৩৫. হারিকেন

ঘরে একটু আগে হারিকেন দিয়ে গেছে। বাইরে এখনো আলো আছে। কিন্তু ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। ওসমান সাহেব বসে আছেন চেয়ারে। দরজার দিকে পিঠি দিয়ে বসেছেন। যেন বাইরের থবীর প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন। অন্ধকারের দিকে। আজ তার র একটি বিশেষ দিন। রানু এসেছে। দুপুর বেলা হঠাৎ দেখলেন একটা ছোট্ট ব্যাগ হাতে নিয়ে সে খানিকটা সঙ্কোচিত ভঙ্গিতে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। মৃদু স্বরে ডাকছে, অপলা অপলা। অথচ তার ডাকা উচিত ছিল টগরকে। সে টগরকে ডাকল না কেন? এর মানে কী এই যে সে টগরের জন্যে আসে নি। যদি তাই হয়ে থাকে তা হলে আজ তার জন্যে একটি বিশেষ দিন। কিন্তু তার আনন্দ হচ্ছে না কেন? বরং কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছে।

তিনি রানুর জন্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন নিজের ঘরে। সে এল না। তিনি নিজেও গেলেন না তার কাছে যেতে। ইচ্ছে করল না।

এখন সন্ধ্যা। বারান্দায় টগরের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। সে তার আনন্দ কিছুতেই সামলাতে পারছে না। রানু কথা বলছে অপলার সঙ্গে। রানুর গলা তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। কিন্তু অপলার কথা শুনা যাচেছ।

তুমি খুব চিন্তা করেছ। আমাদের জন্য তাই না। আপা? পরশু দিন আমরা চলে যেতাম। সব ঠিকঠাক তার পর হঠাৎ টগরের গা গরম হল। পুকুরে খুব ঝাপাঝাপি করেছে তো সেই থেকে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর।

রানু কিছু বলল, তার উত্তরে। তার পর পরই তিনি আপলার হাসির শব্দ শুনলেন। সেই হাসিও চট করে থেমে গেল।

ওসমান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলে কাগজ-কলম সাজানো। একটি পেনসিল পর্যন্ত আছে। হারিকেন জ্বলছে। আধো আলো আধো ছাযা পরিবেশ। দীর্ঘ দিন পর টেবিলটি তাকে চুম্বকোব মত আকর্ষণ করল। কেন জানি মনে হচ্ছে অরণ্যের গল্পটি তিনি এখন লিখতে পারবেন। অরণ্য এগিয়ে আসছে। গ্ৰাস করছে। শহরকে। আতঙ্কগ্রস্ত শহরের মানুষ নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। কাগজ কলম নিয়ে বসার আগে রানুর সঙ্গে দেখা করা উচিত। কিন্তু কেন যেন ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করছে না।

দীর্ঘ দিন পর আবার তিনি লিখতে বসলেন। আগের মত কলম আটকে গেল না। কিন্তু যে গল্প লেখা হচ্ছে তা অরণ্যের গল্প নয়। শহরের গল্প। শহব গ্ৰাস করছে অরণ্যকে। তিনি দ্রুত গতিতে লিখছে

সন্ধ্যার পর থেকে নীলুর কেমন যেন লাগতে লাগল। এক ধবনের অস্বস্তি, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে যে বকম লাগে। সে রকম। সমস্ত শশীবাব বিষম ধবে আছে। মাথার ভেতবটা ফাকা ফাকা।

নীলু। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এ বাড়ির বাবান্দাটা সুন্দাব। কল্যাণপুবের দিকে শহব তেমন বাড়তে শুরু করেনি। গ্রাম গ্রাম একটা ভাব আছে। বারান্দায্য দাঁড়ালে ঝিলের মত খানিকটা জায়গা চোখে পড়ে। গত শীতের আগের শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস নেমেছিল। কী অদ্ভুত দৃশ্য। এ বৎসর নামবে কী না কে জানে। বোধ হয় না। শাহব এগিযে আসছে। পাখিরা শহর পছন্দ কবে না।

অনেক রাতে রানু এসে দাঁড়াল দরজার পাশে। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন বানুকে চিনতে পারছেন না। এ যেন অচেনা কেউ। রানু বলল, কেমন আছে?

ভাল। তুমি ভাল আছ রানু?

হ্যাঁ। কী করছ! লিখছ?

তিনি মাথা নাড়লেন। বানু বলল, লেখা এগুচ্ছে?

হ্যাঁ।

অনেক দিন পর লিখতে বসলে তাই না?

হ্যাঁ, অনেক দিন পর। ভেতরে এসে বস বানু।

সে কয়ক মুহূর্ত ইতস্তত করে ভেতরে এসে দাঁড়াল। বসল খাটে। কেমন কোমল দেখাচ্ছে রানুর মুখ। কেননা দুঃখি দুঃখি চেহারা। তাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন?

মিলির একটি চিঠি আমার কাছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তুমি পড়বে?

হ্যাঁ পড়ব।

রানু চিঠিটা এগিয়ে দিল। চিঠি পড়তে গিযে তিনি লক্ষ্য করলেন তার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তিনি কিছু পড়তে পারলেন না। রানু মৃদু স্বরে বলল, মিলির খবরটা পেয়ে তোমার জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। তোমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল আছে। খুব বড় রকমের মিল। অনেক ভেবেছি বের করতে পারি না। তুমি চিঠিটা আমার কাছে দাও আমি পড়ে শুনাচ্ছি। তুমি পড়তে পারছ না।

রানু চিঠি পড়তে শুরু করল। তিনি তাকিয়ে আছেন রানুর দিকে। চশমার ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে খুব কাছের মানুষও অস্পষ্ট হয়ে যায়।

টগর পা বুলিয়ে খাটে বসে আছে। তার মা চলে এসেছে এটি তার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তার বারবার মনে হচ্ছে তার মা বোধ হয আসেনি। এই যে মা চলে গেল পাশের ঘরে, সত্যি কী গেল? হয়ত সে ঘরে উঁকি দিলে মাকে সে দেখবে না। দেখা যাবে করুণ মুখ করে বাবা বসে আছে।

টগর, খাট থেকে নামল। তাকাল অপলার দিকে। অপলা শীতল গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছে?

ঐ ঘরে।

ঐ ঘরে এখন যে ও না।

কেন যাব না?

একটু পরে যাও। আসি আমরা দু’জন গল্প করি।

শিশুরা অনেক জিনিস চট করে বুঝে ফেলে। টগরও হয়তবা কিছু বুঝল। আবার উঠে বসল খাটে। পা দুলাতে দুলাতে ভয়ে ভয়ে বলল, মা কী এখন থেকে বাবার সঙ্গে থাকবে? অপলা গাঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ থাকবে।

টগর ছোট্ট করে হাসল। ছেলেমানুষি হাসি। দেখতে এত ভাল লাগে।

খালামণি।

বল।

সত্যি থাকবে?

হ্যাঁ থাকবে।

তুমি কী করে জান?

আমি জানি।

টগর, আর কিছু বলল না। পা দুলাতে লাগল। তার মনে হল খালামনি কাঁদছে। খালামণি এখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু টগর বুঝতে পারছে।

তুমি কাঁদছ কেন খালামণি?

কাঁদছি না তো।

কিন্তু খালামণি কাঁদছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বড়দের কত অদ্ভুত দুঃখ-কষ্ট থাকে। টগরের নিজেরও খুব কান্না পেয়ে গেল। কিন্তু ছেলেদের কাঁদতে নেই। সে প্রাণপণে নিজের কান্না সামলাবার চেষ্টা করতে লাগল। অপলা ধরা গলায় বলল, টগর তুমি শান্ত হয়ে বসে থাকবে এখানে, বাবার ঘরে যাবে না। কেমন?

আচ্ছা।

আমি একটু নিচে যাব। একা একা হাঁটব।

কেন?

অপলা চোখ মুছে শান্ত গলায় বলল, বড়দের মাঝে মাঝে একা একা থাকতে ইচ্ছে করে।

রাত অনেক হয়েছে। ওসমান সাহেব মাথা নিচু করে লিখে যাচ্ছেন। টগর ঘুমিয়ে পড়েছে। রানু রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কী অপূর্ব জোছনার রাত উঠোনে একা একা দাঁড়িয়ে আছে অপলা। কী দেখছে সে? রানু একবার ভাবল নিচে নেমে যাবে, অপলার হাত ধরে বলবে, কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? কিন্তু সে তা করল না। তাকিয়ে রইল মাঠের দিকে। রানু ডাকল, অপলা! অপলা ফিরে তাকাল। চাঁদের আলোয় ভেজা কী সুন্দর একটি মুখ। তাকে ঘিরে জোছনা কেমন থর থর করে কাঁপছে। অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে রানুর। সে আবার ডাকল, অপলা, অপলা!

1 Comment
Collapse Comments

Osadharon.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *