ষট্ত্রিংশ অধ্যায় – নরকাসুরের উপাখ্যান
ঋষিগণ বলিলেন,–নরকাসুর কিপ্রকারে বরাহদেবের পুত্ররূপে জন্মিল এবং দেবতার ঔরসে দেবীর গর্ভে জন্মিয়াও কি নিমিত্ত অসুর বলিয়া বিখ্যাত হইল। ১
সে কিরূপে দীর্ঘজীবী হইল এবং পৃথিবী গর্ভে কিরূপে বহুকাল বাস করিল। মহাবলী নরক কোন স্থানে উৎপন্ন হইয়াছিল? ২
সে কিরূপে অসুরগণের অধিপতি হইয়াছিল? তাহার পর কি নামে প্রসিদ্ধ হইল? ৩
শ্রুত হইয়াছি,–যজ্ঞবরাহ এবং পৃথিবী উভয়ের রতি হওয়ায় নরকের জন্ম হইয়াছে। হে মুনিবর! এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত আমাদের নিকট সবিস্তারে বর্ণন করুন। ৪
ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমানবেত্তা আপনিই আমাদের গুরু এবং শাস্তা, অতএব লোকস্রষ্টা ব্ৰহ্মা নরকাসুরকে কি নিমিত্ত বর দিলেন; এই সকল বিষয় আপনার মুখে শুনিতে ইচ্ছা করি। ৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–দ্বিজশ্রেষ্ঠ মুনিগণ! তোমাদের প্রশ্নসকলের ক্রমশ উত্তর প্রদান করিতেছি। প্রথমত নরক কিরূপে উৎপন্ন হইল, তাহা কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
রজস্বলা-ধরিত্রীর গর্ভে বরাহদেবের ঔরসে জন্ম হেতু নরক অসুর-যোনি প্রাপ্ত হইল। ৭
পৃথিবীর গর্ভে মহাবীর উৎপন্ন হইবে জানিয়া ব্ৰহ্মাদি দেবগণ স্বকীয় দৈব শক্তিবলে বহুদিনের নিমিত্ত পৃথিবীগর্ভ কঠিন করত পুত্রপ্রসবে বাধা উৎপাদন করিলেন। ৮
জগদ্ধাত্রী পৃথিবী প্রসবকাল উপস্থিত হইলেও অপত্য প্রসব না হওয়ায় এবং বরাহের মৃত্যু-হেতু অতিশয় শোকাকুল হইয়া বারংবার অনেক রোদন করিতে লাগিলেন। ৯-১০
তৎপরে তিনি ভগবান্ মধুসূদন কর্তৃক প্রবোধিত হইয়া ধৈর্য্যাবলম্বন করিলেন। ১১
তদনন্তর ভগবন্নিৰ্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইলেও দৈববিড়ম্বনায় গর্ভ প্রসব না হওয়াতে যৎপরোনাস্তি দুঃখিতা হইলেন এবং সম্পূর্ণ-গর্ভ-ভার-সহনে অক্ষম হইয়া পুনর্বার মাধবের শরণাগত হইলেন। ১২-১৩
শরণাগত-পালক জগৎপতি মধুসূদনকে নতশিরে প্রণাম করিয়া এই প্রকারে স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন। ১৪
যাঁহার রূপ জগতে সাধারণের নয়নপথের অতীত মূল-কারণরূপে প্রকাশ পাইতেছেন; এবং যে প্রধান পুরুষের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়াদি জীবধর্ম নাই এবং যিনি জগতের নিয়ন্তা, যিনি স্বাহাদি মন্ত্রের প্রতিপাদ্য-স্বরূপ, যাহার আত্মা নিত্যানন্দময় এবং যে জগদীশ্বরের আজ্ঞায় সকলে স্ব স্ব কর্মে নিযুক্ত হইতেছে, স্বয়ং যিনি নিযুক্ত হইতেছেন এবং যিনি অব্যয়রূপে সৰ্ব্বদা শোভা পাইতেছেন এবং সংসারকে সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়-চক্রে ভ্রমণ করাইতেছেন, সেই জগৎ-পিতা ভগবানকে স্থিরচিত্তে স্মরণপূর্বক প্রণাম করিতেছি। ১৫-১৮
যিনি উত্তম যদুবংশে উৎপন্ন হইয়া কন্দর্পের জন্মদাতা এবং সংহর্তা; জল যাহাকে আর্দ্র করিতে পারে না, অগ্নি যাহাকে সন্তাপিত করিতে পারে না, শীত যাহাকে স্বীয় শৈত্যগুণে কষ্ট দিতে পারে না, সমুদ্র যাহাকে জলপ্রবাহে প্লাবিত করিতে পারে না, সূৰ্য্যাদি যাহাকে শুষ্ক করিতে পারে না এবং মৃত্যু যাঁহার প্রতি আধিপত্য করিতে পারে না, এতাদৃশ তোমাকে নমস্কার করি। ১৯-২১
শমগুণাবলম্বী মুনিগণ একাগ্রচিত্তে যে বস্তু ধ্যান করেন, ধর্মবিরোধ পাষণ্ডগণের কুমতিকলাপ যাঁহার দ্বারা বিনষ্ট হয় এবং যাঁহার রূপ, সাত্ত্বিক উপায়ে দৃষ্ট হয়, হে মহাপুরুষ! সেই তুমি বিপদাপন্ন পৃথিবীকে রক্ষা কর। ২২
হরি এই প্রকারে পৃথিবীর স্তবে তুষ্ট হইয়া পৃথিবীর সমীপে আগমন করত বলিলেন,–দেবি বসুন্ধরে! তুমি দুঃখিতমনে কি নিমিত্ত রোদন করিতেছ? ২৩
যদ্যপি কোন ব্যাধিবশত পীড়িত হইয়া রোদন কর, তাহা হইলে সে কি প্রকার ব্যাধি, তাহা অবিলম্বে বল। ২৪
তোমার মুখপদ্ম পূর্বের ন্যায় প্রফুল্ল নাই, শরীরে তাদৃশ কান্তিপুঞ্জ লক্ষিত হইতেছে না, নয়নযুগল ভয়চকিত; সুতরাং পূর্বের ন্যায় কটাক্ষনিক্ষেপ করিতেছে না। ২৫
এরূপ অবস্থায় আর কখনও তোমাকে দেখি নাই। লোকাতীত সৌন্দর্য্যে বিপরীতরূপে পরিণত হইয়াছে, কোন দুঃখে এইরূপ হইয়াছে সত্বর বল। ২৬
জগদীশ্বর হরির এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া পৃথিবী দেবী, বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বিনীতভাবে বলিলেন,–হে মাধব! দুৰ্ব্বহ গর্ভভার বহন করিতে অক্ষমা হইয়া নিরন্তর দুঃখ অনুভব করিতেছি। এই দুঃখ হইতে আমাকে রক্ষা করুন। ২৭-২৮
আপনি যেকালে বরাহরূপ ধারণ করিয়া রজস্বলা আমার সহিত সঙ্গম করিয়াছিলেন, সেই কালেই আমি গর্ভবতী হইয়াছি। ২৯
কিন্তু একাল পর্যন্ত প্রসব না হওয়ায় গর্ভভারে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করিতেছি। ৩০
হে জগদীশ্বর! আপনি যদ্যপি গর্ভধারণ-দুঃখ হইতে আমাকে রক্ষা না করেন, তাহা হইলে শীঘ্রই প্রাণ ত্যাগ করিব। ৩১
আমার ন্যায় আর কোন কামিনীই এ প্রকার গর্ভ-যন্ত্রণায় কষ্ট পায় নাই। মদমত্ত হস্তী যেপ্রকার সরোবরকে আলোড়িত করে, সেইরূপ আমাকেও এই গর্ভ, কষ্ট অনুভব করাইতেছে। ৩২
পৃথিবীপতি ভগবান এই প্রকার পৃথিবীর দীন-বচন শ্রবণ করিয়া সূৰ্য্যকিরণে সন্তপ্তা লতার ন্যায় সন্তপ্তা ধরাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন,-বসুন্ধরে। তোমার এ দুঃখ চিরস্থায়ী হইবে না এবং তোমার গর্ভ, নিরূপিত সময় অতীত হইলেও যে প্রসব হয় নাই, তাহার কাণ বলিতেছি শ্রবণ কর। ৩৩-৩৪
রজস্বলা তোমার সহিত বরাহের সঙ্গম হওয়ায় যে গর্ব ধারণ করিয়াছ, এই গর্ভে মহাবল অসুর উৎপন্ন হইবে জানিয়া ব্ৰহ্মাদি দেবগণ তাদৃশ মহাবল অসুরের উৎপত্তিতে অনিষ্ট হইবে বিবেচনায় দৈবশক্তিতে প্রসব হইতে দিতেছেন না। ৩৫-৩৬
স্বর্গে যদ্যপি তাদৃশ বীরবর তোমার পুত্রের জন্ম হয়, তাহা হইলে দেব দৈত্য প্রভৃতির সহিত স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ত্রিলোক নষ্ট হইবে। ৩৭
এই হেতু ব্ৰহ্মাদি দেবগণ লোক হিতের নিমিত্ত সৃষ্টির পূর্বে অলৌকিক পরাক্রমশালী পুত্রকে তোমার গর্ভে স্থাপন করিয়াছেন। ৩৮
আদি সৃষ্টি হইতে অষ্টাবিংশ চতুর্যুগের অন্তর্গত ত্রেতাযুগে এই গর্ভস্থিত সন্তান প্রসব করিবে। ৩৯
হে চন্দ্রমুখি! যেকাল পর্যন্ত সত্যযুগ শেষ হইয়া ত্রেতাযুগের অর্ধভাগ উপস্থিত না হয়, সেই কাল অবধি এই গর্ভধারণ কর। ৪০
বসুন্ধরে! যত দিন পর্যন্ত তোমার গর্ভ প্রসব না হয়, ততদিন পর্যন্ত গর্ভভারে তোমার কোন কষ্ট হইবে না। ৪১
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–ভগবান বিষ্ণু এই কথা বলিয়া গর্ভবতী দয়িতা বসুন্ধরার নাভিমণ্ডলে পাঞ্চজন্য শঙ্খের অগ্রভাগ স্পর্শ করাইলেন। ৪২
পৃথিবীশ্বরের স্পর্শে পৃথিবীর দেহ লঘু হইল–কষ্টপ্রদ দুৰ্ব্বহ গর্ভ লঘুতর হইয়া সুখকর বোধ হইতে লাগিল। ৪৩
জগন্মাতা পৃথিবী গর্ভবতী হইলেও গর্ভহীন স্ত্রীলোকের ন্যায় আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন। ৪৪
তদনন্তর, জদগীশ্বর বসুন্ধরাকে বহুতর সান্ত্বনা বাক্যে প্রসন্ন করিয়া বলিলেন,–হে মনস্বিনি! জগদ্ধাত্রি! বসুন্ধরে! তুমি যাবতীয় বস্তু ধারণ করিয়া ধরিত্রী নাম লাভ করিয়াছ। ৪৫-৪৬
তোমার সদৃশ ধৈৰ্য্যশালিনী দ্বিতীয়া নাই। তুমি জগতের সকল বস্তু ধারণ করিতে সমর্থা এবং সহিষ্ণুতা গুণের প্রতিকৃতি বলিয়াই ক্ষমা নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছ। তোমাতে সকল ধন নিক্ষিপ্ত আছে, এ নিমিত্ত তুমি বসুমতী নামে আখ্যাতা। ৪৭
ধরিত্রি! তুমি আর দুঃখিতা হইও না। যে কালে তোমার পুত্র প্রসব হইবে, সেইকালে আমাকে স্মরণ করিবামাত্র আমি আগমন করত তোমার পুত্রকে প্রতিপালন করিব। ৪৮
পৃথিবি। আমি তোমাকে যে সকল কথা বলিলাম, ইহা অতি সুগোপ্য; কাহারও নিকট প্রকাশ করিবে না। ৪৯
ভাগ্যবতি! ত্রেতাযুগের মধ্যভাগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে বধ করিলে তোমার গর্ভ হইতে বালক ভূমিষ্ঠ হইবে। ৫০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–ভগবান্ এই বাক্য বলিয়া গর্ভভার পীড়িত পৃথিবীকে আহলাদিত করিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। ৫১
কৃশাঙ্গী পৃথিবী অত্যন্ত আনন্দিত হইয়া গর্ভ-হীনা নারীর ন্যায় সবলে যথাস্থানে গমন করিলেন। ৫২
ষট ত্রিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ৩৬