বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ইন্দ্রাণী দণ্ড চৌধুরীর দিকে নজর পড়েছে তাঁর বিভাগীয় প্রধানের। আমরা জানি পুরুষের নজর যখন পড়ে কোনও মেয়ের ওপর, কী হয়। ইন্দ্রাণীর দিকে সকাল সন্ধ্যে যৌনগন্ধময় বাক্য ছুড়ে দিতে লাগলেন তীর্থংকর দাস পুরকায়স্থ। নির্ভয়ে এবং নির্ভাবনায় এই কাজ তিনি করেন, তাঁকে নিরস্ত করে, সাধ্য কার! ইন্দ্রাণীকে যে ইশারাই বা যে ইঙ্গিতই করেন তীর্থংকর, ব্যর্থ হন। যত ব্যর্থ হন, তত তিনি ব্যাঘ্র হন। ভেতরে বাইরে গর্জন করেন। সব জেনে বুঝেও লোকে শেষ অবধি ইন্দ্রাণীকে দোষ দেয়। যেহেতু মেয়েদের দোষ দেওয়া খুব সহজ এবং এই সংস্কৃতিটি খুব জনপ্রিয়, লোকে ধর্ষককে দোষ না দিয়ে যেমন ধর্ষিতাকে দেয়, ধর্ষিতার পোশাক বা চাহনি বা চালচলন নাকি ইন্ধন জুগিয়েছিল ধর্ষণ করতে। এও ঠিক তেমন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষকে তীর্থংকরের আচরণ নিয়ে অভিযোগ করেছেন ইন্দ্রাণী। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। উপাধ্যক্ষ নিজে পুরুষ। পুরুষেরা সাধারণত পুরুষের পক্ষই নেয় বিপদ দেখলে। কারণ পুরুষের চরিত্র তো পুরুষ চেনে। রতনে রতন যেমন চেনে। এক রতন ফাঁদে পড়লে আরেক রতন যদি না বাঁচায় তবে সেই রতনকে বিপদে বাঁচাবার জন্য এই রতন তো এগোবে না। অলিখিত একটি চুক্তি এদের মধ্যে থাকেই যে পরস্পরের প্রয়োজনে এরা এগিয়ে আসবে এবং এগিয়ে আসে বলেই আজ রতনে জগত ভরে গেছে। রতনদের ভিড়ে মেয়েরা পথ চলতে পারছে না। চলতে গেলেই ধাত্তা খাচ্ছে, পিছলে পড়ছে।
ইন্দ্রাণী যেহেতু সাড়া দেননি তীর্থংকরের প্রস্তাবে, শুধু তাই নয়, গোপনে কী কী বলেছেন এবং করেছেন, তা রাষ্ট্র করে দিয়েছেন, সেহেতু রেগে আগুন হয়ে আছেন তীর্থংকর। প্রচার করার চেষ্টা করছেন যে তাঁর জন্য দুর্দম্য আকর্ষণ ইন্দ্রাণীরই ছিল, ইন্দ্রাণীই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এইসব মিথ্যে প্রচারের কাছে হেরে যাওয়ার মেয়ে ইন্দ্রাণী নন। তিনি অপমান মেনে নেবেন না বলে পণ করেছেন। তীর্থংকর গোষ্ঠী আশা করেছিলেন যে চরিত্র ইেচ্ছেমতো কালি কলঙ্ক লেপন করলে ইন্দ্রাণী এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতে বাধ্য হবেন। আপদ বিদেয় হবে। এ শুধু আশায় বসতি। ইন্দ্রাণী বিশ্ববিদ্যালয় পাল্টাবেন না, আরও এই জন্য পাল্টাবেন না যে তিনি অপরাধ করেননি, অপরাধ করেছেন তীর্থংকর। মাথা নত করে যদি কাউকে বিদেয় নিতে হয়, নেবেন তীর্থংকর, ইন্দ্রাণী কেন! আর পিছু হঠলে দুষ্টু লোকের দেওয়া অপবাদকে সত্যি বলে মনে হবে, নিজের স্বস্তি বলে যে জিনিসটির প্রয়োজন খুব, সেটিও তো থাকবে না! পিছু হঠার কোনও কারণ ইন্দ্রাণীর নেই, কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তিনি কোনও অপরাধ করেননি। সুতরাং মাথা উঁচু করে ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়ে আছেন, এবং অপরাধীর শাস্তি দাবি করছেন।
নারীর বিরুদ্ধে নিগ্রহ নির্যাতনকে, নিরন্তর যৌন হেনস্থাকে এখনও অন্যায় ভাবতে বেশির ভাগ মানুষই পারে না। কারণ সমাজে এসব যেমন নিত্য নৈমিঙ্গিক ঘটনা, তেমনই গা সওয়া, সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকে ভাবছেন, তীর্থংকর তো আর ইন্দ্রাণীকে ধর্ষণ করেননি বা ধর্ষণের কোনও চেষ্টাও করেননি, তবে ইন্দ্রাণী কেন শাস্তি দিতে চাইছেন তাঁকে। শাস্তি দিতে চাইছেন এটা বোঝাতে যে ‘মেয়েরা ইয়ার্কি ফাজলামির জিনিস নয়।’ মেয়ে দেখলেই যৌনগন্ধযুক্ত কথা বলার অধিকার পুরুষেরা মনে করে তাদের আছে, কিন্তু তাদের নেই। তারা ইচ্ছে করলেই মেয়েদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে না।
সমাজ প্রচণ্ডভাবে পুরুষতান্ত্রিক হওয়া সঙ্গে্েবও সামান্য সভ্যতার আইন কানুন ইদানীং যা আমদানি হচ্ছে, তাতে অপকর্মের জন্য পুরুষের শাস্তি পাওয়ার একটি ব্যবস্থা, খুব আশার কথা যে, হচ্ছে। যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে আইন ভারতবর্ষে আছে, পুরুষেরা জানলেও বেশির ভাগ মেয়েই এ কথা জানে না। জানলেও নীরবে লজ্জাবনত মুখে সয়ে যায় সব রকম লাঞ্ছনা। ঘুরে দাঁড়াতে পারে ক’জন?
ইন্দ্রাণী দাঁড়িয়েছেন। তীর্থংকরের বিরুদ্ধে তিনি যে মামলা করেছেন, তা আমি একশ ভাগ সমর্থন করি। প্রতিটি মেয়েরই ইন্দ্রাণীর মতো নিজের ব্যক্তিত্ব এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা উচিত। মেয়ে দেখলেই যে পুরুষেরা টিকাটিপ্পনি করে, অশ্লীলতা করে, তাদের ধর্ষণ করার দরকার হয় না, ধর্ষণের স্বাদ তারা এসব থেকেই নেয়। তাদের অপরাধকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে মেয়েরা বহুকাল দেখে আসছে। এবং এভাবেই তারা পুরুষকে আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলেছে। পুরুষ এখন মনে করে মেয়েদের সঙ্গে বদমাইশি করা তাদের জন্মগত অধিকার। নির্বোধ মেয়েরাও আদুরে গলায় বলে, ‘পুরুষ তো, একটু ওরকম তো হবেই। ওদের তো ইয়েটা বেশি।’ ইয়েটা কী টা? যদি জিজ্ঞেস করি, বলবে, ‘ওই সঙ্গেটা।’
এ কথা এক ফোঁটা সত্য নয়। নারী পুরুষের মধ্যে যৌন তাড়নার কোনও কম- বেশি নেই। যদি থাকে, সে মেয়েদের। শরীর-বিজ্ঞান মতে মাল্টিঅরগাজম পাওয়ার মেয়েদেরই আছে। কিন্তু পুরুষদের বদমাইশি করার ইয়েটা আবার এ সমাজে বেশি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ‘এই ইয়েটা আবার কী?’ খুব সোজা উত্তর, ‘সুযোগটা’। সমাজটা পুরুষ শাসিত। এই সমাজে পুরুষরা বদমাইশি করার সুযোগ পাবে না তো কি মেয়েরা পাবে? এই বদমাইশি পুরুষরা তাদের সঙ্গে করছে, যাদের সঙ্গে তাদের বাস করতে হয়, যাদের ছাড়া তাদের চলে না। এক বাড়িতে, এক অফিসে, এক পথে, এক ট্রেনে যাদের সঙ্গে চলতে হয়, তাদের সঙ্গেই করছে। এখানে আসলে পুরুষেরা কোনও ব্যক্তির সঙ্গে ইয়ার্কি করছে না, জাতটার সঙ্গে করছে। মেয়েজাতটার সঙ্গে। কারণ এই জাতটা সম্পর্কে তাদের ধারণা এই, যে, ‘এই জাতটাকে যাঁতা যায় কারণ এই জাতটা যা তা। জাতটা কলজ্ঞের ভয়ে কাঁপে আর কথায় কথায় কাঁদে। জাতটা জীবনভর মার খায়, যার মার খায় তারই গুণ গায়। জাতটা আসলে কোনও জাতের না।’
ইন্দ্রাণীকে দেখে, যেহেতু ইন্দ্রাণী মেয়ে, মেয়েদের সম্পর্কে মস্তিষ্কে যে ধারণা বাসা বেঁধে আছে তীর্থংকরের , সেটি স্বাভাবিকভাবেই সুড়সুড় করে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে যখন আসে, তখন ইন্দ্রাণী দণ্ড চৌধুরী তীর্থংকর দাস পুরকায়স্থের সহকর্মী নন, আগাগোড়া কেবলই তিনি মেয়ে। সমাজ যেরকম ভাবে, সেরকমই, ‘এক শরীর মাংস আর এক মাথা আবর্জনা।’
এই ধারণা গভীরে বলেই অত সহজে তীর্থংকর পেরেছেন ইন্দ্রাণীকে অপমান করতে। তিনি জানেন যে, অপমানের জবাব একটি পুরুষ হলে দিতে পারে, মেয়ের দেবার ক্ষমতা নেই। সুতরাং অসুবিধে কী! তাছাড়া অপমানিত পুরুষের পক্ষে মানুষ দাঁড়ায়, অপমানিত মেয়ের পক্ষে নয়। কারণ মেয়েরা অপমানিত আর পদদলিত হতে জন্মেছে বলেই সবার বিশ্বাস। মেয়েরা অপমানের শোধ নিতে চাইলে ‘শুভাকাঙ্ক্ষীরা’ চিরকালই একে বাড়াবাড়ি বলে বিবেচনা করেছে, প্রতিবাদে প্রেরণা দেওয়ার বদলে পিছিয়ে থাকতে বলেছে। মেয়েদের নাকি মানায় না গলা চড়ানো, চোখ রাঙানো, তেজ দেখানো। বাহ, পুরুষের জন্য এর চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা আর কীই বা হতে পারে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষকে ইন্ধন জোগায় নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে মেয়েদের যৌন হেনস্থা করে যেতে।
মেয়েদের বিচক্ষণতা, দক্ষতা, মেধা, প্রতিভা—এসবের আজও কোনও দাম নেই। একটি মেয়ে মালি হলেও মেয়ে, মালিক হলেও মেয়ে। সুপার থেকে সুইপার অবধি তার শরীর নিয়ে মজা করে। পুরুষের শ্রেণী আছে। উঁচু শ্রেণী, নিচু শ্রেণী। পুরুষের জাত আছে। উঁচুজাত নিচুজাত। মেয়েদের কোনও শ্রেণী নেই। কোনও জাত নেই। একটিই শ্রেণী তাদের, একটিই বর্ণ। মেয়েবর্ণ। মেয়েজাত। উঁচুশ্রেণী বলে বা উঁচু জাত বলে বা শিক্ষিত বলে, বা স্বনির্ভর বলে, বা প্রতিভাবান বলে মেয়েদের ক্ষমা নেই। এই পুরুষতন্ত্রে সব মেয়েই সমান। সব মেয়েই ‘মাল’, সব মেয়েই ‘ইয়ার্কি মারার জিনিস’।
সমাজের সর্বত্র থিকথিক করছে তীর্থংকরে। যদি মেয়েরা সব ইন্দ্রাণী হত, মেনে না নিত অপমান! যদি মাথা না নোয়াতো। যদি আত্মবিশ্বাস থাকতো তাদের, ইন্দ্রাণীর যেমন আছে! যদি বদ পুরুষদের ক্ষমা না করতো, পাছে লোকে কিছু বলের ভয় যদি না থাকতো! পৃথিবী বদলে যেত।