ছাড়েননি। এই আজকেও বড়দি মাধুরী মাধুরী করছিলেন। মানুষটা মরে গিয়ে সারা জীবন আমার শত্রুতা করে গেল। তাই যখন দেখলাম তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছ তখন হিংসেয় বুক ফেটে গেল। অনিমেষ, আমি যখন এখনও হিংসে করছি তখন পাগল হইনি, না? যাই, তোমার বউ অনেকক্ষণ ওই ঘরে একা আছে। কিছু মনে করো না।’ সাদা কাপড়ে জড়ানো শরীরটা ধীরে ধীরে ভেতরে চলে গেল।
অনিমেষের কোমর টনটন করছিল। সে সাদা জ্যোৎস্নার দিকে তাকাল। প্রথমে মনে হয়েছিল ছোটমার মাথা বোধ হয় ঠিক নেই। কিন্তু এখন ওই জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে সে ঘাড় নাড়ল। ঠিকই। ছোটমা খুব সত্যি কথা বলেছে। এই সত্যগুলো তার মুখের ওপর কেউ এতকাল সরাসরি বলেনি। মাধবীলতা মুখ বুজে থেকেছে, অর্কর বোধে আসেনি। এখন কিছু একটা করা দরকার। এইভাবে বদ্ধ জলার মত পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। স্রোত চাই, যে কোনভাবে এগিয়ে যেতে হবেই।
ঘুম ভাঙ্গতেই চিৎকার চেঁচামেচি কানে এল। অনিমেষ চোখ খুলতেই দেখল অর্ক উঠে বসেছে। একমাত্র খালি পা আর মাথায় তেল না দেওয়া ছাড়া অর্ককে কোন অশৌচ পালন করতে হচ্ছে না। তা দ্বিতীয়টি ইদানীং মাথায় দেয় না বলে ওর কোন অসুবিধে নেই। চেঁচামেচি শুনে অর্ক উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরের দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল অর্ক। এই সাতসকালে পরিতোষ হাঁকডাক করে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। একটা ঠেলা রয়েছে গেটের বাইরে দাঁড় করানো। তার ওপর স্তূপীকৃত মালপত্র। অর্ককে দেখতে পেয়ে একগাল হাসলেন, ‘তোমার ঠাকুমা এল বলে। রাতে ঘুম হয়েছিল? এই যে, মালগুলো নামাও না!’
অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি করছেন?’
‘চলে এলাম। তোমাদের কোন চিন্তা নেই। ওই পুরোনো বাড়িটায় গিয়ে উঠব। দলবদ্ধ হলে শক্তি বাড়ে। সেই গুরু শিষ্যের গল্পটা জানো তো! তা আর সবাই ঘুম থেকে উঠেছে?’ পরিতোষ এগিয়ে এলেন।
‘না’। অর্ক জবাব দেওয়া মাত্র অনিমেষ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এ কি?’
পরিতোষ বললেন, ‘চলে এলাম। তোমার জেঠিমা আসছেন। আর যখন ঝগড়াঝাঁটি নেই তখন আলাদা থেকে লাভ কি? আমি আজই মামলা তুলে নিচ্ছি।’
অনিমেষের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, ‘আপনি পিসীমার অনুমতি নিয়েছেন?’
‘অনুমতি? কার, বড়দির? বড়দির অনুমতি নিতে হবে?’
‘হ্যাঁ। বাবার অবর্তমানে তিনি এই বাড়ির কর্তা।’
‘মেয়েছেলে আবার কর্তা হয় নাকি?’
‘যা বলছি তাই শুনুন। ওদের মালপত্র নামাতে বারণ করুন। এ নিয়ে কোন অশান্তি করতে চাই না আমি। আপনি পিসীমার সঙ্গে দেখা করুন।’
অনিমেষের কথাগুলো পরিতোষের পছন্দ হচ্ছে না বোঝা গেল। তিনি শেষ পর্যন্ত ঘাড় নাড়লেন, ‘ঠিক হ্যায়, চল যাচ্ছি। কোথায় বড়দি?’
অনিমেষ অর্ককে ইশারা করতে সে পরিতোষকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ততক্ষণে ভেতরের ঘরে মাধবীলতা আর ছোটমা এসে দাঁড়িয়েছেন। ছোটমার চোখে বিস্ময় এবং বিরক্তি। অর্ক পরিতোষকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলে পরিতোষ বললেন, ‘বাবার একটা মেহগিনি কাঠের আলমারি ছিল, সেটা নেই?’
অর্ক বলল, ‘আমি এ সব জানি না।’
পরিতোষ বললেন, ‘নির্ঘাৎ হাওয়া হয়ে গেছে।’
ভেতরের বারান্দায় আসতেই হেমলতাকে দেখা গেল। বাগানে ঘুরে ঘুরে একটা রেকাবিতে ফুল তুলে রাখছেন। তাঁর ছোট্ট শরীরটা গাছগুলোর ফাঁকে দুলছিল। মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। তাঁকে দেখা মাত্র পরিতোষ ছুটে গেলেন, বড়দি, ও বড়দি, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর এই অধমকে, আমি পাপী মহাপাপী।’
হেমলতাঅবাক হয়ে তাকালেন পরিতোষের দিকে। পরিতোষ তাঁর সামনে আগাছার মধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন। বোধ হয় তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না। লোকটার ভণ্ডামি দেখে অর্কর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। সে নিজে থেকে বলল, ‘উনি মালপত্র নিয়ে এসেছেন এখানে থাকবেন বলে। বাবা আপনার অনুমতি নিতে বললেন।’
এবার হেমলতার ঠোঁট নড়ল, ‘আমি অনুমতি দেবার কে?’
‘তুমিই সব। তুমি বললেই হবে। আমি মামলা তুলে নেব।’
হেমলতা জবাব দিলেন না। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গীতে অন্য গাছের সামনে গিয়ে ফুল তুলতে লাগলেন। পরিতোষ উঠে দাঁড়ালেন। তার পর করুণ গলায় ডাকলেন, ‘দিদি, বড়দি।’ হেমলতা সেদিকে লক্ষ্যই করছিলেন না। তাঁর ছোট্ট শরীরটা একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছিল।
এই সময় বারান্দা থেকে ছোটমার গলা নেমে এল, ‘অর্ক, এখন ওঁকে যেতে বল। তোমার দাদুর কাজ মিটে যাক তার পর তোমার বাবা ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন। এতদিন যখন ধৈর্য ধরতে পেরেছেন আর কটা দিন নিশ্চয়ই পারবেন।’
পরিতোষ চকিতে বারান্দার দিকে তাকালেন। মুখ অসহায় দেখাচ্ছিল তাকে। অর্ক তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ‘শুনলেন তো। এবার ঠেলা ফিরিয়ে নিয়ে যান।’
হঠাৎ পরিতোষ চিৎকার করে উঠলেন, ‘ঠিক হ্যায়। আমি অভিশাপ দিচ্ছি এই বাড়ি ভূতের বাড়ি হবে। কেউ বাস করতে পারবে না এখানে।’ তার পর হন হন করে বেরিয়ে যেতে যেতে বারান্দার দিকে তাকিয়ে আচমকা গলা পাল্টে বললেন, ‘বেশ বউমা, তোমার কথাই থাক। আমি কাজের পরই এ বিষয়ে কথা বলব।’