ওপরে আজকের তারিখ। নীচে সাদা পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে শ্রীনাথ তার ডায়েরি লিখছিল। আগেও লিখত মাঝে মাঝে। তবে সেসব ছিল গাছপালার কথা, নানা অভিজ্ঞতা এবং ভাবনা-চিন্তার কথা। আজকাল সে লিখছে নিজের জীবনের সব নোংরামির কথা। জ্বালা-যন্ত্রণার কথা। কিছুই গোপন করছে না, বরং এত খোলাখুলি লিখছে যে লেখার পর সেটা পড়তে গেলে তার নিজেরই মাথা গরম হয়ে যায়। তবু তার মধ্যে আছে বিষাক্ত, জ্বালাধারা, তীব্র এক সুখও।
সবচেয়ে উত্তেজনা হয় যখন তৃষার কথা লেখে, মল্লিনাথের কথা লেখে। ওদের অবৈধ প্রেম এবং সজলের জন্মকথা সবটাই সে লিখেছে কিছু তথ্য ও কিছু অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু গল্পটা জমেও গেছে বেশ।
শ্রীনাথ জানে, তার ঘরে কোথাও কিছু গোপন করার উপায় নেই। তৃষা ড়ুপ্লিকেট চাবি করিয়ে রেখেছে। তার অনুপস্থিতিতে এই ঘরে প্রায়ই নিখুঁত তল্লাশি চালানো হয়। তৃষা কী খোঁজে সেই জানে। তবে শ্রীনাথ তার ডায়েরিটা খুব সহজ জায়গায়, হাতের কাছে, টেবিলের ওপরেই রেখে যায়। তৃষা পড়ুক। শুধু তৃষাকে পড়ানোর জন্যই না তার এই নিরন্তর ডায়েরি লিখে যাওয়া! এর জন্যই সে বেশ মোটা একটা খাতা তার প্রেস থেকে বাঁধিয়ে এনেছে।
আজ সে মদ খায়নি। মেয়েমানুষের ঘরে যায়নি। আজ দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টির পর মনটা কেমন অন্য গান গাইল। প্রেসের বুড়ো মালিক মারা গেল সেদিন। গতকাল তার শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েই জীবনের নশ্বরতার দিকটা হঠাৎ আবার চোখে পড়ল তার। রাস্তা দিয়ে মড়া নিতে দেখলে বা শ্মশানঘাটে গেলে যেমনটা হয় আর কী! ফুর্তি করলে মনের ভারী ভাবটা হয়তো কেটে যেত। কিন্তু কাটাতে চায়নি শ্রীনাথ। বহুকাল অনিত্য জীবনের কথা তো ভাবেনি। নতুন একটা ভাবনা। সেটা ভেবে দেখলে ক্ষতি কী?
আজ সন্ধের মুখে ফিরে এসে পরিপাটি করে স্নান সেরে ডায়েরি নিয়ে বসেছে। আজ কোনও জ্বালা-যন্ত্রণার কথাও লিখছে না সে। আজ সে খুব শান্ত বিষণ্ণতায় লিখছে একটা যন্ত্র ও একজন মানুষের যৌথ সংগ্রামের কথা।
একদিন সেই উনিশশো পনেরো সালে খলসেপুর গ্রাম থেকে একটি ছেলে জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় এসে ড়ুবজলে পড়ে গেল। এই তরঙ্গসঙ্কুল উথাল-পাথাল দরিয়ায় সাঁতারের কায়দা। জানে না। কখনও এ রক-এ শুয়ে থাকে, কখনও ওই গাড়িবারান্দার তলায়। তখন করপোরেশনের জলের কল শুকনো থাকত না, লোকের সদাশয়তা ছিল কিছু, দানধ্যান ছিল, ইংরেজ ছিল, রাজা ছিল, জমিদার ছিল। সে এক অন্য জগৎ। কখনও কলের জল, কখনও লোকের দয়া সম্বল করে ছেলেটা টিকে রইল। দু’-একজন তার অবস্থা দেখে দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিল। ছেলেটা গেল না… কালক্রমে সেই ছেলে কীভাবে এক মস্ত প্রেসের মালিক হল সেই কাহিনি খুব মনপ্রাণ। দিয়ে লিখছিল শ্রীনাথ। বুড়ো মালিক শচীন্দ্রনাথকে সে সত্যিই শ্রদ্ধা করত। এই একজন লোক যিনি জীবনে কাউকে বড় একটা আপনি থেকে তুমি বলেননি।
শচীনবাবু মারা গেলেন, বহুকাল বাদে খুব দুঃখ পাওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটল শ্রীনাথের জীবনে। আজকাল তার মন এতই ভোঁতা হয়ে গেছে যে, সহজে সে দুঃখ পায় না। মনে হয় কোনও নিকট আত্মীয়-বিয়োগ ঘটলেও তার চোখে জল আসবে না কিছুতেই।
কিন্তু এল। শচীনবাবুর বয়স হয়েছিল আশির কাছাকাছি। এই বয়সেও বেশ ভালই ছিলেন। শরীরে মেদ ছিল না, কোনও ঘ্যানঘ্যানে অসুখ ছিল না, খাওয়ার লোভ ছিল না। প্রচুর দানধ্যান করে গেছেন। শ্রীনাথ একমাত্র এই লোকটার জন্যই একটানা এতকাল এক জায়গায় নিরুপদ্রবে কাজ করে গেছে। একেবারে হালে কিছু শ্রমিক অসন্তোষ, ধর্মঘট, বিক্ষোভ এবং লক আউটের সম্ভাবনা ইত্যাদি দেখা দিলেও কোনওদিনই খুব বিরক্তিকর কিছু ঘটেনি। সবই মিটে গেছে। সেই প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ডটি ভেঙে গেল। তবে প্রেসের ভবিষ্যৎ ভেবে নয়, নিছক একজন মানুষের জন্যই সেইদিন খুব কেঁদেছিল শ্রীনাথ। খুব কেঁদেছিল।
তার নিজের জীবনে আর-কোনও সদর্থক লড়াই নেই, গরিব থেকে বড়লোক হওয়া নেই, সাফল্য লাভ নেই। এখন একটানা এক জীবন, ঘাত-প্রতিঘাতহীন বয়ে যাবে মৃত্যুর দেউড়ি অবধি। তাই বুঝি ওই কান্না। যে জীবন তার নয়, যে জীবন তার কখনও হবে না, তাকে সিংহাসনে বসিয়ে মানুষ মাঝে মাঝে এরকম ধুলায় পড়ে কাঁদে।
দরজার শেকল নড়ে উঠতেই সামান্য চমকে গিয়েছিল শ্রীনাথ।
মেজদা!–বাইরে থেকে কে ডাকল।
কে?
আমি দীপু। দরজা খোলো।
শ্রীনাথ উঠে দরজা খুলে দীপনাথকে দেখে একটু অবাক হয়। কারণ, দীপনাথের পরনে একটা লুঙ্গি করে পরা ধুতি, গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। এই বেশে কোত্থেকে এল?
দীপু! কখন এসেছিস?
অনেকক্ষণ। সেই বেলা থাকতে।
টের পাইনি তো?
পাবে কী করে? তুমি তো বারবাড়িতে থাকো।
দরজা ছেড়ে ঘরে গিয়ে দীপনাথকে ঘরে আসার পথ দেয় শ্রীনাথ। টেবিলের পাশের চেয়ারটায় গিয়ে ফের বসে বলে, এই ঘরটাই বাড়ির মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।
ঘরখানা তো ভালই।–বলে দীপনাথ বিছানায় বসতে যাচ্ছিল।
শ্রীনাথ বলল, ওই আরামকেদারায় বোস। মুখোমুখি হবে। আজ কি এখানেই থাকবি নাকি?
বউদি যেতে দিল না। একটু কাজ ছিল কলকাতায়।
কাজ তো রোজই আছে। তোর চাকরির কী একটা গোলমাল চলছে না?
মিটে গেছে। আমি কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজাব হয়েছি।
বাঃ খুব ভাল।
বলে শ্রীনাথ একটা বিড়ি ধরাল। আজকাল বিড়ি খেতে দারুণ লাগে। বড়বাজার থেকে স্পেশাল বিড়ি কিনে আনে পাইকারি দরে। দীপনাথের সাফল্য তাকে বিন্দুমাত্রও স্পর্শ করে না। দুনিয়ার কোনও কিছুই করে না বড় একটা! কত মাইনো হল জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করতে পারে না। কী হবে জেনে?
খানিক বিড়ির ধোঁয়া বুকে আটকে রেখে ছেড়ে দিয়ে বলল, ভাল।
খুব ভাল। দীপনাথ চারদিকে তাকিয়ে ঘরখানা দেখে। স্থাপত্যের দিক দিয়ে ঘরটাকে গোলই বলতে হয়। সব দিকটা না হলেও পিছনের দিকটা পুরোপুরি অর্ধ বৃত্তাকার। চারদিকেই মস্ত মস্ত জানালা। এই ঘরের নাম মল্লিনাথ দিয়েছিল ভাবন-ঘর।
হঠাৎ দীপনাথ প্রশ্ন করে, বড়দা এই ঘরে বসে কী ভাবত বলো তো!
কে জানে!
বড়দাকে কখনও কিছু খুব ভাবতে তো দেখিনি। হইচই করত, ফুর্তি করত, ভাবত কখন?
ভাবত, ভাবত। না ভাবলে, ব্রেন না খাটালে এত সম্পত্তি করল কী করে অত অল্প বয়সে?
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, ভাবলেও অলস চিন্তা করত না। এই ঘরটা আসলে ছিল কাজের ঘর। ড্রইং করত, প্ল্যান আঁকত।
তা হবে। আমি তো কিছু করি না, বসে বসে ভাবি। ঘরটার নাম আমিই সার্থক করছি।
কী ভাবো তুমি?–সকৌতুকে প্রশ্ন করে দীপনাথ। তার সন্দেহ মেজদারও ভাবনা-চিন্তা করার মস্তিষ্ক নেই।
আমার সবই অলস চিন্তা। অলস মাথা শয়তানের বাসা।
প্রীতমকে দেখতে গিয়েছিলে?
শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, না। তোর বউদি গিয়েছিল।
সে খবর শুনেছি। তোমারও একবার যাওয়া উচিত।
এবার যাব একদিন। তুই কি প্রায়ই যাস নাকি?
যাই। প্রীতমকে তো ছেলেবেলা থেকে চিনতাম।
সে তো ঠিকই। প্রীতম ছেলেটাও ভাল। ওর যে কেন এমন হল!
সে কথা আমিও ভাবি। প্রীতমের তো কোনও পাপটাপ নেই। তবে কেন ওরই এই রোগ!
বাঁচবে না, না?
ডাক্তাররা স্পষ্ট করে সে কথাটাও তো বলছে না। তবে প্রীতম খুব বেঁচে থাকতে চায়।
এ কথায় যেন একটু অবাক হয় শ্রীনাথ! বেঁচে থাকাটা এমন কী ভাল ব্যাপার যে, লোকে বেঁচে থাকতে চাইবে! তবে মাথা নেড়ে গতানুগতিক কথাটাই বলল, তা তো চাইবেই! কে না চায়!
সেই আকাঙ্ক্ষাই প্রীতমকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো শেষ অবধি ওই জোরেই বেঁচেও যাবে।
তাই যেন হয়। এই বয়সে বিলুটা না ভেসে যায়।
তোমার এক-আধদিন গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করা উচিত। কেন সময় পাও না বলা তো! প্রেসের চাকরিটুকু ছাড়া আর তো তোমার দায়দায়িত্ব নেই। সংসাব-টংসার সব তো বউদি দেখছে।
শ্রীনাথ আর-একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, সময়ের অভাবটা বড় কথা নয়। আমার কেমন যেন অসুখ-বিসুখের কাছে যেতে ইচ্ছে হয় না।
তা বলে কর্তব্য করব না? আমরা ছাড়া প্রীতম আর বিলুর কে আছে বলো?
কেন, প্রীতমের তো মা বাপ ভাই বোন, সবাই আছে শুনেছি।
আছে, তবে তারা এখানে থাকে না। সেটা কোনও কথা নয়। এখানে যখন অসহায়ভাবে আছে তখন আমাদের সকলেরই উচিত খোঁজ-খবর নেওয়া।
শ্রীনাথ একটু বিপদে পড়ে যায়। সঠিক কিছু জবাব দিতে পারে না। অন্য দিকে চেয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার জন্য বলে, সেই যে তোর সঙ্গে একটা মেয়ে এসেছিল তার খবর কী?
মেয়ে নয়, বসের বউ।
ও, আমি ভেবেছিলাম বুঝি—
কথাটা হওয়ায় ছেড়ে দেয় শ্রীনাথ। দীপনাথ একটু লজ্জা পায়। শ্রীনাথ কী ভেবেছিল তা খুব দুর্বোধ্য নয়।
দীপনাথ বলল, অন্যরকম ভাববার তো কিছু নেই। আমি তো পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময়েই বলেছিলাম যে, উনি আমার বসের বউ।
তা হবে। মনে ছিল না। মেয়েটা অনেক খবর রাখে।
একালের ছেলেমেয়েরা তোমাদের আমলের চেয়ে একটু বেশি ইনফরমেশন রাখে।
তা বুঝি। সত্যই তো এমন সব কথা বলে যে আমি অবাক হয়ে যাই।
দীপনাথ মদ হেসে বলে, ইনফরমেশনের ব্যাপারে তোমার আগ্রহ খুবই কম কিন্তু মেজদা। আজকাল তোমাকে সব ব্যাপারেই খুব কোল্ড বলে মনে হয়! কেন বলো তো!
আমার কথা বাদ দে।
বউদির সঙ্গে কি বনিবনা হচ্ছে না?
কোনওদিনই হত না।
আজকাল বেশির ভাগ সংসারেই স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা হচ্ছে না দেখছি।
তাই হবে।
কিন্তু তোমরা তো আজকালকার ছেলেমেয়ে নও। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এতদিনে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
শ্রীনাথ একটা শাস ছেড়ে বলে, অনেক ব্যাপার আছে। সবটা তোকে বলা যায় না।
দীপনাথ গম্ভীব হয়ে বলে, আমি শুনতে চাইনি। ওসব শুনে কী হবে? সবসময়েই দু’পক্ষেরই সমান বলাব কথা থাকে। কিন্তু কথা এক জিনিস, আর কাজ অন্য।
শ্রীনাথ খুব ঘন ঘন বিড়িতে টান দেয় খানিকক্ষণ। তারপর বলে, আমার দিক থেকে আর কিছু করার নেই।
এটা ভাল নয়, মেজদা। এ বয়সেও যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রী অচেনা লোকের মতো থাকো তবে ছেলেমেয়েরা কী ভাববে? ওরা বড় হচ্ছে, বুঝতে শিখছে। মা-বাবার মধ্যে সম্পর্ক ভাল না থাকলে ছেলেমেয়েরা মানুষ হয় না।
তার আমি কী করব? আমার কিছু করার নেই।
বউদির ব্যাপারে তুমি বরফের মতো ঠান্ডা থাকলে কী করে কী হবে! বরং একদিন তোমরা মুখোমুখি বসে ঠান্ডা মাথায় কথাবার্তা বলো না কেম! বউদি তো অবিবেচক নয়। বরং আমাদের
অনেকের চেয়ে বউদির বুদ্ধি বেশি, বড়দার সম্পত্তি উনি খুব ভাল দেখাশোনা করছেন।
হ্যাঁ, ওঁর অনেক গুণ।–বিষ-গলায় বলে শ্রীনাথ।
ওই তো রাগের কথা হল। মানুষের গুণের পাশাপাশি দোষও তো কিছু থাকবেই। তোমারও কি দোষ নেই?
আমারই তো সব দোষ বলে শুনি।–শ্রীনাথ খুবই নিরুত্তাপ গলায় বলে।
এটাও রাগের কথা। শোনো মেজদা, এভাবে বারবাড়ির ঘরে তোমার বনবাস মোটেই ভাল দেখায় না। তার চেয়ে তোমরা একটা আপসরফা করে নাও।
আমাকে আর কিছু করতে বলিস না। আমি পারব না।
কেন পারবে না?
আমার ও ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই।
দীপনাথ একটু চুপ করে ভাবে। ঠিক এই অবস্থায় শ্রীনাথকে আর চাপাচাপি করা উচিত হবে কি বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, শ্রীনাথ এখন এমন একটা হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভুগছে যে তাকে বেশি চাপ দিলে সে খেপে উঠবে।
দীপনাথ মৃদু স্বরে বলে, ঠিক আছে। তুমি না চাইলে কোনও কথা নেই।
শ্রীনাথ আর-একটা বিড়ি ধবাচ্ছে। ধরিয়ে বলল, তুই যেভাবে বলছিস ওভাবে এর সমাধান হয়। অনেকদিনের অনেক ব্যাপার জমে জমে পাহাড় হয়েছে। এ শুধু কি কথা কয়ে ঠিক করা যায়?
তুমি অত বিড়ি খাচ্ছ কেন? আগে তো খেতে না।
খাই। এমনিই।
অত বিড়ি খেয়ো না।
কী আর হবে।
রেসের মাঠে তোমাকে সেদিন খারাপ লেগেছিল। প্রায়ই যাও নাকি?
যাই। তবে নিয়মিত কিছু নয়। আমার নেশা নেই। তুই যাস কেন?
সাধ করে যাই না। বোস সাহেবের সঙ্গে যেতে হয়েছিল। নইলে রেস-টেস আমি বুঝিই না।
শ্রীনাথ একটা শ্বাস ফেলে, আমার কাছে সব সমান। ভাল বা মন্দ বলে কিছু নেই।
তুমি আজকাল খুব অন্যরকম হয়ে গেছ।
সেটা আমিও টের পাই। কিন্তু কিছু করার নেই।
করার থাকলেও তো তুমি করবে না।
এ কথায় শ্রীনাথ একটু হাসল।
আমি সজলকে নিয়ে একটা কথা ভাবছি, মেজদা।
কী?
আমার চাকরি তো পাকা হল। ভাবছি কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট নেব। সজলকে কলকাতার কোনও ভাল ইংলিশ স্কুলে ভরতি করে দেব। আমার কাছেই থাকবে।
সজল কি যেতে চায়?
খুব চায়। আজই তো আমাকে চুপিচুপি বহুবার বলেছে, আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো, বড়কাকা। আমি তোমার কাছে থাকব।
সজল ওরকম একটা কথা আমার কাছেও বলে। ও বোধহয় এ বাড়িতে থাকতে চায় না।
না, চায় না। তোমরা ওর মনের দিকে মোটেই তাকাও না। হি ইজ বিয়িং নেগলেকটেড। আগের বার যখন এসেছিলাম তখন ও আমাকে কিছু অদ্ভুত কথা বলেছিল। তখনই বুঝেছিলাম ও ভেতরে ভেতরে রিভোল্ট করছে।
হতে পারে। আমি অত সব লক্ষ করিনি।
করো না কেন? আমাদের বংশের এখনও পর্যন্ত ওই একটিই সলতে। সজলের দায়িত্ব তোমরা যদি ঠিকমতো নিতে না পারো তবে আমিই নেব। ও আমাকে খুব ভালও বাসে!
নে না। কে বারণ করেছে? ছেলেমেয়েরা আমার কাছে মানুষ হয় না, হয় ওদের মায়ের কাছে। কাজেই ওদের ভালমন্দ তোর বউদির হাতে।
তবু তোমার দায়িত্ব আছে। তুমি বাবা।
শ্রীনাথের বিড়ি নিভে গেছে। সেটার পোড়া মুখটা টিপে ছাই ফেলতে ফেলতে খুব অবাক হয়ে প্রতিধ্বনি করল, আমি বাবা!
দীপনাথ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল শ্রীনাথের দিকে। এই লোকটার জন্য তার দুঃখ হয়, এর ওপর রাগও হয়। কোথায় যেন একটা স্বাভাবিকতার সুর কেটে গেছে শ্রীনাথের জীবনে। বড়দা মল্লিনাথের সঙ্গে মেজো বউদি তুষার যে অবৈধ সম্পর্কের কথা কানাঘুষায় দীপনাথের কানে গেছে তা যদি সত্যিও হয় তবু তার জন্য শ্রীনাথেরও কি দায়িত্ব নেই! বড়দার খামারবাড়িতে বউদিকে একা ফেলে রাখত কেন দিনের পর দিন? ঘি আর আগুন কাছাকাছি রাখতে নেই, সে কথা কে না জানে! তখন তো অনেকে এমন কথাও বলেছে যে, দাদার সম্পত্তি হাত করার জন্যই শ্রীনাথ বউকে কাজে লাগিয়েছে। এসব নোংরামি এতকাল গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি দীপনাথ। এখন অবস্থা দেখে ভাবতে হচ্ছে।
সে বলল, সজলের ওপর আমাদের সকলেরই দায়িত্ব আছে।
বলছি তো, তোব বউদির সঙ্গে বুঝে দেখ। আমি এ সংসারের কেউ নই।
বউদির অমত নেই। তবু তোমাকে জিজ্ঞেস করতে বলল।
তবে তো হয়েই গেছে। নিয়ে যাস সজলকে, আমার অমত নেই। তুই কি শিগগিরই বিয়ে-টিয়ে করবি?
হঠাৎ ওকথা কেন?
বিয়ে না করলে সজল থাকবে কার কাছে? তোর তো অফিস আছে, ট্যুর আছে।
লোক রাখব।
দূর পাগলা!–শ্রীনাথ হাসে, বাচ্চারা কি মাইনে-করা লোকের কাছে ভাল মানুষ হয়? যাকগে, সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে। এ বছরই তো কিছু হচ্ছে না। নতুন সেসনে ওকে কলকাতার ভাল স্কুলে ভর্তি করব। তার দেরি আছে।
বাবার সঙ্গে দেখা করেছিস?
করেছি। বাবা বলছিল, তুমি নাকি এক বাড়িতে থেকেও তার খোঁজখবর নাও না।
নিই না ঠিক নয়। মাঝে মাঝে নিই। তবে এক বাড়িতেই তো থাকা, ব্যস্ততার কিছু নেই।
আর-একটা কথা, মেজদা।
তুই আজ অনেক কথা বলছিস।
প্রয়োজন হয়েছে বলেই বলছি।
বল। শুনছি।
ঘরের কথা বাইরে লোককে জানানো কি ভাল?
শ্রীনাথ ঠান্ডা বিড়িটার দিকে চেয়ে থাকে। জবাব দেয় না।
দীপনাথ অত্যন্ত ঠান্ডা দৃঢ় স্বরে বলে, এ কাজটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। মনে রেখো, এই পবিবারের সঙ্গে আমাদের সকলেরই সম্মান জড়িয়ে আছে। বউদির নামে তুমি যদি বাইরে কিছু রটাও সেটা আমাদেরও ছোট করে দেয়, তোমাকেও করে। তুমি সেটা বুঝতে চাও না কেন?
ওসব কথা থাক।–শ্রীনাথ অস্বস্তি বোধ করে বলে।
আজ থাক। কিন্তু পরে যদি শুনি তবে আবার কথাটা তুলব, আর তুমি যদি মনে করো যে, মানসিক দিক দিয়ে তুমি নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছ তা হলে তা জানিয়ো, ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করব।
সুস্পষ্ট এটা ওয়ার্নিং। দীপনাথকে শ্রীনাথ খুব ভাল করে চেনে না। তবে এটা জানে যে, দীপনাথের নৈতিক বোধ খুব প্রবল, সবাই তাকে দাদা মল্লিনাথের মতোই শক্ত-সমর্থ লোক বলে জানে। তবে মল্লিনাথের নীতিবোধে ঘাটতি ছিল, দীপনাথের তা নেই।
শ্রীনাথ বুঝতে পারল না দীপুকে তার ভয় পাওয়া উচিত কি না। বোধহয় উচিত। কেননা গত পাঁচ মিনিট সে দীপনাথের চোখে চোখ রাখা দূরের কথা, তার দিকে চাইতেই পারল না।
দীপনাথ উঠল, আমি একটু নিতাই খ্যাপার খোঁজ করতে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় দেখা হবে তোমার সঙ্গে।
আয়।
দীপু চলে যেতে নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল শ্রীনাথ। ভারী ভয়েব গুডগুড়ানি উঠেছিল বুকের মধ্যে। ঠিক এই রকম ভয় পেত সে দাদা মল্লিনাথকে।
ডায়েরি বন্ধ করে রাখল শ্রীনাথ। আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। উঠে বহুকাল বাদে সে বিনা প্রয়োজনে ভিতরবাড়ির রাস্তায় পা দিয়ে হাঁটতে থাকে।
তৃষা নিজের ঘরের বারান্দায় একটা প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে মাদুরে বসে জাবদা খাতায় কী লিখছিল নিচু হয়ে। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। চাঁদনি নেই, কিন্তু থোকা থোকা জোনাকি জ্বলছে চারদিকে। ঝিঝি ডাকছে।
তার সাড়া পেয়ে মুখ তোলে তৃষা।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শ্রীনাথ টের পায়, তৃষা আর যুবতী নেই। তৃষা প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছে। বসার ভঙ্গি, চশমা, মুখ তুলে চাওয়া—এসব কিছুর মধ্যে সুস্পষ্টই বয়সের প্রগাঢ়ত্ব এসে গেছে।
তুমি!
একটু এলাম।
বোসো।
শ্রীনাথ মাদুরে বসল। দূরত্ব রেখে।
তৃষা নিজে থেকেই বলে, দীপুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
হুঁ।
ও বড় ভাল ছেলে।
হ্যাঁ।
আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না শ্রীনাথ।