1 of 2

৩৬. জলে ঝাঁপিয়ে পড়েও

জলে ঝাঁপিয়ে পড়েও বিন্দুবাসিনীর আর নাগাল পায়নি গঙ্গানারায়ণ। তখন সে নিজেও বিশেষ সন্তরণ পটু ছিল না, রাত্রির অন্ধকারে মধ্য গঙ্গায় এক নিমজ্জিতাকে উদ্ধার করার সাধ্যও ছিল না তার। বিন্দু হারিয়ে গেল এবং সে নিজে যে কী প্রকারে বেঁচে গেল, তা সে আজও জানে না। জলে পড়ার একটু ক্ষণের মধ্যেই সে চেতনা হারিয়েছিল, জ্ঞান হবার পর দেখলে সে নদীর ধারে কর্দমাক্ত এক ঝোঁপের মধ্যে শুয়ে আছে। জীবন ধারণের বাসনা আর ছিল না গঙ্গানারায়ণের, কিন্তু মৃত্যুর দেবতা তাকে কৃপা করেনি।

এর পর বহু দেশ পরিভ্রমণ করেছে সে। বারানসীতেও কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিল, তারপর সে অগ্রসর হয়েছে গঙ্গাতীর ধরে দক্ষিণের দিকে। পাটনা পর্যন্ত এসে সে আবার গতি পরিবর্তন করেছিল, বাংলাদেশে ফিরতে তার একটুও ইচ্ছে হয়নি। সে মুখ ফিরিয়েছে উত্তর ভারতের দিকে। হরিদ্বার-লছমনঝোলা পেরিয়ে সে গঙ্গোত্রী পর্যন্তও গিয়েছিল। তখন তার মনে হয়েছিল, হিমালয়ের ক্ৰোড়েই বাকি জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে।

বিস্ময়ের কথা এই যে বিন্দুবাসিনী সম্পর্কে সে আর তেমন শোক ব্যথা অনুভব করেনি। বারানসীতে বিন্দুবাসিনীকে দেখার আগে পর্যন্ত যে তীব্র ব্যাকুলতা বোধ ছিল, পরবর্তী কালে তা কোথায় হারিয়ে গেল। জলের অতলে বিন্দুবাসিনীর মৃত্যু যেন তার জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। লছমনঝোলা-গঙ্গোত্রী, যেখানে পাহাড় ও আকাশের মতন বিশালদের রাজত্ব, সেখানে আর অন্য ক্ষুদ্র কথা মনে স্থান পায় না।

কিছুদিনের জন্য গেরুয়া ধারণ করেছিল গঙ্গানারায়ণ। এই দেশে গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীদের গ্ৰাসাচ্ছাদনের অভাব হয় না। নদীতীরে চুপ করে বসে থাকলেও কেউ না কেউ এসে কিছু দিয়ে যায়। হরিদ্বারে বড় বড় সাধুদের আখড়া আছে, সেখানে ভিড়ে গেলে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না। ডাল-পুরী ভোজের সময় অনায়াসে বসে পড়া যায় এক ধারে। কয়েক বৎসর সে তার মনকে যেন ছুটি দিয়ে শুধু শরীর নিয়ে বেঁচে ছিল। তখন গঙ্গানারায়ণকে দেখা যেত হৃষীকেশে পূণবিতার বাবার আখড়ায় প্রতি সন্ধেবোলা অন্যান্য চেলাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ভজন গান গাইছে।

কিন্তু মনের ঘুম এক সময় ভাঙবেই। জাগ্রত অবস্থায় না হোক স্বপ্নে। মানুষ অভ্যেসের দাস হতে হতেও একদিন হঠাৎ শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে গতানুগতিকতার বন্ধন। সুমহান প্রকৃতিও এক সময় আকর্ষণহীন হয়ে যেতে পারে। গঙ্গানারায়ণও একদিন শরীরে সেই রকম চাঞ্চল্য বোধ করলো। নিজেকেই নিজে এক সময় সে ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষা দিয়েছিল, তারপর থেকে দেব-দ্বিজের প্রতি সে আর কিছুতেই ভক্তিমান হতে পারে না। হিমালয়ের অধিকাংশ সাধুকেই তার আচারসর্বস্ব, উদ্দেশ্যহীন মানুষ বলে মনে হয়। প্রায়ই আখড়াগুলিতে ধুমধাম করে নানারকম যজ্ঞ হয়, তাতে অনেক ঘি পোড়ে, গঙ্গানারায়ণের কাছে। এ সবই নিছক শিশু-ক্রীড়ার মতন। বিশাল চেহারার এক-একজন সাধু যেন এক-একটি শিশু, তবু শিশুর সাহচৰ্যই বা পূৰ্ণবয়স্ক মানুষের কতক্ষণ ভালো লাগে? নিরাকার, নির্বিকল্প ঈশ্বরের উপলব্ধিই যদি মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তার জন্য পাহাড় কন্দরে কৃচ্ছ্রসাধনের তো কোনো প্রয়োজন নেই।

একদিন গঙ্গানারায়ণ পাহাড় ছেড়ে আবার সমতলে ফিরে আসা মনস্থ করলো। কিন্তু কোথায় ফিরবে? এতগুলি বৎসর পর সে আবার কলকাতায় ফিরে যাবে কোন মুখে? জননী বিম্ববতীর সামনে অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে নাটকীয় ভাবে বলবে, মা, আমি এসেছি। বিম্ববতী এখনো জীবিত আছেন। কিনা তারই বা ঠিক কী! বরং যেখান থেকে সে ছেদ টেনেছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করা যেতে পারে।

হৃষীকেশে পূণবিতার বাবার আশ্রমে থাকার কালে সে পর পর দু রাত্রি একই স্বপ্ন দেখেছিল। একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মুসলমান হাপুস নয়নে কাঁদছে, আর গঙ্গানারায়ণ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে যে আমি তোমার পুত্রের সন্ধান পাওয়ার জন্য সব রকম চেষ্টা করবো। এরূপ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পর গঙ্গানারায়ণ খুব অবসন্ন বোধ করে। তার জীবনের ঐ পর্বটির স্মৃতি তার কাছে খুবই আবছা। এক মধ্য নিশীথে সে বজরা থেকে নেমে স্বপ্নচালিতের মতন এক দল তীর্থযাত্রীর সঙ্গ নিয়েছিল, ঠিক যেন ঘোরের দশা তখন তার। সেই ঘোর ভেঙেছিল প্ৰয়াগ তীর্থে এসে স্নান করার পর।

সে এক বৃদ্ধের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সে প্রতিশ্রুতি পালন করেনি, স্বপ্নলব্ধ এই বোধ তাকে পীড়া দেয়। তার মনে পড়ে ইব্রাহিমপুরের কথা যেন তার বজরা এখনো সেখানকার ঘাটে বাঁধা আছে তার অপেক্ষায়। সে আবার সেখানে ফিরে গেলেই নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করা যাবে। গঙ্গানারায়ণ তাই ইব্রাহিমপুর ফিরে আসে।

 

কুঠিবাড়িতে আশ্রয় নেবার পর গঙ্গানারায়ণ দেশের বর্তমান অবস্থা বুঝে নেবার চেষ্টা করলো। ইতিমধ্যে যে সিপাহী বিদ্রোহের মতন একটা এতবড় ঘটনা ঘটে গেছে, তাও সে জানে না। কোম্পানির রাজত্ব শেষ, এখন চলছে মহারাণী ভিকটোরিয়ার শাসন। ভুজঙ্গ ভট্টাচার্য বহুদর্শী লোক, অনেক কিছুর খবরাখবর রাখে। সে ইতিমধ্যেই গঙ্গানারায়ণের আগমনবার্তা জানিয়ে একজন বিশ্বাসী লোক মারফত পত্র পাঠিয়েছে কলকাতায় বাবুদের কাছে। গঙ্গানারায়ণের সে খাতির যত্নও করছে যথেষ্ট।

গঙ্গানারায়ণ দেখলো, এই এলাকায় তাদের জমিদারি কাজকর্ম আর কিছুই নেই এখন। সব জমিই সাহেবদের কাছে ইজারা দেওয়া। তাদের নিজস্ব যে কিছু খাস জমি ছিল, সেখানে আখের চাষ দেওয়া হতো এবং কয়েকজন চায়নাম্যান সেখানে খুলেছিল একটা চিনি কল। সে সব কিছুরই অস্তিত্ব নেই আর। আখের জমিতেও নীল চাষ হয়, চায়নাম্যানরা পালিয়েছে, চিনির কল তছনছ করে দিয়েছে কেউ। অথচ এক সময় ইব্রাহিমপুর পরগণাটি ছিল সিংহদের এস্টেটের প্রায় একটি সোনার খনি। এখন এর সবই নীলকরদের খপ্পরে।

নীলকর সাহেবরা যে সম্প্রতি কী করালরূপ ধারণ করেছে, সে খবরও ভুজঙ্গ ভট্টাচার্য শোনায় তাকে। পোশাক রঞ্জিত করার জন্য ইওরোপের বাজারে নীলের খুব চাহিদা, আর বাংলাদেশের নীল অতি উৎকৃষ্ট ধরনের, তাই এর চাহিদাও বেশী। নীল চাষ করে চাষী যদি ন্যায্য দাম পায় তা হলে অন্য চাষের চেয়ে সেটা তার পক্ষে লাভজনকই হবে। সেইজন্যই রামমোহন-দ্বারকানাথের মতন মানুষও মনে করেছিলেন, নীল চাষ বাংলার চাষীদের উন্নতির সহায়ক হবে। কিছু কিছু জমিদারও নিজ জমিদারিতে নীল চাষে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু এই লাভজনক ব্যবসা অবিলম্বেই কুক্ষিগত করে নিল সাহেবরা এবং লাভের নেশায় উন্মত্ত হয়ে তারা পিঁপড়ের পেট টিপে মধুবার করতেও জানে। কয়েক দশকের মধ্যেই চাষীদের শোষণ করতে করতে একেবারে ছিঁবড়েতে পরিণত করেছে তারা। সব চাষীই নীলকরদের কাছে ঋণজালে আবদ্ধ এবং বছরের পর বছর সেই ঋণের বোঝা বাড়ছে। চাষীর জমিতে উৎপাদন যতই হোক, তাতে তার লাভ কিছুই নেই। নীলের বদলে ধান চাষ করলে চাষী তবু অন্তত সম্বৎসরের খোরাকী পায়, কিন্তু তার উপায় নেই, সাহেবদের অত্যাচারে তারা শুধু নীল চাষ করতেই বাধ্য। ব্যাপার এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে কোনো কোনো চাষী মরীয়া হয়ে চাষ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। এ বৎসর। চাষ করলেও অনাহার, না করলেও অনাহার, দুটোই যখন সমান, তখন চাষ না করাই তো ভালো। বর্তমানে অবস্থা সেইজন্য থমথমে।

গঙ্গানারায়ণ প্রতিদিনই একবার করে নিকটস্থ গ্রামগুলিতে পদব্ৰজে বেড়াতে যায়। ভুজঙ্গ ভট্টাচার্য এটা পছন্দ করে না মোটেই। সে বরং গঙ্গানারায়ণকে পরামর্শ দেয় কলকাতায় চলে যাবার জন্য। তার ধারণা, খুব শীঘ্রই গ্ৰামদেশে একটা ব্যাপক গোলযোগ শুরু হবে, সুতরাং এখন এখান থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। গঙ্গানারায়ণ অবশ্য এ পরামর্শে কৰ্ণপাত করে না, এমন কি ভুজঙ্গ ভট্টাচাৰ্য তার সঙ্গে দু-একজন রক্ষী দেবার প্রস্তাব করলেও সে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। জমিদারি চাল-চলনে সে অনেকদিন অভ্যস্ত নয়, সে-জীবনের প্রতি আর কোনো মোহও তার নেই। একবার যে মুক্ত জীবনের স্বাদ পেয়েছে সে আর কোনো রকম পোশাকী বন্ধনই মেনে নিতে চাইবে না। এখন সে স্বচ্ছন্দে নগ্ন পায়ে চলাফেরা করে, শুধু ধুতি পরিধান করে খালি গায়ে বাইরে বেরুতেও সে লোক-লজ্জা  অনুভব করে না। ভুজঙ্গর অনেক পীড়াপীড়িতে সে গায়ে একটি উত্তরীয় জড়াতে সম্মত হয়েছে, কিন্তু জুতো আর পায়ে দেয় না।

গঙ্গানারায়ণ নিজে আর জমিদার বলে পরিচয় দিতে না চাইলেও গ্রামবাসীদের চক্ষে সে জমিদার। তার চমকপ্ৰদ প্রত্যাবর্তনের কাহিনী কাছাকাছি অনেকগুলি গ্রামে রটে গেছে, লোকের মুখে মুখে কাহিনী আরও পল্লবিত হয়। সাধারণ চাষী গৃহস্থেরা তার দিকে সম্ভ্রম ও ভয়ের দৃষ্টিতে তাকায়। চোখাচোখি হলে সেলাম জানায়। কেউ তার কাছে অন্তর খোলে না।

কয়েকদিন গঙ্গানারায়ণ এরকম গ্রামে ঘোরাঘুরি করার পর বৃদ্ধের দল তাকে সানুনয় অনুরোধ করলো। আর তাকে গ্রামের মধ্যে প্ৰবেশ না করতে। তার জন্য নিরীহ লোকরা বিপদে পড়তে পারে। পাশের গ্রামের নবীনামাধব নামে এক দৃঢ়চেতা যুবক এবং এ গ্রামের মহম্মদ রেজা খাঁ নামে এক বর্ধিষ্ণু চাষী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সদরে মামলা দায়ের করেছিল। তার ফলে সাহেবরা একেবারে ক্ৰোধে অগ্নিশর্মা হয়ে আছে। মামলায়-দুজনেই যদিও পরাজিত হয়েছে, তবু সাহেবদের ধারণা কেউ একজন এসব ব্যাপারে গ্রামের লোকদের প্ররোচনা দিচ্ছে। এবং গঙ্গানারায়ণের মতন একজন ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে সাহেবদের সন্দেহ হবেই।

বিপদ সত্যিই একদিন এলো।

বিরাহিমপুর কুঠিতেই একদিন হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার একটি সংখ্যা হঠাৎ হাতে এলো গঙ্গানারায়ণের। আদ্যোপান্ত পত্রিকাটি পড়ে সে চমৎকৃত হলো, এ পত্রিকার প্রতি লাইনই যে অগ্নিক্ষরা। সম্পাদকের নাম একজন কে হরিশ মুখার্জি, গঙ্গানারায়ণ তাকে চিনতে পারলো না। এমন চোস্ত ইংরেজি লেখে, নিশ্চয়ই হিন্দু কলেজের কোনো কৃতবিদ্য ছাত্রই হবে, কিন্তু হিন্দু কলেজের এ নামের কোনো ছাত্রের কথা গঙ্গানারায়ণের স্মরণে আসে না। পত্রিকার নাম হিন্দু পেট্রিয়ট কিন্তু মুসলমান চাষীদের সমস্যার কথাও সবিস্তারে লিখেছে।

হিন্দু পেট্রিয়ট পড়েই গঙ্গানারায়ণ বারাসতের হাকিমের হুকুমনামার কথা জানতে পারলো। সরকার নীল চাষীদের প্রাণান্তকর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়েছে এবং নীলকর ব্যবসায়ীদের জোর জুলুম নীতির জন্য উদ্বিগ্ন। বারাসতের হাকিম সেইজন্যই তাঁর এলাকার থানার দারোগাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যে চাষীর নিজস্ব জমি আছে, সে তার জমিতে তার খুশীমতন ফসল চাষ করতে পারে। জবরদস্তি করে তার জমিতে যদি নীল চাষ করাতে যায় কেউ, তা হলে পুলিস তা প্রতিরোধ করবে।

এ সংবাদ পড়ে গঙ্গানারায়ণ যথার্থ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। হানিফা বিবি এবং তার স্বামী জামালুদ্দীন শেখকে সে ফিরিয়ে আনতে পারেনি বটে। কিন্তু হানিফা বিবি কিংবা জামালুদ্দীন শেখের মতন আর কেউ যাতে নীলকুঠিতে গিয়ে গুম খুন না হয়, সে ব্যবস্থা সে করতে পারে। তা ছাড়া পুলিসের সাহায্য যদি চাষীরা পায় তা হলে নীল-ফসলের বদলে বাংলার মাঠ আবার সোনার ধানে ভরে যাবে।

গঙ্গানারায়ণের প্রথমেই মনে হলো, গ্রামে গিয়ে চাষীদের সে সঙ্ঘবদ্ধ হবার জন্য আহ্বান জানাবে। সবাই মিলে এককাট্টা হয়ে যদি নীল চাষ অস্বীকার করে তা হলে মুষ্টিমেয় নীলকর সাহেবরা কী করবে? বারাসতের চাষীরা যদি নীল চাষে বিরত হতে পারে তা হলে নদীয়াতেই বা পারবে না কেন?

পরে সে মাথা ঠাণ্ডা করে আরও কিছুক্ষণ ভাবে। এখনই নিরীহ, নির্জীব চাষীদের উস্কানি দিয়ে কোনো ঝঞ্ঝাটের মধ্যে টেনে আনা ঠিক হবে না। আগে প্ৰস্তুতি দরকার। সবচেয়ে নিকটবর্তী থানাই এখান থেকে দশ মাইল দূরে। গঙ্গানারায়ণ নিজে যাবে সেখানে। তার আগে এই এলাকার চাষীদের মনোভাব যাচাই করে নিতে হবে। চাষীরা যদি একযোগে নীল চাষে অস্বীকার করতে রাজি থাকে, তা হলে পুলিস-সেপাইদের উপস্থিতিতে তারা একই দিনে সকলের জমিতে মই দেবে।

 

পরদিন সকালে এক বাটি দুধ ও কিছু ফলাহার করে গঙ্গানারায়ণ গেল গ্রামের দিকে। ছোট একটি ডোবার পাশে একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ডোরাকাটা লুঙ্গি, তার বক্ষটি এমনই লোমশ যে আর কোনো পোশাকের দরকার হয় না। চোখের দৃষ্টিতে একটা পাগল পাগল ভাব। লোকটির নাম তোরাপ। এর শরীরের গড়ন দেখলে মনে হয় যে এককালে সে বেশ বলশালী পুরুষ ছিল, এখন খাঁচখানি মাত্রই সার। লোকটিকে গঙ্গানারায়ণ বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছে। একটি কারণে। অন্য গ্রামবাসীরা তাকে দেখলেই বাবু ছালাম বলে সম্বোধন করে কপালে হাত তোলে, কিন্তু এই লোকটি কোনোদিন তাকে সেলাম জানায়নি, বরং গঙ্গানারায়ণের চোখের দিকে চোখ পড়লেই সে উল্টো দিকে ঘুরে যায়।

আজ গঙ্গানারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই এগিয়ে এলো তোরাপের দিকে। সে-ও অমনি পিছন ফিরে দাঁড়ালো এবং উৎকট গলায়, যেন অশ্বত্থ বৃক্ষটিকেই উদ্দেশ করে একটি গান ধরলো।

গঙ্গানারায়ণ গানটির কথার ঠিক মর্ম বুঝতে পারলো না। অনেকটা যেন এই রকম :

ব্যারালচোকো হাঁদা হেমদো
নীলকুটির নীল মেমদো!

এই দুটি লাইনই সে গাইতে লাগলো বারবার। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই গান শুনে তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, কী মিঞা, কী গান গাইচে। ইদিকে ফিরে একটু ভালো করে গাও না, শুনি।

তোরাপ একটুখানি পাশ ফিরে ত্যারছা ভাবে দেখলো গঙ্গানারায়ণকে। তারপর বক্রম্বরে বললো, আমি পাগলা ছাগলা মনিষ্যি, আমি কী গান জানি! গান শোনবেন তো বেগুনবেড়েতে ঝান না ক্যান!

অপরকে প্ৰসন্ন করার জন্য মানুষ যেমন কণ্ঠস্বরে একটা কৃত্ৰিম অতিরিক্ত মিষ্টতা আনে, সেইভাবে গঙ্গানারায়ণ বললো, তুমি পাগল কেন হবে? বেশ তো গান গাইচিলে।

তোরাপ বললো, হ, পাগল হইছি, নীলির ঘায়ে পাগল হইছি।

তারপর সে সম্পূর্ণ ফিরে বললো, আগে জমিদারে মারছে, অহন মারে নীলির সাহেব। আমাগো ঝা জেবন, তায়ের আর বাচা আর মরা। পাগল হওনই সবঝে ভালো, খাই না খাই বগোল বাজাই। গান শোনবেন কইলেন, শোনেন তয়–

ঘর ভাঙ্গিলে জমিদারে
জাত মাল্লে পাদরি ধরে
ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে।

গঙ্গানারায়ণের মুখে একটু অপ্ৰস্তুত ভাব ফুটে উঠলো। সে যে জমিদার বংশের সন্তান একথা কেউ তাকে ভুলতে দেবে না। সে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো, জমিদার তোমার ঘর ভেঙেছেল? কবে?

তোরাপ এবার হা হা করে হেসে বললো, আমার তো ঘরই নাই, তা ভাঙবে কী? এ গানডা রচেছে আমার নানা বচোরদ্দি শ্যাখ। মোর ছ্যালো মোটে পাঁচ বিঘা জমি, তাও সাহেবরা নীলির জন্য দেগে দিয়েলো। হাল গরু ব্যাচে দেয়েছি, চাষই করমু না, তাও সুমুন্দির পো-র ছাড়ে না।

এবার গঙ্গানারায়ণ উৎসাহের সঙ্গে বললো, শোনো, তোরাপ, তোমার জমিতে যদি তুমি নীল রুইতে না চাও, ধান রুইতে চাও, আমি তোমায় সাহায্য করবো।

কিন্তু এ আলোচনা আর বেশী দূর অগ্রসর হতে পারলো না। গ্রামে একটা হই হই রব উঠলো। দাবানলের তাড়া খাওয়া জন্তুজানোয়ারদের মতন উদভ্ৰান্ত ভাবে ছুটতে লাগলো মেয়ে-পুরুষ-শিশুরা। কুঠিয়াল সাহেবরা দলবল নিয়ে আসছে, সব জমি নীল চাষের জন্য দাগিয়ে দেবে। এবারে নাকি সাহেবরা এক ছটাক জমিও ছাড়বে না।

এমনকি পাগল তোরাপও বুঝলো যে এই সময় গঙ্গানারায়ণ সাহেবদের নজরে পড়লে বিপদ ঘটবে। সে বললো, ও বাবু, যদি পরানে বাচতি চাও তো হুই পগারের পানে দৌড়ি পলাও! তুমি ভদ্দরনোক, তোমারে আগে বান্‌ধবে!

গঙ্গানারায়ণ তবু দাঁড়িয়ে রইলো। সে পালাবে কেন? ব্রিটিশ রাজত্বে মহারানীর সমস্ত প্ৰজারই সমান অধিকার। লোভে উন্মত্ত কিছু ব্যবসায়ী যদি আইন ভাঙতে চায়, তা হলে তাদের শাস্তিরও ব্যবস্থা আছে। এরা রুল অব ল মানতে বাধ্য।

যেমন প্রথা, সেই মত তিনজন সাহেব অশ্বপুষ্ঠে এবং তাদের দেওয়ান-গোমস্তা ও লাঠিয়ালের দলবল পিছন পিছন দৌড়ে দৌড়ে আসছে। অশ্বত্থ গাছের তলায় দণ্ডায়মান গঙ্গানারায়ণকে তারা দেখতেও পেল না, সোজা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। গঙ্গানারায়ণ দেখলো, তার পাশ থেকে তোরাপ যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সাহেবরা সব কাজই অতি দ্রুত সারে। তাদের দলটি অবিলম্বেই বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন দিকে। একটু পরেই গঙ্গানারায়ণ শুনতে পেল কান্নার রোল।

খুব বেশী দূরে নয়। সামনের আম বাগানটির ওপার থেকেই কান্নার শব্দ আসছে। গঙ্গানারায়ণ আর থাকতে পারলো না, এগিয়ে গেল সেদিকে।

সেখানে একজন সাহেব, একজন আমীন ও তিনজন লাঠিয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন চাষী সাহেবের জানু ধরে কেঁদে কেঁদে বলছে, ও সাহেব, এ জমিডা ছেড়ে দেও, এড মোগো পুকুর ধাইর্যা জমি, গেরামের মাইয়া মানষেরা এহানে গোছল করতে আসে, ও সাহেব!

সাহেব বারবার লাথি দিয়ে লোকটিকে ফেলে দিচ্ছে, সে আবার উঠে আসছে মিনতি জানাতে। গঙ্গানারায়ণ হন হন করে এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, স্টপ দিস! লিসন, ড়ু ইউ নো দি রিসেন্ট পরোয়ানা অব দি গবরমেণ্ট?

কুঠিয়াল ম্যাকগ্রেগর বেশ কয়েক বৎসর এই অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তার বাংলা ভাষায় যথেষ্ট বুৎপত্তি হয়েছে। গঙ্গানারায়ণের ইংরেজীর উত্তরে সে বললো, এ বাঞ্চৎ কোন আছে?

গঙ্গানারায়ণ মুখ তুলে ভালো করে দেখলো সাহেবটিকে। স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে ক্রমশ মুখখানি স্পষ্ট হলো। এই সেই ম্যাকগ্রেগর। এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই গঙ্গানারায়ণ চুড়ান্ত অপমানিত হয়েছিল। কোনো উত্তরই দিতে পারেনি সেদিন। হঠাৎ রক্ত উঠে এলো তার মাথায়।

কয়েকজন চাষী চিৎকার করে উত্তর দিল, সাহেব, ইনি আমাগো জমিদার!

ম্যাকগ্রেগর হেসে বললো, এ না-লায়েক বেটা কোন জমিন্দার! শ্যামচাঁদ খেলেই জমিন্দার ভাগবে! দেকো, তুমলোগ সব দেকো।

হাতের চাবুকটি শূন্যে ঘুরিয়ে ম্যাকগ্রেগর সজোরে এক ঘা কষালে গঙ্গানারায়ণের শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের পিঠ দিয়ে রক্ত ফুটে বেরিয়ে এলো। সে তবু অবিচল ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মেঘমন্দ্র স্বরে বললো, নতুন আইন হয়েচে, তোমরা জানো না, এই অত্যাচারের জন্য তোমায় গারদে পাঠাবো। এই আমি এখেনে সকলের সামনে শপথ নিলুম। তুমি এই চাষীর জমিতে ট্রেসপাস করেচো–

ম্যাকগ্রেগর বললো, বজ্জাত, নিগার। তুই আমায় আইন ডেখাইটে চাস? এই ড্যাখ তবে আমার আইন।

ম্যাকগ্রেগর আবার চাবুক কষাতেই গঙ্গানারায়ণ সেটা ধরে ফেললো। অতিরিক্ত মদ্যপ ও ভোগী ম্যাকগ্রেগরের চেয়ে সে অনেক বেশি শক্তিমান পুরুষ। হ্যাঁচকা টান দিয়ে চাবুকটা কেড়ে নেবার পর সে আর ক্ৰোধ দমন করতে পারলো না। পর পর কয়েক ঘা চাবুক সজোরে মেরে সে প্রতিদান দিল ম্যাকগ্রেগরকে। ম্যাকগ্রেগর পড়ে গেল ঘোড়া থেকে।

তারপর একটি ছোটখাটো বিদ্রোহের ব্যাপারই ঘটে গেল সেখানে। লাঠিয়ালরা এগিয়ে আসতেই অনেক চাষী একত্রে গর্জন করে উঠলো, খবর্দার, ওনার গায়ে কেউ হাত লোগাবি না। একজন অত্যাচারী সহেবকে ভূপাতিত হতে দেখে তাদের আনন্দ ও সাহস যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। কোথা থেকে একটা প্ৰকাণ্ড লাঠি নিয়ে এসে পড়লো তোরাপ। সকলে মিলে লাঠিয়াল তিনজনকে ঘায়েল করে ফেলল এবং অন্য সাহেবদের কাছ থেকে সাহায্য আসার আগেই ওরা গঙ্গানারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে দূরে পালিয়ে গেল।

সেইদিন মধ্যরাত্রে গ্রামের কয়েক স্থানে লক লক করে উঠলো অগ্নির লেলিহান শিখা। সবচেয়ে প্রথমে ভস্মসাৎ হলো জমিদার সিংহবাবুদের কুঠিবাড়িটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *