পঁয়ত্রিশ
রায়বাবুর শ্রাদ্ধের দিন ভিতরের উঠোনে কীর্তন দিল অবনীশ। নিমন্ত্রণ পেয়েই রমেন লাফিয়ে উঠে বলল, আমি যাব।
সন্ধেবেলা ললিতকেও জোর করে নিয়ে গেল রমেন।
কয়েকজন রোগা চেহারার কালো লোক খোলে চাঁটি দিয়ে মিনমিন করে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ করছিল। ভিতরের বারান্দায় ভিড় করে বসেছে পাড়ার বুড়ো-বুড়ি আর কচিকাচারা। শম্ভুদের দলটা ঘোরাফেরা করছে। তারা শ্মশানবন্ধু।
রমেন হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, একে কি ছাই কীর্তন বলে!
তারপর একসময়ে নিঃশব্দে নেমে গেল রমেন। দেখা গেল সে কীর্তনীয়াদের মাঝখানে। তার শরীর দুলছে। কেঁপে উঠছে। তারপরই হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল সে, ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ..কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে’…
পলকেই পালটে যায় আসরের চেহারা। বিদ্যুতের মতো কী যেন একটা সবাইকে স্পর্শ করে। কেঁপে ওঠে ললিত। দূরাগত বজ্রের মতো গুরুগুরু করে ওঠে খোল।
এমনিতেই চমৎকার গলা রমেনের। সুন্দর গান গায়। তার সঙ্গে এখন এক দুরন্ত ঝড় এসে যোগ দেয়। মানুষজন দুলে ওঠে। থির থির করে কাঁপে পায়ের তলার মাটি। রোগা কালো কীর্তনীয়ারা লাফিয়ে ওঠে রমেনের চারধারে। এ-রকম একজনের অভাবেই যেন এতক্ষণ বৃথা হচ্ছিল তাদের গান। শম্ভু-সুবলেরা এতক্ষণ কোথায় ডুব দিচ্ছিল মাঝে মাঝে, এখন তারা আসর ঘিরে দাঁড়ায়। চিত্রার্পিত হয়ে থাকে।
শূন্যে লাফিয়ে ওঠে রমেন। হুংকার দিয়ে মুহুর্মুহু বলে, হরে কৃষ্ণ হরে রাম… কীর্তনীয়াদের পা হরিণের পায়ের মতো দ্রুত বৃষ্টিপাতের মতো মাটি ছুঁয়ে যায়।
কী করে কী করে এত লোকের সামনে নাচছে রমেন, গান গাইছে? ওর লজ্জা করছে না? ললিতের শরীর কেমন ঝিম মেরে আসে।
কখন যেন শম্ভুর পেশিবহুল চেহারাটা কীর্তনীয়াদের দলে ভিড়ে যায়। সে গায়ের জামা খুলে ফেলেছে। পরনে প্যান্ট, গলায় খোল।
মানুষ বাস্তবতা ভুলে যেতে থাকে। কীর্তনের উদ্দণ্ড ঢেউ আঙুলের মতো তাদের ভিতরে স্নায়ুগুলোকে যন্ত্রের তারের মতো বাজাতে থাকে।
দেখা যায় রমেন কাঁদছে।
বুড়িরা ফুঁপিয়ে উঠে চোখে আঁচল চাপে
হঠাৎ ললিত দেখে তার সামনে রমেন। চোখ জ্বলছে। দু’হাত বাড়িয়ে হঠাৎ তাকে টেনে নেয় রমেন।
ললিত চেঁচিয়ে ওঠে, কী করছিস?
পরমুহুর্তেই সে দেখতে পায় যে, সে আসরের মাঝখানে। তার চারদিকে পাগল লোকগুলো চোখ বুজে নাচছে, গায়ে ঢলে পড়ছে। বিনি মদের মাতাল।
ললিত স্থিরভাবে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। পারে না। রমেন তাকে এক পাক ঘুরিয়ে ছেড়ে দেয়। ললিত টলে পড়ে যেতে যেতে সামলায়। সুবল তাকে টেনে নিয়ে কী যেন বলে। দু হাত তুলে নাচে আর হাসে।
কীর্তনীয়ালের গানের বোল এখন আর স্পষ্ট বোঝা যায় না। কেবল ‘জয়… জয়’ ধ্বনি শোনা যায়। কার জয়? কীসের জয়? বুঝবার চেষ্টা করে ললিত। এর ওর ধাক্কা খায়। টলে পড়ে যেতে গেলে কেউ একজন ধরে আবার দাঁড় করিয়ে নেয়। তুলসীতলায় বাবা একা কীর্তন করত। কাঁদত। বাবার হাতে থাকত ছোট করতাল। বিষয়বুদ্ধিহীন বাবা কীর্তনের মধ্যে ভুলে থাকত তার বাস্তব জীবনের ব্যর্থতা। সেই দৃশ্য মনে পড়ে ললিতের। মনে পড়ে ছেলেবেলার হরির লুট। মনে পড়ে কীর্তন তার রক্তে রয়েছে। অথচ সে কখনও কীর্তন করেনি।
জয়-জয়-জয় গর্জন করে তার চারদিকের পাগল লোকেরা। মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি হয়, উলুর শব্দ বন্যার মতো ভেসে আসে। আকুল কান্নার শব্দ শোনা যায়। হৃৎপিণ্ড ঢিপঢিপ করে লাফিয়ে ওঠে।
‘জয় জয়’ ধ্বনিটা ধরে ললিত। তারপর ফিসফিস করে বলে, জয়-জয়। সংকোচ লজ্জা ভয় ক্রমে কেটে যায়। এত ভিড়ের মধ্যে কে আর তাকে আলাদা করে দেখবে?
তারপর ললিতের আর কিছু খেয়াল থাকে না। সে শুধু মাঝে মাঝে দেখে তার চারধারে অবাস্তব ছায়ার মতো লোক দুরে সরে যাচ্ছে, কাছে আসছে। মাঝে মাঝে কে যেন বুকে টেনে নিচ্ছে তাকে, ছেড়ে দিচ্ছে।
‘জয়-জয়’ বলে দু’হাত তুলে নাচতে থাকে ললিত।
কে জানে কখন শেষ হয়েছিল কীর্তন। ললিত শুধু শেষে টের পায় তার গায় এক অদ্ভুত উত্তেজনায় কদমফুলি কাঁটা দিয়েছে। কার জয়ধ্বনি সে এতক্ষণ দিয়েছে কে জানে। তবু, জয় হোক—তার জয় হোক।
রমেনকে ঘিরে ভিড়। সবাই জানতে চাইছে রমেন আসলে কে।
প্রায় দিনই সকাল বিকেলে দু’-চারজন করে রমেনের প্রজারা আসে। হাতে করে নিয়ে আসে লাউ, শাকপাতা, ফল, কিবা নগদ টাকা।
ললিত মাঝে মাঝে ধমক দেয়, এ-সব তুই নিস কেন?
রমেন হাসে। নিতে হয়। মানুষে ভালবেসে দিলে নিতে দোষ নেই। মানুষের দান গ্রহণ করা এককালে ব্রাহ্মণের প্রাফেশন ছিল।
কেন সেরকম প্রফেশন থাকবে?
রমেন একটু ভাবে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ললিত, আমার পূর্বপুরুষেরা মানুষের অনেক উপকার করেছিল। মানুষ কৃতজ্ঞ হয়ে সেই ঋণ শোধ করত। ক্রমে ক্রমে ওইভাবেই আমাদের জমিদারি তৈরি হয়েছিল। আবার আমার আমলে চলে গেল জমিদারি। আমি আবার ব্রাহ্মণের পুরনো প্রফেশনে ফিরে এসেছি। ওরা আমাকে ভালবেসে দেয়, আমি নিই।
কেন দেয়? তুই ওদের জন্য কী করিস!
রমেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বলে, কী দিই তা ওরা জানে। আমার তো টাকা পয়সা নেই। তাই আমি গিয়ে কেবল ওদের পাশে পাঁড়াই। দেশ ছাড়ার পর ওদের আর কোনও মানসিক আশ্রয় নেই। এককালে শোকে-দুঃখে ওরা আমাদের বাড়িতে ছুটে যেত। এখন তাই ওরা আমাকে দেখলে খুশি হয়। ছুটে আসে। দুঃখের কথা বলে আমাকে। আমি ওদের দাওয়ায় বসি, ছেলেপুলেদের সঙ্গে কথা বলি, কারও বাসায় গিয়ে কীর্তন গাই, লোকগুলো আবার ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ এখন পয়সা করেছে। কেউ বা ডুবে গেছে। ওদের মধ্যে একটা সমতা আনার চেষ্টা করি। এর ওর কাছ থেকে চেয়ে এনে দিই। একে অন্যকে দেখার কথা বলি। কিন্তু এইটুকু তো মাত্র নয়। ওরা আমার কাছ থেকে টাকা পয়সার সাহায্য তেমন চায় না। ওরা এটুকু ভেবেই খুশি যে, আমি ওদের পাশে আছি। ছোটকর্তাকে ওদের দরকার একটা প্রতিমার মতো, যার মধ্যে বুড়োকর্তার ছাপ আছে। কাজেই আমি ওদের স্বার্থ, আমাকে বাঁচিয়ে রাখা ওদের দায়িত্ব।
ললিত তবু গুনগুন করে আপত্তি করে। রমেনের কথাগুলো সাম্যের বিরোধী। কেন একজন দেবতার মতো হয়ে উঠবে?
রমেন মৃদু হেসে বলে, এককালে তোকে দেখতাম রাত জেগে পোস্টার লিখছিস. ঘুরে ঘুরে পার্টির চাঁদা তুলছিস, মিটিং করছিস, মিছিল সামলাচ্ছিস। নিজের দিকে তোর খেয়ালই থাকত না। তখন তোর মনে একটা প্রকাণ্ড আদর্শ কাজ করছে, সকলের ভাল করার আদর্শ। তুই হয়তো টেরও পোতস না যে, সকলের ভাল করার চেষ্টা করছিস বলে তোকে বাঁচিয়ে রাখা সকলের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি দেখতাম কেউ নিজে থেকেই তোর ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে ধরিয়ে দিচ্ছে, তে এনে দিচ্ছে চা, রাত বারোটা তোর জন্য দোকান খুলিয়ে নিয়ে আসছে ‘পাউরুটি। তুই সে-সব টেরও পাচ্ছিস না। এক মনে কাজ করে যাচ্ছিস। আমার ব্যাপারটাও অনেকটা তেমনি। লোকের স্বার্থ হয়ে ওঠা। আমি কেন নিজের পেটের ধান্দায় ঘুরব, আমার পেটের ধান্দায় ঘুরবে অন্যেরা। কারণ, আমি তো তাদের ধান্দাতেই ঘুরছি।
কিন্তু এই প্রফেশন মহৎ নয়। এর মধ্যে ভিখিরিপনা আছে।
তবে কী করল। চাকরি? সে তো বাঁধা মাইনের ব্যাপার। মাইনের টাকা হাতে পেয়ে তার মাপে মাপে নিজেকে ছোট করে ফেলব, খরচ কমাব, জমাতে শিখব।…দ্যাখ না, সেদিন সঞ্জয়ের কাছে গেলাম, পুরনো দিনের কথা হচ্ছে, তার মাঝখানে হঠাৎ ও খুব অসহায় ভাবে লাজুক মুখে বলল, তুই আমার কাছে দু’-তিন হাজার টাকা পাস, কিন্তু সেটা এক্ষুনি দিতে পারছি না রে। সদ্য গাড়িটা কিনেছি, ওভারহল করতে অনেক খরচ গেছে। বিজনেসেও লস দিলাম অনেক… এইসব কথা। ওর এয়ারকন্ডিশনড় করা অফিসঘরে বসে আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল, সত্যিই সঞ্জয়টা গরিব, ঠিক আগে যেমন গরিব ছিল। কী করে টাকা দেবে ও? ওর যে টাকার বড় দরকার। অথচ ও আমাকে বারবার বলছিল যে ও সন্ন্যাসী হতে চায়, আর কয়েক বছর পরেই ও সন্ন্যাসী হয়ে যাবে।
বলে রমেন হাসে। ললিত চুপ করে থাকে।
কোনও দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ললিত দেখে, রমেন বসে আছে। জানালার দিকে মুখ। কোলের ওপর জড়ো করা দুটি হাত। নিস্তব্ধ। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের একটা ফিকে আলো আসছে, সেই আলোতে ললিত দেখে রমেনের দু’ চোখ দিয়ে জলের দুটি ধারা নেমে এসেছে।
দূরে কোথাও একটা কুকুর কাঁদছে। মশারির ও-পাশে জানালা। তার ও-পাশে ধূলিকণার ঝড়ের মতো নক্ষত্রে আকীর্ণ আকাশ। ধোঁয়াটে চাঁদ আকাশে। অপার্থিব মূর্তির মতো রমেন বসে আছে। ললিত বুঝতে পারে, রমেনের চেতনা নেই। সে ধ্যান করছে।
নিশুত রাতে কুকুরের কান্না, অস্পষ্ট আকাশ, ধ্যানস্থ রমেন—সব মিলেমিশে এমন এক স্বপ্নের মতো দেখে ললিত—যেন তা সত্য নয়, অথচ হঠাৎ বুকের ভিতর হু হু বাতাস বয়। কেন যে, ললিত জানে না। জানালা দিয়ে ঝরে পড়ছে তারার গুঁড়ো, জ্যোৎস্নার মোম। কুকুর কাঁদছে শূন্যতার দিকে চেয়ে। আদিগন্ত ছায়াপথ পড়ে আছে হিম আকাশে। মানুষ হঠাৎ ঘুম ভেঙে চোখ চেয়ে দেখে। মূক হয়ে যায়। বিশ্বজগতের কোন রহস্যের সঙ্গে নিবিড় হয়ে আছে মগ্ন রমেন! ললিত তা কোনও দিনই জানবে না।
ছত্রিশ
অনিমা দাশগুপ্ত নামে সেই মেয়েটি খুব আশ্চর্য হল যেদিন সঞ্জয় ওকে নাম ধরে ডাকল।
কী করে জানলেন?
সঞ্জয় গম্ভীরভাবে বলল, শুধু নাম! আমি আপনার ভক্তদের সংখ্যা পর্যন্ত জানি।
মেয়েটা একটু হাসে, তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সঞ্জয়ের কামানো মাথার দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে, আপনার মায়ের কী হয়েছিল?
বয়েস। একটু বিষণ্ণভাবে নিজের কথা চিন্তা করে সঞ্জয়। বলে, আমাদেরও হচ্ছে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কেটে যাচ্ছে।
অনিমা এখনও রিনি আর পিকলুর কথা জানে না। আরও সময় দরকার। এখনই বলা যায় না। অনিমা কিন্তু ঘুরেফিরেই জিজ্ঞেস করে তার বাড়িতে কে আছে। সঞ্জয় এড়িয়ে যায়।
সঞ্জয় জানে অনিমার যারা ভক্ত তাদের কারও গাড়ি নেই। একটা গাড়ির যে কত উপযোগ! এই গরিব ভিখিরির দেশে একটা গাড়ি দেখিয়ে কত কিছু করা যায়!
আজ আর সোজা বাড়ি ফেরা হয় না। অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় ডালহৌসিতে। ম্যককারিয়নের অদূরে গলির মধ্যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সিগারেট খায়। একটুক্ষণের মধ্যেই অনিমা চলে আসে। তরপর অনেকক্ষণ নানা রাস্তায় তাদের গাড়ি ঘুরে বেড়ায়।
বাসায় নতুন ফোন ফিট করে দিয়ে গেছে মিস্তিরিরা। ফোন আসার কয়েক দিন পরেই এক রাত্রে বাসায় ফিরে দেখল রিনি খুব অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছে সুন্দর মুখখানা শুকনো। কী হয়েছে তা প্রথমে বলল না।
যখন রাতে বাইরের গ্রিল দেওয়া বারান্দায় হুইস্কি নিয়ে রোজকার মতো বসেছে সঞ্জয়, তখন নিঃশব্দে ছায়ার মতো সামনে এসে দাড়াল রিনি।
আজকে একটা অদ্ভুত ফোন এসেছিল।
কে করেছিল?
চিনি না। মোটা গলার একজন পুরুষমানুষ। বলল, আপনাকে একটা খবর জানানো দরকার। আপনার স্বামীর একটু খোজখবর নেবেন। সম্প্রতি উনি—
রিনি থেমে গেল। সঞ্জয় চেয়ে ছিল রিনির দিকে। মেয়েটা বড় নরম। সারা দিন কেঁদেছে হয়তো, এখনও কথা বলার সময়ে ঠোঁট কাঁপছে একটু একটু। রিনির তেজ বলে কিছু নেই। মুশকিলে পড়লেই কেমন অসহায় হয়ে পড়ে। সঞ্জয় ধমক-টমক দিলে উলটে ঝগড়া করতে পারে না, কেঁদে ভাসায়। দুর্বল মেয়ে। কথাটা ঠিক মতো স্পষ্টভাবে বলতে পারছে না। ভয় পাচ্ছে। বললেই দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
সঞ্জয় চুপ করে থাকে। ফোনটা কে করেছে তা খানিকটা আন্দাজ করে নেয়। শুভময় ঘোষাল নামে ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার। অনিমার ভক্তদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উজ্জ্বল। ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে। তার প্রতি একটু দুর্বলতা আছে অনিমার।
প্যান্টের হিপ পকেট সাতশোর মতো টাকা ছিল। এটা এক দিনের রোজগার। সঞ্জয় হঠাৎ উঠে গিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে পকেট থেকে টাকার থোকাটা বের করল। রিনির হাতে দিয়ে বলল, এটা রেখে দাও।
রিনি আড়ষ্টভাবে টাকাটা হাতে নিয়ে সঞ্জয়ের দিকে চেয়ে থাকে। বুঝতে পারে না হঠাৎ এ সময়ে, জরুরি কথার মাঝখানে, সঞ্জয়ের হঠাৎ টাকাটার কথা মনে পড়ল কেন!
রিনির সাদা মুখখানার দিকে চেয়ে হঠাৎ বড় লজ্জা পায় সঞ্জয়।
রিনি বলল, লোকটা বলছিল তুমি নাকি অনিমা নামে একজন মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও!
রাস্তায় রাস্তায় এখন খুব ভিড়। পুজোর বাজার। দোকানের শো-কেসে সাজানো পুতুল-মেয়ের মুখ চোখে চোখ রেখে হাসে। সুন্দর সব শাড়ির রং রাস্তা আলো করে দেয়। তাদের গায়ে লটকানো ভয়ংকর দাম লেখা টিকিট। স্কুলের পর দোকান দেখতে দেখতে ললিত অনেক দূর হাঁটে। ইচ্ছে করে দোকানে ঢুকে অনেক কিছু সওদা করে নিয়ে যায়। অনেক দিন পর এবার মায়ের জন্য একটা সাদা থান কাপড় কিনেছে সে, তারপর আর কারও জন্যই কিছুই কেনার নেই। তবু দোকানের দিকে চেয়ে পথ হাঁটে ললিত, মানুষের কেনাকাটা দেখে। কখনও ফুটপাথের দোকানে চওড়া পাড় আর সুন্দর নকশার শাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে যায়। দাম জিজ্ঞেস করে, শাড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, কত?
দোকানদার সাগ্রহে বলে, পঁয়ত্রিশ। নিন, কিছু কমে দেব।
ললিত মাথা নেড়ে বলে, থাক।
আশ্চর্যের বিষয় আজকাল রাস্তায় মেয়েরা তার দিকে তাকায়। আগে প্রায়ই মেয়েরা তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু এখন ললিতের চোখ মাঝে-মধ্যে অচেনা পথ-চলতি মেয়ের চোখে আটকে যায়। মেয়েটা চোখ সরায় না, তাকে দেখে, পেরিয়ে গিয়েও এক-আধবার ঘাড় ফেরায়।
দোকানের আয়নায় নিজের মুখখানা মাঝে মাঝে দেখে ললিত। সুন্দর মুখ। অসুস্থতার কোনও ছাপ নেই। মা বলে ছেলেবেলায় তার রং ছিল দেখবার মতো, রোদে পুড়ে আর ঘুরে ঘুরে সে-রং নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ললিত এখন ভাবে, বোধ হয় সেই শিশু বয়সের গায়ের রং আবার ফিরে এসেছে তার।
বোধ হয় মৃত্যুর আগে মানুষের কয়েকটা সুদিন আসে। সে ক’দিনে তাকে ভোগ করে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। একদিন স্কুল থেকে ফিরে সে ঘরে শুয়ে আছে বিছানায়, এমন সময়ে ‘মাসিমা, ও মাসিমা’ বলে ডেকে খোলা দরজা দিয়ে পালের নৌকোর মতো ভেসে ঘরে এল একটি মেয়ে। সাবলীল লম্বা মেয়েটি, পরনে তাঁতের রঙিন শাড়ি। বাঁ কোলে একটি বাচ্চা। প্রথমে ললিত চেনেনি, মা’ও না। দু’জনেই একটু অবাক হয়ে চেয়ে ছিল। মেয়েটি কোলের বাচ্চাটিকে মেঝেয় দাঁড় করিয়ে মাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই অহংকারের সেই পুরনো ভঙ্গিটি, ঘাড় পিছনে হেলানোর মিষ্টি মুদ্রাদোষটি দেখে চিনতে পারল ললিত। মিতু। স্বেচ্ছায় মিতু কখনও এ-বাসায় আসেনি। এই প্রথম তার স্বেচ্ছায় আসা। এখন তার সিঁথিতে সিঁদুর, কোলে বোধ হয় দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সন্তান।
হাসিমুখে বলল, আমি মিতু।
মা গলায় ঘরঘর শব্দ করে বলল, অ। বোসো। কবে এলে?
কাল এসেছি। বম্বে তো অনেক দূর। আসাই হয় না। চার বছর পর এলাম। পুজোর পরই শ্বশুরবাড়ি যাব ব্যারাকপুরে।
শোয়া থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসল ললিত। এখন আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে মিতু। মসৃণ গা, সতেজ শরীর। দেখলেই বোঝা যায় বড়লোকের ঘর করে। ললিত একবার-দু’বারের বেশি তাকাতেই পারল না। ভীষণ লজ্জা করছিল। কেন এসেছে মিতু!
মা রান্নাঘরে গেল, মিতু গেল পিছু পিছু। ললিত একবার ভাবল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, যাতে মিতুর সঙ্গে দেখা না হয় আর। উঠে সে জামা গায়ে দিল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল। হঠাৎ মনটা বড় ভাল লাগছিল তার। মিতু আসাতে বহুদিনের পুরনো একখানা কাঁটা সরে গেছে। শেষবার এ-বাড়িতে যখন এসেছিল মিতু তখন মায়ের ওপর রাগ করে কেঁদেকেটে মাকে অপমান করে চলে গিয়েছিল। ভেবেছিল মা তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ললিতের সঙ্গে বিয়ে করাতে চায়। সেই লজ্জায় এত দিন কাঁটা হয়ে ছিল ললিত। মিতু নিজে থেকেই এসেছে বলে বড় ভাল লাগছিল ললিতের। জীবনের শেষ কয়েকটি দিন ভরে যাচ্ছে কানায় কানায়। হয়তো মরার সময়ে সে ভরা মন নিয়ে যাবে। কোনও দুঃখ থাকবে না। পৃথিবীর কাছে সব দাবিদাওয়া শেষ হয়ে গেলে মরা কত সহজ হয়ে যায়!
দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে এসে চৌকিতে বসল ললিত। সিগারেট ধরাল। শুনতে পেল উঠোনের ও-পাশের রান্নাঘরে মা আর মিতুর গলা, পরস্পর কথা বলছে। ললিত কান পেতে শোনবার চেষ্টা করছিল।
তখন ঘরটা অন্ধকার হয়ে এসেছে। সন্ধের সামান্য একটু মরা আলোয় ছায়ার মতো একা, একটু কুঁজো হয়ে বসে আছে ললিত। এ সময়ে উঠোন পার হয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘরের মধ্যে এল মিতু। ললিত মুখ না তুলেও বুঝতে পারছিল মিতু চলে যাচ্ছে। জীবনে কোনও দিন মিতুর সঙ্গে তার কোনও কথা হয়নি। আজও হবে না কি? হে ভগবান…
মিতু দরজার মুখ থেকে আস্তে ঘুরে দাড়াল। কোলের বাচ্চাটা কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। আবছা অন্ধকারে মিতুর সুন্দর, অহংকারী মুখখানা বিষণ্ণ দেখল আজ। মৃদু গলায় হঠাৎ মিতু সোজা তার সঙ্গে কথা বলল, এখন কেমন আছেন?
কেমন হঠাৎ কাঠ-আড়ষ্ট হয়ে গেল হাত-পা, গলা বুজে আসছিল। ললিত আস্তে বলল, ভালই।
মিতু এক পাও কাছে এল না, কিন্তু গলার স্বর অনেকটা নিকটজনের মতো শোনাল। বলল, কী হয়েছে!
ললিতের ইচ্ছে ছিল না রোগের নামটা বলে। কী হবে মেয়েটার মন খারাপ করে দিয়ে। পরমুহূর্তেই ইচ্ছেটা পালটে গেল আবার। কেন মিতু চিরকাল সুখী থাকবে? দেখি না ক্যান্সার শুনে ওর মুখটা কেমন পালটে যায়!
ললিত মৃদু গলায় বলে, ক্যান্সার।
প্রথমটায় বুঝতেই পারল না মিতু। বলল, কী!
ললিত আবার বলল!
মিতুর চুড়ি-পরা হাত হঠাৎ ঝনাৎ করে পড়ে যায়। নিশ্বাসের সঙ্গে মিতু বলে, যাঃ! মিথ্যে কথা।
এত আপনজনের মতো শোনায় মিতুর গলা যে, ফের কথাটা শুনতে ইচ্ছে করে।
সত্যিই। ললিত বলে।
কিন্তু আমি যে শুনলাম আপনি শিগগিরই বিয়ে করছেন।
ললিত অবাক হয়, কে বলল?
পাড়ায় সবাই বলছে। শাশ্বতী না কী যেন নাম মেয়েটির!
ললিত অন্ধকারেই মাথা নেড়ে বলে, না।
না?
মিতু একটু চুপ করে থাকে। তারপর আপনমনে বলে, আমি তো জানতাম মাসিমা বলছিলেন কলিক পেন।
মা জানে না।
মিতুর কোলের বাচ্চাটা নড়ে উঠে ‘অঃ’ শব্দ করল। মিতু চঞ্চল হয়ে বলে, ওকে মশা কামড়াচ্ছে, এবার যাই।
আচ্ছা।
মিতু একটু দ্বিধা করে বলে, অনেক দিন আছি। মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাব।
ললিত বলে, আচ্ছা।
চলেই যাচ্ছিল মিতু। যখন ঘরের দরজার বাইরে তার এক পা তখনই হঠাৎ ললিত জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছিলেন?
মিতু থেমে যায়। তারপর মাথা নিচু করে প্রায় ফিসফিস করে বলে, জানি না।
গলিটাকে খুব নির্জন করে দিয়ে মিতু চলে গেল।
ললিত জানে যে তাকে সুখী করা ছাড়া মিতুর এই আসার কোনও দরকারই ছিল না। এইভাবেই শেষ কয়েকটা দিন সে সুখেই কাটাবে।
রাতে এক ডাকেই রমেন সাড়া দেয়। কেন এতক্ষণ না ঘুমিয়ে ললিতের ডাকটারই অপেক্ষায় ছিল। জেগে উঠে বসে রমেন। তার গায়ে হাত রেখে গভীর গলায় বলে, কী রে!
ললিত কী বলবে ভেবে পায় না। ভিতরটা অস্থির লাগে। সারা দিন সে জীবন্ত মানুষজনের ভিতরে ঘুরে বেড়িয়েছে, দেখেছে দোকান, মেয়েদের চোখ, দোকানে সাজানো ফল, বইয়ের মলাট, অচেনা মানুষের মুখ, রাস্তার মোড়ে বকুল গাছ— এইরকমই সব তুচ্ছ বিষয়গুলির জন্য হঠাৎ ব্যথিয়ে ওঠে বুক, দম বন্ধ হয়ে আসে। সামনের পুজোয় শরৎকালে সে এসব দৃশ্য হয়তো আর দেখবে না। এই ব্যক্ত জগৎ ছেড়ে সে কি কোনও অব্যক্ত জগতে চলে যাবে! না কি কোনও অস্তিত্বই আর থাকবে না তার? সে কি আবার জন্ম নেবে? না কি একবারই ললিত এসেছিল, আর আসবে না?
ললিত শ্বাস ফেলে বলে, রমেন, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না রে, তুই দেখিস।
রমেন সান্ত্বনা দেয় না, উত্তরও দেয় না। কেবল চুপ করে জেগে বসে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে ললিতের স্বাস কাঁপতে থাকে। তারপর কখন আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সাঁইত্রিশ
লক্ষ্মীপুজোর পরদিন তুলসী আর মৃদুলা চলে যাচ্ছে। সকাল থেকেই গোছগাছ করছিল মৃদুলা। মাঝে মাঝে গোছানো থামিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছিল। বাইরে বহু দূর পর্যন্ত কলকাতার হিজিবিজি দেখা যায়, একটা স্বচ্ছ ধোঁয়ায় আবৃত। কলকাতার বেশির ভাগই মৃদুলার অচেনা। সে কেবল এতকাল ধরে চিনেছে তাদের বেহালা, তার স্কুল কলেজ, কয়েকজন আত্মীয়ের বাড়ি, বড় জোর কয়েক বার গেছে বোটানিকসে কি চিড়িয়াখানায়—বাদবাকি কলকাতা তার কাছে অচেনা, রহস্যময় এবং ভয়াবহ। ঢাকুরিয়ার বাসার জানালা দিয়ে কলকাতার কিছুই দেখা যায় না। তবু মৃদুলা নির্নিমেষ চেয়ে ছিল। কোথায় যেন নাড়ির যোগ ছিঁড়ে সে চলে যাচ্ছে। মৃদুলার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। বিয়ের পর একবারও বাপের বাড়ি যাওয়া হয়নি। কবে যে যাওয়া হবে আর! কয়েক দিন আগে তার চিঠি পেয়ে বাবা এসেছিল টুপুকে নিয়ে। বাবার শরীর ভেঙে গেছে অনেক, শরীরের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেছে। মুখে কেমন খড়ি-ওঠা শুকনো ভাব, মুখচোখের অবস্থা খুব ব্যথাতুর। টুপু তেমনি লাজুক, তবে আরও একটু রোগা হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে ছাদে চলে গিয়েছিল মৃদুলা। কত কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কয়েক দিনের অদেখাতেই দিদিকে লজ্জা পাচ্ছিল টুপু, মাথা নিচু করে, চোখে চোখ না রেখে মিহি গলায় কথা বলছিল। কিছু দিন আগেই যে জলখাবার কম হয়েছে বলে দিদিকে পাখার ডাঁট দিয়ে মেরেছিল তা এখন তাকে দেখলে বিশ্বাসই হয় না। টুপুর কাছেই মৃদুলা শুনেছে বিভু এখন নামকরা গুন্ডা। তার দাপটে পাড়া অস্থির থাকে। কোমরে ছোরা আর পকেটে পাঞ্চ, ব্লেডের টুকরো, কখনও বা হাতে সাইকেলের চেন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাত্রিবেলা মদ খেয়ে ট্যাক্সিতে ফিরে ট্যাক্সিওয়ালার ওপর হামলা করে। কখনও তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে পা ফাঁক করে সিগারেট ফোঁকে। সপ্তমী পুজোর দিন গলির মধ্যে সে টুপুকে মুখোমুখি পেয়ে রাস্তা আটকায়। জিজ্ঞেস করে, এই শালা, তোর দিদির ঠিকানা কী রে? টুপু ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে সত্যি কথা বলেছে যে, সে জানে না। বিভু হেসে বলেছে, ভাবিস না, তোর দিদির ঠিকানা ঠিক খুঁজে বের করব। ঢাকুরিয়ার দিকে থাকে আমি জানি। বিশে একদিন দেখেছে কালোমতো শুটকো একটা লোকের সঙ্গে যাচ্ছে। আমি ঠিক খুঁজে বের করব। তারপর দেখিস কী হয়। শুনে মৃদুলা ঠিক আগের মতোই ভয় পেয়েছিল, তবে কেন যেন বিভুর জন্যও এই প্রথম একটু কষ্ট হচ্ছিল তার। টুপুর কাছেই আরও শুনেছে, মা’র বুকে এখন কেমন একটা ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তার দেখে বলে যায় অসুখটা আসলে মনের। মৃদুলা সেকথা বিশ্বাস করে। প্রত্যেকটা পরিবারেরই একটা করে আলাদা ধাঁচ আছে। কোনও পরিবারে রাগ বেশি, যেমন তাদের রাঙা পিসিমার বাড়ির প্রায় সবাই রাগী। সে-রকম, কোনও পরিবারে বেশি লোভ, কিংবা কম। ঠিক তেমনই তাদের পরিবারে সকলেরই একটু ভয়ের ধাঁচ আছে। অল্পেই ভয় পায় তারা। আত্মসমর্পণ করে দেয়। তাই ওইটুকুন ছেলেটা, ওই বিভুর ভয়ে তাদের পরিবারটা তছনছ হয়ে গেল। নইলে তারা গুটিকয় নিরীহ মানুষ, মা বাবা টুপু আর সে মিলে কত শান্তিতে ছিল! রাতে তারা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিত, তারপর মা বাবা আর দুই ভাইবোনের একটা ছোট্ট আসর বসত। কী যে সুন্দর ছিল সেই আসর! বাবা বলত কোর্টকাছারির অদ্ভুত সব গল্প, কত বার বাবার মক্কেল হরিদাসের অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে তারা পরস্পরের গা ঘেঁষে বসেছে। হরিদাস ছিল গুরুতর লোক, গুরুর কথায় ওঠেবসে, সারা দিন দয়াল গুরুর মহিমার কথা লোককে বলে বেড়ায়। বর্ধমানের এক গাঁয়ে একটা লোক অল্পবয়সে সান্নিপাতিকে মারা যাচ্ছিল। তার কচি বউ আর মায়ের কান্না শুনে থাকতে না পেরে হরিদাস গিয়ে বসল তার বিছানায়। হেঁকে বলল, গুরুর নামে বসলাম, আমি বলছি এ রুগি মরবে না এখন। হরিদাস বসেই রইল, রুগিও রইল ঘোর জ্বরবিকারের মধ্যে বেঁচে। হরিদাস নড়ে না, রুগিও মরে না। গাঁয়ের কবিরাজ এসে দেখে বলে, রুগি শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে কী করে যেন বেঁচে আছে সে। সাত দিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে বসে রইল হরিদাস, রুগিও রইল। তখন খবর গেল হরিদাসের গুরুর কাছে যে, হরিদাস মুমূর্ষ রুগিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, ক্রমে রুগির চোখ গর্তে চলে যাচ্ছে, শরীর হয়ে যাচ্ছে কাঠের মতো শুকনো, তবু বেঁচে আছে। হরিদাস বিছানা ছাড়ছে না, পায়খানা পেচ্ছাবে যাওয়ার সময়ে গায়ের চাদরখানা খুলে রুগির বিছানায় রেখে যায়। শুনেটুনে হরিদাসের গুরুদেব তামাকের নল মুখ থেকে সরিয়ে বললেন, যখন চাদর রেখে যাবে তখন সেটা সরিয়ে নিন। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া ভাল না। তাই হয়েছিল। হরিদাসের চাদর সরিয়ে নিলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীর মৃত্যু ঘটেছিল। আর-একবার হরিদাস গুরুর নামে উৎসর্গ করা গাছ-পাকা একটা কাঁঠালকে একমাস ঘরে রেখে দিয়েছিল। সে কেবল গাছ থেকে পাড়ার সময়ে একবার বলেছিল, তোকে গুরুর নামে উৎসর্গ করছি, যখন সময় হবে তখন পাকিস। তারপর এক মাস নানা ধান্দায় ঘুরে বেরিয়েছে সে, এক মাস জগদ্দল কঁঠালটিও ছিল একই অবস্থায়। পাকেনি! এইরকম অবিচল ভক্তিও একদিন টলে গিয়েছিল হরিদাসের। তার ক্ষমতার কথা যখন চারধারে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন নিজেকে সে মহাশক্তিমান ভাবতে শুরু করে। বসে বসে সে ভাবত, আমি কম কী? তারপর থেকেই আস্তে আস্তে তার ক্ষমতা নিবে যেতে লাগল। এতটাই নিবে গেল যে, শেষজীবনে সে গুরুর সঙ্গে মামলায় নামে, তার গুরুর নামে উৎসর্গ করা সম্পত্তি ফেরত চায়। অল্পেই বুড়িয়ে যাওয়া হরিদাস নিজের এই পাপের গল্প বলত বাবাকে, চটি খুলে মারত নিজের গালে। গুরু তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন, আর ফিরিয়ে নিলেন তাকে দেওয়া সেই অপার্থিব শক্তি। হরিদাস বাবাকে দুঃখ করে বলত, সাধু মানে জাদুকর নয়, বরং ত্যাগী, প্রেমী। বড় দেরিতে সেটা বুঝলাম।
তাদের সেই পারিবারিক, ছোট্ট আসরটিতে আরও কত গল্প হত! তারা পরস্পরের গা ঘেঁষে, গা শুঁকে বসত। কলেজের বন্ধুদের গল্প করত মৃদুলা, কখনও বা গান শোনাত, কখনও কারও অদ্ভুত কথা বা আচরণ নকল করে দেখিয়ে হাসাত মা-বাবাকে। বেশ ছিল তারা—ভিতু, আমুদে, পরস্পরের মধ্যে গভীর সম্পর্ক। হঠাৎ বাজপাখির মতো ছোঁ মারল বিভু। নইলে আজও মৃদুলা বেহালার সেই বাসায় সকাল-বিকেল তানপুরা নিয়ে বসত, গ্রীষ্মের বিকেলে গা ধুয়ে চলে যেত ছাদে, বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তারা আর চাঁদ আর কলকাতার আকাশরেখায় রঙিন আলো দেখে কীরকম আনন্দ পেত!
বিভু জানেও না সে মানুষের কত ক্ষতি করেছে। সে চারজন ভিতু মানুষকে করে দিয়েছে দুর্বল, অসুস্থ, তাদের আয়ু যাচ্ছে কমে। তাদের সংসারে এখন লক্ষ্মী ছেড়ে যাওয়া ছন্নছাড়া ভাব। বাড়িতে কখন বোমা পড়ে সেই চিন্তায় বাবা কোর্টে ভাল সওয়াল-জবাব করতে পারছে না। অচিরে তার পসার কমে যাবে।
জানালা দিয়ে বাইরে কলকাতার সামান্য দৃশ্যটুকু দেখে মৃদুলা, আর ভাবে, এই শহর ছেড়ে সে যে চলে যাচ্ছে তার কারণও ওই বিভু। সেদিন সিনেমা হলে অনেকটা বিভুর মতো দেখতে সেই লোকটা তাকে চিমটি কেটে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তুলসী কলকাতার ওপর খেপে গেল। ভাগ্যক্রমে মৃদুলার বিয়েও হয়েছে এক ভিতু মানুষের সঙ্গে, যে কেবল পালিয়ে যেতে শিখেছে, রুখে দাঁড়াতে জানেই না। ফলে, এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পাড়ি দিচ্ছে তারা দু’জন। কেমন হবে পলাশপুর জায়গাটা? আগে খুব পলাশপুরের নিন্দে করত তুলসী। আজকাল বলে, কলকাতায় থাকা মানে পৃথিবী এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া। এখানে পচে গেলাম। মৃদুলা জানে এ-সব মন-ভোলানো কথা। পলাশপুরে নিশ্চয়ই ভরসন্ধেয় শেয়াল চলে আসে উঠোনে, রাতদুপুরে কাঁদে কুকুর, ঘাসে গা মিলিয়ে চলে বেড়ায় সাপ, আর জোঁক লাফায়। গ্রামীণ মানুষগুলোর সঙ্গেও মিলমিশ হতে সময় লাগবে অনেক। তারা কলকাতার লোক, তারা এখন কলকাতার প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কেমন লাগবে মৃদুলার?
দুপুরবেলা বাসনের বস্তার মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে তুলসী তার ঘেমো পরিশ্রান্ত মুখখানা মৃদুলার কানের কাছে এগিয়ে এনে বলল, মায়ের একটা সুন্দর সাঞ্চা-হাতা ছিল। পানের মতো দেখতে। কাঁসার, আর খুব ভারী। বউদি সেটা সরিয়ে রেখেছে কোথাও, খুঁজে বার করো দেখি।
উদাসীন গলায় মৃদুলা বলে, বাদ দাও। আমরা স্টেনলেস স্টিলের জিনিস কিনে নেব।
তুলসী মুখ বিস্বাদ করে বলে, ইঃ! সে-রকম জিনিস আর হয়! মা আমাকে একবার সেই হাতাটা দিয়ে পিটিয়েছিল। আমি ভীষণ কান্নাকাটি করায় মা বলেছিল, এটা তোর বউকে দেব, কাদিস না। হাতাটার একটা সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু আছে।
ভাগ-বাঁটোয়ারা অনেক কিছুই সরিয়ে রেখেছিল তুলসীর বউদি। কিন্তু মৃদুলা তেমন গা করল না। যেমন মৃত্যুর আগে মানুষের মায়া কমে যায় তেমনি মায়া কমে যাচ্ছিল তার। সে আড়ালে আবডালে কাঁদছিল।
বাসনের বস্তা বেঁধে তুলসী যখন ছাদের সিড়ির চাতালে বসে সিগারেট ধরিয়েছে তখন মৃদুলা তার পিঠ খুঁটে দিতে দিতে বলল, আবার আমরা ফিরে আসব। তুমি কলকাতায় চাকরি খুঁজো। ওখানে গিয়ে গা ছেড়ে দিয়ো না। গা ছাড়লে তুমি চাষাভুষা হয়ে যাবে।
কলকাতায় চাকরি! শুনে তুলসী একটু চমকে ওঠে। কয়েক দিন আগে ললিত তাকে বলেছিল, তুলসী, আমি সেক্রেটারি আর হেডমাস্টারকে বলে রাখব আমার চাকরিটা যাতে তোর হয়। সেই থেকে ভিতরে ভিতরে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও একটা লোভ কাজ করছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে হয়, কলকাতায় ললিতের চাকরিটা পেলে মন্দ হত না। পরমুহুর্তেই সচেতন হয়ে সে নিজেকে ধিক্কার দেয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা টানা-পোড়েন চলতে থাকে। কোথায় যেন ভিতরে ভিতরে ভাল-তুলসী আর মন্দ-তুলসীর একটা অবিরাম মল্লযুদ্ধ চলছে। কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। তাই মৃদুলার কথা শুনে তুলসী একটু চমকে ওঠে। তারপর নিঃশব্দে সিগারেট টানতে থাকে। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ খেয়াল করে বলে, আজ যাওয়ার সময়ে ললিতের দেওয়া শাড়িটা পরে যেয়ো।
কেন?
এমনিই। শাড়িটা ও দিয়ে যাওয়ার পর একদিনও পরোনি।
বাঃ। আমি যে নীল মুর্শিদাবাদিটা—
না। তুলসী দৃঢ়ভাবে বলে, ললিতের দেওয়াটা।
একটু থমকে যায় মৃদুলা। বলে, আচ্ছা।
তারপর খানিকক্ষণ তুলসীর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ললিতবাবু তো চাকরি ছেড়েই দেবেন! তখন তোমার ওখানে হয় না?
শুনে তুলসী চট করে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। মৃদুলা পিছু পিছু নেমে আসে। বলে, কলকাতায় তো আমাদের ফিরে আসতেই হবে। আমি চিরকাল পলাশপুরে থাকতে পারব না।
তুলসী ফিরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ হেঁকে বলে ওঠে, আমি পলাশপুরের লোক। আজ থেকে আমি চিরকাল পলাশপুরের লোক। আই ডিজওন ক্যালকাটা।
পিতু মেয়েটাকে কোনও দিনই পছন্দ করত না মৃদুলা। পিতু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাপ-মা’র সামনেই হিন্দি গান গুনগুন করে কোমর দোলায়। ছাদের আলসে থেকে ঝুঁকে রাস্তার ছেলেদের ইশারা করে! মৃদুলার সঙ্গে তার বনে না। কিন্তু আজ পিতু সারাদিন কাঁদছে। ‘বন্ধের পর পরীক্ষা না হলে ঠিক তোমার সঙ্গে চলে যেতাম কাকিমা, অনেক দিন থেকে আসতাম তোমাদের পলাশপুরে। সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসতাম ঠিক শাশুড়িদের মতো।’ কান্নার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে এ-রকম ঠাট্টাও করছে পিতু।
ইস! কত কাজের মেয়ে। জল গড়িয়ে খেতে পারে না। পরীক্ষার পরে যেয়ো, দেখব কেমন।
একটু হাসিঠাট্টা করেই পিতু ‘ইস, সত্যি চলে যাচ্ছ’ বলে থমথমে মুখ করে থাকে, চোখে টসটস করে জল। সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলাও কঁদতে বসে।
স্টেশনে খুব বেশি লোক আসবে বলে আশা করেনি তুলসী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বিদায় জানাতে অনেক লোক এসে গেল। সময়মতো এল না কেবল সঞ্জয়। কথা ছিল সে তার গাড়ি নিয়ে এসে তুলসীকে স্টেশনে পৌঁছে দেবে। সঞ্জয়ের কথার খেলাপ বড় একটা হয় না। এটা সেই অন্যতম সদ্গুণ যার ওপর সঞ্জয় বড় হয়েছে। বেলা তিনটে অবধি তার জন্য অপেক্ষা করে অবশেষে ট্যাক্সি ধরতে হল।
বালিগঞ্জ স্টেশনের ওভারব্রিজের তলায় দাড়িয়ে ছিল লম্বা রমেন, উজ্জ্বল কিংবা শেষ উজ্জ্বল চেহারার চলিত, তার বা ধারে সার্জেন্টের পোশাক পরা, কোমরে পিস্তলওলা একজন লম্বা চওড়া লোক। দূর থেকে দেখে মনে হয়েছিল, ললিত আর রমেনকে পুলিশ ধরেছে। কাছে এসে শম্ভূকে চিনতে পেরে খুব জোরে শ্বাস ছাড়ল তুলসী। বলল, হাঁরে, আমি কলকাতায় থাকতে থাকতে তুই সার্জেন্ট হলি না! তোর ভরসায় নিশ্চিন্তে রাস্তায় হাঁটতাম কয়েক দিন।
শম্ভু শুনে তৃপ্তির চওড়া বোকা-হাসি হাসল একখানা। তারপর জড়সড় মৃদুলার পাশে শাড়ী-পরা কচি চেহারার পিতুকে আড়চোখে লক্ষ করে অকারণে পিস্তলের খাপের ওপর হাতখানা রাখল সে।
দূর থেকেই বাবা আর টুপুকে প্লাটফর্মে ভিড়ের মধ্যে লক্ষ করে হাত তুলল মৃদুলা। শরীর ভাল থাকলে চেঁচিয়ে উঠত। টুপ তাকে দেখতে পেয়ে বাবাকে ডেকে আঙুল দিয়ে দিদিকে দেখিয়ে দিল। কী করুণ, কী স্নেহময় হাসি ফুটল মুখে! পিতুর হাত ছাড়িয়ে ছুটে লাইন পেরিয়ে প্লাটফর্মে উঠে গেল মৃদুলা।
মাকে আনলে না বাবা! একটু দেখতাম।
তার শরীর ভাল না রে। তা ছাড়া বাড়িটা ফাঁকা থাকবে।
তোমরা কবে যাচ্ছ পলাশপুরে, বলল। আমরা ওখানে একা, একদম মন টিকবে না। তোমরা গিয়ে এক-দুই মাস থাকবে। বলতে বলতে মৃদুলা একটু থেমে ভাবে। তারপর বলে, চলো না, কলকাতার বাসা উঠিয়ে সবাই পলাশপুরে যাই। ওখানে সবাই কাছাকাছি থাকব।
পলাশপুর সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই মৃদুলার, কিন্তু সে মনশ্চক্ষে দেখতে পায় সে এক স্বপ্নের দেশ—যেখানে বাস্তবের কোনও রূঢ়তা নেই, যেখানে বাইরের দুর্দৈব এসে সংসার ভেঙে দেয় না, যেখানে সবাই চিরকাল সুখে থাকে। এইরকম এক পলাশপুরের চিন্তা করে সে বড় আশান্বিত হচ্ছিল।
বাবা তার মুখখানা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। ধীর স্বরে বললেন, ভয়ে ভয়ে থেকেই আমরা শেষ হয়ে গেলাম। ছেলেটার বড় বাড় বেড়েছে। কেউ এমন নেই যে ওকে ঠান্ডা করতে পারে। কানাঘুষো শুনছি আজকাল খুনজখম শুরু করেছে।
মৃদুলার বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞেস করে, তা হলে কী হবে! মা গো! তুমি শিগগির একটা কিছু করো। পলাশপুর এমন কিছু দূর নয়, তুমি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতে পারবে।
বাবা স্নান শুকনো মুখে হাসলেন, তাই কি হয়! পালিয়ে যাওয়াটা ভাল দেখাবে না। বরং সহ্য করে দেখি আরও কিছু দিন, তারপর না হয় অন্য পাড়ায় বাসা নেব।
একসময়ে ফাঁক বুঝে টুপু মৃদুলার কানে কানে বলল, দিদি, আমাকে পলাশপুরে নিয়ে যাবি? আমি জামাইবাবুর স্কুলে পড়ব।
মৃদুলা আকুল চোখে অসহায়ভাবে চোদ্দো বছরের টুপুর কচি, নরম আর ভিতু মুখখানা দেখে। কী যে বলবে ভেবে পায় না।
টুপু মৃদু স্বরে বলে, বেহালায় আমার একটুও ভাল লাগে না।
কেন রে?
টুপু কী একটু ভেবে লজ্জায় লাল হয়। চোখ নামিয়ে নেয়। কী করে সে মৃদুলাকে বলবে যে, পাড়ার রাস্তা দিয়ে সে হাঁটতে পারে না। বিভুর দল এখনও তাকে দেখলেই দুর থেকে চেঁচিয়ে বলে, এই বিভুর শালা। সেই থেকে ‘বিভুর শালা’ বলে খ্যাপায়। সে দুর্বল, ভিতু, মারপিট করতে পারে না, কাউকে ভয়ও দেখাতে পারে না। লজ্জায় সে কেবল মুখ লুকোয়। মাঝে মাঝে পড়ার টেবিলে বসে লজ্জায় আর অপমানে কাঁদে।
মৃদুলা বুঝতে পারে, টুপু পালাতে চায়। নিশ্চিন্ত, নিরাপদ এবং সম্মানজনক পরিবেশে চলে যেতে চায় সে।
টুপুর পিঠে হাত রাখে মৃদুলা। নরম গলায় বলে, যত দিন মা-বাবা আছে এখানে ততদিন তাদের কাছেই থাক। তুই ছাড়া দু’জনকে দেখবে কে? তুই কাছে না থাকলে মা বাবা আরও ভেঙে পড়বে। একটু চুপ করে মৃদুলা আবার বলল, মাঝে মাঝে যখনই ইচ্ছে হবে তখনই পলাশপুরে চলে যাবি।
কেমন একটু হতাশ আর স্তিমিত হয়ে যায় টুপু। এত দিন সে মনে মনে কল্পনা করেছে, কলকাতার বাইরে অনেক দূরে মেঠো সুন্দর গ্রামখানায় সে চলে যাবে, তারপর সেইখানেই থেকে যাবে সে। দিদিকে বললেই নিয়ে যাবে দিদি। বেহালার বাসায় আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না তার। বড় ভয় করে, লজ্জা লাগে।
বাবা আর দিদি কথা বলছে, টুপু একটু দূরে সরে দাঁড়াল। প্লাটফর্মের শানে একটু জুতো ঘষল। অন্যমনস্কভাবে সে ভাবছিল, খুব শিগগিরই সে একটা ব্যায়ামাগারে ভরতি হবে। সারিবাদি সালসার বিজ্ঞাপনে যে বিপুল চেহারার লোকটাকে দেখা যায় দু’হাতে প্রকাণ্ড একটা সাপকে ধরে পিষে ফেলছে, ঠিক ওইরকমই একটা শরীর বানাবে সে।
অন্যমনস্কভাবে চারদিকে চাইছিল টুপু। হঠাৎ একসময়ে চোখ তুলে কিছু দেখে সে খুব স্থির হয়ে গেল। ওভারব্রিজের ওপরে লোহার রেলিঙের ওপর ভর দিয়ে একটা বিমের ধার ঘেঁষে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার চাপা গাঢ় কালচে রঙের প্যান্ট আর ঘি-রঙের টেরিলিনের শার্ট স্পষ্ট চেনা যায়। চোখে গগলস, খুব নির্বিকারভাবে সিগারেট টানছে। বিকেলের আলো খুব নিস্তেজ, তবু লোকটাকে চিনতে ভুল হয় না। চোখে গগলস বলে বোঝা যায় না কোন দিকে চেয়ে আছে। তবু টুপু বোঝে যে, বিভু তাকে দেখছে না, প্লাটফর্মের হাজারটা লোকের কাউকেই। তার চোখ এক নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির।
ভয়ে টুপুর মুখ সাদা হয়ে গেল। দিদি কিংবা বাবা কেউ লক্ষ করেনি বিভুকে। টুপু তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজের জুতোর ডগার দিকে চেয়ে রইল।
জিনিসগুলো যেখানে নামিয়ে স্তুপাকার করে রাখা হয়েছে সেখানে ছোট ভাইটার হাত ধরে নিজের বাবা-মার সঙ্গে আলাদা দাড়িয়ে ছিল পিতু। প্রকাণ্ড চেহারার সার্জেন্টটা তার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। যত বড় চেহারা লোকটার ততখানি সাহসী নয়। বরং ভিতু। চোখে চোখ পড়ল তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে। অত ঘাবড়াচ্ছে কেন ছেলেটা। পিতু তো চোখ দিয়ে বলতেই চাইছে যে, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। সার্জেন্টদের আমি সত্যিই পছন্দ করি।
ট্রাঙ্কের ওপর রাখা বেতের ঝুড়িটাকে একটু ঠেলে দিয়ে সেখানে বসল পিতু। ছোট্ট রুমালে নাকের নীচের সামান্য ঘাম চেপে নিল। তারপর হাতে থুতনি রেখে ঝুকে বসে চেয়ে রইল লোকটার দিকে। লোকটা কাকার চেনা, নাম নেছে শম্ভু। লোকটা যদি সাহসী হত তা হলে এই স্টেশনেই লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়ে থাকত। কাল স্কুলের বন্ধুদের সে তার সার্জেন্ট-ভক্তের কথা অহংকার করে বলতে পারত।
ওদিকে অল্প অল্প করে ঘেমে যাচ্ছিল শম্ভু। মেয়েটার চোখে চোখ রাখতে পারছিল না। কচি সতেজ শরীরে, মোম-মাখানো মসৃণ চামড়া আর লম্বাটে ধাঁচের মুখওলা কিশোরীটা তাকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। বেশ ভাইঝিটি তুলসীদার। যদি কোনও দিন সুযোগ হয় তবে সে তার লাল মোটরসাইকেলের পাশে ছোট খোপগাড়িতে বসিয়ে নিয়ে মেয়েটিকে সারা কলকাতা দেখিয়ে বেড়াবে।
এতদিন মেয়েদের কথা ভাবতেই পারত না শম্ভু। জিমনাশিয়ামের ইনস্ট্রাকটর কড়া ব্রহ্মচর্য করে যেতে বলেছিল তাকে। স্বাস্থ্যকে বরাবর ভালবেসে এসেছে শম্ভু। তাই এতকাল মেয়েদের ভাল করে চেনেনি সে। গোরুর মতো ছোলা মুগ খেয়েছে। কাঁচা ডিম গিলেছে। কিন্তু এবার এই প্রকাণ্ড শরীরটার একটা মূল্য পেতে ইচ্ছে করে। কেউ মুগ্ধ হোক, ভালবাসুক। পাখা ঝাপটাক বুকের মধ্যে। ছোট্ট পাখির মতো একটি মেয়ে, একটি কিশোরী।
শম্ভু প্রাণপণে ভেবে বের করতে চেষ্টা করল, এটা কীসের ইঙ্গিত।
শুক্রবার দিন বিকেলে অফিসের পর নিজের গাড়িতে নাকি দিঘায় গেছে সঞ্জয়। বাড়িতে রিনিকে ফোনে জানিয়ে গেছে যে, সে দিঘায় যাচ্ছে। তারপর থেকে আর কয়েক দিন তার কোনও পাত্তা নেই। এ দিকে ললিত আর রমেনকে অনেক আগেই বলে রেখেছিল সঞ্জয়, সামনের রবিবার তোরা আমার বাসায় খাবি। রমেনকে বলেছিল, তোর টাকাটা রবিবারে নিবি। সব দিয়ে-থুয়ে এবার আমি ঋণমুক্ত হব। অথচ রবিবারে তার বাসায় গিয়ে সে নেই জেনে দু’জনেই বেকুব। রিনি অবশ্য তাদের যথাসাধ্য আপ্যায়ন করেছে। কিন্তু খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ রিনি ভেঙে পড়েছিল। খুব কান্নাকাটি করে বলল যে, প্রায়ই নাকি বাসায় ভুতুড়ে টেলিফোন আসে। একজন লোক টেলিফোনে বলে, মিস দাশগুপ্ত নামে কে একজন মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সঞ্জয়। ময়দানের অন্ধকারে গাড়ি থামিয়ে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। দিঘাতেও সঞ্জয় গেছে সেই মেয়েটির সঙ্গেই।
শুনে তুলসীর মন খারাপ হয়ে গেল। সঞ্জয় তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আজ গাড়ি নিয়ে আসেনি। তার অর্থ, সে এখনও ফোরেনি কলকাতায়। সঞ্জয় কথার খেলাপ করেছে আজ। অথচ কোনও দিন করত না। কতকগুলো সদ্গুণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়। ধৈর্য, অধ্যবসায়, অবিচল পরিশ্রম আর নিষ্ঠা— যে-গুণগুলো তাদের আর কারও নেই। যদি সঞ্জয়ের কখনও পতন হয় তবে তুলসীর কাছে অনেকগুলো সদ্গুণের অর্থ নষ্ট হয়ে যাবে।
চারিদিকে হই-হট্টগোল শুনে বোঝা যাচ্ছিল যে, ট্রেন আসছে। উবু হয়ে বসে থাকা লোকজন মুখের বিড়ি ফেলে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
তুলসী চেঁচিয়ে বলে, শম্ভু, তুই তো ব্যায়ামবীর, আমার মালপত্রে একটু হাত লাগা।
শুনে শম্ভু গটগট করে হেঁটে গেল। পিতুর কাছে আসতেই উঠে দাঁড়াল পিতু। নিচু হয়ে ট্রাঙ্কটা হাতলে ধরে আলগা করে ওজন দেখার সময়ে শঙ্কু বড় মিষ্টি একটা গন্ধ পায়। না, এটা স্নো-পাউডারের গন্ধ নয়। সে-গন্ধ ছাপিয়ে কিশোরী-দেহের ঘামের বোঁটকা মিষ্টি নেশারু গন্ধ পায় সে। চকিতে এক টানে ট্রাঙ্কটাকে মাটি থেকে আলগা করে ফেলে। এক হাতে। সে জানে, এভাবে গায়ের জোরটা কাউকে দেখানো এক ধরনের বোকামি। চারপাশের লোকজন তাকে হাঁ করে দেখছে। কিন্তু সে আর কী করতে পারে! শরীরের জোর ছাড়া তার আর কী আছে যা সে মেয়েটিকে দেখাতে পারে?
ট্রাঙ্কটা আবার নামিয়ে রেখে পিতুর দিকে চেয়ে হাসল শম্ভু। বলল, তেমন ভারী নয় তো!
নয়! ভারী অবাক হয় পিতু। বলে, ওর মধ্যে একগাদা কাচের বাসন আর বই আছে। খুব ভারী হওয়ার কথা।
পরিতৃপ্তির বোকা-হাসি হাসল শম্ভু।
রমেন অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেছে, ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কী যেন লক্ষ করছে দুর্গাপুরের সেই ছেলেটা। খুনি-চোখ পরকলায় ঢেকে রেখেছে। খুব অন্যমনস্ক। মাঝে মাঝে হাতের আঙুলের একটা আংটির পাথর মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
প্লাটফর্মের মাঝামাঝি হেঁটে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটিকে দেখল। বড় অসহায় ছেলেটির ভঙ্গি। পৃথিবীতে বড় অনিশ্চয়তা বোধ করছে ও।
তুলসীর শালা বাচ্চা ছেলেটি জুতোর ডগা শানে ঘষতে ঘষতে হঠাৎ মুখ তুলে ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখল। তার মুখ সাদাটে। তাতে লেখা আছে ভয়। রমেন বুঝতে পারছিল না, ওভারব্রিজের ওপর থেকে দুর্গাপুরের ছেলেটা কাকে দেখছে। সে খানিকটা আন্দাজে তুলসীর শালার পাশে দাঁড়াল। তার কাঁধে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে?
ছেলেটা ভীষণ চমকে উঠে তার দিকে তাকাল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না, কিছু না।
কিন্তু স্বস্তি পেল না রমেন। তার মন একটি কোনও বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল। সে দাঁড়িয়ে থাকল। দেখল ওভারব্রিজের ওপর থেকে দুর্গাপুরের ছেলেটা আস্তে আস্তে সরে আসছে সিঁড়ির দিকে। একটু পরেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল ছেলেটা। কালো চশমার ওপর তার কোঁচকানো ভ্রূ আর চোয়ালের দৃঢ়তা লক্ষ করে রমেন। খুব কাছ দিয়ে বুক ঘেঁষে অন্যমনস্কের মতো হেঁটে গেল সে, কিন্তু রমেনকে লক্ষ করল না। তারপরেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল ছেলেটা।
তুলসীর শালা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে মৃদুলা স্থির চোখে ভিড়ের ভিতরে কী যেন দেখছে। ঠোঁট কাঁপছে তার। তুলসীর শ্বশুরের চোখ কেমন ঘোলাটে, চঞ্চল। দু’ হাতে আঙুল মটকাচ্ছেন তিনি। হাঁ করে শ্বাস টানছেন।
ঠিক এই সময়ে গাড়ির গুড়গুড় গম্ভীর শব্দ হচ্ছিল। তুলসী হেঁকে বলল, রমেন, তোর তো কোনও পিছুটান নেই, আমার সঙ্গে পলাশপুর যাবি? কয়েক দিন থেকে আসবি আমার সঙ্গে! একা এত মালপত্র নিয়ে সন্ধেবেলায় নামতে কেমন ভয় করছে।
রমেন একটুও চিন্তা না করে বলল, যাব।
বিভু মনস্থির করতে পারছিল না। সে খবর পেয়ে সঠিক পিছু নিয়ে এসেছে স্টেশনে। ওভারব্রিজ থেকে দেখেছে মৃদুলাকে এতক্ষণ। কিন্তু হায় ঈশ্বর, এ কী চেহারা হয়েছে মৃদুলার? কী রোগা হতশ্রী, শুষ্ক চেহারা! চোখের নীচে কালি, হনুর হাড় উঁচু, ঠোঁটে শুকিয়ে আছে পানের রস। কনুইয়ের চামড়ায় পড়েছে কড়া। গায়ের রং ফ্যাকাসে। হায় ঈশ্বর! এর কাছে আর কী চাওয়ার আছে বিভুর?
এতকাল বৃথাই সে ডাকপিয়নকে ভয় দেখিয়ে মা-বাবাকে লেখা মৃদুলার চিঠিগুলো পড়েছে। লোক লাগিয়ে খুঁজে বের করেছে ঠিকানা। পিছু নিয়ে এসেছে এত দূরে। ভেবেছিল, পলাশপুর পর্যন্ত যাবে। তারপর একদিন ওর স্বামী স্কুলে গেলে নির্জন দুপুরে হানা দেবে মৃদুলার দরজায়। বলবে, ওই শুটকো লোকটার চেয়ে কি আমি খারাপ ছিলাম? দেখো তোমার জন্যই আমি আজ ফেরারি, পুলিশ কেস পিছনে নিয়ে ঘুরছি। এ-বিষয়ে তোমার কী বলার আছে!
কিন্তু খুব কাছ থেকে মৃদুলাকে দেখার পর বিভু ভিড় ঠেলে অনেক দূর এগিয়ে গেল। ফিরে এসে আর-একবার মৃদুলাকে দেখতে ইচ্ছে করল না। প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তটা নির্জন। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে। গাড়ি এসে গেলে সে উদাসীন চোখে লক্ষ করল, ঢেউয়ের মতো হাজার হাজার মানুষ আছড়ে পড়ছে গাড়িতে। তার উঠতে ইচ্ছে করল না।
গাড়ি ছেড়ে গেল। আস্তে আস্তে ট্রেনের কোনও একটা জানালায় কবেকার দেখা একটা আধ-চেনা লোকের মুখ লক্ষ করে হঠাৎ সে চমকে ওঠে। বড় সুন্দর মুখখানা। কবে, কোথায় যেন দেখেছে। ঠিক মনে পড়ল না। ভ্রূ কুঁচকে ভাবতে ভাবতে ফিরে যেতে লাগল বিভু।
আটত্রিশ
সেই রাত্রে আর রমেনের ফেরা হল না। বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে যখন ট্রেনটা ছাড়ছিল তখন হতভম্ব ললিত চেঁচিয়ে তাকে বলেছিল, তুই সত্যিই চললি নাকি?
রমেন মৃদু হেসে ঘাড় নাড়তে ললিত আবার চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কবে ফিরবি?
রমেন তার উত্তর দিতে পারেনি। আসলে সে তো কোথাও ফেরে না। যেখানেই সে যায় সেখানেই তার ফিরে যাওয়া। অন্তত ওই রকমভাবেই ভাবতে চেষ্টা করে রমেন। আশ্চর্য এই যে, ভাবতে আজকাল আর অসুবিধে হয় না। তবু ললিতের জন্য কষ্ট হচ্ছিল। রমেনকে ছাড়া আজকাল বোধ হয় ললিতের একটু একা-একা লাগে।
পলাশপুরের নতুন বাসায় পা দিতে-না-দিতে মৃদুলার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সন্ধের মুখে পৌঁছে তারা খানিক দূর ইলেকট্রিকের আলো আর পিচের রাস্তা পেল। তারপর অন্ধকার কাঁচা রাস্তায় একটুখানি গিয়ে ফাঁকায়, প্রায় মাঠের মধ্যে অন্ধকার বাসা। তুলসীর ছাত্ররা আর কয়েকজন মাস্টার, বাড়িওয়ালা নিজে— সবাই মিলে কয়েক পলকে পুরুষালি রীতিতে যেমন-তেমন ভাবে ঘর দু’খানা সাজিয়ে ফেলতে সাহায্য করল। কিন্তু হ্যারিকেনের আলোয় যে ধোঁয়াটে অন্ধকার সৃষ্টি হয়ে থাকে তাতে অভ্যাস ছিল না বলে মৃদুলার কেবল মনে হচ্ছিল সে এক চির অন্ধকারের নির্বাসনে এসেছে। আর কোনও দিন কলকাতা আর বেহালার মুখ দেখবে না। বাড়ির ভিতরদিককার দরজা খুলে ভিতর-বারান্দায় দাঁড়াতেই প্রতিপদের চাঁদের আলোয় ভাসা উঠোন, তারপর আগাছার বেড়া, আর বহুদূর বিস্তৃত এক কুয়াশায় মেঘাচ্ছন্ন আগাছা কণ্টকিত প্রান্তর দেখে তার মনে হল সে মৃত্যুর পরের জগতে চলে এসেছে। চারদিকের এ-জগৎ বেঁচে থাকার জগৎ নয়।
চা খেয়ে সবাই বিদায় নিয়ে গেলে রইল কেবল তুলসীর লম্বা সন্ন্যাসী বন্ধুটি। এও হয়তো কাল কি পরশু চলে যাবে। ভেবে মৃদুলার কেমন কান্না পায়। এখন যে-কোনও মানুষ কাছে থাকলেই ভাল লাগবে। যে-কোনও মানুষ।
নতুন তোলা-উনুনে চালে ডালে চাপিয়ে ভাজার বেগুন কুটতে বসেছিল সে, এমন সময়ে যে-সব ভীরু মেয়েরা দরজার আড়াল থেকে তাদের মালপত্র নিয়ে আসতে দেখেছে তারা আসতে লাগল এক দুই করে। অসম্ভব তাদের কৌতূহল কলকাতার মেয়েদের প্রতি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মৃদুলা বুঝতে পারছিল যে গ্রাম সুখের জায়গা নয়।
তুলসী আড়াল আবডাল থেকে হ্যারিকেনের মাজা আলোয় যতটা সম্ভব মৃদুলার মুখের ভাব লক্ষ করে যায়। তারপর নানা কথা ভেবে কেমন একটু নার্ভাস বোধ করে। এতখানি করার পর যদি মৃদুলা সুখী না হয়ে থাকে তবে তার সুখ কোথায়?
নতুন চৌকির ওপর সদ্য পাতা বিছানায় রমেনের মুখোমুখি আঁট হয়ে বসে একটা সিগারেট ধরাল তুলসী। বলল, এ-জায়গাটা খুব ডেভেলপ করবে, বুঝলি? ভাবছি কিছু জমিয়ে-টমিয়ে এ দিকেই জমি কিনব।
কথাটা বলেই তার খেয়াল হল যে, যাকে সে এই কথা বলল তার জমি-বাড়ি কিংবা পার্থিব সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহ না থাকারই কথা! মনে মনে একটু লজ্জা পেল তুলসী। বরাবর রমেনের কাছে নিজেকে তুচ্ছ বলে মনে হয়েছে তার, আজও হল।
সকালবেলায় উঠেই রমেনের চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু মৃদুলা একটু আপত্তি তুলল, কেন যাবেন এক্ষুনি? কোনও কাজ তো নেই! আজকের দিনটা থেকে যান না।
আসলে বালিগঞ্জ স্টেশনে বিভুকে দেখার পর থেকেই মৃদুলা ক্রমান্বয়ে অস্বস্তিতে আছে। কেবলই মনে হয় যে-কোনও সময়ে যে-কোনও দিন বিভুর আবির্ভাব ঘটবে এইখানে। তুলসীকে মৃদুলা চেনে। যদি কখনও বিভুর মুখোমুখি হয় তবে কোথায় উবে যাবে তুলসীর সাহস! বিভুর আক্রোশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই তুলসীর নেই। তাই লম্বা চওড়া সাহসী রমেন কয়েকটা দিন তাদের কাছে থাক। দুটো ঘরের একটা তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
রমেন থাকল।
মৃদুলাকে বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে চলে যেতে দেখল বিভু। ফেরার পথে ট্যাক্সিতে খুব অন্যমনস্কভাবে বসে ছিল সে। গড়িয়াহাট পেরিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ করল সামনে আর একটা ট্যাক্সি। পিছনের কাচ দিয়ে দেখা যায়, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে।
প্রথমটায় কিছু মনে হয়নি বিভুর। দৃশ্যটা উদাসীনভাবে দেখল একটু। কিন্তু ট্যাক্সিটা আগাগোড়া তার ট্যাক্সির আগে আগে চলছিল। এতে সামান্য উষ্ণতা বোধ করল সে। কেন ওই ট্যাক্সিটা আগে আগে যাবে! বিকেলের নিস্তেজ আলোয় সে লক্ষ করে, মেয়েটার মাথা ভেঙে ছেলেটার ঘাড়ে নেমে আসে। ছেলেটা একটা হাত তুলে মেয়েটার কাঁধ জড়িয়ে ধরেছে। ওদের দু’জনেরই অবস্থা একটু বেসামাল।
বিভু হাত বাড়িয়ে ট্যাক্সিওয়ালার কাঁধ ছুঁয়ে বলে, ওই ট্যাক্সিটাকে ওভারটেক করো সর্দারজি।
ট্যাক্সিওয়ালা বিভুকে খানিকটা চেনে। যারা চেনে না তারাও চিনে নেয়। ফলে সর্দারজি নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে হর্ন দিল।
ত্রিকোণ পার্কের কাছে দুটো ট্যাক্সির জানালা সমান্তরাল হলে বিভু মুখ বাড়িয়ে দেখে, মেয়েটার কোলে ছেলেটার হাত।
বিভু চেঁচিয়ে বলল, এই শালা, সরে বোস।
ভীষণ চমকে ছেলেটা হাত টেনে নিল। ওদের ট্যাক্সিওয়ালা ফিরে তাকাল। বিভুর চিৎকারেই বুঝি ওদের ট্যাক্সিটা টলমল করে একটু আঁকাবাঁকা হয়ে আবার সোজা হল।
ওদের পেরিয়ে এসে বিভু পিছন ফিরে দেখল, ছেলেটা আর মেয়েটা অনেক দুরে সরে বসেছে। হাসল বিভু। পরিতৃপ্তির হাসি। শালা প্রেম করবে! দেশের এই অবস্থা, আর শালারা প্রেম করবে, অ্যাঁ!
মাঝে মধ্যে আজকাল বিভুর অদ্ভুত সব খেয়াল দেখা যায়। রাস্তা দিয়ে দু’টি ছেলেমেয়ে জোড় বেঁধে যাচ্ছে, বিভু হয়তো আসছে উলটো দিক থেকে। এ-রকম অবস্থায় সে ঠিক দু’জনের মাঝখান দিয়ে সোজা হেঁটে যায়; দু’জনকে ছিন্ন করে, দূরে সরিয়ে আনন্দ পায়।
রাসবিহারীর মোড়ের কাছে, রসা রোডে একদিন এই কাণ্ড করল বিভু। এবারের ছেলেটা হলুদ গেঞ্জি গায়ে, স্বাস্থ্যবান চেহারা। ফলে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটা বিভুর কাঁধ চেপে ধরল।
বিভু ফিরে দাঁড়ায়। আপনমনে শান্তভাবে একটু হাসে। তাই! ছোকরার গায়ে জোর আছে। প্রেমিকাকে বীরত্ব দেখাতে চায়।
কী হল এটা? ভদ্রভাবে হাঁটতে শেখোনি! ছেলেটা গরম খেয়ে বলে।
বিভু শুধু হাসে। গায়ে জোর থাকলে কী হয়, প্রেমিকরা কোনও দিনই তেমন নিষ্ঠুর হতে জানে না। তুমি কি পারো আমার মতো হৃদয়হীন হতে! পারলে তুমি হতে মাস্তান। কিন্তু তুমি তো তা নও।
বিভু কিছুমাত্র গায়ের জোর দেখাল না। কেবল অতিশয় হৃদয়হীনতায় ঠান্ডা মাথায় ডান হাতের দুটো আঙুল সাঁড়াশির মতো তুলে লঘু হাতে ছেলেটির চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।
এই হল কায়দা বুঝলে! শত রেগে গেলেও তুমি কখনও পারবে না কারও চোখে আঙুল ঢোকাতে। তোমার মায়া হবে।
ছেলেটা প্রথমে বুকফাটা চিৎকার করে দু’চোখ চেপে ধরেছিল। চশমা পরা মেয়েটা প্রথমে বুঝতে পারেনি কী হল। তারপর বুঝতে পেরে সে তাড়া করল বিভুকে হাতের সাদা ভ্যানিটি ব্যাগটা অস্ত্রের মতো তুলে ধরে।
বিভু শান্তভাবে কয়েক পা দৌড়ে গেল। ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল ছুটন্ত বাস।
পা-দানিতে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই সে দেখল ছেলেটা ফুটপাথে গড়াগড়ি যাচ্ছে। বোধ হয় কাঁদছে। ভিড় জমে উঠেছে আস্তে আস্তে।
প্রেম! শালা প্রেম! দেশের লোক বোমা বন্দুক খেয়ে মরে যাচ্ছে, ফসল ফলছে না জমিতে— তোমরা শালা প্রেম করবে! প্রেমের কি এই সময়! প্রেম দিয়ে কী হয় রে শালা জীবনে, যে সর্বস্ব নিয়ে একটা মেয়ের পিছনে ল্যাং ল্যাং করে ঘুরবে একটা ছেলে!
বিভু তাই রাস্তায় জোড়া ছেলেমেয়ে দেখলে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কখনও দূর থেকে চেঁচিয়ে আওয়াজ দেয়। মুখ খারাপ করে।
বিশু মাঝে মাঝে তাকে সাবধান করে দেয়, বড় বেশি তড়পাচ্ছিস। একদিন বেমক্কা মার খেয়ে যাবি, তোর চেয়ে ঢের মাস্তান আছে।
কিন্তু বিভু বিড় বিড় করে। না, তার চেয়ে বেশি কেউ নেই।
টুপু যেদিন মৃদুলাকে তুলে দিয়ে এসেছিল তার পরদিনই ফুটপাথের দোকান থেকে একটা দেশি লোহার লম্বা চকচকে ছুরি কিনেছিল। হাতলটা কাঠের। ছুরিটা এত লম্বা যে পকেটে আঁটে না।
পরদিন শানে ঘষে ছুরিটাকে আরও তেজালো করে তুলেছিল সে। বন্ধুরা দেখে বলল, বেশ ছুরি। কী করবি এটা দিয়ে?
দেখিস।
টুপু ছেলেমানুষ। কিন্তু ঠিক ছেলেমানুষের মতো সে বলেনি কথাটা। স্টেশনে দিদির সামনে দিয়েই যখন বিভু হেঁটে গিয়েছিল তখন দিদির মুখের ভাব আর বাবার অসহায় শ্বাস টানা সে লক্ষ করেছিল। এর পর থেকেই তার নিজেকে বড় বেশি অসুখী মনে হয়েছিল। এত বিমর্ষ সে আর কখনও বোধ করেনি।
খোলা অবস্থায় ছুরিটা সে পকেটে রাখে। পকেটে হাত দিয়ে মাঝে মাঝে অনুভব করে হাতলটা। ছুরিটাকে নাড়ে, ঘোরায়। ফলে কয়েক বার তার হাত কাটল, ছুরির ডগায় ফুটো হয়ে গেল আঙুল।
রাতে মা-বাবার চোখের আড়ালে দিদির শোওয়ার ঘরে একটা পুরনো কোলবালিশ দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ছুরিটার প্রথম পাঠ নিল টুপু। আশ্চর্য কোলবালিশটা ঠিক ছুরি-খাওয়া মানুষের মতোই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গেল। পেটের ওপর হাতলটা রইল জেগে।
কেবল টুপু জানল, এ-রকম হবে। আর-কেউ জানল না।
টুপুর সিনেমায় যাওয়া বারণ। কিন্তু পোস্টার দেখে সে দুটো মারদাঙ্গার ছবি বেছে নিল। স্কুল পালিয়ে দেখে এল দুটো ছবি। তার চোখে মুখে এবং মনে যথেষ্ট হিংস্রতার সঞ্চার হয়ে গেল। ছবি দুটোর শেষে সত্য এবং অহিংসা এবং প্রেম ইত্যাদির কথা বলা হয়েছিল। টুপু সেগুলো মনে রাখল না।
আজকাল টুপু ডিটেকটিভ বইগুলো দু’বার করে পড়ছে।
বাইরে থেকে তাকে এখন বেশ ভাবুক আর গম্ভীর দেখায়। কেউ ‘বিভুর শালা’ বলে চিৎকার করে তাকে খ্যাপালে সে ফিরেও তাকায় না।
সে এই পারিবারিক দুর্দিনের শেষ দেখতে চায়।
কয়েক দিনই গা-ঘেঁষা দূরত্বে দেখা হল বিভুর সঙ্গে। আগের মতোই রাস্তা ছেড়ে পাশে সরে দাঁড়াল টুপু। ভয় পেল। চোখে চোখ রাখল না।
টুপু নানাজনের কাছে শুনে শুনে শিখেছে যে পেটই হল সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। সেখানে হাড় নেই। ছুরিটা ঢুকিয়ে একটু আড়াআড়ি টেনে দিতে হয়। ছুরিতে খুব ধার থাকলে ব্যাপারটা মোটেই শক্ত না।
উনচল্লিশ
দীর্ঘ রাস্তা মোটর চালিয়ে গভীর রাতে ফিরেছে সঞ্জয়। তারপর বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে নিঃসাড়ে। কাত হয়ে শুয়ে আছে সে। তেল-না-দেওয়া রুক্ষ চুলে ধুলোটে লালচে রং। এখনও চুল বাড়েনি সঞ্জয়ের। মায়ের শ্রাদ্ধের সময়ে কামানো হয়েছিল মাথা। তেল তেল করছে মুখ, গালে দাড়ি বেড়ে কর্কশ দেখাচ্ছে মুখখানা। হয়তো স্বপ্ন দেখছিল সঞ্জয়। তার ঠোঁটে একটু হাসির আভাস। সারা মুখখানায় কোনও পাপের চিহ্ন নেই, কিন্তু তাকে নিদারুণ পরিশ্রান্ত দেখায়।
রিনি এই দৃশ্যটা দেখল বার বার। কাল রাতে ঘুম থেকে উঠে সে সঞ্জয়কে দরজা খুলে দিয়েছিল। দেখেছিল হাসিমুখে সঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, হাতে সুটকেস।
ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল, পিকলু কই?
পিকলু! পিকলুকে কি সঞ্জয়ের মনে ছিল?
সুটকেস মেঝেয় রেখে মশারি তুলে আধখানা শরীর ভিতরে ঢুকিয়ে ঘুমন্ত পিকলুকে ‘বাবা সোনা’ এই সব বলে আদর করেছিল সঞ্জয়। ঠিক বাবাদের মতোই, আদেখলেপনায়।
সম্ভবত সেটা ছিল রিনির মুখোমুখি হওয়ার অস্বস্তি থেকে পলায়ন। নইলে পিকলুকে কখনও হাত-মুখ না ধুয়ে আদর করে না সে।
কিন্তু রিনি জানে, এ-অস্বস্তিটকু চিরকাল থাকবে না সঞ্জয়ের। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সঞ্জয় বাইরে মদ খেলে কড়া জর্দা দেওয়া পান খেয়ে আসত। তবু টের পেত রিনি! টের না পাওয়ার ভান করত। ক্রমে ক্রমে সাহসী হতে হতে সঞ্জয়ের হুইস্কির বোতল আজকাল খাওয়ার ঘরের ফ্রিজেই মজুত থাকে।
ঠিক সেই রকম দিঘা বেড়ানোর ব্যাপারটাও একদিন সঞ্জয় প্রকাশ্যে করবে; রিনির মুখোমুখি দাঁড়াবে নিঃসংকোচে সরল গাছের মত। সেদিনের কথা ভাবলে রিনির ভয় করে।
কাল রাতে যে সঞ্জয় আসবে তার খবর আগে দেয়নি। ফলে খাবার ছিল না।
সঞ্জয় মুখে বলল, খেয়ে এসেছি।
কিন্তু বস্তুত অতিরিক্ত উন্মাদনায় তার খাওয়ার কথা মনেই ছিল না। তার মুখ-চোখ সেই সাক্ষ্য দিচ্ছিল।
রিনি কথা না বলে রুটি টোস্ট করেছে, ডিম ভেজেছে, তৈরি করেছে কফি। সঞ্জয়ের খাওয়ার সময়ে মুখোমুখি বসে লক্ষ করেছে তার মুখ। সমুদ্রের আবহাওয়ায় থাকার ফলে তাকে একটু কালো দেখাচ্ছিল।
রিনি কেঁদেছিল সঞ্জয় ঘুমোনোর পর।
সকাল থেকে ঘুরে ফিরে রিনি আসছে শোওয়ার ঘরে। অকারণে সঞ্জয়ের মাথার নীচে বালিশ ঠিক করেছে। পিকলুকে বিছানা পেতে শুইয়েছে খাওয়ার ঘরে ডাইনিং টেবিলের ওপর। পাছে তার চেঁচামেচিতে সঞ্জয়ের ঘুম ভেঙে যায়।
পিকলু এখন হামা টানে। টলমলে পায়ে কখনও দাঁড়ায়। তারপর ঝুপ করে বসে পড়ে। পাছে সে পড়ে যায় সেই ভয়ে শোওয়ার ঘর থেকে বারবার খাওয়ার ঘরে যাচ্ছিল রিনি।
এইভাবে সারা সকাল সে হাঁটছে। খাওয়ার ঘর থেকে শোওয়ার ঘর, আবার খাওয়ার ঘর। রিনি কোনও শারীরিক অনুভূতি টের পাচ্ছিল না। সকাল থেকে সে কিছুই খায়নি। কিন্তু তার খিদে পাচ্ছিল না, তেষ্টা পাচ্ছিল না। দুই ঘরে যাতায়াতে সে বোধ হয় মাইলখানেক হেঁটে ফেলল।
বেলা ন’টা নাগাদ টেলিফোন বেজে উঠতেই বুকের ভিতরে দুর দুর করে উঠল তার। দম বন্ধ হয়ে এল প্রায়। আজ সকালে সে এই প্রথম নিজের শরীর টের পেল।
কে?
আমি সেই লোক। সঞ্জয়বাবু ফিরেছেন?
লোকটা কোনও দিনই নিজের নাম বলে না। কিন্তু গলাটা এখন চেনা হয়ে গেছে রিনির।
ফিরেছেন। রিনি কাঁপা গলায় বলে। প্রথম প্রথম টেলিফোন রেখে দিত রিনি। কিন্তু আজকাল রাখে না। লোকটা সঞ্জয়ের নানা খবর দেয় তাকে। এই রকমভাবেই লোকটার সঙ্গে বোঝাপড়া এবং অদ্ভুত বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে রিনির। সম্ভবত লোকটা সেই মেয়েটাকে ভালবাসে।
লোকটা কী যেন ভাবে। তারপর বলে, আপনি ওঁকে কিছু বলেননি?
কী বলব।
বলা উচিত। নইলে এরকম হতে থাকবে। আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।
রিনি চুপ করে থাকে।
লোকটা আত্মগতভাবে বলে, মেয়েটা এত সস্তা ছিল না বুঝলেন? কী করে যে ও এতটা বোকামি করতে পারে! মানুষ কী রকম পালটায়!
রিনি চুপ।
লোকটা আস্তে করে বলল, আমি আজ সঞ্জয়বাবুর সঙ্গে তাঁর অফিসে দেখা করব। যদি উনি কথা শুনতে না চান তবে—
লোকটা এইটুকু বলে ইতস্তত করলে রিনি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে, তবে কী করবেন?
কিছু একটা করব। সামথিং হার্শ। আমার অনেক বন্ধু আছে। মেয়েটিকে বাঁচানো দরকার, আপনাকেও।
টেলিফোন রেখে দিয়ে রিনি আবার ঘুরতে থাকে। খাওয়ার ঘর থেকে শোওয়ার ঘর, আবার খাওয়ার ঘর।
সঞ্জয় চোখ মেলে তাকিয়ে সকালের ঝলসানো রোদ দেখে চোখ মিটমিট করে। অভ্যাসবশত ঘুম-চোখে হাত বাড়ায় রিনির জন্য। পায় না। পাশ ফিরে শূন্য বিছানাটা দেখে। সাদা এবং প্রকাণ্ড বিছানা। রিনি কোথায়! কেটে পড়ল নাকি? সঞ্জয় চমকে ওঠে।
ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে সে রিনিকে দেখে, এ-ঘর থেকে শ্লথ পায়ে ও-ঘরের পরদার আড়ালে চলে গেল।
শুয়ে থেকেই একটা সিগারেট ধরায় সঞ্জয়। সকালের এত স্পষ্ট আলো তার সহ্য হয় না। এত স্পষ্টতা তার অসহ্য লাগে। তার মনে হয় এর পর থেকে সারা জীবন দিনের চেয়ে রাতটাই তার বেশি ভাল লাগবে।
দিঘা থেকে ফেরার পরদিন সঞ্জয় গাড়িটা গ্যারেজে পাঠিয়েছিল ধোয়ামোছা আর মেরামতের জন্য। বিকেলের দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি না পেয়ে হেঁটেছিল অনেক দূর। টের পায়নি যে তাকে অনুসরণ করছে কয়েকজন লোক— যাদের চেহারা কালো, রোগা, কিন্তু মজবুত, যাদের দেখলেই পেশাদার গুন্ডা বলে চেনা যায়।
একটু অন্যমনস্ক ছিল সঞ্জয়। অনিমার ভক্তদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল যে ছেলেটি সেই শুভময় ঘোষাল তার অফিসে এসেছিল সেদিন। ছেলেটি মোটাসোটা গোলগাল, সঞ্জয় শুনেছে ছেলেটা নাকি ভাল রবীন্দ্রসংগীত গায়। ছেলেটি সঞ্জয়ের মুখোমুখি হয়ে একটুও না ঘাবড়ে বলল, আপনি দু’টি মেয়ের সর্বনাশ করছেন। এক নম্বর, অনিমা, আর দু’নম্বর রিনি— আপনার স্ত্রী।
এ-সব শান্তভাবে শুনল সঞ্জয়। বেয়ারাকে ডেকে দু’ কাপ কফি আনতে বলল। বাড়িয়ে ধরল সিগারেটের প্যাকেট। ছেলেটাও শান্তভাবে সিগারেট নিল, কফি খেল। কিন্তু সোজা চোখে চোখ রেখে যা বলার তা বলতে ছাড়ল না। পুরনো ধরনের নীতিকথাই বলল বেশি। চরিত্র, সতীত্ব, সমাজ— এই সব নিয়ে যত দূর বলা যায়। ছেলেটি অনিমাকে ভালবাসে। গোলগাল নাদুসনুদুস চেহারার কোনও ছেলেকে এ-রকম শীতল এবং শান্তভাবে রেগে যেতে কখনও দেখেনি সঞ্জয়।
শুভময়ের সঙ্গে একটু কথার খেলা খেলতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। তাই কথার এক ফাঁকে হঠাৎ বলেছিল, অনিমার জন্য আমার কাছে আরও কয়েকজন এসেছিল। ডিজায়রেবল ক্যান্ডিডেটস।
ডাহা মিথ্যে। কিন্তু ছেলেটি এই প্রথম সামান্য লাল হয়ে গেল।
সঞ্জয় হঠাৎ টেবিলের ওপর ঝুঁকে বলল, অনিমা কীরকম মেয়ে তা তো আপনি জানেন বোধ হয়। আপনি শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে, ওকে নিয়ে সামলে রাখতে পারবেন না। চান্স পেলেই ও দড়ি ছিঁড়বে, খোঁটা ওপড়াবে। আমি পাকা লোক, তবু আমিই সামলাতে পারছি না।
সঞ্জয় ছেলেটির গোল মুখে কোনও ভাবপরিবর্তন টের পেল না। কিন্তু ওর মুখে রক্তিমাভাটা লেগেই ছিল।
সঞ্জয় হঠাৎ যেন বে-খেয়ালে তার চেক-বইটা বের করে ফয়েলগুলো শুভময়কে দেখিয়ে বলল, চার দিনে আমরা খরচ করেছি হাজার দেড়েক টাকা। এই দেখুন।
শুভময় ইঞ্জিনিয়ার। সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। সম্ভবত সে বড়লোকের ছেলে নয় এবং বাড়িতে পুষ্যিও অনেক। সম্ভবত হাজার খানেকের বেশি মাইনে সে এখনও পায় না। তাই চার দিনে দেড় হাজার টাকা খরচের কথায় সে একটু ভ্রূ তুলল।
তারপর আস্তে করে বলল, বাঙালি মেয়েরা আজকাল কত দূর অধঃপতনে গেছে!
বলে সে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, আপনার স্ত্রীকে আমিই বেনামে ফোন করতাম। আজ সকালেও করেছি।
খুশি হল সঞ্জয়। বলল, আবার করবেন। যখন খুশি। ও খুব একা একা বোধ করে। ফোন করলে খুশি হবে।
এটাও কথার খেলা। ছেলেটার নীতিবোধ বড় প্রবল। সেইখানেই বোধ হয় আঘাতটা লাগল। শীতল চোখে নীরবতায় সঞ্জয়কে একটু দেখে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
অফিসে যতক্ষণ ছিল সঞ্জয় তারপর, ততক্ষণ সে মৃদু একটা অস্বস্তি বোধ করেছে। কোনও কারণ নেই তবু কেবলই সে একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল।
অন্যমনস্ক সঞ্জয় ‘বার’-এ একটু সময় কাটিয়েছিল বিকেলে। তারপর এসপ্ল্যানেডের ভিড় ঠেলে মেট্রোর সামনে দাঁড়াল ট্যাক্সির জন্য। কী ভেবে রাস্তা পার হয়ে গেল গোলঘরের পেচ্ছাপখানার দিকে। আবার বেরিয়ে এসে প্যান্টের বোতাম এঁটে গাছের তলায় ঝুপসি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যখন সিগারেট ধরাচ্ছিল তখন গোটা চারেক লোক নিঃশব্দে ঘিরে দাঁড়াল তাকে। চারজন পেশাদার লোক।
কাজটা অবশ্য তাদের পক্ষে সহজ হয়নি। সঞ্জয় প্রথম চোটে দু’জনকে নিয়ে নিয়েছিল। একজনের তলপেটে একটা লাথিও জমিয়ে দিয়েছিল সে। এরা কারা, এবং কেন তাকে মারছে তা ভাববার চেষ্টাও করেনি সে। কেবল লাথিটা মেরে সে আদিত্যর লাথিটার শোধ নেওয়ার এক অদ্ভুত আনন্দ বোধ করেছিল।
কিন্তু লোকগুলো ছিল পেশাদার। মার খাওয়া তাদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। কাজেই সঞ্জয়ের ঘুসি লাথি তারা তৃণজ্ঞান করে খুব চটপট সেই প্রকাশ্য জায়গায় তাদের কাজ সারল। চার পাশ থেকে ঘিরে, অভ্যস্ত সুন্দর হাতে।
পেটে সামান্য মদ ছিল সঞ্জয়ের। ফলে সে ওদের হাত আর পায়ের কাজ বুঝতেই পারল না। ঢলে পড়ল লোহার রেলিঙের তলায়, সিমেন্টের বাঁধানো গোড়ায় মাথা রেখে শুয়ে বমি করতে লাগল।
একসময় এ-সব ঘটনা ছিল তার গায়ের ধুলো। চট করে ঝেড়ে ফেলতে পারত। কিন্তু এবার তা হল না। কয়েক দিন ঘরে শুয়ে-বসে থাকতে হল তাকে। ডাক্তার দেখাতে হল। ওষুধ খেতে হল। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, ব্লাডপ্রেশার খুব হাই।
ইয়াঃ। সঞ্জয় শুয়ে থেকে সারা দিন আপনমনে হাসে। মনে মনে রিনিকে সম্বোধন করে কথা বলে, এই সবই বয়সের ব্যাপার, বঝলে রিনি। বয়স হয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি মানুষের জীবনে আর নেই। কে আমাকে মেরেছে আমি তার কী জানি। কেন মেরেছে তাই বা কে জানে। কিন্তু এ-কথা ঠিক, বয়সের শেষ ঢলে মানুষের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হয়। খুব শান্তভাবেই মানুষের তা গ্রহণ করার কথা। আমি তো আর খুব সুন্দর জীবনযাপন করিনি!
আমি এখনও সন্ন্যাসী হওয়ার কথা ভুলিনি। বাইরে এই যে আমাকে দেখছ, সদ্ গুন ঝরে-যাওয়া লোক, চুরি করছে, টাকা জমাচ্ছে, করছে অবৈধ প্রেম, মদ খাচ্ছে— এ-সব কিছু আমার অন্তরের সেই বৈরাগ্যকে স্পর্শও করছে না। একদিন-না-একদিন সেই বৈরাগ্য সব ফেলে রেখে চলে যাবে।
কিন্তু যাওয়া হয় না।
মাঝে মাঝে আজকাল রাতে তার ঘুম আসে না। অনেকটা হুইস্কি খাওয়ার পরেও না।
কখনও নানা কাজে ব্যস্ত সঞ্জয় হঠাৎ গলার কাছে হাত তুলে একটা মাংসের ডেলাকে অনুভব করে। লাম্প। চমকে উঠে ভাবে, ক্যান্সার-ফ্যান্সার হবে না তো! কখনও বা শোওয়ার দোষে ঘুমের মধ্যে তার শ্বাসকষ্ট হয়। অমনি তড়বড় করে উঠে বসে। ভাবে, শরীরের মধ্যে কোথাও রক্ত জমাট বাঁধছে না তো! যদি থ্রম্বসিস হয়!
কখনও বা সে ঘুম-চোখে অকারণে রিনিকে ডাকে।
রিনি!
উঁ! রিনি ঘুমগলায় উত্তর দেয়।
রিনি! আবার ডাকে।
উঁ!
রিনি!
উঁ!
তখন পাশ ফিরে রিনির কানে কানে বলে, আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি। পিকলুকেও। ঘর সংসার টাকা সব কিছুকেই। তবে আর কবে আমি সন্ন্যাসী হব!
রিনি এ-সব কথা বিশ্বাস করে না। চুপ করে থাকে। আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
সঞ্জয়ের কেমন যেন ফাঁকা লাগে বুক। আড়াল থেকে কে যেন তাকে এই সব মিথ্যে রঙিন কথা বলায়। অকারণে। সে রমেন হবে না। সে কোনও দিন রমেন হবে না।