শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে — বাবুরাম, মাস্টার, নীলকণ্ঠ, মনোমোহন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর
হাজরা মহাশয় — অহেতুকী ভক্তি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে, ভক্তসঙ্গে মধ্যাহ্নসেবার পর নিজের ঘরে বসিয়া আছেন (৫ই অক্টোবর, ১৮৮৪)। কাছে মেঝেতে মাস্টার, হাজরা, বড় কালী, বাবুরাম, রামলাল, মুখুজ্জেদের হরি প্রভৃতি — কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া আছেন। শ্রীযুক্ত কেশবের মাতাঠাকুরানীর নিমন্ত্রণে গতকল্য তাঁহাদের কলুটোলার বাড়িতে গিয়া ঠাকুর কীর্তনানন্দ করিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — আমি কাল কেশব সেনের এ বাটীতে (নবীন সেনের বাটীতে) বেশ খেলুম — বেশ ভক্তি করে দিলে।
[হাজরা মহাশয় ও তত্ত্বজ্ঞান — হাজরা ও তর্কবুদ্ধি ]
হাজরা মহাশয় অনেকদিন ঠাকুরের কাছে রহিয়াছেন। “আমি জ্ঞানী”; এই বলিয়া তাঁহার একটু অভিমান আছে। লোকজনের কাছে ঠাকুরের একটু নিন্দাও করাও হয়। এদিকে বারান্দাতে নিজের আসনে বসিয়া একমন হইয়া মালা জপও করেন। চৈতন্যদেবকে “হালের অবতার” বলিয়া সামান্য জ্ঞান করেন। বলেন, “ঈশ্বর যে শুদ্ধ ভক্তি দেন, তা নয়; তাঁহার ঐশ্বর্যের অভাব নাই, — তিনি ঐশ্বর্যও দেন। তাঁকে লাভ করলে অষ্টসিদ্ধি প্রভৃতি শক্তিও হয়।” বাড়ির দরুন কিছু দেনা আছে — প্রায় হাজার টাকা। সেগুলির জন্য তিনি ভাবিত আছেন।
বড় কালী অফিসে কর্ম করেন। সামান্য বেতন। ঘরে পরিবার ছেলেপুলে আছে। পরমহংসদেবের উপর খুব ভক্তি; মাঝে মাঝে আফিস কামাই করিয়াও তাঁহাকে দর্শন করিতে আসেন।
বড় কালী (হাজরার প্রতি) — তুমি যে কষ্টিপাথর হয়ে, কে ভালো সোনা, কে মন্দ সোনা, পরখ করে করে বেড়াও — পরের নিন্দা অত করো কেন?
হাজরা — যা বলতে হয়, ওঁর কাছেই বলছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা বটে।
হাজরা তত্ত্বজ্ঞান মানে ব্যাখ্যা করিতেছেন।
হাজরা — তত্ত্বজ্ঞান মানে কি — না চব্বিশ তত্ত্ব আছে, এইটি জানা।
একজন ভক্ত — চব্বিশ তত্ত্ব কি?
হাজরা — পঞ্চভূত, ছয় রিপু, পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচটা কর্মেন্দ্রিয়, এই সব।
মাস্টার (ঠাকুরকে, সহাস্যে ) — ইনি বলছেন, ছয় রিপু চব্বিশ তত্ত্বের ভিতরে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — ওই দেখ না। তত্ত্বজ্ঞানের মানে কি করছে আবার দেখ। তত্ত্বজ্ঞান মানে আত্মজ্ঞান! তৎ মানে পরমাত্মা, ত্বং মানে জীবাত্মা। জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক জ্ঞান হলে তত্ত্বজ্ঞান হয়।
হাজরা কিয়ৎক্ষণ পরে ঘর হইতে বারান্দায় গিয়া বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতিকে) — ও কেবল তর্ক করে। এই একবার বেশ বুঝে গেল — আবার খানিক পরে যেমন তেমনি।
“বড় মাছ জোর করছে দেখে আমি সুতো ছেড়ে দিই। তা নাহলে সুতো ছিঁড়ে ফেলবে, আর যে ধরেছে, সে শুদ্ধ জলে পড়বে। আমি তাই আর কিছু বলি না।
[হাজরা ও মুক্তি ও ষড়ৈশ্বর্য — মলিন ও অহেতুকী ভক্তি ]
(মাস্টারকে) — “হাজরা বলে, ‘ব্রাহ্মণ শরীর না হলে মুক্তি হয় না।’ আমি বললাম, সে কি! ভক্তি দ্বারাই মুক্তি হবে। শবরী ব্যাধের মেয়ে, রুহিদাস যার খাবার সময় ঘন্টা বাজত — এরা সব শূদ্র। এদের ভক্তি দ্বারাই মুক্তি হয়েছে! হাজরা বলে তবু!
“ধ্রুবকে ল্যায়। প্রহ্লাদকে যত ল্যায়, ধ্রুবকে তত না। নটো বললে ‘ধ্রুবের ছেলেবেলা থেকে অত অনুরাগ’ — তখন আবার চুপ করে।
“আমি বলি কামনাশূন্য ভক্তি, অহেতুকী ভক্তি — এর বাড়া আর কিছুই নাই। ও-কথা সে কাটিয়ে দেয়। যারা কিছু চাইবে, তারা এলে, বড়মানুষ ব্যাজার হয় — বিরক্ত হয়ে বলে, ওই আসছেন। এলে পরে একরকম স্বর করে বলে ‘বসুন’! — যেন কত বিরক্ত। যারা কিছু চায়, তাদের এক গাড়িতে নিয়ে যায় না।
“হাজরা বলে, তিনি এ-সব ধনীদের মতো নয়। তাঁর কি ঐশ্বর্যের অভাব যে দিতে কষ্ট হবে?
“হাজরা তখন আরও বলে — ‘আকাশের জল যখন পড়ে তখন গঙ্গা আর সব বড় বড় নদী, বড় বড় পুকুর — এসব বেড়ে যায়; আবার ডোবা টোবাগুলোও পরিপূর্ণ হয়। তাঁর কৃপা হলে জ্ঞান-ভক্তিও দেন, — আবার টাকা-কড়িও দেন।’
“কিন্তু একে মলিন ভক্তি বলে। শুদ্ধাভক্তিতে কোন কামনা থাকবে না। তুমি এখানে কিছু চাও না কিন্তু (আমাকে) দেখতে আর (আমার) কথা শুনতে ভালবাস; — তোমার দিকেও আমার মন পড়ে থাকে — কেমন আছে — কেন আসে না — এই সব ভাবি।
“কিছু চাও না অথচ ভালবাস — এর নাম অহেতুকী ভক্তি। প্রহ্লাদের এটি ছিল; রাজ্য চায় না, ঐশ্বর্য চায় না, কেবল হরিকে চায়।
মাস্টার — হাজরা মহাশয় কেবল ফড়র ফড়র করে বকে। চুপ না করলে কিছু হচ্ছে না।
[হাজরার অহংকার ও লোকনিন্দা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — এক-একবার বেশ কাছে এসে নরম হয়! — কি গ্রহ, আবার তর্ক করে। অহংকার যাওয়া বড় শক্ত। অশ্বত্থগাছ, এই কেটে দিলে আবার তার পর দিন ফেঁ কড়ি বেরিয়েছে। যতক্ষণ তার শিকড় আছে ততক্ষণ আবার হবে।
“আমি হাজরাকে বলি, কারুকে নিন্দা করো না।
“নারায়ণই এই সব রূপ ধরে রয়েছেন। দুষ্ট খারাপ লোককেও পূজা করা যায়।
“দেখ না কুমারীপূজা। একটা হাগে মোতে, নাক দিয়ে কফ পড়ছে এমন মেয়েকে পূজা করা কেন? ভগবতীর একটি রূপ বলে।
“ভক্তের ভিতর তিনি বিশেষরূপে আছেন। ভক্ত ঈশ্বরের বৈঠকখানা।
“নাউ-এর খুব ডোল হলে তানপুরা ভাল হয়, — বেশ বাজে।
(সহাস্য, রামলালের প্রতি) — “হ্যারে রামলাল, হাজরা ওটা কি করে বলেছিস — অন্তস্ বহিস্ যদি হরিস্ (স-কার দিয়ে)? যেমন একজন বলেছিল মাতারং ভাতারং খাতারং অর্থাৎ মা ভাত খাচ্ছে ।” (সকলের হাস্য)
রামলাল (সহাস্যে) — অনতর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) — এইটে তুমি অভ্যাস করো, আমায় মাঝে মাঝে বলবে।
ঠাকুরের ঘরের রেকাবি হারাইয়াছে। রামলাল ও বৃন্দে ঝি রেকাবির কথা বলিতেছেন — ‘সে রেকাবি কি আপনি জানেন?’
শ্রীরামকৃষ্ণ — কই, এখন আর দেখতে পাই না! আগে ছিল বটে — দেখেছিলাম।