যে ঐ দেশেতে মরি
ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষ শাস্ত্ৰ অনুসারে প্রবাস হলো মৃত্যুর মতো; ভয়ানক। কিন্তু এখন শিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত বাঙালিরা একটা গানের যে-লাইনটা বারবার গাইতে চান, সেটা হলো: “আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন ঐ দেশেতে মরি।” সবকিছুর বিনিময়ে ছোটোবড়ো প্ৰায় সবাই দেশত্যাগ করে “ফরেইনে” যেতে চান এবং সেখানেই বাকি জীবন সুখে থাকতে চান। এই দোষে আমিও দোষী। তার জন্যে প্ৰায়শ্চিত্তও করতে হয় নিত্যদিন। যারা দেশে আছেন, তাঁরা যে কতো সুখে আছেন, সেটা অনুভব করতে পারবেন। একমাত্র বিদেশে থাকার কষ্ট হাড়ে-হাড়ে টের পেলে, তার আগে পর্যন্ত নয়। যে-ভদ্রমহিলারা দেশে জীবনেও নিজের হাতে রান্না করেননি, ঘর পরিষ্কার করেননি, বরং সময় কাটানোর সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন, তারা, কী আশ্চর্য, প্রবাসে মরার ফুরসূত পান না। তাদের সোনার হাতে সোনার কাকন কনকন করে না। তার বদলে পেতলের খুন্তি খনূখন করে। হাতে বারবার ক্রীম লাগানো সত্ত্বেও তাদের সুন্দর হাতের পর্শে দেহমনে রোমাঞ্চ লাগে না, বরং কুলিদের মতো কঠিন হাতের খরখরে স্পর্শে শরীর শিউরে ওঠে।
স্বামীরাও মহারাজ সেজে বসার-ঘরে সোফায় বসে হুকুম দেন না, অথবা দিতে পারেন না। মনুষ্যত্ব থাকলে তাঁরা স্ত্রীর সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মনুষ্যত্ব নাথাকলে স্ত্রীর শাপে ভস্মীভূত হন। দেশে থাকলে যে-সাহেবরা কেবল বন্ধুদের সঙ্গে পরনিন্দা করে আর টিভি দেখে সময় কাটাতেন, সেই প্রবাসী সাহেবরাই অনেকে নিজ হাতে রান্না করেন। তরকারি কুটে দেন। থালা-বাসন ধুয়ে দেন। খাবার দেন। টেবিলে। কাপড় ধোয়ায় এবং সে কাপড় বাইরে নেড়ে দেওয়ায় সাহায্য করেন। কাপড় শুকালে ইস্তিরি করেন। তা ছাড়া, সপ্তাহে অন্তত একদিন ঘর ঝাড়ু দেন। হ্যাঁ, এখানে ভ্যাকুয়াম ক্লীনার আছে, ঠিকই, কিন্তু সেই ভ্যাকুয়াম ক্লীনার ঠেলে-ঠেলে ঘর পরিষ্কার করতে বেশি কষ্ট, নাকি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা বেশি কষ্টের, সেটা ভুক্তভোগীর কাছে বিতর্কের বিষয়। ঘরের আবর্জনা বিনব্যাগে ভরে তার মুখ বন্ধ করে বাইরে রেখে আসা ইত্যাদিও করতে হয় নিয়মিতভাবে। টয়লেট সাফ করা, এমন কি, কমোড পরিষ্কার করার জন্যে বাইরে থেকে সুইপার আসে না। হয়। সাহেবকে, নয়, বিবি-সাহেবকেই করতে হয়।
হঠাৎ পানির ট্যাপ নষ্ট হলে কে সারবে সেটা? প্লাম্বার ডাকলে নিদেন পক্ষে ষাটসত্তর পাউন্ড লাগে। একটা আলো জ্বলছে না–লাইন খারাপ হওয়ায়। সেটা মেরামত করতে গেলে এক শো পাউন্ডও লাগতে পারে। কাল ড্রেইন আটকে গিয়েছিলো। সেটা কে পরিষ্কার করলো? আগামী কাল দরজার একটু কজা খুলে গেলে সেটা কে মেরামত করবে? এ রকমের তাবৎ কাজ নিজেদেরই করতে হয়। সে জন্যে নিতান্ত আনাড়ি না-হলে প্ৰত্যেক সাহেবেরই একটা ডি. আই. ওয়াই-এর বাক্সো থাকে। ডি. আই. ওয়াই, মানে ডু ইট ইওরসেলফ। নিজে করার বাক্সো। তাতে থাকে মিস্তিরিাগিরি, প্লান্বিং, ইলেকট্রিকের কাজ থেকে আরম্ভ করে সব ধরনের কাজ করার মতো যন্ত্রপাতি। বইও পাওয়া যায়। এসব কী করে করতে হয়, তার সবক নেওয়ার জন্যে। এসব বইয়ে সচিত্র উপদেশ দেওয়া থাকে।
ঘরের কাজ ছাড়া, বাইরেরও কাজ থাকে। বাগানের ঘাস কাটা, সেই ঘাস বস্তায় বন্দী করে বাইরের বিনে রেখে আসা, বাগানে ফুলের গাছ থাকলে পানি দেওয়া-সহ তার পরিচর্যা করা, গাড়ি ধোয়া, বাড়ির সামনের রাস্তা পরিষ্কার করা, বরফ পড়লে সেই বরফ কোদাল দিয়ে সরিয়ে ফেলা–এসবই আপনার নিজেকেই করতে হবে। সাহায্য করার কেউ নেই। তাই করতে হবে একদিন নয়, প্রতিদিন।
তা ছাড়া আছে টাকা কামাই করার জন্যে চাকরি করা। দেশ থেকে উচ্চডিগ্রি নিয়ে এসে বিদেশে অড জব–তার মানে–ছোটোখাটো কাজ অনেকেই করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি ডিগ্রিওয়ালা একজন শিক্ষক অনেক বছর লন্ডনের পাতাল রেল চালিয়েছেন। কাজটা আন্দেী অপমানজনক নয়। বেতনও ভালো। কিন্তু ভদ্রলোক যে-বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, সে বিদ্যা আর কাজে লাগাতে পারলেন না।
বেশির ভাগ স্ত্রীদেরও চাকরি করতে হয়। কারণ অনেক সময় স্বামী এমন আয় করেন না, যা-দিয়ে স্বচ্ছন্দে অথবা সসম্মানে বেঁচে থাকা যায়। সুতরাং বেগম সাহেবকে এগিয়ে আসতে হয়। বেচারা স্বামীকে সাহায্য করার জন্যে। তা ছাড়া, পাশের বাসায় ভাবীরা থাকেন না। সুতরাং আডিডা দিয়ে সময় কাটানোর উপায় নেই। আপনজনদের থেকে দূরে একাকী ঘরের মধ্যে বসে টিভি দেখে কতো আর সময় কাটানো যায়। অনেক বিবি সাহেব তাই জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্যেই একটা কাজ জুটিয়ে নেন, যদি করার মতো যোগ্যতা থাকে। স্থানীয় ভাষায় দক্ষতা না-থাকলে কাজও জোটানো যায় না। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এ রকমের অনেক ভদ্রমহিলা তাই বাড়িতে বসে কোনো কম্পোনির জন্যে কাপড়-জামা সেলাই করেন। বাঙালি মহিলারা কেউ কেউ খাবার রান্না করেও দোকানে সরবরাহ করেন। অনুমান করি, এসব বাড়িতে খাওয়ার কোনো দরকার হয় না। কারণ ঘাণে যদি কেবল সিকিভোজনও হয়, তা হলেও এতো খাবারের সুগন্ধে পেট ফুলে ঢেকুর ওঠার কথা। তা ছাড়া, আর-একটা সুবিধে আছে–এসব বাড়িতে চুরি হতে পারে না। কারণ বাড়ির ধারে-কাছে এলেও দুর্গন্ধে দৌড়ে পালানোর পথ পাবে না চোর বেচারা। যারা অফিসের কাজ পান, তাদের কাজটাও খুব সহজ নয়। কারণ, কাজ মানে কেবল অফিসে যাওয়া নয়। অফিসে গিয়ে আর্দালিকে চা নিয়ে আসার আদেশ দেওয়াও নয়। আর্দালি বলে কিছু থাকে না। এ বিদেশে। কাজে কাজেই সাহেবই আর্দালি, আর্দালিই সাহেব। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ–এ দেশে কাজ মানে কাজ, ফাঁকিবাজি নয় মোটেই। সুতরাং কাজ করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠলে অবাক হতে পারেন, কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারেন না। দেশে কাজের একটা ইনসেন্টিভ থাকেউপরি পাওনা। প্রবাসেও উপরি পাওয়া থাকে, তবে কর্মস্থানে নয়, বাড়িতে। বাড়িতে এসে সেই উপরি পাওনা উপভোগ অথবা ভোগ করতে হয়–আপনি যেভাবে নেন, তার ওপরে নির্ভর করে। হ্যাঁ, সারাদিন বাইরে কাজ করে এসে আবার সন্ধ্যায় বাড়িতে উপরি কাজ করতে হয়। অফিসের কাজ সবেতনে, বাড়ির কাজ বেঁচে থাকার জন্যে, বিনা বেতনে।
এসব সত্ত্বেও, ফরেইন বলে কথা! ফরেইনে থাকাটা এমন যোগ্যতা যে, আপনি বৃদ্ধ হলেও দেশে গিয়ে তরুণী ভার্য জোটাতে পারবেন। তা ছাড়া, দেশে আসার পথে তীর্থটাও সেরে আসতে পারবেন। তার মানে আপনার ইহকাল এবং পরকাল–উভয় কালেই ভাগ্যে আছে স্বগীয় অল্পীরা–যদি কিনা একবার ফরেইনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। তাই, দোহাই, হতাশ হবেন না, আদম-ব্যাপারীর সঙ্গে যোগাযোগটা বজায় রাখবেন, প্লীজ!
(যুগান্তর, ২০০৬)