1 of 2

৩৫. লেখার টেবিলে বসে আছে ইন্দিরা

মেঘলা দুপুরবেলা জানলার ধারে লেখার টেবিলে বসে আছে ইন্দিরা। বালিগঞ্জের এই বাড়িটি জ্ঞানদানন্দিনী কিনেছেন কিছুদিন আগে। কলকাতার দক্ষিণে বালিগঞ্জ নামে অঞ্চলটি খুবই জনবিরল, মাঝে মাঝে একটি-দুটি বাড়ি, আর বেশিরভাগই ঝোপঝাড় ও পুকুর। ন’ বিঘে জমির ওপর এই বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে বড় বড় গাছপালা, রাস্তা দিয়ে ক্কচিৎ দু-একটি গাড়ি-ঘোড়া যায়।

একটা বাঁধানো খাতায় একখানি চিঠি দেখে দেখে টুকে রাখছে ইন্দিরা। মাঝে মাঝে লেখা থামিয়ে অলস নেত্রে দেখছে জানলার বাইরের দৃশ্য। মেঘের ছায়া পড়েছে সামনের চত্বরে, উদ্যানে, দূরের দিঘিতে। অনেক উঁচু আকাশ থেকে ঘুরে ঘুরে নামছে চিল, ওরা আসন্ন বৃষ্টির গন্ধ পায়। জামরুল গাছটায় লাফালাফি করছে গুটিকতক হনুমান, মনরাখন নামে দারোয়ান লোহার গেটে পিঠ ঠেকিয়ে উদাস সুরে কী একটা গান গাইছে। আবার লেখায় মনোনিবেশ করল ইন্দিরা। খানিক বাদে কিছু একটা শব্দে পিছনে তাকিয়ে সে দেখতে পেল, কখন সরলা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে। গেট দিয়ে সরলার গাড়ি ঢোকার শব্দও সে টের পায়নি।

চট করে চিঠিটা ভাঁজ করে ব্লাউজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল ইন্দিরা, তারপর খাতাটা বন্ধ করে বলল, ওমা, সল্লি, আয় আয়—।

সরলা কাছে এসে বলল, সারা বাড়িতে দেখি সবাই ঘুমোচ্ছে। তুই বুঝি দুপুরে ঘুম দিস না!

ইন্দিরা বলল, দুপুরবেলা আমার ঘুম আসে না। বৃষ্টি আসবে, বাইরের আলোটা কী সুন্দর হয়েছে দ্যাখ! ঠিক ভোরবেলার মতন।

সরলা বলল, এরকম ডিফিউজড লাইট আমারও ভাল লাগে। বিবি, তুই আমাকে দেখেই কী লুকিয়ে ফেললি রে?

ইন্দিরা সঙ্গে সঙ্গে বুকের কাছে হাত চাপা দিয়ে বলল, ও কিছু না।

সরলা সারা মুখ হাসিতে ঝলমলিয়ে বলল, চিঠি, তাই নারে? কার চিঠি, দেখি দেখি!

সরলা হাত বাড়াতেই ইন্দিরা খানিকটা পিছিয়ে গেল। সরলা তবু তাকে ধরতে যেতেই দৌড়তে লাগল ইন্দিরা। কৌতুকহাস্যে খলখলিয়ে সরলা বলল, তবে রে, দিবি না? আমি দেখবই—

দুই বোনে ছোটাছুটি করতে লাগল কক্ষের মধ্যে। সরলার শাড়ি আঁটসাঁট করে পরা, ইন্দিরার আঁচল লুটোচ্ছে। সরলা দৌড়ঝাঁপে অভ্যস্ত, ইন্দিরা নরম, নমনীয়। অচিরেই সরলা ধরে ফেলল ইন্দিরাকে, ইন্দিরা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল, না, না, দেব না, দেব না, কিছুতেই দেব না।

সরলা থমকে গেল। ইন্দিরার মুখের দিকে বেশ কয়েক পলক দৃষ্টি স্থাপন করে শান্ত গলায় বলল, সত্যি দেখাবি না? তবে থাক। আমি কি জোর করে কেড়ে নেব নাকি?

সরলা টেবিলের কাছে সরে এসে চেয়ারটিতে বসল।

ইন্দিরা বুক থেকে চিঠিখানা বার করে রেখে দিল একটা দেয়াল-আলমারিতে। সেটাতে চাবি বন্ধ করল।

সরলা খাতাখানা খুলে পড়া শুরু করল। ইন্দিরার হস্তাক্ষর যাকে বলে মুক্তোর মতন। বাংলা ও ইংরিজি দুটোই পাকা লেখা। কয়েক লাইন পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে সরলা বলল, এ কী লিখেছিস রে বিবি? এত সুন্দর ভাষা। তোকে ভারতী পত্রিকার জন্য কিছু লেখা দেবার জন্য বলে বলে হন্যে হয়ে গেছি। কিছুতেই লেখা দিস না। আর এদিকে লুকিয়ে লুকিয়ে সাহিত্যচর্চা করিস? ‘আজকাল আমি আমার লেখা ও আলস্যের মাঝে মাঝে কবি কীটসের একটি ক্ষুদ্র জীবনচরিত অল্পস্বল্প পাঠ করি। পাছে একদমে একেবারে শেষ হয়ে যায় সেই জন্য রেখে রেখে রয়ে রয়ে পড়ি–পড়তে বেশ লাগে। আমি যত ইংরাজ কবি জানি সবচেয়ে কীটসের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আমি বেশি করে অনুভব করি।… কীটসের লেখায় কবিহৃদয়ের স্বাভাবিক সুগভীর আনন্দ তার রচনার কলানৈপুণ্যের ভেতর থেকে একটা সজীব উজ্জ্বলতার সঙ্গে বিচ্ছুরিত হতে থাকে। সেইটে আমাকে ভারি আকর্ষণ করে।’… বাঃ বাঃ, অতি চমৎকার। কীটসের ওপর এই প্রবন্ধটা তুই আজই ‘ভারতী’র জন্য কপি করে দে!

ইন্দিরা ওষ্ঠ টিপে হেসে বলল, ওটা বুঝি আমার লেখা? তুই পড়ে বুঝতে পারলি না? আমি অমন ভাষা লিখতে পারি? তা হলেই হয়েছে।

তবে এ কার রচনা?

রবিকা’র লেখা!

রবিমামার লেখা, তোর খাতায় কেন? তোরই তো হাতের লেখা দেখছি।

রবিকা আমায় যত চিঠি লেখেন, তার কতক কতক অংশ আমি এই খাতায় টুকে রাখি। এগুলির লিটারেরি ভ্যালু অমুল্য।

রবিমামার সব লেখারই লিটারেরি ভ্যালু অমূল্য। কিন্তু চিঠি থেকে খাতায় টোকার কী মানে হয়? পুরো চিঠিই তো রেখে দেওয়া যায়।

চিঠি হারিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া পুরো চিঠি তো সকলের পড়ার দরকার নেই। বাদ দিয়ে বাদ দিয়ে টুকে রাখি।

সরলা মুখ তুলে একটুক্ষণ বিমূঢ়ভাবে চুপ করে রইল। তারপর বলল, তুই যে চিঠিটা লুকোচ্ছিলি, সেটাও রবিমামার চিঠি? আমি ভেবেছিলুম, কার না কার প্রেমপত্র! রবিমামার চিঠি তুই আমাকেও দেখাবি না কেন?

ইন্দিরা জানলার বাইরে চেয়ে দৃঢ় স্বরে বলল, রবিকা আমাকে যে চিঠি লিখেছেন, সেগুলি আমি কোনওদিন কারুকে দেখাব না। ও আমার নিজস্ব সম্পত্তি।

সরলা ঠোঁট উল্টে বলল, কী জানি বাপু, আমি বুঝি না। রবিমামার চিঠি কি একবার দেখলেও ক্ষয়ে যাবে নাকি?

একটু থেমে সে আবার বলল, রবিমামা আমার ওপর রাগ করে আছেন শুনেছি।

ইন্দিরা এবার বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কেন, কেন, রবিকা তোর ওপর রাগ করবেন কেন?

ওই যে আমি প্রতাপাদিত্য উৎসব প্রবর্তন করার চেষ্টা করছি। রবিমামা ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে প্রতাপাদিত্যের চরিত্র অন্যরকম এঁকেছেন। উনি কাকে যেন বলেছেন, ওই প্রতাপাদিত্যটা তো একটা বিশ্বাসঘাতক, খুনি! সরলা এখন তাকে হিরো বানাতে চাইছে! দ্যাখ বিবি, প্রতাপাদিত্যের তো অন্য দিকও আছে। সামান্য জমিদার হয়েও দিল্লির বাদশাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই যে রাজশক্তির বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরার সাহস আর তেজ, আমি বাঙালির কাছে সেটাকেই আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে চাই।

-ও, এই ব্যাপার। রবিবার রাগ বেশিদিন থাকে না। দুদিন বাদেই ভুলে যাবেন।

রবিমামা আমাকে কখনও চিঠি লেখেন না।

সল্লি, তুই কত কাণ্ডই না করছিস শুনতে পাই। ছেলেদের সভায় বক্তৃতা, তলোয়ার পুজো, বাড়িতে কারা সব লাঠিসোটা নিয়ে দাপাদাপি করে, ধন্যি তোর সাহস!

তোকেও তো কতবার ডাকাডাকি করি। কতবার বলেছি, বিবি, তুই আয়, আমরা একটা দল গড়ি, এ দেশের মেয়েদের জাগাতে হবে।

আমি বাপু ওসব পারি না। বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমার মুখই খোলে না। সল্লি, তুই একা একা চাকরি করতে গেছিস, কত মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছিস, পুরুষরা তোর হুকুম মানে, তোকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।

তুই আমার সঙ্গে যোগ দে। আস্তে আস্তে সব পেরে যাবি।

সবাই কি সব কিছু পারে? মা তো সব সময় বলে, আমি নাকি ইনট্রোভার্ট। আমি বাড়ি বসে, একলা একলা বইটই পড়তে ভালবাসি। আমি বইয়ের জগতে ঘুরে বেড়াই। সাহিত্য-গানবাজনা এই সবেব মধ্যে আমি বড় আনন্দে থাকি। বাড়ির বাইরে কী সব ঘটছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না।

তা হলে তুই বিয়ে করছিস না কেন, মুখপুড়ি? শুধু শুধু বয়েস বেড়ে যাচ্ছে।

আহা-হা, কে কাকে বলে! তোর মা কত ভাল ভাল পাত্র জোগাড় করে আনে, তুই সব কটা নাকচ করে দিস না?

আমার কথা আলাদা। আমি বিয়ের জন্য তৈরি নই।

মা বলে, সল্লির উপযুক্ত পাত্র এ দেশে পাওয়া যাবে না। ঢাল-তরোয়ালধারী বীর যোদ্ধা চাই, সে আর বাঙালিদের মধ্যে কোথায়?

বিবি, তুই কেন বিয়ে করতে চাস না সত্যি করে বল তো! তোর যখন অন্য কোনও অ্যামবিশান নেই, তোর পক্ষে বিয়ে করাই তো স্বাভাবিক। কত ছেলে তোর জন্য হেদিয়ে মরছে! এখানে তো আর কেউ নেই, আমাকে বল না, বিয়ে সম্পর্কে তোর কী ধারণা? তুই ভয় পাস?

ভয়? তা এক রকম বলতে পারিস। আমার দূরে চলে যেতে ভয় করে। বিয়ে হয়ে গেলে কোনও একটা অচেনা জায়গায় চলে যাব। সব অচেনা মানুষজন, এখানকার সবাইকে ছেড়ে থাকতে হবে।

কেন, কলকাতা শহরের মধ্যে বুঝি বিয়ে হতে পারে না? এখন তো আর সেই আগেকার দিন নেই, যে মেয়ের বিয়ে হল আর বাপের বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকে গেল, শ্বশুরবাড়িতে বন্দি হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন! কলকাতায় বিয়ে হলে বাপের বাড়িতে আসা-যাওয়া করবি। কিংবা একজন বেশ শান্তশিষ্ট ঘরজামাই আনলেই হয়, তোকে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে না। ঠাকুর পরিবারে সেটা তো নতুন কিছু নয়।

আমি ঘর-জামাইদের দুচক্ষে দেখতে পারি না। এই যাঃ– কী বলে ফেললুম!

লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমার বাবাও ঘর-জামাই থাকেননি। তোর জন্য আমার চিন্তা হয়, বিবি। শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকিস, শেষ পর্যন্ত যদি তোর বিয়ে না হয়? বিধবা হওয়ার চেয়েও আইবুড়ো হয়ে থাকা কি কম জ্বালা?

তুই থাম তো, আর বিয়ে বিয়ে করতে হবে না। আমার বিয়ের চিন্তায় গোটা বংশের কারুর যেন ঘুম নেই। সকলের মুখে এক কথা। তুই যে বিয়ে করছিস না সে জন্য তোকে তো কেউ কিছু বলতে সাহস করে না। আমার জন্যই শুধু যত চিন্তা। সেদিন দিনু পর্যন্ত এসে বলল, বিবিপিসি, বিয়ে করো না কেন? আমি বললুম, ধ্যাৎ, তুই থাম তো ছোঁড়া। ভাইপো হয়ে আবার পিসির বিয়ে দিতে এসেছেন।

দুই বোন এবার প্রাণ খুলে হাসতে লাগল।

সরলা ও ইন্দিরা যথাক্রমে পঁচিশ ও চব্বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত কুমারী থেকে ঠাকুর পরিবারে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে দিয়েছে। শুধু ঠাকুর পরিবারে কেন, বাংলায় আর কোনও ভদ্র, উচ্চবংশীয় পরিবারে এরকম সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার একেবারে অকল্পনীয়। অথচ দুটি কন্যারই পাণিপ্রার্থীর সংখ্যা প্রচুর।

ইন্দিরা বলল, নু জাভোঁ শাঁঝ তুত সেলা, তাই না?

সরলা বলল, ফরাসি কথা, মানে কী রে?

ইন্দিরা বলল, আমরা ও সব রীতি-নীতি বদলে দিয়েছি। মলিয়েরের একটা নাটকে আছে। অচেনা একজন লোককে বিয়ের মন্ত্র পড়ার পরেই প্রাণনাথ বলে আমি ডাকতে পারব না। ওসব আমার দ্বারা হবে না।

সরলা আবার খাতাখানি ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, রবিমামা তোকে এত চিঠি লিখেছেন?

ইন্দিরা বলল, রবিকা যেখানেই যায়, আমাকে লেখে। আমার কাছে সব মনের কথা বলে। সল্লি, তুই নিশ্চয়ই মানবি, রথীর মা এসব কথা কিছুই বুঝতে পারে না। আমার আজকাল প্রায়ই মনে হয়, রবিকা খুব একা। বাড়িতে যখন থাকে, বউয়ের কাছে শুধু ঘর-সংসারের কথা আর ছেলেমেয়েদের কথা শুনতে হয়। এতে কি তার মন ভরে? একটা নতুন কবিতা লিখে কাকে শোনাবে? রথীর মাকেও দোষ দিতে পারি না, পাঁচ-পাঁচটা ছেলেমেয়েকে সামলাতেই হিমসিম খেয়ে যায়।

সরলা বলল, শুধু ছেলেমেয়ে সামলানো নয়, মৃণালিনীমামী রান্নাঘর বড্ড ভালবাসে, যখনই যাই দেখি যে রান্নাঘরে কিছু না কিছু রাঁধছে।

ইন্দিরা বলল, রবিকার জন্য আমার মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। অতবড় একজন কবি। এই যে রবিকা কীটসের কথা লিখেছে, কীটস ভাল কবি হতে পারে, রবিকাই বা কম কীসে? সাহেবদের দেশে জন্মালে রবিকার আজ কত কদর হত। সাহেবরা ওর লেখার খবরও রাখে না।

সরলা বলল, তুই ইংরেজিতে কিছু কিছু কবিতার অনুবাদ কর না! ইংরিজির এত ভাল ছাত্র ছিলি…

ইন্দিরা বলল, আমার দ্বারা হবে না। কত বড় বড় পণ্ডিত রয়েছেন। কারুর না কারুর করা উচিত। আমার কী মনে হয় জানিস, সল্লি, যথাসাধ্য রবিকার সেবা করি, ওর কাছাকাছি থাকি, ওর মনে স্ফূর্তি এনে দিই, দেশ-বিদেশের সাহিত্য নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করি, গান শোনাই… তুই লক্ষ করেছিস, পিয়ানোতে নতুন কোনও সুর বাজালে রবিকার অমনি গান রচনার ইচ্ছে জাগে? কতদিন আমাদের সঙ্গে কথা বলা বা তর্ক করার পর রাত্তিরে সে বিষয়ে কবিতা লিখেছেন বা প্রবন্ধ লিখেছেন। একজন প্রতিভাবান লেখককে উৎসাহিত করার জন্য আমার মতন দুএকজনের জীবন নিবেদন করলেও একটা কাজ হয়। রবিকার জন্য আমি সব কিছু ছাড়তে পারি। সারাজীবন বিয়ে না করে আমি যদি রবিকার কাছাকাছি থাকি, তাতে আমার একটুও কষ্ট হবে না।

সরলা জিজ্ঞেস করল, রবিমামা তোকে বিয়ের জন্য তাড়া দেন না?

ইন্দিরা বলল, আর সবাই বললেও রবিকা একবারও ও কথা উচ্চারণ করেননি।

এই সময় শত শত ঘোড়া ছটিয়ে এসে পড়ল ঝড়। জানলাগুলিতে খটাখট শব্দ হতেই ওরা দৌড়ে গেল। ইন্দিরা পর পর জানলা বন্ধ করতে লাগল, সরলা একটির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এটা বন্ধ করতে হবে না, আয় ঝড় দেখি।

ইন্দিরা বলল, চোখে ধুলো লাগবে যে।

সরলা বলল, লাগুক। প্রকৃতির এই শক্তির প্রকাশ দেখলে আমার ভারী আনন্দ হয়। দ্যাখ দ্যাখ বড় বড় গাছের ডগাগুলো কেমন নুইয়ে দিয়েছে বাতাস, যে বাতাস দেখা যায় না।

ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দে ইন্দিরার ভয় ভয় করে, চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের পর প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল কাছাকাছি কোথাও। কিন্তু সরলা সরে আসার পাত্রী নয়, সে দাঁড়িয়ে রইল জানলার শিক ধরে।

একটু পরেই ঝড় প্রশমিত হয়ে নামল বৃষ্টি। বৃষ্টি দেখতে ইন্দিরারও ভাল লাগে, সে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির স্পর্শ নিতে নিতে গুনগুনিয়ে গাইতে লাগল একটা গান।

হঠাৎ গান থামিয়ে বলল, সল্লি, তোর তো বীরপুরুষ পছন্দ। ঢাল-তলোয়ারধারী বাঙালি যখন পাওয়া যাবে না, বন্দুকধারী বাঙালি হলে চলবে? প্রতিভাদিদির এক দেওর, কুমুদ, তিনি খুব ভাল বন্দুক চালাতে পারেন। প্রায়ই শিকার করতে যান শুনেছি। একবার সেই কুমুদবাবুকে দেখবি নাকি?

সরলা সকৌতুকে বলল, চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি? প্রতিভাদিদির তো অনেকগুলো দেওর, তারা তো প্রায়ই এ বাড়িতে তোর হাতের চা খেতে আসে শুনেছি।

ইন্দিরা বলল, ওরা রবিকাকে খুব পছন্দ করে, রবিকার সঙ্গে দেখা করতে আসে।

সরলা বলল, রবিমামার সঙ্গে দেখা করার জন্য জোড়াসাঁকোর বাড়িতে না গিয়ে এখানে আসে যখন, নিশ্চয়ই অন্য টান আছে। হ্যাঁরে বিবি, ওদের ভাইদের মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট, সেই সুহৃৎনাথের সঙ্গে আমাদের দ্বিপুদার মেয়ে নলিনীর বিয়ে হয়ে গেল, অথচ তার ওপরে ক’টা ভাই রয়েছে, তারা এলিজিবল ব্যাচেলর, তাদের এখনও বিয়ে হল না, এটা কী রকম ব্যাপার রে?

ইন্দিরা বলল, তা আমি কী জানি?

সরলা বলল, তুই জানিস না? সুহৃতের এক দাদা, প্রমথ, ওই যে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেও ভারেন্ডা ভাজছে, সেও তো বিয়ে করেনি। তুই সেই প্রমথকে আপনির বদলে তুমি বলিস? আই অ্যাই, মাথা নাড়লে চলবে না, আমি শুনে ফেলেছি। গতবারে সুরেনের জন্মদিনে অনেকে এসেছিল, আশু চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সবাই ছিল, একসময় তুই সিঁড়ি দিয়ে নামছিলি আর প্রমথ উঠছিল, তুই আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলি, তুমি খেয়েছ? ভাল করে খেয়েছ? আমি পেছন থেকে শুনে ফেলেছি!

ইন্দিরা লজ্জাবনত মুখে বলল, উনি ইনসিস্ট করেন আমাকে তুমি বলার জন্য।

সরলা বলল, উনি ইনসিস্ট করলেই…তুই প্রথমে যখন চিঠিখানা লুকোচ্ছিলি, আমি ভেবেছিলাম বুঝি ওই প্রমথবাবুর চিঠি। মানুষটি খুব বাক্যবাগীশ। তোকে চিঠি লেখে নিশ্চয়ই?

ইন্দিরা বলল, তা লেখেন কখনও সখনও। আমরা পরস্পরের বন্ধু।

সরলা ভুরু তুলে বলল, বন্ধু? এই বন্ধুত্বের পরিণতি কী?

ইন্দিরা বলল, কী আবার পরিণতি হবে? একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকতে পারে না সারাজীবন?

সরলা বলল, কেন পারবে না? দুজনেই যদি লেখাপড়া জানা হয়, একটা ইনটেলেকচুয়াল ফ্রেল্ডশিপ তো হতেই পারে। কিন্তু সমাজ কি তা মেনে নেবে?

এই আলোচনা আর এগোতে পারল না, দেখা গেল, গেট দিয়ে একটা বগি গাড়ি ঢুকছে। দু’জনেই সেদিকে তাকাল, ইন্দিরা বলে উঠল, রবিকা এসেছে, রবিকা!

সরলা বলল, আমি তবে এবার যাই?

ইন্দিরা বলল, ওমা, রবিকা এসেছে। তুই চলে যাবি কেন? দেখা করবি না?

সরলা বলল, উনি বোধহয় তোর সঙ্গে আলাদা করে বিশেষ কোনও কথা বলতে এসেছেন।

ইন্দিরা এবার হেসে বলল, ধ্যাৎ! মুখখানা তোর ফ্যাকাসে হয়ে গেল কেন রে সল্লি? রবিকাকে ভয় পাচ্ছিস নাকি? দেখিস, রবিকা তোকে কিছুই বকবেন না।

গাড়ি থেকে নামতে নামতেই বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজে গেছেন রবি। একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে লম্বা টানা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে এলেন। পরনে শুধু কুর্তা আর পাজামা। ইন্দিরা দরজার কাছে উৎসুকভাবে দাঁড়িয়েছে, রবি কাছে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, বি, বি, দুটো মৌমাছি, দেখিস যেন হুল ফোটাসনি!

ইন্দিরা বলল, রবিকা, সল্লি এসেছে।

ঘরের ভেতরে তাকিয়ে রবি বললেন, এই যে বীরাঙ্গনা, আবার কী নতুন প্রস্তাব?

সরলা শুধু হাসল।

রবি বললেন, সল্লি, এমাসের ‘ভারতী’ খানা পাইনি এখনও। পাঠিয়ে দিস তো।

তারপর ইন্দিরার দিকে ফিরে বললেন, এক্ষুনি যেতে হবে রে। অনেক কাজ। কালই নাটোর রওনা হব। বিবি, তোদের বাড়িতে আমার পকেট-ঘড়িটা ফেলে গেছি? কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না তো। বাইরে গেলে ঘড়িটা লাগে।

ইন্দিরা বলল, ঘড়ির কথা তোমার খেয়ালই থাকে না। ভুলো গঙ্গারাম একটা। মা সে ঘড়ি তুলে রেখেছেন। হঠাৎ নাটোর যাবে কেন?

রবি বললেন, হঠাৎ কেন হবে, আগে থেকেই তো ঠিক হয়ে আছে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কনফারেন্স হবে না নাটোরে? অনেকেই যাচ্ছেন। এবার সেখানে একটা হাঙ্গামা বাধাব।

ওমা, কীসের হাঙ্গামা হবে?

বড় বড় নেতাদের দিয়ে এবারে বাংলা বলিয়ে ছাড়ব। গ্রামের সাধারণ মানুষের সামনে ওঁরা ইংরিজি বক্তৃতার তুফান ছোটান, কেউ কিছু বুঝতে পারে না। এরকমটা আর চলতে দেওয়া যায় না। ছেলে ছোকরাদের একটা দলকে উস্কে রেখেছি, ওখানে কোনও নেতা ইংরিজি বক্তৃতা শুরু করলেই তারা হই হই রব তুলবে।

রবিকা, আমিও নাটোর যাব। আমাকে নিয়ে চলো

তুই যাবি? তা যেতে পারিস।

সরলা বলল, রবিমামা, আমিও নাটোর যেতে চাই।

রবি তার দিকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, তুইও যাবি? তোর যাওয়ার যে একটু মুশকিল আছে।

সরলা বলল, কীসের মুশকিল? কলকাতার ন্যাশনাল কংগ্রেসের অধিবেশনে আমি গান গেয়েছি, প্রাদেশিক কংগ্রেসে যাবার অধিকার নেই আমার?

রবি বললেন, অধিকার নিশ্চয়ই আছে। মুশকিলটা হচ্ছে এই, নাটোরের রাজা জগদিন্দ্র এবারকার হোস্ট। জগদিন্দ্র একদিন বলছিলেন, সরলা ঘোষাল কী সব করছে, ওর পেছনে পুলিশ লাগবে। তুই গেলে তোর পিছু পিছু নাটোরেও যদি পুলিশ যায়, সেটা জগদিন্দ্রের পক্ষে সুখকর হবে না। আমার অবশ্য মনে হয় না, পুলিশ এতটা বাড়াবাড়ি করবে।

সরলা ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে ক্ষুন্ন স্বরে বলল, আমি না গেলেও তুই যাবি?

ইন্দিরা আস্তে আস্তে দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, না।

রবি বললেন, বরং তোরা দুজনেই এক কাজ কর। আমি সরাসরি যাচ্ছি না, আমাকে একবার শিলাইদহ ঘুরে যেতে হবে। অবন, বলু এরা সব যাচ্ছে স্পেশাল ট্রেনে পরশু দিন। ওদের সঙ্গে কথা বলে দ্যাখ না, ওরা যদি তোদের নিয়ে যায়—

শেষ পর্যন্ত অবশ্য দু’বানেরই নাটোর যাওয়া হল না। মহারাজ জগদিন্দ্র কংগ্রেসের সব নেতা এবং প্রতিনিধিদের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর বাড়ির দু’তরফের প্রায় সবাইকেই ঢালাও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু মহিলাদের কথা উল্লেখ করেননি। অনাহুতভাবে মহিলাদের নিয়ে যাওয়া চলে না, তাদের থাকার ব্যবস্থার অসুবিধে হবে।

কংগ্রেসের অধিবেশন বটে, কিন্তু এ যেন নাটোরের রাজার ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ। খরচপত্র সবই তাঁর। কলকাতা থেকে পুরো একটি স্পেশাল ট্রেন, প্রতিটি স্টেশনে, মহারাজের লোক দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার, তা ছাড়াও কার কী প্রয়োজন তার তদারকি করার জন্য। ট্রেন এসে থামল সারাঘাটে, সেখানে স্টিমার প্রস্তুত। নাটোর পৌঁছে দেখা গেল, ব্যবস্থাপনা একেবারে নিখুঁত তো বটেই, এলাহি ব্যাপার যাকে বলে। অনেকগুলি বাড়ি সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়েছে, সকলের জন্য নম্বর করা নির্দিষ্ট বিছানা, প্রত্যেক বিছানার পাশে একটি করে বাক্স, তার মধ্যে রয়েছে নতুন ধুতি-চাদর। কলকাতা থেকে সবাই নিজস্ব পোশাক-পরিচ্ছদের পুঁটুলি নিয়ে এসেছেন, সেগুলি খোলারই দরকার হবে না।

এমনভাবে সকলকেই ধুতি-চাদর উপহার দেওয়ার অন্য একটি গূঢ় উদ্দেশ্যও আছে। রবি এবং তাঁর অনুরাগী তরুণ সমাজ আগে থেকেই মতলব করে এসেছে, এবারের সম্মেলনে সকলকেই বাঙালি মতে দেশি পোশাক পরে আসতে হবে। এখন বাড়ির বাইরে বাঙালিরা চোগা-চাপকান পরে থাকেন, আর বিলেত-ফেরত বা হোমড়া-চোমড়ার সর্বক্ষণ সুট-টাই। মোজা না পরা অবস্থায় পা দেখানো তাঁরা কল্পনাই করতে পারেন না। এখন ধুতি-চাদর পরার প্রস্তাব উঠলে কেউ আর বলতে পারবেন না যে আমি ধুতি আনিনি।

শুধু বাঙালি পোশাক নয়, সম্মেলনের সব কার্যক্রম চলবে বাংলা ভাষায়। অধিবেশনের শুরুতেই যুবকের দল এই প্রস্তাব তুলবে। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্র রবির চেয়ে বয়েসে ছ’সাত বছরের ছোট হলেও রবির বিশেষ অনুরক্ত বন্ধু, রবি তাঁকে একটি বইও উৎসর্গ করেছেন। মহারাজ জগদিন্দ্রকে রবি শুধু নাটোর বলে ডাকেন। জগদিন্দ্রের গানবাজনা, খেলাধুলো ও সাহিত্য সব দিকেই খুব উৎসাহ, নিজে ভাল পাখোয়াজ বাজান। প্রবীণ নেতাদের বিরুদ্ধে নবীন দলের এই যে বিদ্রোহ, জগদিন্দ্রও তাতে গোপনে যোগ দিয়েছেন।

প্রবীণরা কিন্তু নবীনদের এই দাবি মানতে চাইলেন না। সম্মেলন শুরু হবার আগেই চলতে লাগল তর্ক বিতর্ক। প্রবীণদের মধ্যে আছেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালমোহন ঘোষ, জানকীনাথ ঘোষাল প্রমুখ। তাঁরা বললেন, অনেকদিন ধুতি পরার অভ্যেস নেই। সভার মাধ্য মুক্তকচ্ছ হবার সম্ভাবনা। আর বাংলায় বক্তৃতা? কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় দল, সেখানে বাংলায় বক্তৃতা কেন হবে?

তরুণরা বলল, মুক্তকচ্ছ হবার সম্ভাবনা থাকলে বেল্ট বেঁধে ধুতি পরুন। আর কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল ঠিকই, কংগ্রেসের বাৎসরিক জাতীয় অধিবেশনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধি আসে, সেখানে ইংরিজিতে বক্তৃতার যুক্তি আছে। কিন্তু প্রাদেশিক কনফারেন্স হচ্ছে বাংলাদেশে, বক্তারা সবাই বাঙালি, আর শ্রোতারাও বাংলার সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যে চাষা-ভুষোও থাকে, তারা ইংরিজি এক বর্ণও বোঝে না। তাদের সামনে চোস্ত ইংরিজিতে বক্তৃতা করা হাস্যকর নয়?

প্রবীণরা বললেন, বাংলায় আবার বক্তৃতা দেওয়া যায় নাকি? বাংলায় সারগর্ভ কথা বলার মতন ভোকাবুলারিই নেই। সাধারণ ঘর সংসারের কথা বাংলায় চলে, রাজনৈতিক বক্তৃতা চলে না।

এর প্রতিবাদে যুবকে দল হই হই করে উঠল।

শেষ পর্যন্ত একটা রফা হল। যে-ক’জন নেতা ইংরিজি ছাড়া বাংলায় বক্তৃতা দিতে একেবারেই পারেন না, তাঁরা ইংরিজিতেই বলবেন, তরুণদের পক্ষ থেকে কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সব বক্তৃতা সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় অনুবাদ করে শোনাবেন। আর গান হবে সব বাংলায়, তা বলাই বাহুল্য।

মাঠের মধ্যে প্রকাণ্ড শামিয়ানা খাটানো হয়েছে, কয়েক হাজার লোকের সেখানে স্থান সঙ্কুলান হবে। অধিবেশনেব আর দু’দিন বাকি আছে, এর মধ্যে আদর-আপ্যায়নের ঠেলায় কারুর কারুর প্রাণ ওষ্ঠাগত। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ডজন হুঁকো-বরদার এসে বিছানাতেই গড়গড়ার নল হাতে গুঁজে দেয় ধূমপায়ীদের। যারা চুরুট কিংবা সিগারেট পছন্দ করে, তাদের জন্যও ওসব রয়েছে প্রচুর। প্রাতঃকৃত্য সারার পরেই কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে জলপান, চপ কাটলেট, লুচি-মণ্ডা, পুডিং, মিষ্টান্ন তো আছেই, তা ছাড়া কার চা, কার কফি, কার ডাবের জল, সোডার জল বা অন্য পানীয় চাই, তাও হাতের কাছে মজুত। দুপুরে ও রাত্রের ভোজের জন্য ভিয়েন বসেছে। বড় বড় উনুনে সর্বক্ষণ রান্না চলেছে, পাচক-হালুইকররা সদা ব্যস্ত, বারোয়ারি খানা নয়, যে-যেটা খেতে চাইবে, ঠিক সেইরকমই প্রস্তুত করে দেওয়া হবে। মাছ-মাংস-ডিম-পিঠে-পায়েস সবই আছে। একজন রসিকতা করে বলল, রসগোল্লা গরম গরম হয়, কিন্তু সন্দেশ হয় ঠাণ্ডা। গরম সন্দেশ পাওয়া যায় না? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, কেন পাওয়া যাবে না? খাবারের ঘরের দরজার সামনে উনুন পেতে মস্ত কড়া চাপানো হল। সন্দেশ পাক দিয়ে সেই কড়াই থেকেই গরম গরম তুলে এনে দেওয়া হল সকলকে।

আলাদা আলাদা বাড়িগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ক্যাম্প। বয়সের তারতম্য অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা। সাহেব-মনস্ক প্রবীণদের নানারকম পিটপিটিনি দেখে তরুণরা আড়ালে হাসাহাসি করে। তরুণদের শিবিরই গান বাজনা, হই-হুল্লোড়ে জমজমাট। গান গাইবার জন্য রবিকে নিয়ে সবাই টানাটানি করে।

অনেকদিন পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথও বাইরে বেরিয়েছেন, এসেছেন এই দলের সঙ্গে। এখনও তাঁর মনের ভার কাটেনি, সকলের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারেন না, মাঝে মাঝেই উদাসীনের মতন চুপ করে বসে থাকেন। রবিও যেন জ্যোতিদাদাকে একটু এড়িয়ে এড়িয়ে চলেন, দু’জনে মুখোমুখি পড়ে গেলে কথা খুঁজে পান না। সময় মানুষকে কত বদলে দেয়। চন্দননগরের সেই সুমধুর দিনগুলির কথা মনে পড়লে এখনও রবির বুক মুচড়ে ওঠে।

বিশেষ কারুর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, এখন তার ছবি আঁকার ঝোঁক চেপেছে। নাটোরের বিভিন্ন মন্দির ও প্রাসাদের স্কেচ করেন, কিছু কিছু মানুষেরও স্কেচ করেন, যাদের মাথার আকৃতি আকর্ষণীয় মনে হয় তাঁর কাছে। ছেলে-ছোকরাদের মধ্য থেকেই বেছে নিচ্ছেন, চাঁইদের ধারে কাছে যান না। এক এক সময় তাঁর সঙ্গে থাকে এক ভাইপো, অবন। এই ছেলেটির আঁকার হাত বেশ ভাল।

সম্মেলনের শুরুতে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন ইংরিজিতে। মেজদাদার পাশে দাঁড়িয়ে রবি তৎক্ষণাৎ প্রতিটি বাক্যের অনুবাদ করে শোনাতে লাগলেন বাংলায়। এরপর অন্যান্য বক্তারাও ইংরিজিতেই বক্তৃতার আগুন ছোটালেন। বিক্ষুব্ধ তরুণরা মাঝখানে একবার চ্যাঁচামেচি করে উঠলেও সুবিধে হল না। বক্তারা বাংলাতে বলবেনই না। রবি সকলের বক্তৃতাই বাংলায় অনুবাদ করে যেতে লাগলেন। বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর কোনও ক্লান্তি নেই। শুধু শেষের দিকে বিখ্যাত বাগ্মী লালমোহন ঘোষ একেবারে বিশুদ্ধ ও জোরালো বাংলায় বক্তৃতা করে চমকিত করে দিলেন সবাইকে। শ্রোতারা সহর্ষ হাততালিতে তাঁকে অভিনন্দন জানাল। এই তো যেন জয় হল বাংলা ভাষার।

রবির গান দিয়েই প্রথম দিনের অধিবেশন শেষ হল।

সভাভঙ্গের পর বাইরে বেরুবার সময় পাক্কা সাহেব ডব্লু সি ব্যানার্জি রবির কাঁধ চাপড়ে বাঁকা সুরে বললেন, ওয়েল, ওয়েল, রবিবাবু, ইয়োর বেঙ্গলি ওয়াজ ওয়ান্ডারফুল, বাট ডু ইউ থিঙ্ক ইয়োর চাষাজ অ্যান্ড ভুষাজ আল্ডারস্টুড ইয়োর মেল্লিফ্লুয়াস বেঙ্গলি বেটার দ্যান আওয়ার ইংলিশ?

অনেকেরই আশঙ্কা ছিল প্রবীণ ও নবীন দলের মন কষাকষিতে সম্মেলন ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেরকম কোনও সম্ভাবনা দেখা দিল না। কিন্তু আর একটি সাঙ্ঘাতিক বিপদ যে আসন্ন, তা কেউ জানে না তখনও।

সভা মণ্ডপের বাইরে টেবিল-চেয়ার পেতে চা পানের ব্যবস্থা হয়েছে। বিকেল পাঁচটা বাজে, আকাশ পরিষ্কার। কিন্তু পাখিগুলো যেন অকারণে বেশি কিচির মিচির করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। দূরে কোথাও এক সঙ্গে শোনা যাচ্ছে অনেকগুলি কুকুরের ডাক। চায়ের সঙ্গে নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যও রাখা রয়েছে, কিন্তু কেউ সেসব বিশেষ মুখে তুলছেন না। আজ সন্ধের সময় দিঘাপাতিয়ার রাজপ্রাসাদে সমস্ত অতিথিদের সংবর্ধনা ও ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। ঠিক সাতটায় সেখানে উপস্থিত হবার কথা। সেই রাজকীয় ভোজের আগে এখন কে আর অন্য খাবার খেয়ে পেট ভরাতে চায়।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প চলছে ছোট ছোট বৃত্তে। বৈকুণ্ঠ নামে এক ভদ্রলোক বেশ জমিয়ে একটা রোমহর্ষক কাহিনী শুরু করেছে, মন দিয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ অবনের হাতের চায়ের কাপ চলকে উঠে পড়ে গেল খানিকটা চা। অবন ভাবল, এ কী তার হাত কাঁপল কেন? আরও কাঁপছে, কাপটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। তারপর দেখা গেল সবারই হাতের কাপে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে।

অবন দু’হাত দিয়ে কাপটা ধরে আবার চুমুক দিতে যেতেই বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত শুরু হল। চতুর্দিকে বোমা ফাটার মতন বিকট শব্দ। কেউ বাজি পোড়াচ্ছে না কামান দাগছে? হাতিশালের হাতি আর ঘোড়াশালের ঘোড়াগুলি আর্ত চিৎকার শুরু করেছে, মণ্ডপটা দুলছে, মাটি দুলছে, শত শত শাঁখ বেজে উঠল।

এটা যে ভূমিকম্প তা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। তারপরেই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়। কে কার নাম ধরে ডাকছে বোঝা যাচ্ছে না, ধুলো বালিতে চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে রবি এক সময় এসে অবনের হাত ধরে ফেললেন, সামনে একটা মস্ত ফাটল, অবন আর একটু হলে পড়ে যাচ্ছিল, সেই ফাটলের মধ্য থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। লাফিয়েও সেই ফাটল পেরুনো যাবে না। ঝাপসা অন্ধকারের মধ্য থেকে এসে আশু চৌধুরী বলেন, ডান দিকে কেউ যেয়ো না, নদী উপছে এগিয়ে আসছে।

এই বুঝি মহাপ্রলয়। কারা যেন চিৎকার করছে, পালাও পালাও! কিন্তু কে কোন দিকে পালাবে? দ্রুম-দ্রাম করে এক একটা বাড়ি ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রেল লাইনের দিকটা উঁচু। সেখানে উঠে দাঁড়ালে কি রক্ষা পাওয়া যাবে?

যেমন হঠাৎই শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎই থেমে গেল। কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

অনেকেই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে লাগল, বেঁচে আছি? সত্যি বেঁচে আছি।

দূরে শোনা যাচ্ছে কান্নার কলরোল। হতাহতের সংখ্যা এখনি জানা যাচ্ছে না, তবে ধ্বংসের চিহ্ন বিপুল। এবই মধ্যে কিছু রাজকর্মচারী এসে প্রতিনিধিদের আশ্বাস দিয়ে বলতে লাগলেন, আপনাদের সকলেই ঠিকঠাক আছেন। রাজপ্রাসাদের একটি অংশের কোনও ক্ষতি হয়নি, আপনারা সেখানেই বসবেন চলুন, আর ভয় নেই।

ফেরার পথে অবন আর রবি দেখলেন, পুকুরের ধারে একটা ভারী সুন্দর মন্দির ছিল, সেটা একেবারে ধ্বংসস্তুপ। আরও কত বাড়ি অর্ধেক ভাঙা। উল্টে গেছে প্রচুর বড় বড় গাছপালা। নাটোরের রাজাদের বৈঠকখানা বাড়িটি ছিল দেখবার মতন, বহু সুদৃশ্য ঝাড়লণ্ঠনে সাজানো, কত রকম ফুলদানি আর ঘড়ি ছিল, আগাগোড়া লাল কার্পেট পাতা, সে বাড়ি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। রবির মুখ থমথম করছে। নিজেরা তো এখানে বেঁচে গেলেন, কিন্তু কলকাতার কী অবস্থা? সেখানকাব প্রিয়জনেরা কেমন আছে?

এক জায়গায় আবার সবাই মিলে বসার পর নানান ধ্বংসের বিবরণ আসতে লাগল। রেল লাইন উপড়ে গেছে, টেলিগ্রাফের লাইন ছিন্ন ভিন্ন, অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে ব্রিজ। এক্ষুনি এখান থেকে কলকাতায় ফেরারও উপায় নেই।

একটি সংবাদ শুনে সকলে দ্বিতীয়বার শিহরিত হল। দিঘাপাতিয়ার যে রাজবাড়িতে সকলের আজ সাতটার সময় যাবার কথা ছিল, সেই প্রাসাদটি একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে, চাপা পড়েছে বেশ কয়েকজন। অর্থাৎ, ভূমিকম্প যদি পাঁচটার বদলে সাতটায় শুরু হত, তা হলে বাংলা মায়ের বহু কৃতী সন্তান, প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ, কত কবি-শিল্পী-গায়ক সব একসঙ্গে শেষ হয়ে যেত।

2 Comments
Collapse Comments
Jiban Kumar Ghosh July 22, 2022 at 6:44 pm

Thought provoking indeed.excellent in creative work.

Jiban Kumar Ghosh July 22, 2022 at 6:46 pm

Thought provoking indeed.excellent in creative work. Not commented earlier .
.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *