৩৫. শওকত সাহেবের জ্বর

তিনদিন ধরে শওকত সাহেবের জ্বর।

খুব বেশি নয় একশ, একশ এক। তরু বয়সের কারণেই তিনি বেশ কাহিল হয়ে পড়লেন। শারীরিক অসুবিধা ছাড়াও কিছু কিছু মানসিক অসুবিধাও দেখা গেল। পর পর দু’দিন মুনাকে বললেন লতিফাকে তিনি পর্দার ফাঁকি থেকে উঁকি দিতে দেখছেন। মুনা কিছুই বলেনি। ঠোঁট বাকিয়েছে যা থেকে মনে হয় সে বিরক্ত। অথচ এর মধ্যে বিরক্ত হবার কী আছে। তার কথা সে বিশ্বাস না করতে পারে সেটা ভিন্ন কথা কিন্তু বিরক্ত হবে কেন? আগে তো শুনবে তিনি কী বলতে চান তাও শুনেনি। ঠোট বাকিয়ে ঘরের কাজ করতে গেছে। অথচ লতিফাকে তিনি দেখেছেন। নিশি রাতে ঘুম ভেঙে দেখা। তিনি শুয়ে ছিলেন। জানালা দিয়ে রোদ আসছিল বলে জানালা বন্ধ করে দিতেই ঘর খানিকটা অন্ধকার হয়ে গেল! ঠিক তখন ঘরের পর্দা নড়ে উঠল। শুধু শুধু পর্দা নড়বে কেন? তিনি তাকালেন এবং দেখলেন পর্দার নিচে স্যান্ডেল পরা রোগা রোগ দু’টি পা। লতিফার পা। তিনি ডাকলেন–কে লতিফ! লতিফা! পৰ্দা আবার নড়ে উঠল। তিনি বিছানায় উঠে বসতেই পা সরে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে দেখলেন না। মুনা অফিসে। ঘর খালি। একটি প্রাণীও নেই। শুধু রান্নাঘরে ইঁদুর খুটাখুটি করছে।

অথচ সেই কথাটি মুনা শুনতেই চাইল না। বিরক্তি দেখিয়ে চলে গেল। সেদিনকার পুচকে মেয়ে অথচ ভাবটা এ রকম যেন পৃথিবীর সব রহস্য তার জানা। মুনার ওপর তিনি গত ক’দিন ধরে বেশ বিরক্ত। সে স্পষ্টতই তাকে অবহেলা করছে। তিন দিন ধরে তার জ্বর যাচ্ছে এই নিয়েও তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। একবার বলল না, ডাক্তার দেখাও। কিংবা নিজে গিয়ে কোনো ওষুধবিষুধ আনল না।

গতকাল সন্ধ্যায় তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনাকে শুনিয়ে বললেন, বাঁচব না। দিন শেষ। মুনা বলল, খামোেকা আজেবাজে কথা বল কেন?

তিনি দুঃখিত গলায় বললেন, বাঁচব না। এই কথাটা বলছি। এটা কি আজেবাজে কথা?

হ্যাঁ। বাচাবে না সেটা তো সবাই জ্বানে। বারবার বলা দরকার কী?

তিনি চুপ করে গেছেন। মেয়েটা এমন অদ্ভুত একেকবার একেকটা জিনিস নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে যে রীতিমত রাগ লাগে। এখন যেমন বাকেরের ব্যাপারটা নিয়ে করছে। সেদিন দেখলেন টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কার জন্যে খাবার নিচ্ছিস?

বাকের ভাইয়ের জন্যে।

কেন?

খাবে সেই জন্যে। আজ ছুটির দিন আছে। কাজেই নিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আর কিছুই বলেননি। কিন্তু জানেন কাজটা ভাল হচ্ছে না। লোকের চোখে পড়বে। নানান জনে নানান কথা বলবে। কিন্তু এই সহজ জিনিসগুলি মুনাকে কে বোঝাবে? কিছু বলতে গেলে ফোঁস করে উঠবে। দিন দিন মেয়েটার আকাশ-ছোঁয়া মেজাজ হচ্ছে। এক’দিন কড়া করে ধমক দিতে হবে।

শওকত সাহেব জ্বর গায়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ক্ষুধা হচ্ছে। সকালে কিছু খাননি। মুনা যাবার সময় বলে গেছে মিটাসেফে খাবার ঢাকা দিয়ে গেছে। মিটসোফে কয়েকটা রুটি আর কিছু ভাজি ঢাকা দেয়া। সেখানে কয়েকটা তেলাপোকা। ঢাকনির ওপর হাঁটাহাঁটি করছে। শওকত সাহেবের বমি এসে গেল। সেই বমি চাপতে গিয়ে বুকে চাপ ব্যথা। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। শওকত সাহেব বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। আলো মরে আসছে, ঘর অন্ধকার। আজও কী লতিফা আসবে নাকি। শূন্য ঘরে তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। মুনা কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। হয়ত সন্ধ্যা পার করে ফিরবে। ঐ দিন মামুন এসেছিল। একদিনের জন্যে এসেছে। হাতে সময় নেই। তবু সে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইল। মুনার দেখা নেই। মুনা এল সন্ধ্যা মিলাবারও আধঘণ্টার পর। মামুন তখনো বসে আছে। মুনা শুকনো হাসি হেসে বলল, কখন এসেছ?

মামুন বলল, অনেকক্ষণ।

কোন কারণে এসেছি, না এমনি।

মামা চিঠিতে লিখেছিলেন একবার আসার জন্যে।

কথা হয়েছে মামার সঙ্গে?

হঁ। তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলবার জন্যে বসে আছি।

আজ না বললে হয় না? প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। দাঁড়াতে পারছি না।

আজ রাতের ট্রেনে চলে যাচ্ছি।

তাহলে এর পরের বার যখন আস তখন কথা হবে।

শওকত সাহেব দেখলেন মামুন শুকনো মুখে চলে যাচ্ছে। একি কাণ্ড! সব বদলে যাচ্ছে। বকুল? বকুলও কী কম বদলেছে! প্রথম প্রথম চিঠি লিখত। এখন তাও লেখে না। যদিও লেখে দুতিন লাইনে সব কথা শেষ বাবু ভাল আছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। বাবুকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। যেন বাবু ছাড়া তার আর কোনো চিন্তা নেই।

শওকত সাহেব শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলেই চমকে উঠলেন। দরজার পর্দা আবার কাঁপছে। তিন ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকালেন। রোগা রোগা দু’টি পা দেখা যাচ্ছে। শওকত সাহেবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। প্রচুর ঘাম হতে লাগল। তিনি মৃদু স্বরে ডাকলেন, কে লতিফা!

টুনটুন করে দুবার কাচের চুড়ির শব্দ হল। লতিফা কাচের চুড়ি পরত। তার হাত ভর্তি ছিল নীল রঙের চুড়ি।

লতিফা। ও লতিফা।

পা দু’টি চট করে সরে গেল। শওকত সাহেব দরজা খুলে বাইরে এসে শুনেন খুব শব্দে বাইরের দরজার কড়া নড়ছে। দরজা খুলতেই দেখলেন মুনা দাঁড়িয়ে আছে। মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, কতক্ষণ ধরে কড়া নাড়ছি। দরজা খুলছ না কেন?

শওকত সাহেব কিছু বললেন না।

দরজা খুলছে না দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কি ভেবেছিলি মরে গিয়েছি?

তা না ভাবলাম অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেছ বোধ হয়।

তোর মামলার কি হল?

মামলা তো এখনো শুরু হয়নি। উকিলকে কাগজপত্র দেখতে দিয়েছি।

উকিল কে?

তোমার উকিল। তোমার বেলায় যিনি ছিলেন।

ও আচ্ছা।

হাসান সাহেব আছেন না? উনিও একজনকে বলছেন। মামলা কে চালাবে এখনো ঠিক হয়নি।

তুই এই ব্যপারটা নিয়ে বেশি ছোটোছুটি করছিস। যাদের করার তারা করবে তোর এত কিসের মাথাব্যথা।

মুনা হাসল। শওকত সাহেব বললেন, সামলো-সুমলে চলতে হয়। সমাজ সংসার দেখতে হয়। কঠিন জায়গা।

আমিও তো মামা কঠিন মেয়ে।

শওকত সাহেব কিছু বললেন না। মুনা বলল, তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। কী হয়েছে। বল তো?

তিনি ইতস্তত করে বললেন, আজ আবার দেখলাম। এই কিছুক্ষণ আগে। দশ মিনিটও হয়নি।

কি দেখলে?

তোর মামিকে দেখলাম।

তুমি কি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছ নাকি মামা? কি ধরনের কথাবার্তা যে বল; রাগে গা জ্বলে যায়।

ঘটনাটা না শুনলে তুই…

কোন কিছু আমি শুনতে চাই না।

শওকত সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, জ্বর কমেছে?

শওকত সাহেব সেই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। মুনা রাতের খাবার তৈরি করে তাকে খেতে ডাকল। তিনি উঠে এলেন। কিন্তু খেতে পারলেন না। খানিকক্ষণ পরই উঠে গিয়ে একগাদা বমি করলেন। চারদিক কেমন দুলছে। শরীরটাকে অসম্ভব হালকা মনে হচ্ছে। তিনি মৃদু স্বরে ডাকলেন ও লতিফা, লতিফা। মুনা এসে তাঁর পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলি।

মুখ ধোয়ার পানি দে রে মা।

মুনা পানি নিয়ে এসে দেখল তিনি বিড়বিড় করে নিজের মনে কি সব কথা বলছেন।

মামা কী বলছ?

কিছু বলছি না। পরিষ্কার দেখলাম বুঝলি। মনটা একটু ইয়ে হয়ে আছে।

ইয়ে হয়ে থাকলে তো খারাপ। মনটাকে ঠিক কর। আমার মনে হয় বকুলের কাছ থেকে ঘুরে এলে তোমার সব ঝামেলা মিটে যাবে।

তুই যাবি আমার সঙ্গে?

পাগল হয়েছ? মামলা-মোকদ্দমা ফেলে আমি যাব কোথায়? ঘুম থেকে উঠেই আমাকে যেতে হবে উকিলের কাছে।

শওকত সাহেব শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললেন।

উকিল সাহেব আজ উদ্ভূত একটা পোশাক পরে এসেছেন। জিনিসটা পাঞ্জাবির মত। কিন্তু শার্টের কলারের মত কলার আছে। ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে সার্কাসের ক্লাউনের মতো! মুনাকে দেখেই তিনি বললেন–হবে না।

মুনা বলল, কী হবে না?

এফআইআর দেখলাম। এই মামলায় লাভ নেই।

আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

কথা তো বাংলাতেই বলছি, বোঝেন না কেন? পুলিশের সাজানো মামলা। কনভিকসন হয়ে যাবে। উকিল-মোক্তার কিছু করতে পাববে না।

মুনা তাকিয়ে রইল। উকিল সাহেব মুখখানা অনেকখানি সরু করে টেনে বললেন, ধরন-ধারণ দেখে মনে হয়। পলিটিক্যাল কেইস। কাউকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে আড়ালে সারিয়ে রাখতে হলে এইসব মামলা করা হয়। পুলিশ যদি নিজেরাই কিছু অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে বলে এইসব পাওযা গেছে তাহলে কি করার আছে বলুন। এটা কোর্টে প্রমাণ করা মুশকিল যে, অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়নি। তাছাড়া আমার ধারণা এই ছেলেটির আগের রেকর্ডও ভাল না। ঠিক না?

জি ঠিক।

আপনার যা করা উচিত তা হচ্ছে বড় কোন নেতা-ফেতার কাছে যাওয়া। আছে তেমন কেউ?

জি না।

খুঁজে বের করুন। বাংলাদেশ ছোট জায়গা। খুঁজলেই কাউকে পাবেন যার আপনি দুলাভাই কিংবা ভায়রা ভাই হচ্ছেন কোনো তালেবর ব্যক্তি। তার মাধ্যমে কাজ করুন। আইন? আইনের হাত বেঁধে ফেলা হচ্ছে। অন্তত চেষ্টা চলছে। বুঝবেন। নিজেই বুঝবেন। হা হা হা! উঠলেন নাকি?

জি উঠছি।

মামলাটা আমি নিচ্ছি না।–কিছু মনে করবেন না। প্রথম দিন যে টাকা দিয়েছিলেন সেটি ফেরত দেয়া উচিত কিন্তু দিচ্ছি না। কারণ আমি কিছু উপদেশ দিয়েছি। প্রফেশনাল এডভাইস। ওর একটা চার্জ আছে। আচ্ছা বিদায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *