ছত্রিশ
বারীনকে ভাল লাগল অনিমেষের। একটু আত্মভোলা টাইপের, কাজের নেশা মাথায় চাপলে সময়ের ঠিক থাকে না। বিবেকানন্দ মার্কেটে ওঁর একটা ছোট স্টল আছে। স্টলটা শিলিগুড়িতে বেশ বিখ্যাত। এক হাতে সাইনবোর্ড লেখা থেকে শুরু করে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর কভার এঁকে যান বারীন ওখানে বসে। পয়সাকড়ি তেমন পান কিনা সন্দেহ আছে কারণ তাঁর পোশাক যথেষ্ট ময়লা, দাড়ি অবিন্যস্ত এবং সংসারে একমাত্র মা থাকলেও কোনও দামি আসবাব নেই।
কিন্তু এই লোকটির সঙ্গে পরিচয় হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অনিমেষ তাঁকে পছন্দ করে ফেলল। কোনও রাখ-ঢাক নেই কথাবার্তায়। এমন একটা স্পষ্ট আন্তরিকতা আছে যে, নিজেকে দূরে রাখতে ইচ্ছে করে না। বারীনের মা খুব ঠান্ডা মানুষ। বললেন, ‘তোমার বোধহয় খেতে একটু অসুবিধে হবে। আমি মাছ মাংস রাঁধতে পারি না।’
কথাটা শোনামাত্র হেমলতার মুখ মনে পড়ে গেল। মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট তফাতে হেমলতা এবং সরিৎশেখর রয়েছেন। মাছ মাংস রান্নায় হেমলতারও এখন আপত্তি। বারীনের বাড়িতে অনিমেষের বেশ স্বস্তি হল।
দুপুর পেরিয়ে গেলে অনিমেষ বারীনের সঙ্গে বের হল। পায়জামা পাঞ্জাবি যথেষ্ট ময়লা। কাঁধে ঝোলা, বারীন ওকে রাস্তাঘাট বোঝাচ্ছিলেন। শিলিগুড়িতে আসা-যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ থেকেছে অনিমেষ, আজ ভাল করে চেয়ে দেখল। বেশ জনবহুল শহর, ব্যাবসাপাতির দৌলতে জলপাইগুড়ি থেকে অনেক এগিয়ে আছে। কলকাতার পর এমন বিভিন্ন জাতের মানুষ বোধহয় বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যাবে না।
সকালে দেখা হওয়ার পর বারীন অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু যে জন্যে অনিমেষ এখানে এসেছে তা নিয়ে কথা তোলেননি। বারীনের বয়স অনুমান করা মুশকিল। যদিও দাড়িতে পাক ধরেছে তবু পঞ্চাশ ছাড়িয়েছেন বলে মনে হয় না। অথচ আজ কথা বলার সময় অনিমেষ জেনেছে বারীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। পার্টি যখন বেআইনি ঘোষিত হল তখন পালিয়ে বেড়িয়েছেন অনেককাল। অনিমেষের একবার মনে হয়েছিল ছোটকাকা প্রিয়তোষের কথা বারীনকে জিজ্ঞাসা করে কিন্তু একটা কথা ভেবে সে নিজেকে সংযত করল। প্রিয়তোষ আজ যেখানে বিচরণ করছেন তাঁর সঙ্গে বারীনের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যখন অনিমেষই নিজের কাকাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখছে না তখন বারীন তো আরও পারবেন না। সে ক্ষেত্রে খামোকা ওঁর কথা তুলে কী লাভ! আজ এই কয়েক ঘণ্টায় বারীনকে দেখে অনিমেষের মনে হয়েছে ভদ্রলোক অত্যন্ত নিরাসক্ত। কোনও ব্যাপারেই তাঁকে তেমনভাবে স্পর্শ করে না। কোনও কিছুর বিরুদ্ধে তাঁর বিশেষ অভিযোগ নেই। এরকম নির্লিপ্তির সঙ্গে এর আগে তার পরিচয় হয়নি।
বারীনের স্টলে বসার জায়গা বলতে কয়েকটা মোড়া ছাড়া কিছু নেই। স্টলটা খোলাই ছিল। একটা বাচ্চা ছেলে টিনের পাতে রং বোলাচ্ছিল। বারীনকে দেখে বলল, ‘সকাল থেকে তিনজন লোক অনেকবার খুঁজতে এসেছে।’
‘কারা?’ দোকানের ভেতরে ব্যাগটাকে রেখে অনিমেষের দিকে একটা মোড়া এগিয়ে দিলেন বারীন।
‘নাম জানি না। চেহারা দেখেছি।’
‘তারে নামে জানি না শুধু চোখে দেখেছি!’ হাসলেন বারীন, ‘এখানে যারা আসা-যাওয়া করে তাদের কেউ?’
‘একজনকে দেখেছি এখানে আসতে।’
‘যার গরজ আছে সে নিশ্চয়ই আবার আসবে। আসুন, আমরা আরাম করে বসি। এই হল আমার ব্যাবসাকেন্দ্র। লোকে অবশ্য একে আড্ডাখানা বলে। তা নিন্দুকেরা তো কত কথাই বলে থাকে।’ বারীন একটা মোড়ায় বসে হাসলেন।
অনিমেষ ঢোকার সময় এলাকাটা দেখেছিল। চারধারে বেশ বড়সড় দোকান, জামাকাপড়েরই বেশি। প্রত্যেকের ব্যাবসা যে খুব চালু তা বোঝা যায়। এসবের মধ্যে বারীনের দোকান মূর্তিমান বেখাপ্পা। কিছু সাইনবোর্ড আর টিনের পাত, রেঙর সরঞ্জাম চারপাশে ছড়ানো। কুড়িয়ে বাড়িয়ে দুশো টাকারও সম্পত্তি হবে না। ব্যাপারটা অনিমেষ লক্ষ করেছে দেখে বারীন বললেন, ‘কী, আমার দোকানের চেহারা দেখা হচ্ছে? ওটা আমারই মতন, কখন বাজারে অচল আধুলির মতো হাতঘষা খাচ্ছে টের পাওয়া যায়নি। ভাড়া সাকুল্যে পঁচাত্তর। ছেড়ে দিলে দশ-বারো হাজার দক্ষিণা পাওয়া যাবে। কিন্তু তা হলে শিলিগুড়ির লেখক শিল্পীদের আড্ডা মারার জায়গা জুটবে না যে। এখানে তো ভাই কফিহাউস নেই।’
‘ভাড়া বাকি নেই তো?’ অনিমেষ ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারল না।
‘ছিল। সবাই চাঁদা করে মিটিয়ে দিয়েছে। এটি হল দোকানের কর্মচারী। বিশ টাকা মাইনে নেন, টিকে আছেন কাজ শেখার প্রবল আগ্রহে। শিল্পী হবার একটা প্রাণপণ চেষ্টা আছে ওর মধ্যে। কানু, দু’কাপ চা খাওয়াবি?’ বারীন পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে ছেলেটির সামনে ধরলেন। অনিমেষ দেখল কাজে ব্যাঘাত হওয়ায় ছেলেটি একটু বিরক্ত হলেও খুব যত্নে তুলিটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে পয়সাটা তুলে নিল। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, ‘কাল সকালে সাইনবোর্ডটা ডেলিভারি না-দিলে টাকা দেবেন না বলেছে। মনে থাকে যেন!’
‘কাল সকাল কেন, আজ বিকেলেই তারা ইচ্ছে করলে নিয়ে যেতে পারে। তুই তো সব করেই ফেলেছিস।’ হাসলেন বারীন। অনিমেষ দেখল টিনের পাতটায় শুধু একটা রংই পাতলা করে বোলানো হয়েছে, তাতে এখনও কিছু লেখা হয়নি। ছেলেটি বেরিয়ে গেলে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কিন্তু এখনও আমার সঙ্গে কোনও কথা বলেননি!’
‘কী কথা?’ বারীন তাকালেন।
‘আমি কী জন্যে এসেছি তা তো আপনি জানেন।’
‘হবে’খন। এত ব্যস্ততা কেন?’
‘একটা দিন খামোকা নষ্ট করে লাভ কী?’
‘নষ্ট হল বলে মনে হচ্ছে কেন? এই যে আমরা পরিচিত হলাম, কথা বলছি, এটাই তো একধরনের লাভ। ওই যে কবিরা এসে গেছে, সময় হলেই আমরা ও ব্যাপারে কথা বলব, কেমন?’
বিকেলবেলায় অনিমেষের মনে হল সত্যি বারীনের সহ্যশক্তি আছে। যারা একবার আসছে তারা আর নড়ার নাম করছে না। কেউ কবিতা লেখে, কেউ গল্প, কেউ আবার নাটক করে। পৃথিবীর সমস্ত বিষয় নিয়ে তারা বকবক করে যাচ্ছে সমানে। কোনও বিষয়ে বেশিক্ষণ আটকে থাকছে না তারা এবং এত দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছে যে, আগের বিষয় নিয়ে কথা বলার কী প্রয়োজন ছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। অনিমেষ একটা জিনিস অনুভব করল। এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে এদের জেহাদ প্রচণ্ড। যে সমস্ত লেখক বড় বড় কাগজে লেখেন তাঁরা নাকি ইতিমধ্যে বিক্রিত হয়ে গেছেন। তাঁদের কাছ থেকে নতুন কিছু আশা করা ভুল হবে। বারীন চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল এদের কথা। হঠাৎ নরম গলায় শুধোলেন, ‘ওসব কাগজে লেখেননি এমন কোনও মহান লেখকের নাম তোমাদের জানা আছে?’
দু’-তিনটে নাম বিভিন্ন মুখে উচ্চারিত হল। অনিমেষ এঁদের কোনও লেখা কখনও পড়েনি। বারীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাটা কাটা শব্দ উচ্চারণ করলেন, ‘প্রতিবাদ মানেই অন্ধ হওয়া নয়। বরং উদারতাই আসল ভিত্তি। যে যোগ্য তার স্বীকৃতি দেওয়াই সুস্থতা। তোমরা যাঁদের নাম করলে তাঁদের সাহিত্যপ্রতিভা সমরেশ বসুর কাছাকাছি পৌঁছোয় না। মনে মানলেও মুখে তোমরা মেনে নিচ্ছ না। ভোঁতা ছুরি দিয়ে কিন্তু আলুও কাটা যায় না। অক্ষমতাই মানুষকে অন্ধ করে।’
রাত দশটা নাগাদ ভিড় কমল। এতক্ষণ অনিমেষ এখানে রয়েছে কিন্তু বারীন কারও সঙ্গেই ওর আলাপ করিয়ে দেননি। যারা এসেছিল তারা তাকে দেখলেও কেউ যেচে কথা বলেনি। ক্রমশ এদের একঘেয়ে কথাবার্তা শুনে অনিমেষের মাথা ধরে গিয়েছিল। একটু ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়াবার জন্যে সে মার্কেটের বাইরে বড় রাস্তায় এসেছিল। শিলিগুড়িতে এখন বেশ ঠান্ডা পড়েছে।
এত রাতে রাস্তা ফাঁকা। দোকানপাট সব বন্ধ। মাঝে মাঝে দু’-একটা পানের দোকান থেকে আলো আসছে পথে। অনিমেষ বারীনের দোকানে ফিরে এসে দেখল সাইনবোর্ডটায় শেষবার তুলি বোলাচ্ছেন বারীন। ওকে দেখে মুচকি হাসলেন, ‘কী, মাথা ধরে গিয়েছিল বুঝি?’
‘না, অনেকক্ষণ একভাবে বসে ছিলাম, এই একটু—।’
‘দেশের যুবশক্তির চেহারা দেখা হল?’
‘যুবশক্তি?’
‘এই যে নব্য যুবকবৃন্দ আমার এখানে এসেছিলেন তাঁদের দেখা হল?’
‘হুঁ।’
‘তোমার খিদে পেয়েছে?’
‘খিদে?’ না।’
‘তোমায় তুমি বলে ফেললাম ভাই। তুমিও আমাকে তুমি বোলো।’
‘ঠিক আছে।’
কর্মচারী ছেলেটিকে বিদায় করলেন বারীন। এখন মার্কেট চুপচাপ। অনিমেষের খুব ক্লান্তি লাগছিল। সারাটা দিন একদম ফালতু কাটল। বারীনের উদ্দেশ্য কী বুঝতে পারছে না সে। অথচ লোকটি সম্পর্কে তার মোটামুটি শ্রদ্ধাই জাগছে। কথাবার্তা, চালচলন অবশ্যই অনিমেষকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু যে জন্যে সে এসেছে তার কথা ভদ্রলোক একবারও তুলছেন না কেন?’
বারীন এবার দোকান বন্ধ করে ওকে নিয়ে বড় রাস্তায় এলেন। এসে বললেন, ‘এগারোটা বাজতে দেরি আছে, না?’
‘হ্যাঁ।’
‘এবার খেয়ে নিলে হত।’
‘কোথায়?’
‘ওই মোড়ের মাথায় একটা পঞ্জাবির দোকান আছে। খুব ভাল তড়কা তৈরি করে। চলো, ওখানেই খেয়ে নিই।’
‘আপনি কি রাত্তিরে বাইরে খান?’
‘আপনি নয়, তুমি। না না, বাইরে খাব কেন? আজ খাচ্ছি। কারণ বাড়ি ফিরতে কত রাত হবে বলা যায় না। ততক্ষণ বুড়ি মাকে জাগিয়ে রাখা উচিত হবে না, কী বলো?’
অনিমেষ সম্মতির মাথা নাড়ল। তার মানে আজ রাত্রে বারীন তাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। তবু কিছু কাজ করা যাবে ভেবে এতক্ষণে ভাল লাগল অনিমেষের। পঞ্জাবির হোটেলে খাওয়া চুকিয়ে সে জোর করে দাম মেটাল। বলল, ‘প্রথম দিনটা আমার জন্য বরাদ্দ থাক।’
বারীন বললেন, ‘বেশ বুদ্ধিমান ছেলে দেখছি? খুব অল্পেই কাজ সারলে।’ তারপর হোটেলের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলো, এবার উঠি, আর মিনিট পাঁচেক আছে এগারোটা বাজতে।’
নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বারীন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি গরম জামাকাপড় কিছু আনোনি সঙ্গে?’
‘এনেছি, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে বের হইনি।’
‘আনা উচিত ছিল। শিলিগুড়িতে এই সময় রাত্তিরে খুব ঠান্ডা পড়ে। আর এই একটা জিনিস কোনও রসিকতা বোঝে না। যা হোক, আমার ঝুলিতে বোধহয় কিছু পাওয়া যাবে।’ নিজের ব্যাগ থেকে বারীন একটা সোয়েটার আর আলোয়ান বের করলেন। দুটোই খুব সুন্দর অবস্থায় নেই। সোয়েটারের মাঝে মাঝে ছোট ফুটো চোখে পড়ল।
বারীন ওকে জোর করে আলোয়ানটা গায়ে জড়াতে বলে নিজে সোয়েটারে মাথা গলিয়ে নিলেন। প্রথমে একটু অস্বস্তি হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে অনিমেষ বুঝতে পারল বারীন তার উপকারই করেছেন।
এয়ারভিউ হোটেলের সামনে এসে বারীনের চেহারা পালটে গেল। হাবভাবে বেশ সতর্কতা, অনিমেষকে দোকানের আড়ালে দাঁড়াতে বললেন। একটা পুলিশের জিপ দ্রুত চলে গেল শহরের দিকে। তেমাথায় কোনও লোকজন নেই। শুধু হোটেলের নীচে একটা পানের দোকান খোলা। সেখানে রেডিয়োতে কোনও বিদেশি স্টেশন বাজছে। চুপচাপ দু’জনে ওখানে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ানোর পর বারীন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সিগারেট খাও না?’
‘খাই।’
‘খাচ্ছ না যে?’
ভেতরে ভেতরে একটু উত্তেজিত ছিল অনিমেষ। বারীন তাকে কিছু না-জানালেও ওঁর ভাবভঙ্গিতে এই উত্তেজনা অনিমেষের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। এইসময় এরকম প্রশ্ন শুনে ও অবাক হয়ে গেল। সে হেসে বলল, ‘সঙ্গে নেই, তাই।’
তা হলে নেশাখোর নও।’
‘ঠিক নেশা বলা যায় না।’
‘কোনও কিছুর কাছে মুচলেকা লিখে দেওয়া কখনওই উচিত নয়।’
অনিমেষ বারীনের দিকে তাকাল। কথাগুলোয় কি দুটো মানে রেখে বারীন বলছেন? ঠিক সেই সময় একটা টেম্পো খুব ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়িটার একটা লাইট নেবানো, অন্যটা একচক্ষু দৈত্যের মতো জ্বলছে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে বনেট খুলে ইঞ্জিনের ভেতর মাথা গলিয়ে কিছু দেখছে। বারীন অনিমেষের হাত ধরে দ্রুত আড়াল ছেড়ে রাস্তায় নামলেন। তারপর এক হাতে অদ্ভুত দক্ষতায় টেম্পোর পেছনে উঠে সটান শুয়ে পড়লেন। অনিমেষ হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু ড্রাইভার বনেট বন্ধ করার আগেই দ্রুত এবং নিঃশব্দে বারীনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শোওয়ার পর দেখল তলায় একটা ত্রিপল পাতা আছে। খুব খারাপ লাগছে না তাই। বারীন চাপা গলায় বললেন, ‘মাথার ওপরে কত তারা অথচ আমরা কখনও লক্ষই করি না, না?’
বুকের মধ্যে তখনও উত্তেজনা, বারীনের কথা শুনে অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে আছে। টেম্পোটা আবার চলতে শুরু করেছে। সামান্য ঝাঁকি লাগছে শরীরে। এই সময় বারীন তার কাছে তারার গল্প করছেন? সে আকাশের দিকে তাকাল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় চোখে ফুটবে। ছোট বড় অজস্র তারায় আকাশ ঝকঝকে হয়ে রয়েছে। এত তারা একসঙ্গে কখনও দেখেনি অনিমেষ। এভাবে মাটিতে শুয়ে মুখ আকাশের দিকে করে তাকানোও হয়নি জীবনে। কিছুক্ষণ দেখলে মনে হয় যেন খুব ধীরে ধীরে আকাশটা অজস্র টর্চ জ্বেলে তার দিকে নেমে আসছে। এরকম নির্মেঘ, ঠান্ডা আকাশ, অনেকটা অজস্র পিন ঢোকানো কুশনের মতো, কোনওদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। তারাগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনিমেষের সমস্ত শরীর শিহরিত হল। সে নিজের লোমকূপগুলো ফুলে উঠছে অনুভব করল। বাল্যকালে এক রাত্রে মাধুরী তাকে বলেছিলেন তিনি নাকি আকাশের তারা হয়ে তাকে লক্ষ রাখবেন। মৃতা মায়ের ওই কথাটাকে সে অনেককাল বিশ্বাস করত। কখনও কোনও দুঃখ কিংবা সুখ তাকে সেই বয়সে আলোড়িত করলে সে ছুটে যেত সেই তারার কাছে, গিয়ে কাঁদত কিংবা হাসত। বড় হলে, সময় যখন সবকিছু খেয়ে নিল, তখন সেই তারাটাও তার কাছ থেকে হারিয়ে গেল। এখন এই রাত্রে টেম্পোতে শুয়ে অজানা জায়গায় যাওয়ার সময় এক আকাশ তারার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের সামনে মাধুরী হঠাৎ চলে এলেন। এতকাল অনেক চেষ্টা করেও যাঁর মুখ মনে করতে পারেনি, জলপাইগুড়ির শ্মশানে দাহ করে আসার পর মায়ের যে চেহারাটা একটু একটু করে হারিয়ে গিয়েছিল, সেই মা এখন তার দু’চোখের সামনে। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। মাধুরী হাসছেন। কিন্তু মাধুরী কি এমন দেখতে? অনিমেষ মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মাকে দেখছিল। সম্পূর্ণ দেখা হলে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। মাধুরীর মুখ বলে এতক্ষণ যাকে সে কল্পনায় দেখছিল তা যে মাধবীলতার এটা বুঝতে পেরে সে পাথর হয়ে শুয়ে রইল।
সেই সময় বারীন খোলা গলায় বললেন, ‘তুমি দেখছি দারুণ রোমান্টিক। আকাশের তারা দেখতে দেখতে কখনও কেউ কেঁদেছে বলে শুনিনি।’
অনিমেষ দ্রুত চোখের জল মুছল। তারপর হাসতে চেষ্টা করে বলল, ‘আমরা কতদূর এলাম?’
‘শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে গেছি। এবার উঠে বসতে পারো।’
অনিমেষ ধীরে ধীরে মাথা তুলল। একপাশে অন্ধকার মাখানো জঙ্গল, অন্যদিকে ধু ধু মাঠ দেখা যাচ্ছে। এসব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। সে বারীনকে বলল, ‘আপনি কিন্তু ভাল নাটক করেন!’
‘আবার আপনি! তুমি বলতে বাধে নাকি?’
‘চট করে বয়স্কদের তুমি বলতে অস্বস্তি হয়।’
‘চেষ্টা করো, চেষ্টা করো। হ্যাঁ, কী বলছিলে, নাটক? এক-আধটু ওরকম না-করলে বৈচিত্র্য আসবে কেন? আমরা আর মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব।’
‘এটা কোন এলাকা?’
‘আর একটু এগোলেই শুকনা টি-এস্টেট পড়বে।’
ঘুমন্ত একটা লোকবসতির কাছে এসে গাড়িটা থেমে যেতেই ওরা নেমে এল। ড্রাইভারের সঙ্গে একটাও কথা হয়নি ওদের। কয়েক সেকেন্ড থামার পর গাড়িটা সোজা বেরিয়ে গেল। এখানে ঠান্ডা খুব। বেশ হিম পড়ছে। আলোয়ান মুড়ি দেওয়া সত্ত্বেও একটা কাঁপুনি অনুভব করল অনিমেষ। বারীনদা দ্রুত পায়ে হাঁটছেন। সামনে অনেকগুলো কাঠের বাড়ি। একনজরে অনিমেষ বুঝল টিম্বার মার্চেন্টদের এলাকা এটা।
পেছনের সারির একটা বাড়ির কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে একটা লোক ওদের সামনে এসে দাঁড়াল, ‘বারীনদা’!
‘হ্যাঁ ভাই।’
‘আসুন।’
লোকটি ওদের পথ দেখিয়ে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিয়ে গেল। দরজাটা ভেজানো ছিল, খুলতেই আলো চোখে পড়ল। লোকটি বলল, ‘বারীনদা এসে গেছেন।’
ওদের পেছন পেছন অনিমেষ ভেতরে ঢুকল। মাঝখানে একটা লন্ঠন জ্বলছে। সেটাকে ঘিরে জনা দশেক মানুষ বসে আছেন। ওদের দেখে একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আসুন, আসুন বারীনবাবু, উনি এসেছেন?’
বারীন বললেন, ‘হ্যাঁ, টেম্পোয় শুইয়ে নিয়ে এলাম। এই হল অনিমেষ মিত্র, জলপাইগুড়ির স্বর্গছেঁড়া চা-বাগানের ছেলে, এখন কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছে।’
অনিমেষ নমস্কার করল কিন্তু এ ধরনের সৌজন্যবোধ প্রত্যেকের কাছে পাওয়া গেল না। যে-দু’জন ভদ্রলোক প্রথম কথা বলছিলেন তাঁদের একজন উঠে এসে ওর দু’হাত জড়িয়ে ধরলেন, ‘আসুন, আসুন ভাই। আমরা আপনার জন্যে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। শিলিগুড়িতে পৌঁছে গেছেন সে খবর আমরা অবশ্য আগেই পেয়ে গেছি।’ ভদ্রলোক ওকে মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বসালেন। অনিমেষ দেখল ঘরের সবাই খুব সতর্ক চোখে তাকে দেখছে। যেসব মুখ এখানে আছে তাঁদের সবাই বাঙালি নন। বয়সের পার্থক্যটাও স্পষ্ট। পাশে যিনি বসে ছিলেন তিনি বললেন, ‘আপনার তো কলকাতা থেকে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি! মিলিটারি কম্পার্টমেন্টে এসেছেন।’
অনিমেষ অবাক হল। কলকাতা থেকে সে কীভাবে এসেছে এ খবরও এখানে পৌঁছে গেছে! গম্ভীর গলায় সে বলল, ‘না, কোনও অসুবিধা হয়নি। ভুল করে ওদের কামরায় উঠে পড়ে লাভই হয়েছে।’ তারপরই ওর নজরে পড়ল বারীন এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। সে ডাকল, আপনি বলতে গিয়ে সামলে নিয়েই বলল, ‘এসো বারীনদা, দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
মাথা নাড়লেন বারীন, ‘দূর! ওখানে বসার যোগ্যতা আমার আছে নাকি! সাইনবোর্ড এঁকে খাই, তাই করতে দাও। তোমাকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ছিল, দিলাম। আমি এবার চলি। তোমার থাকার ব্যবস্থা এখানেই হবে। তোমার জিনিসপত্র পৌঁছে যাবে ঠিক সময়ে। চলি ভাই, তোমরা কাজ করো।’ বারীন আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অনিমেষ বিস্মিত চোখে ওঁর যাওয়া দেখল। বারীন তা হলে সক্রিয়ভাবে যোগ দেননি অথচ গোপনে তাদের সাহায্য করছেন। লোকটির প্রতি ওর সমর্থন আরও বেড়ে গেল।
একটু পরেই কাজের কথা আরম্ভ হল। কথা বলতে বলতেই অনিমেষ এদের অনকের নাম জেনে গেল। মোটামুটি উত্তরবাংলার বিভিন্ন জেলার সক্রিয় কর্মীরা আজকের সভায় উপস্থিত। আন্দোলনের প্রথম ধাপ কীভাবে সংগঠিত করা হবে, এ ব্যাপারে কলকাতার কী নির্দেশ তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হল। কৃষকদের সংগঠিত করতে হবে। এলাকায় এলাকায় আরও বেশি ক্যাডার ছড়িয়ে দিতে হবে। তারা কৃষকদের বোঝাবে। যখনই সবুজ সংকেত পাওয়া যাবে তখনই অ্যাকশন শুরু হবে। ওপাশে ফাঁসিদেওয়া, নকশালবাড়িতে ক্রমশ আবহাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। একজন অবাঙালি মানুষের কথা অনিমেষকে ভীষণ আকৃষ্ট করল। তিনি বললেন, ‘আমার ছেলেরা প্রস্তুত। কিন্তু সেটা শুধু আমার এলাকায়, অন্য এলাকাগুলো একসঙ্গে তৈরি না-হলে কোনওরকম প্রতিরোধ টিকবে না। প্রস্তুতির কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে নেওয়া উচিত।’
অনিমেষ তাঁকে সমর্থন করে বলল, ‘আমরা শুধু কৃষকদের কথাই বলছি। জমি দখলের ব্যাপারটা তাদের দিয়েই করতে হবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না উত্তরবাংলার গরিব মানুষের ষাট ভাগই কৃষিজীবী নয়। এতগুলো চা-বাগানে ছড়িয়ে থাকা মদেশিয়া ওঁরাও মানুষগুলোকে সঙ্গে পাওয়া দরকার। সরাসরি পুলিশ কিংবা মিলিটারিদের সঙ্গে আমরা পেরে উঠব না। গেরিলা যুদ্ধই আমাদের একমাত্র রাস্তা। আর তা করতে হলে কৃষক ছাড়া অন্য শ্রমিকদেরও উৎসাহিত করা দরকার। আপনারা এই দিকটা দেখেছেন?’
সবাই স্বীকার করল, তা দেখা হয়নি। বিভিন্ন চা-বাগানের শ্রমিকরা কংগ্রেসি বা আর. এস. পি. ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে গিয়ে কাজ করার অসুবিধে আছে। তা ছাড়া জমি দখল করে তার অধিকার নেওয়ার ব্যাপারে কৃষকদের যত সহজে উদ্বুদ্ধ করা যাবে শ্রমিকদের তো তা যাবে না। তাদের সামনে পাওয়ার প্রত্যাশা কিছু রাখা যাচ্ছে না।
অনিমেষ উত্তপ্ত হল, ‘আপনারা এ-দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর লাইনে কথা বলছেন। সাধারণ মানুষ কি শিশু যে তাদের ললিপপের লোভ দেখিয়ে কাজ করাবেন? সেটা পাওয়া হয়ে গেলেই আমাদের সম্পর্কে ওদের আগ্রহ মিটে যাবে। এভাবে দেশে বিপ্লব হবে না।’
একজন বললেন, ‘কিন্তু আমাদের নেতা বলেছেন এই বিপ্লব হল কৃষি বিপ্লব। জোতদারের কাছ থেকে জমি জবরদখল করে নিয়ে তার সূত্রপাত হবে। অতএব সেই দিকটায়ই জোর দেওয়া হচ্ছে।’
‘কিন্তু বিপ্লব তো শুধু কৃষকরাই করবে না, শ্রমিকরা যখন সংখ্যায় ভারী তখন তাদেরও দলে থাকা দরকার।’
অনিমেষের এই কথাটাকে অবাঙালি ভদ্রলোক সমর্থন করলেন। উত্তরবাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ এমন যে গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে এর চেয়ে ভাল এলাকা পাওয়া যাবে না। চা-বাগানগুলো বেশিরভাগই জঙ্গলে ঘেরা এবং একটার থেকে আর-একটা বেশ দূরে দূরে। এই ব্যাপক এলাকায় মিলিটারিকে লুকিয়ে থেকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা সম্ভব।
প্রায় চারটে অবধি আলোচনা চলল। অনিমেষের ওপর দায়িত্ব পড়ল চা-বাগানগুলো দেখার। এটা যে হবে তা সে কলকাতা থেকেই অনুমান করেছিল। অবাঙালি ভদ্রলোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন। খুব দ্রুত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। যাতে চূড়ান্ত মুহূর্ত এলে আর কোনও জড়তা না-থাকে। যে যার কাজের এলাকা ভাগ করে নিল। শিলিগুড়ির এই তল্লাটটা অনিমেষের পরিচিত নয়। সে তিস্তার অপর পারে চা-বাগানগুলোর শ্রমিক সংগঠনের দায়িত্ব নিল।
এই সিদ্ধান্তের পর আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। অনিমেষ ভোর হওয়ামাত্র ট্রাক ধরে শিলিগুড়িতে চলে এল। সেই অবাঙালি ভদ্রলোকও ওর সঙ্গে এলেন। অনিমেষ জানতে পারল, প্রচুর অস্ত্র আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় যেসব অস্ত্র চোরাই পথে এসেছিল সেগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর জন্যে অর্থ দরকার। স্বদেশিরা তো বলপ্রয়োগ করত, এ ক্ষেত্রে তাই করতে হবে। এইভাবে যদি কিছুদিন চলে তা হলে পুলিশের মোকাবিলা করতে কোনও অসুবিধা হবে না। অবশ্য কৃষকরা তির ধনুক নিয়েই মরিয়া হতে পারে। অনিমেষ ভাবছিল, এ সবই ঠিক, অস্ত্র প্রচুর থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো যারা ব্যবহার করবে সেই মানুষগুলোকে অবিলম্বে তৈরি করা দরকার।