৩৫
স্কুল ছুটি ছিল এই ক’দিন। মাসিমার ব্যাপারটা মেটাতে নানা ঝামেলা গেছে। তা ছাড়া ওই বিষাক্ত গন্ধ কিছুতেই যেন যেতে চাইছিল না। মাসিমার মৃত্যু থানা-পুলিস পর্যন্ত গড়াল। স্বাভাবিক মৃত্যু কিন্তু ঘটনাচক্রে কী অস্বাভাবিক হয়ে গেল!
আজ স্কুল খুলবে। আজই বিকেলে জিনিকে নিয়ে ফিরে আসবে দেবাশিস। চা খেতে খেতে সে-কথাই তুললেন বিকাশ। মেয়েটা মাত্র ক’দিন হল এসেছে অথচ এরই মধ্যে সে না থাকাতে কেমন ফাঁকা লাগছে বাড়িটা! তিনি বলছেন—ওদের তো আজ ফেরার কথা।
লক্ষ্মী চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। বলছেন—দেখো, আবার কী হয়!
—কী হবে?
—কী করে বলব! যা সব হচ্ছে! যাই বলো, মেয়েটার কিন্তু পয় নেই।
বিকাশ চমকে উঠছেন। ভ্রূ কুঁচকে বলছেন—তার মানে?
—মেয়েটার পয় নেই। বাড়িতে পা দিতে না-দিতে কী কাণ্ডই হল! মাগো, রাত্রে ঘুমোতে পারছি না।
—এখানে ওর দোষ কোথায়? কোথায় পাড়ার কোন বাড়িতে কে মরে পড়ে থাকবে তার দায় ওকে নিতে হবে কেন? তোমার কি বুদ্ধি-সুদ্ধি গুলিয়ে গেল?
লক্ষ্মী চোখ পাকাচ্ছেন। সে-চোখে কী যেন একটা ঘনিয়ে আসছে। বিক্ষুব্ধ ঝড়। গভীরভাবে নিরিখ করলে উন্মাদ রাগের মতোই লাগে বটে। কিন্তু শুধুমাত্র রাগও নয়। ঈর্ষা নাকি? ঘৃণা? ঠাহর করা সম্ভব হয় না সবসময়। ক্রোধী চোখে বিকাশকে বিদ্ধ করছেন তিনি। বলছেন—বাবা! খুব দরদ দেখছি! ক’দিন হল ও এসেছে?
—যে ক’দিনই হোক, এসেছে তো আমাদের হয়েই। ও তো এ বাড়িরই একজন এখন।
—তুমি জানো, কটা চোখের মেয়েরা কখনও শুভ হয় না?
—কী যা-তা বকচ্ছ! ইউরোপ-আমেরিকায় ক’জন মেয়ের চোখ কালো বলো তো? ওদের জন্য কি পৃথিবী রসাতলে যাচ্ছে?
—সে ওদের একরকম, আমাদের একরকম। কটা চোখের মেয়ে কোনও দিক থেকেই ভাল নয়।
—তা সম্বন্ধ করার সময় তো তুমি ওকে দেখতে গিয়েছিলে। তখন তোমার এ সব মনে হয়নি?
বিকাশ আধকাপ চা এক চুমুকে শেষ করলেন। উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। বললেন—ও আমাদের মেয়ের মতো। ওর নামে জোর করে নিজের সংসারে কু-সংস্কার টেনে এনো না।
লাফিয়ে উঠলেন লক্ষ্মী। তাঁর শরীরের ধাক্কায় টেবিল কেঁপে উঠল৷ কাপে-প্লেটে ঠনঠন শব্দ হল। তিনি বললেন—কী বললে তুমি? কী বললে? আমি কু-সংস্কার টেনে আনছি? আমি কু-সংস্কারগ্রস্ত? আমার মতো আধুনিক শাশুড়ি ও আর কোথাও পাবে? ন্যাকা! দেমাকি! আরে ওর মতো ওরকম বাংলায় এম এ কলকাতা শহরে পথে-ঘাটে গড়াগড়ি যায়।
বিকাশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাঁর বশ্যতা বিদ্রোহ করে। তিনি বলেন—এ সব প্রসঙ্গ কেন আসছে? লক্ষ্মী, আমি দেখেছি, ওর ব্যাপারে তোমার আচরণ অসংলগ্ন হয়ে যায়। একটি মেয়ে ঘরে এল কি এল না সে শুভ না অশুভ, পয় কি অপয়, সে এলে ভাল ঘটনা ঘটছে না খারাপ ঘটনা এ সব বিচার শুরু করলে! কোনও মানে হয়? তুমি যখন বউ হয়ে এসেছিলে তখন যদি এ রকম বিচার হত? তুমি ভাল না মন্দ—তুমি শুভ না অশুভ—তোমার কেমন লাগত? তুমি একটা স্কুলে পড়াও লক্ষ্মী…
—কী! কী বললে তুমি! কী বললে!
লক্ষ্মী জ্বলে উঠলেন। দরজা দিয়ে জানালা দিয়ে উত্তুরে বাতাসের মতো কলহ ঢুকে পড়ল। এতদিন লক্ষ্মী নানা বিষয়ে বিকাশকে দায়ী করেছেন আর বিকাশ নীরবে, নির্বিবাদে সেইসব সহ্য করে এসেছেন। লক্ষ্মীর দু’খানি সিজার করা বাচ্চার আগমনের জন্য দায়ী হয়েছেন বিকাশ। মাথুরের গড় ছেড়ে বালিগঞ্জ বা সল্ট লেকে বাড়ি করা হল না তারও দায়ভাগী বিকাশ। দেবার্চনের ওই পরিণতিও বিকাশের জন্যই। বিকাশের জন্যই লক্ষ্মী শারীরিকভাবে ক্ষুধার্ত রইলেন দীর্ঘকাল, চরম আস্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখলেন। এ সব শুনতে শুনতেই বিকাশ জানলেন—তাঁর এই কেরানিজীবন থেকে বেরুবার প্রচেষ্টাও আসলে তাঁরই অক্ষমতার দায় কারণ লক্ষ্মী না থাকলে সেটুকুও তিনি করতেন না। বিকাশ শান্তি বজায় রাখতেই লক্ষ্মীকে মেনে এসেছেন চিরকাল। কিন্তু শান্তি পেয়েছেন কি? সে-খবর আর নেওয়া হয়নি। সংঘর্ষ এড়াবার জন্য অত্যন্ত নমিতভাবে তিনি তাঁর ইচ্ছাগুলি পেশ করে এসেছেন বরাবর। কিন্তু তাতেও সে-সব গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেনি। লক্ষ্মীকে যত মেনেছেন বিকাশ লক্ষ্মী তত বেশি অভিযোগ করেছেন। লক্ষ্মীকে যত সুখী করার চেষ্টা করেছেন লক্ষ্মী তত বেশি অসুখী হয়ে উঠেছেন কারণ অপরের এতটুকু উন্নতি—বিশেষত তা যদি হয় বিকাশের পদমর্যাদার চেয়ে বেশি কিছু—তবে অভিযোগে উত্তাল হয়েছেন তিনি। যেন এই পৃথিবীতে বিকাশেরই হওয়া উচিত ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাবান, সবচেয়ে সম্মানীয়, সবচেয়ে ধনী ও ব্যক্তিত্ববান। কিন্তু তিনি কিছুই হতে পারেননি, অকর্মণ্য বিকাশ হয়েই তিনি ছিলেন আর অভিযোগ শুনতে শুনতে বিকাশের মনে হয়েছিল—হবেও-বা। তিনিই এ সব কিছুর জন্য দায়ী। যদি দায়ী না হন, তাহলেও, স্ত্রীর অভিযোগ তাঁকে শুনতে হবে। শুনতেই হবে। এরই নাম দাম্পত্য। এই কলহ। এই অভিযোগ। স্ত্রীর স্বপ্নের সঙ্গে সমানতালে দৌড়তে না পারার অক্ষমতায় এই দায়ী হয়ে থাকা। কিন্তু এর সবটাই তাঁর নিজের বিষয়। নিজের দায়। কিন্তু লক্ষ্মী যখন আরও অনেককে দায়ী করতে চাইছেন, অকারণে, বিশ্বের কোনওখানে ঘটে যাওয়া কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য সহজ সরল বধূটির ওপর দায় চাপাচ্ছেন তখন বিকাশের প্রতিবাদ আসছে। শান্ত, নিরুত্তেজ প্রতিবাদ। কিন্তু লক্ষ্মী জ্বলছেন। প্রলাপের মতো তীক্ষ্ণ ও অবিশ্রাম বেরিয়ে আসছে তাঁর মুখ থেকে—ও! এত দরদ! আমি এ সংসারে পর হয়ে গেছি। দু’টো কথা বলেছি কি বলিনি এত বড় অপবাদ দিয়ে দিলে আমাকে! বুড়ি হয়ে যাচ্ছি তো, বয়স হচ্ছে তো আমার। আমাকে ভাল লাগবে কেন এখন?
মানুষ কখন যে নীচে নেমে যেতে থাকবে আর পৌঁছে যাবে কর্দমাক্ত পিচ্ছিলে তা কেউ বলতে পারে না। কোনও মানুষ নিজেও জানে না কখন স্খলন হয় আর ঢুকে পড়ে অশ্রদ্ধার উপকরণ— সমস্ত ভালবাসা ও বিশ্বাস কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি তখন। যা ভাল তা ভালবাসা কঠিন নয়। কিন্তু ভালর ধারণার সঙ্গে যখন অমিল ঘটে কিংবা চরম বিরোধ তৈরি হয় তখনই নিজস্ব ভালবাসার পরমায়ু ফুরোতে চায়। সে এক কঠিন সময়।
বিকাশ লক্ষ্মীকে ভালবাসেন কি না সে হিসেব দীর্ঘদিন করা হয়নি। কিন্তু পুত্রবধূ প্রসঙ্গে লক্ষ্মীর এই আত্মপতন বিকাশের অভিপ্রেত ছিল না।
লক্ষ্মী কাঁদছেন। বিকাশ চলে যাচ্ছেন বাইরে। তাঁর গাছগুলিকে অনেকদিন দেখাশুনো করা হয়নি। আজ পাড়াটা একবার চক্কর মারবেন। মনটা তেতো হয়ে গেছে। তিনি সাধারণত লক্ষ্মীর কথার জবাব দেন না বলে কলহ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। আজ আর এড়ানো গেল না। অন্ধর মা বাসন মাজছিল। সেও সব শুনেছে। বিকাশের মনে অশান্তি হতে লাগল। কিন্তু তিনি এর পরও ভাবলেন, ওটুকু না বললে আরও অশান্তি হত তাঁর! ছোটখোকা যদি থাকত আজ, যদি তার সামনে এ সব কথা হত, সে কি সহ্য করতে পারত? সেও প্রতিবাদ করত! নিশ্চয়ই করত! বিকাশ এগোলেন। মিথিলেশবাবুর সেতারের শব্দ ছড়িয়ে গিয়েছে রাস্তায়। পথ-ঘাট শিশিরে ভেজা। বিকাশ চাদর জড়িয়ে দু’পাশ দেখতে দেখতে চলেছেন। মল্লিনাথের বাড়ির কাছে এসে আরও মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর। বাড়িটায় যেন প্রতিদিন অন্ধকার জমছে। চুন-বালি খসিয়ে ফেলে শুধু দুঃখ আর বিষণ্ণতার দেওয়াল। মাত্র ক’দিনেই পরিবারটা শেষ হয়ে গেল! একজন অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। মাত্র ক’দিনেই কীরকম বেভুল হয়ে গেলেন! এই ভাঙন নিশ্চয়ই অনেকদিন আগে শুরু হয়েছিল। তলায় তলায়। গভীর প্রক্রিয়ায়। যাঁরা ভাঙছেন, তাঁরাই টের পাননি। হঠাৎ এমনভাবে সব ধসে পড়ল যে সর্বনাশ আর ঠেকানো গেল না।
মল্লিনাথের বাড়ি ছাড়িয়ে আরও একটু এগোতে দুটি মানুষ চোখে পড়ল বিকাশের। ধীরে ধীরে তাঁরা এগোচ্ছেন। একজন আনিসুজ্জামান। একজন তৃণাঙ্কুর। আনিসুজ্জামান তৃণাঙ্কুরকে হাঁটতে সাহায্য করছেন। তৃণাঙ্কুর টলে টলে পা ফেলছেন। ছোট ছোট পদক্ষেপ। অনেকটা যেন শিশুকে হাঁটতে শেখানো অভ্যেস করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন কলেজ যাননি তৃণাঙ্কুর। ইদানীং সত্য এসে গাড়ি করে তাঁকে কলেজে পৌঁছে দিচ্ছে আবার নিয়েও আসছে। আনিসুজ্জামান এই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সত্যর ব্যবসা হচ্ছে। তার বোন এসে পড়া দেখিয়ে নিচ্ছে তৃণাঙ্কুরের কাছে। বিকাশ দেখছেন।
নীলিমার ফ্ল্যাট থেকে সেতারের শব্দ আসছে। নীলোফা নিজের ঘরে বসে সেতার বাজাচ্ছে। নীলিমা নিজের ব্যালকনিতে গাছের পরিচর্যা করছেন। নীলোফার বাগান থেকে সেই লতাটি ব্যালকনির গরাদ ছেড়ে লাফিয়ে পড়ছে শূন্যে যেটি একদিন সে সংগ্রহ করে এনেছিল কোনও বাড়ি থেকে আর বনসাই করার ইচ্ছে জানিয়েছিল বিকাশের কাছে। বিকাশ ধমকে দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে কেমন দিন পেরিয়ে যায়। এই যে তৃণাঙ্কুর, এরও জীবন কীরকম অদ্ভুতভাবে গড়ে উঠল আবার উঠলও না। তৃণাঙ্কুরের বাবা সমরেশ ছিলেন অদ্ভুত মানুষ। অসম্ভব জ্ঞানী, অথচ জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো ভুল একটা লোক। বিকাশ দেখেছেন, অনেক কষ্ট করেছেন নীলিমা। সেই সময় চাকরি-বাকরি করেছেন। আজ থেকে কতদিন আগে। তখন ঘরের বউয়ের চাকরি করতে যাওয়া এ পাড়ায় ভাবতেই পারত না কেউ। নীলিমা ঘর সামলেছেন, ছেলে মানুষ করেছেন, ওই রকম অকর্মণ্য স্বামীকে সামলেছেন কিন্তু এ পাড়ার কেউ কখনও নীলিমাকে গলা চড়িয়ে ঝগড়া করতে শোনেননি। তাঁর কাজে কোথাও ফাঁকি ছিল না। কিংবা, ছিল হয়তো, ওই মানুষ করার মধ্যে কোনও ভুল ছিল হয়তো, যার জন্য তৃণাঙ্কুরের বিবাহ ভেঙে গেল, শোনা গেল তার স্ত্রী তাঁকে স্লো পয়জন করেছে, যা বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়, কিন্তু এটা ঠিক যে তৃণাঙ্কুর এখন চলতে-ফিরতে পারছেন না ঠিকঠাক। কেনই-বা তৃণাঙ্কুরের স্ত্রী তাঁকে ভালবাসতে পারল না, এর কিছুটা দায় নিশ্চয়ই নীলিমার ওপর বর্তায়। যেভাবে দেবার্চনের নকশাল হয়ে যাওয়া ও মৃত্যুর দায় বর্তায় বিকাশের ওপর। আর বিকাশের শিক্ষিতা শিক্ষয়িত্রী স্ত্রী বিশ্বসংসারের নানা ঘটনার জন্য দায়ী করতে থাকেন অন্যদের যাদের সঙ্গে ওই ঘটনার সরাসরি বা পরোক্ষ যোগাযোগও নেই। তবু বিকাশ গাছের দায়িত্ব নেন। নিজের কর্মক্ষেত্রে খুব সাফল্যের সঙ্গে পা ফেলেন এবং এক পদোন্নতি থেকে লাফিয়ে যেতে থাকেন অন্য পদোন্নতির দিকে। প্রথমে ছিলেন নীচের সারির কেরানি। লক্ষ্মীর বুকে তখন অনেক প্রেম ছিল। সেই প্রেম দিয়ে বিকাশকে প্রেরণা দিয়েছিলেন লোয়ার থেকে আপার ডিভিশনে পৌঁছনোর জন্য। বিকাশ পৌঁছলেন। লক্ষ্মীর তখন প্রেম শুকিয়ে আসছে। দাবি বাড়ছে। দাবি মেটাতে বিকাশ লাফ দিলেন। অফিসার হলেন। লক্ষ্মীর এক বোনের জামাই গেজেটেড অফিসার। প্রত্যয়িত নকল কাগজে সই করার বিশাল ক্ষমতা ছিল তাঁর। লক্ষ্মী কেঁদে পড়লেন—তুমি কবে হবে? ক—বে হ—বে গো-ও-ও। হলেন বিকাশ। সরকারি চাকরিতে স্বাভাবিক পদোন্নতি হয়। অস্বাভাবিকও হয়। বিকাশের অস্বাভাবিক পদোন্নতি হতে লাগল। বিকাশ নকলে সই করার ক্ষমতাধারী হলেন। পাড়ার ছেলেরা-মেয়েরা, বুড়োরা-বুড়িরা নানা নকলে সই দেবার জন্য বিকাশের কাছে আসতে লাগল। পরীক্ষার নম্বরের কাগজ, ব্যাঙ্কের কাগজ, লাইব্রেরির সদস্যপত্রের আবেদনপত্র—হাজারও ধরন। তারা ডিং ডিং করে বেল বাজালে, লক্ষ্মী ব্যাজার মুখে দরজা খোলেন, বলেন—ওর এখন সময় নেই, রেখে যান। বলেন—সব সময় কি পারা যায়? যারা আসে, শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে, মাটির দিকে চোখ। লক্ষ্মী দয়া করেন। আঃ—লক্ষ্মী অনুভব করেন—দয়া দেখাতে কী আরাম! লক্ষ্মী দয়াবতী হয়ে যান এবং ক্ষমতা উপভোগ করেন। ‘আমার স্বামী’ বলার সময় তাঁকে অনেকটা লক্কা পায়রার পাশে উদ্ধত গ্রীবা তোলা দেশি পায়রানির মতো লাগে। এবং গর্বের সঙ্গে, দয়ার সঙ্গে দাবি উত্থিত হয়। এমন কোনও শাড়ি কেউ পরতে পারবে না যা লক্ষ্মীর নেই। এমন কোনও নকশা থাকবে না পৃথিবীতে, যা দিয়ে লক্ষ্মীর গয়না তৈরি হবে না। বিকাশ ক্লান্ত হয়ে যান এবং টেবিলে মাথা রাখেন। মৎস্যজীবী বড় বড় মৎস্য ব্যবসায়ীরা টোপ ফেলেন বিকাশের সামনে। টোপের দিকে তাকিয়ে থাকেন বিকাশ আর ঢোঁক গেলেন। এক এক সময় ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলেন। খেলেই ফ্ল্যাট। খেলেই গাড়ি। খেলেই হাতের মুঠোয় সল্টলেক আর বালিগঞ্জ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেন না। শেষ পর্যন্ত জীবিত দেবার্চন কাছে এসে দাঁড়ায়। কোমল প্রশ্ন করে, বাবা, ওইখানটা জানো, ওই জায়গাটা? কথামৃতের নরেন সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত ভর্তি প্রার্থনা নিয়ে দেবীর কাছে এসে দাঁড়াচ্ছেন দরিদ্র বিপন্ন অথচ শক্তিমান মানুষ। কিন্তু চাইতে ভুলে যাচ্ছেন। বিকাশের ক্লান্তি আসে এক এক সময়। কত অজস্র অর্থহীন চাওয়া দিয়ে বেঁধে রেখেছেন এই জীবনকে। কত অপমান অভিযোগ, কত দুঃখ-মৃত্যু তবু চাওয়া ফুরোয় না। চাওয়ার জন্যই, চেয়ে চেয়ে কাঙাল হওয়ার জন্যই যেন বেঁচে থাকে মানুষ আর সারা জীবনে কী কী পেল না তার হিসেব করতে করতে মরে যায়। যা পেল তাঁকে সরিয়ে রাখে। অবহেলা করে। না পাওয়া বস্তুর প্রতিই মানুষের সীমাহীন চিরকালীন লোভ আর প্রাপ্ত জিনিসে অপরিমিত অবহেলা। যদি এমন হত, সব না-পাওয়া পূর্ণ হত, তাহলেও সমস্যার সমাধান হত না। হয়তো তখন সব পাওয়াই একটা মস্ত না-পাওয়া হয়ে দেখা দিত।
বিকাশ চলেছেন। গাছ দেখছেন। শীতে গাছের বৃদ্ধি কম। পথের দু’পাশে যে গাছগুলি লাগিয়েছেন তারা সব বৃক্ষ হয়ে উঠবে একদিন। বিকাশ জানেন না এই বৃক্ষ হয়ে ওঠা তিনি দেখে যেতে পারবেন কি না। প্রত্যেকটি গাছ লাগানো হলেই তা মনে মনে ছোটছেলেকে উৎসর্গ করেন তিনি। গাছ ভালবাসত দেবার্চন। তার ধারণা ছিল গাছের থেকে দূরে চলে গিয়েছে বলেই মানুষ এত স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। এখন বিকাশ গাছ ভালবাসেন। গভীর করে ভালবাসেন। ছেলের ভালবাসায় প্রাণ মিশিয়ে দিয়ে তিনি, এক সাধারণ সংসারী মানুষ, ক্রমশ বৃক্ষপ্রেমী হয়ে উঠছেন, ক্রমশ গাছ পরিবারের একজন হয়ে উঠছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন কারও বেড়া খসে গেল কি না, কারওকে গোরুতে মুড়িয়ে খেল কি না, কেউ বুঝি একটু শীর্ণ হয়ে উঠল। নীলিমার বাড়ির উল্টোদিকে দত্তরায়দের বাড়ির সামনে একটি জারুলের চারা লাগিয়েছেন বিকাশ। এ গাছ খুব দ্রুত বাড়ে। গেল বর্ষায় লাগিয়েছিলেন, এরই মধ্যে প্রায় চার ফুট হয়ে গিয়েছে। এখনও ওর বেড়া প্রয়োজন হয়। আরও ফুট তিনেক না হলে বেড়া তোলা যাবে না। এই বর্ষা আসার আগেই বা বর্ষার মধ্যেই হয়তো তিন ফুট আরও পেয়ে যাবে গাছটা। হয়তো সামান্য ফুলও দেবে। বেগুনি রং, নরম পাপড়ি। বৃষ্টিতে ভিজে থাকবে ফুলগুলি। বিকাশ হাত ছোঁয়ালেন গাছটায়। বেড়া থেকে দু’-একটা বাঁশ খসে গেছে। অন্য বাঁশগুলো টেনে টেনে ফাঁক ভরে দিলেন। তাঁর হঠাৎ মনে হল, গাছটা, তাঁর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আর চোখ পিট পিট করছে। তিনি মনে মনে বলতে থাকলেন—‘ফুল দেবে তুমি? এই বর্ষায়? দেবে?’
‘আমাকে তুমি কী দিয়েছ?’—চমকে উঠলেন বিকাশ। হাত ছিটকে বেড়ায় লাগল আর বাঁশের খোঁচ ফুটে গেল আঙুলে। বিকাশ তাকালেন। ‘আমাকে তুমি কী দিয়েছ? সারা জীবন শুধু জ্বালিয়েছ। সংসারের জোয়াল গলায় ঝুলিয়ে গলায় রক্ত তুলে খেটে মরছি আমি, আর তুমি?’ দত্তরায়ের স্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন। এই সাতসকালে। যখন মানুষের ঘুম কাটেনি ঠিকমতো, শরীরের আড় ভাঙেনি তখনই কী সব সাংঘাতিক প্রশ্ন ঘরে ঘরে রচিত হচ্ছে। আমাকে তুমি কী দিয়েছ? লক্ষ্মী বলেন বিকাশকে। দত্তরায়ের গিন্নি বলেন দত্তরায়কে। সারা জীবন জ্বালিয়েছ—বলেন লক্ষ্মী। দত্তরায়ের গিন্নিও বলেন। বিকাশের মনে হয় সারা পৃথিবীর সমস্ত মধ্যবয়সী গিন্নির ভাষা এক, উচ্চারণ এক, উপলব্ধি এক—‘আমাকে কী দিয়েছ? আমাকে জ্বালিয়েছ সারা জীবন…।’ যদি প্রশ্ন করা হয়—‘তুমি জ্বলেছ কেন? জ্বলা ছাড়া অন্য উপায় কি ছিল না তোমার?’
নীলিমার গলা ভেসে এল ওপর থেকে—‘এবার কিছু পাম লাগাও।’ বিকাশ ওপর দিকে তাকালেন। দেখছেন। নিজের প্রশ্নের জবাব যেন পেয়ে যাচ্ছেন নিজেই। সে-জবাব ওই নীলিমার উপস্থিতি। জ্বলা ছাড়াও অন্য উপায় আছে, তা হল নিজের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। সেটুকু করেছিলেন বলেই নীলিমা আজও, এত কিছুর পরও, পঙ্গু হতে থাকা ছেলেকে হাঁটতে পাঠানোর পরও গাছের যত্ন নিচ্ছেন ব্যালকনিতে। এখন বিকাশকে পরামর্শ দিচ্ছেন—‘পাম লাগাও।’ বিকাশের মন ভাল হয়ে যাচ্ছে। সকালবেলায় লক্ষ্মীর অসংলগ্ন আচরণের রেশ আর লাগছে না মনে। নীলিমার সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলার লোভ হচ্ছে তাঁর। বলছেন—চা খাওয়াবেন নাকি বউদি?
—হ্যাঁ, কেন খাওয়াব না? তুমি অনি আর মান্তুকেও ডাকো বরং। আমি জল চাপাই।
বিকাশ এগিয়ে যান আনিসুজ্জামান ও তৃণাঙ্কুরের দিকে। দু’জনে ধীরে ধীরে হাঁটছেন। মগ্ন হয়ে আছেন কথা বলায়। তৃণাঙ্কুর একবার পাথরে হোঁচট খেলেন। আনিসুজ্জামান ধরে ফেললেন তাঁকে। কিন্তু কথা চলতে লাগল। বিকাশ শুনলেন আনিসুজ্জামান তাঁর দুর্গা বিষয়ে গবেষণার কথা নিয়ে মগ্ন আছেন। বলছেন—…হ্যাঁ। পোড়ামাটির কাজে আমি যে-সব দুর্গা পেয়েছি তাতে বৈচিত্র্য আছে। আবার পটচিত্রেও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দুর্গামুদ্রা। আমার মনে হয়েছে, যে-কোনও ব্যক্তি, যাঁর শৈল্পিক বোধ প্রবল, তিনি দুর্গার প্রতিষ্ঠিত রূপ ভেঙে নতুন মাত্রা দিতে চেয়েছেন বারবার। হয়তো কবিগানে তাঁর বর্ণনা করেছেন। হয়তো তুলিতে তাঁকে এঁকেছেন। তাঁর শিল্পের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে কোনও জনপদ এবং ক্রমে যুগে যুগে ওই অঞ্চলে দুর্গার ওই রূপই প্রচলিত থেকেছে। এর তো কোনও লিখিত ইতিহাস নেই। এগুলোকে আনুমানিক ব্যাখ্যা বলা যেতে পারে মাত্র। ধরা যাক স্বপ্নাদেশের কথা। স্বপ্নে আদেশ পেয়ে যাঁরা মূর্তির গড়ন বদলেছেন তাঁরাও কি আসলে তাঁদের শৈল্পিক মানসকল্পনাকেই রূপ দেননি?
বিকাশ ডাকতে যাবেন—তক্ষুনি তারও একবার ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবার মতো হলেন তৃণাঙ্কুর। আনিসুজ্জামান কথা থামিয়ে তৃণাঙ্কুরকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই ধরার মধ্যে এমনই মায়া এক জনের এবং অন্য জনের এমনই নির্ভরতা, বিকাশের মনে হল—কে বলবে ওরা ভাই নয়!
৩৬
বড্ড ধাতব। ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে বলল পাখিটা। আসলে বেলা পড়ে আসছিল আর উড়তে উড়তে তার ডানা দু’খানি ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। সে এসে বসে পড়েছিল চলমান মালগাড়ির ছাদে। ফটিক বিলের পাশ দিয়ে এগোচ্ছিল গাড়িটা আর যাচ্ছিল এত ধীর গতিতে যে-পাখিটা ঠাহরই করতে পারেনি ওটা চলমান। বুঝল যখন, একটুখানি ডানা খুলে টাল সামলাল। তারপর ঠুকরে দেখল। হতে পারে সে ঠোঁটে লেগে থাকা খাবারের কণা মুছতে চেয়েছিল কিংবা যাতে বসে আছে সেই চলমান বস্তুটি কী পরখ করতে চেয়েছিল। চলমান অনেক কিছুর ওপর বসার অভিজ্ঞতা তার আছে। গরু মোষ ছাগল শুয়োর সবার ওপরই সে সুযোগ পেলে বসে পড়ে এবং ঠুকরে ওদের গায়ের এঁটুলি তুলে দেয়। গোরুগুলি আরামে গলা নামিয়ে দেয়। মোষ—কী অসম্ভব ভাল লাগছে—ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকায়। শুয়োর কান নাড়ে। শুধু ছাগলের কোনও অভিব্যক্তি নেই। পাখি ঠোকরালে একটু ব্যথা লাগে আর সে উদাস হয়ে যায়। অদ্ভুত নির্বোধ চোখে চায় যেন এই পৃথিবীর কোনও আঘাতের কার্যকারণ জানতে তার আগ্রহ নেই, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযাগ তার নেই। পাখি তাকে ঠুকরে দিয়ে বলে—‘বুদ্ধু’, আর চিক শব্দ করে উড়ে যায়। এখন সে এই রেলগাড়িটাকে ঠোকরাচ্ছে আর বলছে বড্ড ধাতব আগাগোড়ো। তার ঠোঁটে বেশ লেগেছে। ফটিকবিল পেরিয়ে যাবার আগেই উড়ান দিল পাখি, আর বসল বিলের ধারে ঝাঁকড়া ছাতিম গাছটায়, যেখানে তার বাসা। ওই গাছটার নীচেই দাঁড়িয়ে আছে অন্ধ, সে টের পাচ্ছে সন্ধে নামছে, পাখিরা ফিরে আসছে বাসায়। বিলের জলে যত মাছ শেষবারের মতো হুস করে ভেসে উঠেই ডুব মারল। যেন আকাশটা দেখে নিচ্ছে। ট্রেন যাবার শব্দ পাচ্ছে অন্ধ। ঘটঘটাং ড্যাং চোঁও…কিচ চিক কিচ চিক খস্—বড্ড ধাতব। আগাগোড়া আশ্চর্য ধাতব। একটা বড় শ্বাস ফেলল সে, এখন আর কাজ নেই। এখন বাড়ির দিকে ফেরা। সারা দিনে কাজেই বা তার কী? শুধু ঘুরে বেড়ানো, এর ওর বাড়ি কান পাতা, শব্দ শুনে গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করা কে কেমন আছে। কে কী করছে। চোখ নেই বলে সে কিছুই করতে পারে না। শুধু দৃষ্টির অন্য পার থেকে সমস্ত পৃথিবীকে শুষে নিতে চায়। কিন্তু মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, বিশেষ করে যখন এরকম সন্ধে আসে। ফটিক বিল থেকে সমস্ত শীত গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাড় কাঁপিয়ে দেয় আর সে দ্রুত পা চালায়, তাড়াতাড়ি গায়ে চাদর জড়াবে বলে, তখন তার এই অন্ধ বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায়। সন্ধ্যার পরে যে অনিবার্য অন্ধকার নেমে আসে, তার কেবলই মনে হয় তার নিজের বেঁচে থাকার মধ্যেও ওই রকম অন্ধকার গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। যদিও মাস্টার বলে—এ দেশের মানুষ অন্ধের চেয়েও অনেক বেশি অন্ধ। রাত্রির অন্ধকারের চেয়েও গাঢ়তর অন্ধকার তাদের জীবনে ছেয়ে আছে। কিন্তু যখন মাইক বাজে—রূপ তেরা মাস্তানা—গান ভরে যায় আকাশে, দলে দলে ম্যাটাডোর ভর্তি করে কত লোক যায় পিকনিক করতে, তখন অন্ধর মাস্টারের কথা বিশ্বাস হয় না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে মাস্টারের সব কথা বিশ্বাস করত, এখনও করতে চায় কিন্তু কোথায় একটা ফাটল ধরেছে তার নিজেরই মধ্যে, যা টপকানোর সাধ্য নেই তার। কিছুদিন আগেকার সব ভাল লাগা পাল্টে যাচ্ছে। সব বিশ্বাসে নতুন করে মোচড় লাগছে। অনেক নতুন প্রশ্ন ও বোধ জেগে উঠছে নিজের মধ্যে। তার শৈশবের বন্ধু হীরু সে-দিন থেকে কাজে লেগে গেল। তার বাবার সঙ্গে জুতো সারাইয়ের কাজে বসবে সে। চামড়া কাটবে, সেলাই দেবে, পেরেকও ঠুকে দেবে কোনও কোনও জুতোয়। মাখনের বাবা মাখনকে একটা বাল্ব তৈরির কারখানায় দিয়ে দিয়েছে। বড় বাল্ব নয়। মাখন বলছিল ওগুলো হচ্ছে টুনি বাল্ব। উৎসব-টুৎসব হলে যে আলোর সাজ লাগানো হয় তার কাজে লাগে। অন্ধর চারপাশে সবাই কাজে লেগে যাচ্ছে, একমাত্র তারই কিছু করার নেই। তার এতদিনের চেনা দুনিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ছে অচেনা বোধ। এতদিন টেপির সঙ্গে সে মাগ-ভাতার খেলত, ইদানীং টেপি ডাকলে সে আর যায় না। তার ভয় করে। টেপির বুকটা কীরকম গুটি পাকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, অন্ধর হাতটা নিয়ে সে চেপে ধরে ওই জায়গায়। আগে অন্ধ ভাবত এটা খেলা। সে খেলত। যেমন মেয়েরা খেলে। রান্নাবাটি খেলে। নারকোলের মালায় পাতার কুঁচি নিয়ে মাকে নকল করে বলে, আজ সীমচচ্চড়ি আর ভাত— তেমনই মাগ-ভাতারে কী হয়, আড়ালে অন্ধকারে তারা কী করে, আদ্যপ্রান্ত জেনেও সে শুধুই খেলত। নকল করার খেলা। আগুন বিহীন উনুনে নকল রান্নার মতো শরীর বিহীন শরীরে খেলা। কিন্তু এখন আর অন্ধ সেটা পারছে না। টেপি তার হাত টেনে নিলে সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। শরীরে এক নতুন রকম বোধ, যা ভয় ধরিয়ে দেয়, যা অসুখের মতো লাগে, কিন্তু এ অসুখের কথা কারওকে বলা যাবে না। যে মাস্টারকে অকপটে সব বলতে পারে সে তাকেও বলা যাবে না। তার মন খারাপ হয়ে যায়। কেন এমন হবে? কেন এমন কিছু ঘটবে যা সে চায়নি? অন্ধর এখন সারা দিন মাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ওইখানেই আনন্দ আছে, ওইখানেই নির্ভরতা আছে। যেন মাস্টারের সঙ্গে থাকলে অন্ধর আর অনভিপ্রেত অনুভূতি হবে না।
এখন পলাশ রোজই অন্ধর সঙ্গে মাস্টারের কাছে চলে আসে। স্কুলের বইখাতা নিয়ে সে খুশি খুশি মুখে মাস্টারের বাড়ি যায়। মাস্টার তাকে অঙ্ক কষিয়ে দেয়। পড়িয়ে দেয় বাংলা, ইংরাজি, ভূগোল আর অন্ধকে বলে—শোন, অন্ধ ও যা পড়ে শোন। অন্ধ শোনে। পলাশ সে-দিন পড়ছিল—আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। এটুকু পড়ার আগে সে একবার চেঁচিয়ে বলে নিয়েছিল—ছোট নদী—কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পলাশের পড়ার এই শব্দ অন্ধর কানে অন্য রকম ঠেকে। কিছুটা নতুন। কিছুটা ছন্দোময়। এমনি করে দুলে দুলে কেউ তো এখানে কিছু পড়ে না, তাই একা অন্ধ নয়—পঠনের এই আশ্চর্য শব্দ ও ছন্দ বস্তির অন্যরাও কান পেতে শোনে, যেন কিছুক্ষণের জন্য তাদের মনে হয় এই বস্তিটা আর বস্তি নেই। বাবুদের পাড়া হয়ে গেছে। তাদের মনের গভীরে একটি ক্ষীণ প্রত্যাশা দুঃখের বাজনা হয়ে বাজে—আমার ছেলেটাও যদি পড়ত! পড়ে না। এখানে কেউই পড়ে না। একেবারে ছ’মাস বয়স থেকে প্রত্যেকটি বাচ্চা শুধু খুঁটে খেতে শেখে। হামাগুড়ি দিয়ে কুড়িয়ে নেয়—এতটুকু খাদ্যবস্তু অথবা খেলনার ভাঁঙা টুকরো। শুধু অন্ধ, অন্ধ বলেই এইরকম খুঁটে নিতে কুড়িয়ে তুলতে শিখল না কোনও দিন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুনে অন্ধ ভেবেছিল—ঠাকুর! আর তিনিও কবিতা লেখেন! মাস্টার তাকে অনেক কবিতা শুনিয়েছে। ওই সব কবিতা যাঁরা লিখেছেন তাঁদের নাম সুকান্ত, তাঁদের নাম সুভাষ। কিন্তু কোনও ঠাকুর কবিতা লিখেছেন বলে অন্ধ জানত না। শিব, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এমনকী সন্তোষী মা কোনও কবিতা লেখেননি! একা গণেশ কোন কালে একটা মহাভারত লিখেছিলেন। সেও তাঁর নিজের মগজ থেকে বেরোয়নি। ব্যাসদেব রচেছিলেন। গণেশ লিখেছিলেন। সেক্ষেত্রে গণেশকে বলা যেতে পারে অনুলিপিকার।
আর মহাভারত তো কবিতা নয়। মাস্টার বলে—মহাভারত মহাকাব্য। মহাকাব্য কী সে অন্ধ বোঝে না। তবে, মহাভারতের গল্প শুনতে তার ভারী ভাল লাগে। সে ঠিক করে ফেলেছে বীর যদি হতেই হয় তবে অর্জুনের মতো নয়, হতে হবে অভিমন্যুর মতো। স্বয়ং ভগবানকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করতে আর কে না পারে! ও কি একটা বীরের কাজ হল! মাস্টারের মুখে অন্ধ যখন নকশাল ছেলেদের কথা শোনে, কল্পনা করে মাঠে ময়দানে অলিতে গলিতে প্রাণের ভয়ে ছুটে পালাচ্ছে একটা ছেলে। হাতে হয়তো বন্দুক আছে, হয়তো নেই, পকেট থেকে একটা বোমা বার করে ছুঁড়েও দিতে পারে কখনও, হয়তো কিছুই নেই। এমনকী চটি অবধি খুলে ফেলেছে যাতে জোরে ছোটা যায়, আর তাকে তাড়া করছে ছ’জন-সাত জন সশস্ত্র পুলিশ। পুলিশ কিংবা গুণ্ডা, কে যে—সব সময় বুঝতে পারে না অন্ধ। শুধু দেখতে পায়—একজনকে তাড়া করছে সাতজন, তার অভিমন্যুর কথা মনে পড়ে। এবং আশ্চর্য লাগে তার। সেই কবে, কোন যুগে হিসেব নেই, সপ্তরথী দ্বারা অভিমন্যুর হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আজও তেমনি চলেছে। এ কথা মাস্টারকে বলেছিল অন্ধ। মাস্টার বলেছিল, এই যে সর্বকালীনতা, এই হল মহাকাব্যের মূল শক্তি।
রবীন্দ্রনাথ কি ঠাকুর? কখন এই পুজো হয় বলো তো? জিজ্ঞেস করেছিল অন্ধ। মাস্টার বলেছিল—ঠাকুর? ঠাকুর মানে! তারপর হো হো করে হেসে উঠেছিল, যেমন হাসতে তাকে খুবই কম শুনেছে অন্ধ। সে বুঝতে পারেনি এতে হাসির কী হল, এমনকী পলাশও বোঝেনি। মাস্টার বলেছিল—তাই তো অন্ধ, তোকে কি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি রে। কিছু কিছু কবিতা তুই শুনেছিস কিন্তু। তোর মনে আছে তোকে বলেছিলাম—কাঁটামারা জুতোর তলায় বীভৎস কাদার পিণ্ড… আর সেটা শুনে তুই ঘুমোতে পারলি না। এক ভোরে ছুটে এলি আমার কাছে—সে ছিল রবিঠাকুরের লেখা। রবীন্দ্রনাথ আসলে মানুষ, ঠাকুর নয়। এই যেমন তুই দাস। তোর একটা ভাল নাম দেওয়া উচিত রে অন্ধ। অন্ধ দাস এটা কি কোনও নাম হল?’
অন্ধ বলেছিল—ধুস্! ভাল নাম দিয়ে আমি কী করব? আমি যা আমার নামও তাই। তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা কী বলছিলে বলো!
মাস্টার বলেছিল—একদিনে বলা যাবে না, বুঝলি। তবে কি জানিস, তুই যদি পূজাও করিস রবীন্দ্রনাথকে, এই যেমন তোর মা সন্তোষী মা’র পূজা করে, তবে সন্তোষী মা যা দেন তার চেয়ে অনেক বেশি দেবেন রবীন্দ্রনাথ। এটা তো আর কেউ বোঝেনি। শুধু বুঝেছিল ফুলবাগানের এক মিষ্টির দোকানওয়ালা, সে কীরকম জানিস!
—কীরকম?
—ফুলবাগানে গেছি একদিন। খুব খিদে পেয়েছে। একটা মিষ্টির দোকানে দেখি গরম গরম কচুরি ভাজছে, ভাবলাম খাই, ঢুকে গেলাম। বিশাল মোটা কালো একটা লোক, বিরাট কড়াই ভর্তি গরম গরম তেলে গরম গরম কচুরি ভাজছে। লোকটার নাদা পেট, গণেশঠাকুরের পেটের মতো ঝুলঝুল করছে। আমি বেঞ্চে বসলাম। অত মাছি ভনভন করছিল, তবু দোকানটাকে পছন্দ হয়ে গেল আমার। কেন জানিস?—আমি দেখতে পেলাম, দোকানের চার দেওয়াল জুড়ে অনেক ঠাকুর-দেবতার ছবি—কালি, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সন্তোষী, গণেশ, রামসীতা, রাধা-কৃষ্ণ, শিব, শ্রীচৈতন্য, হনুমানজি আর তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কত বড় ঠাকুর সেই দিন আমি ঠিক ঠিক বুঝেছিলাম। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছবি এখানে রাখার মানে কী? লোকটা কচুরিগুলো তুলে ঝাঁঝরি হাতা নামিয়ে রেখে বলল—আজি মোর মনে হয় অমৃতের পাত্র যেন আমার হৃদয়—যেন সে মিটাতে পারে এ বিশ্বের ক্ষুধা… এক নিশ্বাসে বলে কড়ায় আবার কিছু কচুরি দিয়ে বলেছিল—কিছু বুঝলেন? সে-দিন আমার মনে হয়েছিল ভালবাসা যেমন মানুষের অন্তর্গঠনের ইচ্ছে তেমনি পূজাও। অপরিসীম শ্রদ্ধার পর, ভালবাসার পর পূজা জেগে ওঠে। এই পূজায় কোনও মিথ্যে থাকে না। সংস্কার থাকে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বই লিখেছেন বুঝলি অন্ধ! গানের বই, কবিতার, গল্পের… সে-সব একজন পাঠ করতে থাকলে বছর ঘুরে যাবে। কেউ কেউ তাঁকে ঠাকুর মানে। আমি ভেবেছিলাম ওই লোকটা না জেনে ছবিটা টাঙিয়েছে। কিন্তু সে যখন ওই কথাগুলি বলল…!
অন্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। শুনছিল। সব কথা সে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু মাস্টারের স্বরে রবীন্দ্রনাথ মূর্ত হয়েছিলেন। সেই দোকানির পূজা মাস্টারের স্বরের মাধ্যমে ঘণ্টা-ধূপ-প্রদীপ সমেত আরতি হয়ে অন্ধর শ্রবণে পৌঁছেছিল। সে, রবিঠাকুর সম্পর্কে কিছুই না জেনেও তাঁকে অনুভব করেছিল। তারপর বলেছিল—কোথায় পাওয়া যাবে ঠাকুরকে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে?
মাস্টার বলেছিল—হাওড়ার স্টেশনে গিয়ে তুই যদি চেপে বসিস একটা ট্রেনে, আর ক্রমশ পেরিয়ে যাস—বেগমপুর, বর্ধমান, ঝাপটের ঢাল আর পৌঁছে যাস বোলপুর ইস্টিশনে আর যদি পায়ে পায়ে চলে যাস শান্তিনিকেতন বলে জায়গাটায় তবে তুই পেয়ে যাবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
এখন অন্ধর সে-সব কথা মনে পড়ছে। এই সন্ধ্যায়, যখন সে ক্রমশ বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। আর ক্রমশ অর্থহীন লাগছে তার বেঁচে থাকা, আর তখন সে ভাবছে—মাস্টার বলেছিল— শান্তিনিকেতন এক আশ্চর্য জায়গা, সেখানকার সব মাটির রং লাল। রবীন্দ্রনাথ সে-মাটিকে রঙে রাঙিয়েছেন। সেখানকার সব বাড়ির গায়ে সুন্দর ছবি আঁকা। সে-সব রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন। সেখানে যত ছাতিম আর আমগাছ আছে তা সব রবীন্দ্রনাথের লাগানো। ওখানে যত ভিখিরি গান গেয়ে ভিক্ষা করে—রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া তারা আর কিছুই জানে না। ভিক্ষে করার অপমান ধুয়ে যায় সেইসব গানে। আর তারা সব আশ্চর্যভাবে বেঁচে থাকে। তুই যদি ওখানে কিছু কিনতে যাস, অন্ধ, তবে শুনবি ওখানকার দোকানদারেরা কবিতায় বেচাকেনা করছে। সেইসব কবিতা রবীন্দ্রনাথের। সেখানকার বৃষ্টি ভাল। রুখু মাটি ভাল। রুখু মাটিতে যারা কষ্ট করে ফসল ফলায় তারাও ভাল, ওখানে যদি তোর কোনও কষ্ট হয়, আর তুই একটা রবীন্দ্রসংগীত গাস, তবে তোর সব কষ্ট চলে যাবে। অন্ধর ইচ্ছে করছে সেই আশ্চর্য শান্তিনিকেতন দেশে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যাবে।
ভাবতে ভাবতে ঘরে এল অন্ধ। ঠাকুমা বলল—তর মায় অখনও আইল না! তর বাপের শরীলটা আইজ ভাল নাই। একবার ডাক্তারের কাসে লইয়া যাওন লাগব।
অন্ধর বাবার ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা গেল—আর ডাক্তার লাগব না। আমারে যমে ডাকসে। যেই ট্যাহা ডাক্তারর খ্যাটনে দিবা হেই দিয়া আমার ছেরাদ্দ কইরো।
অন্ধর ঠাকুমা হাঁউ-মাউ কাঁদছে এখন। বলছে—তর কি পেরানে অ্যাতটুকও মায়া নাই? আমি বাইচ্যা থাকত যম তরে নিব ক্যান? অত পাপ আমি করি নাই।
অন্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সে জানে বাবা মরে যাবে। কোনও ডাক্তার আর বাবাকে বাঁচাতে পারবে না। বাবাকে বাঁচানোর জন্য মা সন্তোষী মা’র পুজো করত। অন্ধ একবার ভাবল, মাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুজো করার কথা বলবে। মাস্টার বলেছিল—সন্তোষী মা যা দেয় তার অনেক বেশি দেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপরই তার মনে হল—এসব ভাবনা বেকার। আসলে যমে টানলে কোনও ঠাকুরই কিছু দিতে পারে না। যম হল, যাকে বলে, বড় ঠাকুরের বড় ঠাকুর। আর তা ছাড়াও, মাস্টারের কথায় একটা অন্য স্পন্দন ছিল। অন্ধর কাছে তা ধরা দিয়েও দিচ্ছে না। সে জানে মাস্টার পুজো করে সমস্যার সমাধান বিশ্বাস করে না। তা হলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পুজো করলে আরও অনেক বেশি যা পাওয়া যাবে তার সন্ধান জানে না অন্ধ। সে-জানে মাস্টার। এবং অন্ধ কোনওদিন তা জেনে নেবে।
তার বাবার এই শরীর খারাপ এবং ঠাকুমার এই বিলাপ যেহেতু প্রায় রোজকার ঘটনা সেহেতু হাতড়ে হাতড়ে চাদর নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল অন্ধ। আজ সে বড় খারাপ গন্ধ পাচ্ছে। শুধু ভ্যাপসা পচা গন্ধ। সে দেখেছে, এইসব পচা গন্ধের পরপরই কোনও খারাপ খবর আসে। মাস্টার অবশ্য বলেছে এর নাম সমাপতন। অর্থাৎ একটা ঘটনার সঙ্গে আর একটি ঘটনা যদি কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই বারবার ঘটতে থাকে তবে এই বিশ্বাস জন্মায় যে একটি আর একটির ওপর নির্ভরশীল এবং দু’টির মধ্যে কোনও অদৃষ্ট সংযোগ আছে। এটা একটা মিথ্যে ধারণা। সমাপতন একটা ঘটনামাত্র। তার বেশি কিছু নয়। যেমন অন্ধর ঠাকুমা কাক ডাকলেই হায় হায় করে, বলে—সব যাইব, শনি লাগসে—শুনে শুনে অন্ধও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, কাক ডাকলেই অনর্থ, কিন্তু মাস্টার বলেছিল—সব যেতে আর বাকি কী? তোদের আছেটা কি যে শনি সব কেড়ে নিতে কাক পাঠাবে? এই শহরে হাজার হাজার কাক সারাক্ষণ কা-কা করছে, তাতে যাদের ভাল হওয়ার তাদেরটা আটকাচ্ছে না।
শনি ভাবতে ভাবতেই শনি-শনি শুনতে পেল অন্ধ। কপিলাদির মা চিৎকার করছে। অন্যমনস্ক হাঁটতে হাঁটতে কপিলাদিদের ঘরের কাছে এসে গিয়েছে অন্ধ। বেশ একটা চেঁচামেচি হচ্ছে। অন্ধ দাঁড়াল। টেপির গলা পাওয়া গেল—শোন, অন্ধ শোন—
অন্ধর হাত ধরে ফেলেছে টেপি। অন্ধ শক্ত হয়ে গেছে। শক্ত গলায় বলছে—কী ব্যাপার?
তার কণ্ঠ থেকে ‘কী’ বেরুচ্ছে এক স্বরে, ‘ব্যাপার’ বেরুচ্ছে অন্য স্বরে। অন্ধর স্বর ভাঙছে।
হি-হি হাসতে হাসতে অন্ধর গায়ে পড়ল টেপি। অন্ধ তাকে ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গিতে বলল— কী বলছিস বল।
টেপি আবার হাসল—হি-হি-হি।
অন্ধর গা ঘুলিয়ে উঠল। টেপিকে আজকাল সে সহ্য করতে পারছে না। অনেক কিছুই আজকাল আর সহ্য হয় না। সে রেগে বলল—শুধু হাসিই শোনাবি না বলবি!
কপিলাদির বাড়িতে হট্টগোল বাড়ছে। অনেক মানুষের গলা পাওয়া যাচ্ছে। অন্ধ নিজের মা’র গলাও তার মধ্যে পেল। সকলেই কিছু কিছু বলার চেষ্টা করছে। মানোদা বলল—তকনই তোমাকে বললুম, নগেন মিত্তিরের বাড়িতে মেয়েকে কাজ করতে দিয়োনিকো। শুনলে আমার কতা? দু’টো টাকার জন্য মেয়েটাকে বেচে দিলে গা!
রামু বলল—আমাদের একটা পেসটিজ নেই? বস্তির মেয়ে বলে যা-খুশি করবে! গরিব বলে কি মানুষ নয়? গতরে খাটতে যায়। গতর বেচতে তো যায় না। নগেন মিত্তিরের বাড়ি ঘেরাও করব। টাকা আদায় করে ছাড়ব।
টেপিকে ছেড়ে এগিয়ে এসেছিল অন্ধ। শুনছিল এ সব। টেপি আবার তার ঘাড়ের কাছে মুখ এনেছে গন্ধে টের পেল অন্ধ। আর স্পর্শে বুঝল, টেপির গুটিপাকানো বুক তার পিঠে ঠেকে আছে। সে বলছে—কপিলাদির পেট হয়ে গেছে বুঝলি অন্ধ। চার মাস পার হয়ে গেছে। নগেন মিত্তির উকিলবাবুর বাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিল। লোকটা এমন ঢ্যামনা, কপিলাদিকে চুষে ছিবড়ে করে দিয়েছে।
মুখ নিচু করে বেরিয়ে এল অন্ধ। অসহ্য লাগছে। কী হবে এখন কপিলাদির কে জানে। অন্ধর আবছা আবছা মনে পড়ছে—পেঁচোর পিসির পেট হয়ে গিয়েছিল। কামারহাটির কোথায় যেন তাকে খালাস করতে নিয়ে গিয়েছিল পেঁচোর মা। পেট খালাস হবার বদলে পেঁচোর পিসি নিজেই একেবারে খালাস হয়ে গিয়েছিল। পেঁচোর পিসিও কি নগেন মিত্তিরের বাড়িতে কাজ করত? অন্ধ জানে না, কপিলাদিও কি পেট খালাস করতে যাবে, আর মরে যাবে? এও অন্ধ জানে না। হঠাৎ তার মনে হয় পেট খালাস মানে কী? অকারণে তার বেশি বেশি শীত করে। ভয়, অস্বাভাবিক ভয়ে পাগল পাগল লাগে, ওই কথাটার মানে যাই হোক, অন্ধ গভীরভাবে অনুধাবন করে—মানেটা এত খারাপ যে মানুষের প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নেয়। পায়ে পায়ে সে চলতে থাকে পলাশের ঘরের দিকে। এতদিন হয়ে গেল পলাশের মায়ের স্বরটা যে কেমন, তা পরিষ্কারভাবে অন্ধর কাছে ধরা দিল না। খুব কম কথা বলে পলাশের মা। যা বলে তাও এত আস্তে বলে যে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলার মতো শোনায়। এই বস্তিতে সকলেই জোরে কথা বলে। তারা আনন্দেও চেঁচায়, দুঃখেও চেঁচায়। চেঁচিয়ে ঝগড়া করে, চেঁচিয়েই সোহাগ করে। কিন্তু পলাশের মা আলাদা। অন্ধর তাই পলাশের মাকে একটু দূরের মনে হয়। কিন্তু এ এমন দূর যা সবসময়ই কাছে ডাকে। পলাশের মায়ের নীরবতা অন্ধকে এমন আকর্ষণ করে যে যখনই অন্ধ এ ঘরে আসে, তখনই তার মধ্যে প্রত্যাশা স্ফূরিত হয়। পলাশের মা তাকে ডেকে একটু পাশে বসাক। দু’টো কথা বলুক। কিন্তু রাধিকা কখনই তা করেনি। অন্ধ জানে অনেক দিন হল পলাশের বাবা আসছে না। সেই যে লোকটা উদ্বাস্তু কলোনি থেকে পলাশদের এই বস্তিতে দিয়ে গেল, তার পর থেকেই তার আর দেখা নেই। অন্ধ বাইরে থেকে পলাশকে ডাকল। হাতে বইখাতা নিয়ে বেরিয়ে এল পলাশ। অন্ধ বলল—আজ যাবি তো?
পলাশ বলল—এই তো বই নিয়েছি।
অন্ধ বলল—বইগুলো আমার হাতে দিবি একবার?
পলাশ স্লেট আর পেনসিল নিজের হাতে রেখে বইগুলো অন্ধর হাতে তুলে দিল। গভীর শ্বাস টেনে বইয়ের ঘ্রাণ নিল অন্ধ। আস্তে আস্তে তার সব মনখারাপ চলে যেতে থাকল। আজ সন্ধ্যায় তার বাঁচতেও ইচ্ছে করছিল না, এ কথা আর মনেও পড়ল না। তার বাবাকে যমে নিয়ে যাবে কি না, কপিলাদি মরে যাবে কি না, নগেন মিত্তিরের কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত টাকা আদায় হবে কি না, এ সব কিছুই আর মনে এল না। বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে সে বলল—তোর বইয়ের গন্ধটা আলাদা।
পলাশ বলল—ভাল?
—হ্যাঁ ভাল। কিন্তু মাস্টারের ডায়রির গন্ধ আরও চমৎকার, ওর মধ্যে তো ইতিহাস লুকিয়ে আছে তাই। বলেই জিভ কাটল অন্ধ, যেন গভীর গোপন কথা বলে ফেলেছে পলাশকে। তার ও মাস্টারের একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি, বাক্স-প্যাটরা যেন হঠাৎ খুলে ফেলেছে সকলের সামনে, পলাশ কিছু বলার আগেই অন্ধ বলল—আকাশে তারা উঠেছে রে আজ?
পলাশ বলল—হ্যাঁ।
—চাঁদ?
—না, চাঁদ আজ নেই।
চাঁদ যে নেই তা কী অন্ধ জানে? সে চাঁদের আলোর গন্ধ পায়। জ্যোৎস্নাকে স্পর্শে অনুভব করে। কিন্তু এখন পলাশকে অন্যমনস্ক করে দেবার জন্য সে চাঁদ ও তারা বিষয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকল। জিজ্ঞেস করল—ক’টা তারা, গোন দেখি?
পলাশ গুনতে লাগল—একটা, দু’টো, তিনটে, চারটে—
হেসে হেসে বলতে লাগল অন্ধ। বলল—কী বোকা তুই, কী বোকা! তারা কেউ গোনে?
পলাশ বলল—বেশি তারা মোটেও ওঠেনি, তাই গুনছিলাম।
গোলাপের গন্ধ এল নাকে। অন্ধ জানে মাস্টারের বাড়ি এসে গেছে। এই গোলাপের ডাঁটি, মাস্টার গত বছর এনে পুঁতেছিল। এ বছর গাছটা ফুল দিয়েছে।
অন্ধ বলল—চল।
পলাশ বলল—দরজা তো বন্ধ।
ঝাপের যেখানে তালা থাকে, সেই জায়গাটা স্পর্শ করল অন্ধ, তালা দেওয়া নেই, অন্ধ ভাবল—মাস্টার নিশ্চয়ই কপিলাদির বৃত্তান্ত শুনে ওদের ঘরে গেছে। সে পলাশকে বলল— আমরা বসি, মাস্টারকাকা এসে পড়বে।
অন্য দিন পলাশ স্কুলের গল্প, ভাইয়ের গল্প অথবা উদ্বাস্তু কলোনির কথা বলে। আজ সে একেবারেই চুপচাপ।
অন্ধ বলল—কথা বলছিস না যে?
পলাশ বলল—জানিস, আজ আমাদের ঘরে একদানাও চাল নেই।
অন্ধ জিজ্ঞেস করল—কেন?
—বাবা আসেনি তো, টাকাও দেয়নি। মা’র যা ছিল ফুরিয়ে গেছে।
—তা হলে কী হবে?
পলাশ বলল—আগেও তো বাবা এরকম করত। তখন ঘরে কিছু না থাকলে, ওখানকার দিদা আমাদের খেতে দিত। খুব ভাল ছিল দিদা। এখন তো দিদা নেই। হ্যাঁ রে অন্ধ তোর মা তো বাবুদের বাড়ি কাজ করে। মা বলছিল—ওমনি একটা কাজ কি মা’র জন্য জুটিয়ে দেওয়া যায় না?
চুপ করে রইল অন্ধ। ভাবতে লাগল—পলাশরা তো ভদ্দরলোক। পলাশ ইস্কুলে পড়ে, ওর মা আস্তে আস্তে কথা বলে। তা হলে, ওরাও বাবুদের বাড়ি কাজ করবে কেন? মাস্টার বলে— ভদ্দরলোকের ছোটলোক হতে এক সেকেন্ড সময় লাগে। পলাশরা কি তা হলে ছোটলোক হয়ে গেছে! ভাবতেই আবার মন খারাপ হয়ে গেল অন্ধর। সে বলল—আচ্ছা আমি মাকে বলে দেখব।
অল্পক্ষণ পরই ঘরে ফিরল মাস্টার। কপিলার বিষয়ে কী করা যায়, সে বুঝতে পারছে না। নগেন মিত্তির ঘুঘু লোক। একে উকিল, তায় মেয়েঘটিত সর্বনাশে তার জুড়ি মেলা ভার। তা ছাড়া একটা হিসেব মাস্টার কিছুতে মেলাতে পারছে না। কপিলা খুব ছোট নয়। কী করলে সর্বনাশ হয়, বস্তির মেয়েরা তা ন’ বছর বয়স থেকে বুঝতে শেখে। কপিলা প্রায় কুড়ি পেরুল। নগেন মিত্তির যে এরকম কিছু ঘটাচ্ছে, কপিলা তা আগে বলল না কেন? হতে পারে, তাকে কোনও স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। মাস্টার ভাবছে, এইসব বিষয়ে দরবার করতে সে নিজে কখনই যাবে না। কিন্তু এও সে জানে যে নিজে গেলে যতখানি কথা হতে পারে, না-গেলে ততখানি হবে না। তার এই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া হয়তো-বা বস্তির পক্ষে মঙ্গলজনক হচ্ছে না। কিন্তু মাস্টারের মধ্যে যতটুকু শক্তি আছে তা এই নিজেকে গুটিয়ে নেবারই শক্তি।
পড়াশুনো আজ আর তেমন জমল না। পলাশ চোদ্দোর নামতা মুখস্থ করেছিল তা শোনাল মাস্টারকে। মাস্টার বলল—আজ আর পড়াব না রে। গল্পও বলব না। তুই বাড়ি চলে যা পলাশ, কাল আসিস।
অন্ধ বলল—আমি তবে দিয়ে আসি ওকে?
মাস্টার বলল—যা।
সে পকেট থেকে এক টাকা বের করে অন্ধর হাতে দিয়ে বলল—বেণুর দোকান থেকে দু’বাণ্ডিল বিড়ি আর একটা দেশলাই আনিস।
পলাশকে বাইরে রেখে। আবার ফিরে এল অন্ধ। পলাশকে বাইরে রেখে। মাস্টার চোখ বন্ধ করে বসেছিল চুপচাপ।
অন্ধ বলল—মাস্টারকাকা—।
—কী রে।
—পলাশদের বাড়িতে আজ একটুও চাল নেই। ওরা কী খাবে?
—তোদের ঘরে যখন চাল থাকে না তোরা কী খাস?
—কিছুনা।
—ওরাও কিছু খাবে না। কাল বা পরশু একটা সমাধান খোঁজার জন্য ওদের বেরিয়ে আসতে হবে।
—কিন্তু ওরা তো ভদ্দরলোক।
—ভদ্রলোককেও পথে বেরোতে হয় রে অন্ধ।
—তুমি ওদের আজকের মতো কিছু দিয়ে দাও না মাস্টারকাকা।
মাস্টার দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো শার্টের পকেট থেকে তিন টাকা বের করে। অন্ধকে দেয়। বলে—তুই বললি তাই দিলাম। কিন্তু পলাশের মা নেবে না। আর এটা কোনও সমাধান নয় অন্ধ। তুই বুঝিস না?
অন্ধ নীরবে বেরিয়ে আসে। হ্যাঁ। বোঝে সে। এটা কোনও সমাধান নয়। একদিনের সাহায্য কোনও সমাধান নয়।
সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছিল মাস্টার, পলতে কমিয়ে রেখেছিল। অন্ধর তো কী-বা দিন, কী-বা রাত্রি। লণ্ঠন জ্বলল কি জ্বলল না তাতে কিছু এসে যায়নি। কিন্তু পলাশও পলতেটা উসকে দেয়নি। বেশ কিছুদিন চিমনি মোছা হয়নি। কালচে ছোপ পড়ে গেছে। মাস্টার পলতেটা উসকে দিল। আলোটা একটু জোর হল বটে, কিন্তু ঘরের অন্ধকার অপসৃত হল না। মাস্টারের মনে হল—এই বস্তিতে তার আসা কালচে হয়ে যাওয়া লণ্ঠনটার মতোই এখন। আলো আছে, তার দ্বারা অন্ধকারের কিছু এসে যায় না। সে একবার হাত মুঠো করে। যদি কোনওভাবে দুনিয়াটাকে সত্যিই বদলে দেওয়া যেত! পারল না। কেউই পারল না। বদলানোর চেষ্টা করতে করতেই সব ধ্বংস হয়ে যায়, শুধু বদলে যাওয়া পৃথিবীর স্বপ্নটাই বেঁচে থাকে এবং পৃথিবীর বুকের ওপর রাজত্ব করে চলে পচনশীল সমাজব্যবস্থা। আসলে মানুষ নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এবং সে-প্রতিষ্ঠা ভাঙতে চায়, সারাক্ষণ তার নিজের মধ্যে চলে অসাধারণ দ্বন্দ্ব। অর্ধাংশ চায়—প্রতিষ্ঠার পক্ষে যেতে। যা-কিছু বানানো হয় তা টিকিয়ে রাখতে। অন্য অর্ধাংশ সেই প্রতিষ্ঠা ভাঙে। কখনও ভাঙতে সফল হয়, কখনও হয় না। সফল হলে, সে-সাফল্যের ওপর গড়ে ওঠে নতুনতর প্রতিষ্ঠা, যা আবার নতুনতর ভাঙনের প্ররোচনা দেয়।
দেশলাই আর বিড়ি নিয়ে ফিরে এল অন্ধ। মাস্টার বলল—আজ কী করা যায় বল তো? মেজাজটা ধরছে না।
অন্ধ বলল—কপিলাদির কী হয়েছে মাস্টারকাকা?
মাস্টার বলল—কপিলার কথা তুই শুনেছিস বুঝি? অবশ্য তুই কী-বা শুনিস না! ঈশ্বর তোকে চোখ না দিয়ে একপক্ষে ভালই করেছে রে অন্ধ। এই পৃথিবীর সমস্ত বিকৃতি তুই শুনিস শুধু, তোকে দেখতে হয় না।
অন্ধ বলল—তাতে কি কিছু কম পড়ে?
মাস্টার চমকে উঠল—কী বললি?
অন্ধ বলল—আমি দেখতে পাই না, কিন্তু এই পৃথিবীটা কেমন হওয়ার কথা সে তো তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছ। চোখ ছাড়া যেমন যেমন বোঝা যায়, আমি তেমনই বুঝেছি। তোমার বোঝার চেয়ে, সে-বোঝাটা আলাদা। কিন্তু আমি তো ওইরকম করেই চাই। যখন বুঝতে পারি—যেমন চাই তেমন হচ্ছে না, তখন আমারও তোমার মতো কষ্ট হয়।
মাস্টার অন্ধর চুলগুলো নেড়ে দিল, বলল—তুই খুব আশ্চর্য রে অন্ধ। তুই যখন কথা বলিস, মাঝে মাঝে আমার কেমন ধাঁধা লেগে যায়, যেন তুই—এক ভগবান বা দার্শনিক বসে আছিস আমার সামনে।
অন্ধ বলল—তুমি আজ কথায় কথায় খুব ভগবান আর ঈশ্বর বলছ, তুমি যে আমায় বলতে—ভগবান নয়, যা-কিছু তৈরি হয়, তার সবেরই স্রষ্টা প্রকৃতি। তা হলে?
মাস্টার হাসল, বলল—এর মানে কী জানিস? এর মানে হল আমি যে হেরে গিয়েছি, এইটে এবার বুঝতে শুরু করেছি।
—কার কাছে হেরেছ?
—বলতে পারিস ভগবানের কাছে, বা সত্যি করে বলতে গেলে নিজের সক্ষমতার কাছে। মানুষের অক্ষমতার অন্য নামই তো ভগবান। আমরা যা পারি—তা তো পারিই। যা পারি না অথচ আপ্রাণ পারতে চাই, তার জন্য দু’হাত পেতে ভগবানের সামনে দাঁড়াই। শেষ পর্যন্ত কী হবে জানিস? আমি যা পারব, করব, কিন্তু আমি যে করেছি সেটুকু ভুলে গিয়ে বলতে থাকব এটাও ভগবান করেছেন। অর্থাৎ অক্ষমতা এসে আমার আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেবে।
অন্ধ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মাস্টার আবার অন্য ভাষায় কথা বলছে। ঠিক কী যে বলতে চাইছে, এখন ধরতে পারছে না অন্ধ। মোদ্দা কথা হল—ভগবানে বিশ্বাস করবে, কী করবে না! মাস্টার যে এখন কোন দলে তা কে জানে! ভগবান যেমনই হোক, মানুষকে যে সে বাবুদের মতোই খুব একচোট খাটিয়ে নেয়, সে-বিশ্বাস অন্ধর হয়েছে। এই যেমন—মা মাঝে মাঝে পুজোর জন্য উপোস দেয়, একটু সন্দেশ আনল বা দু’টো কলা, বাতাসা, সঙ্গে সঙ্গে সাবধান করে দেবে—‘খাইয়া থুইস না য্যান, ঠাকুরের ভোগ দিমু।’
মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল অন্ধর—সব ভোগে যায়, কলা, সন্দেশ, বাতাসা, খেজুর, খিচুড়ি-পায়েস এমনকী ছাগল পর্যন্ত। ঠাকুরের ভোগ। ঠাকুরের পেট কত বড়? অন্ধর মায়ের মতো আরও কত অন্ধর মা-ই তো এই রকম রোজ রোজ পুজো করছে। আর ঠাকুর তাদেরও কলা-বাতাস চেটে চেটে খেয়ে নিচ্ছে। তার পেট ফাটে না? কথাগুলো মাস্টারকে শোনাল অন্ধ।
মাস্টার বলল—বেশ জোর প্রশ্ন করেছিস রে অন্ধ। ভগবানের পেট কত বড়, সে বোঝা মানুষের কর্ম নয়। শুধু জানবি তোর মতো এই প্রশ্নটা আরও অনেকের মনে এসেছিল, আর তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে পাগল হবার ঠিক আগে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে—এই গাছপালা, মাটি, নদী, মানুষ, জানোয়ার সব ভগবানের পেট থেকে বেরিয়ে আসছে আবার পেটে গিয়ে সেঁধোচ্ছে।
অন্ধ হঠাৎ হাসতে লাগল, অবিশ্রাম বৃষ্টির মতো হাসি। হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল বিছানায়। সে তো জানে না পেট থেকে বেরিয়ে আসাটা কেমন, কিন্তু একটা পেটের মধ্যে গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ সব সেঁধিয়ে গিয়ে জটলাজটলি করছে এ কথা ভেবে তার আর হাসি থামছে না।
কথায় কথায় রাত বেড়েছে, অন্ধর মা ডাকতে এসেছে অন্ধকে। বলছে—খাওনদাওন সব মিটাইয়া আবি অন্ধ, আমার শরীলডা ভাল না, শুইয়া পড়ুম।
মাস্টার বলল—অন্ধ আজ আমার এখানেই থাক। রুটি তরকা নিয়ে আসব, খেয়ে নেব দু’জনে।
অন্ধর মা ফিরে গেল। রুটি তরকা-ভোজন শেষে চমৎকার ঢেঁকুর তুলল অন্ধ।
মাস্টার বলল—শুয়ে পড়বি?
অন্ধ বলল—না। ডায়রি ডায়রি খেলব। অনেকদিন খেলোনি তুমি এটা।
মাস্টার ডায়রি নিয়ে এল, অন্ধকে বলল—খোল। অন্ধ আকাশের দিকে মুখ করে, এক ঝটকায় খুলে ফেলল একটি পাতা, মাস্টার পড়তে লাগল—
—হে পশ্চিমবঙ্গ, তিন বৎসরকাল তুমি কী লইয়া বাঁচিয়া আছ?
—আয়ারাম-গয়ারাম সরকার লইয়া।
—আর?
—মূল্যবৃদ্ধি লইয়া।
—আর?
—অস্থিতিশীল জীবন, ভাঙন আর উষ্মা।
—বুঝাইয়া বলো।
—যদ্যপি কর্ণ সতর্ক করি, ভাঙনের শব্দ পাই। হৃদয় ভাঙে, সংসার ভাঙে, সংগঠন ভাঙে। দশ নেতা, দশ মাথা, দশ মত। নানা মুনির নানা মত লইয়া শত শত দর্শনশাস্ত্র গড়িয়া উঠিতে পারে কিন্তু দেশ চলিবে কী প্রকারে? সংগঠনই বা কীরূপে টেকে? সকলেই পূর্বে আসন প্রত্যাশা করে, তৎপরবর্তী কল্যাণের কথা ভাবিবার প্রতিশ্রুতিমাত্র দেয়। অস্থিরতা, অস্থিরতা। সর্বত্র অস্থিরতা। জীবনের স্থিতি নাই। জীবন ও মৃত্যু আজি এ বঙ্গে নিরর্থক।
—ইহা কথা কেন বলো?
—হীরেন বসু নামে এক তরুণের কথা কহি। প্রেক্ষাগৃহে বসিয়া সে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতরস আহরণ করিতেছিল। সহসা প্রেক্ষাগৃহে আরক্ষাকর্মী ঢুকে এবং শূন্য দূরত্বে হীরেনকে গুলি করিয়া হত্যা করে। তাহাদের অভিযোগ, হীরেন আরক্ষাকর্মীদের নিকট হইতে বন্দুক ছিনাইয়া লইয়াছে। তাহা সত্য-মিথ্যা কে বলিবে? কে নির্ণয় করিবে! এক প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি লোকের চক্ষের সম্মুখে হীরেনের পা ধরিয়া হিঁচড়াইয়া বাহিরে লইয়া যাওয়া হইল। তৎক্ষণাৎ কোনও প্রতিবাদ উঠিল না। কেহ গর্জন করিল না। কিন্তু কনভেনশন ইন ডিফেন্স অব ডেমোক্রেটিক রাইটস অ্যান্ড সিকিয়োরিটির পক্ষে একটি বিবৃতি উঠিল—কোনও মতানৈক্য ব্যতিরেকে জানানো হইতেছে যে হীরেনকে জনসমক্ষে শূন্য দূরত্বে গুলি করিয়া মারা হয়— “We came across the unanimous evidence of quite a large number of persons that Hiren was shot dead of point blank range in full public view.”
ঘটনার তদন্তের দাবি হইল। কিন্তু আরক্ষাপ্রধান পাল্টা বিবৃতি দিলেন—এই বিবৃতি ভুল ও মিথ্যা। এই ঘটনা বিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই।
ইহাই আমাদের বর্তমান জীবন। জীবন যাপন।
—মাস্টারকাকা?
—বল।
—কবে লিখেছিলে এই জায়গাটা?
—সত্তর সালের শেষের দিকে।
—এটা তো আটাত্তর সাল?
—হ্যাঁ।
—সত্যিই ওরকম হয়েছিল, না?
—তুই সবটা বুঝেছিস রে অন্ধ?
—কেন বুঝব না মাস্টারকাকা?
—ভাষাটা অন্যরকম তো, তাই।
—তুমি যখন এ সব পড়ে শোনাও তখন আমি যেন ঘটনাগুলো দেখতে পাই। সবার সামনে মেরে ফেলল আর পা ধরে হেঁচড়ে নিয়ে গেল। ইস্! ছেলেটা গান শুনতে শুনতে মরে গেল! আমার খারাপ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে।
—ক’জনের জন্য অন্ধ? ক’জনের জন্য তুই কাঁদবি? এর ঠিক দু’দিনের মাথায় পুলিশ তিনজন নকশালকে গুলি করে মারে। তাদের একজনের বয়স ছিল আঠারো।
—ইস্!
—একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিবৃতি দিয়েছিলেন, দশ দিনের মধ্যে পুলিশের গুলিতে একুশজন নকশাল মারা গেছে, আহত হয়েছে সাতজন। সংখ্যাটা প্রকৃতপক্ষে এর তিন গুণ ভাবাই ভাল।
—ওরা কি মানুষ নয়? মাস্টারকাকা? ওরা কি দানব?
—মানুষই তো দানব হয়। তোকে স্পার্টাকাসের গল্প বলিনি? যিশুর কাহিনী শোনাইনি? একেবারে আদি থেকে মানুষের দু’টি বিপরীত সমান্তরাল ইতিহাস। একটি যুদ্ধ ও মৃত্যুর। অন্যটি শান্তি ও কল্যাণের। দ্বিতীয়টির ইতিহাস সরু। শীর্ণ। কিন্তু প্রার্থনীয়। আর তুই এই বলছিস। তবে শোন। আরও আছে। ওই একুশজনের পর আরও মৃত্যু সংযোজিত হয় মাত্র সতেরো দিন পর। বেলেঘাটায় চারজন নকশাল যুবককে বিছানা থেকে তুলে এনে প্রকাশ্য রাস্তায় খুন করা হয়। এবং একই দিনে বারাসতে খোলা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল এগারোজন নকশালের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ।
—এই সব তুমি লিখে রেখেছ, না?
—হ্যাঁ রে অন্ধ, চেষ্টা করেছি অন্তত। কখনও লিখেছি, কখনও খবরের কাগজ কেটে সেঁটে রেখেছি। অনেকটা ধরা আছে এখানে। মৃত্যুর ইতিহাস। নিষ্ঠুরতার ইতিহাস।
নিষ্ঠুরতা ও মৃত্যু, হত্যা ও অত্যাচার—মানুষ কোনও দিন উপলব্ধি করবে এ কাজ তার জন্য নয়। ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ, ঈর্ষা ও লকলকে লোভ—মানুষ কোনওদিন উপলব্ধি করবে এ সম্পূর্ণতার বিরুদ্ধাচারী, বিকাশের ব্যাহতি, মানুষের বেমানান। এইসব ঘটবেই একদিন, ভেবেছিল কেউ কেউ। ভাববে। গুটিকয় মানুষ সেই ভাবনাগুলি বুকে করে বেড়াবে আজীবন। এবং দিয়ে যাবে অন্য কোনও মানুষকে। যেমন মাস্টার। যেমন অন্ধ।
অন্ধও ঘুমোয়নি। মাস্টারও না। জেগে আছে যে-যার মতো। ফটিক বিল বস্তিতে দু’টি মাত্র জাগ্রত মানুষ। বাকি সব ঘুমন্ত। সারা বস্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনকী ঘুমিয়ে পড়েছে মাছেরাও। বিলের জলের নীচে যথার্থ বাসস্থানে। শুধু কোনওদিন ঘুমোবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে জেগে আছে পি ডব্লু ডি রোড। রেললাইন তবুও ঘুমোয়। একটা ট্রেন যাবার পর আরও একটা আসার আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয় সে। অল্প অল্প ঘুমিয়েও কি পড়ে না? অন্তত এটুকু তো সে জানে—একটি রেল চলে গেলেই আর একটি সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে তার ঘাড়ে এসে চড়বে না! রাস্তার সে-সুযোগ নেই। তাকে কেউ ঘুমোতে দেবে না। তাই ঘুমোনার ইচ্ছেই সে ত্যাগ করেছে। একমাত্র ধর্মঘটের প্রতীক্ষা। ধর্মঘট হলে পুলিশের গাড়ি ছাড়া আর কোনও গাড়ি সইতে হয় না তাকে। কিন্তু বরাহনগরের সব রাস্তা জানে—পুলিশের গাড়ির ওজন দুর্বহ।
ঘুমনোর ইচ্ছে ত্যাগ করে মহান হয়েছে পি ডব্লু ডি রোড। অধিকার হরণ করে নেবার আগেই সেই অধিকার হস্তগত রাখার ইচ্ছা পরিহার করার মধ্যে এক ধরনের জয় ঘোষিত হয়। এই রাস্তার মতোই, এই মহানগর কখনওই ঘুমোয় না। চোরও জাগে, পাহারাদারও জাগে। খুনি জাগে, যে খুন হয় সেও জেগে থাকে ত্রাসে। আর কিছু লোক—যারা এই নিদ্রা ও জাগরণের খেলা প্রত্যক্ষ করতে চায় চুপিসাড়ে—তারা ঘুরে বেড়ায় একা। কিছুক্ষণ সময়। সকলের অলক্ষে। যেমন ঘোরেন—আনিসুজ্জামান।
৩৭
আজ আবার ভোর ভোর উঠে পড়েছে হরিচরণ। তুলসী আজ সন্তোষী মা’র পুজো করবে। গত বছর যখন সে পুজো শুরু করেছিল, তখন ভেবেছিল—মনস্কামনা পূর্ণ না-হওয়া পর্যন্ত পুজো করে যাবে। কিন্তু অন্ধর মা বলল—এভাবে পুজো করতে নেই। যোলো শুক্রবার পালন করো তারপর উদ্যাপন দাও। অপেক্ষা করতে থাকো, যা চেয়েছ দেবী তা পূর্ণ করেন কিনা।
কতদিন অপেক্ষা? তার কোনও হিসেব জানা নেই অন্ধর মা’র। যতদিন না দেবী সন্তুষ্ট হন, যতদিন না তোমার মনে হয় আরও বেশি আরাধনা তাঁকে করা প্রয়োজন ছিল ততদিন। তুলসীও তাই অপেক্ষা করেছে, এবং আজ আবার পূজা শুরু করছে। গত বছর ব্রত পালনের সময় প্রতি শুক্রবার ছোলা-গুড়ের পূজা হরিচরণ ও তার পরিবারের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। যেমন রান্না খাওয়া, যেমন ছেলেদের ইস্কুলে পাঠানো, তেমনই এও এক সংসারধর্ম। শুধুমাত্র পেশা পালন নয়, শুধু প্রেম বিবাহ জন্মদান শিশুপালন রান্না খাওয়া নয়। মানবজীবনের অলঙ্করণে শোভায় স্বাতন্ত্রে আছে ধর্মবোধ। ধর্মচর্চা। পূজা না করলে কী হয়? কিছু না। মসজিদে না গেলে, নমাজ না পড়লে, চার্চে ঈশ্বরের ভজনা না করলে? কী হয়? কিচ্ছু না। এমন মানুষ আছে যারা ধর্মবোধকে অধর্ম ভেবে বসে। তাদের নাস্তিকতা ধর্ম। আর স্বধর্মে প্রতিপালিত মানুষ। তবু এইসব চর্চা, প্রার্থনা, পূজাপার্বণ জীবনকে রাঙায় যতক্ষণ না অপরের পক্ষে তা ক্ষতিকর। ব্রত উদ্যাপনের পর, কয়েকটি শুক্রবার বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগত। আজ এই শীতের ভোরে ঘুম থেকে উঠে হরিচরণ খুবই প্রসন্ন বোধ করছে এই ভেবে যে গৃহে আবার দেবী ফিরে এলেন। গায়ে একখানা চাদর জড়িয়ে সব সরঞ্জাম নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। আকাশ একটু ফিকে লাগছে বটে, কিন্তু ভোর খুব ধীর প্রক্রিয়ায় নেমে আসবে এখন। তাতে কিছু যায় আসে না, হরিচরণ জানে—কোথায় কতটুকু ময়লা জমা হয়, কোন গৃহ থেকে বেরিয়ে আসে কত বেশি পরিমাণ আবর্জনা। এটা ঠিক যে, প্রত্যেকটি পরিবারই একই ধরনের জীবনযাপন করে। সকলেই উপার্জনে যায়, রাঁধে, খায়, পরচর্চা কিংবা শিল্পচর্চা করে। অথচ প্রত্যেক পরিবার থেকেই একই পরিমাণ আবর্জনা নিঃসৃত হয় না। কোন গৃহের সামনে কতখানি আবর্জনা জমে থাকবে এবং তার মধ্যে কী কী বস্তু থাকতে পারে, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতোই অনিবার্যভাবে বলে দিতে পারে হরিচরণ। আজ রাস্তা পেরুতে পেরুতে তার মনে পড়ল গত বছরের এমনই একটা ভোরের কথা, যে-দিন তুলসী সন্তোষী মা’র পূজা শুরু করেছিল। হরিচরণ, সাতকন্যার গলি দিয়ে প্রথম পাড়ায় ঢুকেছিল সে-দিন, আর দেখতে পেয়েছিল উদাস ভোরবেলায় সাতকন্যার তৃতীয় মেয়েটি একলা দাঁড়িয়ে আছে ছাদে প্রসাধনহীন। আজও সে পায়ে পায়ে সাতকন্যার গলির দিকে যেতে লাগল।
পরিপূর্ণ ভোর হওয়ার পূর্বেকার এই অন্ধকারে নানা রকম বিভ্রম জাগে, একটা সম্পূর্ণ নতুন দিন অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষিত থাকে বলে, মানুষ আগের দিনের সমস্ত আবর্জনা রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে চায় ভোর হবার আগে। হরিচরণ এমনই সব বিভ্রমের মুহূর্তে আবর্জনার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। যেমন সে চিরকাল ভেবে এসেছে ঈশ্বর আশীর্বাদের মতো তাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছেন, তেমনই আজও আশীর্বাদমণ্ডিত পবিত্র কাজের জন্য সে বাগিয়ে ধরেছে তার বেলচা আর অন্ধকারে দৃষ্টি প্রসারিত করছে। এখন কোথাও কোনও নারী জাগে না, কোথাও কোনও মাতৃত্ব জাগে না, তাই একটি ছোট শিশু হয়তো সদ্যোজাত সে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত হয়। বেড়ালছানার চেয়ে ছোট শক্তিতে শিশুটি দু’-একটি বিক্ষিপ্ত শব্দ করে যা হয়তো-বা জীবনের শব্দ, হয়তো-বা চাঁদ ওঠার শব্দ কিংবা ফুলেরা পাপড়ি মেলছে কোথাও—যা আবর্জনা থেকে উঠে আসার সম্ভাবনা অবিশ্বাস্য করে দেয়। হরিচরণ প্রথমে কোনও বেড়াল-মায়ের বিভ্রম ভাবতে চায় এবং বেলচার ডগায় বেড়ালছানা তুলে নেবার ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে হতবাক হয়ে যায়। প্রথমে সে ঈশ্বরকে ডাকে, তারপরই হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ চিরন্তন মানুষ-সন্তান। বেলচা ফেলে ক্রমশ নিচু হতে থাকে সে, তার চাদর ভূলুন্ঠিত হয়। কোথাও কোনও গাছে পাখিদের ঘুম ভাঙে তখনই, ঘুম জড়ানো গলায় এই ভোরকে স্বাগত জানায় তারা আর হরিচরণ তার দু’টি কম্পিত হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে দেয় আবর্জনার দিকে আর তুলে নিতে থাকে সেই একটুখানি মানুষের বাচ্চা, যাকে জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং যে বর্জিত। যাকে মেরে ফেলা সম্ভব হয়নি কিন্তু ছুড়ে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুর সমান আবর্জনায়। শিশুটি তিরতির করে কাঁপছে, প্রাণ উড়ে যাবার আগে হয়তো-বা এই কাঁপুনি তাকে শেষ উষ্ণতা দিয়ে রেখেছিল। হরিচরণ কম্পিত শরীরটিকে সাপটে নিচ্ছে বুকে, আর চাদর দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বলছে—‘হে ভগবান আবর্জনার মধ্যে এ তুমি আমাকে কী দিলে!’ সে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। বেলচা পড়ে রইল। ভ্যান পড়ে রইল। হরিচরণের আর স্মরণে নেই কিছু। সে কেবল লম্বা লম্বা পায়ে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে তুলসীর বিশাল অপার্থিব স্তনের দিকে যেখানে সে নিজে শান্তির আশ্রয় পায়— তাদের পাঁচ ছেলে করুণার আশ্রয় পায়—সেখানে এই শিশুটিকে সমর্পণ করবে বলে। এবং সে নিশ্চিত, ঠাণ্ডা নীল এই শিশু তুলসীর স্তনের গভীরে প্রাণ হারাবে না কিছুতেই। সে ছোটে। ছুটে যায় বাঁচানোর আর্তিতে, যে আর্তি মানুষকে বাঁচায়।
আসলে আয়ুই সেই আশ্চর্য ভবিষ্যৎ যা মানুষকে টেনে নিয়ে যায় অপ্রত্যাশিত উপসংহারে। আয়ুই প্রতীক্ষা করে, পৃথিবীতে নেমে আসার প্রথম মুহূর্তকাল থেকে কোনও এক অসামান্য আলোর কাছে পৌঁছবার কাল পর্যন্ত। তুলসী বুঝি-বা আলো এখন যার কাছে গিয়ে হরিচরণ নিজের বুক থেকে শিশু তুলে দিয়ে দিচ্ছে আরও বৃহৎ বক্ষের প্রত্যাশায়। তুলসী কাঁদছে। প্রথমেই তার মুখে উচ্চারিত হয়েছে অভিশাপ—মরে যাক সেই মা, যে শিশুর জন্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করে এবং তাকে আবর্জনায় ফেলে দেয়। ঘায়ে পচে যাক সেই দুধেল স্তন যা ব্যর্থ ধারায় ভিজিয়ে দিতে থাকবে পোশাক।
তুলসী কাঁদছে। তার নিজস্ব স্তনের মধ্যে প্রায় নীল হয়ে যাওয়া শরীর ঢুকিয়ে ওম্ দিতে দিতে বলছে—ঘুঁটে জ্বালাও। কড়াই চাপিয়ে ছোট খোকার ছোট কাঁথা একটি নিয়ে গরম করো তাড়াতাড়ি।
হরিচরণ দিশেহারা বোধ করছে। তার হাত-পায়ের কাঁপন শুরু হয়েছে এখন। শুধু সমস্ত বোধের ঊর্ধ্বে এটুকুই জাগ্রত আছে—উত্তাপ চাই, ওর জন্য উত্তাপ চাই। শীতের শুষ্ক খটখটে ঘুটে দ্রুত পোড়াচ্ছে নিজেকে, বুঝি-বা সেও উদ্গ্রীব যাতে শিশুর উত্তাপ পেতে দেরি না হয়। কড়ায় কাঁথা গরম করে তুলসীর হাতে দিয়ে হরিচরণ জিজ্ঞাসা করছে—ও বাঁচবে তো?
—সন্তোষী মা’র কৃপা—ওকে মা’ই পাঠিয়েছেন আজ। তুমি কি জানো এই বাচ্চা কী?
—না!
—আমি দেখে নিয়েছি, এ আমাদের মেয়ে গো। আমাদের বিটিয়া। সন্তোষী মা’র কাছে আমি তো বেটি চেয়েছিলাম। তুমি দেখো ও ঠিক বাঁচবে। একটু গরম হলে ওকে আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
বাসি বিছানায় ঘন হয়ে বসে থাকল তুলসী আর হরিচরণ। উত্তপ্ত কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে নিল শিশুটিকে। দেখতে থাকল অপলক। নীল রং একটু কি ফিকে হচ্ছে? দু’টি উদ্বিগ্ন মানুষকে ঘিরে ঘুমিয়ে আছে আরও পাঁচটি মানুষ সন্তান। ধীরে ধীরে সূর্য উঠছেন। আজ এই অনন্তকালের মধ্যে প্রথম অরুণ সেনের ছাদে লাফিয়ে উঠে সমস্ত উত্তাপ নিয়ে তিনি নেমে এসেছেন হরিচরণের গৃহে। শিশুটি ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে। মিহি স্বরে ডাকছে যে প্রকৃতপক্ষে তার মা—তাকে। লাফিয়ে উঠেছে হরিচরণ—কাঁদছে গো কাঁদছে। তার মানে বেঁচে যাবে বলো? ডমরুর মা, মেয়ের কী নাম রাখব জানো? সীতা। কেমন? সীতাকে কি এ ভাবেই কুড়িয়ে পায়নি জনক? বলো?
ঝাম্রে ওঠে তুলসী। ফুঁসে ওঠে—না। কখনও না। ও কথা আর মনেও আনবে না তুমি। সীতা নামের মেয়েরা সুখী হয় না তা জানো?
—তা হলে কী নাম হবে ওর? ডমরুর মা? জানকী?
—না। জানকীও না। ওর নাম সন্তোষী। সন্তোষী মাঈ ওকে দিয়েছেন। তাই ও সন্তোষী। বুঝলে?
তুলসী মেয়েকে বুকে চাপে। তার শীতল নীলচে কপালে ঠোঁট ছোঁওয়ায়। আর বাধ্য ছেলের মতো এই দৃশ্য দেখতে দেখতে মাথা নাড়ে হরিচরণ। ঠিক। ঠিকই তো। মেয়ের নাম সন্তোষীই হওয়া উচিত। তুলসী কখনও ভুল বলে না। সে প্রশ্ন করে—বাচ্চাদের তুলে দিই ডমরুর মা?
তুলসী বলছে—সবাইকে না। শুধু ডমরুকে তোল তুমি। সবাইকে তুললে এক মহা হট্টগোল বেধে যাবে। ডমরু সমজদার। ওকে আমি বুঝিয়ে বলব, তারপর বাচ্চা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। তুমি দেখো পাশে কৃষ্ণকে পাও কিনা। ওর রিকশা নিয়ে চলে আসতে বলো।
হরিচরণ যন্ত্রের মতো তুলসীকে পালন করে গেল। কৃষ্ণকে জাগিয়ে তুলল তার ঘরে গিয়ে এবং কৃষ্ণ রিকশাওয়ালা থেকে শিবতোষ ডাক্তার থেকে হর মুদিওয়ালা থেকে সমস্ত মাথুরের গড় জেনে গেল সাতকন্যার বাড়ির কাছে আবর্জনার স্তূপে একটি শিশুকন্যা কুড়িয়ে পেয়েছে হরিচরণ। ডাক্তার শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু তার আগে বলেছেন থানায় যেতে। কারণ বেওয়ারিশ কুকুর বেড়াল তুলে তুমি ঘর ভর্তি করে দাও কেউ কিছু বলবে না কিন্তু বেওয়ারিশ মানুষের বাচ্চা তুলে ঘরে নেবার অধিকার তোমার নেই। সে তুমি যত ভালবেসেই তাকে নাও না কেন।
তুলসী বলল—এখন ওকে থানায় নিয়ে তারপর হাসপাতালে গেলে, ও তো মরেই যাবে ডাক্তারবাবু।
শিবতোষ বললেন—তা যেতে পারে। তবু তোমাদের থানায় জানানো দরকার।
হরিচরণ কী করবে ভেবে পেল না। ডাক্তারের বাড়ির সামনে ছোট ভিড় জমে গেছে, সকলেই শিশুটিকে দেখতে চায়। কার শিশু, এটা চিহ্নিত করাই তাদের প্রথম লক্ষ্য। হরিচরণ সে-দিকে তাকাল একবার। দেখতে পেল মুখে শ্বেতী ভর্তি সেই মুসলমানবাবুকে, যে কলেজে পড়ায়। সেই মুখে অন্যদের মতো ঔৎসুক্য নেই, আছে বেদনার কয়েকটি অসামান্য আঁচড়, যা দেখে মানুষের জন্য মানুষ আছে বলে ভরসা জাগে এবং সেই ভরসায় হরিচরণ ভিড়ের মধ্যে এসে বলে।—আমি এখন কী করব বাবু!
আনিসুজ্জামান হরিচরণের বাহু স্পর্শ করেন, বলেন—একটু অপেক্ষা করো। আমি কয়েকজনকে ডাকছি।
সমস্ত ভিড় আনিসুজ্জামানের দিকে ঘুরে যায়। এই মুহূর্তে আনিসুজ্জামান হয়তো-বা এই শিশুটির বিধাতা।
হরিচরণ ডাক্তারের ঘরে ফিরে যায়। শিবতোষ যতটুকু সম্ভব পরিচর্যা করেছেন। এর বেশি করার সাধ্য তাঁর নেই, অপেক্ষা করা ছাড়া তিনি আর কী-বা করতে পারে। ডাক্তারি পড়ার সময়, শিশু ফেলে যাবার ঘটনা তিনি অনেক দেখেছে। তাঁর কাছে আবেগ ততখানি জরুরি নয় যতখানি থানার অনুমোদন। হরিচরণ জানালা দিয়ে দেখতে লাগল দ্রুত চলে যাচ্ছেন আনিসুজ্জামান। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সত্যিই কি সন্তোষী মা এভাবেই মেয়ে পাইয়ে দিলেন? হরিচরণ ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে এখন। সে যখন শিশুটিকে বুকে তুলে নেয় তখন পুলিশের কথা ভাবেনি। হাসপাতালের কথা ভাবেনি। কোর্ট-কাছারি করতে হবে, এ কথাও জানত না। একটি প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ছুটে গিয়েছিল তুলসীর বুকের উত্তাপের কাছে। হরিচরণ বুঝতে পারছে না এভাবে বাচ্চা পাইয়ে দেবার পেছনে ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে! আস্তাঁকুড় থেকে তুলে আনা বাচ্চা বাঁচানোর চেয়ে, হরিচরণের মনে হয়, তুলসীর গর্ভজাত পাঁচটি সন্তান বাঁচানো অনেক সহজ ছিল। সে দু’টি ভীত অসহায় চোখ মেলে তুলসীর দিকে তাকায়। তুলসী শিশুটির ঘুমন্ত শরীরের তাপ অনুভব করতে করতে চোখের ভাষা পাঠিয়ে দেয় হরিচরণের দিকে—ভয় পেয়ো না। ভগবানকে ডাকো। তিনি দিয়েছেন, তিনিই রক্ষা করবেন। আমরা তো কোনও অন্যায় করিনি। পাপ করিনি।
পাপ, পাপ—ধ্বনিত হচ্ছে লোকমুখে। সন্দেহ ছড়িয়ে যাচ্ছে জটিল আবর্তে এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে। পাপ-পাপ। কার পাপ! কে করেছে এমন কাজ! যার গৃহে বয়স্থা অনূঢ়া মেয়ে নেই তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। যাক বাবা, আমাদের যে নয় তা সবাই বুঝবে। যার গৃহে তেমন মেয়ে আছে, সে বুঝি কলেজে যায়, স্কুলে যায়, দিবস-রাত বাবা-মায়ের চোখের সামনে থাকে, তবু সেইসব গৃহ সন্দেহে বিদ্ধ হচ্ছে। সে বাড়ির মা-পিসিরা শুকনো মুখে বসে আছে। তাদের মেয়ের নয়। ভাগ্যিস তাদের মেয়ের নয়! কিন্তু যদি হত! যদি হয়। সকাল সকাল এই পাপের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে ছটফট করে তারা এবং মেয়ের বিবাহের জন্য বাপকে তাড়া দেয়। সঙ্গে সঙ্গে খোঁজও করে। কার পাপ, কার পাপ? কে? কে? কোন মেয়েকে দেখা যায়নি গত কয়েক মাস? কোন মেয়ের মায়ের চোখের তলায় কালি? ‘সাতকন্যা’র নয়? ‘সাতকন্যা’র মা নয়? মেয়ে নয়? ওদের বাড়িতে অনেক মেয়ে আছে। কেউ যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে হঠাৎ এবং বলে—আহা! এ পাড়ার কেউই হবে তার কী মানে? অন্য কোথাকার কেউ যে ফেলে যায়নি, তাই-বা কে বলবে! নিজের বাছাকে কেউ নিজের বাড়ির কাছে ফেলে রাখে? যদি চোখের সামনে কুকুর টেনে নিয়ে যায়? যদি চিল শকুনে ছোঁ মারে!
—ছাড়ো ও সব। বাচ্চাকে যে ভাগাড়ে ফেলে দেয় সে তো কুকুরের ভোগ দেবার জন্যই ফেলে। অতই মায়া যার, সে তো ফেলবেই না। কেন যে এরা দশ মাস ধরে রেখে দেয়! ফেলেই যদি দেবে তো আগে ফেললেই পারে!
মন্তব্য চলে। সমালোচনা চলে। আর আলোচনা করতে থাকেন কয়েকজন। আনিসুজ্জামান বিকাশকে ডাকেন। বৃত্তান্ত বলেন। লক্ষ্মী বিকাশকে আড়ালে ডেকে বলেন—ছি ছি, এ সব নোংরা ব্যাপারে যেয়ো না।
জিনি বলে বসে—নোংরা কেন মা? বাচ্চাটাকে বাঁচাতে তো হবে।
লক্ষ্মী অপ্রীত মুখ ঘুরিয়ে নেন পুত্রবধূর দিকে। বলেন—তোমার কাছে আমাকে শিখতে হবে। নাকি?
জিনি মাথা নিচু করে। বিকাশ ঘরের আধময়লা চাদর ছেড়ে একটি ভাল চাদর গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়েন আনিসুজ্জামানের সঙ্গে। পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসেন রণেন, সমরেন্দ্র, মিথিলেশবাবু সেতারিস্ট ও তাঁর স্ত্রী, ওপর থেকে নেমে আসেন নীলিমা। অভিজ্ঞ প্রৌঢ়দের ঘিরে দাঁড়ায় কাজল সুজন মৃণ্ময় অমিতাভ—তাদের চোখে পিচুটি লাগা, গালের হাড়ে ক্ষয়। নেশাগ্রস্ত ঘুম ছাড়িয়ে তারা বিছানা ছেড়ে এসেছে একটি শিশুর জন্য। এখন আকাশে আকাশে ধ্বনিত হচ্ছে—পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। একটি শিশু পাওয়া গেছে আস্তাকুঁড়ে। কোথায়! কে পেল!—হরিচরণ পেয়েছে। ময়লা পরিষ্কার করতে এসে পরিত্যক্ত শিশু বুকে তুলে নিয়েছে হরিচরণ জমাদার। কার শিশু? কার শিশু? উত্তর উঠছে—জানি না জানি না জানি না—না না না—কন্যা কন্যা কন্যা—সাত কন্যা সাত কন্যা, সবারই মনে সাত কন্যা উঁকি দিচ্ছে। কারণ ওদের কেউ ভাল করে জানে না। ওরা মেশে না কারও সঙ্গে। ওরা আলাদা। রহস্যময়। আর ওদের বাড়িতে অনেক মেয়ে।
চলে এসেছে শ্যামল-কমল। চলে এসেছে দেবাশিস—মাকে অমান্য করে। এসেছে মানোদা ঝি, অন্ধর মা, মকবুল, সুধীর পাল, গোপাল কুণ্ডু, এসেছেন কংগ্রেস নেতা অনিল সামন্তর ডান হাত বাসুদেব পোদ্দার, এসেছেন সি পি এম নেতা শ্যামাকান্ত আর তাঁর ভাই তপন, এসেছে কালীতারা, পঞ্চা মুদি, হর মুদি। উকিল নগেন মিত্তিরও। আর এসেছে ঘুঁটে কুড়ানি ফুলরেণু, অনুপম, দেবোপম, পরেশবাবু, হিরণ, এমনকী রাজেশ্বরী হোটেলের ম্যানেজার বিনয় ধাড়া পর্যন্ত। জেগে উঠেছে সারা মাথুরের গড়। ভাবছে সারা মাথুরের গড়। শিশুটি কার এ বিষয়ে কোনও ঐকমত্য নেই। আস্তাঁকুড়ের শিশু। এক টুকরো ছেঁড়া প্রাণ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে তুলসীর বুকে। সে জানে না সে বাঁচবে কি না। কিন্তু অন্য সব লোক, একমত হয়ে, এক জোট হয়ে ভাবছে—বাঁচাতেই হবে। শিশুটিকে বাঁচাতেই হবে। আর হরিচরণ যদি চায়, তাকে রাখতে, নইলে পুলিশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে পৌঁছে দেবে অনাথ আশ্রমে। হরিচরণের পিতৃত্ব ভিড়ে মিশে আছে। সে চড়া স্বরে বলছে—আমি রাখব। আমি নেব। ও আমারই আছে। আমারই হচ্ছে। আমার বউ ওকে নিজের মেয়ে ভেবে, ঈশ্বরের দান ভেবে বুকে নিয়েছে। ওকে আপনারা কেড়ে নেবেন না হু-জৌ-র…
সমস্ত ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে একসঙ্গে—মেয়ে বুঝি? মেয়ে? ও মেয়ে?
সন্দেহ কুমারী মাকে ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে বিবাহিতা মায়ের ওপর। তার স্বামী-শাশুড়ি-শ্বশুরের ওপর। মেয়ে বাচ্চা? মেয়ে? মেয়ে বলেই কেউ ফেলে দিয়ে যায়নি তো?
তখন, কপিলার পেট করে দেওয়া নগেন মিত্তির বলছে—ভয় পেয়ো না হরিচরণ। কোর্ট থেকে যাতে অর্ডার পাও সে আমি দেখব।
৩৮
যেমন হয়ে থাকে বিয়ের পর, যেমন নিয়ম, ঘর ছেড়ে যাওয়া, বা প্রকৃত অর্থে ঘর ফেলে যাওয়া কন্যার জন্য মন-কেমন-করা, আশঙ্কায় জর্জরিত এবং ও সুখে থাকুক এমনই অভিপ্রায়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনারত তেমনই জিনির মা জিজ্ঞেস করেছিলেন—জিনি, তুই সুখী তো?
জিনি বলেছিল—হ্যাঁ, মা।
—সত্যি তো?
—সত্যি মা। সুখী।
দাদারা বলেছিল—জিনি, এত রোগা লাগে কেন তোকে?
—আমি তো রোগাই বড়দা।
—চোখের নীচে যেন কালচে-কালচে লাগে।
—ও তোমার চোখের ভুল। চশমার কাচ কতদিন পাল্টাওনি বলো তো?
—তুই যেন আর আগের মতো হাসিস না জিনি।
—আহা! তোমরা হাসাচ্ছ না তাই বলো মেজদা। সবাই সারাক্ষণ গোমড়া মুখ করে কাজ করছ!
—জিনি, তোর কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?
—না। কোনও অসুবিধা নেই বড়দা।
বড় বউদি বলেছিল—হ্যাঁ রে, তোকে ভালবাসে?
জিনি লাল হয়ে যায়। তার চোখের তলার মৃদু কালি আরও কালো হয়। সে বলে—ও বউদি! আমি জানি না।
মেজ বউদি বলে—তোর শাশুড়ি কেমন রে জিনি?
—বেশ, মেজবউদি।
—তোর বউ-ভাতের দিন কত সেজেছিলেন! হ্যাঁ রে, খুব মডার্ন, না?
—হ্যাঁ। খুব।
—তোর সেই দেওরের কথা-টথা বলেন? কাঁদেন?
—না। শুনিনি এখনও বউদি। তবে শ্বশুরমশাই বলেছেন।
—যাই বল, তোর শাশুড়িকে দেখলে বোঝা যায় না কিন্তু অত বড় শোক পেয়েছেন।
—সেই তো ভাল, বউদি। শোক কি মানুষকে দেখিয়ে বেড়াবার জিনিস? ও তো লুকিয়েই রাখতে হয়। ঢেকেই বেড়াতে হয়।
—কিন্তু অত বড় ছেলের শোক, চেহারায় ছাপ থাকবে না?
—মুখ দেখে কি কিছু বোঝা যায় বউদি?
—যায় না বুঝি?
—না। কেউ যদি মনে করে মুখে তার মনের বিপরীত ভাবটি ফুটিয়ে রাখবে তবে সে তা করতেই পারে।
—আমাদের জিনিও তা করছে না তো?
—কী?
—নিজের মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছে না তো? মিছিমিছি ভাব দেখাচ্ছে না তো?
—না, বাবা, না। তোমার বুঝি জানা নেই আমি কেমন? তুমি বুঝি চেনো না আমাকে?
—চিনি বলেই তো বলছি। আমার যেন কোথায় কম লাগছে জিনি।
—কী কম?
—প্রাণ।
—কেন?
—নতুন বিয়ে করেছিস, কোথায় বরের পিছু পিছু ঘুরবি, না, কেমন সব আলগা আলগা।
—তুমি বুঝি মেজদাদার পিছু পিছু ঘুরতে! কই! আমি তো দেখিনি!
—ঘুরতাম বৈকি বাপের বাড়ি গেলে। তোমার মেজদাদাকে নিয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম আমার ইস্কুল, খেলার মাঠ, বন্ধুর বাড়ি—সব জায়গায়।
জিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—আমিও যাব। বিকেলে।
এখন নিজেকে প্রশ্ন করছে জিনি—কেমন আছ?
—ভাল।
—সত্যি?
—হ্যাঁ সত্যি।
—তা হলে? এখন তোমার চোখে জল আসছে কেন?
টিভি চলছে বসার ঘরে। কোনও হিন্দি সিরিয়াল। এ এক রবিবারের দুপুর। বিকাশ চলে গেছেন নিজের ঘরে। যা আসলে দেবার্চনের ঘর। বই পড়ছেন। দেবাশিস টিভি দেখছে। জিনি টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে না। লক্ষ্মী ছেলের পাশে বসে শাড়ি তুলছেন। শাড়ি পায়ের গোছ ছাড়াল। হাঁটু ছাড়াল। সাদা ভারী ঊরু বেরিয়ে পড়ল। বলছেন—টিভির সাউন্ডটা ভাল না।…তাঁর হাতে কুকুম্বার লোশন। সরাসরি শশা ছেঁচে রস নেওয়া এমনই বিজ্ঞাপন থাকে লোশনটির। টিভিতে। লক্ষ্মী শশার লোশন মাখছেন পায়ে। উইন্টার কেয়ার। জিনি তাকাতে পারছে না। তার চোখে শীত করছে। লক্ষ্মীর আঁচল খসে পড়ল। তিনি গ্রাহ্য করছেন না, বলছেন—টিভির সাউন্ডটা বেশ খারাপ। কী বল্? খাবলা খাবলা শশার নির্যাস মাখছেন। শীতের বিরুদ্ধে লড়াই। শীতেরই বিরুদ্ধে? নাকি জরার বিরুদ্ধেও? ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে। পা ডলছেন তিনি। ঊরু ডলছেন। বুকের খাঁজ সমেত উপত্যকায় কোনও আড়াল নেই। জিনির কষ্ট হচ্ছে। চোখে জল আসছে। সে ভাবছে উঠে যাবে কি না। যেতে পারছে না। যদি ভাবে সবাই, তার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগা প্রকাশ করতেও লজ্জা, ভয়। মানিয়ে নিতে হবে। সব মানিয়ে নিতে হবে। মা আর ছেলে। এর মধ্যে দোষ কী? আড়াল কী? মা-ছেলের সম্পর্কে কাল বাসা বাঁধে না। বাসা বাঁধে না কোনও ক, কোনও কু। এমনকী অন্য কোনও মস্তিষ্কও এ বিষয়ে মৌনী থাকে। মা-ছেলে ছেলে-মা পবিত্র-পবিত্র। মা-ছেলে ছেলে-মা স্বর্গ-স্বর্গ-স্বর্গ। কিন্তু মা-মেয়ে মেয়ে-মা তেমন স্বর্গ? তেমন পবিত্র? তেমন নির্দোষ শশার নির্যাস মাখামাখি? দেবাশিস মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। বলছে—কেন? সাউন্ডটা কী খারাপ!
—বেশ খারাপ। তোরা কি যাচ্ছিস?
—হ্যাঁ
—কী দরকার ছিল? এই বিয়েতে এত পয়সা গেল। এখুনি বেড়াতে না গেলেই চলছে না? আমার পিঠে একটু মেখে দে তো।
তিনি লোশন এগিয়ে দিচ্ছেন ছেলের দিকে। ঊরু থেকে নামিয়ে কাপড় আবার যথাস্থানে করেছেন। ছেলে শশার রস মাখাচ্ছে মায়ের পিঠে। মা বলছেন—কী সব যে শুরু হয়েছে। হানিমুন—আমাদের এ সব ছিল না।
দেবাশিস লোশনের বোতল নামিয়ে রাখছে। বলছে—এটা কি হানিমুন নাকি? দশজন মিলে হানিমুন হয়?
জিনির কান গরম হয়ে উঠছে। ইস্, কী আলোচনা!
লক্ষ্মী বলছেন—দশজন মানে কে কে?
—আমি-জিনি। অনুপম আর ওর বউ পুপু। দেবোপম। দেবোপমের বন্ধু অরূপ। আর কাকু-কাকিমা।
—কাকু-কাকিমা মানে পরেশ বোস আর শবরী বোস?
—হ্যাঁ।
—ওঁদের সঙ্গে যাচ্ছ? ওই নোংরা লোকগুলোর সঙ্গে?
জিনি টিভিতে ঢুকে পড়তে চাইছে। ওই পর্দায় যদি একটা দরজা থাকত! যদি সে ঢুকে পড়তে পারত ওখানে।
দেবাশিস বলছে—অনুপম-দেবোপমকে কোথায় খারাপ দেখলে তুমি?
—ভালই-বা কী? যাদের ওই বাবা-মা! আর তোরা-তোরা যাবি সে একরকম। ওদের সঙ্গে যাবার কী দরকার?
—বেড়াতে যাবার আয়োজনটা অনুপমেরই মা। ওরা নাকি গত পনেরো-কুড়ি বছর গোটা পরিবার কোথাও যায়নি। অনুপম সেই ফাঁকটা পূর্ণ করতে চায়। ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পার।
—না বাপু। তোমরা যাচ্ছ যাও। আমার কথা শোনা তো তোমরা বাপ-বেটায় প্রায় ছেড়েই দিয়েছ। সংসারে আমার আর এখন দাম কী? মুখে রক্ত তুলে খাটব আমি, আর কেউ কেউ আয়েস করে দুপুরে ঘুমোবেন। এই তো হয়েছে এখন সংসারের অবস্থা।
জিনির ফের কান্না পাচ্ছে। সে কি সংসারে কিছু করে না? হাত লাগায় না? এ কথা ঠিক, শাশুড়ি তার নাম করে কিছু বলছেন না। তবু জিনি কাতর হয়ে যায়। শাশুড়ির কঠিন শব্দগুলি তার গায়ে বেঁধে। সে ধীরে ধীরে উঠে পড়ে এ বার। পায়ে পায়ে নিজের ঘরের দিকে যায়। শুনতে থাকে লক্ষ্মী বলছেন—তা তোমরা যে যা পারো করো। আমি তো তা বলে নিজেকে বিকোতে পারব না। ওই মেয়েছেলেটার সঙ্গে আমি কিছুতেই কোথাও যেতে পারব না।
দেবাশিস বলল—যোয়ো না। আমি তো জোর করছি না।
—জোর করবে কেন? তোমার তো আর আমাকে প্রয়োজন নেই। তোমারও নেই। তোমার বাবারও নেই।
—তুমি এ সব কী বলছ বলো তো? তোমার কিন্তু কমপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে মা।
—কী বললি? কমপ্লেক্স? ওই মেয়েটা দু’দিনেই তোর মণ্ডু ঘুরিয়ে দিল, না? এতদিন মাকে ছাড়া তোমার ঘুম হত না। এখন বউকে পেয়ে আর মায়ের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না …
জিনি দু’হাতে কান চাপা দিচ্ছে। শুনবে না সে। শুনবে না এ সব। রেকর্ড প্লেয়ারে পঙ্কজ মল্লিক চাপিয়ে দিচ্ছে সে। রেকর্ড ঘুরে ঘুরে বাজছে—দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না— তার চোখে জল আসছে। কেন তিনি এরকম বলেন! কেন এরকম করেন! এ সংসারে তেমন কোনও আশান্তি ছিল না। জিনির মনে হয়, সে যেন এক অশান্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। যেখানে যা-কিছু অসঙ্গতি, তার দায় লক্ষ্মী ছুড়ে দেন জিনির দিকে। সে-দিন পাড়ার জমাদার একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেল, লক্ষ্মী বলতে লাগলেন—আজকালকার মেয়ে সব, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ছেলেদের গায়ে গা লাগিয়ে হাহা হিহি করাই সার। আর এইসব। কী নোংরা যে হয়ে যাচ্ছে দিনকাল।
জিনির খারাপ লেগেছিল। বলেছিল—এভাবে বলবেন না। আগে যখন মেয়েরা পরপুরুষকে মুখও দেখাত না তখনও ভ্রূণহত্যা হত। অবৈধ সন্তান জন্মাত। চিরকালই তা হয়েছে। এমনকী ধর্মযুদ্ধের কালেও। আপনি সীতার কথা ভাবুন, শকুন্তলার কথা ভাবুন, কর্ণ তো সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
ফুঁসে উঠেছিলেন লক্ষ্মী—তুমি আমাকে এত বড় অপমান করলে? কী ভাবো তুমি? এম এ পড়িনি বলে আমি কিছু জানি না?
জিনি অবাক হয়ে বলেছিল—আমি তো অপমান করিনি।
—করোনি? করোনি? বলোনি আপনি মুর্খ?
—কখন বললাম?
—যা বললে তাতে তাই দাঁড়ায়।
লক্ষ্মী কাঁদছেন। জিনি বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। লক্ষ্মী ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘরে গিয়ে দোর দিলেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। জিনি বোকার মতো বসে ছিল কিছুক্ষণ। কোন কথার কী মানে হয় সে বুঝতে পারছিল না। তার নিজেকে ছোট লাগছিল, নিচু লাগছিল। কেন মিছিমিছি তর্ক করতে গেল? কোনও লাভ আছে এ সবে! সে কি ঝগড়াটে হয়ে যাচ্ছে? সে টের পায় শাশুড়ির কাছে সে গ্রহণীয় হয়নি, মাঝে মাঝে মনে হয় সহনীয়ও না। কেন? জিনি জানে না। কিন্তু যুদ্ধ এড়াতে চায়। সে মনে মনে ঠিক করছিল সে আর কথা বলবে না। কিছুই বলবে না।
সন্ধের পর প্রথমে বিকাশ ফিরলেন। তারপর দেবাশিস। রাত দশটার আগে লক্ষ্মী বিছানা ছাড়লেন না। সারা বাড়ি থমথম করতে লাগল। দেবাশিস কড়া গলায় বলল—যাও। ক্ষমা চাও মা’র কাছে।
জিনি বলল—কীসের ক্ষমা?
—মাকে কী বলেছ?
—কিছু না।
—মা মিথ্যে বলছেন?
—আমি মাকে কোনও খারাপ কথা বলিনি।
—কিন্তু মার খারাপ লেগেছে। তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে জিনি।
—তা হলে তুমি ধরে নিচ্ছ আমি মথ্যে বলেছি, তাই না?
—তুমি ক্ষমা চাইবে কি না? আমার মা ভীষণ ভাল। মা’র কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না। যাও যাও—
—আমি কিছু বলিনি। সামান্য কথা নিয়ে মা … বেশ আমি ক্ষমা চাইছি। চলো।
জিনি লক্ষ্মীর ঘরে গিয়েছিল। বলেছিল—আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার খারাপ লাগবে আমি বুঝতে পারিনি।
তার হয়তো বলার কথা ছিল, কী আপনার খারাপ লাগবে আমি বুঝতে পারি না।
লক্ষ্মী উঠেছিলেন। কান্নাভেজা ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে রাত্রের খাবার পুরোটাই খেয়েছিলেন। সেদিন রাত্রে দেবাশিস কিছুতেই জিনিকে রাজি করাতে পারেনি। সে প্রায় খেপে গিয়েছিল। উন্মত্তের মতো জিনির রাতপোশাক খুলতে গিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু জিনি পারেনি। গভীর অপমানবোধে পাথর হয়ে গিয়েছিল সে। ক্রমশ ভীতু হয়ে উঠছিল। ক্রমশ শীতল। সারা রাত্রি ঘুমোতে পারেনি। সেও। দেবাশিসও। অধিকারবোধ এবং আত্মসম্মানের লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে রাত ভোর হয়ে গিয়েছিল। চোখের তলায় বিপুল কালি নিয়ে চায়ের টেবিলে এসেছিল জিনি আর দেবাশিস। কিন্তু লক্ষ্মীর মুখের কোথাও কোনও অপ্রসন্নতা ছিল না। আর বিকাশ যখন চায়ের টেবিলে এলেন তখন জিনি দেখল তাঁর কপালে লেপটে আছে গুঁড়ো গুঁড়ো সিঁদুর।
জিনি ভাবতে লাগল, তারা সব পুরী যাচ্ছে। অফিসের হলিডে হোম বুক করেছে অনুপম৷ খুব ছোটবেলায় সে একবার বাড়ির সকলের সঙ্গে পুরী গিয়েছিল। সমুদ্রের পারে খেলতে খেলতে একটি সুন্দর বেগুনি রঙের গোটা ঝিনুক সে কুড়িয়ে পায়। ঝিনুকের খোল দু’টো কিছুতেই খোলা যাচ্ছিল না। সে যখন একমনে খোলার চেষ্টা করছে তখন হঠাৎই একটা লোক এসে তার হাত থেকে ঝিনুকটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সে-দিনও খুব অপমানিত লেগেছিল জিনির। সবটা অপমান সে বুকের তলায় লুকিয়ে ফেলেছিল। কোনওদিন কারওকে বলেনি। প্রাপ্য সম্মান যখন পায় না কোনও মানুষ, প্রাপ্য অধিকার যখন কেউ কেড়ে নেয় তখন মানবতায় এই অপমানবোধ জাগে। তার তলায় থাকে নিজের দুর্বলতার প্রতি করুণা। তারও তলায় আত্মধিক্কার। এই ধিক্কার বিপক্ষ শত্রুর মতো মুখোমুখি হয় আত্মসম্মানবোধের। দু’জনের যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধের নাম বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দিয়ে আগুন জ্বালা যায়। পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া যায় শ্যাওলাপড়া বোধ। আবার সমস্ত বিদ্রোহের শীতল অভিব্যক্তিও বিরল নয়। তার নাম আত্মপীড়ন।
দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল রবিবার আর একটা নতুন সোমবার এসে পড়ল। রবিবার সবাই ঘরে থাকেন বলে দিনটাকে একটু অন্যরকম লাগে। কিন্তু সোমবার থেকে সব বড়ই শ্লথ ও গতানুগতিক হয়ে যায়। চারটে-সাড়ে চারটে পর্যন্ত একা থাকে জিনি। বিকাশ, দেবাশিস, লক্ষ্মী—সবাই বেরিয়ে যান। জিনির কোথাও যাবার নেই। পিসির বাড়িতে গিয়েও লাভ নেই কারণ তিনি কলেজে চলে যাবেন। অন্ধর মা ঘুরে ঘুরে আসে। এটা-ওটা কাজ করে। জিনি টুকটাক কথা বলে অন্ধর মা’র সঙ্গে। বেশ লাগে জিনির, অন্ধর মা মানুষ ভাল। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলার পর কথা ফুরিয়ে যায়। সে তখন কবিতার বই খোলে। কিংবা ডিকেন্স পড়ে। ডিকেন্স তার এত প্রিয় যে এক-একটি বই সে বহুবার পড়েছে। কখনও গান শোনে। গান গায়ও। তার সময় কেটে যায়। সাড়ে চারটে নাগাদ লক্ষ্মী ফেরেন। আজও ফিরলেন। একটু পরেই তাঁর ঘরে ডাক পড়ল জিনির। জিনি গিয়ে দেখল, আয়নার কাছে শায়া আর ব্রা পরে বসে আছেন লক্ষ্মী। সে তাড়াতাড়ি, ভুল সময়ে ঢুকে পড়েছে ভেবে ফিরে আসছিল। লক্ষ্মী ডাকলেন—চলে যাচ্ছ কেন?
জিনি দাঁড়াল। লক্ষ্মী বললেন—ব্রা-এর স্ট্র্যাপটা খুলতে পারছি না। একটু খুলে দাও তো।
জিনি হুকে হাত রাখল। লক্ষ্মী বললেন—দেখেছ, আমার বুকটা এখনও কত ভাল আছে? তোমার এ বয়সেই কী অবস্থা! এই ব্রা-টার দাম জানো? চল্লিশ টাকা। দামি ব্রা ছাড়া আমি পরতেই পারি না।
জিনি নীরবে শুনে চলল। এ কথার কোনও উত্তর হয় কিনা সে জানে না। শুধু টের পায় এ পরিবারে অদৃশ্য ছায়ার মতো সারাক্ষণ প্রাকৃতশরীর খেলে বেড়ায়। তার অবসাদ আসে। একটু আলোর জন্য, হাওয়ার জন্য প্রাণ ছটফটায়। সে হুক খুলে দিয়ে বেরুনোর উদ্যোগ নেয়। লক্ষ্মী বলেন—বোসো, তোমাকে দু’টো কথা বলি। সবসময় মনে রাখবে, পুরুষমানুষকে কখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে নেই। আর জেনে রাখবে, স্বামীকে বশে রাখতে হলে শরীরটা ঠিক রাখা দরকার।
জিনি অপলক চেয়ে রইল শাশুড়ির দিকে। তিনি এখন ব্লাউজ পরছেন। মাথা দিয়ে অন্য একটি শায়া গলিয়ে আগের শায়াটি ছেড়ে ফেলছেন। শাড়ি টেনে নিলেন আলনা থেকে। কুঁচি দিচ্ছেন। বলছেন—আজ স্কুলে যাচ্ছি। একটা লোক আমার পেছন পেছন গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে গেল। আমাকে দেখলে তো বোঝা যায় না আমার বয়স কত! আমার পেছন-টেছনগুলো দেখেছ? এখনও কী দারুণ!
জিনি হাসার চেষ্টা করছে। সম্মতির হাসি বা ভদ্রতার। দু’টোই এই মুহূর্তে কঠিনতম তার পক্ষে। শাশুড়ি আজ তাকে এরকম অঙ্গসৌষ্ঠব প্রদর্শন করছেন কেন সে জানে না। তার পক্ষে পুরোটাই অস্বস্তিকর। সে মাথা নিচু করছে। লক্ষ্মী বলছেন—তোমাকে দেখলে কিন্তু বয়সের তুলনায় অনেক বেশি লাগে।
জিনির কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে এত ছোট করছেন কেন লক্ষ্মী! পুরুষকে বিশ্বাস কোরো না পুরোপুরি। তার মানে কি তিনি বিকাশকে বিশ্বাস করেন না? তার মানে কি তিনি দেবাশিসকে অবিশ্বাস করতে শেখাচ্ছেন না? বিকাশ আর দেবাশিস কি নিজেদের অজ্ঞতে লক্ষ্মীর দ্বারা অপমানিত হচ্ছেন না? কারওকে অবিশ্বাস করলে কি কিছুই পাওয়া যায়, বিশ্বাস করলে যা পাওয়া যায় তার তুলনায়? হ্যাঁ। বিশ্বাস করলে ঠকতে হয় কখনও কখনও। কিন্তু জীবনের সামান্য যা-কিছু প্রাপ্তি তা বিশ্বাস থেকেই উঠে আসে। অবিশ্বাসের ফলাফল চিরকালই শূন্য।
শরীর শরীর শরীর! কী আশ্চর্য বোধ। স্বামীকে ধরে রাখতে গেলে শরীর ধরে রাখতে হবে। ঊরুর কাপড় তুলে মাখতে হবে শশার রস। মেধা নয়, বুদ্ধি নয়, রুচি নয়, শিল্পবোধ নয়, নয় কোনও গুণ বা সৃষ্টিশীলতা—একজন শিক্ষিত শিক্ষয়িত্রী নারী আপন আত্মজাতুল্য শিক্ষিত একটি মেয়েকে পরামর্শ দিচ্ছেন—স্বামীকে ধরে রাখতে গেলে শরীরটি ধরে রাখা দরকার। যেন কোনও তওয়ায়েফ দীক্ষা দিচ্ছে শিষ্যাকে। কিংবা রূপোপজীবিনী শুনিয়ে দিচ্ছে মূল মন্ত্র। জিনি আয়নায় নিজেকে দেখে। রোগা। ফরসা। ছিপছিপে একটি শরীর। এ শরীরের নবতম মূল্যায়ন ঘটছে এখন। সে ভাবছে—আমি কে? আমি কী? আমি কি একটা শরীর?
৩৯
ফিসফিস করে বলল ময়না। দু’চোখ গোল পাকিয়ে, নীলিমার প্রায় কানের কাছে এসে— আমাদের মতন না। কাজ-কাম করে নাই কুনোদিন। ভদ্দর লোক গো। স্বামীতে আইনা বস্তিতে ফ্যালছে। খোঁজ ন্যায় না।
নীলিমা রাধিকার দিকে তাকান।
বুকে বাচ্চা সামলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাধিকা। বাবুদের বাড়ি কাজ করতে আসা—সে কি কখনও ভেবেছিল? বাবুদের বাড়ি! সে তো বাবু বলতেই শেখেনি কারওকে। বাবু ভাবতেও শেখেনি। সে জানে সে গরিব। তাদের পয়সা নেই। সে জানে সে নিঃস্ব। তাকে সংযত থাকতে হয়। চাইতে হয় না। সে এ সব জানে কিন্তু ভদ্দরলোক ছাপটা নিজের মন থেকে সরাতে পারে না। বস্তির মেয়েরা যা করে, যে-ভাবে বাঁচে, সেও সে-ভাবে বাঁচতে এসেছে। সেই কাজ করতে চেয়েছে, তবু সে যেন কোনওভাবে ময়না নয়। কালীতারা নয়। অন্ধর মা নয়। সে ভদ্দরলোক, তাই সংযত। তাই লোভ করে না। পয়সা না থাকলে কিছু চাইতে নেই। পৃথিবীর ভাল কিছুর প্রতি, সুন্দর কিছুর প্রতি নজরই তুলতে নেই। যা অর্জন করতে তোমার ক্ষমতা কুলান দেয় না তার প্রতি চোখ তোলার অধিকারও তোমাতে বর্তায় না। সুস্বাদের বস্তু, ভাল বস্তু, আনন্দের বস্তু—যতটুকু আপনি এসে ধরা দেয়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকো। যদি ধরা না দেয় তবেও ক্ষোভ কোরো না একথা মনে করে যে এই তোমার ভাগ্য। কখনও কিছু চাইলে কাকি বলত— কত সাধ লয় গো চিতে/ মলের আগে চুটকি দিতে। শেফালির মা বলত—
এই দিক নাই ওই দিক আসে
তিন কোনা নাই তার মুশইর আসে।
স্বপ্ন দেখার, প্রত্যাশা করার যতটুকু অবকাশ ছিল ছেঁটে ফেলেছে রাধিকা। নিজের শ্রেণী ও অবস্থান সম্পর্কে তার এটুকুই উপলব্ধি যে সে গরিব। কিন্তু ভদ্রলোকের তকমা ফেলে কী করে? বড় দিদিমণির বাড়িতে যখন ঝিয়ের মতো খাটত শেফালির মা তখন সেও বিদ্ধ হত কষ্টে। বলত—দ্যাশেও কষ্ট করসি। গায়ে লাগে নাই। অখন যারে কয় :
জন্ম গ্যালো কর্ম করতে করতে
দুই হাঁটু গ্যালো স্যালাম পাড়তে পাড়তে।
মাঝে মাঝে বড় দিদিমণির ওপর রাগ করে এ রকমই একটুখানি ক্ষোভ প্রকাশ করত শেফালির মা। রাধিকা নিরন্তর শেফালির মা’র সহনশীলতা স্মরণ করে এবং নিজের সহনশীলতাকে প্রশ্রয় দেয়। এখন মানুকে দেখে, অন্ধর মাকে, ময়না, কালীতারা, টেঁপির মাকে দেখে তার মধ্যে নতুন একটি দর্শন তৈরি হচ্ছে। বাবুদর্শন। এইসব দালানবাড়ি, কোঠাবাড়ির লোকেরা তবে বাবু! এইসব দেওয়াল ভর্তি বই ও ফ্রিজ আছে, রেকর্ড প্লেয়ার আছে, সম্প্রতি একটি ছোট্ট টিভি কিনেছেন নীলিমা, টিভি আছে, লোকেরা তবে বাবু! আর বস্তিতে যারা থাকে, তারা কী? নিরক্ষর, ভাঙা ঘরের বাসিন্দা, অতীত-ভবিষ্যৎ খোয়ানো পরের বাড়ি বাসন মেজে খাওয়া মানুষরা তবে কী? রাধিকা কী? রাধিকা জানে না। সে শুধু নিজের মধ্যে শক্ত হতে হতে জিয়নকাঠির সন্ধান করে। এতদিন অভাবে অনটনে না খেয়ে মরার আগে, ভিক্ষাবৃত্তি করার আগে করুণা সিঞ্চন করে তাকে আর তার সন্তানদের আগলে রেখেছিল শেফালির মা। সে সম্ভব ছিল এক পরিবারের মতো একই গৃহে তারা বসবাস করত বলে। কিন্তু আর কতদিন? আর কেন? এই ফটিক বিল বস্তি থেকে উদ্বাস্তু কলোনিতে গিয়ে কি শেফালির মাকে বলা যায়—আমার চাল ফুরাইসে। পলাশরে যে কী খাইতে দিমু? রাধিকা নিজের মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব টের পায়।
নীলিমা একটু বিপন্ন বোধ করেন। তাঁর রান্নার লোক চাই। রাধিকাকে দেখে তিনি বুঝতে পারছেন সে আর পাঁচটা বস্তির লোকের মতো নয়। তবু তার বস্তিতে গিয়ে পড়া—ময়নার কাছে যতখানি বিস্ময়ের হোক—নীলিমার কাছে নয়। নীলিমা জানেন এরকম হয়। এরকম হওয়া সম্ভব। তিনি নিজে কি কখনও ভেবেছিলেন চাকরি করে তাঁকেই সংসার প্রতিপালন করতে হবে? নীলিমা রাধিকার প্রথম কাজ করতে আসা নিয়ে একটুও বিচলিত না হয়ে বরং তার শিশুটি নিয়ে বিপন্ন বোধ করেন। শিশু বুকে করে রাধিকা কী করে রান্নার কাজ সম্পন্ন করবে! সরাসরি—তোমাকে দিয়ে হবে না—বলতেও খারাপ লাগছে নীলিমার। মেয়েটির কাজ পেলে সুবিধে হয়। তিনি বলেন,—তোমার নাম কী?
—রাধিকা।
—কী করেন তোমার স্বামী?
—কাঠের মিলে কাজ করেন।
—তুমি বাঙাল?
—হ।
—বাড়ি কোথায় ছিল?
—ঢাকায়।
রাধিকা মুখ তুলে দেখছে না। কিছুই দেখছে না। শুধু উত্তর দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। বাড়ি কোথায় ছিল তার? ঘর কোথায়? এই অসামান্য প্রশ্ন যেন কতকাল পর তাকে করছে কেউ! সে জবাব দিয়ে তৃপ্তি বোধ করছে।
—ঢাকায়? কোন গ্রামে ছিলে?
—খিলপাটনি।
নীলিমার জোর গলা শোনা যায়। বিস্মিত ও আনন্দিত গলা।
—কী বললে? খিলপাটনি? রূপসী নদীর পাড়ে? বুড়ো বটতলায় জাগ্রত শিবমন্দির আছে। যেখানে?
রাধিকার মুখ ওঠে। তারও জোর কণ্ঠ শোনা যায়। বিস্মিত ও আনন্দিত কণ্ঠ—আপনি চিনেন? আমাগো গেরাম চিনেন?
নীলিমা হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়েন—না। চিনি না। কিন্তু জানি। বাবার মুখে অনেক গল্প শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে।
তখন পা ঘষে ঘষে এ ঘরে আসেন তৃণাঙ্কুর। নীলিমা খুশির গলায় বলেন—শোন মান্তু, কী কাণ্ড, এই মেয়েটা খিলপাটনির মেয়ে।
—খিলপাটনি?
তৃণাঙ্কুর সহসা মনে করতে পারেন না।
—আরে আমাদের সেই ঢাকার বাড়ি! তোকে গল্প করিনি? বাবা বলতেন।
—হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেই রূপসী নদী তো? দাদু একবার ডুবে যাচ্ছিল, একটা জেলে পরনের ধুতি ছুড়ে দাদুকে বাঁচায়—।
নীলিমার উৎসাহ বেড়ে যায়। তিনি বলেন—গোস্বামী বাড়ি চেন? এখন অবশ্য কেউ থাকে না। অনেকদিন ধরেই নেই। আমরাই যাইনি কখনও। তুমি না চিনলেও তোমার বাবা নিশ্চয়ই চিনবেন।
রাধিকা বলে—হ। চিনুম না ক্যান? বাড়ি আর নাই। দালানের ইট কয়খান আসিল। তায় লোকে কয় গোস্বামীগো ভিটা। রফিকুল চাচায় কলাইয়ের চাষ দিসিল। ভিটা তোলে নাই। কইত—থাউক। মাটির ইট, মাটিতে মিশ্যা যাউক। আমাগো ভাঙনের কাম কী?
রাধিকা, গ্রাম প্রসঙ্গে, মোহগ্রস্ত হয়ে যায়, ভুলে যায় এই বাড়িতে সে প্রথম এল, এই মানুষগুলির কাছে প্রথম এল। এত কথা বলার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। সে বলে চলে— রফিকুল চাচা বলত, ভিটেমাটি তুলতে নেই, তাহলে অকল্যাণ হয়। হোক ভাঙা, হোক দু’-চারটে ইটই আর পড়ে আছে, কিন্তু ওই ইটের মধ্যে জড়িয়ে আছে কবে বাস করে যাওয়া মানুষগুলির সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার ইতিহাস! কত সফল হওয়া না-হওয়া স্বপ্ন! ভাঙা বাড়ির এইসব ইট কি মানুষের হাড়পাঁজরার মতোই নয়? ধরো, চাষ দিতে দিতে তুমি কোদালের ডগায় হঠাৎ কোনও কঙ্কাল পেয়ে গেলে! সে প্রাণহীন বলেই, হাড়সর্বস্ব বলেই কি তুমি তাকে অস্বীকার করবে! তাকে কি এই বলে সম্মান করবে না যে সে একসময় মানুষের আত্মা প্রাণ শরীর ধরে রেখেছিল?
তৃণাঙ্কুর অপলক তাকিয়ে আছেন রাধিকার দিকে। এ কী সব আশ্চর্য কথা বলছে মেয়েটা? অনাহারের মেয়ে, দারিদ্রের মেয়ে, বুকে শিশু নিয়ে কাজ খুঁজতে আসা মেয়ে—এ সব কী বলছে!
নীলিমা ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত জেনে নিচ্ছেন। বাবা আছেন কি! স্বামী খারাপ কি! এবং সব শেষে, তাঁর কাছে যা সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন, সেটি করে নিচ্ছেন—কাজ যে করবে তুমি, ছেলে সামলাবে কী করে?
রাধিকা বলার আগেই এবার কথা বলছে ময়না, যেন সে মনে মনে দায়িত্ব বোধ করছে যাতে রাধিকা কাজ পায়। যেন সে এই বস্তিতে এসে পড়া, বস্তির পক্ষে বেমানান মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছে। সে বলছে—ওইটা কি কোনও কথা হইল মা? আমরা তো সবৈ পোলাপানের জন্ম দিয়াই কাজ কইরা গ্যালাম। বস্তি তো বড়লোকের জায়গা না যে কেউ কারও দিকে মুখ তুইলাও চাইব না। এইখানে অ্যার পোলা আরে দ্যাহে। অ্যার নাতিরে আরে মানুষ করে। আমার কানু যখন হইল, তহন কি আমি তারে চাইর মাসের বেশি দুধ খাওয়াইতে পারসি? না খাওয়াইসি! কাম করতে আইসা বুকে দুধ উপচাইয়া পড়ত। বেলাউজ ভিজত। বুক টনটন করত। হেই কথা কেউ বুঝব না। নিজের প্যাটও বুঝব না। তহন কে দ্যাখত আমার কানুরে? ওই পাড়া-পড়শি, ওই অন্ধর ঠাকুমা। অ্যারেও দেখব গো। ওই জোছন, কী ফুটফুইট্টা ছেইলা, অর যত্নের অভাব হইব না ফটিক বিলের বস্তিত।
নীলিমা মৃদু ধমকান ময়নাকে। ধমক না দিলে ও থামবে না।
বলেন—তোমার বৃত্তান্ত থামাও দেখি। আমার আর কী! ওর অসুবিধে হবে বলেই বলা। তা তোমরা যদি সামলাতে পারো ভাল। তা মেয়ে, এ বাড়িতে কী কী কাজ করতে হবে তোমায় বলি।
তৃণাঙ্কুর উঠে চলে যেতে থাকেন। কাজকর্মের বৃত্তান্তে তাঁর মন নেই। শুধু যে-কাজ করতে আসবে তার মুখ সুরের রেশ হয়ে মনে লেগে যায়। আশ্চর্য মেয়েটি! বিষণ্ণ এবং ক্ষয় হতে থাকা সৌন্দর্যের মতো করুণ। যেন প্রাচীন প্রাসাদের অযত্ন বাগানে নাক ভেঙে যাওয়া ডানা কেটে যাওয়া সুন্দর মার্বেল পরি!
নীলিমা বলেন—ময়না যা করছে করবে। তোমাকে আমার সংসার দেখতে হবে। নিজের মতো করে রাঁধবে, বাড়বে, ঘর গুছোবে। আমার আর ভাল লাগে না। তোমায় দেখে ভরসা হচ্ছে, ঠিকঠাক গুছিয়ে নেবে তুমি আর আমি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করব। আমাদের খিলপাটনি গাঁয়ের মেয়ে তুমি। ভাবলেই ভাল লাগছে। আমাদের ময়না সব কাজ করে, আবার কিছুই করে না। যেমন মেঝে মুছে গেল। শুকোলে তুমি দেখতে পাবে ধুলোয় গোল গোল দাগ শুকিয়ে আছে মেঝেয়। বাসন মেজে গেল, তুমি দেখলে বাসনে ভাত শুকিয়ে আছে। কি মানু?
মানু নির্বিকার উত্তর দিচ্ছে—হ। তা হয় মাজেমইধ্যে। পাঁচ বাড়ি কাম করি। তাড়া থাহে না?
নীলিমা বলেন—তা তোমাকে মানুর কাজের ওপর কাজ করতে হবে আবার। বুঝলে?
রাধিকা ঘাড় নাড়ে। ছেলেকে এ কোল থেকে ও কোলে নেয়।
নীলিমা বলেন—কত নেবে বলো!
রাধিকার ঘাড় আরও নুয়ে যায়। বুকের মধ্যে গুড় গুড় করে। ময়না সারা রাস্তা তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছিল—দেড়শো টাকা চাইবে। বলবে না হলে তোমার সংসার থেমে যাবে। কিন্তু রাধিকা এখন কিছুই বলতে পারছে না। সে জানে না। বোঝে না। কত পায় লোকে? এ কাজ করে? তা ছাড়া এখন বুকের মধ্যে অদ্ভুত আত্মীয়তার বাঁধন টের পাচ্ছে সে। সেই গাঁয়ের গোস্বামীদের ভিটে। সেই ভিটেবাড়ির মানুষ ইনি। রাধিকা থেকে থেকে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে আর ভুলে যাচ্ছে সে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কাজ চাইতে এসেছে। বাবুবাড়ি এসেছে। টাকার কথা কেমন করে বলবে সে।
নীলিমা বলছেন—আশি টাকা দেব, কেমন?
রাধিকা মাথা নাড়ে। ময়না আর চুপ করে থাকতে পারে না। নীলিমাকে সে দেখছে কিছু কম দিন নয়। সে জানে মানুষটার মন ভাল। দিল দরাজ। বেত্তান্ত খুলে বললে একটু বেশি টাকা দিয়ে দেবেন নিশ্চয়ই। সে বলে—ওইতে কি অর হইব মা?
নীলিমা বলেন—সে ও বলুক। তুমি কেন কথা বলছ?
—সে কইলে হয়? হ্যায় কি আগে কাম করসে নাকি যে বুইজ্যা কইব! মুখ ফুইট্যা ট্যাকার কথা হ্যায় কয় কী কইরা? তা আপনেও মানুষ ভাল। হ্যায়ও ভাল। তাই কই। তিরিশ ট্যাহা ঘর ভাড়া, বড় পোলাডা ইশকুলে যায়—
—তাই নাকি?
—তাইলে আর কী কই? কেমুন সুন্দর ল্যাখাপড়া করে! আমাগো কান জুড়ায়। হেই পোলার খরচা আসে। কোলের পোলাডারে তো দ্যাখলেন। অখন কন তিনজনের খ্যাটন পঞ্চাশ ট্যাহায় চলে?
নীলিমা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন—আচ্ছা একশো দেব। কাজ করুক। তারপর দেখব।
রাধিকা কৃতজ্ঞ চোখে ময়নার দিকে তাকাল। প্রথম যে-দিন এরা বাড়ি বয়ে কথা বলতে এসেছিল, তার পছন্দ হয়নি। এরা নোংরা, কুঁদুলে, ক্ষয়াটে। কথায় কথায় অকথ্য গালাগালি করে, কথায় কথায় রসে চুব্চুব্ ইয়ার্কি। চিল্লিয়ে ছাড়া কথা বলতে পারে না। আনন্দে চেঁচায়, দুঃখেও চেঁচায়। আদরে চেঁচায়, অভিসম্পাতেও চেঁচায়। রাধিকা এদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছে। অথচ এরাই এখন রাধিকার আপন, তার নির্ভর। একজন তার জন্য কেমন সওয়াল করছে! তার তো কোনও স্বার্থ নেই। বরং রাধিকার জন্য তার এ বাড়ির চাকরি যেতে পারত। নীলিমা বলতে পারতেন—‘রাধিকাই তবে সব কাজ করুক। দু’জনের দরকার নেই।’ তাঁকে ভাল বলতে হবে যে তিনি এ কথা বলেননি। ময়না নীলিমার প্রায় ত্রিশ বছরের কাজের লোক। মল্লিনাথ ডাক্তারের বাড়িতে ছিল কালীতারা আর নীলিমার বাড়িতে ময়না যেন এ বাড়িরই একজন।
ময়নার সঙ্গেই নীলিমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রাধিকা। একবার শেফালির মা’র কাছে যাবার জন্য মন ছটফট করল তার। ময়নাকে বলল—অ ময়নাদি!
—ক
—আমার লগে যাইবা?
—কুনখানে?
—উদ্বাস্তু কলোনি?
—অ। তর আগের বাসায়? শ্যাফালির মা’র বাড়িত যাবি?
—হ। যাইতে মন লইতাসে। অ্যাকা অ্যাকা ডর করে। যাইবা?
—আমি যাইতে পারি। শুন—
—কও।
—আমি ঝি-চাকরাইন্যা মানুষ। আমারে দেইখা হ্যায় রাইগা যাইব না?
—কী যে কও! রাগব ক্যান? মাসিউ তো খাইট্যাই খায়।
—হ। খাটে। কিন্তু ইশকুলের কাম করে ত। আমাগো লগে কথা কয় না।
—আমার লগে যাইবা। আমি কইতাসি। মাসি মানুষ খাঁটি।
ময়না আর কথা বাড়াল। অন্য নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে পায়ে পায়ে রাধিকার সঙ্গে চলল। কিছুই নয়, তবু অকারণে বুকের মধ্যে শব্দ হতে থাকল রাধিকার। উঠোনে যখন ঢুকল সে তখন সন্ধ্যা পার হয়েছে। ঘরে ঘরে ধুনো পড়েছে। মিষ্টি ঘরোয়া ও সাংসারিক কল্যাণী গন্ধ ছড়িয়ে আছে উঠোনময়। বুকের মধ্যে ছেলেকে জোরে চেপে ধরল রাধিকা। পরমেশ কি আছে? পরমেশকে কি দেখতে পাবে? ভাবতে ভাবতে সংজ্ঞা হারাবার অবস্থা তার। ছেলেকে আঁকড়ে নিজের বুকের তলাকার শব্দ থেকে নিজেই পালাতে চাইছে সে। তার মনে পড়ছে—
পসরইতে শরীর হোয় অবসান।
কহইতে ন লয় অব বুঝহ অবধান॥
কহয় ন পারিয় সহন ন যায়।
বচহ সজনি অব কি কর উপায়॥
কোন বিহি নিরমিল হই পুন নেহ।
কাহে কুলবতী করি গড়ল মঝু দেহ॥
কাম করে ধরিয় সে করয় বহার।
রাখয় মন্দিরে ই কুল আচার॥
সহই ন পারিয় চলই ন পারি।
ঘন ফিরি যৈসে পিঞ্জর মাহা সারী॥
পরমেশ নেই। শেফালির মা ছাড়া কেউই নেই ঘরে। রাধিকাকে দেখে হইহই করে উঠল শেফালির মা। জোছনকে কোলে তুলে আদর করে বলতে থাকল—আমাগো জোছন আইসে। আর ঘরখান আলো হইসে।
জোছনের ঘুম ভেঙে গেছে। শেফালির মাকে দেখে চমৎকার হাসি দিচ্ছে সে। শেফালির মা বিছানা দেখিয়ে বলে, ব। ব এইখানে।
ময়না এখনও ঘরে ঢোকেনি। শেফালির মা তার অস্তিত্ব টের পেল। বলল—সঙ্গে ক্যাডা?
—ময়নাদি।
—আইতে ক।
ময়নাকে ভিতরে ডাকল রাধিকা। ময়না এল। ক্ষয়ে যাওয়া সেফটিপিন লাগানো হাওয়াই চটি বাইরে খুলে দ্বিধার পায়ে ঢুকে এল ঘরে। হোক না দশ ঘরের ভাড়া বাড়ি, তবু তো এ ভদ্রলোকের বাড়ি। সে, ভদ্রলোকের গৃহে কাজ করতে যেতেই অভ্যস্ত। ভদ্রতা সমাগমে নয়। রাধিকা লক্ষ করল শেফালির মা ময়নাকে পিঁড়ি দিচ্ছে বসার জন্য। বিছানায় বসার আহ্বান জানাচ্ছে না। প্রথম দিন যখন বস্তির মহিলারা আসে তখন তার যেমন হয়েছিল তেমনই নিশ্চয়ই হচ্ছে শেফালির মা’র। কিন্তু এখন, রাধিকা নিজেই, খাঁটি বস্তিবাসী একজন, ময়নাদির বা অন্ধর মা’র সঙ্গে তার কোনও তফাত নেই। হয়তো আরও কিছুদিন পর সেও ওইরকম ধুলো পা থেকে খুলে রাখবে ছেঁড়া হাওয়াই চটি আর তাতে সেফটিপিন লাগানো থাকবে। শেফালির মা যখন দেখবে সে নীলিমার বাড়ি থেকে রান্না করে বেরুচ্ছে নোংরা উলোঝুলো অবস্থায় তখন তাকেও আর বিছানায় বসতে বলবে না। রাধিকার ক্রমে প্রত্যয় হতে থাকে, সে আর সেই রাধিকা নেই, যে ছিল, যে শেফালির মা’র বুকের কাছে ছিল। সে হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে ময়নার পাশে মেঝেতে বসে পড়ে। এবং পরবর্তী সকাল, যা কিনা তার কাছে নতুন হয়ে প্রতিভাত হবে, তার জন্য প্রস্তুত হয়।
বস্তিতে ফিরে সাতকাহন করে সকলকে গল্প করে ময়না। কেমন চমৎকার দাঁও সে পাইয়ে দিয়েছে রাধিকাকে। সকলেই খুশি হয়। অঞ্জলি বলে, ছেলে নিয়ে ভাবনা কোরো না। আমার কাছে রেখে যেয়ো। এই বস্তিতে কেউ কারওকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে না। কিন্তু যে যা পারে করে।
অতএব, ছেলে বড় হচ্ছে রাধিকার। জোছন, তার যেমন হওয়ার কথা তেমনই ভুঁয়ে লুটিয়ে বড় হচ্ছে। কে না জানে চন্দ্রের জোছনা, তার সৃষ্টি হয়েছিল ভুঁয়ে লুটোবে বলে আর বৃক্ষকে চুমো দেবে আর জলের ওপর পড়ে এই পৃথিবীকে ক্রমশ করে তুলবে মায়াময়। সমস্ত জোছন রচনা করে মায়া, মানুষ তাকে প্রতিপালন করে, লালন করে স্বপ্নের ভিতর। রাধিকা কি ব্যতিক্রম তবে? কেন-না জোছন যে রাধিকার স্বপ্ন নয়। পলাশ সে নয় রাধিকার বসন্তমত্ততা। জোছন ও পলাশ রাধিকার দুই বাস্তব ও সত্য যাদের জন্য কোনও শমসের কোনও পরমেশের জন্য পরি হয়ে যাচ্ছে না রাধিকা। আর রাধিকা, নীলিমার সংসারে ঢেলে দিচ্ছে নিজেকে। সেই প্রথম দিন যেমন কথা হয়েছিল, তারপর থেকে অত কথা আর বলেন না নীলিমা। তাঁর ব্যবহারে একটি নিপুণ দূরত্ব আছে যা কর্ত্রী এবং কর্মীর মধ্যবর্তী ব্যবধান সূচিত করে। রাধিকা তা অনুভব করে এবং অতিক্রমের চেষ্টা করে না। সেই সন্ধ্যার পর সে আর শেফালির মা’র বাড়িতে যায়নি। পরমেশের জন্য আপ্লুত হয়নি। শেফালির মাও আসেনি তার বাড়িতে। একদিন স্কুলে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল রাধিকা। শেফালির মা বলেছিল—‘অখন কি আমার কতা কওনের সময়?’ দূরত্ব বাড়ছে। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। রাধিকা মেনে নিচ্ছে। যা হয়েছে এতকাল সব কিছুরই মতো, এখন যা হচ্ছে তার মধ্যেও রাধিকা বাঁচতে থাকছে, এমনভাবেই বেঁচে থাকার কথা ছিল কিনা তা না জেনেই। দূরত্ব, দু’টি সম্পর্কের মধ্যবর্তী ব্যবধান, অকস্মাৎ গড়ে ওঠা কিংবদন্তীর মতো মাথা তোলে। সে তৈরি হল, তৈরি হতে থাকছে তা কেউ বুঝতে পারে না। রাধিকাও এই না বোঝার কাছে জলস্রোতের মতো নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে বারবার আর এ পাথর ও পাথর কাটিয়ে গিয়ে পড়েছে অনির্দিষ্ট অজ্ঞাত সম্পর্কগুলির কাছে। এই পরিবার বিপদের সময় তাকে কাজের সুযোগ দিয়েছে তাই সে রান্নার এতটুকু অযত্ন করে না। জিনিসের অভাব নেই। তাই রসিয়ে রাঁধে। নীলিমা খুশি। তৃণাঙ্কুরও খুশি। নীলিমার নির্দেশে বিকেলের রান্না চুকিয়ে যাবার সময় নিজের মতো খাবার সঙ্গে নিয়ে যায় রাধিকা। তাতেই রাত্রে তার ও পলাশের হয়ে যায়। প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়ে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। কী কী করবে সে, কী কী কিনবে ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়েছিল। এক মাসের মাইনে আর খরচপত্র দিয়ে কার্তিক সেই যে চলে গেল আজ প্রায় চার-পাঁচ মাস সে আসছে না। মানুষ এত নিষ্ঠুরও হয়? কার্তিক কি জানত রাধিকা যেমন করেই হোক খরচ চালিয়ে নেবে! নাকি অসুখ-বিসুখ করল লোকটার। করুক গে। রাধিকা ভাবতে চায় না। আর নাই আসে যদি, কী এসে যায়! কার্তিকের প্রতি এতটুকু মমতা বোধ হয় না। সে জানে তার দু’টি সন্তান আছে, যাদের জন্য তার বেঁচে থাকতে হবে। সে জানে তার বুকের তলায় একটি মুখ লুকনো আছে, যাকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখে তার উপায় নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হয়, ভবিষ্যতের কথা ভেবে সঞ্চয় করতে হয়, পরিকল্পনা করতে হয়, এমনটা সে ছোটবেলায় দেখেছিল। এখন সে এটুকু জানে, জন্মালে বেঁচে থাকতে হয়। শুধু বেঁচে থাকতে হয়। এই বাঁশের চাঁচের ঘরে, ফটিক বিলের যাবতীয় শীত ও দুর্গন্ধ গায়ে মেখে, ফটিক বিলের দূষিত নোংরাঋদ্ধ জল দিয়ে স্নান করে, এর ধুলায় দুধের শিশুকে ফেলে গিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এই বাঁচার ইচ্ছের মধ্যে কোনও গৌরব নেই। অসততাও নেই। এই বাঁচার ইচ্ছের মধ্যে কার্তিকও নেই কোথাও। শুধু শমসের আছে। পরমেশ নামে একটা মানুষ সে একটুখানি শমসের হয়ে ছিল, সেও হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, কিন্তু শমসের কিছুতেই হারিয়ে যেতে রাজি হয়নি। সে রাধিকার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে যায়। আর রাধিকা তাকে আগলে চলতে চলতে ঘরমোছার কাজটি বা তৃণাঙ্কুরের পুস্তক ভাণ্ডারের ধুলো ঝাড়ার কাজটি খুবই শৈল্পিকভাবে সম্পন্ন করতে থাকে।
যে তিনদিন কলেজে যান না তৃণাঙ্কুর, সেই তিনদিন রাধিকা তাঁকে অবাক হয়ে দেখে। মানুষটা চলতে পারেন না ভাল করে। বউ নাকি বিষ খাইয়ে এমনি করে দিয়েছে। মানুষ কী নিষ্ঠুর! কেমন করে পারল! সে যে কার্তিককে এতটুকু ভালবাসেনি, তাতেও কি সে পারবে কার্তিককে বিষ খাইয়ে দিতে!
দুপুরবেলাটা বড় ফাঁকা, বড় অলস এই বাড়ি। নীলিমা ঘুমিয়ে পড়েন। রাত্রে আজকাল ঘুম হতে চায় না তাঁর। তাই এই দুপুরে গড়িয়ে নেন। কিন্তু তৃণাঙ্কুর জেগে থাকেন। দুপুরে ঘুমালে মেদ বৃদ্ধি হয়। তৃণাঙ্কুর জানেন তাঁর ওই ঘষে ঘষে চলাও অসম্ভব হয়ে যাবে যদি তিনি আরও মেদবাহুল্যে পড়েন। তিনি তাই দুপুরটা পড়ে কাটান। জোরে জোরে পাঠ করেন কবিতা বা নাটক। রাধিকা শুনতে পায়। ইংরাজি ভাষার বিন্দুবিসর্গ সে বুঝতে পারে না। কিন্তু শোনে। তৃণাঙ্কুরের স্বর তার ভাল লাগে। তাঁর পাঠের মধ্যে রাধিকা দুঃখ বা বেদনার রসটি ছুঁতে পায়৷ এ বাড়িতে সে আসে এগারোটায়। সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত থাকে। নীলিমা স্বীকার করেন, রাধিকা তাঁর সংসারকে চকচকে করে তুলেছে ক্রমশ। তিনি যেমন ভালবাসেন কিন্তু বয়সের জন্য আর পারেন না তেমনটি করতে, তাই করছে রাধিকা। আজ রাধিকা তৃণাঙ্কুরের ঘরের ধুলো-ময়লা ঝাড়ছে। আর আজই তৃণাঙ্কুর, ইংরাজি ছেড়ে বাংলা কবিতা পাঠ করছেন—
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক
রাধিকা থেমে গেছে। এক লহমায় পৌঁছে গেছে খিলপাটনি গাঁয়ে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! একথাই যেন সে বলতে চেয়েছে কতবার, বলতে পারেনি। ভাবতে চেয়েছে কতবার কিন্তু ছুঁতে পারেনি। তৃণাঙ্কুর পড়ছেন—
তাহার দুটি পালন করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে
যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া
কোলের পরে নিই তাহারে তুলে
ভেড়া ছিল না কিন্তু বকরি ছিল ওদের। গোরু ছিল। হ্যাঁ, চঞ্চল বাছুর মাঝে মাঝেই ছুটে চলে আসত রাধিকাদের উঠোনে। আর রাধিকা তাকে তাড়ানোর ছলে তার গলা জড়িয়ে ধরত একটাই কারণে যে সে শমসেরদের গোহালে বাস করে। সেই পুরনোকে জাগ্রত স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে সে পায়ে পায়ে তৃণাঙ্কুরের কাছে এসে দাঁড়ায়। হাতে ধুলোভর্তি কাপড়ের টুকরো। চুলে কুটো। শাড়িতে পরিশ্রমের ঘ্রাণ। সে দাঁড়ায়। স্বপ্নোত্থিতের মতো বলে—আবার থিক্যা পড়ব্যান?
তৃণাঙ্কুর চমকে মুখ তোলেন। প্রথমে তাঁর বোধগম্য হয় না যে রাধিকা কী বলতে চায়। বিস্ময় এসে উপলব্ধি আড়াল করে দাঁড়ায়। তিনি মাঝখানে আঙুল রেখে বই বন্ধ করেন। ভ্রূ কুঁচকে রাধিকার দিকে তাকান। প্রশ্ন করেন—কী বললে? আর একবার পড়ব?
—হ
রাধিকা মুখ নিচু করে। ক্রমে লজ্জা পায়। ঝোঁকের মাথায় যা সে বলে বসেছে তার হাত থেকে মুক্তি চায় এখন। তৃণাঙ্কুর কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন তার দিকে। তারপর বলেন—দাঁড়িয়ে কেন? বোসো।
রাধিকা মেঝেতে বসে। তৃণাঙ্কুরের কষ্ট হয় কিন্তু ভদ্রতাবোধ, যা কিনা প্রায় শালীনতার সমার্থক—কখনও কখনও ডিঙোতে পারেন না তিনি, বলতে পারেন না—নীচে নয়। এখানে বসো। তার বদলে তিনি পড়ে চলেন—
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ।
এক সময় কবিতা ফুরোয়। রাধিকা স্তব্ধ হয়ে থাকে। জীবনের অফুরন্ত রুক্ষ পথ যা শুষে শেষ করতে পারে না সেই অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। তৃণাঙ্কুর দেখতে থাকেন, কাজের মেয়ে নয়, বস্তির মেয়ে নয়, এক অন্য মেয়েকে, যার বুকের তলায় টলটল করছে স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। তিনি ধীরে ধীরে শুধোন—কাঁদছ কেন?
—আমাগো গেরামে রূপসী নদী আসিল। কী সোন্দর জল।
—আর কী ছিল গাঁয়ে? কেউ কি ছিল যার নাম রঞ্জন?
রাধিকা তৃণাঙ্কুরের কথা বুঝতে পারে না। মুখ নিচু করে। আঁচল দিয়ে মুছে নেয় অযত্নের গাল। তৃণাঙ্কুর ফের বলেন—তুমি আমাদের মতো কথা বলতে পারো না?
—কই না।
—কেন?
—পারুম।
—কও।
হেসে ফেলে রাধিকা। দু’হাতে মুখ ঢাকতে গিয়ে ধূলিমলিন কাপড়টি মুখে ঠেকিয়ে ফেলে। মুহূর্তে দুরত্ব পালিয়ে যায়। ব্যক্তি ও ব্যক্তির মধ্যেকার দূরত্ব। সম্পর্ক ও অবস্থানের মধ্যেকার দূরত্ব। কেউ তা টের পায় না। শুধু ধুলো আর চোখের জলের ছোপ লেগে যায় গালে। যে সারল্য জীবন এখনও তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়নি—তার দিকে চেয়ে থাকেন তৃণাঙ্কুর। তাঁর মধ্যে ভাল লাগা ঘনায়।
ফের নিজের ভুলে হাসির দমক আসছে। কতদিন পর সে হাসছে এমন? কতদিন পর? হাসতে হাসতে বলছে—আইজ না। কাইল থিকা কমু।
—বেশ।
—না, কাল থিক্যা না।
—কবে থেকে।
—কয়দিন যাউক গিয়া।
—ক’দিন?
রাধিকা মুখ নামিয়েছে ফের। যেন তার মনে পড়ে গেছে এই সহজ কথন স্বাভাবিক নয়। এবং সে নিশ্চিত নয়, আপনা ভাষা ত্যাগ করে সে কবে নাগাদ এ দেশীয় হয়ে উঠবে। তৃণাঙ্কুর মৃদু হাসেন। বলতে থাকেন—থাক। তুমি তোমার মতো করেই কথা বোলো, কেমন?
রাধিকা মাথা হেলায়। হাসে।
হাসছেন তৃণাঙ্কুরও। বলছেন—তুমি জানো, কোনও কবিতা? স্কুলে পড়েছ?
রাধিকা তার পড়াশুনোর বৃত্তান্ত জানায়। তার বাবার কথা জানায়। তার পদাবলী শোনার কথা বলে। কার রচনা জানে না। কোন বই জানে না। শুধু মুখস্থ বলে যায়। নির্জন শান্ত মধ্যাহ্নে, ছেলে ফেলে আসা, স্বামী ভুলে যাওয়া, খেটে খেতে থাকা মেয়ে আপন মনে পদাবলীর আখর শোনাতে থাকে বিদগ্ধ অধ্যাপককে। অধ্যাপক শুনতে থাকেন—দু’জনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ক্রমে লুপ্ত হয়ে যায়। দুপুরের পর দুপুরের ধ্যানে সারাদিন কাটিয়ে দিতে থাকে দু’টি দুই স্তরীয় নারী-পুরুষ। তাদের আর কোনও কষ্ট নেই এখন। কোনও বঞ্চনা অপমান নেই। রাধিকা নামের মেয়ে শমসের নামের পুরুষ ছাড়াও অন্য এক পুরুষের আশ্লেষে ধরা দেয় ক্রমশ। তার কষ্ট শুষে নেয়। তাপ শুষে নেয়। অসুস্থতাকে লঙ্ঘন করায়। তৃণাঙ্কুর নামের শিক্ষিত স্ত্রী-পরিত্যক্ত অধ্যাপক পুরুষ নিজের সমস্ত প্রেম ও শ্রদ্ধা দিয়ে জড়িয়ে ধরেন এই নিঃস্ব ক্ষয়িষ্ণু নারীকে। মধ্যাহ্নের পর মধ্যাহ্নে তাঁদের মিলন রচিত হয়। শর্মি নেই, কার্তিক নেই, দারিদ্র্য নেই, বিবাহবিচ্ছেদ নেই, পরমেশ নেই, রঞ্জন নেই, শুধু অপূর্ব মধ্যাহ্ন জেগে থাকে আর নীলিমা ঘুমিয়ে থাকেন। আর শমসের জেগে থাকে। আর জোছন ধুলোয় ঘুমিয়ে থাকে। আর অন্ধ বিষণ্ণ প্রাণে ঘুরে বেড়ায়। আর পলাশ পড়া মুখস্থ করে। আর রাধিকা বলে—
ন কর ন কর সখি মোহে অনুরোধে।
কি করব হমহু তকর পরবোধে ॥
অলপ বয়স হম কানুসে তরুণা।
অতিহু লাজ ডর অতিহু করুণা ॥
লোভে নিঠুর হরি কয়লহ্নি কেলি।
কি কহব যামিনী যত দুখ দেলি ॥
তৃণাঙ্কুর জড়িয়ে ধরেন রাধিকাকে। এবং ধরাকালীন টের পান এর কোনও পরিকল্পনা ছিল না তবু এ অনিবার্য। প্রথম দিন যখন এই নারীকে দেখেছিলেন তখন আশ্চর্য লেগেছিল। কারণ, না খেয়ে মরেও যেতে পারে এমন সে-নারীর মুখে অপার্থিব আলো দেখেছিলেন তিনি, তার মনে রাখা দেখেছিলেন, শুধু গ্রামকে ভালবেসে মনে রাখা নয়, সে স্মরণ করেছিল অপূর্ব দর্শন। সে স্মরণ করেছিল কারণ তা আত্মস্থ করেছিল। সে আত্মস্থ করেছিল কারণ কথাগুলির নিহিত অর্থ স্পর্শ করেছিল তাকে। তাই সে সাধারণ নয়। সাধারণ ছিল না। তাই তৃণাঙ্কুর কাছে টানেন তাকে। রাধিকার শাড়ির পরিশ্রমের গন্ধ নাকে লাগে তাঁর। তিনি অস্ফুটে বলেন—
What lovely lad most pleasured me.
Of all that with me lay?
I answer that I gave my soul
And loved in misery,
But had great pleasure with a lad
That I loved bodily.
রাধিকা দু’হাত দিয়ে তৃণাঙ্কুরের ভারী পিঠে বেড় দেয়। ভাবে, কী সরল মানুষটা! কী সুন্দর সহজ মানুষটা! ওর বউ কেমন করে পারল! বিষ খাওয়াতে কেমন করে পারল! তৃণাঙ্কুরের শরীরের পেষণ নিতে থাকে সে আর বলে—
হঠ ভেল রস হম হরল গেয়ান।
নীবিবন্ধু তোড়ল কখন কে জান।।
তৃণাঙ্কুর নীবিবন্ধ নামিয়ে আনেন নীচের দিকে। গভীর নাভিগর্ত। অমসৃণ নিম্ন উপত্যকা। জন্মদানের ফাটলে মহিমান্বিত। তিনি ঠোঁট ঘষেন। শর্মি কত সতর্ক ছিল যাতে তলপেটে কোনও ফাটল না হয়। যাতে একটুও চর্বি না জমে। শর্মির তলপেটে পারফিউমের নেশাধরানো গন্ধ থাকত। তৃণাঙ্কুরের নাকে রাধিকার চামড়ার গন্ধ উঠে আসছে এখন। তিনি বলছেন—
Flinging from his arms I laughed
To think his passion such
He fancied that I gave a soul
Did but our bodies touch,
And laughed upon his breast to think
Beast gave beast as much
রাধিকা তৃণাঙ্কুরের বুকে মুখ ঘষছে। তার লালা লেগে যাচ্ছে তৃণাঙ্কুরের স্তিমিত পুরুষবৃন্তে। আর সেই ক্ষুদ্র বৃন্ত উদ্ধত কণ্টকের ন্যায় শক্ত হচ্ছে। পাশের ঘর থেকে নীলিমার ঘুমের শব্দ আসছে। শীত নেই। একটুও শীত নেই কোথাও। পড়ি-মরি করে ছুটে আসছে বসন্ত। ঝাঁপ দিচ্ছে তৃণাঙ্কুরের জানালায়। রাধিকা বলছে—
দেল আলিঙ্গন ভুজযুগ চাপি।
তহিখনে হৃদয় মঝু উঠল কাঁপি ॥
নয়নে বারি দর শাওল রোই।
তবুও কানু উপশম নহি হোই ॥
শক্তিমান হয়ে উঠেছেন তৃণাঙ্কুর। শক্ত হাতে মথিত করছেন দু’খানি পর্বতচূড়া। পান করছেন। পান করছেন। তাঁর দু’চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে।
I gave what other women gave
That stepped out of their clothes,
আধর নীরস মঝু করলনি মন্দা।
রাহু গরাসি নিশি তেজল চন্দা ॥
কুচযুগে দেল নখ পর হারে।
কেশরী জানি কজকুম্ভ বিদারে ॥
But when this soul, its body off,
Naked to naked goes,
He it has found shall find therein
What none other knows, …
ঘুম ভাঙছে নীলিমার। ঘুমের আস্তরণ ভেদ করে তিনি দেখতে পাচ্ছেন বাড়ির ঝিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন তৃণাঙ্কুর। রাত্রে তিনি মুখোমুখি হচ্ছেন ছেলের। ডাকছেন—মান্তু।
—বলো মা।
—শেষ পর্যন্ত একটা ঝিয়ের সঙ্গে তুই … ছি ছি ছি আমি ভাবতেও পারি না।
—মা। ও তো মানুষ মা। প্রত্যেককেই কোথাও না কোথাও তো কাজ করতেই হবে।
—তাই বলে একটা রুচি থাকবে না? শিক্ষা থাকবে না?
—শিক্ষা তো ছিল মা, শর্মির। রুচিও তো ছিল মা। ওই শিক্ষার আড়াল থেকে রুচির আড়াল থেকে কি অশিক্ষা আর কুরুচি বারবার খুঁজে পাওনি তুমি?
—হ্যাঁ। পেয়েছি। তার মানে সবাই এরকম নয়। ভাল মেয়েও আছে। তোমার জীবনে একটা খারাপ মানুষ এসেছিল বলে তোমাকে বস্তি থেকে সোনা খুঁজতে হবে?
—মা, বস্তিতে বাস করাটা একটা মানুষের শেষ পরিচয় নয়। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করি না আমি। ওর আচারব্যবহার দেখো তুমি। ওকে দেখো। ওর মধ্যে শিক্ষা আছে। ওর নিজস্ব শিক্ষা। ওর মধ্যে আলো আছে। আমি তার সন্ধান পেয়েছি। ওর ভাগ্য ও পরিস্থিতি ওকে এখানে টেনে এনেছে। তার জন্য ও দায়ী নয়। তুমি এ সব ভাবছ না। দেখছ না।
—আমি সবই দেখি মান্তু। তোমাকেও দেখি। তোমার বাবাকেও দেখেছি। তিনিও, তোমার মতোই, ঝিতে আসক্ত হয়েছিলেন। চরিত্র রক্তে বয়ে যায়। তোমার বাবার ছায়া থেকে তোমাকে আড়াল করেছি এতদিন, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, কোনও লাভ হয়নি। তোমার রক্তে তিনি আছেন।
—মা চুপ করো। তুমি আমাকে অপমান করছ। নিজেকেও অপমান করছ।
—হ্যাঁ, এখন তোমার অনেক কিছু মনে হবে। তোমার জীবনে যতবার নারী এসেছে ততবার আমাকে তোমার অসহনীয় ঠেকেছে।
—আমি সে-কথা বলিনি মা। আমি বোঝাতে চাইছিলাম যে একজন ঝিগিরি করে পেট চালায় বলেই সে অশ্রদ্ধেয় নয়। একজন ঝিয়ের কাছেও অনেক কিছু শেখার থাকতে পারে। অনেক কিছু নেবার থাকতে পারে।
—কালই দূর করে দেব মেয়েটাকে। বিপদের দিনে কাজ দিলাম। এক গাঁয়ের মেয়ে। কষ্টে পড়েছে। এক কথায় মাইনে বাড়িয়ে দিলাম, এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই! যেই দেখল একা পুরুষমানুষ, বউ নেই, অমনি গলে পড়ল। একেবারে বিশ্বাস করতে নেই এদের। একদম না।
—আর একটা কথাও বোলো না মা। ওকে চলে যেতেও বোলো না। পাপ হবে তোমার। অসহায় একটা মেয়ে। সরল, সুন্দর। তোমার সংসার কি ও মাথায় করে রাখেনি? হ্যাঁ, আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক আছে। তুমি তো আজ জেনেছ। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক অনেক দিনের। এর মধ্যে একটা বাড়তি জিনিস চাইতে দেখেছ ওকে? কোনও বিশেষ সুবিধা নিতে দেখেছ? আমি ওকে ভালবাসি মা। ওর সম্পর্কে আমার কোনও সংশয় নেই। আমি কী বা ও কী তার হিসেবও আমাদের সম্পর্কের মধ্যে নেই। উই লাভড ইচ্ আদার অ্যান্ড ওয়্যার ইগনোরেন্ট।
—কবিতা বলছ? কবিতা? এই জন্য শর্মি তোকে ছেড়ে চলে গেছে। বই পড়ে পড়ে তোর আর বাস্তববুদ্ধি হল না। ঝিয়ের সঙ্গে প্রেম—ইটস্ আ ক্রাইম, আ পারভারসন আই সে।
How could passion run so deep
Had I never thought
That the crime of being born
Blackens all our lot?
But where the crime’s committed
The crime can be forgot
আবার কবিতা বললাম মা। গত বছর অম্বুবাচির সময় ছোটমাসি তোমাকে ফল দিতে এসেছিল। প্রতিবারই কেউ-না-কেউ আসে। মেজমাসি, ছোটমাসি, মামিমারা। সবাই জানে তুমি অম্বুবাচি করো না। তবু আসে। তুমি প্রতিবার ফল নাও আর বেছে বেছে ওই দিনগুলোয় আমিষ ভোজন করো, তুমি বৈধব্য অস্বীকার করো আর ওরা তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় তুমি কত বড় পাপ করছ। তুমি রেগে যাও কারণ প্রত্যেকের নিজস্ব পদ্ধতিতে জীবনচর্যার অধিকার আছে, তুমি বিশ্বাস করো। ব্যক্তিস্বাধীনতায় ওদের ওই হস্তক্ষেপ তুমি মানো না কারণ তুমি প্রগতিশীল মহিলা। দুঃস্থ নারীকল্যাণের জন্য গড়ে ওঠা কিছু সংস্থার সঙ্গেও তুমি নিজেকে যুক্ত করেছিলে। মা, আমার বয়স প্রায় চল্লিশ হতে চলল। আমি একটা কলেজে পড়াই। এখনও তুমি আমাকে বলতে চাও, বোঝাতে চাও, কোনটা রুচিকর কোনটা নয়। আমার মধ্যে যে রুচিবোধ তৈরি হয়ে গেছে তা তোমার সঙ্গে না মিললেও তা আমারই। আমি সে নিয়মেই চলব। তুমি অনেকবার বলেছ ওকে তাড়িয়ে দেবে। যদি দাও, আমি এ পাড়াতেই ঘর নেব। থাকব। ওকে রাখব আমার ঘরে।
—ছিঃ। ওই মদোমাতাল হিরণের সঙ্গে আজ আমার ছেলের কোনও তফাত নেই। যাক। তোমাকে আলাদা ঘর ভাড়া করতে হবে না। কেলেঙ্কারি বাড়িয়ো না, দু’দিন বাদে আমি চোখ বুজব। তখন যা খুশি কোরো।
তখন অন্ধকারে ছেয়ে আছে রাধিকা। লণ্ঠনের আলো পড়েছে জোছনের মুখে। ছেলেটা রোগা হয়ে গেছে। রাধিকা স্তন মুক্ত করছে। দুই ঠোঁটে বৃন্ত ধরার জন্য হাসফাঁস করছে জোছন। হঠাৎ পলাশ ঝুঁকে পড়ছে মায়ের ওপর। খোলা বুকে গাঢ় নীলচে দাগ। পলাশ বলছে— তোমার বুকে ও কীসের দাগ মা?
রাধিকা আঁচলের আড়াল দিচ্ছে। কিসু না। তুই মাস্টারের বাড়ি গেলি না আইজ?
তৃণাঙ্কুরের দংশনচিহ্নে বুক ভরে আছে রাধিকার।