গানের ভিতর দিয়ে
আমরা যখন কথা বলি তখন গলা ওপরে তুলি, আবার কখনো খাদে নামাই। কোনো শব্দ লম্বা করে বলি, কোনোটার ওপর ঝোঁক দিই। মোট কথা, একটা ভাব প্রকাশের জন্যে কতোগুলো অর্থবোধক শব্দই যথেষ্ট নয়। ঠিকমতো ভাব প্রকাশ করতে হলে শব্দের সঙ্গে গলার ওঠা-নমার দরকার হয়। একই শব্দ দিয়ে নানা অর্থ প্রকাশ করতে পারি নানাভাবে সেই শব্দ উচ্চারণ করে। যেমন, ধরা যাক, দুটি শব্দ–“মনে আছে?” মাত্র দুটি শব্দের এই কথা দিয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করতে পারি।–মনে আছে? প্রেমিকা অথবা প্রেমিককে অতীতের একটা ঘটনা অথবা কথা মনে করিয়ে দিতে পারি। সেই মনে করানোর সঙ্গে দুঃখ থাকতে পারে, ক্ষোভ থাকতে পারে, অভিমান থাকতে পারে, বিস্ময় থাকতে পারে, প্ৰেম থাকতে পারে, ভালো লাগা থাকতে পারে। কাজের লোককে তার কাজের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়ে সাবধান করে বলতে পারি: মনে আছে? এমন কি, একজনের প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি, হ্যাঁ, মনে আছে। এই সব বিচিত্র অর্থ প্ৰকাশ পায় কেবল গলার ওঠা-নামার মুধু দিয়ে, বাচনভঙ্গি থেকে।
বস্তুত, কেবল শব্দাবলী নয়, ভাব এবং আবেগ প্রকাশের একটা প্রধান বাহনই হলো গলার উঠানামা। আমরা গলা খাদে নামিয়ে গুরুগম্ভীর আদেশ দিই। গলা উঁচু করে গাল দিই। অনুরোধ করি। গান হলো সেই ওঠা-নামারই সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি। এর মধ্য দিয়ে আমরা মনের এমন কতোগুলো কোমল অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি, অন্য কোনো উপায়ে যা পারিনে। গান আমাদের নিয়ে যায় এমন এক জগতে যেখানে আমরা অন্য কোনো উপায়ে পৌঁছতে পারিনে। বাঞ্ছিতজন অনেক সময়ে গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকেন। সুর দিয়ে তাঁর চরণ ছুতে পারি, কিন্তু কিছুতেই তাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারিনে।
মনে আছে, অনেক বছর আগে, প্রথম যৌবনে এক রাতের বেলায় একটা গান শুনে অভিভূত হয়েছিলাম–সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে। পরের দিন আমার এক বন্ধু এলো আমার সঙ্গে আডডা দিতে। তাকে বললাম, জানো, গত রাতে কী এক আশ্চর্য গান শুনেছি। তুমি কখনো শুনেছো এ গান? এই বলে আমি গীতবিতান বের করে গানটা তাকে পড়ে শোনাতে চেষ্টা করলাম।
সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে,
যাক না গো সুখ জ্বলে।
এ পর্যন্ত পড়ে আমার সন্দেহ হলো: ঠিক গান পড়ছি তো! নাকি, ভুল করে অন্য কোনো গান পড়ছি? রাতের বেলায় যে-গান কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আমাকে অনির্বচনীয় এক জগতে নিয়ে গিয়েছিলো, সে কি এই গান? পড়ে শোনাতে গিয়ে অন্তত তা তা মনে হলো না। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন যে, বাল্যকালে একদিন যখন পড়ছিলেন: জল পড়ে, পাতা নড়ে; তখন জল পড়ের সঙ্গে যেই জোড়া লাগলো পাতা নড়ে, অমনি ছন্দের দোলায় তাঁর মন নেচে উঠলো। বস্তুত কবিতার ছন্দ এবং ভাষাও গদ্যের সীমানা পেরিয়ে আমাদের অনির্বচনীয় আনন্দলোকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ছন্দ আর কাব্যিক ভাষার সঙ্গে সুরের মিলন ঘটলে তা আমাদের নিয়ে যায় আরও উর্ধ্বলোকে। সে জন্যেই রাতের বেলায় সুরের ছোঁয়ায় যে-অনুভূতি এসেছিলো হৃদয়-মন-দেহ জুড়ে আমার সমগ্র সত্তায়, সুরহীন কবিতা মনের গভীরে সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলো। বন্ধুকে আর তেমন নিবিড় করে আমার অনুভূতিটা তুলে ধরতে পারলাম না।
উইলিয়াম র্যাডিচি তাঁর একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথের গান অনুবাদ করার প্রসঙ্গে কবিতা আর গানের পার্থক্যের কথা বলেছেন। চমৎকার একটি উপমা দিয়ে। তিনি লিখেছেন: সুরবর্জিত গান হলো পাখাহীন প্রজাপতির মতো। নগ্ন, সৌন্দর্যহীন। সুতরাং গান অনুবাদ না-করাই ভালো।
গানের এই অসাধারণ প্ৰকাশ ক্ষমতার কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেও বার বার বলেছেন, এমন কি গান দিয়েও বলেছেন।
গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি,
তখন তারে চিনি
আমি তখন তাকে জানি।
কখনো বলেছেন, গানে গানে আমার বন্ধন, আমার সীমানা ছিন্ন করো।
আমাদের জীবন যতোই জটিল হচ্ছে, আমরা যতোই বস্তুর পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, গান আমাদের জীবন থেকে ততোই দূরে সরে যাচ্ছে। আগের তুলনায় প্রযুক্তি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে–ঘরে রেডিও থাকে, টিভি থাকে, হাইফাই থাকে, সিডি থাকে। কিন্তু করুণাধারায় গান এসে আমাদের অতি শুষ্ক জীবনকে আন্দ্রে করে না, বরং শুষ্ক জীবন করুণার ধারাকেই শুকিয়ে ফেলে। তারপরও কখনো কখনো গীতসুধার তরে চিত্ত পিপাসিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের আগে পর্যন্ত আমরা যে-বাংলা গান দেখতে পাই, সে গানে কথা খুব সামান্যই থাকতো। তাতে প্রাধান্য ছিলো সুরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আঠারো-উনিশ বছর বয়সে যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন প্রায় বছর খানেক, তখন কথাপ্রধান গান শুনেছিলেন। শিখেওছিলেন তাঁর বান্ধবী লুসি স্কটের কাছে। যে-গান তিনি শিখেছিলেন, পশ্চিমে সে গানকে বলা হয় ফোক সং। তিনি স্কটিশ এবং আইরিশউভয় ধরনের ফোক সং শিখেছিলেন। এসব গান আবৃত্তি করে গাইবার মতো গান। বাংলায় তখনো এ ধরনের গান ছিলো না। এ ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ আরও এক ধরনের গান শুনেছিলেন, যাকে বলে অপেরা সং। গীতিনাট্যের গান। সেখানেও কথার ছড়াছড়ি। দেশে ফিরে এসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন মায়ার খেলা গীতিনাট্য। তাতে আইরিশ এবং স্কটিশ ফোক সং-এর আদলে কয়েকটি গানও ছিলো। কিন্তু যা তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যা ছিলো, তা হলো: অতঃপর গান লিখতে গিয়ে তিনি অনেক বেশি জোর দিলেন কথার ওপর। ফোক সং-এর মতো কথার সঙ্গে সুরের মিলন ঘটালেন। এবং তার পর থেকে বাংলা গানের ধরনই বদলে গেলো। কথার প্রাধান্য ছাড়া এখন বাংলা গান হয় না। আমরা বাঙালিরা সুরের সঙ্গে মিলিয়ে মনের কথাটাই বলতে চাই বারবার।
(যুগান্তর, ২০০৬)