ব্ৰজরাখাল সেদিন ‘কল্যাণ হোক’ বলে আশীর্বাদ করেছিল বটে। কিন্তু সত্যি কি ভূতনাথের কল্যাণ হয়েছিল। এক-একবার সন্দেহ হয় ভূতনাথের। আবার মনে হয়, কল্যাণই তো হয়েছে। ব্রজরাখালের আশীর্বাদ তত তার জীবনে সফলই হয়েছে। সমস্ত পাপ, সমস্ত প্রলোভন, সমস্ত কামনাকে যে সে ত্যাগ করতে পেরেছে, সে-ও কল্যাণ বৈকি! জবা তার জীবনে যে-ঝড় বইয়ে দিয়েছিল, কেমন করে সে-ঝড়কে সে সেদিন প্রশমিত করতে পেরেছে? আর ছোটবৌঠানের অত নিবিড় সান্নিধ্যও তত তাকে… কিন্তু সে-কথা এখন থাক!
সাইকেলে চড়ে পটলডাঙায় তাগাদায় যেতে-যেতে সেদিন ননীলালের কথা মনে হলো হঠাৎ। অনেকদিন ননীলালের সঙ্গে দেখা নেই। তা ছাড়া ননীলাল সেদিন তাকে না বলে জবাদের বাড়ি কেনই বা গিয়েছিল তাও জানা হয়নি!
পুরোনো বাড়িটার সামনে আসতেই দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে–সাহেব হ্যায়?
দারোয়ান বললে–সাহেব ভবানীপুরের নয়াকুঠিতে আছে।
-নয়া কুঠি? ভূতনাথ বুঝতে পারলে না। আবার বললে–ননীলাল সাহেব আপিস থেকে ফিরেছে আজ?
এবার দারোয়ান ভালো করে বুঝিয়ে দিলে। সাহেব নতুন বাড়ি তৈরি করেছে ভবানীপুরে, সেখানেই থাকে আজকাল। এ-বাড়িতে শুধু ননীলালের শ্যালকরা থাকে। নাবালকদের নিয়ে ননীলাল সেখানে গিয়ে উঠেছে। তাও বেশি দিন নয়, মাত্র মাস খানেক হয়েছে। এখানে আসে বটে মাঝে মাঝে। এ-বাড়িটা তো শ্বশুরবাড়ি। এখানে তার থাকাও উচিত নয়। তাছাড়া এপাড়াটাও নাকি সাহেবের পছন্দ হচ্ছিলো না। বড় মোটরগাড়ি রাস্তায় ঢোকে না। সাহেব-মেমদের আসতে-যেতে অসুবিধে। তাই ভবানীপুরে নতুন রাস্তা হয়েছে এখন এলগিন রোড-সেখানে নতুন বাড়িতে উঠে গিয়েছে। ননীলালের বিধবা শাশুড়ী থাকেন এ-বাড়িতে বড়ছেলের সঙ্গে, আর ননীলাল এলগিন রোড-এর বাড়িতে উঠে গিয়েছে মেমসাহেবকে নিয়ে।
-কত নম্বর?
পকেট থেকে নোট বইটা বার করে বাড়ির নম্বরটা টুকে রাখলে ভূতনাথ। বিলের টাকা, ইট, চুন, সুরকির ভাউচার, রাজমিস্ত্রীদের হাজরে-খাতা সব সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হয় রোজ। সরকার সেটা বড় খাতায় তুলবে তবে ছুটি। কিন্তু এক-একদিন এই ছুটি হতেই রাত সাতটা-আটটা বেজে যায়। রূপচাঁদবাবুর সঙ্গে এক-একদিন দেখা হয়ে যায়। একটা ছোট নমস্কার করে ভূতনাথ। যেদিন ব্যস্ত থাকেন রূপচাঁদবাবু, সেদিন দেখতেই পান
ভূতনাথকে। সামনের উঠোনে সার-বন্দি হয়ে বসে থাকে কুলী, মিস্ত্রী, কারিগরের দল। হপ্তায়-হপ্তায় তাদের পেমেন্ট। রূপচাঁদবাবুর সামনে বিড়ি খায় না তারা আর বাবু এলেই সব গোলমাল থেমে যায়। তার আগে পর্যন্ত যত ঝগড়া, বকাবকি!
মিস্ত্রীরা বলে—বাবু তো ভালো লোক হুজুর—ওই সরকারটাই পাজি।
কতখানি কাজ হলো, তার মাপজোক নেয় ইঞ্জিনীয়ার-ওভারসিয়ারবাবুরা। তাদের মাপজোকের হিসেবও বড়খাতায় উঠে যায়। দামী দামী মাল কিনতে যায় ওভারসিয়ারবাবুরা।
ইঞ্জিনীয়ারদের সঙ্গে ওভারসিয়ারবাবুদের সড় থাকে। মোটা মাল কেনবার সময় কমিশন রেখে দেয় ওদের জন্যে। সে-কমিশন আবার ভাগ হয় ওদের মধ্যে আড়ালে।
বুড়ো মিস্ত্রী ইদ্রিস বলে—এ-মাসে কত পেলেন বিলবাবু?
–বারো টাকা—যা বরাবর পাই।
–তা বলছিনে, দস্তুরি কত পেলেন?
অবাক হয়ে যায় ভূতনাথ।—কীসের দস্তুরি?
—আপনাকে দেয় না বুঝি?
ইদ্রিসের কাছেই প্রথম জানতে পারে ভূতনাথ।
—আপনি এবার চাইবেন হুজুর, না চাইলে দেবে কেন?
-থাক গে, আমার ওতে দরকার নেই—ভূতনাথ কেমন যেন ভয় পায়।
–তা বলে আপনার ন্যায্য পাওনা-গণ্ডা বুঝে নেবেন না? অন্য বিলবাবুরা যে পায়।
–থাক ইদ্রিস, বাবুর কানে গেলে আবার এত কষ্টের চাকরিটা শেষকালে হয় তো চলে যাবে।
ইদ্রিস বলে—চাকরি যাবে কেন, বাবুর তো তাতে লোকসান নেই, দস্তুরি তো দেয় দোকানদারেরা।
তা হোক, তবু ওসব পথে না যাওয়াই ভালো। কী এমন তার ক্ষতি হচ্ছে। আগে পেতে সাত টাকা ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে, এখন বারে টাকা। তাছাড়া ট্রাম ভাড়ার খরচা নেই।
সরকার বলে—আপনার কথা আলাদা মশাই, আপনার সঙ্গে কার তুলনা।
—কেন?
—আপনি হলেন বাবুর পেয়ারের লোক, এই দেখুন না, সব বিলবাবুরা পায় সাত টাকা করে, আপনি ভর্তিই হলেন বারো টাকায়, আপনাকে কে ঠেকায়?
-কেন, ওকথা বলছেন সরকার মশাই, আপনাদের আশীর্বাদে চাকরি যদি থাকে তো অনেক ভাগ্যি বলতে হবে। কত জায়গায় পুজো দিচ্ছি, কালীঘাটে কতদিন গিয়ে কত মানত করে এসেছি।
সরকার মশাই-এর হাতের কাজ বোধ হয় সেদিন কম ছিল। পান মুখে পুরে দিয়ে হাসতে হাসতে বললে—আপনাকে ঠেকায় কে মশাই? দেখবেন তবে, আমাদের চাকরিটা যেন থাকে।
-সে কি বলছেন?
—ঠিকই বলছি, এই বলে রাখলুম, মনে রাখবেন, আপনি কি আর বেশিদিন বিলবাবু থাকবেন, ওভারসিয়ার হলেন বলে!
কথাটা জানাজানি হয়েছে তা হলে। সুবিনয়বাবুর বিশেষ সুপারিশেই তার চাকরি। সব কর্মচারিই যেন তাকে বেশ সন্ত্রম করে কথা বলে।
ইদ্রিস বলে—যদি দস্তুরি না দেয় তো বাবুকে বলে দিন।
সাইকেল চালিয়ে বড়বাড়ির দিকে আসতে-আসতে ভূতনাথ সেই কথাই ভাবছিল-সব চাকরিতেই ওই রেষারেষি। ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসেও সেই ঠাকুর নিয়ে কী কাণ্ডটাই না হয়ে গেল।
ওদিকে রাস্তায় সেই দলটা আবার বেরিয়েছে—“৩০শে আশ্বিন দোকানপাট সব বন্ধ থাকবে। দোকানী দোকান বন্ধ করবেন, কেরানীরা আপিসে যাবেন না, সেদিন অরন্ধন, আমাদের জাতীয় ঐক্যকে স্মরণ করবার জন্যে আমরা পরস্পরের হাতে রাখী বেঁধে দেবো-ভাই ভাই এক ঠাঁই” আর তারপর সেদিন বেলা তিনটের সময় পার্শিবাগানে এক বিরাট সভার অনুষ্ঠান হবে, বাঙলা দেশের রাজধানীতে দেশবাসীরা গড়ে তুলবেন ‘ফেডারেশন হল, সেই মিলন-মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করবেন জাতির অগ্রজ শ্রীআনন্দমোহন বসু-বন্দে মাতরম্’ তারপর সমবেত সঙ্গীত করতে-করতে চললো সবাই—
বাঙালীর পণ বাঙালীর আশা
বাঙালীর কাজ বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক সত্য হউক
সত্য হউক হে ভগবান—
গুটি চার-পাঁচ ছেলে। রাস্তার ভিড়ের মধ্যে ওদের উপস্থিতি নজরেই পড়ে না বিশেষ। তবু কী উৎসাহ নিয়েই না বলে চলেছে। কী অদম্য উৎসাহ। রোজই এমনি করে। অথচ লোকে যে খুব উৎসাহ দেখায় তা নয়!
সাইকেল ঘুরিয়ে ভূতনাথ বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকলো এবার।
বড়বাড়িতে আজকাল আর তেমন যেন জাঁকজমক নেই। তবু দিনের শেষে এখানে আসবার জন্যে ভূতনাথের ছটফটানির আর অন্ত থাকে না। ব্রিজ সিং এখন একাই ডিউটি করে।
একদিন ভূতনাথ জিজ্ঞেস করেছিল—তোমার দোস্তভাই —নাথু সিং কোথায় গেল?
–ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে এক মাসভি হলো, আর আসছে
শালাবাবু।
–তা বলো না কেন সরকারবাবুকে, আর একজন রাখতে একা দিনরাত পাহারা দিতে পারবে কেন?
তা পাহারাও আজকাল সেই রকমই দেয় ব্রিজ সিং। বন্দুকটা পাশে রেখে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খৈনি ঘষে। উর্দির আর সে-বাহার নেই। শুধু গাড়ি-টাড়ি এলে-গেলে চিৎকার করে ওঠে—হুঁশিয়ার
–হুঁশিয়ার হো–
এদানি ইব্রাহিমের ঘরের সামনে রেড়ির তেলের বাক্স-বাতিটা আর জ্বলে না। একদিন ঝড়ে পড়ে গিয়েছে উঠোনের ওপর। তারপর থেকেই অন্ধকার। সন্ধ্যেবেলা থেকেই উঠোনটা অন্ধকার। আস্তাবল বাড়িটাতে তেমন গাড়ি-ঘোড়ার আসা-যাওয়া নেই। ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেটখানা সেই যে সেদিন জানবাজার থেকে এসে ঢুকেছে ওখানে আর বোধহয় বেরোয় নি। ভালো করে ধোয়ামোছও হয় না আজকাল।
–কেমন আছো আজকাল বংশী?
আস্তে-আস্তে হাটে বংশী। এখনও দুর্বল। তেমন করে ছোটাছুটি করতে পারে না। বলে—এখন একটু ভালো আছি শালাবাবু।
—ছোটমা তোমার কেমন আছে?
–কেউ ভালো নেই শালাবাবু, কেউ ভালো নেই, সেই যে ছোটবাবু পড়েছে, আজো উঠতে পারলো না, আমি তো উঠে হেঁটে দিব্যি বেড়াচ্ছি। আজো শশী ডাক্তার এসেছিল, বললে—এখনও সময় লাগবে। শশী ডাক্তার মদ খেতে একেবারে মানা করে দিয়েছে আজ্ঞে।
ভূতনাথ বলে—তা বলে ছোটবাবু কি আর সত্যি-সত্যি মদ ছাড়তে পারবে?
বংশী বলে—না শালাবাবু, তাই তো আশ্চর্য হয়েছি, ছোটবাবু মদ আর ছোঁয় না, বলে—আমার সামনে ও-বিষ আর আনবি না, আমি খেতে চাইলেও দিবিনে আমাকে।
-সত্যি?
—আজ্ঞে, মা কালীর দিব্যি বলছি, একদিনও খায় না, আমার হাতেই তো মদের আলমারির চাবি ছিল, সব ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছি—চাইলেও আর পাবে না কেউ।
-সে কি? ভূতনাথও কম অবাক হয়নি। এ-ও কি সম্ভব?
–চেহারা যদি দেখেন ছোটবাবুর তত আপনি আরো অবাক হয়ে যাবেন। এই এমনি হয়ে গিয়েছে-বলে হাতের কড়ে আঙলটা উচু করে দেখায়।
-হ্যাঁ শালাবাবু, এই এমনি রোগা হয়ে গিয়েছে। উঠতে হাঁটতে তো পারে না, কেবল শুয়ে পড়ে আছে—খুব যখন খেতে ইচ্ছে করে, তখন সোডা খায় কেবল, আস্তে-আস্তে ধরে তুলে পিঠে বালিশ দিয়ে বসিয়ে দিই দিনের বেলা, আবার শুইয়ে দিই খানিক পরেই, বলে-পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছে এক নাগাড়ে শুয়ে-শুয়ে–আমি না হলে ছোটবাবুর একদণ্ড চলে না আজকাল। একলা মানুষ কোন্ দিকে দেখি বলুন তো হুজুর।
—আর সব কোথায় গেল?
—এখন বাজার করতেও আমি, তামাক সাজতেও আমি, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই একা।
—কেন, লোচন কোথায় গেল?
–কেন, আপনি জানেন না কিছু?
-আমি তো বেরোই সেই সকালবেলা, তারপর দুপুরবেলা ভাত খেতে আসি আধঘণ্টার জন্যে, তারপর সেই আসতে যার নাম রাত্তির হয়ে যায়।
—তা তো জানিই। লোচন তত সেই পান-বিড়ির দোকান করেছে বড়বাজারে না কোথায়, কিন্তু মধুসূদন সেই যে দেশে গেল আর আসবার নামটি নেই হুজুর, কী নেমোখহারাম দেখুন, এই বড়বাড়ির নুন খেয়ে আমরা সাতপুরুষ মানুষ হয়েছি, তোর এই সময়ে যাওয়া ভালো হলো—হ্যাঁ, না হয় বুঝলুম মাইনে পায়নি ক’মাস, আরে মাইনেটাই বড় হলো, এই যে আমরা ভাইবোনে সাত মাস মাইনে পাইনি–কিছু বলেছি?
মেজবাবু রোজ আর গাড়ি নিয়ে বেরোয় না আজকাল। যেদিন বেরোয় দেরি করে, সেদিন দেখা হয়ে যায়। সেই বড়মাঠাকরুণ, মেজমাঠাকরুণ থাকে সঙ্গে। আর থাকে হাসিনী। পানের ডিবে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। ভৈরববাবু আজকাল নিয়ম করে রোজ আসতে পারে না। বয়েস তত বাড়ছে। আর তেমন ফুর্তিও নাকি হয় না আজকাল। রাত বারোটা না-বাজতেই আবার মেজবাবু ফিরে আসে। ঘুমের মধ্যে গেট-এর ঘড়ঘড় শব্দ কানে আসে। আস্তাবল বাড়িতে ঘোড় এসে ঢোকে। অন্ধকার উঠোন। তারই মধ্যে পা ঠুকে-কে ইব্রাহিম গিয়ে ওঠে নিজের ঘরে।
বিধু সরকারের ঘরের সামনেও আজকাল বেশি ভিড়।
শুধু বরফওয়ালা নয়, মুদিখানার লোক আসে, কাপড়ওয়ালা আসে, গয়লা আসে, মিস্ত্রী-মজুর আসে। বিধু সরকারের মেজাজ আরো উগ্র হয়েছে। বলে—খ্যাচ খ্যাচ করিস কিসের জন্যে শুনি? পাওনা কি কখনও পাসনি? তবে এত হেনস্তা কেন? পাবি, পাবি, পাবি, ব্যস এই বলে রাখলাম। বাবুদের ধর্মের পয়সা, অধর্ম বাবুরা করবে না-তোদের দুটো পয়সা মেরে বাবুরা বড়লোক হবে নাকি!
কিন্তু রাত্রে যেন সেই সুরটা আজকাল বড় ঘন-ঘন শোনা যায়। খিড়কির দিকের সেই নারকোল গাছটার গোড়ায় একতলার সিঁড়ির নিচ থেকে প্রথমে মৃদু একটা সুর ওঠে। তারপর তার ব্যাপ্তি বাড়ে। প্রদক্ষিণ করে সমস্ত বাড়িটা। দক্ষিণের বাগানটা ঘুরে এসে যেন দাঁড়ায় একেবারে বড়বাড়ির অন্ধকার উঠোনে। চায় এদিক-ওদিক একবার। তারপর ওঠে ছাদের ওপর। তখন সেসুরটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। আকাশে-বাতাসে সেই তীব্র সুর সমস্ত অন্তরীক্ষ ছাপিয়ে এক আর্তনাদের মত আওয়াজ করে। সে-আর্তনাদে বড়বাড়ির ভিত্ পর্যন্ত যেন কেঁপে ওঠে। তারপর ভোরের দিকে যখন দক্ষিণের বাগানের আমলকি গাছটার ডাল থেকে সেই অদ্ভুত পাখীটা ডাকতে ডাকতে কোথায় হঠাৎ উড়ে যায়, তখন ধীরে-ধীরে থেমে আসে সে-সুর। তখন বুঝি আবার গিয়ে ঢুকে পড়ে সেই অন্ধকূপ কোঠরে। দিনের আলোয় লোকালয়ে বুঝি ওর বেরোনো নিষেধ।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে গিয়েও যেন আলস্য ধরে ভূতনাথের। সারা শরীর যেন ব্যথা করে। আর মন? মন কি ব্যথা করে না? কে জানে মনের খবর। নিজের মন নিয়ে কখনও মাথা ঘামাবার তো সময় হয়নি। একবার এক জায়গায় হয় তো একটু সময় হয়েছিল কিন্তু সে কথা তো ভুলে যাওয়াই ভালো। এক-একবার মনে হয়, পটেশ্বরী বৌঠানের কথা। ভাবলেই কেমন যেন ভয় করে। অত যার রূপ, অতখানি যে স্নেহ করে, ভালোবাসে, তাকে এতখানি ভয় করা যেন অন্যায়। তবু মুখ দেখাতেই কেমন যেন ভয় করে। কেমন করে মুখ দেখাবে সে। বৌঠানের মুখখানা যদি কালো দেখে, যদি দেখে সে-মুখেও হাসি নেই—তাহলে? তাহলে সহ্য করবে কী করে ভূতনাথ? যদি দেখে, বৌঠানও শীর্ণ হয়ে গিয়েছে। অত্যাচারে, রাত জাগায়, হতাশায় আর দীর্ঘশ্বাসে? তার চেয়ে না দেখা করাই ভালো। বার-বার। চোরকুইরির বারান্দার দরজাটার সামনে গিয়েও কতদিন দাঁড়িয়েছে। খিলটা খুলতে গিয়ে আবার থেমেছে। কী দেখবে সে! কী শুনবে সে!
কিন্তু রাত্রে স্বপ্নের ঘোরে এক-একবার সে যায় পটেশ্বরী বৌঠানের ঘরে। বৌঠানের চেহারা দেখে ভূতনাথ চমকে যায়। এ কি চেহারা হয়েছে? কোথায় গেল সেই রূপ! কোথায় গেল সেই লাবণ্য! সেই স্তিমিত-ভাস্বর চোখ। আর সেই চোখের চাউনি?
বৌঠান বলে-ভূতনাথ তুই বেইমান।
ভূতনাথ অপরাধীর মতো চুপ করে থাকে।
বৌঠান বলে—তোকে খাওয়ালুম পরালুম, আর আমার কাছে তুই একবারও আসিস নে, আমি তোর কী সর্বনাশ করেছি?
ভূতনাথ অনেকক্ষণ পরে বলে—তোমার কেন এমন হলো বৌঠান, তোমাকে তো আমি এমন করে দেখতে চাই নি।
বৌঠান বলে—কেন, আমার তো কিছুই হয়নি, আমি তো এখন সুখী ভূতনাথ, ছোটকর্তা তো এখন বাড়িতে থাকে রে আজকাল। আমার তত আর কোনো দুঃখ নেই—কেন তুই ভাবছিস।
ভূতনাথ বলে-তোমার চেহারা তবে কেন এমন হলো?
-কই, কী হয়েছে চেহারার?
—তা আমি বলতে পারবে না, কিন্তু তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে যে—তুমি হাসো না যে আগেকার মতো।
–এই তো হাসছি—এই দ্যাখ-কত হাসছি–বলে হো-হো করে হাসতে লাগলো বৌঠান। হাসতে-হাসতে হঠাৎ সে-হাসি যেন কান্নায় পরিণত হয়। গলা চিরে যায় বৌঠানের। সেই কান্নার শব্দে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায় ভূতনাথ। চারিদিকে চেয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই। শুধু অন্ধকার চোরকুঠুরি। ভূমিপতি চৌধুরীর অভিসার-কক্ষ। সমস্ত কলকাতা নিঃশব্দ, নিঝুম, নিশুতি। নিচে আস্তাবলে ঘোড়াদের পা ঠোকার শব্দ পর্যন্ত নেই, সেই রাতজাগা পাখীটা পর্যন্ত আর ডাকে না বাগানের আমলকি গাছটা থেকে। মনে হয় এ-যেন বড়বাড়ি নয়—এ প্রেতপুরী।
কিন্তু ভবানীপুরে গিয়ে দাঁড়ালে, রাত্রের স্বপ্ন আবার কোথায় মিলিয়ে যায়। সার-সার বাড়ি তৈরি হচ্ছে রূপচাঁদবাবুর। ইট, কাঠ, লোহা, চুন, সুরকি, ছাদ পেটানোর সুর। কলকাতা এখানে আবার যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে। ছাদের পর ছাদ উঠছে। একএকটা বাড়ি শেষ হয়, আর নতুন লোকজন আসে গাড়ি করে। খাট, টেবিল, চেয়ার, আসবাবপত্র এসে নামে। ভরে যায় লোক শহরে। দু’দিনেই চেহারা ফিরে যায় রাস্তার।
ইদ্রিস বলে-দস্তুরির কথা বলেছিলেন বাবুকে?
—না, বলিনি ইদ্রিস।
—তা যদি বলেন তো আমিই বলতে পারি আপনার হয়ে।
–না, তোমাকে আর বলতে হবে না ইদ্রিস।
—আমি ওভারসিয়ার বাবুদের বলবো। আপনার ন্যায্য পাওনা কেন দেবে না হুজুর?
ইদ্রিসের ন্যায়-অন্যায় নিয়ে ইদ্রিসই থাক, ভূতনাথের তাতে দরকার নেই। ব্রজরাখাল তাকে আশীর্বাদ করে গিয়েছে, তার কল্যাণ হবে। ব্রজরাখালের কথা কি মিথ্যে হবে! কিন্তু জীবনে এর বেশি কিছু তো চায়নি ভূতনাথ! ফতেপুরে মঙ্গলচণ্ডীতলায় প্রণাম করে ভূতনাথ ছোটবেলায় একদিন যা কামনা করেছে, বনমালী সরকার লেন-এর নরহরি মহাপাত্রের দেবতামণ্ডলীর সামনে প্রণাম করে সেই একই প্রার্থনা সে করেছে। যেন কল্যাণ হয়। কল্যাণ শুধু নিজের নয়। সকলের কল্যাণ। ব্রজরাখালের কল্যাণ, ছোটবৌঠানের কল্যাণ, জবার কল্যাণ, বংশীর কল্যাণ—সকলের, সকলের। কাউকে বাদ দিয়ে তার নিজের কল্যাণ দরকার নেই।
সেদিন হঠাৎ ভবানীগুর দিয়ে চলতে-চলতে এলগিন রোড-এর সামনে এসেই থমকে দাঁড়ালো ভূতনাথ! ননীলালের সঙ্গে একবার দেখা হয় না।
পকেট থেকে ঠিকানা লেখা নোট বইটা বের করে একবার দেখলে বাড়িগুলোর সামনে! আশ্চর্য। সামনের বাড়িটাই ননীলালের। কী বিরাট বাড়ি! প্রাসাদ বললে চলে। সাইকেল থেকে নেমে পড়লো ভূতনাথ।
—ননীবাবু আছে? নীলালবাবু? সামনের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতে হলো।
দারোয়ান ভুল শুধরে দিলে—বাবু নেই—সাহেব আছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে ভূতনাথ আবার বললে—সাহেব বাড়িতে আছে?
দারোয়ান বললে—সাহেব বেরিয়ে গিয়েছে।
–কখন ফিরবে?
—কিছু ঠিক নেই। দারোয়ানের উত্তরগুলো শুনতে ভালো লাগলো না অবশ্য। হয় তো তার চেহারা দেখে ঠিক অনুমান করতে পারছে না, সাহেবের সঙ্গে তার আত্মীয়তা কতখানি। তবু দারোয়ানের কথায় মন খারাপ করা বোকামি! আবার জিজ্ঞেস করলে—কালকে সন্ধ্যেবেলা এলে দেখা হবে?
-না।
—পরশু সকালবেলা?
–না।
—তারপর দিন?
—না বাবু, না। সাহেব বিলাইত চলে যাবে কাল।
–বিলেত? ননীলাল বিলেত যাবে? আবার জিজ্ঞেস করলে কালই যাবে?
–হ্যাঁ বাবুজী।
ভূতনাথ অগত্যা সাইকেল-এ উঠলো। কালকেই ননীলাল বিলেত যাচ্ছে। একবার তার আগে দেখা করা যায় না। একসঙ্গে পড়েছে দুজনে, এক স্কুলে, একই ক্লাশে। কী ভালোই যে লাগতো তখন ননীলালকে। তার হাতের লেখা চিঠিটা বোধ হয় আজো টিনের স্যুটকেসের মধ্যে খুঁজলে পাওয়া যাবে। কোথা থেকে মানুষের কী হয়ে যায়। বাড়িখানার দিকে আবার পেছন ফিরে দেখলে ভূতনাথ। কত বড় বাড়ি। বড়বাড়ির চেয়েও বড়। উত্তরমুখো বাড়ি। কিন্তু সমস্ত রাস্তা জুড়ে আছে সামনের দিকটা। দক্ষিণ দিকেও কতদূর পর্যন্ত প্রসার কে জানে। সবটা এখান থেকে দেখা যায় না। জানালায়-জানলায় পর্দা। তামার প্লেট-এর ওপর ননীলালের পুরো নামটা লেখা। কেমন করে এ হলো? ও-দিকে বড়বাড়ির চৌধুরী বাবুরা কেন পড়ে যাচ্ছে, আর এদিকে এরা ওঠে কী করে? ওদের তো অনেক টাকা। ননীলালেরই তত টাকা দিন টাকা ধার করে নিয়ে গিয়েছে ছুটুকবাবুর কাছ থেকে। আজ পর্যন্ত সে-টাকা তল শোধই দিলে না। তবে কেন এমন হয়। ননীলাল অবশ্য বলেছিল একদিন—ওরা যে বসে-বসে খায়।
কিন্তু ননীলালও তত বসে খায়। কী এমন পরিশ্রম করে সে। গাড়িতে করে শুধু তো ঘুরে বেড়ায়। টাকা ওড়ায় দু’হাতে। মদ তো ননীলালও খায়। মেয়েমানুষ তো ননীলালও রাখে। কত কাণ্ডই করেছে ননী জীবনে! ছুটুকবাবুকে ওই ননীলালই তে নিয়ে গিয়েছিল মতিয়া বাঈজীর বাড়িতে! তবে?
আর ওই তো রূপচাঁদবাবু! কী নিষ্ঠা নিয়ে ব্যবসা করছেন। মাসে-মাসে মাইনে দিয়ে যাচ্ছেন ঠিক। এতগুলো ইঞ্জিনীয়ার, ওভারসিয়ার, বিলবাবু, রাজমিস্ত্রী, ছুতোর মিস্ত্রী খাটছে। নতুন শহর গড়ে তুলছেন ভবানীপুরে! লোহা, কাঠ, ইট দিয়ে স্বপ্ন গড়ছেন মানুষের, ভবিষ্যৎ পাকা করে তুলছেন নিজের, পরের, সকলের।
রূপচাঁদবাবু বলেন—ভাঙা গড়াই নিয়ম-নদীর যখন এপার ভাঙে, তখন ওপার গড়ে ওঠে।
ভবানীপুরের নতুন পাড়ার ছেলেরা খেলা করে পার্কে। ফুটবল খেলে, গান গায়, ওরা গড়ে উঠছে বুঝি। কিন্তু একদিক গড়ে তুলতে গেলে আর একদিক কি ভাঙতেই হবে?
সেদিন ইদ্রিস কাজে আসেনি। কাজকর্ম বন্ধ হবার যোগাড়।
পরদিন আসতেই প্রশ্ন। ইঞ্জিনীয়ার সাহেব, ওভারসিয়ারবাবুও রেগে আগুন। ওভারসিয়ারবাবু বলে-ফুরনের কাজ আমাদের তুমি কী বলে কামাই করলে? একটা আক্কেল নেই তোমার?
ইদ্রিস বলে—আমারই না-হয় রোজটা নষ্ট হলো—আপনাদের কী ক্ষতিটা হলো শুনি?
—আমাদের আবার ক্ষতি কী? কিন্তু বাবুকে তো খেসারৎ দিতে হবে?
–কীসের খেসারৎ? আর যদি খেসারৎ দিতেই হয় তো দিন , কত দিক থেকে লাভ তো হচ্ছে বাবুদের—একটু না-হয় ক্ষতিই হলো!
–ওই কথা বাবুকে গিয়ে বলবে আমি?
–বলুন গে আপনি, আমরা কাজের ভয় করি না, যেখানে যাবো, সেইখানেই কাজ মিলবে আমাদের, কাজের কি অভাব আছে ওভারসিয়ারবাবু, কাজের অভাব নেই আজকাল। তামাম ভবানীপুর পড়ে আছে, সব বাড়ি হবে—আমাদের ডাকতেই হবে।
-নাও, নাও, কাজ করে, কেবল কথা-ওভারসিয়ারবাবু গজগজ করতে-করতে চলে যায়।
তারপর ভূতনাথের দিকে চেয়ে ইদ্রিস বলে—দেখুন তত বিলবাবু, খামকা ঝগড়া করে—ভারি ভদ্রলোক হয়েছে আমার। আমাদের চটালে আমরাও ফাঁকি দিতে জানি, এমন বাড়ি বানাবো, দু’দিনে দেয়াল ফেটে চৌচির হয়ে যাবে—উঠে যাবে কোম্পানী।
ভূতনাথ সান্ত্বনা দিয়ে বলে চুপ করে ইদ্রিস, কেন ঝামেলা বাড়াও, তা সত্যি কালকে আসোনি কেন?
ইদ্রিস বলে—আসবো কী করে বিলবাবুযে-বস্তিতে ছিলাম, সেখান থেকে কাল ঘরদোর সব তুলে নিয়ে যেতে হলো যে!
-কেন?
—আমাদের বস্তীতেও বাড়ি হবে যে, পাঁচ শ’ লোকের বাস, রাতারাতি উঠতে পারা যায়? বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে আবার এক জায়গায় আস্তানা পেলে তবে তো!
তোমাদের বস্তীতেও বাড়ি হচ্ছে বুঝি?
-হ্যাঁ বিলবাবু, বাড়ি হলেই তো ভালো আমাদের, কাজ পাবে, তা বুঝি—কিন্তু নিজেদের তত আর থাকা হবে না!
ভূতনাথ ভাবলে—এ তো বেশ মজার।
ইদ্রিস বলে—তাই তো ভাবি-বাড়ি করবো আমরা, থাকবে অন্য লোক! এই দেখুন না, ভবানীপুরের বস্তিতে ছিলাম, এখন উঠে গেলাম বালীগঞ্জের ধোপাপাড়ায়, তারপর যখন আবার বালীগঞ্জে শহর তুলবে, তখন যাবো চেতলায়।
পরদিন ননীলাল সেই কথাই বলেছিল।
ভোরবেলাই সেদিন বেরিয়ে পড়েছিল ভূতনাথ। অল্প-অল্প কুয়াশা চারদিকে। রাত থাকতে উঠতে হয়েছে। চাকর-বাকর কমে গিয়েছে আজকাল বড়বাড়িতে। সব সময় জল থাকে না ভিস্তিখানায়। অত সকালে কলেও জল আসে না। কেউ দেখবার আগেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। রাস্তা তখন নির্জন। যখন এলগিন রোড-এ এসে পড়লো তখন বেশ ফর্সা হয়েছে। ননীলাল বরাবরই ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে। দেখা করবার এইটেই সময়। তবু এরই মধ্যে ননীলালের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আরও অনেক লোক জড়ো হয়েছে।
দারোয়ান যে-ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেল, সে-ঘরটার ভেতর চারপাঁচটা বেঞ্চি। আরো ক’জন বসে আছে। কিন্তু বসে-বসে ক্লান্তি, ধরে গেল ভূতনাথের।
পাশের লোকটি হঠাৎ বললে—আপনি কোত্থেকে আসছেন স্যার?
ভূতনাথ চেয়ে দেখলে লোকটার দিকে। গরীব লোক। বেঞ্চির ওপর একটা পা তুলে বসে আছে। ভূতনাথ বললে— বৌবাজার থেকে।’
—চাকরির জন্যে বুঝি?
–না
—তবে কি দালালি?
–না।
অন্য লোকগুলো তাদের কথা শুনছিল। কেউ-কেউ ভদ্র চেহারার, একজন শুধু কোট-প্যান্ট পরা সাহেব। সবাই প্রতীক্ষমান। নতুন বাড়ি। নতুন দেয়াল। দেয়ালের গায়ে লেখা রয়েছে–গোলমাল করিবেন না।
আগের লোকটি এবার বললে—আমি আসছি মশাই বরানগরু থেকে।
—সে তো অনেক দূর।
—তা অনেক দূর বললে তো চলবে না, পেটের দায়ে লোকে কঁহা কঁহা যায়, এ তো সামান্য। সেই রাত থাকতে বেরিয়েছি, শুনলুম কিনা সাহেব চলে যাবে আজ।
ভূতনাথ বললে—আমিও শুনেছি।
—তবে তো ঠিকই বলেছে হরিহরদা’–হরিহরদা’ কাজ করে কি না সাহেবের আপিসে, আমাকে বলেছে—সাহেবের পা গিয়ে জড়িয়ে ধর—একটা হিল্লে হয়ে যাবেই। কী বলেন স্যার, হবে না?
কোট-প্যান্ট পরা লোকটি তখন একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। সিগারেট খেতে-খেতে একবার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। কে জানে কী কাজ ওর। হয় তো চাকরির জন্যেই এসেছে।
এমন সময় হঠাৎ সকলের যেন একটু সন্ত্রস্ত ভাব দেখা গেল। পাশের ঘরে যেন শব্দ হলো একটু। কোট-প্যান্ট পরা লোকটি হাতের সিগারেট ফেলে দিলে।
দারোয়ান এসে পড়লো। বললে—আপনাদের নাম-ঠিকানা সব এই কাগজে লিখে দিন।
কোট-প্যান্ট পরা লোকটি আগে লিখে দিলে—এস, আর, মিটার।
পাশের লোকটা বললে—আমি তো লিখতে জানিনে স্যার, আপনি একটু লিখে দেবেন?
ভূতনাথ সকলের শেষে লিখলে—ভূতনাথ চক্রবর্তী, বড়বাড়ি, বৌবাজার।
দারোয়ান কাগজ নিয়ে চলে গেল। সব ক’জন লোকই যেন একটু তটস্থ হয়ে বসেছে। এখনি এক-এক করে ডাক আসবে। ভূতনাথও কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। এত লোকের মধ্যে তার নামটাই অমন নাম পিসিমা কেন যে রেখেছিল। বাবার দেওয়া নাম ‘অতুল’ই তো ছিল ভালো। পিসিমা বলতো–বউ-এর ছেলে হয় আর মরে যায়, শেষে পঞ্চানন্দের দোর ধরে এই ছেলে হলো–সতীশ বললে এর নাম থাক ‘অতুল’-আমি বললাম —পঞ্চানন্দের দোর ধরে হয়েছে, এর নাম থাক ভূতনাথ, তা ভূতনাথ তো ভূতনাথ–ভোলানাথ আমার, খেতে ভুলে যায়, ঘুমোতে ভুলে যায়, এমন ছেলে কোথাও দেখেছো মা তোমরা। ভূতনাথের মনে হয়—কেন, অতুল নাম থাকলেই তো ভালো হতো। অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী। বাবা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন অতুল বলেই কিন্তু ডাকতো তাকে।
দারোয়ান হঠাৎ এল আবার। ডাকলে—ভূতনাথবাবু—
এত লোক থাকতে তাকেই প্রথম ডাকা। ভূতনাথ তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে ঢুকলো।
—কী খবর ভূতো, তুই?
ভূতনাথ কী বলে প্রথম কথা বলবে ভাবতে পারলে না। এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটলো। সময় পাওয়া গেল না মোটে। আর ননীলালেরও চেহারাটা কেমন হয়ে গিয়েছে যেন। যেন আরো বয়েস বেড়ে গিয়েছে। ভয় হয় দেখলে। বিরাট একটা টেবিল। চারদিকে কাগজপত্র। একটা কাগজে কী যেন লিখছিল। হাতে তখনও কলমটা রয়েছে। মুখে সিগারেট। চোখে চশমা।
—বোস, তোর চাকরিটা খালি পড়ে রয়েছে—আর দেখাই করলি না তুই—আছিস কোথায়? এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে গেল ননীলাল।
ভূতনাথ বললে—সেই বড়বাড়িতে, আবার কোথায় থাকবে।
—এখনও ওখানে আছিস…কিন্তু চাকরি?
—চাকরি তো একটা করছি রূপচাঁদবাবুর কোম্পানীতে। বিল সরকারের কাজ পেয়েছি একটা।
—ভালোই হয়েছে, আমিও চলে যাচ্ছি আজ।–কোথায়?
—তোকে বলেছিলাম, একবার বেড়াতে যাবোআজই যাচ্ছি—শুধু দেরি হলে চূড়োর জন্যে।
—ছুটুকবাবু? ছুটুকবাবুর জন্যে?
ননীলাল আর একটা সিগারেট ধরালে। তারপর বললো, ওদের বড়বাড়িটা আমার কাছে বাঁধা রাখলে কিনা–আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না।
বাঁধা। বন্ধক। বড়বাড়ি! কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল সমস্ত। ননীলাল এ বলছে কী!
ননীলাল বললে-আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না ভাই, নিজেদের মধ্যে, এতদিনের জানাশোনা, তা ছাড়া ছোটবেলা থেকে ওদের বাড়িতে যাচ্ছি, কত খাওয়া-দাওয়া করেছি ও-বাড়িতে, চুভোর কাছে কতবার কত টাকা নিয়েছি, শোধ করিনি, তুই তো জানিস কতদিনের আলাপ ওদের সঙ্গে—অথচ তাই-ই করতে হলো—বড় সঙ্কোচ লাগছিল নিজের মনে।
ভূতনাথের মন তখন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। যা শুনছে সব সত্যি! সেই আস্তাবলবাড়ি, খাজাঞ্চীখানা, তোষাখানা, ভিস্তিখানা, পূজোবাড়ি, বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি, কৌস্তুভমণি, ছুটুকবাবু, ভূতনাথের জীবনের অর্ধেকের সঙ্গে ও-বাড়ির সমস্তটা জড়িয়ে আছে যে। সেই ভৈরববাবু! ছুটুকবাবুর বিয়ে! আর সকলের চেয়ে সেই পটেশ্বরী বৌঠান। পটেশ্বরী বৌঠানের
কী হবে!
বৌঠান বলেছিল—এ-সব কর্তাদের ব্যাপার,আমরা ও নিয়ে মাথা ঘামাই না।
—কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন এমন হলো?
ননীলাল বলতে লাগলো—প্রথমে আমার ইচ্ছে ছিল না, অতবড় বংশ, বনেদী বাড়ি, আমার কাছে যখন চূড়ো প্রস্তাব করলে, তখন আমি বললুম—আমার দ্বারা হবে না ভাই, কলিস তো ও-টাকার জন্যে আমি অন্য লোক যোগাড় করে দিচ্ছি।
চূড়ো বললে—আর কেউ হলে জানাজানি হতে পারে, ওটা তুই-ই দিয়ে দে। আমরা শোধ করে দেবে বছর দু’-একের মধ্যে। সুদ যা বলবি তাই-ই দেবো।
শেষে রাজি হলাম—কিন্তু জানি ও আর শোধ হবে না, টাকাও ওদের যোগাড় হবে না, ও-বাড়িও ওদের ছাড়তে হবে।
–বাড়ি ছাড়তে হবে? ভূতনাথ যেন নিজের কানে নিজের ফঁসির হুকুম শুনছে।
–ছাড়তে হবে বৈকি! টাকা তো আমার একলার নয়, আমাদের ফ্যামিলির টাকা, আমার নাবালক শালারা রয়েছে, আমার শাশুড়ী রয়েছে, তারা সুদই বা ছাড়বে কেন? আর টাকা দিয়ে বন্ধকি বাড়িই বা হাতছাড়া করবে কেন! শেষ পর্যন্ত তেমন হলে বাড়িও খালি করতে হবে বৈকি!
–তা হলে যাবে কোথায় ওরা? এতদিনের বংশ, এত লোকজন, চাকর-বাকর, পূজা-পার্বণ, বিগ্রহ সকলকে নিয়ে সব তুলে নিয়ে-সে কি সম্ভব?
ননীলাল বললে—চূড়ো তত এটর্নিশিপ পাশ করতে পারলে না জানিস—তা বিয়ের পর কেউ এগজামিনে পাশ করতে পারে?
—কী করবে তা হলে?
—বলছিল আর একবার পরীক্ষা দেবে, কিন্তু ও আর পাশ করতে পারবে না, দেখে নিস। এখন ওর মাথায় কেবল ওই সব চিন্তা, স্বপ্ন দেখছে কেবল সম্পত্তি ফিরে পাবার, ব্যাঙ্কটাও ওদের ফেল মারলো। জমিদারী যেটুকু আছে, তাতে কিছুই চলে না, এদিকে কোলিয়ারি কিনলে তাতেও ওই…
—তাতে কী? কোলিয়ারি চললো না কেন?
ননীলাল আর একটা সিগারেট ধরালো এবার। বললেওদের কপালই খারাপ, যেমন প্রথমে আমাকে কিছু বললে না, জিজ্ঞেসও করলে না, ভাবলে এত টাকার কারবার, আমি বোধহয় দালালি মারবো। তাই বিশ্বাস করে ঝুমুটমলকেই ডাকলে—এখন বুঝতে পেরেছে। এতখানি নেমকহারামি আমি অন্তত করতে পারতুম না—অনেক খেয়েছি রে ওদের বাড়িতে, অনেকদিন চূড়োর পয়সায় বাবুয়ানি করেছি, ওর অনেক পয়সা ধার নিয়ে শোধ দিইনি আজ পর্যন্ত—একটু কৃতজ্ঞতা অন্তত পেতে আমার কাছে। এখন ছুটুককে তাই বললুম—মায়োয়াড়ীকেই তুই বেশি বিশ্বাস করলি!
চুলো বললে-কাকারা যা করতো তাতে তো আগে আমি কিছু বলতে পারতুম না।
ননীলাল আবার বলতে লাগলো—তা শেষকালে দেখা গেল শুধু ওপরটাই কয়লা, নিচে সমস্ত পাথর—ভালো করে এক্সপার্ট দিয়ে দেখালে না পর্যন্ত, অত সময়ই ওদের নেই—যা করে বিধু সরকার আর ঝুমুটমল। ননীলাল এবার হাতঘড়িটা দেখলে।
ভূতনাথ বললে—আমি এবার উঠি ননীলাল—দেরি হয়ে যাচ্ছে হয় তো তোর।
রাস্তায় বেরিয়ে কান্না পেতে লাগলো ভূতনাথের। মনে হলো এখনি সে দৌড়ে যাবে বড়বাড়িতে। পটেশ্বরী বৌঠানের কাছে না যেতে পারলে যেন তার স্বস্তি হচ্ছে না। বড়বাড়ির সমস্ত প্রাণীর জন্যে যেন মায়া হতে লাগলো তার। সেই ছুটুকবাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু, বৌঠান, বংশী, চিন্তা, ইব্রাহিম, ইয়াসিন সবাই। এমন কি সেই রান্নাবাড়ির আরশোলাটা পর্যন্ত। কেন এমন হলো! কোথায় যাবে সব! এর হাত থেকে বাঁচবার কি কোনো পথ নেই? নিজের জন্যে তার চিন্তা নেই। কিন্তু বৌঠান! আর ছোটবাবু যে উঠতে পারে না—তাকে যে উঠে বসিয়ে ধরে খাওয়াতে হয়, স্নান করাতে হয়! ছোটবাবু কোথায় যাবে! বনেদী বংশ, কখনও নিজের হাতে এক গেলাশ জল গড়িয়ে পর্যন্ত খায়নি। কখনও নিজের কাপড়টার হিসেব পর্যন্ত রাখেনি! কোথায় যাবে ওরা! কোথায় ওরা যাবে!